কিতাবুত তাওহীদ যা বান্দার ওপর আল্লাহর হক।
পরম করুনাময় দয়াময় আল্লাহর নামে
সমস্ত প্রসংশা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তাঁর রহমত ও শান্তি নাযিল করুন মুহাম্মাদের ওপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবীগণের ওপর।
কিতাবুত তাওহীদ
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্যেই যে, তারা কেবল আমার ইবাদাত করবে।” [আয-যারিয়াত: ৫৬]
আল্লাহ আরও বলেছেন, “আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং পরিহার কর তাগূতকে।” [আন-নাহল ৩৬]
এবং আল্লাহর বাণী, “আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।” [আল-ইসরা: ২৩-২৪]
আল্লাহর বাণী: “আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না।” [আন-নিসা: ৩৬]
আল্লাহর বাণী: “বলুন, ‘এসো, তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তোমাদেরকে তা তিলাওয়াত করি, তা হচ্ছে, ‘তোমারা তাঁর সাথে কোনো শরীক করবে না, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্রের ভয়ে তোমার তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমরাই তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিযক দিয়ে থাকি।প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক, অশ্লীল কাজের ধারে-কাছেও যাবে না। আল্লাহ্ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না।’ তোমাদেরকে তিনি এ নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা বুঝতে পার।” আর ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ছাড়া তোমারা তার সম্পত্তির ধারে-কাছেও যাবে না এবং পরিমাপ ও ওজন ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দেবে। আমরা কাউকেও তার সাধ্যের চেয়ে বেশী ভার অর্পণ করি না। আর যখন তোমারা কথা বলবে তখন ন্যায্য বলবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও এবং আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (১৫২) আর এ পথই আমার সরল পথ। কাজেই তোমরা এর অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমারা তাকওয়ার অধিকারী হও।” [আল-আন‘আম: ১৫১-১৫৩]
ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোহরাঙ্কিত অসিয়ত দেখতে চায়, সে যেন আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী পড়ে নেয়: “তুমি বলো, এসো তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হলো, তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবে না।” আল্লাহর নিম্নের বাণী পর্যন্ত: “আর এটাই হচ্ছে আমার সরল, সোজা পথ।” আয়াত।
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াললাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে একটি গাধার পিঠে বসে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘হে মু‘আয, তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কী হক রয়েছে আর আল্লাহর উপর বান্দার কী হক আছে?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, ‘বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে, যারা তার সাথে কাউকে শরিক করবে না তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না।” আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কি এ সুসংবাদ লোকদেরকে জানিয়ে দেব না? তিনি বললেন, “তুমি তাদেরকে এ সুসংবাদ দিওনা, তাহলে তারা অলস বসে থাকবে।” হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে:
এক: জিন ও মানুষ সৃষ্টির হিকমত।
দুই: ইবাদত হচ্ছে কেবলই তাওহীদ। কারণ এটা নিয়েই বিবাদ।
তিন: যে তাওহীদ বাস্তবায়ন করল না, সে আল্লাহর ইবাদতও করল না। এ কথার মধ্যে আল্লাহর বাণী (وَ لَاۤ اَنْتُمْ عٰبِدُوْنَ مَاۤ اَعْبُدُ) “এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও।” এর অর্থ নিহিত আছে।
চার: রাসূলদের পাঠানোর হিকমত।
পাঁচ: রিসালাহ সকল উম্মতকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
ছয়: নবীগণের দীন এক ও অভিন্ন।
সাত: বড় মাসআলা হচ্ছে, তাগুতকে অস্বীকার করা ব্যতীত ইবাদতের মর্যাদা অর্জন করা যায় না। এতে রয়েছে আল্লাহর নিম্নের বাণীর মর্মার্থ: “যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল।”
আট: তাগুত শব্দটি আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করা হয়, তাদের সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
নয়: সালাফে-সালেহীনের কাছে সূরা আন‘আমের উল্লেখিত তিনটি মুহকাম আয়াতের বিরাট মর্যাদার কথা জানা যায়। এতে দশটি মাসআলা রয়েছে। তার প্রথমটিই হচ্ছে; শিরক থেকে নিষেধ করা।
দশ: সূরা ইসরায় কতগুলো মুহকাম আয়াত রয়েছে। এবং তাতে আঠারোটি মাসআলা রয়েছে। যা আল্লাহ তাঁর নিম্নের বাণী দ্বারা সূচনা করেছেন: “আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ সাব্যস্ত করো না; করলে নিন্দিত ও লাঞ্চিত হয়ে বসে পড়বে।” আর আল্লাহ তা শেষ করেছেন তাঁর নিম্নের বাণী দ্বারা: “আর তুমি আল্লাহর সাথে আরেকজন ইলাহ সাব্যস্ত করো না। ফলে জাহান্নামে অপমান অপদস্থ করে নিক্ষেপ করা হবে।” আল্লাহ তা‘আলা এ মাসআলাগুলোর গুরুত্বের ওপর তাঁর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করেছেন: “এটি তোমার রব তোমার প্রতি যে হিকমত ওহী হিসেবে প্রেরণ করেছে তারই অংশ।”
এগারো: সূরা নিসার ‘আল- হুকুকুল আশারা’ [বা দশটি হক] নামক আয়াতটিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিম্নের বাণী দ্বারা শুরু করেছেন, “আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না।”
বারো: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর সময় তাঁর অসিয়তের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন।
তের: আমাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার হকসমূহ জানা।
চৌদ্দ: আল্লাহর ওপর বান্দার হকসমূহ জানা, যখন বান্দাগণ তাঁর হক আদায় করবে।
পনেরো: অধিকাংশ সাহাবী এই মাসআলা জানেন না।
ষোল: কোনো বিশেষ স্বার্থে ইলম গোপন রাখা বৈধ।
সতের: মুসলিমকে যেসব বিষয় আনন্দ দান করে তার সুসংবাদ দেয়া মুস্তাহাব।
আঠারো: আল্লাহর রহমতের প্রশস্ততার ওপর ভরসা করে অলস হওয়ার ভয়।
ঊনিশ: জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি যা জানে না সে বিষয়ে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন- বলা।
বিশ: কাউকে বাদ রেখে অন্য কাউকে ইলম দানে বিশেষিত করার বৈধতা।
একুশ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়। কারণ, তিনি গাধার পিঠে চড়েছেন তার পেছনে আরেকজনকে সঙ্গী করে।
বাইশ: সাওয়ারীর ওপর কাউকে পেছনে নেয়া বৈধ।
তেইশ: মু‘আয ইবন জাবালের ফজিলত।
চব্বিশ: এই মাসআলাটির মর্যাদা অনেক বড়।
পরিচ্ছেদ: তাওহীদের মর্যাদা এবং যা গুনাহসমূহকে মুছে দেয়
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুম (শির্ক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।” [আল-আন‘আম: ৮২]
উবাদাহ ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন, “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া (সত্য) কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই, আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, আর তাঁর বাণী যা তিনি মারইয়ামের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন এবং তাঁর রূহ আর জান্নাত সত্য ও জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; সে যে আমলের ওপরই থাকুক।” এটিকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। তাঁদের উভয়ের গ্রন্থে ইতবানের হাদীসে রয়েছে: “যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্যে জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন।”
আবূ সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মূসা বললেন, হে আমার রব! আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যা দিয়ে আমি তোমার স্মরণ করব এবং তোমাকে ডাকবো। তিনি বললেন হে মূসা তুমি বল, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই। তিনি বললেন, হে আমার রব! তোমার প্রতিটি বান্দাইতো এ বাক্য বলে থাকে। তিনি বললেন, হে মূসা, যদি সাত আসমান এবং আমি ছাড়া তার অধিবাসীগণ এবং সাত যমীন এক পাল্লায় রাখা হয় এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অপর পাল্লায় রাখা হয়, তাহলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাদের নিয়ে ঝুঁকে পড়বে।” এটি ইবন হিব্বান ও হাকেম বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এটিকে সহীহ বলেছেন।
আর তিরমিযীতে রয়েছে, যা তিনি হাসান বলেন, আনাস থেকে বর্ণিত। আমি রাসূল্লাহ সালাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘হে আদম সন্তান, তুমি দুনিয়া ভর্তি গুনাহ নিয়ে যদি আমার কাছে হাজির হও, আর আমার সাথে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় তুমি আমার সাথে সাক্ষাত করো, তাহলে আমি দুনিয়া পরিমাণ মাগফিরাত নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবো।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর করুণা ব্যাপক।
দুই: আল্লাহর নিকট তাওহীদের অনেক সাওয়াব।
তিন: তাওহীদ থাকলে তার গুনাহসমূহকে দূর করে দেয়া হবে।
চার: সূরা আন আন‘আমের ৮২ নং আয়াতের তাফসীর।
পাঁচ: উবাদাহর হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ে চিন্তা করা।
ছয়: উবাদাহ ও ইতবানের হাদীস এবং যা তার পরে রয়েছে তা সব একত্র করলে তোমার সামনে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ সুস্পষ্ট হবে এবং ধোঁকায় নিপতিত লোকদের ভুলও তোমার কাছে স্পষ্ট হবে।
সাত: ইতবানের হাদীসে উল্লিখিত শর্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ।
আট: নবীগণও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর ফযীলত জানার প্রতি মুখাপেক্ষী ছিলেন।
নয়: সমগ্র সৃষ্টিসহ তার ঝুঁকে যাওয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা, অথচ এ কালিমা যারা বলেন তাদের অনেকের পাল্লাহ হালকা হবে।
দশ: স্পষ্ট দলিল যে, সাত আসমানের মতো যমীনও সাতটি।
এগারো: প্রত্যেক আসমান ও জমিনের আবাদকারী রয়েছে।
বারো: আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীকে সাব্যস্ত করা যা আশআরী সম্প্রদায়ের মতের পরিপন্থী।
তের: আনাসের হাদীস যখন তুমি অবগত হবে, তখন তুমি ইতবানের হাদীসে বর্ণিত তাঁর বাণী-
فإن الله حرم على النار من قال لا إله إلا الله يبتغي به وجه الله
“যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্যে জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন।”-এর মর্মার্থ বুঝতে পারবে। আর তা হচ্ছে শিরক বর্জন করা, শুধু মুখে বলা নয়।
চৌদ্দ: ঈসা ও মুহাম্মদ উভয়ের আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল হওয়ার বিষয়টি একত্রে জমা করার কারণটিতে চিন্তা করো।
পনের: বিশেষভাবে ঈসার ‘কালিমাতুল্লাহ’ -আল্লাহর কালিমা- হওয়ার বিষয়টি জানা।
ষোল: তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে রুহ তা জানা।
সতের: জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনার ফজিলত জানা।
আঠারো: তার বাণী “আমল যাই হোক না কেন”, এ কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করা।
ঊনিশ: মিজানের দুটি পাল্লা আছে তা জানা।
বিশ: চেহারা উল্লেখ করার বিষয়টি জানা।
পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তি তাওহীদ বাস্তবায়ন করবে সে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “নিশ্চয় ইবরাহীম ছিলেন এক উম্মাত, আল্লাহর একান্ত অনুগত, একনিষ্ঠ এবং তিনি ছিলেন না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত।” [আন-নাহাল: ২০]
তিনি আরও বলেন, “আর যারা তাদের রব-এর সাথে শির্ক করে না।” [আল-মুমিনূন: ৫৯]
হুসাইন ইবন আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি সাঈদ ইবন জুবাইর এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, গতকাল রাত্রে যে নক্ষত্রটি ছিটকে পড়েছে তা তোমাদের মধ্যে কে দেখতে পেয়েছে? তখন বললাম, ‘‘আমি’’। তারপর বললাম, ‘বিষাক্ত প্রাণী কর্তৃক দংশিত হওয়ার কারণে আমি সালাতে উপস্থিত থাকতে পারিনি’। তিনি বললেন, ‘তখন তুমি কী করেছ? আমি বললাম ‘‘ঝাড় ফুঁক করেছি’’ তিনি বললেন, কিসে তোমাকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? [অর্থাৎ তুমি কেন এ কাজ করলে?] বললাম, ‘একটি হাদীস’ [এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে] যা শা’বী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। তিনি বললেন, তিনি তোমাদেরকে কী বর্ণনা করেছেন? বললাম ‘তিনি বুরাইদাহ ইবন আল হুসাইব থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “চোখের দৃষ্টি বা চোখ লাগা এবং জ্বর ব্যতীত অন্য কোনো রোগে ঝাড়- ফুঁক নেই।” তিনি বললেন, ‘সে ব্যক্তিই উত্তম কাজ করেছে, যে যা শুনেছে তাতেই ক্ষান্ত করেছে। কিন্তু ইবন আববাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, “আমার সম্মুখে সমস্ত জাতিকে উপস্থাপন করা হলো। তখন আমি এমন একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে। এরপর আরো একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে একজন ও দু’জন লোক রয়েছে। আবার এমন একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে কোনো লোকই নেই। ঠিক এমন সময় আমার সামনে এক বিরাট জনগোষ্ঠী পেশ করা হলো। তখন আমি ভাবলাম, এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হলো এরা হচ্ছে মূসা এবং তাঁর জাতি। এরপর আরো একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর দিকে আমি তাকালাম। তখন আমাকে বলা হলো, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তুর হাজার লোক রয়েছে যারা বিনা হিসেবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” একথা বলে তিনি দরবার থেকে উঠে বাড়ির অভ্যন্তরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা ঐ সব ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করে দিলো। কেউ বললো, তারা বোধ হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহচার্য লাভকারী ব্যক্তিবর্গ। আবার কেউ বললো, তারা বোধ হয় ইসলামী পরিবেশে অথবা মুসলিম মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে তারা কাউকে শরিক করেনি। তারা এ ধরনের আরো অনেক কথা বলাবলি করলো। অতঃপর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে উপস্থিত হলে বিষয়টি তাঁকে জানানো হলো। তখন তিনি বললেন, “তারা হচ্ছে ঐ সব লোক যারা ঝাড়-ফুক করে না। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করে না। শরীরে সেক বা দাগ দেয় না। আর তাদের রবের উপর তারা ভরসা করে।” একথা শুনে ওয়াকাশা ইবন মুহসিন দাঁড়িয়ে বললো, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভুক্ত করে নেন। তিনি বললেন, ‘‘তুমি তাদের দলভুক্ত’’। অতঃপর অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে বললো, আল্লাহর কাছে আমার জন্যও দোয়া করুন যেন তিনি আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে নেন। তিনি বললেন, ‘‘তোমার পূর্বেই ওয়াকাশা সে সুযোগ নিয়ে গেছে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: তাওহীদের ব্যাপারে মানুষের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে জানা।
দুই: তাওহীদ বাস্তবায়নের অর্থ কী?
