ইসলামি আকিদা ও নবপ্রকৃতি (⮫)


 ইসলামি আকিদা ও নবপ্রকৃতি

العقيدة الإسلامية والفطرة الإنسانية

 সূচিপত্র

 সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............

‘ইসলামি আকিদা ও মানবপ্রকৃতি’ নামক গ্রন্থে কুরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামি আকিদার বৈশিষ্ট্য, মানবপ্রকৃতির সাথে ইসলামি আকিদার সামঞ্জস্যতা, ইসলামি আকিদার মৌলিক বিষয়াবলি গবেষণাধর্মী আলোচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।


 ইসলামি আকিদা ও মানবপ্রকৃতি

প্রবন্ধের সূচনায় কয়েকটি বিষয় খুব গভীর যত্নসহকারে আলোচনার দাবি রাখে। যথা: ১. মানব। ২. প্রকৃতি। ৩. মানব প্রকৃতি। ৪. ইসলাম। ৫. আকিদা। ৬. ইসলামি আকিদা।

 ১. মানব বা মানুষ:

দু’টি জিনিসের সমন্বিত বস্তুর নাম।

এক. শরীর, অবয়ব, বা কায়া।

দুই. আত্মা। অর্থাৎ দেহে ব্যাপৃত চৈতন্যময় সত্তা বা প্রাণ। উভয়টির সমন্বয়ে মানুষ বা মানব।

শরীরের মূল উপাদান হচ্ছে মাটি: প্রত্যক্ষ যেমন প্রথম মানব আদম আলাইহিস সালাম।[1] পরোক্ষ যেমন আমরা। অর্থাৎ আদম পরবর্তী প্রজন্ম মাটি থেকে উৎপাদিত খাদ্য, পানীয় থেকে তৈরি বীর্য দ্বারা সৃষ্ট।[2] মাটির এ সারাংশ থেকেই মানুষ সৃষ্টির সূচনা। অতঃপর পর্যায়ক্রমে প্রথমে সে শুক্র বিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপিত হয়; এরপর জমাট রক্ত; জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করা হয়; মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করা হয়; অবশেষে এক নতুন আকৃতি ধারণ করে।[3]

রূহ আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে আগত তাঁর সরাসরি নির্দেশ।[4] শরীরের জন্য যেমন খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজন, তদ্রূপ আত্মারও খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজন। তবে উভয়ের পানাহার ও জীবিকা নির্বাহ আলাদা ও স্বতন্ত্র। শরীর বা দেহের উৎস মাটি, তাই মাটিতেই এর জীবন উপকরণ ও জীবন ধারণের সমস্ত আয়োজন।

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَلۡيَنظُرِ ٱلۡإِنسَٰنُ إِلَىٰ طَعَامِهِۦٓ ٢٤ أَنَّا صَبَبۡنَا ٱلۡمَآءَ صَبّٗا ٢٥ ثُمَّ شَقَقۡنَا ٱلۡأَرۡضَ شَقّٗا ٢٦ فَأَنۢبَتۡنَا فِيهَا حَبّٗا ٢٧ وَعِنَبٗا وَقَضۡبٗا ٢٨ وَزَيۡتُونٗا وَنَخۡلٗا ٢٩ وَحَدَآئِقَ غُلۡبٗا ٣٠ وَفَٰكِهَةٗ وَأَبّٗا ٣١ مَّتَٰعٗا لَّكُمۡ وَلِأَنۡعَٰمِكُمۡ ٣٢ ﴾ [عبس: ٢٤،  ٣٢] 

“মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক, আমরা আশ্চর্য উপায়ে পানি বর্ষণ করেছি, এরপর আমরা ভূমিকে বিদীর্ণ করেছি, অতঃপর তোমাদের এবং তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুদের জীবিকা নির্বাহের স্বার্থে তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবজি, যয়তুন, খর্জুর এবং ঘন উদ্যান, ফল ও ঘাস ।” [সূরা আবাসা, আয়াত: ২৪-৩২]

আর “এ মাটিতেই রয়েছে চতুষ্পদ জন্তু, যা আমাদের বিত্ত বৈভবের আলামত, শীত বস্ত্রের উপকরণ এবং কিছু আহার্যে ব্যবহৃত খাদ্য, এর মাধ্যমে আমরা খুব সহজে মালামাল স্থানান্তর করি, আরো আছে এতে আভিজাত্য, সৌন্দর্য, শোভা ও আরোহণের ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা।”[5]

রূহ ঊর্ধ্বজগত থেকে আগত ঊর্ধ্বজগতেই তার আহার্য। নবী-রাসূলগণ সেখান থেকেই তার আহার্য নিয়ে এসেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ﴾ [الرعد: ٢٨] 

“জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ ও যিকিরের মাধ্যমে অন্তরাত্মা প্রশান্ত।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৮]

অর্থাৎ প্রকৃতিলব্ধ পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ জ্ঞান। তবে জ্ঞানার্জন ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা, সামর্থহীনতা ও জ্ঞানের স্বল্পতার দরুন একটি পর্যায়ে পৌঁছে মানুষ ধাঁধাচ্ছন্ন হয়ে যায়, পৌছেও পৌছতে পারে না। প্রয়োজন হয় ঐশী বাণীর। স্রষ্টার সরাসরি সমর্থন ও নির্দেশপ্রাপ্ত দূত তথা নবী ও রাসূলগণের। এদের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত, যথাযথ জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়। তা-ই ওহী বা কুরআন রূহের আহার্য।[6]

মোদ্দাকথা: শরীর মাটির তৈরি, মাটিতেই তার খাদ্য। রূহ উর্ধ্বজগত থেকে আগত উর্ধ্বজগতেই তার আহার্য।

রূহ ও শরীরের মধ্যে মূল হচ্ছে রূহ। এ জন্যই প্রবাদ-প্রবচনে ‘পাপাত্মা, পুণ্যাত্মা’ ইত্যাদি বলা হয়। শরীরের সাথে ভালো-মন্দ সম্পৃক্ত করা হয় না, যদিও ভালো-মন্দ দু-ই সম্পন্ন হয় শরীর ও আত্মার সমন্বয়ে। হাদীসেও এ বিষয়টিকে সমর্থন করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ».

“জেনে রাখ, শরীরের অভ্যন্তরে গোশতের একটি টুকরা আছে, সে যদি সুস্থ্য ও সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, পুরা শরীরই সুস্থ্য ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। আর সে অসুস্থ্য ও রুগ্ন হলে, পুরা শরীরই অসুস্থ্য ও রুগ্ন হয়ে যায়। জেনে রাখ, তার নাম-ই কলব।”[7]

রূহ ও আত্মার সমন্বয়ে-ই একজন সক্রিয় ও জীবন্তমানুষ।[8] একটি ব্যতীত অপরটি নিথর, মৃতদেহ কিংবা স্রেফ অস্পৃশ্য একটি প্রাণ।[9]

২. প্রকৃতি: আল্লাহ কর্তৃক ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডলের নির্মাণ কৌশল এবং উভয়ের মধ্যস্থিত জড়জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণী জগতের নিরন্তর চলমানতার স্বাভাবিকতা ও চলমানতা-ই প্রকৃতি। আমাদের উপরস্থিত সুনিপুণ ও সুশোভিত আকাশ; তাতে নেই কোনো ত্রুটি, নেই কোনো ছিদ্র। আমাদের পদতলে বিস্তৃত ভুমি; এতে স্থাপিত হয়েছে পর্বতমালার ভার, এতেই উদ্গত হয় সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ। এ সবই আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতি; অনুরাগী ও কৃতজ্ঞ বান্দার জ্ঞান আহরণ ও আল্লাহকে স্মরণ করার মতো ধ্রুব উপজীব্য।[10] প্রভাত রশ্মি[11] ভূ-মণ্ডলের বিভিন্ন শষ্যক্ষেত্র,  যা পরস্পর মিলিত ও সংলগ্ন; আরো আছে আঙ্গুরের বাগান, শষ্য ও খর্জুর- পরস্পর মিলিত ও বিচ্ছিন্ন উভয় প্রকার। যা একই পানি দ্বারা সেচ করা হয়। তার পরেও একটি অপরটির চেয়ে উৎকৃষ্ট, স্বাদে ভিন্ন। এসবই প্রকৃতি, স্বীয় স্রষ্টার নিদর্শন।[12] আরো আছে আলোকময় উজ্জ্বল সূর্য, স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারী চন্দ্র। যা নির্ধারিত ও সুর্নিদিষ্ট কক্ষপথসমূহে ঘুর্ণায়মান। এর দ্বারা আমরা নির্ণয় করি বছরের হিসাব, মাসের সংখ্যা। অযথা সৃষ্ট করা হয় নি এ প্রকৃতি, এতে রয়েছে মহৎ উদ্দেশ্য, বাস্তবতার চাহিদা ও মানব প্রয়োজন।[13] এ হলো এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট প্রকৃতি। একমাত্র মানব ও মানুষের জন্যই।[14] ভাগ্যবান ও সফলকাম সে ব্যক্তি যে প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করে এর থেকে জ্ঞান আহরণে সচেষ্ট হয়।

৩. মানবপ্রকৃতি: মানবস্বভাব ও মানবপ্রকৃতি; শিক্ষালাভ করা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা; এককথায় সে অনুসন্ধিৎসু। কারণ, মায়ের উদর থেকেই সে মূর্খ ও অজ্ঞ। সাদা-কালো, ভালো-মন্দ, দোস্ত-দুশমন, রাত-দিন সবই তার কাছে অজানা ও অস্পষ্ট। নাক, কান, চোখ, চর্ম, জিহবা তথা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আস্তে আস্তে শিখে: মায়ের ভাষা শিখে, বাবার পেশা শিখে, শিখে শিল্প, বিদ্যা অর্জন করে, পরিচিত হয় সংস্কৃতির সাথে। পুরা জীবনটাই তার শিখা, অভিজ্ঞতা অর্জন করা আর পার্থিব জীবনে বাস্তবায়ন করা। এটাই তার প্রকৃতি, অন্যথায় সে মূর্খ, অজ্ঞ।[15]

জার্মানি এক জীববিজ্ঞানী তো বলেই ফেলেছেন: “প্রকৃতিই মানুষের ধর্মীয় আকিদার জনক। মানুষ আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, চার দিগন্ত দেখে প্রভাবিত হয়, উপলব্ধি করে, সে এক মহাশক্তি বেষ্টিত; যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দৃশ্যমান দিগন্ত ও দিগন্তের বাইরে অদৃশ্য যাবত কিছু। কে এগুলো সৃষ্টি করেছে? কোথায় তার সূচনা? আছে কি তার অন্ত? ভাবতে ভাবতে সহসা মস্তক অবনত হয়ে আসে মহান সত্ত্বার পানে, পবিত্রতা ঘোষণা করে তার, মনুষ্য সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে জ্ঞান করে তাকে। কারণ, সে-ই উপযুক্ত, সে-ই পারে মানুষের অসাধ্য সাধন করতে।”

কেউ কেউ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। কারণ, একটি জিনিস বার বার দেখার ফলে স্বাভাবিক ও নিরাকর্ষণ হয়ে পড়ে, কৌতুহল বিরাজমান থাকে-না তার ভেতর।

ফলে প্রকৃতি গবেষকদের আরেকটি দল বলেন, “আকস্মিক ভীতিপ্রদ ও অস্বাভাবিক কিছুই মানুষের ভেতর আকিদা তথা ধর্মীয় বিশ্বাসের জনক। যেমন বিজলি, মেঘের গর্জন, প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, তুফান ও ভূমিকম্প ইত্যাদি। ঘন্টার আওয়াজ যেরূপ তন্ময় কিংবা ঘুমন্ত ব্যক্তিদের জাগিয়ে তুলে, তদ্রূপ এগুলো মানুষের ভেতর অনুসন্ধিৎসার জন্ম দেয়, দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কৌতুহলি হয়ে উঠে সে! কে এর সৃষ্টিকর্তা? কোথায় এর উৎস? কীভাবে তার অন্ত? বাহ্যিক কোনো কারণ-ই খোঁজে পায়-না সে; বাধ্য হয় অজানা এক মহা শক্তির সামনে অবনত মস্তক হতে। এভাবেই মানবপ্রকৃতিতে বিশ্বাসের সৃষ্টি, ধর্মীয় আকিদার জন্ম। জনৈক ইংরেজ বৈজ্ঞানিকের মত এটি।”

কিন্তু ফ্রন্সের এক বিজ্ঞানী বলেন, “শুধু ভয়ের বস্তু দেখলেই যথেষ্ট নয়। এর দ্বারা শুধু নৈরাশ্য ও আতঙ্কের জন্ম হয়, ইন্দ্রীয় শক্তি লোপ পায়। সুতরাং এমন এক অনুভুতির প্রয়োজন, যার ফলে এ ভয়ের বিপরীতে সৃষ্টি হয় আশা ও সম্ভাবনার। যে তাকে আশা-ভয়, সম্ভাবনা ও হতাশার টানাপোড়নে অবনত মস্তক করে দিবে মহান সত্তার পানে। এটাই ধর্ম, দীনের বাস্তব আকৃতি।”[16]

পবিত্র কুরআনও অনুরূপভাবে মানবপ্রকৃতিকে আকিদা তথা ধর্মীয় বিশ্বাস আহরণের দীক্ষা দিয়েছে। তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের ওপর জোরপূর্বক কোনো আকিদা চাপিয়ে দেয় নি, মুক্ত চিন্তার সুযোগ দিয়েছে। বরং যারা চিন্তা করে না, গবেষনা করে-না প্রকৃতি নিয়ে, তাদের তিরস্কার করেছে, ধিক্কার জানিয়েছে তাদের মনুষ্য আকৃতিকে, অনুভূতি ও চেতনা বোধকে।[17] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَفَلَا يَنظُرُونَ إِلَى ٱلۡإِبِلِ كَيۡفَ خُلِقَتۡ ١٧ وَإِلَى ٱلسَّمَآءِ كَيۡفَ رُفِعَتۡ ١٨ وَإِلَى ٱلۡجِبَالِ كَيۡفَ نُصِبَتۡ ١٩ وَإِلَى ٱلۡأَرۡضِ كَيۡفَ سُطِحَتۡ ٢٠ ﴾ [الغاشية: ١٧،  ٢٠] 

“তারা কি উষ্ট্রের প্রতি লক্ষ্য করে না, কীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? আকাশের পানে তাকায় না, কীভাবে তা উচ্চ করা হয়েছে? দেখে না পাহাড়ের দিকে, কীভাবে তা স্থাপন করা হয়েছে? দৃষ্টি বুলায় না পৃথিবীর বুকে, কীভাবে তা সমতল বিছানো হয়েছে?” [সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ১৭-২০], এ হচ্ছে ইসলামি আকিদা, যা স্বাধীন মানবপ্রকৃতির অনুকূল ও স্বভাবজাত, তথ্যে ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ।

৪. ইসলাম: মৌলিক কয়েকটি বিষয়ের সাক্ষ্য প্রদান করা:

ক. আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই তথা ইবাদাতের উপযুক্ত কোনো সত্তা নেই। যাবতীয় ইবাদত কেবল তাঁরই প্রাপ্য। আর এ কথার অন্তর্ভুক্ত হবে এটা সাব্যস্ত করা যে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও বিধানদাতা।

আরও স্বীকৃতি প্রদান করা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।

খ. সালাত কায়েম করা।

গ. যাকাত প্রদান করা।

ঘ. রমযান মাসে সাওম পালন করা।

ঙ. সামর্থ থাকলে হজ করা।”[18]

৫. আকিদা: মানুষ যে বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে লালন করে এবং যা দ্বারা সে পরিচালিত হয়, তাই আকিদা।

আকিদার সূচনা: আল্লাহ বলেন,

﴿ سَنُرِيهِمۡ ءَايَٰتِنَا فِي ٱلۡأٓفَاقِ وَفِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّۗ أَوَ لَمۡ يَكۡفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُۥ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ شَهِيدٌ ٥٣ أَلَآ إِنَّهُمۡ فِي مِرۡيَةٖ مِّن لِّقَآءِ رَبِّهِمۡۗ أَلَآ إِنَّهُۥ بِكُلِّ شَيۡءٖ مُّحِيطُۢ ٥٤ ﴾ [فصلت: ٥٣،  ٥٤] 

“বিশ্বজগতের প্রান্তদেশে ও তাদের নিজেদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে এ বিশ্বাস ও আকিদা সুস্পষ্ট হয় যে, এ কুরআন সত্য; তোমার রবের জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কি যে, তিনি সকল বিষয়ে সাক্ষী?” [সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ, আয়াত: ৫৩] মূলত পার্থিব জগত, এর চাহিদা ও প্রয়োজন-ই মানুষের ভেতর আকিদার জনক। প্রতিদিন সে নিজস্ব কর্ম ও কর্তব্য সাধনে আকিদার সম্মুখীন হয়। তার সমস্ত চেষ্টা, সকল সাধনা, সমূহ অভিপ্রায় উন্মুখ থাকে এক অদৃশ্য সত্তার কৃপার তরে। তার নিকট-ই সে স্বীয় কর্মের প্রতিদান কামনা করে। যেমন, ব্যবসায়ী মূলধন বিনিয়োগ করে লাভের জন্য, অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থতার জন্য, কৃষক বীজ বপন করে ফসলের জন্য এক অদৃশ্য সত্তার প্রতি ভরসা করে। তদ্রূপ সকল মুখাপেক্ষী ও পরনির্ভরশীল ব্যক্তি-ই আশা-ভরসার জন্য এক মহান সত্তা তথা আল্লাহর অনুগ্রহে বিশ্বাসী। কারণ, যা সে কামনা করে তা অর্জন করতে পারে না, আবার যার থেকে পলায়ন করে সেই তাকে আক্রমণ করে।[19]

মানুষের অক্ষমতার আরো উদাহরণ, মানুষ শান্তি, নিরাপদ ও পরস্পর মিল মহব্বতে বাস করতে চাইলেও পারে না, পাহাড় সম বাধা আর সমুদ্রের সারি সারি ঢেউয়ের ন্যায় জটিলতা এসে হাযির হয়।[20] মানুষের সবচেয়ে বড় অক্ষমতার প্রমাণ স্বীয় মন ও সত্তার সাথে বৈরিতা।[21] তবে আল্লাহ মুমিনদের ওপর খাস রহমত তথা শান্তি অবতীর্ণ করেন।[22] এসব ব্যাপার ও বিষয়বস্তু মানুষের ক্ষমতার বাইরে, সাধ্যের অতীত, আর এখানেই আল্লাহর পরিচয়। ফলে স্বভাবত মানুষ আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এটা-ই তার প্রকৃতিগত ও স্বভাবসিদ্ধ। 

নৃবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ব বিদ্যা প্রমাণ করেছে, মানুষের জ্ঞান; আংশিক, সামান্য, সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী। তার জ্ঞান কষ্টার্জিত, অভিজ্ঞতালব্ধ। পূর্বে ছিল না, হালেও অনিশ্চিত, আজীবনও বিদ্যমান থাকবে না। যে কোনো দুর্ঘটনা ও বিপদে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিকলত্ব, স্মৃতি শক্তির লোপ, দূরত্ব ও সীমাবদ্ধতায় আংশিক কিংবা পূর্ণ জ্ঞান অর্জনে অক্ষমতা। দূরের জিনিস দেখা যায় না, দূরের শব্দ শুনা যায় না। আবার সামনে কিংবা শরীরযুক্ত না-হলেও দেখা যায় না। শরীর ও আকৃতির মাধ্যমে সামান্য জ্ঞান লাভ করা যায় মাত্র।[23]

মানব প্রকৃতির সর্বপ্রথম আকিদা:

আকিদা ও তার সূচনা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় প্রতীয়মান; তাওহীদ তথা একত্ববাদের আকিদাই মানব প্রকৃতির সর্বপ্রথম আকিদা, পরবর্তীতে শির্কের জন্ম হয়। এ জগতে সর্বপ্রথম বসবাসকারী মানব আদম আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত নবী।[24]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা সকলে আদম থেকে, আর আদম মাটি থেকে।”[25]

আল্লাহ তখনই নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন, যখন মানব সমাজে বিচ্যুতি ঘটেছে, নৈতিক পতন এসেছে, যখন তারা নিজদের সৃষ্ট বস্তুর ইবাদত ও পূঁজা-অর্চনায় মগ্ন হয়েছে। যেমন, সূর্যের ইবাদত, কারণ সে নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে সর্বদা উদিত হয়, এর দ্বারা তারা উপকৃত হয়। এখনো পর্যন্ত জাপানীদের কাছে ‘মিকাদু’ সম্মানের পাত্র। তাদের বিশ্বাস, সে ‘সূর্য নামে’র প্রভুর প্রতিকৃতি। তদ্রূপ আসমান: কারণ সে চন্দ্র, সূর্য ও তারকা অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে, সেখান থেকে বারিবর্ষণ হয়। অনুরূপ জমিন: কারণ, সে শষ্যাদি উৎপন্ন করে, মানুষ তার বুকেই বাস করে।[26]

তদ্রূপ মানুষ এক সময় পিতার উপাসনা করেছে: কারণ, সে দুনিয়ায় আসার মাধ্যম, শক্তির আধার। আরেকটু অগ্রসর হয়ে গোত্রপতির উপাসনা শুরু করেছে। কারণ, সে সমাজপতি, তার ক্ষমতাই বেশি, তার শক্তিই প্রবল। যেমন, আদি মিসরবাসীরা ফির‘আউনের ইবাদত করেছে।[27] বর্তমান যুগেও  জাপানের রাজা তার সম্প্রদায়ের বৃহৎ সংখ্যার উপাস্য।[28]

আকিদার ধারক:

নাজমুদ্দিন বাগদাদি বলেন, জগৎ তিন প্রকার:

১. শুধু জ্ঞান ও বোধশক্তি সম্পন্ন জগৎ; যেমন ফিরিশতা।

২. শুধু প্রবৃত্তি ও কামুকতা সম্পন্ন জগৎ; যেমন পশু ও চতুষ্পদ প্রাণী।

৩. উভয়ের সমন্বয় তথা বোধশক্তি ও প্রবৃত্তি সম্পন্ন জগৎ; যেমন মানব ও জিন্ন।

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত জগতের স্বীয় স্বার্থ ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো ত্যাগ, কুরবানি ও পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। তারা নিজস্ব সিদ্ধান্ত, কর্তব্য ও চাহিদা মেটাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিংবা দোদুল্যমন হয় না। শারীরিক চাহিদা পূরণে কোথাও বিবেক বাধা দেয় না। আবার বিবেকের কর্তব্য সাধনে শারীরিক প্রয়োজন পিছুটান দেয় না। কারণ, প্রথম শ্রেণিভুক্ত জগতের ভেতর জ্ঞান ও বোধের সাথে বিরোধ সাধে এমন কোনো প্রবৃত্তি নেই। দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত জগতের ভেতর প্রবৃত্তির সাথে বাধসাধে এমন কোনো অনুভূতি নেই। হ্যাঁ, টানাপোড়েন ও দ্বিমুখী দ্বন্দ্বের শিকার হয় মানব ও জিন্ন জাতি। প্রবৃত্তির স্বার্থে বার বার দংশন করে বিবেক; নিয়ন্ত্রিত হওয়ার উপদেশ দেয়, বৈধ-অবৈধ বিবেচনার দীক্ষা দেয়। কঠোরভাবে ধিক্কার জানায় স্বেচ্ছাচারিতাকে। আবার বিবেক তথা আত্মার কর্তব্য সাধনে বার বার প্রবৃত্তির চাহিদা ও প্রয়োজন উঁকি মারে, পিছু টান দেয়। বাধাগ্রস্ত করে তার একাগ্রতা ও নিরবচ্ছিন্নতা। উভয় প্রয়োজন-ই মানব মনে ও জিন্ন উপলব্ধিতে অঘোষিত, অযাচিত, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি করে। কারণ, বিবেক ও প্রবৃত্তি বিপরীত মুখি গতি ও প্রকৃতিতে চলমান। জয়ী হয় কখনো প্রবৃত্তি কখনো বিবেক। একটি আরেকটির বিপরীত। বিবেক, বুদ্ধি ও বোধ এবং শারীরিক, জৈবিক ও পার্থিব চাহিদার মাঝে সমঝোতা, সমন্বয় ও প্রয়োজন যথাযথ মূল্যায়ন করে সামনে অগ্রসরমান ব্যক্তি-ই প্রকৃত বিশ্বাস তথা ইসলামি আকিদার যথাযোগ্য ও উপযুক্ত। এর বিপরীতে জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তির অনুসরণে অন্ধ ও পরিচালিত ব্যক্তি পশুবৎ, পার্থিব জগতের শান্তি সৃঙ্খলার জন্য হুমকি। যেমন, অধুনিক বিশ্বের পাশ্চাত্য জগৎ। আবার নিরেট আত্মার খোরাক ও বিবেচনায় মগ্ন ব্যক্তি অথর্ব, অপাংক্তেয় ও পৃথিবীর অযোগ্য। যেমন বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের যোগীবৃন্দ।[29]

আত্মা ও প্রবৃত্তির মাঝে সমন্বয়ে সক্ষম, প্রকৃতি দেখে ভালো-মন্দ বিবেচনা করার যোগ্য ও তা থেকে উপকৃত সত্তা তথা মানব ও জিন্ন জাতি-ই ইসলামি আকিদার ধারক হতে সক্ষম। ইসলামের লক্ষ্য এরাই। এরাই প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করার যোগ্যতা রাখে। আর তাই কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে বিবেকবান, বিশ্বাসী, আলেম, ঈমানদার, গবেষক ও উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।[30] অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ لَأٓيَٰتٖ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩٠ ٱلَّذِينَ يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ قِيَٰمٗا وَقُعُودٗا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمۡ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ رَبَّنَا مَا خَلَقۡتَ هَٰذَا بَٰطِلٗا سُبۡحَٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٩١﴾ [ال عمران: ١٩٠،  ١٩١] 

“নিশ্চয় আসমান-জমিন সৃষ্টি ও রাত-দিন পরিবর্তনের ভেতর শিক্ষনীয় আলামত রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য, যারা বসতে, শুতে এবং কাতশুয়েও আল্লাহর স্মরণ করে, এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে বলে উঠে, হে আমাদের প্রভু তুমি এ গুলো অযথা সৃষ্টি কর নি। তুমি পবিত্র, আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে পরিত্রান দান কর।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০–১৯১] আল্লাহ যাকে ইচ্ছে গবেষণার তাওফীক দেন, উপকৃত জ্ঞান দান করেন।[31]

৬. ইসলামি আকিদা:

মৌলিক কয়েকটি বিষয়ের ওপর ঈমান ও বিশ্বাসের সমন্বয় ইসলামি আকিদা: যথা-

১. আল্লাহর প্রতি ঈমান: আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, রাত-দিন, মানব-জিন্ন, ফিরিশতা যাবৎ কিছু তার পরিকল্পনা এবং তার সৃষ্টি, তিনিই এর একক মালিক। মেঘমালার স্থানান্তকরণ, বৃষ্টি বর্ষণ, কল্যাণ-কল্যাণের মালিক তিনি। তার সৃষ্টি ও রাজত্বে কারো অংশিদারিত্ব নেই।[32] ইবাদতের মালিক তিনি। কোনো ধরনের ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উৎসর্গ কিংবা নিবেদন করা অবৈধ।[33]

কিছু বিশেষ ইবাদত যেমন দো‘আ, সালাত, যাকাত, সাওম, হজ, কুরবানি, ফরিয়াদ ও সাহায্য প্রার্থনা ইত্যাদি। তিনি সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণের মালিক। তার সাদৃশ্য কোনো জিনিস নেই।”[34]

২. ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান: তারা আল্লাহর অনেক বড় মাখলুক, নূরের তৈরি। তারা দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার পাখা বিশিষ্ট। কেউ এর চেয়ে বেশি পাখার অধিকারী। তারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা, রাত-দিন আল্লাহর প্রশংসা করে, ক্লান্ত হয় না, কখনো আল্লাহর নাফরমানি করে না, সর্বদা তাঁর নির্দেশ পালন করে।[35]

বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত বিশিষ্ট কয়েকজন ফিরিশতা: জিবরীল, মিকাইল, ইসরাফীল, মালাকুল মাউত ও মুনকার-নাকির।

৩. আসমানি কিতাবের প্রতি ঈমান: (ক) তওরাত, (খ) ইঞ্জিল, (গ) যাবুর, (ঘ) কুরআন এবং মুসা ও ইবরাহীমের সহিফার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত মানবজাতির জীবন বিধান। পূর্বের সবগুলো কিতাবে মানুষ পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ও সংস্করণ করেছে। এদের মৌল ও মৌলিকত্ব অবশিষ্ট নেই। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর এদের মেয়াদও শেষ। কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংরক্ষিত, কিয়ামত পর্যন্ত এর ভেতর কোনো ধরনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্ভব নয়।[36] কেউ অপচেষ্টার প্রায়াসে লিপ্ত হলে, মুখ থুবড়ে পড়বে, দিবালোকের ন্যায় সহসা উন্মুক্ত হবে তার মুখোশ। শিষ্টের পোষণ ও দুষ্টের দমনের জন্য কুরআনের ফয়সালা একমাত্র ন্যয়সঙ্গত, ইনসাফপূর্ণ। যে কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে এর শরনাপন্ন হওয়া, এর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা ঈমানের পরিচয়, এর থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা, এর ফয়সালায় সন্তুষ্ট না হওয়া মুনাফিকের আলামত। কুরআন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনাকারী মুমিন, অন্যথায় অবস্থাভেদে সে কাফের, ফাসেক এবং ইনসাফ প্রত্যাখ্যানকারী জালেম।

৪. নবী ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান: তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির পথপ্রদর্শক, দূত। সর্বপ্রথম রাসূল নূহ আলাইহিস সালাম। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।[37]

৫. পরকাল দিবসের প্রতি ঈমান: পরকাল দিবস তথা কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট একটি দিন। যা অনেক দীর্ঘ।[38] সে দিন সমস্ত মানুষ উত্থিত হবে, মৃতদের করা হবে জীবিত। ছোট-বড় সমস্ত আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে। অত্যাচারীদের থেকে প্রতিশোধ নেওয়া হবে, সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দেওয়া হবে। কাফের, মুনাফিক, পাপীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। সে দিন সারা পৃথিবীর অবস্থা পাল্টে যাবে। মীযান, হাওযে কাউসার, পুলসিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, নবী-রাসূল, ফিরিশতা, নেককার লোকদের  সুপারিশ এবং আল্লাহর দর্শন ও কথপোকথন অনুষ্ঠিত হবে।

৬. তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান, এর চারটি স্তর রয়েছে:

(এক) আল্লাহ তা‘আলার শাশ্বত, অবিনশ্বর, চিরন্তন ও চিরস্থায়ী ইলম বা জ্ঞানের আকিদা:  আসমান-জমিন সৃষ্টির পূর্ব থেকে প্রতিটি বস্তু ও জিনিস সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা সম্যক জ্ঞাত। ছোট-বড়, দৃশ্য-অদৃশ্য, অস্তি-নাস্তি, যে নাস্তি কোনো দিন অস্তিত্ব পাবে না, পেলে কীভাবে পেত, পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে তিনি সেটা সম্পর্কে অবগত। একটি জিনিসও তার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হয় না।  সবকিছুই তিনি স্বীয় জ্ঞান দ্বারা আবৃত করে রেখেছেন।[39]

(দুই) যাবৎ কিছু চিরন্তন ও স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার আকিদা: পার্থিব জগতে যা ঘটছে ভালো-মন্দ, ছোট-বড় সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক লিপিবদ্ধ। সে লিখানুযায়ী সবকিছু সংঘটিত হচ্ছে, অস্তিত্ব পাচ্ছে।[40] কোন্ মৃত দেহ কতটুকু মাটি ভক্ষণ করেছে সে ব্যাপারেও আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত আছেন।[41]

(তিন) আল্লাহর ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের আকিদা: দুনিয়াতে বিদ্যমান সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় অস্তিত্ববান। অর্থাৎ তার সৃষ্টি ক্ষমতার ইচ্ছা, যার দ্বারা তিনি এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যে ইচ্ছার বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবী। ভালো-মন্দ, মানুষের যাবতীয় কর্ম ও প্রতিটি জিনিস এর আওতাভুক্ত। তিনি যা চাননি তা হয় নি, যদিও সারা পৃথিবীর মানুষ চেয়েছে, চেষ্টা করেছে।[42] এমনকি মানুষের পরস্পর ঝগড়া-বিবাদও এ ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকে।[43]

(চার) সৃষ্টি ও অস্তিত্ব দানের আকিদা: আল্লাহ তা‘আলার নাম, সিফাত ও তার কর্ম ব্যতীত যা কিছু আছে, সব আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট, মাখলুক। আল্লাহ-ই তাদের একমাত্র স্রষ্টা।[44] আল্লাহ সৃষ্টি করলেই কোনো জিনিস সৃষ্ট হয় ও অস্তিত্ব লাভ করে। এমনকি মানুষের ভালো-মন্দ কর্মও স্বীয় বিবেচ্য ও বিশেষ হিকমতের কারণে তিনিই সৃষ্টি করেছেন, মানুষ সৃষ্টি করেনি। যদিও বাহ্যত মানুষ-ই ইচ্ছা করে, সে-ই সম্পাদন করে। কারণ, এ আকিদা না রাখলে বলতে হবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো স্রষ্টা আছেন। অথচ আল্লাহ-ই মানুষ ও তার কর্ম ও ইচ্ছার স্রষ্টা।[45]

তাকদীরের আকীদা গ্রহণীয় হওয়ার জন্য বর্ণিত চারটি স্তরের ওপর ঈমান আবশ্যক। অন্যথায় তাকদীরের আকিদা শুদ্ধ নয়। তাকদীরের ওপর ঈমান শুদ্ধ না হলে, ইসলামও গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম ছাড়া আমলের মূল্য নেই, পরিশ্রমের ফল নেই।

একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, আল্লাহর ইচ্ছা দু’ধরনের:

(এক) আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের প্রয়োজন ও স্বার্থে ধর্মীয় তথা শর‘ঈ ইচ্ছা।

(দুই) আল্লাহর সৃষ্টিকৃত পার্থিব জগতের স্বার্থ ও প্রয়োজনে পার্থিব ইচ্ছা।

প্রথমটি বাস্তবায়নের ফলে আল্লাহর মহব্বত ও সন্তুষ্টি অর্জন হয়। এরই নির্দেশ আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসের দ্বারা দিয়েছেন।[46] শরী‘আত কর্তৃক প্রত্যেকটি আদেশ ও নিষেধ এই ইচ্ছার-ই অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয়টির দ্বারা আল্লাহর মহব্বত ও সন্তুষ্টি অর্জন হয় না। এ ইচ্ছার সম্পর্ক শুধু আল্লাহর সৃষ্টির সাথেই। আর এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, নিম্নোক্ত আয়াতে,

﴿مَن يَشَإِ ٱللَّهُ يُضۡلِلۡهُ وَمَن يَشَأۡ يَجۡعَلۡهُ عَلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ﴾ [الانعام: ٣٩] 

“আল্লাহ যাকে ইচ্ছে পথভ্রষ্ট করেন, আর যাকে ইচ্ছে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত রাখেন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৩৯]

 পার্থিব জগতের স্বার্থ ও প্রয়োজনে আল্লাহর ইচ্ছা এবং আল্লাহর শরী‘আতের স্বার্থ ও প্রয়োজনে আল্লাহর ইচ্ছার পার্থক্য:

এক: শর‘ঈ ইচ্ছার সাথে আল্লার মহব্বত ও সন্তুষ্টি সম্পৃক্ত। পার্থিব ইচ্ছা শুধু আল্লাহর একটি ইচ্ছাই, এর সাথে আল্লাহর মহব্বত ও সন্তুষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন পার্থিব স্বার্থে আল্লাহ কাফেরের কুফুরী, অবাধ্যের নাফরমানির অস্তিত্ব চেয়েছেন, ফলে এগুলো সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ গুলো আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের বিচারে পছন্দনীয় নয়, প্রিয়ও নয়। তবে কি জন্য সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ পাক-পবিত্র, তিনিই ভালো জানেন এর সৃষ্টি রহস্য।

দুই: শর‘ঈ ইচ্ছা কখনো বাস্তবায়ন হয়, যেমন কোনো কাফের ঈমান নিয়ে আসল অথবা কোনো মুমিন আল্লাহর আদেশ পালন করল বা কোনো নিষেধ থেকে বিরত থাকল। আবার কখনো বাস্তবায়ন হয় না, যেমন কোনো মুমিন আল্লাহর আদেশ অমান্য করল বা কোনো কাফের ঈমান প্রত্যাখ্যান করল।