তিন: ইবরাহীম মুশরিক ছিলেন না বলে তার ওপর আল্লাহর তা‘আলার প্রশংসা করা।
চার: বড় বড় ওলীগণের প্রশংসা করা। কারণ তারা শির্ক থেকে নিরাপদ ছিলেন।
পাঁচ: ঝাড়-ফুঁক এবং আগুনের দাগ পরিত্যাগ করা তাওহীদের বাস্তবায়ন।
ছয়: আল্লাহর উপর ভরসা বা তাওয়াক্কুলই বান্দার মধ্যে উল্লেখিত গুণ ও স্বভাবসমূহের সমাবেশ ঘটায়।
সাত: সাহাবীগণের ইলমের গভীরতা যে, তারা জানতেন (বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করার) উক্ত মর্যাদা তারা আমল ব্যতীত হাসিল করেননি।
আট: ভালো কর্মের প্রতি তাঁদের (সাহাবীদের) অপরিসীম আগ্রহ।
নয়: সংখ্যা ও গুণাবলী উভয় দিক থেকে এ উম্মতের ফযীলত।
দশ: মূসার সাহাবীদের মর্যাদা।
এগারো: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সব উম্মতকে উপস্থিত করা।
বারো: প্রত্যেক উম্মতই নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথকভাবে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে।
তের: নবীগণের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মত লোক কম।
চৌদ্দ: যে নবীর দাওয়াত কেউ সাড়া দেয়নি তিনি একাই হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন।
পনেরো: এই ইলমের শিক্ষা হচ্ছে, সংখ্যাধিক্যের দ্বারা ধোকা না খাওয়া আবার সংখ্যাল্পতার ভেতর অনাগ্রহী না হওয়া।
ষোল: চোখ-লাগা এবং জ্বরের চিকিৎসার জন্য ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি।
সতের: সালাফে সালেহীনের ইলমের গভীরতা। কারণ, তার বাণী قد أحسن من انتهى إلى ما سمع ‘‘সে ব্যক্তিই ভাল কাজ করেছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শুনেছে তার ওপর ক্ষান্ত করেছে’। তবে এমন ও এমন।” কাজেই জানা গেল যে, প্রথম হাদীস দ্বিতীয় হাদিসের বিরোধী নয়।
আঠারো: মানুষের মধ্যে যে গুণ নেই তার প্রশংসা থেকে সালাফে সালেহীন বিরত থাকতেন।
ঊনিশ: أنت منهم (তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত) ওয়াকাশার ব্যাপারে একথা নবুওয়তেরই প্রমাণ পেশ করে।
বিশ: ওয়াকাশার মর্যাদা ও ফযীলত।
একুশ: অস্পষ্ট ইশারা ও ঈঙ্গিত ব্যবহার করা।
বাইশ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের সৌন্দর্যতা।
অনুচ্ছেদ: শিরক থেকে ভয়।
মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে কৃত শিরককে ক্ষমা করবেন না, আর এ ছাড়া সকল কিছুই যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দিবেন।” [আন-নিসা: ৪৮]
ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম বলেন, “আমাকে এবং আমার সন্তানদের মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা কর।” [ইবরাহীম: ৩৫]
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “আমি তেমাদের ওপর যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হচ্ছে ছোট শির্ক। তা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন: রিয়া (লোক দেখানো আমল)।”
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো শরীককে ডাকে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন। আর মুসলিমে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে যে অবস্থায় সে তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করে না সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে যে অবস্থায় সে তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: শির্ককে ভয় করা।
দুই: রিয়া (লৌকিকতা) শির্কের অন্তর্ভুক্ত।
তিন: রিয়া (লৌকিকতা) হল ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
চার: নেককার লোকদের ওপর যার আশঙ্কা করা হয় তার মধ্যে ছোট শিরক সবচেয়ে বিপজ্জনক।
পাঁচ: জান্নাত ও জাহান্নাম কাছাকাছি হওয়া।
ছয়: জান্নাত ও জাহান্নাম নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি একই হাদীসে বর্ণিত হওয়া।
সাত: যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে তার সঙ্গে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় সে জান্নাতে যাবে। আর যে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে তার সঙ্গে কাউকে শরিক করা অবস্থায় সে জাহান্নামে যাবে, যদিও সে মানুষের ভেতর সবচেয়ে বেশী ইবাদতকারী হয়।
আট: মহান মাসআলা হলো। ইবরাহীম খলীলের তাঁর নিজের জন্য এবং তাঁর সন্তানের জন্য মূর্তিপূজা তথা শিরক থেকে সুরক্ষার প্রার্থনা করা।
নয়: অধিকাংশ লোকের অবস্থা থেকে তার উপদেশ গ্রহণ। কারণ, তিনি বলেন, “হে আমার রব, এমূর্তিগুলো বহু লোককে গুমরাহ করেছে।”
দশ: তাতে রয়েছে, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র তাফসীর। যেমনটি বুখারী উল্লেখ করেছেন।
এগারো: যে ব্যক্তি শির্ক থেকে মুক্ত থাকল তার ফযীলত।
অনুচ্ছেদ: আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার প্রতি আহ্বান করা।
আর মহান আল্লাহর বাণী: “বলুন, ‘এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি ডাকি জেনে-বুঝে, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ কতই না পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” [ইউসূফ: ১০৮]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মু‘আয ইবন জাবালকে ইয়ামানে পাঠান তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। সুতরাং তুমি তাদেরকে ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল’ এ কথার সাক্ষ্যদানের প্রতি দাওয়াত দেবে। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাদের উপর প্রতি দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। তারা যদি এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের সম্পদের ওপর সাদকাহ (যাকাত) ফরয করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদের থেকে যাকাত উসূল ক’রে যারা দরিদ্র তাদের মাঝে বিতরণ করা হবে। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তুমি (যাকাত নেওয়ার সময়) তাদের উৎকৃষ্ট মাল নেওয়া থেকে দূরে থাকবে। আর অত্যাচারিতের বদ্দুআ থেকে বাঁচবে। কারণ, তার বদ্দুআ এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ, শীঘ্র কবুল হয়ে যায়)।” হাদীসটি তারা দুইজন (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনা করেছেন।
বুখারী ও মুসলিমে সাহাল ইবন সাআদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারের [যুদ্ধের] দিন বললেন, “নিশ্চয় আমি আগামীকাল যুদ্ধের পতাকা এমন এক ব্যক্তিকে দিব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালোবাসেন। তার হাতেই আল্লাহ বিজয় দান করবেন।” কাকে ঝান্ডা প্রদান করা হবে এ উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতার মধ্যে লোকজন রাত্রি যাপন করলো। যখন সকাল হয়ে গেলো তখন লোকজন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলো তাদের প্রত্যেকেই আশা পোষণ করছিলো যে ঝান্ডা তাকেই দেয়া হোক। তখন তিনি বললেন, আলী ইবন আবী তালিব কোথায়?
বলা হলো, তিনি চক্ষুর পীড়ায় ভোগছেন। তাদেরকে তার নিকট প্রেরণ করা হলে তাকে নিয়ে আসা হলো। তারপর তিনি তার দুই চোখে থু থু ছিটালেন এবং তার জন্য দোআ করলেন। তখন তিনি এমন সুস্থ হলেন যেন তার কোনো রোগই ছিল না। তারপর তিনি তার হাতে পতাকা তুলে দিয়ে বললেন। “তাদের আঙ্গীনায় পৌছা পযন্ত তুমি তোমার মতো করে চলতে থাকো। তারপর তুমি তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দাও এবং তাদের ওপর আল্লাহর যে সব হক আদায় করা ওয়াজিব তা জানিয়ে দাও। তোমার দ্বারা একজন মানুষও যদি হিদায়াত পায় তা তেমাার জন্য লাল উট হতে উত্তম “
গভীরে গিয়ে চিন্তা করা।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা হলো যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করে তাদের নীতি ও পথ।
দুই: ইখলাসের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। কেননা অনেক লোক হকের পথে মানুষকে আহ্বান জানালেও মূলতঃ তারা নিজের স্বার্থের দিকেই আহ্বান জানায়।
তিন: সুন্দরভাবে জানা ও বুঝা ফরয।
চার: তাওহীদের সৌন্দর্যের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি গাল-মন্দের সকল কারণ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র থাকা।
পাঁচ: শিরকের নিকৃষ্টতা হচ্ছে, তাতে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি গাল-মন্দ রয়েছে।
ছয়: এটি তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি: অর্থাৎ মুসলিমদের মুশরিকদের থেকে দূরে রাখা। যাতে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যায়; যদিও সে শির্ক না করে।
সাত: তাওহীদই হচ্ছে সর্ব প্রথম ফরয।
আট: সর্বাগ্রে এমন কি নামাযেরও পূর্বে তাওহীদ দিয়েই আরম্ভ করা হবে।
নয়: আল্লাহকে এক জানার অর্থ হচ্ছে, ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ সাক্ষ্যের অর্থ।
দশ: একজন মানুষ কখনো কখনো আহলে কিতাব হয়; অথচ সে তা জানে না বা সে জানে, তবে সে তদনুযায়ী আমল করে না।
এগারো: পর্যায়ক্রমে শিক্ষা দানের প্রতি গুরুত্বারোপ।
বারো: সর্ব প্রথম অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুরু করা।
তের: যাকাত প্রদানের খাত।
চৌদ্দ: শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রের সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উন্মোচন করা।
পনেরা: যাকাত আদায়ের সময় বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নেয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।
ষোল: মজলুমের বদ দোয়া থেকে বেঁচে থাকা।
সতেরো: মজলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকার সংবাদ প্রদান করা।
আঠারো: সাইয়্যিদুল মুরসালীন ও বড় বড় অলীদের উপর যে সব দুঃখ- কষ্ট এবং কঠিন বিপদাপদ আপতিত হয়েছে তা তাওহীদেরই প্রমাণ স্বরূপ।
ঊনিশ: তার বাণী: “অবশ্যই পতাকা প্রদান করব” শেষ পর্যন্ত, নবুওয়তের একটি নিদর্শন।
বিশ: তার দু’চোখে তাঁর থু থু দেওয়া নবুয়্যতের একটি নিদর্শন।
একুশ: ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মর্যাদা।
বাইশ: সেই রাতে সাহাবীদের অপেক্ষা ও আগ্রহে থাকা এবং বিজয়ের সুসংবাদ থেকে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার ভেতর সাহাবীগণের মর্যাদা প্রমাণিত হয়।
তেইশ: বিনা প্রচেষ্টায় ইসলামের পতাকা লাভ করা আর চেষ্টা করেও তা লাভে ব্যর্থ হওয়া, উভয় অবস্থায়ই তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখা।
চব্বিশ: “ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাও” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথায় ভদ্রতা নিহিত রয়েছে।
পঁচিশ: যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা।
চাব্বিশ: ইতোপূর্বে যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদেরকেও যুদ্ধের আগে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার অনুমোদন।
সাতাশ: হিকমতের সঙ্গে দাওয়াত প্রদান করা। কারণ, তিনি বলেছেন: “এবং তাদের ওপর আল্লাহর যে সব হক আদায় করা ওয়াজিব তা জানিয়ে দাও।”
আটাশ: দীন ইসলামে আল্লাহর হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।
ঊনত্রিশ: যার হাতে একজন মানুষ হেদায়াত প্রাপ্ত হয় তার সওয়াব প্রমাণিত হয়।
ত্রিশ: ফতোয়ার ব্যাপারে কসম করা।
অনুচ্ছেদ: তাওহীদ ও আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই সাক্ষ্য প্রদানের (শাহাদার) ব্যাখ্যা।
আল্লাহ তাআলার বাণী: “তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হতে পারে, আর তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় আপনার রবের শাস্তি ভয়াবহ।” [আল-ইসরা: ৫৭]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: “আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমরা যেগুলোর ইবাদাত করা নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পৰ্কমুক্ত। (২৬) তবে তিনি ব্যতীত যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর নিশ্চয় তিনি শীঘ্রই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন। (২৭) আর এ ঘোষণাকে তিনি চিরন্তন বাণীরূপে রেখে গিয়েছেন তার উত্তরসূরীদের মধ্যে, যাতে তারা ফিরে আসে।” [আয-যুখরফ: ২৬-২৮]
এবং মহান আল্লাহ আরও বলেন, “তারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের রবরূপে গ্রহণ করেছে এবং মার্’ইয়াম- পুত্র মসীহ্ কেও। অথচ এক ইলাহের ‘ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ্ নাই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্র! [তাওবাহ: ৩১]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: “মানুষের মধ্যে এমন মানুষও রয়েছে যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সদৃশ স্থির করে, আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে।” [আল-বাকারাহ: ১৬৬]
সহীহ হাদীস গ্রন্থে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলল এবং আল্লাহ ব্যতিত যার ইবাদত করা হয়, তার সাথে কুফরী করল তার জান ও মাল নিরাপদ এবং তার হিসাব আল্লাহর জিম্মায়।”
পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই অধ্যায়ের ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তাতে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা রয়েছে। আর তা হচ্ছে তাওহীদ:
তাওহীদের তাফসীর ও শাহাদাতের তাফসীর। কয়েকটি সুস্পষ্ট বিষয়ের মাধ্যমে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে:
যেমন- (ক) সূরা ইসরার আয়াত, তাতে সে সব মুশরিকদের সমুচিতজওয়াব দেযা হয়েছে যারা বুজুর্গ ও নেক বান্দাদেরকে (আল্লাহকে ডাকার মত] ডাকে। তাতে আরও রয়েছে যে এটা হলো ‘শিরকে আকবার’ সবচেয়ে বড় শিরক।
(খ) সূরা তাওবার আয়াত। এতে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি খৃষ্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আলেম ও দরবেশ ব্যক্তিরদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। আরো বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়নি। অধিকন্তু তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হলো যে, অন্যায় ও পাপ কাজ ছাড়া আলেম ও ইবাদতকারীদের আনুগত্য করা যাবে, কিন্তু তারা তাদেরকে আহ্বান করতে পারবে না।
(গ) কাফেরদেরকে লক্ষ্য করে ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালামের কথা: “নিশ্চয় আমি তোমরা যা কর তা থেকে মুক্ত।” (২৬) “কেবল তাঁরই যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন” তিনি তাঁর রবকে যাবতীয় মা’বুদ থেকে আলাদা করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা এখানে এটাই বর্ণনা করেছেন যে [বাতিল মা’বুদ থেকে] পবিত্র থাকা আর প্রকৃত মাবুদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ সাক্ষ্য প্রদানের প্রকৃত ব্যাখ্যা। “আর এ ঘোষণাকে তিনি চিরন্তন বাণীরূপে রেখে গিয়েছেন তার উত্তরসূরীদের মধ্যে, যাতে তারা ফিরে আসে।”
সূরা বাকারার কাফেরদের বিষয় সম্পর্কিত আয়াত। যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তারা কখনো জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।” এখানে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকরা তাদের শরীকদেরকে [যাদেরকে তারা আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার মনে করে] আল্লাহকে ভালবাসার মতই ভালবাসে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা আল্লাহকে ভালবাসে, কিন্তু এ ভালবাসা তাদেরকে ইসলামে দাখিল করতে পারেনি। তাহলে আল্লাহর শরীককে যে ব্যক্তি আল্লাহর চেয়েও বেশী ভালবাসে সে কিভাবে ইসলামকে গ্রহণ করবে?
আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র শরীককেই ভালবাসে। আল্লাহর প্রতি তার কোন ভালবাসা নেই তার অবস্থাই বা কি হবে?!
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলল এবং আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করা হয়, তার সাথে কুফরী করল তার জান ও মাল নিরাপদ এবং তার হিসাব আল্লাহর জিম্মায়।”
(শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল-ওয়াহহাব তাঁর তাওহীদ নামক কিতাবে এ হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন:) এটি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ বর্ণনাকারী একটি মহান হাদীস। কারণ, এটি শুধু মুখে বলাকে কারো জান ও সম্পদের রক্ষাকারী নির্ধারণ করেনি; বরং মুখে বলার সাথে তার অর্থ জানা ও তা স্বীকার করাকেও যথেষ্ট করেনি এবং সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকে না যার কোনো শরীক নেই এতেও যথেষ্ট করেনি; বরং তার সম্পদ ও জান হারাম হবে না যতক্ষণ না সে তার সাথে আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যকে অস্বীকার করা যোগ না করবে। যদি সন্দেহ বা দ্বিধা থাকে তাহলে তার রক্ত ও সম্পদ নিরাপত্তা পাবে না। সুতরাং এটি কতই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়!
আহ, কী চমৎকার ব্যাখ্যা! কী স্পষ্ট বর্ণনা! এবং বিতর্ককারীরকে লা-জাওয়াবকারী কী অকাট্য দলীল?!
পরিচ্ছেদ: বালা মুসীবত দূর করা অথবা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে রিং, তাগা [সূতা] ইত্যাদি পরিধান করা শিরক।
আল্লাহ তাআলার বাণী: “বলুন, 'তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ্ আমার অনিষ্ট করতে চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহকে রোধ করতে পারবে?' বলুন, 'আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।' নির্ভরকারীগণ তাঁর উপরই নির্ভর করে।” [যুমার: ৩৮]
ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে তামার আঙ্কটি দেখে বললেন, ‘‘এটা কি?’’ লোকটি বললো, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, “এটা খুলে ফেলো। কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকেই শুধু বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তবে তুমি কখনো সফলকাম হতে পারবে না।” এটি আহমাদ সমস্যাহীন সনদে বর্ণনা করেছেন।
উকবা ইবন আমের হতে ‘মারফু’ হিসেবে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি তাবীজ ঝুলালো আল্লাহ তার কর্মসমূহ পূর্ণ করবেন না। আর যে ব্যক্তি কোনো ঝিনুক ঝুলালো আল্লাহ তার জন্য তার আশা সহজ করবেন না।” অন্য বর্ণনায় এসেছে, “যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করলো।”
ইবন আবি হাতেম হুযাইফা থেকে বর্ণনা করেছেন, “জ্বর নিরাময়ের জন্য হাতে সূতা বা তাগা পরিহিত অবস্থায় তিনি একজন লোককে দেখতে পেয়ে তিনি সে সূতা কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন, “তাদের বেশীর ভাগই আল্লাহর উপর ঈমান রাখে, তবে তাঁর সাথে (ইবাদতে) শির্ক করা অবস্থায়।” [ইউসূফ: ১০৬]
এতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
প্রথম: রিং (বালা) ও সূতা ইত্যাদি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে পরিধান করার ব্যাপারে অত্যাধিক কঠোরতা।
দ্বিতীয়: স্বয়ং সাহাবীও যদি এসব জিনিস পরিহিত অবস্থায় মারা যায় তাহলে তিনিও সফলকাম হতে পারবেন না। এতে সাহাবায়ে কেরামের এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ছোট শিরক কবিরা গুনাহর চেয়েও মারাত্মক।
তিন: অজ্ঞতার অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
চার: لا تزيدك إلا وهنا ইহা তোমার দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করবে না।’’ এ কথা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে রিং বা সূতা পরিধান করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই বরং অকল্যাণ আছে।
পাঁচ: যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজ করে তার কাজকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
ছয়: যে ব্যক্তি কোনো কিছু ঝুলালো তাকে তার দিকে সোপর্দ করা হবে।
সাত: স্পষ্ট করা হলো ‘‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করলো।’’
আট: জ্বর নিরাময়ের জন্য সূতা পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
নয়: সাহাবী হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম শিরকে আসগরের দলীল হিসেবে ঐ আয়াতকেই পেশ করেছেন যে আয়াতে শিরকে আকবার বা বড় শিরকের কথা রয়েছে। যেমনটি ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বাকারার আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
দশ: নজর বা চোখ লাগা থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য শামুক, কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদি লটকানো বা পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
এগারো: যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করে তার উপর বদ দোয়া করা হয়েছে, ‘আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন।’ আর যে ব্যক্তি শামুক, কড়ি বা শঙ্খ (গলায় বা হাতে) লটকায় তাকে যেন আল্লাহ রক্ষা না করেন।
পরিচ্ছেদ: ঝাড় ফুক ও তাবিজ কবজ ইত্যাদি প্রসঙ্গে
সহীহ গ্রন্থে আবু বাসীর আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফর সঙ্গী ছিলেন। তিনি একজন দূতকে পাঠালেন: “(এর উদ্দেশ্য ছিল) কোনো উটের গলায় ধনুকের রজ্জু লটকানো রাখবে না অথবা এ জাতীয় রজ্জু রাখবে না, অবশ্যই তা কেটে ফেলা হবে।
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “মন্ত্র, তাবীয, গিটযুক্ত মন্ত্রের সূতা হলো শির্ক।” এটি আহমদ ও আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন।
تمائم বা তাবিজ হচ্ছে এমন জিনিস যা চোখ লাগা বা দৃষ্টি লাগা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সন্তানদের গায়ে ঝুলানো হয়। ঝুলন্ত জিনিসটি যদি কুরআনের অংশ হয় তাহলে সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এর অনুমতি দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ অনুমতি দেননি বরং এটাকে শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় বলে গণ্য করতেন। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ অভিমতের পক্ষে রয়েছেন।
আর رقى বা ঝাড়-ফুঁককে عزائم নামে অভিহিত করা হয়। যে সব ঝাড়-ফুঁক শিরক মুক্ত তা দলিলের মাধ্যমে খাস করা হয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাললাম চোখের দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্ছুর বিষের ব্যাপারে ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন।
“তিওয়ালা” এমন জিনিস যা কবিরাজদের বানানো। তারা দাবী করে যে, এ জিনিস [কবজ] দ্বারা স্ত্রীকে স্বামীর কাছে আর স্বামীকে স্ত্রীর কাছে প্রিয় করা হয়।
আব্দুল্লাহ ইবন উকাইম থেকে মারফু হিসেবে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি কোনো কিছু ঝুলালো তাকে তার দিকে সোপর্দ করা হবে।” এটি আহমাদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রুআইফি‘ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “হে রুআইফি, তোমার হায়াত সম্ভবত দীর্ঘ হবে। তুমি লোকজনকে জানিয়ে দিও, যে ব্যক্তি দাড়িতে গিরা দিবে, অথবা গলায় তাবিজ- কবজ ঝুলাবে অথবা পশুর মল কিংবা হাড় দ্বারা এস্তেঞ্জা করবে, মুহাম্মদ তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।”
সাঈদ ইবন জুবাইর থেকে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি কোনো মানুষ থেকে তাবীজ কেটে দিল, সে একটি গোলাম মুক্ত করার মতো হলো।” এটি ওয়াকী বর্ণনা করেছেন।
ইবরাহীম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “তারা কুরআন অথনা কুরআন ছাড়া যে কোনো কিছুর তাবীজকে অপছন্দ করতেন।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
প্রথম: ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজের ব্যাখ্যা।
দ্বিতীয়: (تولة) ‘‘তাওলাহ’’ এর ব্যাখ্যা।
তিন: কোনো ব্যাতিক্রম ছাড়াই উপরোক্ত তিনটি বিষয় শিরক।
চার: কুরআনের বাণীর সাহায্যে [চোখের] দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্ছুর বিষ নিরাময়ের জন্য ঝাড়-ফুঁক করা শিরক নয়।
পাঁচ: তাবিজ কুরআন দ্বারা হলে তা শিরক হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ছয়: নজর বা চোখ লাগা থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য শামুক, কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদি জন্তুর গলায় লটকানো শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
সাত: যে ব্যক্তি ধনুকের রজ্জু গলায় ঝুলায় তার উপর কঠিন ধমক।
আট: কোনো মানুষের তাবিজ- কবজ ছিড়ে ফেলা কিংবা কেটে ফেলার ফজিলত।
নয়: ইবরাহীমের কথা পূর্বোক্ত মতভেদের বিরোধী নয়। কারণ এর দ্বারা আব্দুল্লাহর সঙ্গী- সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে।
গাছ, পাথর ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাসিল করা।
আর আল্লাহর বাণী: “অতএব, তোমরা আমাকে জানাও ‘লাত’ ও ‘উযযা' সম্পর্কে। (১৯) এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্পর্কে? (২০) তবে কি তোমাদের জন্য পুত্ৰ সন্তান এবং আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান? (২১) এ রকম বন্টন তো অসঙ্গত। (২২) এগুলো কিছু নাম মাত্র যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছ, যার সমর্থনে আল্লাহ্ কোনো দলীলপ্রমাণ নাযিল করেননি। তারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে; অথচ তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে হেদায়াত এসেছে।” [আন নাজম: ১৯-২৩]
আবু ওয়াকিদ আল-লাইছি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইনের উদ্দেশ্যে বের হলাম, আমরা কুফুরি অবস্থার কাছাকাছি [সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী] ছিলাম। আর মুশরিকদের একটি বৃক্ষ ছিল, তারা সেখানে নিবদ্ধ থাকতো এবং তাদের তলোয়ার ঐ গাছে ঝুলিয়ে রাখত এবং তাকে বলা হত: ‘যাতু আনওয়াত’। সুতরাং আমরা যখন গাছটির পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য একটি ‘যাতু আনওয়াত’ এর ব্যবস্থা করুন, যেমন তাদের একটি ‘যাতু আনওয়াত’ রয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার, তোমাদের এ দাবীটি পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা এমন কথাই বলেছো যা বনী ইসরাইল মূসাকে বলেছিলো। তারা বলেছিলো, ‘‘হে মূসা, মুশরিকদের যেমন মা’বুদ আছে আমাদের জন্য তেমন মা’বুদ বানিয়ে দাও। মুসা বললেন, তোমরা মূর্খের মতো কথা বার্তা বলছো’’ (আরাফ: ১৩৮)। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতিই অবলম্বন করবে।” এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।
পরিচ্ছিতটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
প্রথম: আন-নাজমের আয়াতের তা্ফসীর
দ্বিতীয়: তারা যা তলব করেছিলেন, সেই বিষয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা।
তিন: তারা বনী ইসরাইলদের মতো মূর্খ কাজ করেননি।
চার: তাঁরা তার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চেয়েছিলেন এ কথা ভেবে যে, আল্লাহ তা পছন্দ করেন।
পাঁচ: সাহাবায়ে কেরামই যদি এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকেন তাহলে অন্য লোকেরা তো এ ব্যাপারে আরো বেশী অজ্ঞ থাকবে।
ছয়: সাহাবায়ে কেরামের জন্য যে অধিক সওয়াব দান ও গুনাহ মাফের ওয়াদা রয়েছে অন্যদের ব্যাপারে তা নেই।
সাত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের না-জানাকে অযুহাত হিসেবে গ্রহণ করেননি, বরং তাঁদের কথার শক্ত জবাব এ কথার মাধ্যমে দিয়েছেন- “আল্লাহু আকবার নিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী লোকদের নীতি। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের নীতি অনুসরণ করবে।” উপরোক্ত তিনটি কথার দ্বারা বিষয়টি অধিক কঠিন করেছেন।
আট: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর তাই হলো মূল উদ্দেশ্য যে, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, সাহাবায়ে কেরামের দাবী বনু ইসরাইলের দাবীর মতই, যখন তারা মূসাকে বলেছিল: “আমাদের জন্যে একটি ইলাহ বানিয়ে দিন।
নয়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক না সূচক জবাবের মধ্যেই তাঁদের জন্য ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর’’ মর্মার্থ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নিহিত আছে।
দশ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফতোয়া দানের ব্যাপারে “হলফ” করেছেন, অথচ তিনি কারণ ছাড়া কসম করেন না।
এগারো: শিরকের মধ্যে ‘আকবার’ ও ‘আসগার’ রয়েছে। কারণ, তাঁরা এর দ্বারা দীন থেকে বের হয়ে যাননি।
বারো: “আমরা কুফরী যমানার খুব কাছাকাছি ছিলাম” [অর্থাৎ আমরা সবেমাত্র মুসলমান হয়েছি] এ কথার দ্বারা বুঝা যায় যে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন না।
তের: আশ্চর্যজনক ব্যাপারে যারা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা পছন্দ করে না, এটা তাদের বিরুদ্ধে একটা দলীল।
চৌদ্দ: পাপের পথ বন্ধ করা।
পনেরো: জাহেলী যুগের লোকদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ নিষেধ।
ষোল: শিক্ষাদানের সময় প্রয়োজন বোধে রাগ করা।
সতেরো: “এটা পূর্ববর্তী লোকদের নীতি” এ বাণী একটা চিরন্তন নীতি।
আঠারো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সংবাদ বলেছেন, বাস্তবে তাই ঘটেছে। এটা নবুয়তেরই নিদর্শন।
ঊনিশ: কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইহুদী ও খৃষ্টানদের চরিত্র সম্পর্কে যে দোষ-ত্রুটির কথা বলেছেন, তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যই বলেছেন।
বিশ: তাদের [আহলে কিতাবের] কাছে এ কথা স্বীকৃত যে ইবাদতের ভিত্তি হচ্ছে [আল্লাহ কিংবা রাসুলের] নির্দেশ। এখানে কবর সংক্রান্ত বিষয়ে শর্তকতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। [তোমার রব কে?] দ্বারা যা বুঝানো হয়েছে তা সুস্পষ্ট। [অর্থাৎ আল্লাহ শিরক করার নির্দেশ না দেয়া সত্বেও তুমি শিরক করেছো। তাহলে তোমার রব কে যার হুকুমে শিরক করেছো?]। [ তোমার নবী কে] এটা নবী কর্তৃক গায়েবের খবর [অর্থাৎ কবরে কি প্রশ্ন করা হবে এ কথা নবী ছাড়া কেউ বলতে পারেনা। এখানে এ কথার দ্বারা বুঝানো হচ্ছে কে তোমার নবী? তিনি তো শিরক করার কথা বলেননি। তারপরও তুমি শিরক করেছো। তাহলে তোমার শিরক করার নির্দেশ দাতা নবী কে?] [তোমার দীন কি] এ কথা তাদের [আমাদের জন্যও ইলাহ ঠিক করে দিন} এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হবে। [অর্থাৎ তোমার দীনতো শিরক করার নির্দেশ দেয়নি তাহলে তোমাকে শিরকের নির্দেশ দান কারী দীন কি?]