পক্ষান্তরে আল্লাহর পার্থিব ইচ্ছার বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবি। যেমন কোনো জিনিস সৃষ্টি করা বা ধ্বংস করা। বৃষ্টি বর্ষণ, কুফুরী, হত্যা ইত্যাদির সম্পাদন।

তিন: আল্লাহর শর‘ঈ ইচ্ছা শুধু ভালো কাজ ও আনুগত্যের জন্য হয়। যা আল্লাহ পছন্দ করেন, যে জন্য তিনি নির্দেশ দেন এবং যেগুলো পরিত্যাগ করতে নিষেধ করেন। পার্থিব ইচ্ছা ভালো-মন্দ, আনুগত্য-অনানুগত্য উভয়ের শামিল। কারণ, অনেক জিনিস আছে, যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা কোনো হিকমতের জন্য সৃষ্টি করেন ঠিক, কিন্তু তা তিনি পছন্দ করেন না, বরং নিয়মানুসারে অপছন্দ করেন। যেমন, কাফেরের কুফরি, যে কারণে শাস্তির উপযুক্তও হবে সে। তদ্রূপ কাফের-মুমিন পরস্পরের মাঝে সংগঠিত পরীক্ষামূলক দ্বন্দ্ব-বিবাদ। যার ভেতর সুপ্ত রয়েছে আল্লাহর বিবিধ হেকমত, অজানা হাজারো রহস্য। পার্থিব ইচ্ছা এবং শর‘ঈ ইচ্ছার সমন্বিত ব্যক্তি-ই ভাগ্যবান, চিরসুখী, অন্যথায় সে হতভাগা, চিরদুখী।

 আল্লাহর ইচ্ছাকে দুভাগে বিভক্তি করার কারণ:

যেহেতু কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, আল্লাহ তা‘আলা কুফর, ব্যভিচার, অবাধ্যতা, হত্যা ও এ ধরনের যাবতীয় অঘটন, দুর্ঘটনার প্রতি সন্তুষ্ট নন, পছন্দও করেন না, বরং এ থেকে নিষেধ করেন, দূরে থাকতে বলেন। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, এতদসত্বেও দুনিয়াতে সবকিছুই সংঘটিত হচ্ছে, মানুষ এগুলো করে যাচ্ছে। আবার এও লক্ষ্য করি, আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে ঈমান গ্রহণ, সালাত কায়েম, যাকাত প্রদানসহ ইত্যাদি নির্দেশ দিচ্ছেন। তারপরও লক্ষ্য করি অনেক মানুষ এর বিরোধিতা করছে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধের পরোয়া করছে না। অতএব আমরা যদি বলি, আল্লাহর আদেশ প্রত্যাখ্যান, তার নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনও আল্লাহর শর‘ঈ ইচ্ছানুযায়ী হয়, তাহলে তা হবে শরয়িতের দলিল প্রমাণাদির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যেখানে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সুস্পষ্ট বর্ণনা বিদ্যমান। এর বিপরীতে আমরা যদি বলি, তাদের কর্ম আল্লাহর পার্থিব ইচ্ছার বাইরে সম্পাদিত হচ্ছে। যার অর্থ, আল্লাহর ইচ্ছার উপর তাদের ইচ্ছা প্রধান্য লাভ করেছে, জয়ী হয়েছে। আল্লাহর অনিচ্ছা সত্তেও তারা এগুলো সম্পাদনে সক্ষম হচ্ছে। এ আকিদাও সুস্পষ্ট গোমরাহি। সুতরাং আমরা নিশ্চিত যে, গুনাহ ও নাফরমানি আল্লাহর শর‘ঈ ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির ভিত্তিতে সম্পাদন হয় না, বরং এগুলো আল্লাহর পার্থিব স্বার্থজনিত ইচ্ছার প্রতিফলন, যা রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই, যার থেকে পলায়ন করারও সুযোগ নেই। আমরা আরেকটি জিনিসও লক্ষ্য করি যে, কুরআন-হাদীসে যা কিছু গোমরাহি ও ভ্রষ্ট বলা হয়েছে, যেমন কুফুরী ও অবাধ্যতা আল্লাহর পার্থিব ইচ্ছার ভিত্তিতেই সংঘটিত হচ্ছে, কোনো না-কোনো হিকমতের কারণে। যে কারণে তিনি প্রশংসার যোগ্য, স্তুতির পাত্র। তাই আমরা পার্থক্য করতে বাধ্য হয়েছি যে, শর‘ঈ ইচ্ছার ভিত্তিতে আল্লাহর পছন্দনীয় বস্তু, যার বাস্তবায়ন তিনি হতে দেন না, যেমন কাফেরের ঈমান, অবাধ্যের আনুগত্য। তদ্রূপ শর‘ঈ ইচছার ভিত্তিতে আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্তু, যার বাস্তবায়ন তিনি পার্থিব স্বার্থে করেন, যেমন কাফেরের কুফুরী, অবাধ্যের অবাধ্যতা।

তকদীরের ব্যাপারে সমস্ত প্রশ্ন দূর করার জন্য পার্থিব স্বার্থের ইচ্ছা ও শর‘ঈ স্বার্থের ইচ্ছার ভেতর বিভক্তিকরণ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। তারপরও আল্লাহর তাওফীক প্রাপ্তদের ছাড়া কেউ তকদীর বোঝার ক্ষমতা রাখে না।

ইসলামি আকিদা দ্বারা উদ্দেশ্য:

ষড়যন্ত্র, মূর্খতা ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতার ফলে, বিভিন্ন পরিস্থিতি, আনুকুল্যতা ও প্রতিকুলতার বিভাজনে, ইসলামি আকিদার ভেতর শ্রীহীনতা ও অনাকাঙ্খিত কুসংস্কারের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জন্ম হয়েছে বিভিন্ন দল-উপদলের। কাদারী, জাহমী, শিয়া, রাফেযী, খারেজী, মাজার পূজারি, ব্যক্তির আধ্যাত্মিক শক্তিতে বিশ্বাসীর ন্যায় অনেক ফিরকা। যাদের আকিদা প্রকৃতি বিরুদ্ধ, বিজ্ঞান প্রত্যাখ্যাত, পাগলামি, প্রলাপ, শুধুই ভক্তিনির্ভর, বাড়াবাড়ি, কল্পনা ও গোড়ামি নির্ভর। যে আকিদার সাথে সর্ম্পক নেই আল্লাহ, তাঁর রাসূল কিংবা পথিকৃৎ আসহাবে রাসূলের সাথে। তাই প্রয়োজন; স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন-খাঁটি ইসলামী আকিদার পৃথকিকরণ। যে আকিদা কুরআনে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমোদিত, সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত। অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকিদা, ত্বায়েফায়ে মানসুরার (সাহায্যপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর) আকিদা, ফিরকায়ে নাজিয়ার (মুক্তিপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর) আকিদা। এ আকিদা-ই প্রকৃতির অনুকূল, মানব স্বভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, বিজ্ঞানের পরিপূরক। এ আকিদার দ্বারাই সুষ্ঠু-সুন্দর ও সুনিপুনভাবে নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও নির্দেশিত হতে পারে মানবজাতি। সংশোধিত হতে পারে তার সত্তা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব। এ আকিদার মাধ্যমে দূরীভূত হতে পারে দুর্নীতি, যুলুম, বর্বরতা, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা- ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে। প্রতিষ্ঠিত হতে পারে হিংসা ও বিদ্বেষহীন, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব।

আমাদের এ আকিদা-বিশ্বাসে বালা-মুসীবত দূর কিংবা প্রতিরোধের জন্য তাগা, রিং, আংটা, শঙ্খ-শামুক, সূতা ইত্যাদি শরীরের কোনো অংশে ঝুলানোর কিংবা বাধার বিধান নেই।[47] গাছ, পাথর বরকতময় বা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বস্তু মনে করার সুযোগ নেই।[48] শরী‘আত সমর্থিত ঝাড়-ফুঁক ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করা বা তাবিজ-কবজ ব্যবহারের কোনো স্বীকৃতি নেই।[49] আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে মান্নত করা, কাউকে ডাকা, ফরিয়াদ করা, কারো নামে কুরবানি করার অনুমতি নেই।[50] নেককার লোকদের কবর নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, মসজিদ বানানো,[51] জাদুকর, গণক,[52] নাশরাহ বা প্রতিরোধমূলক জাদু,[53] জ্যোতিষ্ক, তারকার ক্ষমতায় বিশ্বাস, শান্তির জন্য কবুতর উড়ানো, মাটিতে রেখা টেনে অদৃশ্যের সংবাদ প্রদান,[54] কুলক্ষণ[55] ইত্যাদির আকিদা পোষণ করা বা বিশ্বাস রাখা অবৈধ, হারাম ও ইসলামি আকিদার পরিপন্থি।

ইসলামি আকিদা-ই একমাত্র আকিদা- যা আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতি হিসেবে আমাদের জন্য পছন্দ করেছেন। মূলত এর দ্বারা তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, আমাদেরকে ধন্য করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٣] 

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পুর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং দীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৩] এ কারণেই এবং তখন থেকেই ইসলাম মানব জাতির জন্য বাস্তবমুখী প্রকৃত জীবন বিধান। যা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা দান করেছেন, যাতে আমরা দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতে ভাগ্যবান এবং খিলাফতের সে যোগ্যতা অর্জন করতে পারি, যে জন্য তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন।[56] এবং যাতে তার বিধি-নিষেধ ও পরিকল্পনা মোতাবেক দুনিয়া আবাদ করতে পারি।[57] শুধু তার ইবাদত ও আনুগত্যের নিমিত্তে, যা সমগ্র মানব জাতি সৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।[58]

এ সংক্ষিপ্ত পরিচিতির মাধ্যমে আমাদের ইসলামি আকিদার বিশেষ ব্যঞ্জনা, অনন্য বৈশিষ্টের একটি স্পষ্ট ধারণার জন্ম হল। অর্থাৎ ইসলামি আকিদা সার্বজনিন, পরিপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও প্রকৃতিগত। আমরা এ নিয়ে সামনে আরও বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়াস পাবো।

ইসলামি আকিদা ও মানবপ্রকৃতি:

এক আল্লাহর আকিদা ও মানবপ্রকৃতি: একেশ্বরবাদ, বহু ইশ্বরবাদ ও ত্রিত্ববাদের আকিদা ও বিশ্বাসের সংঘর্ষ যুগ যুগ ধরে। তবে কোনটি যুক্তিযুক্ত ও মানুষের প্রকৃতিগত? সামান্য বিবেচনা ও ক্ষণিক চিন্তা দ্বারাই আমরা নির্ণয় করতে পারি যে, এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসই যুক্তিযুক্ত ও প্রকৃতিগত। সাধারণ যুক্তি, ছোট-বড় সবারই অভিজ্ঞতা একরাজ্যে দুই রাজা, একরাষ্ট্রে দুই সরকার, একবিশ্বে দুই পরাশক্তির সহাবস্থান হয় না, সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র একটি ফ্যামিলী, দু’জনের দাম্পত্য জীবনও সমান অধিকার, বরাবর কর্তৃত্বের দাবির সাথে সাথেই ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায়, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে। যুদ্ধ-বিদ্রোহ আরম্ভ হয়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ব্যাপক আকার ধারণ করে রাজ্য ও দেশের ভেতর। সমূলে ধ্বংস কিংবা কর্তৃত্বহীন হয় কোনো পক্ষ অথবা আলাদা হয়ে যায় নিজস্ব অংশ ও অনুসারীদের নিয়ে। এ স্বভাবজাত বাস্তবতাই পবিত্র কুরআনে বিধৃত হয়েছে এভাবে:

﴿لَوۡ كَانَ فِيهِمَآ ءَالِهَةٌ إِلَّا ٱللَّهُ لَفَسَدَتَاۚ فَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ رَبِّ ٱلۡعَرۡشِ عَمَّا يَصِفُونَ ٢٢﴾ [الانبياء: ٢٢] 

“যদি আসমান-জমিনে এক আল্লাহ ছাড়া অনেক উপাস্য বিদ্যমান থাকত, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং আল্লাহ (অংশিদার থেকে) পবিত্র। তারা (আল্লাহর ব্যাপারে) বহু ইশ্বরবাদের যে বাজে গুণ আরশের অধিপতি আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করছে তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২২]

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

﴿ قُل لَّوۡ كَانَ مَعَهُۥٓ ءَالِهَةٞ كَمَا يَقُولُونَ إِذٗا لَّٱبۡتَغَوۡاْ إِلَىٰ ذِي ٱلۡعَرۡشِ سَبِيلٗا ٤٢ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يَقُولُونَ عُلُوّٗا كَبِيرٗا ٤٣ تُسَبِّحُ لَهُ ٱلسَّمَٰوَٰتُ ٱلسَّبۡعُ وَٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهِنَّۚ وَإِن مِّن شَيۡءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمۡدِهِۦ وَلَٰكِن لَّا تَفۡقَهُونَ تَسۡبِيحَهُمۡۚ﴾ [الاسراء: ٤٢،  ٤٤] 

“হে নবী, আপনি বলুন, তাদের কথা মতো যদি অনেক ইলাহ বা মা‘বুদ থাকত, তাহলে সকলেই ‘আরশের অধিপতির প্রতি ধাবিত হতো। সুতরাং তারা যা বলে, আল্লাহ তা থেকে কত পবিত্র, অনেক উর্ধ্বে। আসমান-জমিন এবং এ দুয়ের মাঝখানে যা আছে, সবই তার প্রশংসা করে, এমন জিনিস নেই যে তার প্রশংসা করে না, কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৪২-৪৪]

অন্যত্র তিনি বলেন,

﴿مَا ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ مِن وَلَدٖ وَمَا كَانَ مَعَهُۥ مِنۡ إِلَٰهٍۚ إِذٗا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهِۢ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعۡضُهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۚ سُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ ٩١﴾ [المؤمنون: ٩١] 

“আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেন নি, তার সাথে অন্য কোনো মা‘বুদও নেই। যদি থাকত প্রত্যেকেই নিজস্ব সৃষ্টি নিয়ে আলাদ হয়ে যেত এবং একে অপরের ওপর প্রধান্য বিস্তারের জন্য ব্যগ্র থাকত। আল্লাহ সম্পর্কে তারা যা বলে, তা থেকে আল্লাহ পবিত্র।” [সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ৯১]

অন্যত্র বলেন,

﴿قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ١ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ٢ لَمۡ يَلِدۡ وَلَمۡ يُولَدۡ ٣ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ٤﴾ [الاخلاص: ١،  ٤] 

“হে রাসূল, আপনি বলুন, আল্লাহ এক, তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ, অমুখাপেক্ষি, কারো থেকে জন্ম গ্রহণ করেন নি, কাউকে জন্ম দেন নি, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।” [সূরা ইখলাস, আয়াত: ১-৪]

আবার বহু ইশ্বরের আনুগত্য মানুষের সাধ্যাতীত। মানুষ শুধু একজনের আনুগত্য, তার চাহিদা পূরণ ও সন্তুষ্টির অনুসরণ করতে পারে, দুই বা অনেকের আনুগত্য, অনুসরণ তার সাধ্যের বাইরে। কারণ, এক-ই মুহূর্তে দ্বৈত চাহিদা, বিপরীতমুখীকর্ম কিংবা এক-ই কর্ম দুই জনের হয়ে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। একজন সন্তুষ্ট হলে অপরজন হবে নারাজ। একজনের কাছে হবে আপনজন অপরের বিরাগভাজন। এ বাস্তবতাই তুলে ধরা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে:

﴿ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا رَّجُلٗا فِيهِ شُرَكَآءُ مُتَشَٰكِسُونَ وَرَجُلٗا سَلَمٗا لِّرَجُلٍ هَلۡ يَسۡتَوِيَانِ مَثَلًاۚ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٢٩﴾ [الزمر: ٢٩] 

“আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছেন: একটি লোকের পরস্পর বিরোধী কয়েকজন মালিক, আরেক ব্যক্তির প্রভু মাত্র একজন, তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? (না-সমান নয়) সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ২৯]

মানুষের স্বভাব কঠিনতম মুহূর্তে, জটিলতম সমস্যায় এবং জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে, কপটতা শূন্য সত্য বের করে দেয়া। চাপহীন অনুভূতি, মুক্ত বিবেক, স্বাধীন চেতনা ও বাস্তব প্রকৃতির উন্মেষ গঠে তখন। অকপটে স্বীকার করে নেয় চিরসত্য, অমোঘ হক কথা। এ ক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার চিত্র এক ও অভিন্ন। প্রাগৈসলামিক ও ইসলামিক উভয় যুগেই এর উদাহরণ অগণিত, অসংখ্য।[59] আবু জাহেলের ছেলে ইকরিমাহ মক্কা বিজয়ের সময় সমুদ্রপথে পলায়নরত জাহাজে বসা, হঠাৎ তুফানের আক্রমণ, অকস্মাৎ তার অন্তরে এক আল্লাহর স্মরণ জাগরুক হলো, সাথে সাথে বুঝে আসল আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব। সে ডাকেই সাড়া দিয়ে পরবর্তীতে ঈমান নিয়ে আসেন।[60] রুশ দার্শনিক স্টালিনও এক আল্লাহর অস্তিত্ব বুকে বেধে বলেছিল, “আল্লাহ আমাদের স্কীম সফল করুন।”[61] কথিত আছে, জনৈক পণ্ডিত বেশ কয়েকটি ভাষায় অগাধ পারদর্শী ছিল, দ্বিধাহীনভাবে অনর্গল কথা বলত সবক’টি ভাষাতেই। তার স্বভাবজাত ও মাতৃভাষা কেউ জানত না। এ বিষয়টি জানার জন্য কৌতহলী সকলেই আরেক পণ্ডিতের শরনাপন্ন হলো। তার পরামর্শ, তোমরা তাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় এনে, মাঠের কোথাও রশির পেঁচ, ল্যাং বা অন্য কোনো কৌশলে নীচে ফেলে দাও, তখন সে ব্যাথাজনিত দুঃখ যে শব্দ দ্বারা প্রকাশ করবে, সেটাই তার স্বভাবজাত বা মাতৃভাষা। এ হলো মানুষের স্বভাবসিদ্ধ প্রকৃতি, এর উপর তিনি মানবজাতি সৃষ্টি করেছেন, আফসোস! মানুষ মোহান্ধ, স্বার্থপর, প্রবৃত্তির কারণে অন্তরদৃষ্টি ও শ্রবণইন্দ্রিয় বিকল করে স্বভাব-ধর্ম ত্যাগ করছে, জাহান্নামি হচ্ছে, যে জন্য তার পরিতাপের অন্ত থাকবে না।[62] অসাধু গুরুর অন্ধ অনুকরণ,[63] বিক্রিত পরিবেশ এবং অপরিণামদর্শী পিতা-মাতার কারণে হিন্দু-খৃস্টান-ইয়াহূদী-অগ্নিপুজক হয়ে যাচ্ছে।[64]

মোদ্দাকথা: একেশ্বরবাদ তথা এক আল্লাহর আকিদা-ই যুক্তিযুক্ত, স্বভাবসিদ্ধ ও প্রকৃতিগত। এ আকিদাই আল্লাহর মনোনীত,[65] ও গ্রহণীয়;[66] অন্য সব আকিদা ভ্রষ্ট,[67] পরিত্যাজ্য, যুক্তিহীন, স্বভাববিরোধী ও অপ্রকৃতিগত।

পরকালের আকিদা ও মানবপ্রকৃতি:

মানব প্রকৃতিতে আছে অনেক চাহিদা, প্রচুর আবেদন, বিচিত্র সখ ও বিনোদন ইচ্ছা। যা একমাত্র ইসলামি আকিদাই সমর্থন করে এবং এর মাধ্যমে তথা পরকালের আকিদার দ্বারাই তা পূর্ণ হয়। এখানে আমরা তার প্রকৃতির কয়েকটি নমুনা ও স্বভাব এবং ইসলামে তার সমর্থন ও বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করছি:

১. মৃত্যু ও মানুষ: মানুষ স্থায়ী হতে চায়, মৃত্যুকে ঘৃণা করে। সুস্থ থাকতে চায়, অসুস্থতাকে অপছন্দ করে। তারপরেও সে অস্থায়ী, মৃত্যু নিশ্চিত। সাময়িক সুস্থতা ও অসুস্থতা ক্ষণিকের ব্যাপার। এ জন্য সে হাজারো চেষ্টা-তদবির গ্রহণ করে, সম্পদ ব্যয় করে; স্বভাবের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির বিপরীতে। তবুও তাকে মরতে হয়, মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হয়। মৃত্যু নিশ্চিত।[68] কিন্তু পরকালের আকিদা তাকে এমন জগতের আশ্বাস প্রদান করে, যেখানে মৃত্যু হবে না, অসুস্থ হবে না, যৌবন লোপ কিংবা ক্ষয় প্রাপ্ত হবে না; চিরকাল থাকবে। সেখানে তার প্রকৃতি নিজস্ব স্বাদ আস্বাদন করবে।[69]

২. মানুষ ও প্রতিদান: মানুষ স্বাভাবিকভাবেই কর্মের ফলাফল প্রত্যাশী। সে জন্য সে বরাবরই চেষ্টা-মেহনতে নিরত থাকে। সে আরো চায় শিষ্টের পোষণ, দুষ্টের দমন; যথাযথ মূল্যায়ন, উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু এর বাস্তবায়ন সে পায় না দুনিয়াতে, সম্ভবও নয়। কারণ, যে ব্যক্তি একশটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে; ইনসাফ হলো, তাকে একশ বার হত্যা করা। কিন্তু দুনিয়াতে একবারের বেশি হত্যা কল্পনাতীত। ইসলামি আকিদা তাকে এমন এক জগতের দিশা প্রদান করে, যেখানে অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿كُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُودُهُم بَدَّلۡنَٰهُمۡ جُلُودًا غَيۡرَهَا لِيَذُوقُواْ ٱلۡعَذَابَۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَزِيزًا حَكِيمٗا﴾ [النساء: ٥٦] 

“তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আবার আমি তা পালটে দিব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আযাব আস্বাদন করতে থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, হিকমতের অধিকারী।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৬]

আরো বলেন,

﴿وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ﴾ [الانعام: ١٦٠] 

“আর যে একটি মন্দকাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে, তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬০]

অন্যত্র বলেন,

﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨﴾ [الزلزلة: ٧،  ٨] 

“যে কেউ অনু পরিমাণ সৎকর্ম করবে, দেখতে পাবে। আবার কেউ অনু পরিমাণ অসৎকর্ম করলেও দেখতে পাবে।” [সূরা আল-যিলযাল, আয়াত: ৭-৮] সুতরাং ইসলামি আকিদা তথা পরকালের বিশ্বাস মানুষের প্রকৃতির সমর্থক ও সামঞ্জস্যশীল।

৩. মানুষ ও সৌন্দর্যপ্রীতি: মানুষের প্রকৃতির মজ্জাগত স্বভাব হচ্ছে, সৌন্দর্য প্রীতি, সুস্থ্য দেহ, সুন্দর বাড়ি, সুন্দর নারী, সুন্দর গাড়ি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও হিংসা-বিদ্বেষহীন কলাহল বসতি। কিন্তু পার্থিব জগৎ একটির ভোগ, অপরটির আশা ও আরেকটির অপেক্ষায় নিঃশেষ হয়ে যায়। ইসলামি আকিদা তাকে এমন এক জগতের দিশা প্রদান করে যেখানে তার প্রকৃতির সমস্ত আবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে পূরণ হবে। সমস্ত সৌন্দর্য তার নখদর্পনে বিরাজ করবে। চিরসুখময় বাসস্থান জান্নাত লাভ করবে, যার সামান্য জায়গা দুনিয়া এবং তার ভিতরে যা আছে তা থেকে উত্তম।[70] এমন মনোরম দৃশ্য-শান্তিপূর্ণ আবাসন যা কোনো চক্ষু দর্শন করে নি, কোনো কর্ণ শ্রবণ করে নি এবং মানুষের অন্তরে যার কল্পনা পর্যন্ত হয় নি।[71] পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “কেউ জানে না তার কৃতকর্মের কী কী নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুকায়িত আছে।”[72] আমল ও সাধনার তারতম্যের অনুপাতে প্রত্যেকে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ পূর্ণিমা রাতের চাঁদের ন্যায় রূপ ও লাবণ্যে ষোলকানায় পূর্ণ অপরূপ আকৃতিতে, কেউ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায়।[73] কেউ আদম আলাইহিস সালামের ন্যায় ষাট হাত লম্বা আর সুস্থ শরীর নিয়ে প্রবেশ করবে জান্নাতে।[74] কারো সাথে কারো কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ থাকবে না, সকলের অন্তরসমূহ একটি অন্তরের নীতিতে পরিচালিত হবে।[75] আপোষে কোনো ক্রোধ থাকবে না, সবাই ভাই ভাই, সামনাসামনি উপবিষ্ট থাকবে।[76] দেহ ও শরীরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য  প্রত্যেককে একশত ব্যক্তির পানাহার ও সহবাস ক্ষমতা প্রদান করা হবে।[77] সৎকর্মশীলদের জন্য জান্নাতে ষাট মাইল বিস্তৃত মনি-মুক্তার তাবু হবে, তাদের পরিবার-পরিজন সেখানে অবস্থান করবে। তাদের পার্শ্ব দিয়ে আরো সৎকর্মশীলগণ ঘুরাফেরা করবে, কেউ কাউকে দেখবে না।[78] এভাবেই আখেরাত তথা পরকালে মানুষের প্রকৃতিগত সমস্ত বাসনা পূর্ণ হবে। শান্তি ও জীবনের নিশ্চয়তা লাভ করবে।

৪. মানুষ ও বাসনা: মানুষের মনে অনেক অনেক বাসনা। কিন্তু এ দুনিয়াতে তার বৃহৎ অংশই পূরণ হয় না, সম্ভবও নয়। ইসলামি আকিদা তাকে এমন জগতের দীক্ষা প্রদান করে যেখানে সমস্ত চাহিদা পূরণ হবে। আতিথেয়তাস্বরূপ ক্ষমাশীল, করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল দাবি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা আছে।[79] সবই তার প্রকৃতিগত চাহিদার বাস্তবায়ন, মননশীলতার পূর্ণ সমর্থন।

পার্থিব জগৎ এর কোনো একটি বাসনা পূরণের উপযুক্ত স্থান নয়। এ দুনিয়া একটি চাহিদা পূরণের জন্য সহায়কও নয়। প্রতিটি পদে বাধার আধার। নৈরাশ্য ও হতাশা ব্যতীত কিছুই অর্জন হয় না। যার ভিত্তিতে কোনো কোনো দার্শনিক দুনিয়াকে বিষাদ-তিক্ততা-দুঃখের আস্তানা বলেছেন। আরেকটি কারণ, দুনিয়া অস্থায়ী, পার্থিব জীবন ক্ষণ-ভঙ্গুর, এখানে সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, আলো-আধাঁর, সত্য-মিথ্যা, রাত-দিন, সকাল-সন্ধ্যা, জীবন-মৃত্যুসহ দ্বৈত ও বিপরীতমুখী জিনিসের সহাবস্থান। এর মাঝেই মানব ও তার প্রকৃতির বিচরণ। কখনো জয়ী, কখনো পরাজিত, কখনো প্রসন্ন, কখনো অবসন্ন। তাই মানব প্রকৃতির আবেদন এমন একটি জগৎ, যেখানে তার সমস্ত বাসনা পূর্ণ হবে, অনন্ত জীবন লাভ হবে, দুঃখ চিরদিনের জন্য বিদায় নিবে। আর তা-ই হল পরকাল বা আখেরাত, বাস্তবিক পক্ষে পরকালের আকিদা ছাড়া মানুষের জীবন ও প্রকৃতি নিরর্থক। আখেরাত ভিন্ন দুনিয়া অসম্পূর্ণ।[80]

৫. মানুষ ও ত্বরাপ্রবণতা: মানুষ সব বিষয়ে, সর্বক্ষেত্রে ত্বরাপ্রবণশীল। আল্লাহ বলেন,

﴿خُلِقَ ٱلۡإِنسَٰنُ مِنۡ عَجَلٖۚ ﴾ [الانبياء: ٣٧] 

“সৃষ্টিগতভাবে মানুষ ত্বরাপ্রবণ।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৩৭]

অন্যত্র বলেন,

﴿وَكَانَ ٱلۡإِنسَٰنُ عَجُولٗا﴾ [الاسراء: ١١] 

“মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয়।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১১] কর্মের প্রতিদান দ্রুত পেতে চায়; ইসলাম তার এ প্রকৃতির অবমূল্যায়ন করে নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা মজদুরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজদুরি পরিশোধ কর।[81] এ জন্যই হত্যা, ডাকাতি, মদ্যপান, যিনা ও চুরি জাতীয় বড় বড় অপরাধের শাস্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করার নির্দেশ প্রদান করেছে। আফসোস মানুষ এ প্রকৃতির ধর্ম ত্যাগ করে মানব রচিত ধর্ম ও সংবিধানের কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে প্রবৃত্তির বিচার ব্যবস্থায় বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে মানুষ তার প্রকৃতি বিরোধী এ ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। শক্তি থাকলে নিজেরাই হন্তাকে হত্যা করছে, ডাকাত,  চোরদের শাস্তি হাতেনাতে ধরেই দিয়ে দিচ্ছে। কখনো চোখ উপড়ে, কখনো হাত পা ভেঙ্গে, কখনো অক্কার মাধ্যমে, কখনো সন্দেহের বসে। লঘু অপরাধে বড় শাস্তি, বড় অপরাধে লঘু শাস্তি নিত্যদিনের ঘটনা। কথিত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হাতে গোনা দুএকটি ঘটনাই সোপর্দ হচ্ছে।

 ইসলামি আকিদার কিছু বৈশিষ্ট্য:

এক. ইসলামি আকিদার সার্বজনীনতা বিস্তৃত ব্যাপকতা: আকিদা বাহ্যিক আভ্যন্তরীণ মানবীয় সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ব্যঞ্জনা সমন্বিত। আকিদায় শরীর-বিবেক-আত্মা, আখলাক-চিন্তা-অনুভূতি দুনিয়া-আখেরাতের সকল বিষয় সন্নিবেশিত। মানবজগত তদীয় সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নেই, যা আকিদা থেকে বিচ্ছিন্ন অথবা আকিদা তার থেকে আলাদা। আকিদা মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, সম্পাদিত কর্ম অন্তরে বিচরণকৃত অনুভূতির সাথে জড়িত।

মানব জীবনের সর্বত্র সোচ্চার ও সক্রিয় এ আকিদা। বিভিন্ন আবর্তন ও পরিবর্তনের নিত্য সঙ্গী। পূর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, ইসলামি আকিদা: আল্লাহ, শেষ দিবস, ফিরিশতা, নবী-রাসূল, আসমানি কিতাব এবং ভালো-মন্দের তাকদিরের বিশ্বাস; ইহকালীন-পরকালীন উভয় জগতের আমল; বাহ্যিক আচার-আচরণ, বিবেকের চিন্তা-গবেষণা, আত্মার উপলব্ধি; ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, দেশ ও বিশ্বের মৌলিক নীতি ও আদর্শের সমন্বিত। স্রষ্টা আল্লাহ ও সৃষ্ট মানবের সেতু বন্ধন সমন্বিত। পারিবারিক, সামাজিক, মুসলিম মুসলিম ও মুসলিম অমুসলিম এবং মানবজাতি ও বিশ্ব স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক সমন্বিত।

মোদ্দাকথা: ইসলামি আকিদা অস্তিত্ববান প্রতিটি বস্তুর সমন্বিত আকিদা। ইসলামি আকিদার পরিধির মতো অন্য কোনো পরিধি নেই যা এত বিস্তৃত ও সর্বব্যপ্ত।

দুই. ইসলামি আকিদার একটি বিষয় অপর বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ও একটি আরেকটির পরিপুরক:

ইসলামি আকিদা শুধু উল্লেখিত ক্ষেত্র ও বিষয়ের সমন্বিত নয়, বরং আলোচিত ব্যাপকতার উর্ধ্বে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্তও। কারণ, এর একটি বিষয় অপর সকল বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়েই একটি পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানে রূপান্তরিত হয়েছে, যা মানবজাতির জীবনে সাফল্য বয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। আরেকটু সুক্ষ্মভাবে বলতে হয়, ইসলামি আকিদার প্রতিটি রুকন, প্রথম ও প্রধান রুকন তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহর প্রতি ঈমান এ আকিদার মূল ভিত্তি  ও শেকড়। যেমন, পরকালের বিশ্বাস- আল্লাহর ইনসাফ, হেকমত, আসমান-জমিন ও জীবন-মৃত্যুর সৃষ্টি রহস্যের সাথে সম্পর্কিত। সেখানে প্রত্যেকের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হবে, প্রত্যেক বস্তু তার মূল স্বভাবে ও প্রকৃতিতে উপস্থিত হবে।

ফিরিশতাদের ওপর বিশ্বাস, মূলত আল্লাহর কুদরত তথা আরেকটি সিফাতের ওপরই বিশ্বাস।[82] এ বিশ্বাস আল্লাহর সেই জীবন বিধানের আরেকটি ধারা, যার ওপর তিনি আমাদের পরিচালিত করতে চান। কারণ, তাদের মাধ্যমেই তিনি তার মনোনীত বান্দা নবী-রাসূলদের নিকট বার্তা প্রেরণ করেন। তাই ফিরিশতাদের ওপর ঈমান মূলত আলাদা কোনো জিনিসের ওপর ঈমান নয় বরং আল্লাহর উপর ঈমানের সম্পূরক, অন্যান্য রুকনের সাথে সম্পৃক্ত।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ঈমানের একটি রুকন অপর রুকনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আবার সবকটি রুকন আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত। অতএব আসমানি কিতাবের উপর ঈমান আল্লাহর বিধানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত, যা তিনি মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্যের জন্য দিয়েছেন।

তদ্রূপ নবীদের ওপর ঈমানের সাথেও সম্পৃক্ত, কারণ তারাই ফিরিশতাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত ওহীর দ্বারা আমাদের পর্যন্ত এ বিধান পৌঁছিয়েছেন।

তাকদীরের ওপর বিশ্বাসও আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত, কারণ একমাত্র তিনিই এ বিশ্বপরিমণ্ডলের নিয়ন্ত্রক, পরিকল্পনাকারী। কল্যাণ-অকল্যাণ, নিষ্ট-অনিষ্ট একমাত্র তার থেকেই উৎসারিত হয়।

মোদ্দাকথা, এ আলোচনার দ্বারা বুঝতে পারলাম- ঈমানের বিষয়ে আরকানুল ঈমান তথা বিশ্বাসের একটি শাখার সাথে অপর শাখার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী।

এ আকিদা থেকে উৎসারিত আমলও ঠিক একই রকম। অর্থাৎ দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতের আমল সমন্বিত। এখানে বলতে চাই এ আকিদার বৈশিষ্ট্য, দুনিয়া-আখেরাতের আমলের মাঝে পাথর্ক্য না করা। এ আকিদায় কোনো আমল শুধু দুনিয়া কিংবা শুধু আখেরাতের জন্য নির্দিষ্ট নয়, বরং প্রত্যেকটি আমল এক বিবেচনায় আখেরাতের, অন্য বিবেচনায় দুনিয়ার কল্যাণে নিবেদিত।

সাধারণত আখেরাতের আমল হিসেবে যা কিছু বিবেচ্য, তাও পার্থিব জীবনের আবেদন কিংবা সম্পূরক। যেমন,

সালাত: এর দ্বারা পার্থিব জগত সুসজ্জিত, পরিমার্জিত ও অশ্লীলতা মুক্ত হয়।[83]

সাওম: এর দ্বারা ক্ষুধা ও দারিদ্রের দুঃখ অনুভূত হয়। অনাথ ও অভাবিদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহানুভূতির প্রেরণা সৃষ্টি হয়। যার বাস্তবায়নে এ দুনিয়া শ্রীহীনতা, পরস্পর সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় ভরে উঠে।[84] এমনিভাবে এ আকিদার সমস্ত ইবাদত, আখেরাতের জন্য যেমন কাম্য, তেমন দুনিয়াতেও তা কাম্য।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে সমস্ত আমল বাহ্যত শুধু পার্থিব বলে মনে করি, যেমন পানাহার,  বস্ত্র পরিধান, দাম্পত্য জীবন ও পৃথিবীর আবাদ। সেগুলোও অপার্থিব কিংবা আখেরাতের আমল। তবে এর সাথে কিছু শর্তের প্রয়োজন। অর্থাৎ এ আমল দ্বারা আখেরাতের প্রতিদান পাওয়ার জন্য হালাল-হারাম এবং আল্লাহর নির্দেশের অনুসরণ জরুরী। তাহলে এ সমস্ত আমল ইসলামের দৃষ্টিতে মূল ইবাদত বলে গণ্য হবে। যেহেতু এর ভিতর আল্লাহর নির্দেশ মান্য ও তার সন্তুষ্টির নিয়্যত করা হয়েছে।[85] এভাবেই এ আকিদায় বিশ্বাসী মানব সম্প্রদায় হতে উৎসারিত সমস্ত আমল দুনিয়া আখেরাতের সাথে সংযুক্ত, ইসলামি আকিদার সাথে সম্পৃক্ত।