একুশ: মুশরিকদের রীতি- নীতির মত আহলে কিতাবের [অর্থাৎ আসমানী কিতাব প্রাপ্তদের] রীতি-নীতিও দূষণীয়।
বাইশ: বাতিল থেকে পরিবর্তনশীল ব্যক্তি পূর্বে যেসব বিষয়ে অভ্যস্ত ছিল তার অন্তরে সেসব বিষয়ের অবশিষ্টাংশ কিছু থাকবে না এ ব্যাপারে নিরাপদ ও নিশ্চিত হওয়া যায় না। [আমরা কুফরী যুগের খুব নিকটবর্তীছিলাম বা নতুন মুসলিম ছিলাম] সাহাবীদের এ কথার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়।
পরিচ্ছেদ: গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করা
আর আল্লাহর বাণী: “বলুন, ‘আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই জন্য। (১৬২) তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম।” [আল-আনআম: ১৬২,১৬৩]
এবং আল্লাহর বাণী “কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। [আল-কাউসার, ২]
আলী ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি বিষয়ে আমাকে অবহিত করেছেন, “যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে (পশু) যবেহ করে তার উপর আল্লাহর লা’নত। যে ব্যক্তি নিজ পিতা- মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত। যে ব্যক্তি কোনো বিদআতীকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত। যে ব্যক্তি জমির সীমানা [চিহ্ণ] পরিবর্তন করে তার উপর আল্লাহর লা’নত।” মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
তারেক ইবন শিহাব থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এক ব্যক্তি একটি মাছির ব্যাপারে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। আর এক ব্যক্তি একটি মাছির ব্যাপারে জাহান্নামে গিয়েছে।”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এমনটি কিভাবে হলো?
তিনি বললেন, “দু’জন লোক এমন একটি কওমের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল যাদের জন্য একটি মূর্তি নির্ধারিত ছিল। উক্ত মূর্তিকে কোনো কিছু নযরানা বা উপহার না দিয়ে কেউ সে স্থান অতিক্রম করত না।
উক্ত কওমের লোকেরা দু’জনের একজনকে বললো, ‘মূর্তির জন্য তুমি কিছু নযরানা পেশ করো’।
সে বললো, ‘নযরানা দেয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই।’
তারা বললো, ‘অন্ততঃ একটা মাছি হলেও নযরানা স্বরূপ দিয়ে যাও’। অতঃপর সে একটা মাছি মূর্তিকে উপহার দিলো। তারাও লোকটির পথ ছেড়ে দিলো। এর ফলে মৃত্যুর পর সে জাহান্নামে গেলো।
অপর ব্যক্তিকে তারা বললো, ‘‘মূর্তিকে তুমিও কিছু নযরানা দিয়ে যাও।
সে বললো, ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নৈকট্য লাভের জন্য আমি কাউকে কোনো নযরানা প্রদান করি না’ এর ফলে তারা তার গর্দান উড়িয়ে দিলো। [শিরক থেকে বিরত থাকার কারণে] মৃত্যুর পর সে জান্নাতে প্রবেশ করলো।” এটি আহমাদ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
প্রথম: قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَ نُسُكِيْ “বলুন, ‘আমার সালাত, আমার কুরবানী” এর তাফসীর।
দ্বিতীয়: “কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন” এর -তাফসীর।
তিন: প্রথম অভিশপ্ত ব্যক্তি হচ্ছে গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহকারী।
চার: “যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত”- এরমধ্যে এ কথাও নিহিত আছে, তোমার কোনো ব্যক্তির পিতা- মাতাকে অভিশাপ দেওয়া ফলে তারও তোমার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেওয়া।
পাঁচ: যে ব্যক্তি বিদআতীকে (অপরাধীকে) আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত। বিদআতী (অপরাধী) হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে এমন ঘটনা ঘটালো যাতে আল্লাহর হক (হদ/শাস্তি) ওয়াজিব হয়। এর ফলে সে এমন ব্যক্তির আশ্রয় চায় যে তাকে উক্ত শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে।
ছয়: যে ব্যক্তি জমির সীমানা বা চিহ্ণ পরিবর্তন করে তার উপর আল্লাহর লা’নত। এটা এমন চিহ্ণিত সীমানা যা তোমার এবং তোমার প্রতিবেশীর জমির অধিকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। এটা পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে, তার নির্ধারিত স্থান থেকে সীমানা এগিয়ে আনা অথবা পিছনে নিয়ে যাওয়া।
সাত: নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর লা’নত এবং সাধারণভাবে পাপীদের উপর লা’নতের মধ্যে পার্থক্য।
আট: এই কাহিনীটি খুব মহান, অর্থাৎ মাছির কাহিনী।
নয়: লোকটির জাহান্নামে প্রবেশ করার কারণ হচ্ছে ঐ মাছি, যা উৎসর্গ হিসেবে মূর্তিকে দেয়ার কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্বেও কওমের অনিষ্টতা হতে বাঁচার উদ্দেশ্যেই সে [মাছিটি নযরানা হিসেবে মূর্তিকে দিয়ে শিরকী] কাজটি করেছে।
দশ: মুমিনের অন্তরে শিরকের [মারাত্মক ও ক্ষতিকর] অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ। নিহত [জান্নাতী] ব্যক্তি নিহত হওয়ার ব্যাপারে কি ভাবে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের দাবীর কাছে সে মাথা নত করেনি। অথচ তারা তার কাছে কেলমাত্র বাহ্যিক আমল ছাড়া আর কিছুই দাবী করেনি।
এগারো: যে ব্যক্তি জাহান্নামে গিয়েছে সে একজন মুসলিম। কারণ সে যদি কাফের হতো তাহলে এ কথা বলা হতোনা دخل النار في ذباب একটি মাছির ব্যাপারে সে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে। [অর্থাৎ মাছি সংক্রান্ত শিরকী ঘটনার পূর্বে সে জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য ছিল]
বারো: এতে সেই সহীহ হাদিসের পক্ষে সাক্ষ্য পাওয়া যায়, যাতে বলা হয়েছে, “জান্নাত তোমাদের কারো জুতার রশি থেকেও অতি নিকটে এবং জাহান্নামও তাই।”
তের: এটা জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, অন্তরের আমলই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য। এমনকি মূর্তি পূজারীদের কাছেও এ কথা স্বীকৃত।
যে স্থানে গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে [পশু] যবেহ করা হয় সে স্থানে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করা শরীয়ত সম্মত নয়।
আর আল্লাহর বাণী: “আপনি তাতে কখনো সালাতের জন্য দাঁড়াবেন না; অবশ্যই যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে তাক্ওয়ার উপর, তাই আপনার সালাতের জন্য দাঁড়ানোর বেশী হকদার। সেখানে এমন লোক আছে যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন ভালবাসে, আর পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন।” [তাওবাহ: ১০৮]
সাহাবী ছাবিত ইবন আদ্দাহহাক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি বুওয়ানা নামক স্থানে একটি উট কুরবানী করার জন্য মান্নত করলো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সে স্থানে এমন কোনো মূর্তি ছিল কি, জাহেলী যুগে যার পূজা করা হতো?”
তারা বললেন, ‘না,।
তিনি বললেন, “সে স্থানে কি তাদের কোনো উৎসব বা মেলা অনুষ্ঠিত হতো?”
তাঁরা বললেন, ‘না’ [অর্থাৎ এমন কিছু হতো না] তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি তোমার মান্নত পূর্ণ করো।” তিনি আরো বললেন, “আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মান্নত পূর্ণ করা যাবে না। আর আদম সন্তান যার মালিক নয়, তাতেও তার মান্নত পূরা করা যাবে না।” এটি বর্ণনা করেছেন আবূ দাউদ, আর তার সনদ তাদের দুইজনের শর্তের অনুরূপ।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
প্রথম: لَا تَقُمْ فِيْهِ اَبَدًا “আপনি তাতে কখনো সালাতের জন্য দাঁড়াবেন না” এর তাফসীর।
দ্বিতীয়: দুনিয়াতে যেমনিভাবে পাপের [ক্ষতিকর] প্রভাব পড়ে তেমনিভাবে [আল্লাহর] আনুগত্যের [কল্যাণময়] প্রভাবও পড়তে পারে।
তিন: দুর্বোধ্যতা দূর করার জন্য কঠিন মাসআলাকে সুস্পষ্ট ও সহজ মাসআলার দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।
চার: প্রয়োজন বোধে ‘‘মুফতী’’ জিজ্ঞাসিত বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ [প্রশ্ন কারীর কাছে] চাইতে পারেন।
পাঁচ: মান্নতের মাধ্যমে কোনো স্থানকে খাস করা কোনো দোষের বিষয় নয়, যদি তাতে শরিয়তের কোনো বাধা-নিষেধ না থাকে।
ছয়: জাহেলী যুগের মূর্তি থাকলে তা দূর করার পরও সেখানে মান্নত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
সাত: জাহেলী যুগের কোনো ঈদ থাকলে তা দূর করার পরও সেখানে মান্নত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
আট: এসব স্থানের মান্নত পূরণ করা জায়েজ নয়। কেননা এটা অপরাধমূলক কাজের মান্নত।
নয়: মুশরিকদের ঈদসমূহের সাদৃশ্য গ্রহণ থেকে সতর্ক থাকা, যদিও তা উদ্দেশ্য না হয়।
দশ: পাপের কাজে কোনো মান্নত করা যাবে না।
এগারো: যে বিষয়ে আদম সন্তানের কোনো মালিকানা নেই সে বিষয়ে মান্নত পূরা করা যাবে না।
পরিচ্ছেদ: গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে মান্নত করা শিরক।
আর আল্লাহর বাণী: তারা মানত পূর্ণ করে এবং সে দিনের ভয়ে করে, যে দিনের অকল্যাণ হবে ব্যাপক। [আল-ইনসান: ৭]
মহান আল্লাহর বাণী: “আর যা কিছু তোমরা ব্যয় কর অথবা যা কিছু তোমরা মানত কর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা জানেন।” [আল-বাকারাহ: ২৭০]
সহীহ বুখারিতে‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করার মান্নত করবে, সে যেন তার আনুগত্য করে। আর যে তার নাফরমানি করার মান্নত করবে, সে যেন তার নাফরমানি না করে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: প্রতিশ্রুতি (মান্নত) পূরণ করা ওয়াজিব।
দুই: মান্নত যেহেতু আল্লাহর ইবাদত হিসেবে প্রমাণিত, সেহেতু গাইরুল্লাহর জন্য মান্নত করা শিরক।
তিন: আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মান্নত পূরণ করা জায়েয নয়।
পরিচ্ছেদ: গাইরুল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া শিরক
আর আল্লাহর বাণী: “এও যে, কিছু কিছু মানুষ কিছু জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা জিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিয়েছিল।” [আল-জিন: ৬]
খাওলা বিনতে হাকীম রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কোখাও অবতরণ করে (أعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق) [অর্থ: আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালাম দিয়ে তাঁর নিকট তাঁর সৃষ্টির খারাবী হতে আশ্রয় চাই] দো‘আটি পাঠ করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জায়গা থেকে ফিরে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছুই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।” মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা আল-জিনের আয়াতের তা্ফসীর।
দুই: গাইরুল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া শির্ক।
তিন: হাদীসের মাধ্যমে তার উপর [অর্থাৎ গাইরুল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া শিরক হওয়ার উপর] দলীল পেশ করা। কেননা,আলেমগণ উক্ত হাদীস দ্বারা এ প্রমাণ পেশ করেন যে, কালিমাতুল্লাহ অর্থাৎ ‘‘আল্লাহর কালাম’’ মাখলুক [সৃষ্টি] নয়। তাঁরা বলেন, ‘কেননা মাখলুক দ্বারা আশ্রয় চাওয়া শিরক।’
চার: সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও দু`আটি ফযীলতপূর্ণ।
পাঁচ: কোনো বস্ত্ত দ্বারা পার্থিব উপকার হাসিল করা অর্থাৎ কোনো অনিষ্ট থেকে তা দ্বারা বেঁচে থাকা কিংবা কোনো স্বার্থ লাভ করা, এ কথা প্রমাণ করে না যে, উহা শিরকের অন্তর্ভুক্ত নয়।
পরিচ্ছেদ: গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয় অথবা গা্ইরুল্লাহর কাছে দোয়া করা সবই শিরক
আল্লাহর বাণী: “আর আপনি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবেন না, যা আপনার উপকারও করে না, অপকারও করে না, কারণ এটা করলে তখন আপনি অবশ্যই যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। (১০৬) আর যদি আল্লাহ্ আপনাকে কোনো ক্ষতির স্পর্শ করান, তবে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর যদি আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ প্রতিহত করার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার কাছে সেটা পৌঁছান। আর তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।” [ইউনুস: ১০৬,১০৭]
এবং তার বাণী- “আল্লাহর কাছে রিযিক চাও এবং তাঁরই ইবাদত করো, তাঁরই শুকরিয়া করো, তার দিকেই তোমাদের ফিরে যাওয়া।” [আল-আনকাবুত: ১৭]
এবং তার বাণী- “আর সে ব্যাক্তির চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের আহ্বান সম্বন্ধেও গাফেল। (৫) আর যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্র করা হবে তখন সেগুলো হবে এদের শত্রু এবং এরা তাদের ইবাদাত অস্বীকার করবে।” [আল-আহকাফ: ৫,৬]
এবং তার বাণী, “নাকি তিনি, যিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ দূরীভূত করেন, আর তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান। আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ আছে কি? তোমরা খুব অল্পই শিক্ষা গ্রহণ করে থাক।” [আন-নামাল: ৬২]