ইসলামি আকিদা ও মানব অবয়ব:

আমরা আগেই বলেছি, ইসলামি আকিদা মানবজাতির দৈহিক, মানসিক এবং অন্তরাত্মার সবকিছু নিয়ে গঠিত। তাই বলে এগুলো পৃথক পৃথক নয়। তবে এতটুকু ঠিক: কখনো দৈহিক কর্মচঞ্চলতা প্রাধান্য পায়, যেমন পানাহার ও স্ত্রী সহবাস। কখনো চিন্তাশক্তি প্রাধান্য পায়, যেমন- চিন্তা ও গভীর মনোযোগসহ গবেষণা। কখনো আত্মার কর্ম প্রাধান্য পায়, যেমন- ইবাদতের সময় ইত্যাদি...। কিন্তু ইসলাম এগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনা করে না। যেমন পানাহার এবং স্ত্রী সহবাসের সময় হালাল-হারাম বিবেচনা ও আল্লাহর নাম স্মরণ করার ফলে এর উপকারিতা শুধু শরীরে সীমাবদ্ধ থাকে না, পরকালীন ইবাদত বলেও গণ্য হয়। চিন্তার সময় খারাপ বিষয় থেকে বিরত থাকা, ভালো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা এবং আল্লাহকে নাজির ও ভয় করার ফলে এ চিন্তাও শুধু তার বোধশক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, ইবাদতে পরিগণিত হয়। খালেছ ইবাদতেও শরীর, বোধশক্তি এবং আত্মা সমানভাবে সক্রিয় থাকার ফলে এ সবের অনুশীলন হয় যথাযথভাবে। যেমন সালাত- এখানে শুধু আত্মার কর্মই নয়, বরং তাতে উঠা-বসা, রুকু-সাজদার মাধ্যমে যোগ হয় শরীর, কুরআনের আয়াতে ধ্যান করার কারণে যোগ হয় আত্মা। এ জন্যই বলা হয়, “তুমি সালাতের ততটুকুই উপকৃত হবে, যতটুকু তুমি বিবেকে ধারণ করতে পেরেছ।”

ইসলামি আকিদা ও সমাজ:

আমরা আগে বলেছি ইসলামি আকিদা ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র সব কিছুকে সমন্বিত করে। এখানে বলতে চাই, ইসলামি আকিদা এসব বিষয়গুলো আলাদা করে বিবেচনা করে না। এমন নয়, ব্যক্তিকে এক মানদণ্ডে আর সমাজকে অন্য মানদণ্ডে পরিচালিত করে। বরং উভয়কে একই মানদণ্ডে পরিচালিত করে তবে উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভিন্ন।

মানদণ্ড বলতে আল্লাহর প্রতি ঈমান, তাকওয়া এবং তার নির্দেশিত বিধি-বিধান। এ মানদণ্ডের আওতায় কিছু দায়িত্ব সম্পাদন করে ব্যক্তি, আর কিছু দায়িত্ব সম্পাদন করে সমাজ। কিন্তু উভয়ে একমানদণ্ড-একদীক্ষায় পরিচালিত হয়। অতএব, আমরা বলতে পারি এ আকিদায় বিশ্বাসী বিভিন্ন জাতি-গোত্র বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য এক-অভিন্ন। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে আলাদা হলেও তাদের উদ্দেশ্য এক। ব্যক্তি-সমাজ, রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব কেউ কারো প্রতিপক্ষ কিংবা দুশমন নয়। যেমনটি হয়ে আছে জাহিলিয়্যাতপূর্ণ সমকালীন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দুই মেরু। একদিকে অত্যাচারী শাসক অন্যদিকে অত্যাচারিত জনতা কিংবা একদিকে সংঘবদ্ধ জনতা অন্যদিকে নিঃসঙ্গ জননেতা।

তদ্রূপ জাতি ও রাষ্ট্র এক নীতির শরণাপন্ন, এক আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর হুকুম অনুযায়ী সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সকলেই বাধ্য ও পরিকরবদ্ধ। অধিকন্তু এ বিষয়টি আকিদার মেরুদণ্ডও বটে। অন্যথায় সে আকিদা হতে বহিস্কৃত, আল্লাহতে অবিশ্বাসী।[86]

আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধের ব্যাপারেও জাতি-রাষ্ট্র সকলেই সমান, সবারই দায়িত্ব। অধিকন্তু এ বিষয়টি আকিদার আবেদন, শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার সনদও বটে।[87] রাজা-প্রজা উভয়েই একে অপরের সহযোগী ও সহকর্মী। উভয়ের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন।

ইসলামি আকিদা ও পারস্পরিক সম্পর্ক:

ইতোপূর্বে আমরা বলে এসেছি ইসলামি আকিদা মানুষের আত্মা ও আল্লাহর সেতু বন্ধন। এখানে বলে রাখি এ সকল সম্পর্ক এক লক্ষ্যে এসে একত্রিত ও সংযুক্ত হয়, অর্থাৎ আল্লাহর উপর ঈমান আনা ও তার ইবাদত করা। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের অর্থ তার ওপর ঈমান আনা, তার ইবাদত করা। নিজ আত্মার সাথে সম্পর্কের অর্থ তাকে সংশোধন করা। আর তা সম্ভব হয় আল্লাহর উপর ঈমান, ইবাদত এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চলার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্কও পূর্ণতা পায়। সমস্ত সম্পর্ক এভাবেই এক-ই গ্রন্থিতে স্থাপিত হয়, যার নীতি নির্ধারক একমাত্র ইসলামি আকিদা তথা ঈমান। আর এভাবেই ঈমানের একটি শাখা আরেকটি শাখার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

তিন. ভারসাম্য: এই আকিদা দৈহিক-মানসিক, ইহকালীন-পরকালীন, ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র যাবৎ কিছুর সমন্বিত আকিদা। অধিকন্তু এটি সামগ্রিক বিবেচনায় ভারসাম্যপূর্ণও বটে। যা বিকশিত হয় বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিভিন্ন স্তরে। যেমন,

১- শরীর-আত্মা বা বাহ্যিক-অভ্যন্তরীণ জগতদ্বয়ের মাঝে ভারসাম্য।

২- দৃশ্য-অদৃশ্য জগতের মাঝে ভারসাম্য।

৩- তাকদীরের ওপর বিশ্বাস এবং আসবাব নির্ভরতার মাঝে ভারসাম্য।

৪- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনের মাঝে ভারসাম্য।

এসব ক্ষেত্র ও তার বিষয়াদি নিয়ে আমরা সামান্য আলোকপাত করছি।

১- মানুষ একমুষ্টি মাটি ও আল্লাহর নির্দেশ তথা আত্মার সমষ্টি। উভয়ের মাঝখানে ইসলামি আকিদা ভারসাম্য রক্ষা করেছে। আমরা যদি একের প্রতি অপরের তুলনায় বেশি গুরুত্বারোপ করি তাহলে ভুল করব। জাহিলিয়্যাত তথা মূর্খতা সব সময় এক পক্ষ অবলম্বন করে, ভারসাম্য রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। যেমন, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় আধ্যাত্মিকতার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করে। সমসাময়িক কালের পাশ্চাত্য সমাজ কায়িক ও দৈহিকতার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করে। ফলে একদল দুনিয়াতে বসবাসের অযোগ্য, অপর দলটি মনুষ্য জীবন-যাপনের অনুপযুক্ত- পশুত্বের মতো জীবন-যাপন ও যৌনতায় লিপ্ত।

এ ক্ষেত্রে ইসলামি আকিদার বৈশিষ্ট্য উভয়ের মাঝখানে সঠিক ও নির্ভুল ভারসাম্য রক্ষা করা। একদিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এ আকিদা কর্মের ও ইবাদতের ময়দানে দৈহিক জগত ও আত্মিক জগত উভয়কে সুষমভাবে সমন্বিত করে রেখেছে। অপর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এ আকিদা উভয়কে পৃথক পৃথক ন্যায্য প্রাপ্যও প্রদান করেছে। মানবজাতিকে দৈহিকতায় ব্যস্ত রেখে আধ্যাতিকতা শূন্য করে দেয় নি- যেমন সমসাময়িক জাহিলিয়্যত ও মূর্খতা। আবার আধ্যাত্মিকতায় ব্যস্ত রেখে দৈহিক আবেদন নিঃশেষ করে দেয় নি- যেমন হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:

أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي»

“জেনে রেখো, আমি তোমাদের ভেতর আল্লাহকে অধিক ভয় করি এবং অধিক মান্য করি। তা সত্ত্বেও আমি সাওম পালন করি, সালাত আদায় করি, ঘুমাই, বিবাহ করি। (এ হলো আমার সুন্নত) যে আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার পক্ষের নয়।”[88] এভাবেই ইসলামি সংস্কৃতি-সভ্যতা এ আকিদা কেন্দ্রিক কায়িক ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে গড়ে উঠে।

২- ইসলামের একটি আবেদন অদৃশ্যের উপর ঈমান। অর্থাৎ আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান। তাই বলে পার্থিব জগত নিষ্ক্রিয় রাখতে বলে নি। বরং এ আকিদার মৌলিক বিষয়াদি শক্তভাবে আকড়ে ধরার জন্য পার্থিব জগতে আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি গভীর দৃষ্টি প্রদানের আহ্বান করে। যার ফলে আল্লাহর প্রতি ঈমান হয় আরো দৃঢ়, আরো মজবুত। এ নীতির ফলেই ইসলাম সে সমস্ত কট্টরপন্থীদের নীতি ও আদর্শ থেকে ভিন্ন যারা বলে আমরা আল্লাহর দর্শনে নিমগ্ন, আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির দর্শন আমাদের প্রয়োজন নেই। তদ্রূপ ইসলাম এমন আবেদনও করে না যে, অদৃশ্য জগত অগ্রাহ্য করে, দৃশ্য জগত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাও। অর্থাৎ আল্লাহ ও আখেরাত থেকে বিমুখ হয়ে যাও। যেমন আধুনিক কালের সমসাময়িক মূর্খতা।

৩- ইসলাম দুনিয়া-আখেরাতের মাঝখানে কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। বরং সে উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন এবং উভয়কে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত করে। অন্যথায় মানবীয় উপলব্ধিতে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। যার ফলশ্রুতিতে হয়তো দুনিয়ার কর্মব্যস্তায় ব্যাপৃত হবে কিংবা শুধু আখেরাতের আমলে আত্মনিয়োগ করবে। তখনই দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা। রিযিক ও বিত্ত-বৈভবের সন্ধানে আস্তে আস্তে আখেরাত ভুলে দুনিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে কিংবা দুনিয়ার সামগ্রী ও তার আবাদ থেকে বিমুখ হয়ে আখেরাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যা ইসলামের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য, আল্লাহর বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আল্লাহর বিধান: নি‘আমত দ্বারা আখেরাত অন্বেষণ করার সাথে সাথে দুনিয়ার হিস্যা পরিত্যাগ না করা।[89] এ বিধান মতেই ইসলাম প্রতিটি ক্ষেত্রে দুনিয়া-আখেরাতের সমন্বয় নিশ্চিত করে সামনে অগ্রসর হয়। ইবাদত কিংবা দুনিয়ার আবাদ কোনোটিই অগ্রাহ্য বা মূল্যহীন জ্ঞান করে না।

৪- তাকদীরের ওপর বিশ্বাস মুসলিম উপলব্ধিতে আসবাব নির্ভরতা ও তাকদীরের মাঝখানে ভারসাম্য তৈরি করে। অধিকন্তু তাকদির ইসলামি আকিদার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যও। তথাকথিত আল্লাহর ওপর ভরসাকারীরা দুনিয়ার উপায়-উপকরণ ত্যাগ করে অভাব-অনটন, রোগ-ব্যধি, অজ্ঞতা-মূর্খতা, অক্ষমতা ও অমর্যাদার সম্মুখীন হয়। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য (জাহিলিয়াত পূর্ণ) সমাজ আল্লাহ ও তাকদীর বিমুখ হয়ে সম্পূর্ণ উপকরণ নির্ভর। যার ফলে বস্ত্তবাদী, চরিত্রশূন্যতা ও মানুষ্যত্বহীন হয়ে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ, অস্থিরতা, স্বার্থপরতা, স্বদলপ্রীতি, স্বজাতপ্রীতি, অন্ধত্ব, হত্যা সর্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞে পর্যবসিত। কারণ, এ সমাজ আল্লাহর স্মরণ এবং তাকদিরের বিশ্বাস জনিত শান্তি ও নিরাপত্তা বঞ্চিত।

ইসলাম বিপরীতমুখী দুই মেরুর মাঝখানে সুষম ভারসাম্য নিশ্চিত করে। সে জানে পার্থিব জগত এবং মানবীয় জীবন আল্লাহর নির্ধারিত বিধান মুতাবিক চালিত। তাই শুধু দুনিয়াবী উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হলে, সে উপকরণ নির্ভর হয়ে পড়বে। কিন্তু না- তাকে এর সাথে সাথে আল্লাহ নির্ভর হতে হবে, স্বীয় উদ্দেশ্য ও স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তার নিকট প্রার্থনা করতে হবে। তবেই ভারসাম্য সৃষ্টি হবে, অর্থাৎ কাজও করবে-উপকরণও ধরবে এবং তাকদিরের উপর বিশ্বাসও রাখবে।

মোদ্দাকথা: মানবীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পরিধির মাঝখানে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী একমাত্র ইসলামি আকিদা। এখানে দৈহিক বিবেচনা আত্মিক বিবেচনার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। রাজনৈতিক চিন্তাধারা অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। তদ্রূপ অর্থনৈতিক চিন্তাধারা চারিত্রিক বিবেচনাকে বির্সজন দিতে পারে না। বরং সবাইকে আল্লাহ এবং তার নাজিলকৃত বিধানের অক্ষ ও গণ্ডির আওতায় এনে সবার মাঝে সমতার বিধান নিশ্চিত করে। ফলে মানবীয় সমস্ত আবেদন সমানভাবে সহবাস্থান করার সুযোগ লাভ করে।

 ইসলামি আকিদার প্রভাব:

ইসালামি আকিদা: একটি পোষাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান যাতে উৎপাদন হয় বিচিত্র রং, বিভিন্ন সাইজ, হরেক ডিজাইন নিয়ে মনাবদেহের নিন্মাংশ, উর্ধ্বাংশের অভিজাত পোষাক, দেহাবরণ। যার ব্যবহারে মানুষ হয়ে উঠে রুচিশীল, শালীন, মার্জিত, সামাজিক ও সভ্য। পোষাক বা দেহাবরণ প্রত্যাখ্যানকারী মানব প্রকৃতি বিবর্জিত, রুচিহীন, অশালীন, অসামাজিক ও অসভ্য। তদ্রূপ ইসলামি আকিদা একজন মানুষকে উত্তম চরিত্র ভূষণে আবৃত, নন্দিত, সমাদৃত, সৃজনশীল করে তুলে। আরো করে তুলে মাতা-পিতার আনুগত্যশীল,[90] বড়দের সাথে শ্রদ্ধাশীল, ছোটদের প্রতি স্নেহময়,[91] পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহারকারী,[92] বন্ধুবান্ধবদের বিশ্বস্ত,[93] অপরের অধিকার ও হক আদায়ে অধিক যত্নশীল, নিজের অধিকারের জন্য নমনীয়। ক্ষমাশীল, উদার, পরপোকারী।[94] এ আকিদার বাইরে লালিত ব্যক্তি স্বার্থপর, নির্দয়, অবাধ্য, দুষ্ট ও পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য আতঙ্ক।

মুসলিম মিল্লাতের অনুসৃত ও বাস্তব জীবনে অনুশীলনকৃত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার নিরিখে মানবীয় জীবনে ইসলামি আকিদার প্রভাবের ওপর আমরা একটি মূল্যায়ন বা প্রতিবেদন তৈরী করতে পারি। মুসলিম জাতির জন্য মনোনীত দীন তথা ইসলামের প্রতি আল্লাহর অপার কৃপা, তিনি এ দীনকে বাস্তব ময়দানে অনুসৃত একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস প্রদান করেছেন। যার ফলে এ আকিদা কিছু প্রতীকি আনুষ্ঠানিকতা আর ধারণা প্রসূত অবকাঠামোয় সীমাবদ্ধ নয়, বরং ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ভর দেদীপ্যমান উপাখ্যান। মানব ইতিহাসে এ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, যে “তারা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের কল্যাণের জন্য প্রেরিত।”[95] কারণ, এ জাতি তার জীবনে কুরআন বাস্তবায়ন করেছে। মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাব্য সাধ্যানুপাতে কুরআনের রঙ্গে রঙ্গীন হয়েছে। তাই মানবীয় জীবনে ইসলামি আকিদার প্রভাব প্রত্যক্ষ করার জন্য এ জাতির প্রথম প্রজন্ম, বিশেষ করে প্রথম ব্যক্তিকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করাই যথেষ্ট। তবেই আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে এ আকিদার এক একটি মৌলনীতি ও আদর্শের প্রভাব ও ক্রিয়া।

ইসলামি আকিদার মূল ভিত্তি তাওহীদ:

ঐতিহাসিক পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে প্রমাণিত মানবীয় জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী একমাত্র আদর্শ তাওহীদ। শর্ত এর আলোকে মানসিক চিন্তাধারা, আবেগ-অনুভূতি ও আচরণবিধির সুষ্ঠু পরিচালন। এ আকিদায় পরিতৃপ্ত ব্যক্তি যে পরিমাণ ত্যাগ, যে পরিমাণ কষ্টসাধ্য কর্ম সম্পাদন করতে পারে, তা এ আকিদাশূন্য অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

ইসলাম তার প্রথম যুগের অনুসারীদের দ্বারা যে বিরল দৃষ্টান্ত পেশ করেছে, তা সমগ্র মানব ইতিহাসে অদ্বিতীয়। যা শুধু আবূ বকর, উমার, উসমান, আলী কিংবা ইতিহাসে জাজ্বল্যমান সীমিত কতক নামসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যদিও এ নামগুলোর মানব ইতিহাসে জুড়ি মেলা ভার। তদুপরি তাদের ভিন্ন হাজার হাজার ব্যক্তি ও উদাহরণ বিদ্যমান আছে, ইতিহাস যাদের লিপিবদ্ধ করতে অক্ষম-অসমর্থ, অসম্পূর্ণ-অপর্যাপ্ত। তাই তো আমরা লক্ষ্য করি, ঐতিহাসিকগণ এ জাতির সমৃদ্ধ-বিক্ষিপ্ত দেদীপ্যমান ইতিহাস আদ্যপান্ত লিপিবদ্ধ করার স্বীয় অসামর্থতা প্রত্যক্ষ করত শুধু ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে এক পর্বের শিরোনাম থেকে অন্য পর্বের শিরোনাম আবিস্কার করছে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে এ আকিদার উর্বর ভূমি থেকে এ ধরনের দৃষ্টান্ত অঙ্কুরিত হওয়াই স্বাভাবিক।

উদাহরণত: আল্লাহর রাস্তায় জেহাদের জন্য উৎসর্গিত সে সৈনিকের ব্যাপারটি আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করবো? যে হাতে বিদ্যমান কয়েকটি খেজুর এ বলে নিক্ষেপ করেছিলো, এগুলো খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাও দীর্ঘ হায়াত বৈকি? অতঃপর তা নিক্ষেপ করে শাহাদাতের অদম্য স্পৃহায় যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে, আর স্বর্গীয় সুধা পান করে সচল দেহ নিথর করে পার্থিব অধ্যায়ের ইতি টানে।

পারস্যের মোকাবেলায় সে যুদ্ধবাজ লড়াকুর মূল্যায়ন কীভাবে করবো, যে স্বীয় বর্ম পরিধান করলে সাথীরা তাতে ছিদ্র দেখে সাবধান করে দেয়, এবং পরিবর্তন করতে বলে। সে হেসে উত্তর দিল এ ছিদ্রজনিত আঘাতে মারা গেলে অবশ্যই আমি আল্লাহর কাছে সমাদৃত হব। কালক্ষেপন না করে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে সে। অকস্মাৎ ছিদ্র দিয়ে আঘাত হানে একটি তীর, ফলে সহাস্য বদনে চক্ষুশীতলকারী শাহাদাত আলিঙ্গন করে সে। এ উপলব্ধি নিয়ে- আল্লাহর নিকট সম্মানিত সে, যেহেতু তার মন স্বতঃস্ফুর্ত সায় দিয়েছে শাহাদাতে।

কীভাবে মূল্যায়ন করবো তাদের নজিরবিহীন পরোপকারের মাহাত্ম্য? যারা সংগ্রহে রাখা সমস্ত খেজুর নিয়ে খেতে বসে, অতঃপর একজন মেহমান উপস্থিত হলে, বাতি নিভিয়ে দেয় এবং মেহমানের সামনে খেজুর পেশ করে, যাতে সে বুঝতে না পারে- এটুকুই তাদের সমস্ত খাদ্য, এবং যাতে খানা থেকে বিরত না হয়।[96]

প্রতিটি ব্যাপারে এ ধরনের হাজারো উদাহরণ বিদ্যমান আছে, আর প্রত্যেকটি উপমাই এমন স্তরের যা মানব কৃতিত্বের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

আমরা এখানে সীমিত কয়েকটি দফায় মুসলিম মিল্লাতের জীবনে এ আকিদার প্রভাব ও কার্যকারিতা নিয়ে আলোকপাত করবো। অতঃপর এ আকিদা প্রত্যাখ্যানকারীদের জীবনেও এর প্রভাব সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করবো।

আল্লাহর ভয়-ভীতির গভীর উপলব্ধি এবং কিয়ামত দিনের ভাবনা:

যার ফলে স্বীয় চাল-চলন নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসে, দায়িত্ববোধ ও মানব কল্যাণের চেতনা জাগ্রত হয়। উদাহরণত আমরা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর বায়তুলমাল থেকে গ্রহণকৃত ভাতার ব্যাপারে প্রেক্ষাপট উল্লেখ করতে পারি। এবং তার প্রসিদ্ধ সে বাণী  “যদি ইয়ামানের সানআতে কোনো গাধার পা পিছলে যায়, তার ব্যাপারেও আমি জিজ্ঞাসিত হবো, কেন আমি তার রাস্তা সমতল করে দিই নি?” পেশ করতে পারি।

এ হলো ইসলামি আকিদায় সিঞ্চিত, পরিতৃপ্ত, এর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত, এর রঙে রঙ্গিন মুসলিম জাতি থেকে উৎসারিত, ইসলামি সামাজের উৎপাদিত যৎসামান্য স্মৃতি, কতক নমুনা। সারসংক্ষেপে আমরা বলতে পারি- এ আকিদার দ্বারা সৎ-নীতিবান, আল্লাহ ভীরু ও মানবতার কল্যাণকামী মানুষ তৈরি হয়। ব্যাপক অর্থে আল্লাহর একজন গোলাম বা আবেদ, যে স্বীয় কাজ-কর্ম, চিন্তা-চেতনাবোধ ও অনুভূতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির  লক্ষ্যে কাজ করে, তার নির্দেশ পালন করে। উচ্চারণ করে পূর্ণতৃপ্তি নিয়ে, “আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু দুজাহানের প্রতিপালক-আল্লাহ তা‘আলার জন্য।”[97] জাগতিক চাহিদার ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকারী, প্রতিমা-দেবতার অর্ঘ্য-আরাধনা পরিত্যাগ করে এক আল্লা­হর ইবাদত-আনুগত্যে আত্মনিয়োগকারী এবং স্বীয় চাল-চলন, চিন্তা-গবেষণা ও পার্থিব জগতের উন্নয়নে বোধ-বুদ্ধির ভারসাম্যে যত্নশীল ব্যক্তিই আল্লাহর সন্তুষ্টিকে পাথেয় বানাতে পারে।

 সাধারণভাবে অমুসলিমদের ওপর ইসলামি আকিদার প্রভাব:

যারা ইসলাম গ্রহণ করে নি। বরং ক্রুসেড ও অন্যান্য যুদ্ধে ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে পৈচাশিকতাপূর্ণ নঘ্ন আঘাত হেনেছে। সে ইউরোপের ইসলাম ও মুসলিম থেকে শিক্ষণীয় কতক বিষয় উল্লেখ করছি।

মধ্য যুগীয় পতনোন্মুখ ইউরোপ আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞতায় বাস করছিল। যার সরকার ও পুরোহিতগণ আপ্রাণ চেষ্টায় নিরত ছিল- কীভাবে ক্ষমতাধর রাজত্ব মানুষের আত্মা ও অন্তরে সমহিমায় বিদ্যমান রাখা যায়। তাদের রাজ্যগুলো ছিল প্রাদেশিক কেন্দ্রিক, খণ্ড-বিখণ্ড ও মিলন সূত্রহীন। যদিও সম্পূর্ণটাই খৃষ্টরাজ্য ছিল। কারণ, প্রাদেশিক সরকার তার রাজত্বে স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্রীয়, বিচার-বিভাগীয় আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়নসহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল।

আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে: পোপতন্ত্রের ক্ষমতা ও দাপটের যাঁতাকল মানুষের অন্তরাত্মা, চিন্তা-চেতনাকে দাসত্বে আবদ্ধ রেখেছিল। অবৈধভাবে মানুষের শ্রম ও সম্পদ কুক্ষিগত করছিল।[98] এ অবস্থার এক পর্যায়ে এসে ইউরোপ ইসলামের মুখোমুখী হয় সার্বিকভাবে। কখনো সন্ধি চুক্তির বিনিময়ে: যেমন মুসলিম স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, সিসিল দ্বীপ ও অন্যান্য দেশের সাথে। কখনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে: যেমন প্রায় দুই যুগ ধরে ক্রুসেড যুদ্ধ। এ শান্তি চুক্তি ও যুদ্ধের বাস্তবতায় ইউরোপ ইসলামের মুখোমুখী হয়ে যে শিক্ষা অর্জন করেছে, যেভাবে প্রভাবিত হয়েছে, তার সামান্য নমুনা নিম্নে পেশ করলাম:

১. ইউরোপ পুর্ণাঙ্গ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করে এবং সাইন্টেফিক গবেষণায় ইসলামের প্রায়োগিক পদ্ধতি অবলম্বন করে। যার ওপর ভিত্তি করেই তাদের বর্তমান বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার উৎপত্তি।

২. ইসলামি ঐক্যবদ্ধতার নীতি অনুসরণ তথা খেলাফত পদ্ধতি গ্রহণ করে, যা এক বাঁধনে আবদ্ধ, এক সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত। তবে তারা সেটাকে বিশ্বাস বা আকিদার ওপর নির্ভরশীল করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। কারণ তাদের আকিদা ভ্রান্ত-বিকৃত, পুরোহিতরা অন্যায় প্রবণ-দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে জাতীয়তার রূপায়নে তারা তাদের ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করে। অদ্যাবধি সে নীতির ওপর-ই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ চলমান।

৩. কার্লফন, মার্টিন লুসার ও অন্যান্যরা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে আকিদা ও গীর্জার ভ্রান্তমতবাদ ও বিকৃত সিদ্ধান্তের সংস্করণ চেষ্টা করেন। তবে ভারসাম্যহীনতা ও অশ্লীলতায় আচ্ছন্ন বিশৃংখলার ভেতর কিঞ্চিত মাত্র সাফল্য লাভ হয়। কারণ, পরিশুদ্ধকরণ ও ভারসাম্য সমৃদ্ধ করণের মূল চাবিকাঠি ইসলামকে তারা প্রথমেই পরিত্যাগ করেছে।

৪. ইসলামি বিদ্যাপিঠের নিয়ম পদ্ধতি সংগ্রহ করে এবং তার অবকাঠামোর ওপর তারা নিজস্ব বিদ্যাপিঠগুলোর রূপরেখা তৈরি করে।

৫. অশ্বারোহণ বিদ্যার প্রচলন। মুসলিমদের বিচক্ষণতা, দুঃসাহসিকতা, আদর্শ গ্রহণের যথাসাধ্য প্রয়াস।

৬. শাসক শ্রেণির প্রবৃত্তি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে সংবিধান রচনার সূত্রপাত। বরং অধিকাংশ মূলনীতি তারা ইসলামি ফিকহ থেকে গ্রহণ করে। যেমন ফ্রান্সের নগরায়নের অধিকাংশ বিধান-পদ্ধতি মালেকী ফিকহ থেকে সংকলিত হওয়া এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। কারণ, উত্তর আফ্রিকায় প্রসারিত মালেকি মাযহাব-ই তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী ছিল।

৭. ইসলামি নির্মাণ কৌশল ও স্থাপত্য পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। ধর্মীয় কিংবা সাধারণ সব প্রাসাদে তার হুবহু অনুকরণ। সর্বোতভাবেই তারা প্রভাবান্বিত হয় ইসলামি নিখুঁত পদ্ধতির মাধ্যমে। তার ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ: ঘরে বাথরুমরের অন্তর্ভুক্তি। গোসলের মাধ্যমে শরীর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা। মুসলিমের সংস্পর্শে আসার আগে ইউরোপ কোনো দিন এ অভিজ্ঞতার স্বাদ পায় নি।

৮. ভৌগলিক রুপরেখা: ইসলামি মানচিত্রের মাধ্যমে তারা প্রচুর উপকৃত হয়। সে অনুপাতে মানচিত্রের ত্বরিত উন্নতির ব্যাপারে তারা ভূমিকা রাখে।

৯. সারসংক্ষেপ: ইউরোপ তার বর্তমান প্রগতি ও উন্নতির মূল রসদ গ্রহণ করেছে ইসলাম হতে। যদিও বর্তমান যুগে এসে ইসলাম ও মুসলমানের সক্রিয় প্রভাব তাদের জীবনে জড়তায় পর্যবসিত হয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও স্বজাতপ্রীতির অন্ধত্বে দূরে নিক্ষেপ করেছে ইসলাম।

বর্তমান যুগে আমাদের চার পাশের ইসলামী বিশ্বে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এর কোনো সঠিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। তাহলে কী ইসলামি আকিদা স্বীয় ঐতিহ্য ও কার্যকারিতা শূন্য হয়ে গেল? না, কখনো নয়। ইসলাম কোনো অংশে তার কর্মক্ষমতা হারায়নি। কারণ, এটা কার্যকর ও সক্রিয় আল্লাহ তা‘আলার জীবন বিধান। যার মাধ্যমে সরাসরি মানব জীবন সঠিক পথে পরিচালিত হয়। নির্ভুল ও পরিশুদ্ধভাবে স্বীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। তবে মূল ব্যাপার হলো: এ আকিদা তখনই কাজ করবে যখন মানুষ স্বীয় শরীর ও বাস্তব জীবনে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।[99] এটাই আল্লাহর বিধান- যার কোনো পরিবর্তন নেই। মানুষের প্রচেষ্টা ব্যতীত, ফলপ্রসূ উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা ছাড়া, কখনো মানুষের অবস্থা পরিবর্তন হবে না। মানুষের জীবন অধ্যায় পরিচালনার জন্য ইসলামি আকিদার চালিকা শক্তির মতো অন্য কোনো চালিকা শক্তি নেই। কিন্তু সে তাকে-ই পরিচালনা করবে, যে ইসলামকে আলিঙ্গন করবে, তার প্রতি মননিবেশ করবে এবং বাস্তব জীবনে তার বাস্তবায়নের জন্য জীবন-মরণ পণ করবে।

উদাহরণত: মনে করুন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সর্বদাই কাজ করতে প্রস্তুত। কিন্তু তার যদি কোনো সংযোগ দানকারী না থাকে, তবে কি উপকারে আসবে?

অথবা মনে করি সে সক্রিয়। কিন্তু কেউ যদি তার থেকে শক্তি সঞ্চয় না করে তবে কি লাভ হবে? আমরা কি বলব- বিদ্যুৎ প্রভাব শূন্য হয়ে গেছে? না-কি বলব- মানুষ তার ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে?

এ হলো ইসলামি আকিদার উদাহরণ- বাস্তব ময়দানে ইসলামি মৌলিকত্ব শূন্য নাম সর্বস্ব মুসলিমের ক্ষেত্রে। যে ইসলাম দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের বাহক। কিন্তু তারা সে ইসলামকে প্রয়োগ করে না। তার প্রতি ধাবিত হয় না। ফলে তাদের জীবন পতনোন্মুখ। আবার কখনো এর থেকে উত্তরণের চিন্তা করলেও সত্যিকারার্থে ত্রাণকর্তার দিকে দৃষ্টি দেয় না। বরং যে পতন ত্বরান্বিত ও গভীর করবে- তার প্রতি-ই ধাবিত হয়।

মুসলিমদের সময় এসেছে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের এবং তার পছন্দকৃত ইসলামের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের। তাদের সময় এসেছে বাস্তব ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করার। শয়তান আছরকৃত ব্যক্তির ন্যায় এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা ছেড়ে, ইসলাম থেকেই জীবনের সঠিক রূপ রেখা গ্রহণ করা- যার নীতি নির্ভর হয়ে এগুবে অভীষ্ট লক্ষের দিকে।

তবে মুসলিম যুবকদের ভেতর ইসলামি পুনঃজাগরণের যে আন্দোলন দুনিয়া-জুড়ে বিরাজ করছে- অদূর ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি শুভ সংবাদ। যদিও এ ভবিষ্যত প্রচুর ত্যাগ-তিতিক্ষা আর কুরবানির দাবিদার।

তবে যারা দীন পরিত্যাগ করেছে কিংবা দীন থেকে নিজেকে চিরতরে মুক্ত করে নিয়েছে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদা প্রযোজ্য নয়। বরং তাদের ওপর প্রয়োগ হবে আল্লাহর অশনি সংকেত।[100]

পক্ষান্তরে যারা এ দীন আঁকড়ে আছে, এ দীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তারা অতি সত্বর আল্লাহর ওয়াদা প্রত্যক্ষ করবে। তারাই পৃথিবীতে কর্তৃত্ব করবে। যেমন কর্তৃত্ব করেছিল তাদের পূর্ববর্তীগণ। তিনিই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্ম এবং ভয়-ভীতির উর্ধ্বে দান করবেন শান্তি।[101]



[1] আল্লাহ বলেন, “আমি মানবকে পচা কর্দম থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ২৬] অন্যত্র বলেন, “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে।” [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ১৪]

[2] আল্লাহ বলেন, “অতএব, মানুষের দেখা উচিৎ যে, কী বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। এটা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষপাজরের মধ্য থেকে।” [সূরা আত-তারিক, আয়াত: ৫-৬]

[3] আল্লাহ বলেন, “আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আমি তাকে এক শুক্র বিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি, এরপর আমি শুক্র বিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে এক নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। আল্লাহ অনেক কল্যাণময় নিপুনতম সৃষ্টিকর্তা।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ১২-১৪]

[4] আল্লাহ বলেন, “আর তারা তোমাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, ‘রূহ আমার রবের আদেশ থেকে, আর তোমাদেরকে জ্ঞান থেকে অতি সামান্যই দেওয়া হয়েছে।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮৫]

[5] আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, এতে তোমাদের শীত বস্ত্রের উপকরণসহ আরো অনেক উপকার রয়েছে। এবং এর কতককে তোমরা আহার্যে ব্যবহার কর। এবং এ গুলো তোমাদের বিত্ত বৈভবের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কারকও। যে সৌন্দর্য তোমরা সকাল-সন্ধ্যায় উপলব্দি কর, যখন চারণভুমি থেকে এগুলো বাড়ি নিয়ে আস, এবং যখন চারণভুমিতে নিয়ে যাও। এরা তোমাদের বোঝা খুব সহজে এমন শহর পর্যন্ত নিয়ে যায়, যেখানে তোমরা প্রাণান্তকর পরিশ্রম ব্যতীত পৌছতে পারতে না। তোমাদের প্রভু পরম দয়ালু, অসীম মেহেরবান। তোমাদের আভিজাত্য, সৌন্দর্য, শোভা ও আরোহণের জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা সৃষ্টি করেছেন। আরো এমন কিছু সৃষ্টি করছেন ও করবেন; যা তোমরা জান না। সরল পথ আল্লাহ পর্যন্ত নিয়ে যায়, তবে বক্র পথও অনেক আছে। আল্লাহ ইচ্ছে করলে সকলকে জোরপূর্বক সরল পথে পরিচালিত করতেন। (কিন্তু না, তিনি প্রকৃতি, বিবেচনা ও বিবেকের ওপর সোপর্দ করেছেন।) [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৫-৯]

[6] আল্লাহ বলেন, “তিনিই মূর্খদের মাঝে রাসূল প্রেরণ করেছেন, যে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শুনায়, আত্মশুদ্ধ করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়।” [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ২]