তাবরানী নিজ সনদে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে এমন একজন মুনাফিক ছিলো, যে মুমিনদেরকে কষ্ট দিতো। তখন মুমিনরা পরস্পর বলতে লাগলো, চলো, আমরা এ মুনাফিকের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহায্য চাই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, “নিশ্চয়ই আমার কাছে কোনো কিছুর ফরিয়াদ করা যাবে না। কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করা যাবে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সাহায্য চাওয়ার সাথে দোয়াকে আতফ্ করার ব্যাপারটি কোনো عام বস্ত্তকে خاص বস্ত্তর সাথে সংযুক্ত করারই নামান্তর।
দুই: وَ لَا تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَ لَا يَضُرُّكَ “ আপনি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবেন না, যা আপনার উপকারও করে না, অপকারও করে না,”-আল্লাহর এ বাণীর তাফসীর।
তিন: গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া বা গাইরুল্লাহকে ডাকাই হলো ‘শিরকে আকবার-বড় শির্ক।’
চার: সব চেয়ে নেককার ব্যক্তিও যদি অন্যের সন্তুষ্টির জন্য গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য চায় বা দোয়া করে, তাহলেও সে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
পাঁচ: এর পরবর্তী আয়াত অর্থাৎ وَ اِنْ يَّمْسَسْكَ اللّٰهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهٗۤ اِلَّا هُوَ “আর যদি আল্লাহ্ আপনাকে কোনো ক্ষতির স্পর্শ করান, তবে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই”- এর তাফসীর।
ছয়: গাইরুল্লাহর কাছে দোয়া করা কুফরী কাজ হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াতে তার কোন উপকারিতা নেই।
সাত: তিন নম্বর আয়াতের অর্থাৎ “আল্লাহর কাছে রিযিক চাও এবং তাঁরই ইবাদত করো, তাঁরই শুকরিয়া করো, তার দিকেই তোমাদের ফিরে যাওয়া”- তাফসীর
আট: আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে রিযিক চাওয়া উচিত নয়। যেমনিভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে জান্নাত চাওয়া উচিৎ নয়।
নয়: চার নম্বর আয়াতের অর্থাৎ “আর সে ব্যাক্তির চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের আহ্বান সম্বন্ধেও গাফেল”- তাফসীর
দশ: যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর কাছে দোয়া করে, তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কেউ নেই।
এগারো: যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর কাছে দোয়া করে সে গাইরুল্লাহ দোয়াকারী সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবচেতন থাকে, অর্থাৎ তার ব্যাপারে গাইরুল্লাহ সম্পূর্ণ অনবহিত থাকে।
বারো: مدعو [মাদউ’] অর্থাৎ যাকে ডাকা হয় কিংবা যার কাছে দোয়া করা হয়, দোয়াকারীর প্রতি তার রাগ ও শত্রুতার কারণ এই দোয়াই হবে।
তের: গাইরুল্লাহকে ডাকার অর্থই হচ্ছে তার ইবাদত করা।
চৌদ্দ: মাদউর (যাকে ডাকা হয়েছে তার) সেই ইবাদত অস্বীকার করা।
পনেরো: আর এসব বিষয় মানুষের মধ্যে তার সবচেয়ে পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রমাণ।
ষোল: পাঁচ নম্বর আয়াতের তাফসীর।
সতেরো: বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, মূর্তি পূজারীরাও একথা স্বীকার করে যে, বিপদগ্রস্ত, অস্থির ও ব্যাকুল ব্যক্তির ডাকে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাড়া দিতে পারে না। এ কারণেই তারা যখন কঠিন মুসীবতে পতিত হয়, তখন ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে তারা আল্লাহকে ডাকে।
আঠারো: এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাওহীদের হেফাযত, সংরক্ষণ এবং আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার বিষয়টি জানা গেলো।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “তারা কি এমন বস্তুকে শরীক করে যারা কিছুই সৃষ্টি করে না? বরং ওরা নিজেরাই সৃষ্ট। ওরা না তাদেরকে সাহায্য করতে করতে পারে আর না নিজেদেরকে সাহায্য করতে পারে।” [আল-আরাফ: ১৯১,১৯২]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: “তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে [উপকার সাধন অথবা মুসীবত দূর করার জন্য] ডাকো তারা কোনো কিছুরই মালিক নয়। (১৩) তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ আল্লাহর মত কেউই আপনাকে অবহিত করতে পারে না । [ফাতির: ১৩,১৪]
সহীহ বুখারীতে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত: উহুদ যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঘাত প্রাপ্ত হলেন এবং তাঁর সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেলো। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুঃখ করে বললেন, “সে জাতি কেমন করে কল্যাণ লাভ করবে, যারা তাদের নবীকে আঘাত দেয়।:” তখন নাযিল হলে, لَيْسَ لَكَ مِنَ الْاَمْرِ شَيْءٌ “এ বিষয়ে তোমার কোনো অধিকার নেই।“ [আলে ‘ইমরান: ২৮]
আব্দুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফজরের নামাজের শেষ রাকাতে রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে এ কথা বলতে শুনেছেন, اللهم العن فلانا وفلانا ‘‘আল্লাহ তুমি অমুক, অমুক, [নাম উল্লেখ করে] ব্যক্তির উপর তোমার লানত নাযিল করো।” سمع لله لمن حمده، ربنا ولك الحمد، বলার পরে এ বদদোয়া করতেন। তখন মহান আল্লাহ নাযিল করেন, “এ বিষয়ে তোমার কোনো অধিকার নেই।” [আলে ইমরান: ২৮]
আরেক বর্ণনায় আছে, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা এবং সোহাইল ইবন আমর আল-হারিছ ইবন হিশামের উপর বদদোয়া করেন তখন এ আয়াত নাযিল হয়, “এ বিষয়ে তোমার কোনো অধিকার নেই।” [আলে ইমরান: ২৮]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যখন وَ اَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْاَقْرَبِيْنَ “আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন”- এ আয়াত নাযিল হলো তখন আমাদেরকে কিছু বলার জন্য দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি বললেন, “হে কুরাইশ বংশের লোকেরা [অথবা এ ধরণেরই কোনো কথা বলেছেন] তোমরা তোমাদের জীবনকে খরিদ করে নাও। [শিরকের পথ পরিত্যাগ করতঃ তাওহীদের পথ অবলম্বন করার মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেদেরকে বাঁচাও] আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো উপকারে আসব না। হে আববাস ইবন আবদুল মোত্তালিব আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি আপনার জন্য কোনো উপকার করতে সক্ষম নই। হে রাসূলুল্লাহর ফুফু সাফিয়্যাহ, আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি আপনার কোনো উপকার করতে সক্ষম নই। হে মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা, আমার সম্পদ থেকে যা খুশী চাও। কিন্তু আল্লাহার কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে তোমার কোনো উপকার করার ক্ষমতা আমার নেই।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের তাফসীর।
দুই: উহুদ যুদ্ধের কাহিনী।
তিন: সালাতে সাইয়্যেদুল মুরসালীন তথা বিশ্বনবী কর্তৃক ‘‘দোআয়ে কনুত’’ পাঠ করা এবং নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক আমীন বলা।
চার: যাদের উপর বদ দোয়া করা হয়েছে তারা কাফের।
পাঁচ: তারা এমন কিছু কাজ করেছে যা অতীতে অধিকাংশ কাফের করেনি, যেমন, নবীদেরকে আঘাত করা, তাঁদেরকে হত্যা করতে চাওয়া এবং একই বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও মৃত ব্যক্তির নাক, কান কাটা।
ছয়: আল্লাহ সেই ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর لَيْسَ لَكَ مِنَ الْاَمْرِ شَيْءٌ “এ বিষয়ে তোমার কোনো অধিকার নেই।” নাযিল করেছেন।
সাত: তার বাণী: { اوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ اَوْ يُعَذِّبَهُمْ } “হয়তো তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন অথবা তিনি তাদেরকে আযাব দেবেন।” এরপর তারা তাওবা করলো অতপর তারা ঈমান আনল।
আট: বালা-মুসীবতের সময় দোয়া-কুনুত পড়া।
নয়: যাদের উপর বদ দোয়া করা হয়, সালাতের মধ্যে তাদের নাম এবং তাদের পিতার নাম উল্লেখ করে বদ দোয়া করা।
দশ: ‘কুনুতে নাযেলায়’ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করা।
এগারো: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়, তাঁর সেই সময়ের ঘটনা: وَ اَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْاَقْرَبِيْنَ “আর আপনার নিকটস্থ জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে সতর্ক করুন।”
বারো: ইসলামের দাওয়াত প্রচারের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অক্লান্ত পরিশ্রম। এ কাজ করতে তাঁকে কেউ কেউ পাগল বলেছেন। এমনিভাবে বর্তমানেও কোন মুসলিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো দাওয়াতী কাজ করলে তাকেও বিভিন্ন প্রকারের কষ্ট সহ্য করতে হয়।
তের: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দূরবর্তী এবং নিকটাত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে বলেছেন لا أغني عنك من الله شيئا [আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি তোমার সাহায্য করতে পারব না] এমনকি তিনি ফাতেমাকেও লক্ষ্য করে বলেছিলেন, يا فاطمة بنت محمد، لا أغني عنك من الله شيئا ‘‘হে ফাতেমা, আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে তোমার কোনো উপকার আমি করতে সক্ষম হবো না।”
তিনি সমস্ত নবীগণের নেতা হওয়া সত্ত্বেও নারীকুল শিরোমণির জন্য কোনো উপকার করতে না পারার ঘোষণা দিয়েছেন। আর মানুষ যখন এটা বিশ্বাস করে যে, তিনি সত্য ছাড়া কিছুই বলেন না, তখন সে যদি বর্তমান যুগের কতিপয় খাস ব্যক্তিদের অন্তরে সুপারিশের মাধ্যমে অন্যকে বাঁচানোর ব্যাপারে যে ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে, তাহলে তার কাছে তাওহীদের মর্মকর্থা এবং দীন সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতার কথা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ‘‘এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন লোকদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে তখন তারা বলবে, তোমাদের রব কি জবাব দিয়েছেন? তারা বলবে, সঠিক জবাবই পাওয়া গিয়েছে আর তিনিই মহান ও শ্রেষ্ঠ। [সাবা: ২৩]
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন আল্লাহ তা‘আলা আকাশে কোনো বিষয়ের ফয়সালা করেন, তখন তাঁর কথার সমর্থনে বিনয়াবনত হয়ে ফিরিস্তারা তাদের ডানাগুলো নাড়াতে থাকে। ডানা নাড়ানোর আওয়াজ যেন ঠিক পাথরের উপর শিকলের আওয়াজ। তাদের অবস্থা এভাবেই চলতে থাকে। যখন তাদের অন্তর থেকে এক সময় ভয়-ভীতি দূর হয়ে যায়, তখন তারা বলে, তোমাদের রব তোমাদেরকে কি বলেছেন? তারা জবাবে বলে, আল্লাহ হক কথাই বলেছেন। বস্তুত তিনিই হচ্ছেন মহান ও শ্রেষ্ঠ। এমতাবস্থায় চুরি করে কথা শ্রবণকারীরা উক্ত কথা শুনে ফেলে। আর এসব কথা চোরেরা এ ভাবে পর পর অবস্থান করতে থাকে। এ হাদীসের বর্ণনাকারী সুফইয়ান ইবন উয়াইনা চুরি করে কথা শ্রবণকারী [খাত চোর] দের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে হাতের তালু দ্বারা এর ধরণ বিশ্লেষণ করেছেন এবং হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁক করে তাদের অবস্থা বুঝিয়েছেন। অতঃপর চুপিসারে শ্রবণকারী কথাগুলো শুনে তার নিজের ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। শেষ পর্যন্ত এ কথা একজন যাদুকর কিংবা গণকের ভাষায় দুনিয়াতে প্রকাশ পায়। কোনো কোনো সময় গণক বা যাদুকরের কাছে উক্ত কথা পৌঁছানোর পূর্বে শ্রবণকারীর উপর আগুনের তীর নিক্ষিপ্ত হয়। আবার কোনো কোনো সময় আগুণের তীর নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই সে কথা দুনিয়াতে পৌঁছে যায়। ঐ সত্য কথাটির সাথে শত শত মিথ্যা কথা যোগ করে মিথ্যার বেশাতি করা হয়। অতঃপর শত মিথ্যার সাথে মিশ্রিত সত্য কথাটি যখন বাস্তবে রূপ লাভ করে তখন বলা হয়, অমুক-অমুক দিনে এমন এমন কথা কি তোমাদেরকে বলা হয়নি? এমতাবস্থায় আকাশে শ্রুত কথাটিকেই সত্যায়িত করা হয়।”
নাওয়াস ইবন সাম‘আন রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো বিষয়ে অহী করতে চান এবং অহীর মাধ্যমে কথা বলেন তখন আল্লাহ রাববুল ইজ্জতের ভয়ে সমস্ত আকাশ কেঁপে উঠে অথবা বিকট আওয়াজ করে। আকাশবাসী ফিরিস্তাগণ এ নিকট আওয়াজ শুনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে সর্ব প্রথম যিনি মাথা উঠান, তিনি হচ্ছেন জিবরাঈল তারপর আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা করেন অহীর মাধ্যমে জিবরাঈল এর সাথে কথা বলেন। জিবরাঈল এরপর ফিরিস্তাদের পাশ দিয়ে যেতে থাকেন। যতবারই আকাশ অতিক্রম করতে থাকেন ততবারই উক্ত আকাশের ফিরিস্তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, ‘হে জিবরাঈল, আমাদের রব কি বলেছেন?