[7]  সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৯৯; তিরমিযী, হাদীস নং ১২০৫; নাসাঈ, হাদীস নং ৪৪৫৩; আবূ দাউদ , হাদীস নং ৩৩২৯; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৯৮৪; আহমদ (৪/২৭০); দারেমী, হাদীস নং ২৫৩১।

[8] আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদের বললেন, ‘আমি একজন মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি শুকনো ঠনঠনে কালচে মাটি থেকে’। অতএব, যখন আমি তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিব এবং তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিব, তখন তোমরা তার জন্য সাজদাবনত হও।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ২৮-২৯]

[9] আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরে নি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল কাওমের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪২]

[10] আল্লাহ বলেন, “তারা কি তাদের উপরে আসমানের দিকে তাকায় না, কীভাবে আমি তা বানিয়েছি এবং তা সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোনো ফাটল নেই। আর আমি যমীনকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেক প্রকারের সুদৃশ্য উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আল্লাহ অভিমুখী প্রতিটি বান্দার জন্য জ্ঞান ও উপদেশ হিসেবে।” [সূরা ক্বাফ, আয়াত: ৬-৮]

[11]আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ প্রভাত রশ্মির উন্মেষক।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯৬]

[12] আল্লাহ বলেন, “আর যমীনে আছে পরস্পর পাশাপাশি ভূখন্ড, আঙ্গুর-বাগান, শস্যক্ষেত, খেজুর গাছ, যেগুলোর মধ্যে কিছু একই মূল থেকে উদগত আর কিছু ভিন্ন ভিন্ন মূল থেকে উদগত, যেগুলো একই পানি দ্বারা সেচ করা হয়, আর আমি খাওয়ার ক্ষেত্রে একটিকে অপরটির তুলনায় উৎকৃষ্ট করে দিই, এতে রয়েছে নিদর্শন জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৪]

[13] আল্লাহ বলেন, “তিনিই সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় এবং চাঁদকে আলোময় আর তার জন্য নির্ধারণ করেছেন বিভিন্ন মনযিল, যাতে তোমরা জানতে পার বছরের গণনা এবং (সময়ের) হিসাব। আল্লাহ এগুলো অবশ্যই যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫]

[14] আল্লাহ বলেন, “তিনিই একমাত্র তোমাদের জন্য এ দুনিয়ার সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৯]

[15] আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের উদর থেকে বের করেছেন, তোমরা ছিলে মূর্খ, কিছুই জানতে না। কিন্তু তিনি তোমাদের কর্ণ, চক্ষু, অন্তর দিয়েছেন (যাতে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর, নিজের অক্ষমতা, প্রাক মূর্খতার স্মরণ করত শুকরিয়া আদায় কর, কিন্তু না) তোমরা খুব কম শুকরিয়া আদায় কর, খুব সামান্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৭৮]

[16]  ড. আব্দুল্লাহ দারাজ লিখিত ‘আদ-দীন’ পৃ (১১৪)

[17] আল্লাহ বলেন “তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা তারা গবেষণা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা তারা দেখে না, তাদের কানও রয়েছে, তার দ্বারা তারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তাদের চেয়েও অধম, নিকৃষ্টতর। তারাই গাফেল-চেতনাহীন।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৯]

[18] সহীহ মুসলিম।

[19] ‌আল্লাহ বলেন, “মানুষ যা চায়, তা-কি সে পায়? (না-পায় না; জেনে রাখ) পূর্বাপর সমস্ত মঙ্গলই আল্লাহর হাতে।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৪-২৫]

[20] আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর নি‘আমতরাজির কথা স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু; আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে মিলিয়ে দিয়েছেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩]

[21] আল্লাহ বলেন, “জেনে রাখ, আল্লাহ বান্দা ও তার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্দক সেজে যান।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৪]

[22] আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ স্বীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের ওপর শান্তি অবতীর্ণ করেছেন।” [সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ২৬]

[23] আল-ওশী‘আহ ফী নাকদি আকাইদিশ শী‘আহ, পৃ.১২-১৩, লাহোর, পাকিস্তান, ১৪০৩ হি. ১৯৮৩। অনুরূপ আল-ইসলাম ওয়াল আদইয়ান: দেরাসাহ মুকারানা: ৪৮, ড. মুস্তাফা হিলমি

[24] আল্লাহ বলেন, “স্মরণ কর, যখন তোমার প্রভু বলেছিলেন, আমি দুনিয়াতে প্রতিনিধি প্রেরণ করব।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩০] তিনি-ই আদম আলাইহিস সালাম, প্রথম নবী। মানব হিসেবে দুনিয়াতে সর্বপ্রথম তিনিই বসবাস আরম্ভ করেন।

[25] আবু দাউদ, ৫১১৬।

[26] ঈমান বিল গায়েব: বাসসাম সালামাহ, মাকতাবাতুল মানার, জর্দান। পৃ. ৪৪, প্রকাশনা: ১৪০৩ হি. ১৯৮৩ খৃ.।

[27] আল্লাহ বলেন, “ফির‘আউন তার সম্প্রদায়ের সকলকে সমবেত করে সজোরে ঘোষণা দিল, আমি-ই তোমাদের প্রধান ও বড় প্রভু।” [সূরা আন-নাজিআত, আয়াত: ২৩-২৪]

[28] আহমাদ আব্দুল গফুর আল-আত্তার, আদ-দিয়ানাত ওয়াল আকায়েদ ফী মুখতালাফিল ‘উসূর’, পৃ. ৭২-৭৩।

[29] [টিকা: আল-ইসলাম ওয়াল আদইয়ান, দেরাসাহ মুকারানা (ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম একটি তুলনামূলক গবেষণা): পৃ. ৯, ড. মুস্তফা হেলমি, ইসলামি শিক্ষা বিভাগের প্রধান, দারুল উলুম কলেজ, কায়রো ইউনিভার্সিটি। প্রথম প্রকাশনা: ২০০৫ ইং ১৪২৬ হি. দার ইবন জাওযী, আল-কাহেরা।]

[30] আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে বিবেকবানদের জন্য।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৪] “বিশ্বাসীদের জন্য।” [সূরা আল-জাছিয়া, আয়াত: ৪] “আলেমদের জন্য।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২২] “ঈমানদারদের জন্য।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ৩৭] “গবেষকদের জন্য।” [সূরা আন-নাহাল: ১১] “উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ১৩]

[31] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ যাকে ইচ্ছে জ্ঞান দান করেন, আর যাকে জ্ঞান দান করা হয়, মূলত তাকে প্রচুর কল্যাণ প্রদান করা হয়। কারণ, একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই হিতোপদেশ গ্রহণ করে।” বাকারা: (২৬৯)

[32] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিশ্চয় তোমাদের প্রভু আসমান-জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর ‘আরশের উপর উঠেন। তিনি এমনভাবে রাতের উপর পরিয়ে দেন দিন, যে দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পেছনে আসে। তিনি স্বীয় আদেশের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন,  চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্র। শুনে রেখ, তারই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দেওয়া।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]

[33] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর ইবাদত কর। জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই এখলাস পূর্ণ ইবাদত।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ২-৩]

[34] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮০; সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ১১।

[35] দেখুন: সূরা ফাতির, আয়াত: ১; সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৬; সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২০; সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬।

[36] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]

[37] দেখুন: সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫; সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৩ ও সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০।

 আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “মুহাম্মাদ তোমাদের কারো পিতা নন, তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]

[38] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সে দিনের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।” [সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত: ৪]

[39] দেখুন: সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত: ৭; সূরা আত-আলাক, আয়াত: ১২।

[40] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপদাপদ আসে, তা সবই আমি কিতাবে অর্থাৎ লওহে-মাহফুজে জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই লিখে দিয়েছি।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২২]

[41] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তাদের কতটুকু অংশ মাটি ভক্ষণ করেছ, আমি সে বিষয়ে অবগত আছি। আমাদের কাছে সংরক্ষণকারী কিতাবও বিদ্যমান আছে।” [সূরা ক্বাফ, আয়াত:৪]

[42] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা যা চান তা বাস্তবায়ন করেন।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ১৮]

[43] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ যদি তাদের মাঝে জগড়া বিবাদ না চাইতেন, তারা জগড়া বিবাদ করত না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যা চান তাই করেন।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত:২৫৩]

[44] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ সমস্ত জিনিসের স্রষ্টা।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬২]

[45] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ তোমাদের এবং তোমাদের কর্মসমূহ সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা সাফ্‌ফাত, আয়াত: ৯৬] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক সম্পাদনকারী এবং তার সম্পাদিত কর্ম উভয় সৃষ্টি করেছেন।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৩২)

[46] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর ওপর এবং তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৩৬]

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা যদি কুফুরী কর তবে (জেনে রাখ) আল্লাহ তোমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী; আর তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফুরী পছন্দ করেন না এবং তোমরা যদি শোকর কর তবে তোমাদের জন্য তিনি তা পছন্দ করেন।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৭]

[47] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (হে রাসূল) আপনি বলে দিন, আল্লাহকে ছাড়া যাদের আহ্বান করো, তোমরা মনে করো কি তারা আমাকে রক্ষা করতে পারবে? যদি আল্লাহ আমার কোনো ক্ষতি করতে চান।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩৮]

   ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে হলুদ তাগা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কী?” লোকটি বলল, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, “এটা খুলে ফেল, কারণ এটা শুধু দুর্বলতাই বৃদ্ধি করবে। আর এটা নিয়ে মারা গেলে কখনোই তুমি সফলকাম হবে না।” (আহমাদ)

   উকবা ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে একটি “মারফু” হাদীসে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি তাবিজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেয়, (আল্লাহর উপর ভরসা না করে) আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। যে ব্যক্তি কড়ি, শঙ্খ বা শামুকের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, তাকে যেন আল্লাহ রক্ষা না করেন।”

   অপর একটি বর্ণনায় আছে, “যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শির্ক করলো।” (আহমাদ) ইবন আবি হাতেম বর্ণনা করেন, হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এক অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে দেখেন “জ্বর নিরাময়ের জন্য হাতে সুতা বা তাগা বাঁধা, তিনি সুতা কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন, যার অর্থ “তাদের অধিকাংশই শির্ক করে, আবার আল্লাহর ওপরও ঈমান আনে” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১০৬] অর্থাৎ তাদের ঈমান নির্ভেজাল বা খাটি নয়। (আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী) 

[48] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “তোমরা কি (পাথরের তৈরি মুর্তি) ‘লাত’ আর “উয্যা” নিয়ে চিন্তা করেছ?” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ১৯] আবূ ওয়াকিদ আল-লাইছী বলেন, “আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইনের (যুদ্ধের) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমরা তখনও নও মুসলিম। কোথাও মুশরিকদের একটি কুলগাছ ছিল, যার চারপাশে তারা বসতো এবং তাতে সমরাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। গাছটি তারা ذات أنواط (যাত আনওয়াত) বলতো। আমরা একদিন রাসূলসহ সে কুলগাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল তাদের যেমন “যাতু আনওয়াত” আছে আমাদের জন্যও অনুরূপ “যাতু আনওয়াত” নির্ধারণ করে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, “আল্লাহু আকবার! এ একটি কু-প্রথা; আমার জীবনের মালিক-আল্লাহর কসম, তোমরা বনী ইসরাইলের মতো উক্তি করেছ; তারা মূসা আলাইহিস সালামকে বলেছিল। “হে মূসা, মুশরিকদের যেমন মা‘বুদ আছে আমাদেরও তেমন মা‘বুদ বানিয়ে দাও। মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, তোমরা মূর্খের মতো কথা বলছ।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৮] বাস্তবে তোমরা তাদেরই অনুসরণ করছ। তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে সহীহ বলেছেন। আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।

[49] আবূ বাসীর আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফর সঙ্গী ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জনপদে দূত পাঠালেন, এ নির্দেশ দিয়ে; কোনো উটের গলায় ধনুকের রজ্জু লটকানো থাকবে না, থাকলে তা যেন কেটে ফেলা হয়। (সহীহ বুখারী) ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ হচ্ছে শির্ক” (আহমাদ, আবূ দাউদ) আবদুল্লাহ ইবন উকাইম-এর মারফু‘ হাদীসে আছে, “যে কোনো জিনিস (তাবিজ-কবজ) লটকায় সে উক্ত জিনিসেই সোপর্দ হয়।” (আহমাদ, তিরমিযী) তাবিজ: বদনজর থেকে রক্ষার জন্য সন্তানদের গায়ে ঝুলানো বস্তু। ঝুলন্ত বস্তুটি কুরআনের অংশ হলে সলফে সালেহীনের কেউ অনুমতি দিয়েছেন, আবার কেউ অনুমতি দেন নি বরং শরী‘আত কর্তৃক নিষিদ্ধ মনে করতেন। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাদের একজন। ঝাড়-ফুঁককে عزائم বলা হয়। যেসব ঝাড়-ফুঁক শির্কমুক্ত তা অন্য দলীলের দ্বারা বৈধ প্রমাণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদনজর এবং সাপ বিচ্ছুর বিষের  জন্য ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন। تولة তিওয়ালা কবিরাজদের বানানো কবজ: তাদের দাবী এর (কবজ) দ্বারা স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর ভালোবাসা, স্বামীর অন্তরে স্ত্রীর ভালোবাসার জন্ম হয়। ইমাম আহমাদ বলেন, সাহাবী রুওয়াইফি‘ বলেছেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে রুওয়াইফি‘, তুমি সম্ভবত দীর্ঘজীবি হবে। মানুষদের জানিয়ে দিও, “যে ব্যক্তি দাঁড়িতে গিরা দেয়, গলায় তাবিজ-কবজ ঝুলায়, পশুর মল কিংবা হাড় দ্বারা এস্তেঞ্জা করে; আমি মুহাম্মাদ তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।” সা‘ঈদ ইবন জুবাইর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো মানুষের তাবিজ-কবজ ছিড়ে ফেলল বা কেটে ফেলল সে একটি গোলাম আযাদ করার সওয়াব অর্জন করল।” (ওয়াকী) ইবরাহীম রহ. বলেন, আমাদের পূর্বসূরী বড় আলেমগণ সব ধরনের তাবীজ-কবজ অপছন্দ করতেন, তার উৎস কুরআন হোক বা অন্য কিছু। [আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।]

[50] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “কিছু সংখ্যক লোক কতিপয় জিন্নের কাছে আশ্রয় চাচ্ছিল, যার ফলে তাদের (জিন্নদের) গর্ব ও আহমিকা আরো বেড়ে বৃদ্ধি পেল।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ৬] খাওলা বিনতে হাকীম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কোনো অবতরণ স্থানে পৌঁছে বলে,أعوذ بكلمات الله التامات من شرما خلق  “আমি আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণাঙ্গ কালামের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির সকল অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাই।” (সহীহ মুসলিম) সে ঐ মঞ্জিল ত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো বস্তুর ক্ষতির শিকার হবে না। (সহীহ মুসলিম) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ ব্যতীত এমন সত্তাকে ডেকো না, যা তোমার কোনো উপকার কিংবা ক্ষতি করতে পারবে না। অন্যথায় তুমি একজন যালিম। অপর দিকে আল্লাহ তোমাকে বিপদে ফেললে, তিনি ব্যতীত কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৬, ১০৭] অল্লাহ আরো বলেন, “তার চেয়ে অধিক গুমরাহ আর কে? -যে আল্লাহ ছাড়া এমন সত্ত্বাকে ডাকে যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না”[সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৫] আল্লাহ আরো বলেন, “বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ডাকে কে সাড়া দেয়? -যখন সে ডাকে; কে তার কষ্ট দূর করে?” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬২] ইমাম তাবরানী বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একজন মুনাফিক ছিল, যে মুমিনদের কষ্ট দিত। মুমিনরা পরস্পর বলল: চলো, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার অত্যাচার হতে বাচাঁর জন্য সাহায্য চাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন, “আমার কাছে সাহায্য চাওয়া যায় না, সাহায্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হয়।” আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমার রবের জন্য সালাত পড় এবং কুরবানি কর।” [সূরা আল-কাওসার, আয়াত: ২] আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য কুরবানি করবে তার ওপর আল্লাহর লা‘নত। (সহীহ মুসলিম) আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।

[51] সহীহ হাদীসে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলার বাণী “কাফেররা বলল, ‘তোমরা নিজেদের মাবূদগুলো পরিত্যাগ করো না। বিশেষ করে “ওয়াদ”, “সু‘আ”, “ইয়াগুছ” “ইয়াঊক” এবং “নসর।” [সূরা নূহ, আয়াত: ২৩] এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘এগুলো নূহ আলাইহিস সালামের কাওমের কতিপয় নেককার-বুজুর্গ ব্যক্তির নাম, তারা মারা গেলে, শয়তান তাদের অনুসারীদের কুমন্ত্রণা দিয়ে বলল, ‘যেসব জায়গায় তাদের মজলিস হত সেসব জায়গাতে তাদের মুর্তি স্থাপন কর এবং তাদের সম্মানার্থে তাদের নামেই মুর্তিগুলোর নামকরণ কর। তারা তাই করল। তাদের জীবদ্দশায় মুর্তির পূজা করা হয় নি ঠিকই; কিন্তু মূর্তি স্থাপন কারীদের মৃত্যুর পর, মুর্তি স্থাপনের ইতি কথা ভুলে, মুর্তিগুলোর ইবাদত শুরু হলো। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, একাধিক আলেম বলেছেন, ‘নেককার-বুজুর্গ ব্যক্তিগণ মারা গেলে, তাদের কাওমের লোকেরা কবরের পাশে ধ্যান-মগ্ন হয়ে বসে থাকত। একধাপ এগিয়ে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করে নিল। এভাবে বহুদিন অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তারা তাদের ইবাদত আরাম্ভ করল। [আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।]

[52] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “তারা অবশ্যই অবগত, যে (জাদু) ক্রয় করেছে, পরকালে তার সুফল নেই।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১০২] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, “তারা “জিবত” এবং “তাগুত” কে বিশ্বাস করে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫১] উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “জিবত” হচ্ছে জাদু, আর “তাগুত” হচ্ছে শয়তান। জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘তাগুত হচ্ছে গণক। তাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হত। প্রত্যেক গোত্রের জন্যই একজন করে গণক নির্ধারিত ছিল। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তু হতে বেঁচে থাক; সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর সাসূল, ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কী? তিনি বললেন, ...জাদু করা। জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু  থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, “জাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে মৃত্যুদণ্ড। (তিরমিযী) সহীহ বুখারীতে বাজালা ইবন আবাদাহ থেকে বর্ণিত, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু  মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লিখেছেন, “তোমরা প্রত্যেক জাদুকর পুরুষ, জাদুকর নারীকে হত্যা কর।” বাজালা বলেন, এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন জাদুকরকে হত্যা করেছি। হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা  থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে আছে, তিনি তার অধীনস্থ একজন বান্দী (ক্রীতদাসী)-কে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাকে জাদু করেছিলো। একই রকম হাদীস জুনদুব থেকে সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ রহ. বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিনজন সাহাবী থেকে একথা সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে। [আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস্ সা‘দী।]

[53] নাশরাহ বা প্রতিরোধমূলক জাদু: জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নাশরাহ বা প্রতিরোধমূলক জাদু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে। তিনি বলেন, “এটা হচ্ছে শয়তানের কাজ” (আহমাদ, আবূ দাউদ) আবূ দাউদ বলেন, ইমাম আহমাদ রহ.-কে নাশরাহ (প্রতিরোধমূলক জাদু) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন; “ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নাশরার সব কিছুই অপছন্দ করতেন।” সহীহ বুখারীতে কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, আমি ইবনুল মুসাইয়্যিবকে বললাম, “একজন লোকের অসুখ হয়েছে বা তাকে স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে; তার এ সমস্যার সমধান কল্পে প্রতিরোধমূলক জাদুর (নাশরাহ) মাধ্যমে চিকিৎসা করা যাবে? তিনি বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই।’ কারণ, এর (নাশরাহ) দ্বারা তারা সংশোধন ও উপকার করতে চায়। যার দ্বারা মানুষের উপকার ও কল্যাণ সাধিত হয়, তা নিষিদ্ধ নয়।” অপর দিকে হাসান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, لا يحل السحر إلا السحر “একমাত্র জাদুকর ছাড়া অন্য কেউ জাদুকে বিনষ্ট করতে সক্ষম হয় না।” ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, النشرة حل السحر عن المسحور ‘নাশারাহ’ হচ্ছে জাদুকৃত ব্যক্তি বা বস্তুর উপর থেকে জাদুর প্রভাব দূর করা। নাশরাহ দু’ধরনের: প্রথমটি হচ্ছে, জাদুকৃত ব্যক্তি বা বস্তুর উপর থেকে জাদুর ক্রিয়া নষ্ট করার জন্য অনুরূপ জাদু দ্বারা চিকিৎসা করা। আর এটাই হচ্ছে শয়তানের কাজ। হাসান বসরী রহ.-এর বক্তব্য দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নাশের (জাদুর চিকিৎসক) ও মুনতাশার (জাদুকৃত রোগী) উভয়ই শয়তানের অনুকরণের মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হয়; বিনিময়ে শয়তান জাদুকৃত রোগী থেকে স্বীয় প্রভাব উঠিয়ে নেয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ঝাড়-ফুঁক আর বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ঔষধ-পত্র প্রয়োগ ও শরী‘আতসম্মত দো‘আ ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা; এ ধরনের চিকিৎসা জায়েয। ইবনুল মুসাইয়্যেবের বক্তব্য দ্বারা এ নাশরাই উদ্দেশ্য। [আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।]

[54] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো এক স্ত্রী থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, “যে গণকের কাছে এসে কিছু (ভাগ্য সম্পর্কে) জিজ্ঞাসা করল এবং তার কথায় বিশ্বাস করল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল হবে না। (সহীহ মুসলিম) আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে গণকের কাছে আসল, অতঃপর সে যা বলল তা সত্য বলে বিশ্বাস করল, সে মূলতঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত কুরআনকেই অস্বীকার করল। [সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হাদীসটি সহীহ। আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাজাহ ও হাকিম এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।] ইমরান ইবন হুসাইন থেকে মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, “যে পাখি উড়িয়ে ভালো-মন্দ ভাগ্য যাচাই করল; যার জন্য পাখি উড়ানো হলো; যে ভাগ্য গণনা করল; যার ভাগ্য গণনা করা হলো; যে জাদু করল; যার জন্য জাদু করা হলো; যে গণকের কাছে আসল; অতঃপর গণকের কথায় বিশ্বাস করল; সে মূলতঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত কুরআনকে অস্বীকার করল। (বায্যার)

   ইমাম বগবী রহ. বলেন, গণক ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে চুরি হওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া জিনিসের স্থান ইত্যাদি বিষয় অবগত আছে বলে দাবী করে। মূলতঃ গণক বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যে ভবিষ্যতের গায়েবি বিষয় সম্পর্কে সংবাদ দেয় [অর্থাৎ ভবিষ্যদ্বাণী করে]। কেউ বলেন, যে ব্যক্তি ভবিষ্যতের গোপন খবর বলে দেয়ার দাবী করে তাকেই গণক বলা হয়। কেউ বলেন, যে দিলের (গোপন) খবর বলে দেওয়ার দাবী করে, সেই গণক। আবুল আববাস ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন كاهن [গণক], منجم  [জ্যোতির্বিদ], এবং رمال [বালির উপর রেখা টেনে ভাগ্য গণনাকারী] এবং এ জাতীয় পদ্ধতিতে যারাই গায়েব সম্পর্কে কিছু জানার দাবী করে তারাই হাদিসে বর্ণিত ‘আররাফ [عراف] বলে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেছেন, একটি সম্প্রদায়ের কতিপয় লোক আরবি  أباجاد লিখে নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ভালো-মন্দ ভাগ্য নির্ণয় করে; পরকালে আল্লাহর কাছে তাদের কোনো অংশ আছে বলে মনে করি না। [আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।]

[55] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَآ إِنَّمَا طَٰٓئِرُهُمۡ عِندَ ٱللَّهِ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ﴾ [الاعراف: ١٣١] 

   “মনে রেখো, তাদের কুলক্ষণসমূহ আল্লাহর নিকট রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা বুঝে না।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৩১]

   আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্নিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ، وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ» “দীন ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি, কুলক্ষণ, অলুক্ষ্যেনে প্রাণী বা অলুক্ষ্যেনে মাস বলতে কিছু নেই।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) বুখারি ও মুসলিমে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ، وَيُعْجِبُنِي الفَأْلُ» قَالُوا: وَمَا الفَأْلُ؟ قَالَ: «كَلِمَةٌ طَيِّبَةٌ» “ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি আর কুলক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে ‘ফাল’ আমার খুব পছন্দ। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফাল’ কী? জবাবে বললেন, ‘শুভ লক্ষণমূলক ভালো কথা’। উকবা ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, কুলক্ষণ বা দূর্ভাগ্যের বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উল্লেখ করা হলে, তিনি বলেন,

«أَحْسَنُهَا الْفَأْلُ وَلَا تَرُدُّ مُسْلِمًا، فَإِذَا رَأَى أَحَدُكُمْ مَا يَكْرَهُ فَلْيَقُلِ اللَّهُمَّ لَا يَأْتِي بِالْحَسَنَاتِ إِلَّا أَنْتَ، وَلَا يَدْفَعُ السَّيِّئَاتِ إِلَّا أَنْتَ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِكَ»

  “এর মধ্যে উত্তম হচ্ছে ‘ফাল’। কুলক্ষণ কোনো মুসলিমকে স্বীয় কর্তব্য কর্ম পালন করতে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। (কারণ সে আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করে।) তোমাদের কেউ অপছন্দনীয় কিছু প্রত্যক্ষ করলে, বলবে اللَّهُمَّ لَا يَأْتِي بِالْحَسَنَاتِ إِلَّا أَنْتَ، وَلَا يَدْفَعُ السَّيِّئَاتِ إِلَّا أَنْتَ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِكَ “হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কেউ কল্যাণ দিতে পারে না, কেউ অকল্যাণ দূরও করতে পারে না। তুমিই একমাত্র ক্ষমতা ও শক্তির আধার।” (আবূ দাউদ)

   ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে আছে, পাখি উড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা, লক্ষণ নির্ধারণ করা শির্কী কাজ, এ কাজ আমাদের নয়। আল্লাহ তা‘আলা তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে মুসলিমের দুশ্চিন্তাকে দূর করে দেন। (আবূ দাউদ, তিরমিযী)

   ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, ‘কুলক্ষণ বা দুর্ভাগ্যের ধারণা যে ব্যক্তিকে স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখল, সে মূলতঃ শির্ক করল। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এর কাফ্‌ফারা কী? তিনি বললেন, তোমরা এ দো‘আ পড়বে,أللهم لا خير إلا خيرك ولا طير إلا طيرك ولا إله غيرك  “হে আল্লাহ, তোমার মঙ্গল ব্যতীত কোনো মঙ্গল নেই। তোমার অকল্যাণ ছাড়া কোনো অকল্যাণ নেই। আর তুমি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই।” (আহমাদ) [আল-কাওলুস সাদীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন নাসের আস-সা‘দী।]

৫৯ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “স্মরণ কর- যখন তোমার রব ফিরিশতাদের বলেছিলেন, আমি দুনিয়াতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩০]

[57] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “একমাত্র তিনিই তোমাদেরকে জমিন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তন্মধ্যে বসতি দান করেছেন।” [সূরা হূদ, আয়াত: ৬১]

[58] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি মানব ও জিন্ন জাতি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫৬]

[59] আল্লাহ বলেন, “দুঃখ-কষ্ট মানুষকে যখন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলে, তখন সে নিজ পালনকর্তাকে একাগ্রচিত্তে আহ্বান করে; অতঃপর যখন তিনি নাজাত দান করেন, তখন সে কষ্টের কথা ভুলে যায়, যে কষ্টে পড়ে সে প্রভুর শরনাপন্ন হয়েছিল।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৮] “সমুদ্রে থাকাবস্থায় যখন তোমাদের ওপর বিপদ নেমে আসে, তখন আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যদের ভুলে যাও, যাদেরকে তোমরা  নিরাপদ ও সচ্ছল অবস্থায় ডাক-উপাসনা কর। আবার যখন তিনি স্থলে ভিড়িয়ে তোমাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তোমরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৬৭]

[60] উজুদে বারি তা‘আলা আউর তওহিদ, পৃষ্ঠা: ৮৮-৮৯, ডা. মালিক গোলাম মুর্তজা, প্রকাশক: ডা. গোলাম মুর্তজা এডুকেশনাল ট্রাস্ট লাহোর, প্রকাশকাল ২০০২ জুলাই

[61] (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিষয়ে চার্চিল স্বীয় গ্রন্থের ৪৩৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: ১৯৪২ সনের ভয়ানক পরিস্থিতিতে, যখন রুশ জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে দুরহ দুরহ করছিল, এদিকে হিটলার সমগ্র ইউরোপের জন্য এক মারাত্মক হুমকির কারণ। তখন চার্চিল মাস্কো সফর করেন এবং যৌথবাহিনীর পরিকল্পনা ও স্কীম সম্পর্কে স্টালিনকে বিস্তারিত তথ্য দেন। স্কীমের পরিকল্পনা ও ব্যাখ্যা শ্রবণ করতে করতে বিশেষ এক মুহূর্তে স্টালিনের মুখ থেকে অলক্ষে বের হয়ে যায়, “আল্লাহ আমাদের স্কীম সফল করুন।” [সূত্র: উজুদে বারি তা‘আলা আউর তাওহীদ, পৃষ্ঠা. ৮৯, ডা. মালিক গোলাম মুর্তজা, প্রকাশক: ডা. গোলাম মুর্তজা এডুকেশনাল ট্রাস্ট লাহোর, প্রকাশকাল ২০০২ জুলাই, সংকলিত: ডা. আব্দুল সাইয়্যেদ লতিফ: দি মাইন্ড আল-কুরআন বিল্ডাজ, পৃষ্ঠা. ৯৪]

[62] “আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা আরো বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।” [সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১০]

[63] “এমনিভাবে আপনার আগে যখন কোনো জনপদে কোনো সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি এক আদর্শের ওপর, আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করছি। সে বলত, তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে আদর্শের ওপর পেয়েছ, আমি যদি তদপেক্ষা উত্তম আদর্শ নিয়ে আসি, তবুও কি তোমরা তাই কলবে? তারা বলত, তোমাদের আদর্শ আমরা মানব না।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৩-২৪]

[64] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক নবজাতক স্বীয় স্বভাবজাত ধর্ম তথা ইসলাম নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা ও অগ্নিপূজক বানায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৮৫)

[65] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৩]

[66] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহনযোগ্য দীন একমাত্র ইসলাম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯]

[67] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহই তোমাদের প্রকৃত রব, সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরার মাঝে কি আছে গোমরাহী ছাড়া, সুতরাং তোমরা কোথায় ঘুরছ?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩২]

[68] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “জীবন মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৫৭; সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫; সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫]

[69] “তোমরা এখানে নিশ্চিত চিরঞ্জিব, কখনো মুত্যু মুখে পতিত হবে না। এখানে তোমরা চির সুস্থ, কখনো অসুস্থ হবে না। এখানে তোমরা চির যৌবনপ্রাপ্ত, কখনো বৃদ্ধ হবে না।” (সহীহ মুসলিম)

[70] মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের কারো চাবুক পরিমাণ জান্নাতের জায়গা দুনিয়া এবং তার ভিতরে যা আছে তা হতে উত্তম।” (সহীহ বুখারী)

[71] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো চক্ষু দর্শন করে নি, কোনো কর্ণ শ্রবণ করে নি এবং মানুষের অন্তরে যার কল্পনা পর্যন্ত হয় নি। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

[72] আল্লাহ বলেন, “কেউ জানে না তার কৃতকর্মের কী কী নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুকায়িত আছে।” [সূরা আস-[সাজদাহ, আয়াত: ১৭]

[73] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “জান্নাতবাসিদের প্রথম দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে, পূর্ণিমার রাতের চাদের আকৃতিতে, অতঃপর যারা যাবে উজ্জল নক্ষত্রের আকৃতিতে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

[74]  “জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের পিতা আদম আলাইহিস সালামের আকৃতিতে। ষাট হাত পর্যন্ত প্রত্যেকে লম্বা হবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) 

[75]  আপোষে কোনো বিবাদ থাকবে না, তাদের অন্তরসমূহ একটি অন্তরের নীতিতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (সহীহ বুখারী)

[76] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ছিল, আমি তা দূর করে দিব। তারা ভাই ভাইয়ের মতো সামনা-সামনি বসবে।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৪৭]

[77] “পানাহার, সহবাস ইত্যাদিতে প্রত্যেককে একশত ব্যক্তির শক্তি প্রদান করা হবে।” (তিরমিযী)

[78] “মুমিনদের জন্য জান্নাতের ভিতর মনি-মোক্তার তাবু হবে যার শুন্যগর্ভ আসমানে ষাট মাইল পর্যন্ত লম্বা হবে। মুমিনদের পরিবার-পরিজন সেখানে অবস্থান করবে। যাদের পার্শ্ব দিয়ে অন্যান্য মুমিনরা ঘোরাফেরা করবে, কেউ কাউকে দেখবে না।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

[79] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সেখানে তোমাদের মনের যাবতীয় চাহিদা বিদ্যমান আছে, তোমাদের সমস্ত দাবি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা আছে। ক্ষমাশীল করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাদর আপ্যায়নস্বরূপ।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩১-৩২]

[80] উজুদে বারি তা‘আলা আওর তওহিদ, পৃষ্ঠা: ৮৬-৮৭, ডা. মালিক গোলাম মুর্তজা, প্রকাশক: ডা. গোলাম মুর্তজা এডুকেশনাল ট্রাস্ট লাহোর, প্রকাশকাল ২০০২ জুলাই।

[81]  ইবন মাজাহ, অন্যত্র বলেন, তিন ব্যক্তির পক্ষে কিয়ামতের দিন আমি বাদী হব, তার ভেতর সে ব্যক্তিও আছে, যে তার কর্মপূর্ণ করল, অথচ প্রাপ্য মজুরি  পেল না। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২২৭০)

[82]  আল্লাহ বলেন,“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা এবং ফিরিশতাগণকে করেছেন বার্তাবাহক-তারা দুই-দুই, তিন-তিন ও চার-চার পাখাবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টির ভিতর যা ইচ্ছা যোগ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সক্ষম।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১]

[83] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিশ্চিত নামাজ অশ্লিল ও গর্হিত আমল হতে বিরত রাখে।” [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৪৫]

[84] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ তোমাদের ওপর সাওম ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা (এ দুনিয়াতেই) মুত্তাকি হতে পার।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩]

[85] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি- মানব ও জিন্ন জাতি।” [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫৬]

তিনি আরো বলেন, “বলুন- আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬২-১৬৩]

[86] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, সে কাফের।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৪]

যে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ফয়সালা করে না সে যালিম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৫]

যে আল্লাহর বিধান মুতাবিক ফয়সালা করে না সে ফাসেক। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৭]

[87] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদেরকে মানবজাতির কল্যাণে প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা কল্যাণের আদেশ করবে, অকল্যাণ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]

[88] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৬৩; সহী মুসলিম, হাদীস নং ১৪০১।

[89] আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তোমাকে যে নি‘আমত দান করেছেন, তার দ্বারা তুমি আখেরাত অন্বেষণ কর। তবে দুনিয়ার স্বীয় হিস্যা ভুলে যেও না।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ১৭৭]

১০৩ “আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নিদের্শ দিয়েছি।” [সূরা সূরা লুকমান, আয়াত: ১৪]

[91] “যে আমাদের ছোটদের রহম করে না, বড়দের সম্মান করে না। সে আমাদের অর্ন্তভুক্ত নয়। (তিরমিযী, হাদীস নং ১৯১৯)

[92] “যার থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০১৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩)

[93] “যে আমাদের ধোকা দেয় সে আমাদের সাথে নয়।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৪)

[94] “যদি ক্ষমা কর, উপেক্ষা কর, মাফ কর, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুনাময়।” [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৪]

[95] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০।

[96] তাদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয় “যারা মুহাজিরদের পূর্বে মদিনায় বসতি স্থাপন করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে, মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৯]

[97] সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬২-১৬৩।

[98] পবিত্র কুরআনের সাক্ষ্য: “হে ঈমানদারগণ, অধিকাংশ পোপ ও পুরোহিতগণ অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করে, আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। এবং যারা স্বর্ণ-রোপা পুঞ্জিভুত করে- আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দিন।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৪]

[99] পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হচ্ছে: “আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১১]

[100] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, আল্লাহ তোমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতির সৃষ্টি করবেন যারা তোমাদের মত হবে না।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮]

[101] পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হচ্ছে- “তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎ কর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীর শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদেরপূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৫]