জিবরাঈল উত্তরে বলেন, ‘আল্লাহ হক কথাই বলেছেন, তিনিই মহান ও শ্রেষ্ঠ’। একথা শুনে তারা সবাই জিবরাঈল যা বলেছেন তাই বলে। তারপর আল্লাহ তাআলা জিবরাঈলকে যেখানে অহী নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন সে দিকে চলে যান।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: এ আয়াতে রয়েছে শিরক বাতিলের প্রমাণ। বিশেষ করে সালেহীনগণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার শিরক। এটিই সে আয়াত, যাকে অন্তর থেকে শিরক বৃক্ষের ‘শিকড় কর্তনকারী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
তিন: মহান আল্লাহর বাণীর ব্যখ্যা “তারা বলবে, সঠিক জবাবই পাওয়া গিয়েছে আর তিনিই মহান ও শ্রেষ্ঠ।”
চার: হক সম্পর্কে ফিরিস্তাদের জিজ্ঞাসার কারণ।
পাঁচ: তাদের জিজ্ঞাসার পর জিবরীল তাদের উত্তর দিয়েছেন এই বলে যে, “(মহান আল্লাহ) এমন এমন কথা বলেছেন।”
ছয়: সর্বপ্রথম যিনি মাথা তুলেন, তিনি হলেন জিবরাইল। এ কথার উল্লেখ।
সাত: জিবরীল সমস্ত আকাশবাসীকে বলেন, কারণ তারা সবাই তাঁকে জিজ্ঞেস করেন।
আট: বেহুশ হয়ে পড়ার বিষয়টি আকাশবাসী সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
নয়: আল্লাহর কালামের প্রভাবে সমস্ত আকাশ প্রকম্পিত হওয়া।
দশ: জিবরাঈল আল্লাহর নির্দেশিত পথে অহি সর্ব শেষ গন্তব্যে পৌঁছান।
এগারো: শয়তানের কানচুরি করার বর্ণনা
বারো: তাদের কতকের ওপর কতকের আরোহণ করার বিবরণ।
তের: জলন্ত আগুনের শিখা নিক্ষেপ করা।
চৌদ্দ: কখনো আগুনের শিখা তাদের নাগাল পেয়ে যায় সেটি পৌঁছানোর পূর্বেই।
আবার কখনো আগুনের শিখার তাদের নাগাল পাওয়ার আগেই তারা তাদের মানব বন্ধুদের কাছে তা পৌঁছে দেয়।
পনেরো: গণক কখনো কখনো সত্য কথাও বলে।
ষোল: আর তারা একটি সত্যের সাথে হাজারো মিথ্যা একত্র করে।
সতেরো: একমাত্র আসমান থেকে যে কথাটি শুনেছে তা ছাড়া কোনো কারণেই তার মিথ্যাকে বিশ্বাস করা হয় না।
আঠারো: নফসসমূহের বাতিলকে গ্রহণ করা: কিভাবে সে একটির সাথে সম্পৃক্ত হয় অথচ একশটির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না।
ঊনিশ: তারা একে অপর থেকে গ্রহণ করতে থাকে
সেই কথাটি এবং তা সংরক্ষণ করে ও তার দ্বারা দলীল পেশ করে।
বিশ: আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীকে সাব্যস্ত করা যা আশআরী সম্প্রদায়ের মতের পরিপন্থী।
একুশ: এ কথা স্পষ্ট করা যে বেহুশ হওয়া ও প্রকম্পিত হওয়া মূলত
মহান আল্লাহর ভয়ের কারণে।
বাইশ: অবশ্যই তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।
পরিচ্ছেদ: সুপারিশ
মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহর বাণী: “আর আপনি এর দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করুন, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রব-এর কাছে সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী। যাতে তারা তাকওয়ার অধিকারী হয়।” [আল-আনআম: ৫১]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: “বলুন, সমস্ত শাফাআত কেবলমাত্র আল্লাহরই ইখতিয়ার ভুক্ত।” [আয-যুমার: ৪৪]
এবং আল্লাহর বাণী, “কে আছে তাঁর কাছে শাফা‘আত করবে তাঁর অনুমতি ব্যতীত?” [আল-বাকারাহ: ২৫৫]
এবং তাঁর বাণী, “আর আসমানসমূহে বহু ফিরিশতা রয়েছে; তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর, যার জন্য তিনি ইচ্ছে করেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [আন-নাজম: ২৬]
এবং তাঁর বাণী, “বলুন, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ্ মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়। আর এ দু'টিতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয়।” [আস-সাবা: ২২,২৩]
আবুল আব্বাস বলেন, মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া যার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তার সবই আল্লাহ তাআলা অস্বীকার করেছেন। গাইরুল্লাহর জন্য রাজত্ব অথবা আল্লাহর ক্ষমতায় গাইরুল্লাহর অংশীদারিত্ব অথবা আল্লাহর জন্য কোনো গাইরুল্লাহ সাহায্যকারী হওয়ার বিষয়কে তিনি অস্বীকার করেছেন। বাকী থাকলো শাফাআতের বিষয়। এ ব্যাপারে কথা হচ্ছে এই যে, ‘‘আল্লাহ তাআলা শাফাআত [সুপারিশ] এর জন্য যাকে অনুমতি দিবেন তার ছাড়া আর কারো শাফাআত কোনো কাজে আসবে না।’’ ‘‘তিনি [আল্লাহ] যার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবেন, কেবলমাত্র তার পক্ষেই তারা শাফাআত [সুপারিশ] করবেন।’’ [আল-আম্বিয়া: ২৮]
মুশরিকরা যে শাফাআতের আশা করে, কেয়ামতের দিন তার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। কুরআনে কারীমও এধরনের শাফাআতকে অস্বীকার করেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন,
“তিনি অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবেন। অতঃপর তাঁর রবের উদ্দেশ্যে তিনি সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন এবং আল্লাহর প্রশংসায় মগ্ন হবেন। প্রথমেই তিনি শাফাআত বা সুপারিশ করা শুরু করবেন না। অতঃপর তাঁকে বলা হবে, ‘‘হে মুহাম্মদ, তোমার মাথা উঠাও। তুমি তোমার কথা বলতে থাকো, তোমার কথা শ্রবণ করা হবে। তুমি চাইতে থাকো, তোমাকে দেয়া হবে। তুমি সুপারিশ করতে থাকো, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।”
আবু হুরাইয়ারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার শাফাআত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন, “যে ব্যক্তি খালেস দিলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে।” আমার সুপারিশ দ্বারা সেই সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে।
এ হাদীসে উল্লেখিত শাফাআত [বা সুপারিশ] আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি প্রাপ্ত এবং নেককার মুখলিস বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহর সাথে যে ব্যক্তি কাউকে শরিক করবে তার ভাগ্যে এ শাফাআত জুটবে না।
এ আলোচনার মর্মার্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা‘আলা মুখলিস বান্দাগণের প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং শাফাআতের জন্য অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রার্থনায় তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, শাফাআতকারীকে সম্মানিত করা এবং মাকামে মাহমূদ অর্থাৎ প্রশংসিত স্থান দান করা।
কুরআনে কারীম যে শাফাআতকে অস্বীকার করেছে, তাতে শিরক বিদ্যমান রয়েছে। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত এর স্বীকৃতির কথা কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় এসেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, শাফাআত একমাত্র তাওহীদবাদী নিষ্ঠাবানদের জন্যই নির্দিষ্ট। (তাঁর কথা শেষ)
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: উপরোক্ত আয়াতসমূহের তাফসীর।
দুই: যে শাফাআতকে অস্বীকার করা হয়েছে তার প্রকৃতি।
তিন: যে শাফাআতকে স্বীকার করা হয়েছে তার প্রকৃতি।
চার: সবচেয়ে বড় শাফাআতের উল্লেখ।
আর তা হচ্ছে ‘‘মাকামে মাহমুদ’’।
পাঁচ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম [শাফাআতের পূর্বে] যা করবেন তার বর্ণনা। অর্থাৎ তিনি প্রথমেই শাফাআতের কথা বলবেন না, বরং তিনি সেজদায় পড়ে যাবেন।
তাঁকে অনুমতি প্রদান করা হলেই তিনি শাফাআত করতে পারবেন।
ছয়: শাফাআতের মাধ্যমে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তির উল্লেখ।
সাত: আল্লাহর সাথে শিরককারীর জন্য কোনো শাফাআত গৃহীত হবে না।
আট: উক্ত শিরকের হাকীকতের বর্ণনা।
পরিচ্ছেদ: আল্লা্হ তা‘আলর বাণী: “আপনি যাকে ভালবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহ্ই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন। [আল-কাসাস: ৫৬]
সহীহ বুখারীতে ইবনুল মুসাইয়্যাব তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন আবু তালিবের মৃত্যু ঘনিয়ে এলো, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে আসলেন। আবদুল্লাহ ইবন আবি উমাইয়্যাহ এবং আবু জাহল আবু তালিবের পাশেই উপস্থিত ছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “চাচা, আপনি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন। এ কালিমা দ্বারা আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য কথা বলবো।”
তখন তারা দু’জন [আবদুল্লাহ ও আবু জাহল] তাকে বললো, ‘তুমি আবদুল মোত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবে?’
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কলেমা পড়ার কথা আরেকবার বললেন। তারাও কুফরীর কথা আরেকবার বলল। আবু তালিবের সর্বশেষ অবস্থা ছিল এই যে, সে আবদুল মোত্তালিবের ধর্মের উপরই অটল ছিলো এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করেছিলো।
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আপনার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে নিষেধ করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকবো।”
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন, “আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।” [আত-তাওবা: ১১৩]
তাছাড়াও নিম্নোক্ত আয়াত আবু তালিব সম্পর্কে অবতীর্ণ হলো, “নিশ্চয় আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে আপনি হিদায়াত দিতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন।” [আল-কাসাস: ৫৬]
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে:
এক: “নিশ্চয় আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে আপনি হিদায়াত দিতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন।”- এ আয়াতের তাফসীর।
দুই: “আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য সংগত নয়”- এর তাফসীর।
তিন: সবচেয়ে বড় মাসআলা হলো, ‘‘আপনি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলুন’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথার ব্যাখ্যা। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা এক শ্রেণীর তথা কথিত জ্ঞানের দাবীদারদের বিপরীত।
চার: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মৃত্যুপথ যাত্রী আবু তালিবকে বললেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলুন”, তখন আবু জাহিল এবং তার সঙ্গে যারা ছিল তারা এ কথার উদ্দেশ্য বুঝে ছিল। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুন, ইসলামের ঊসূল সম্পর্কে আবু জাহিল যার চেয়ে বেশী জানেন।
পাঁচ: আপন চাচার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তীব্র আকাংখ্যা ও প্রাণপণ চেষ্টা।
ছয়: যারা আবদুল মোত্তালিব এবং তার পূর্বসূরীদেরকে মুসলিম হওয়ার দাবী করেন, তাদের দাবী খন্ডন।
সাত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা আবু তালেবের জন্য মাগফিরাত চাইলেও তার গুনাহ মাফ হয়নি; বরং তার মাগফিরাত চাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
আট: মানুষের উপর খারাপ লোকদের ক্ষতিকর প্রভাব।
নয়: পূর্বপুরুষ এবং পীর-বুজুর্গের প্রতি অন্ধ ভক্তির কুফল।
দশ: পূর্বপুরুষদের ব্যাপারে বাতিলপন্থীদের সংশয়। কারণ, আবু জাহল তার দ্বারা দলিল পেশ করেছেন।
এগারো: সর্বশেষ আমলের ওপরই শুভাশুভ পরিণতি নির্ধারিত হয়। কেননা আবু তালিব যদি শেষ মুহুর্তেও কালিমা পড়তো, তাহলে তার বিরাট উপকার হতো।
বারো: গোমরাহীতে নিমজ্জিত লোকদের অন্তরে এ সংশয়ের মধ্যে বিরাট চিন্তার বিষয় নিহিত আছে। কেননা উক্ত ঘটনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমান আনার কথা বারবার বলার পরও তারা [কাফির মুশরিকরা] তাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি অন্ধ অনুকরণ ও ভাল বাসাকেই যুক্তি হিসেবে পেশ করেছে। তাদের অন্তরে এর [গোমরাহীর তথা কথিত] সুস্পষ্টতা ও [তথা কথিত] শ্রেষ্ঠত্ব থাকার কারণেই অন্ধ অনুকরণকে যথেষ্ট বলে মনে করেছে।
নেককার পীর-বুজুর্গ লোকদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করা আদম সন্তানের কাফের ও বেদ্বীন হওয়ার অন্যতম কারণ।
মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহর বাণী: “হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর উপর সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলো না। মারইয়ামের পুত্র মাসীহ ঈসা কেবলমাত্র আল্লাহর রাসূল ও তাঁর কালিমা, যা তিনি প্রেরণ করেছিলেন মারইয়ামের প্রতি এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ।” [আন-নিসা: ১৭১]
সহীহ বুখারীতে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী সম্পর্কে ইবন আব্বাস হতে বর্ণিত, “এবং বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাস্রকে।” [নূহ: ২৩]
তিনি বলেন, “এগুলো হচ্ছে নূহ এর কওমের কতিপয় নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের নাম, তারা যখন মৃত্যু বরণ করলো, তখন শয়তান তাদের কওমকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বললো, ‘যেসব জায়গায় তাদের মজলিস বসতো সে সব জায়গাগুলোতে তাদের [বুজুর্গ ব্যক্তিদের] মুর্তি স্থাপন করো এবং তাদের সম্মানার্থে তাদের নামেই মুর্তিগুলোর নামকরণ করো। তখন তারা তাই করলো। তাদের জীবদ্দশায় মুর্তির পূজা করা হয়নি ঠিকই; কিন্তু মূর্তি স্থাপন কারীরা যখন মৃত্যু বরণ করলো এবং মুর্তি স্থাপনের ইতিকথা ভুলে গেলো, তখনই মুর্তিগুলোর ইবাদত শুরু হলো।
ইবনুল কায়্যিম বলেন, একাধিক আলেম ব্যক্তি বলেছেন, ‘যখন নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তিগণ মৃত্যু বরণ করলেন, তখন তাঁদের কওমের লোকেরা তাঁদের কবরের পাশে ধ্যান-মগ্ন হয়ে বসে থাকতো। এরপর তারা তাঁদের প্রতিকৃতি তৈরী করলো। এভাবে বহুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর তারা তাঁদের ইবাদতে লেগে গেলো।
উমার থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা আমার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেমনটি খৃষ্টানরা ইবন মারইয়্যাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তার বান্দা। তাই তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল।” হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “তোমরা বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাক। তোমাদের পূর্ববর্তীদের বাড়াবাড়িই ধ্বংস করেছে।”
মুসলিমে ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “দীনের ব্যাপারে সীমা লংঘন কারীরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।” এটি তিনি তিনবার বলেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: যে ব্যক্তি এ অধ্যায়টি সহ পরবর্তী দু’টি অধ্যায় উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, ইসলাম সম্পর্কে মানুষ কতটুকু অজ্ঞ, তার কাছে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এবং সে আল্লাহ তাআলার কুদরত ও মানব অন্তরের আশ্চর্যজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করবে।
দুই: পৃথিবীতে সংঘটিত প্রথম শিরকের সূচনা সম্পর্কে জানা, যা নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের প্রতি সংশয় ও সন্দেহ থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
তিন: সর্বপ্রথম যে জিনিসের মাধ্যমে নবীগণের দীনে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল এবং এর কারণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সাথে সাথে একথাও জেনে নেয়া যে, আল্লাহ তাআলাই তাদেরকে [দীনের জন্য] পাঠিয়েছেন।
চার: শরীয়ত ও ফিতরাত কর্তৃক ‘বিদআত প্রত্যাখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করা।
পাঁচ: এ সবের কারণ, হলো হককে বাতিলের সাথে মেলানো।
প্রথমটি হলো নেককারদের ভালোবাসা
আর দ্বিতীয়টি হলো, কতক আহলে ইলম ও দীনদার মানুষের এমন কর্ম করা যার দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু তাদের পরবর্তীগণ ধারনা করল যে, তারা অন্য কিছু উদ্দেশ্য করেছে।
ছয়: সূরা নূহের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
সাত: মানুষের স্বভাব হলো তাদের অন্তরে হক হ্রাস পায় এবং বাতিল বৃদ্ধি পায়
আট: এতে সালাফদের থেকে বর্ণিত উক্তির প্রমাণ রয়েছে, তারা বলেন, বিদ‘আত কুফরের কারণ হয়।
নয়: বিদ‘আতের পরিণতি সম্পর্কে শয়তানের জানা; যদিও বিদ‘আতকারীর নিয়ত ভালো হয়।
দশ: সাধারণ নীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া। আর তা হলো, বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকা। আর তার পরিণতি সম্পর্কে জানা।
এগারো: ভালো কাজের উদ্দেশ্যে কবরের ওপর অবস্থান করার ক্ষতি সম্পর্কে জানা।
বারো: মূর্তি থেকে বিরত থাকা সম্পর্কে জানা এবং তা দূর করার হিকমত।
তের: অবহেলিত হলেও এই ঘটনার গুরুত্ব ও তীব্র প্রয়োজনীয়তা জানা।
চৌদ্দ: এটি বড় আশ্চর্যের বিষয়। তাফসীর ও হাদীসের কিতাবসমূহে তাদের তা পাঠ করা এবং তাদের কালামের অর্থ জানা এবং তাদের মধ্যে ও তাদের অন্তরের আল্লাহরই বাধা হওয়া, যার ফলে তারা বিশ্বাস করে যে, কাওমে নুহের কর্ম সবচেয়ে উত্তম ইবাদাত। আর তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল যা নিষেধ করেছেন, তা হলো, সরাসরি কুফর, যা জান ও মালকে হালাল করে।
পনেরো: এ কথা স্পষ্ট করা যে, তার কেবল সুপারিশই কামনা করেছিল।
ষোল: তারা ধারণা করছিল যে, যেসব আলেম চিত্র অঙ্কন করেছেন তাদের উদ্দেশ্য তাই (সুপারিশ) ছিল।
সতেরা: তার কথার মধ্যে মহান বর্ণনা, (তোমরা মারয়ামের ব্যাপারে খৃষ্টানরা যেভাবে বাড়াবাড়ি করেছে আমার ব্যাপারে সেভাবে বাড়াবাড়ি করো না) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিয়েছেন।
আঠারো: বাড়াবাড়িকারীদের ধ্বংস দ্বারা আমাদেরকে তার উপদেশ প্রদান করা।
উনিশ: এ কথা স্পষ্ট করা যে, ইলম ভুলে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের ইবাদত করা হয়নি। এতে ইলম থাকার মর্যাদা ও ইলম না থাকার ক্ষতি বুঝা যায়।
বিশ: ইলম না থাকার কারণ হলো আলেমদের মারা যাওয়া।
অনুচ্ছেদ: নেককার বুজুর্গ ব্যক্তির কবরের পাশে ইবাদত করার ব্যাপারে যেখানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে ঐ নেককার ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে কী হতে পারে?
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত আছে যে, উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হাবশায় যে গীর্জা দেখতে পেয়েছিলেন এবং তাতে যে ছবি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে উল্লেখ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “সে সব দেশের লোকেরা তাদের কোনো নেককার ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর কবরের ওপর মাসজিদ নির্মাণ করত এবং তাতে ঐ সব চিত্রকর্ম অংকণ করত। তারা হলো, আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট সৃষ্টি।”
তারা দুটি ফেতনাকে একত্রিত করেছে। একটি হচ্ছে কবর পুজার ফেতনা। অপরটি হচ্ছে মূর্তি পূজার ফেতনা।
বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা থেকে আরো একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যু ঘনিয়ে আসলো, তখন তিনি নিজের মুখমন্ডলকে স্বীয় চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলতে লাগলেন। আবার অস্বস্তিবোধ করলে তা চেহারা থেকে সরিয়ে ফেলতেন। এমন অবস্থায়ই তিনি বললেন, “ইয়াহূদী ও নাসারাদরে প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, তারা তাদের নবীদের কবরকে মাসজিদে পরিণত করেছে।” তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে দিয়েছেন। কবরকে ইবাদতখানায় পরিণত করার আশংকা না থাকলে তাঁর কবরকে উন্মুক্ত রাখা হতো। এটিকে তারা দুইজন (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনা করেছেন।
জুনদুব ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে এ কথা বলতে শুনেছি, “তোমাদের কাউকে খলীল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করা থেকে আমি আল্লাহর কাছে মুক্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি ইবরাহীমকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর আমি যদি আমার উম্মত থেকে কাউকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে অবশ্যই আবু বকরকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করতাম। সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করতো। সাবধান, তোমরা কবরকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তেও এ কাজ [কবরকে মসজিদে পরিণত] করতে নিষেধ করেছেন। আর এ কাজ যারা করেছে (তাঁর কথার ধরন দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে) তাদেরকে তিনি লানত করেছেন। কবরের পাশে মসজিদ নির্মিত না হলেও সেখানে সালাত আদায় করা রাসূল এর এ লানতের অন্তর্ভূক্ত। এটিই হলো তাঁর বাণী: “কবরকে ইবাদতখানায় পরিণত করার আশংকা না থাকলে তাঁর কবরকে উন্মুক্ত রাখা হতো।” মর্মার্থ। সাহাবায়ে কেরাম নবীর কবরের পাশে মসজিদ বানানোর মত লোক ছিলেন না। যে স্থানকে সালাত পড়ার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে সে স্থানকেই মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। বরং এমন প্রতিটি স্থানের নামই মসজিদ যেখানে সালাত আদায় হয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “পৃথিবার সব স্থানকেই আমার জন্য মসজিদ বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পবিত্র করে দেয়া হয়েছে।”
ইমাম আহমাদ বিশুদ্ধ সনদে ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেন: “কিয়ামত যাদের জীবনকালে সংঘটিত হবে এবং যারা কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত করে তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক।” হাদীসটি আবু হাতিম বর্ণনা করেছেন এবং ইবন হিব্বানও তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: যে ব্যক্তি নেককার ও বুজুর্গ লোকের কবরের পাশে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য মসজিদ বানায় নিয়ত সহীহ হওয়া সত্বেও তার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্তি।
দুই: মূর্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কঠোরতা অবলম্বন।
তিন: কবরকে মসজিদ না বানানোর বিষয়ে তাঁর কঠোরতা থেকে উপদেশ গ্রহণ। তিনি প্রথমত এটি কিভাবে তাদের জন্যে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে তিনি যা বলার তা বারবার বলেছেন। তারপরও পরবর্তীতে তিনি কবর পূজা সম্পর্কিত আগের কথাকে যথেষ্ট মনে করেননি।
চার: নিজ কবরের অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই তাঁর কবরের পাশে এসব কাজ অর্থাৎ কবর পূজাকে নিষেধ করেছেন।
পাঁচ: নবীদের কবর পূজা করা বা কবরকে ইবাদত খানায় পরিণত করা ইহুদী নাসারাদের রীতি-নীতি।
ছয়: এ জাতীয় কাজ যারা করে তাদের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অভিসম্পাত।
সাত: এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবরের ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধান করে দেয়া।
আট: তাঁর কবরকে খোলা না রাখার কারণ এ হাদীসে সুস্পষ্ট।
নয়: কবরকে মসজিদ বানানোর মর্মার্থ।
দশ: তিনি যারা কবরকে মসজিদে পরিণত করে তাদের মাঝে
এবং যাদের উপর দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে এ দু’ধরনের লোকের কথা একই সাথে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর একজন মানুষ কোন পথ অবলম্বনে শিরকের দিকে ধাবিত হয় এবং এর পরিণতি কি সেটাও উল্লেখ করেছেন।
এগারো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে স্বীয় খুতবায় বিদআতী লোকদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দু’টি দলের জবাব দিয়েছেন।
কিছু সংখ্যক জ্ঞানী ব্যক্তিরা এ বিদআতীদেরকে ৭২ দলের বহির্ভূত বলে মনে করেন। এসব বিদ‘আতীরা হচ্ছে ‘‘রাফেজী’’ ও জাহমিয়্যা’’। এ রাফেজী দলের কারণেই শিরক এবং কবর পূজা শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম কবরের উপর তারাই মসজিদ নির্মাণ করেছে।
বারো: মৃত্যু যন্ত্রণার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে পরীক্ষা করা হয়েছে তা জানা যায়।
তের: খুল্লাত’ বা বন্ধুত্বের মর্যাদা ও সম্মান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেয়া হয়েছে।
চৌদ্দ: খুল্লাতই হচ্ছে মুহাববতের চেয়ে সর্বোচ্চ স্থান।
পনেরো: আবু বকর ছিদ্দিক সর্ব শ্রেষ্ঠ সাহাবী হওয়ার ঘোষণা।
ষোল: তাঁর [আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর] খিলাফতের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান।
নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের কবরের ব্যাপারে সীমা লংঘন করলে তা তাকে মূর্তি পূজা তথা গাইরুল্লাহর ইবাদতে পরিণত করে।
ইমাম মালেক মুয়াত্তায় বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে ভূত বানিও না যা পূজা করা হয়। আল্লাহর কঠিন রোষাণল সেই জাতির ওপর, যারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে।
ইবন জারীর স্বীয় সনদে সুফিয়ান হতে, তিনি মানসূর হতে এবং তিনি মুজাহিদ হতে বর্ণনা করেন, “অতএব, তোমরা আমাকে জানাও ‘লাত’ ও ‘উযযা' সম্পর্কে।” [আন নাজাম: ১৯] ‘‘লাত’’ এমন একজন নেককার লোক ছিলেন, যিনি হজ্জ যাত্রীদেরকে ‘‘ছাতু’’ খাওয়াতেন। তরপর যখন তিনি মৃত্যু বরণ করলেন, লোকেরা তার কবরে ইতেকাফ করতে লাগলো।
ইবন আববাস থেকে আবুল জাওযা একই কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘‘লাত’’ হাজীদেরকে ‘‘ছাতু’’ খাওয়াতেন।
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারাতকারীনী, তার উপর মসজিদ নির্মাণকারী এবং তাতে বাতি জ্বালিয়ে প্রজ্জ্বলিতকারীদেরকে অভিসম্পাত করেছেন।” এটি সুনান গ্রন্থকারগণ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: أوثان (মূর্তি ও প্রতিমা) এর ব্যাখ্যা।
দুই: ‘‘ইবাদত’’ এর তাফসীর।
তিন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা সংঘটিত হওয়ার আশংকা করেছেন একমাত্র তা থেকেই আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছেন।
চার: নবীদের কবরকে মসজিদ বানানোর বিষয়টিকে মূর্তি পূজার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
পাঁচ: আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কঠিন গযব নাযিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ছয়: এটি এ অধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্ববৃহৎ মূর্তি ‘‘লাতের’’ ইবাদতের সূচনা কিভাবে হয়েছে তা জানা গেলো।
সাত: ‘‘লাত’’ নামক মূর্তির স্থানটি মূলতঃ একজন নেককার লোকের কবর।
আট: ‘‘লাত’’ প্রকৃতপক্ষে কবরস্থ ব্যক্তির নাম। এবং “লাত” নামকরণের অর্থও উল্লেখ করা হয়েছে।
নয়: কবর জিয়ারতকারী নারীদের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অভিসম্পাত।
দশ: যারা কবরে বাতি জ্বালায় তাদের প্রতি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অভিশাপ।
পরিচ্ছেদ: তাওহীদের হেফাযত ও শিরকের সকল পথ বন্ধ করার ক্ষেত্রে নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবদান প্রসংঙ্গে।
আর আল্লাহর বাণী: “অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদের যে দুঃখ-কষ্ট হয়ে থাকে তা তার জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি করুণাশীল ও অতি দয়ালু।” [আত-তাওবাহ: ১২৮]
আর আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবর বানাবে না এবং আমার কবরকে মেলার স্থল বানাবে না। তোমরা আমার ওপর সালাত পাঠক করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের সারাত আমার কাছে পৌঁছে যায়।” [এটি আবূ দাউদ হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন এবং এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভর যোগ্য]
আলী ইবনু হুসাইন ইবনু আলী থেকে বর্ণিত, তিনি একদা জনৈক ব্যক্তিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরের একটি ফাঁকা জায়গায় ঢুকে সেখানে দু‘আ করতে দেখলে তিনি তাকে নিষেধ করেন এবং তিনি বলেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি হাদীসের কথা বলবো না যা আমি আমার পিতার সূত্রে আমার নানা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। তিনি বলেন: “তোমরা আমার কবরকে মেলায় পরিণত করো না আর তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করো না। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের সালাম আমার কাছে পৌঁছে যায়।” [দিয়াউদ্দীন তিনি এটি মুখতারাতে বর্ণনা করেছেন।]
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা তাওবার لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ য়াতটির তাফসীর।
দুই: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় উম্মতকে কবর পূজা তথা শিরকী গুনাহর সীমারেখা থেকে বহুদূরে রাখতে চেয়েছেন।
তিন: আমাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মমত্ববোধ, দয়া, করুণা এবং আমদের ব্যাপারে তার তীব্র আগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চার: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যিয়ারত সর্বোত্তম নেক কাজ হওয়া সত্ত্বেও বিশেষভাবে তাঁর কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন।
পাঁচ: অধিক যিয়ারত নিষিদ্ধ করেছেন।
ছয়: ঘরে নফল ইবাদত করার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
সাত: ‘‘কবরস্থানে সালাত পড়া যাবে না’’ এটাই সালাফে-সালেহীনের অভিমত।
আট: তার কারণ হলো, ব্যক্তির সালাত ও সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে পৌঁছানো হয়, যদিও সে দূরে অবস্থান করে। কাজেই তাঁর কাছে সালাত ও সালাম প্রেরণ করার জন্যে তাঁর নিকটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
নয়: আলমে বরযখে’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে তাঁর উম্মাতের আমল সালাত ও সালাম পেশ করা হয়।
পরিচ্ছেদ: মুসলিম উম্মাহর কিছু সংখ্যক লোক মূর্তি পুজা করবে।
মহান আল্লাহ বাণী- ‘‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের কিছু অংশ দেয়া হয়েছে? তারা ‘জিবত’ এবং ‘তাগুত্কে বিশ্বাস করে।” [নিসা: ৫১]
মহান আল্লাহর আরেকটি বাণী: “বলুন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়ে নিকৃষ্ট পরিণামের সংবাদ দেব যা আল্লাহর কাছে আছে? যাকে আল্লাহ লা’নত করেছেন এবং যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন। আর যাদের কাউকে তিনি বানর ও কাউকে শূকর করেছেন এবং (তাদের কেউ) তাগূতের ইবাদাত করেছে।” [মায়েদা: ৬১]
মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘‘যারা তাঁদের ব্যাপারে বিজয়ী হলো তারা বললো, আমরা অবশ্যই তাদের উপর [অর্থাৎ কবরস্থানে] মসজিদ তৈরী করবো।’’ [আল-কাহাফ: ২১]
আবূ সাঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি আশঙ্কা করছি ‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করবে [যা আদৌ করা উচিৎ নয়] এমনকি তারা যদি গুঁই সাপের গর্তেও ঢুকে যায়, তোমরাও তাতে ঢুকবে।”
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, তারা কি ইহুদী ও খৃষ্টান?’
জবাবে তিনি বললেন, “তারা ছাড়া আর কে?”
আর সহীহ মুসলিমে সাওবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা গোটা যমীনকে একত্রিত করে আমার সামনে পেশ করলেন। তখন আমি যমীনের পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্ত দেখে নিলাম। পৃথিবীর ততটুকু স্থান আমাকে দেখানো হয়েছে আমার উম্মতের শাসন বা রাজত্ব যে পর্যন্ত বিস্তার লাভ করবে।
লাল ও সাদা দু’টি ধন-ভাণ্ডার আমাকে দেওয়া হলো।
আমি আমার রবের কাছে আমার উম্মতের জন্য এ আরজ করলাম, তিনি যেন আমার উম্মতকে গণ দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ধ্বংস না করেন এবং তাদের নিজেদেরকে ব্যতীত অন্য কোনো শত্রুকে তাদের উপর বিজয়ী বা ক্ষমতাসীন করে না দেন যার ফলে সে (শত্রু) তাদের সমূলে ধ্বংস করবে।
আমার রব আমাকে বললেন, হে মুহাম্মদ আমি যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা নিয়ে ফেলি, তখন তার কোনো ব্যতিক্রম হয় না। আমি তোমাকে তোমার উম্মতের জন্য এ অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আমি তাদের গণ দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ধ্বংস করবো না এবং তাদের নিজেদেরকে ছাড়া যদি সারা বিশ্বও তাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় তবুও এমন কোনো শত্রুকে তাদের উপর ক্ষমতাবান করবো না যা তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করবে যে পর্যন্ত না তারা একে অপরকে ধ্বংস করবে আর একে অপরকে বন্দী করবে।
এটিকে বারকানী স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি আরও সংযোগ করে উল্লেখ করেন, ‘‘আমি আমার উম্মতের জন্য পথভ্রষ্ট শাসকদের ব্যাপারে বেশী আশংকা বোধ করছি। একবার যদি তাদের উপর তলোয়ার উঠে তবে সে তলোয়ার কেয়ামত পর্যন্ত আর নামবে না। আর ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না আমার একদল উম্মত মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে এবং যতক্ষণ না আমার উম্মতের একটি শ্রেণী মূর্তি পূজা করবে। আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদী অর্থাৎ ভন্ড নবীর আবির্ভাব হবে। প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমিই হচ্ছি সর্বশেষ নবী। আমার পর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না। কেয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের মধ্যে এমন একটি সাহায্য প্রাপ্ত দলের অস্তিত্ব থাকবে যাদেরকে কোনো অপমানকারীর অপমান ক্ষতি করতে পারবে না। [অর্থাৎ সত্য পথ থেকে বিরত রাখতে পারবে না]”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা আন-নিসার উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: সূরা মায়েদার উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
তিন: সূরা কাহাফের উপরোক্ত আয়াতের তা্ফসীর।
চার: সূরা নিসার আয়াতটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। [আর তা হচ্ছে] ‘জিবত’ এবং ‘তাগুতের’ প্রতি ঈমানের অর্থ কি এই স্থানে?
এটা কি শুধু অন্তরের বিশ্বাসের নাম?
নাকি জিবত ও তাগুতের প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভ এবং বাতিল বলে জানা সত্ত্বেও এর পূজারীদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা বুঝায়?
পাঁচ: তাগুত পূজারীদের কথা হচ্ছে, কাফেররা তাদের কুফরী সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও তারা মুমিনদের চেয়ে অধিক সত্য পথের অধিকারী।
ছয়: আর এটিই হলো এই শিরোনামের উদ্দেশ্য— অর্থাৎ আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে যে ধরনের লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সে ধরনের বহু সংখ্যক লোক এ উম্মতের মধ্যে অবশ্যই পাওয়া যাবে। [যারা ইহুদী খৃষ্টানদের হুবহু অনুসারী হবে]।
সাত: এ উম্মতের মধ্যে বহু মূর্তি পূজারী লোক পাওয়া যাবে। এটি স্পষ্ট করা।
আট: সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ‘‘মুখতারের’’ মত মিথ্যা এবং ভন্ড নবীর আবির্ভাব। মুখতার নামক এ ভন্ডনবী আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রিসালতকে স্বীকার করতো। সে নিজেকে উম্মতে মুহাম্মদীর অন্তর্ভূক্ত বলেও ঘোষণা করতো সে আরো ঘোষণা দিতো, রাসূল সত্য, কুরআন সত্য এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী হিসেবে স্বীকৃত। এগুলোর স্বীকৃতি প্রদান সত্বেও তার মধ্যে উপরোক্ত স্বীকৃতির সুস্পষ্ট বিপরীত ও পরিপন্থী কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ভন্ড মুর্খও সাহাবায়ে কেরামের শেষ যুগে আবির্ভূত হয়েছিল এবং বেশ কিছু লোক তার অনুসারীও হয়েছিল।
নয়: সুসংবাদ হচ্ছে এই যে, অতীতের মতো হক সম্পূর্ণরূপে কখনো বিলুপ্ত হবে না বরং একটি দল হকের উপর চিরদিনই প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
দশ: এর সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে, তারা [হক পন্থীরা] সংখ্যায় কম হলেও কোনো অপমানকারী ও বিরোধীতাকারী তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
এগারো: কেয়ামত পর্যন্ত উক্ত শর্ত কার্যকর থাকবে।
বারো: এ অধ্যায়ে কতগুলো বড় নিদর্শনের উল্লেখ রয়েছে। যথা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক সংবাদ পরিবেশন যে, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের সবকিছুই একত্রিত করে দেখিয়েছেন। এ সংবাদ দ্বারা যে অর্থ বুঝিয়েছেন বাস্তবে ঠিক তাই সংঘটিত হয়েছে, যা উত্তর ও দক্ষিণের ব্যাপারে ঘটেনি। তাঁকে দু’টি ধন-ভান্ডার প্রদান করা হয়েছে এ সংবাদও তিনি দিয়েছেন। তাঁর উম্মতের ব্যাপারে মাত্র দুটি দোয়া কবুল হওয়ার সংবাদ তিনি দিয়েছেন এবং তৃতীয় দোয়া কবুল না হওয়ার খবরও তিনি জানিয়েছেন। তিনি এ খবরও জানিয়েছেন যে, এ উম্মতের উপরে একবার তলোয়ার উঠলে তা আর খাপে প্রবেশ করবে না। [অর্থাৎ সংঘাত শুরু হলে তা আর থামবে না]। তিনি আরো জানিয়েছেন যে, উম্মতের লোকেরা একে অপরকে ধ্বংস করবে, একে অপরকে বন্দী করবে। উম্মতের জন্য তিনি ভ্রান্ত শাসকদের ব্যাপারে শতর্কবাণী উচ্ছারণ করেছেন। এ উম্মতের মধ্য থেকে মিথ্যা ও ভন্ড নবী আবির্ভাবের কথা তিনি জানিয়েছেন। সাহায্য প্রাপ্ত একটি হক পন্থীদল সব সময়ই বিদ্যমান থাকার সংবাদ জানিয়েছেন। উল্লেখিত সব বিষয়ই পরিবেশিত খবর অনুযায়ী হুবহু সংঘটিত হয়েছে। অথচ এমনটি ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারটি যুক্তি ও বুদ্ধির আওতাধীন নয়।
তেরো: একমাত্র পথভ্রষ্ট নেতাদের ব্যাপারেই তিনি শঙ্কিত ছিলেন।
চৌদ্দ: মূর্তি পূজার মর্মার্থের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সতর্ক বাণী।
পরিচ্ছেদ: যাদু বিষয়ে আলোচনা
আর আল্লাহর বাণী: “এবং তারা অবশ্যই জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা জানত।” [আল-বাকারাহ: ১০২]
এবং মহান আল্লাহর বাণী, “তারা ‘জিবত’ এবং ‘তাগুত’ কে বিশ্বাস করে।” [নিসা: ৫১]
‘উমার বলেন, ‘জিবত’ হচ্ছে যাদু, আর ‘তাগুত’ হচ্ছে শয়তান।
জাবির বলেন, ‘তাগুত’ হচ্ছে গণক। তাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হতো প্রত্যেক গোত্রের জন্যই একজন করে গণক নির্ধারিত ছিল।
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে।”
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, সেগুলো কি?
তিনি বললেন, “(১) আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা (২) যাদু (৩) আল্লাহ তা‘আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, শরী‘আতসম্মত কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করা (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল গ্রাস করা (৬) রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরল স্বভাবা সতী-সাধ্বী মুমিনাদের অপবাদ দেওয়া।”
যুনদুব থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘‘যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে গর্দান উড়িয়ে দেয়া’’ [মৃত্যু দন্ড]। এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। আর তিনি বলেছেন, বিশুদ্ধ হলো এটি মাওকুফ।
সহীহ বুখারীতে বাজালা ইবন আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লিখেছেন, ‘‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা করো।’’ বাজালা বলেন, এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকরকে হত্যা করেছি।”
হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে আছে, তিনি তাঁর অধীনস্ত একজন বান্দী (ক্রীতদাসী) কে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাঁকে যাদু করেছিলো। অতঃপর উক্ত নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
একই রকম হাদীস জুনদাব থেকে সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমদ বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তিনজন সাহাবী থেকে একথা সহীহ ভাবে বর্ণিত হয়েছে।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা বাকারার উপরোক্ত আয়াতের তা্ফসীর।
দুই: সূরা আন-নিসার উক্ত আয়াতের তা্ফসীর।
তিন: ‘জিবত’ এবং ‘তাগুত’ এর ব্যাখ্যা এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য।
চার: ‘তাগুত’ কখনো জিন আবার কখনো মানুষ হতে পারে।
পাঁচ: ধ্বংসাত্মক সাতটি বিষয় জানা, যে ব্যাপারে বিশেষভাবে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
ছয়: যাদুকরকে কাফের ঘোষণা দিতে হবে।
সাত: তাওবা তলব করা ছাড়াই যাদুকরকে হত্যা করতে হবে।
আট: যদি ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর যুগে যাদু বিদ্যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর পরবর্তী যুগের অবস্থা কি দাঁড়াবে?
পরিচ্ছেদ: যাদু এবং যাদুর শ্রেণীভূক্ত বিষয়
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন মুহাম্মাদ ইবন জাফর সূত্রে। তিনি আউফ সূত্রে। তিনি হাইয়্যান ইবন আলা সূত্রে। তিনিকুতুন ইবন কুবাইসা সূত্রে তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই ‘ইয়াফা’, ‘তারক’ এবং ‘তিয়ারাহ’ হচ্ছে ‘জিবত’ এর অন্তর্ভুক্ত।
‘আউফ বলেছেন, ‘ইয়াফা’ হচ্ছে পাখি উড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা। ‘তারক’ হচ্ছে মাটিতে রেখা টেনে ভাগ্য গণনা করা।
আর জিবত হচ্ছে:
হাসান বলেছেন, ‘জিবত’ হচ্ছে শয়তানের মন্ত্র।
এ বর্ণনার সনদ সহীহ, আবূ দাউদ, নাসায়ী এবং ইবনু হিববান স্বীয় সহীহতে (আউফের ব্যাখ্যা বাদে) শুধু মুসনাদ অংশটুকু বর্ণনা করেছেন।
ইবন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্যোতিষবিদ্যার কিছু শিক্ষা করলো, সে মূলত যাদুবিদ্যার একটা শাখা আয়ত্ত করলো। জ্যোতিষবিদ্যা যত বাড়বে যাদুবিদ্যাও তত বাড়বে।” এটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন আর তার সনদ সহীহ।
ইমাম নাসায়ী আবু হুরায়রা থেকে একটি হাদীসে বর্ণনা করেছেন, “যে ব্যক্তি গিরা লাগায় অতঃপর তাতে ফুঁক দেয় সে মূলতঃ যাদু করে। আর যে ব্যক্তি যাদু করে সে মূলতঃ শিরক করে আর যে ব্যক্তি কোন জিনিস [তাবিজ-কবজ] লটকায় তাকে ঐ জিনিসসের দিকেই সোপর্দ করা হয়।”
ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ওহে, আমি কি তোমাদের জানাবো চোগলখুরী কী? চোগলখুরী হচ্ছে মানুষের মাঝে কথা চালাচালি।” মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
ইবন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় কোন কোন কথার মধ্যে যাদু আছে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: ‘‘নিশ্চয়ই ‘ইয়াফা’, ‘তারক’ এবং ‘তিয়ারাহ’ হচ্ছে ‘জিবত’ এর অন্তর্ভুক্ত।
দুই: ‘ইয়াফা’, ‘তারক’, এবং ‘তিয়ারাহ’ এর তাফসীর।
তিন: জ্যোতির্বিদ্যা যাদুর অন্তর্ভুক্ত।
চার: ফুঁকসহ গিরা লাগানো যাদুর অন্তর্ভুক্ত।
পাঁচ: কুৎসা রটনা করা যাদুর শামিল।
ছয়: কিছু কিছু বাগ্মীতাও যাদুর অন্তর্ভুক্ত।
পরিচ্ছেদ: গণক ইত্যাদি প্রসঙ্গে
ইমাম মুসলিম তার স্বীয় সহীহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে আসলো তারপর তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করল এবং তাকে বিশ্বাস করল। তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না।”
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যাক্তি গণকের কাছে আসলো, অতঃপর গণক যা বললো তা সত্য বলে বিশ্বাস করলো, সে মূলতঃ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করলো।” এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।
আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ ও হাকিম-এ রয়েছে,
-ইমাম হাকিম হাদীসটিকে বুখারি ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ বলেছেন- “যে ব্যাক্তি গণকের কাছে আসলো, অতঃপর গণক যা বললো তা সত্য বলে বিশ্বাস করলো, সে মূলতঃ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করলো।”
আবু ইয়ালা-তে
জাইয়্যেদ সনদে ইবন মাসউদ থেকে অনুরূপ মওকুফ বর্ণিত আছে।
ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত, “সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে কু-লক্ষণে বিশ্বাস করে বা তার জন্যে কু-লক্ষণ গ্রহণ করা হয় অথবা যে গণনা করে বা তার জন্য গণনা করা হয় অথবা যে যাদু করে বা তার জন্য যাদু করা হয়, আর যে ব্যক্তি কোনো যাদুকরের নিকট আসল এবং সে যা বলল তা বিশ্বাস করল, সে যেন মুহাম্মাদের ওপর অবতীর্ণ দীনকে অস্বীকার করল।” উত্তম সনদে এটি বাযযার বর্ণনা করেছেন।
[ইমাম তাবারানীও এ হাদীসটি আওসাতে বর্ণনা করেছেন। তবে ومن أتى كاهنا থেকে হাদীসের শেষ পর্যন্ত ইমাম তাবারানী কর্তৃক বর্ণিত ইবনে আববাসের হাদীসে উল্লেখ নেই।
ইমাম বাগাবী বলেন, عراف [গণক] ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যে ব্যক্তি বিভিন্ন মন্ত্র ইত্যাদির মাধ্যমে চুরি হয়ে যাওয়া জিনিস এবং কোন জিনিস হারিয়ে যাওয়ার স্থান ইত্যাদি বিষয়ে অবগত আছে বলে দাবী করে।
কেউ কেউ বলেছেন, عراف হলো الْكَاهِنُ তথা গণক । মূলতঃ الْكَاهِنُ বা গণক বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যে ভবিষ্যতের গায়েবী বিষয় সম্পর্কে সংবাদ দেয় [অর্থাৎ যে ভবিষ্যদ্বাণী করে]।
কারো মতে যে, ব্যক্তি অন্তরের (গোপন) বিষয় সম্পর্কে খবর দেয় সেই গণক।
আবুল আববাস ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, كاهن [গণক], منجم [জ্যোতির্বিদ], এবং رمال [বালির উপর রেখা টেনে ভাগ্য গণনাকারী] এবং এ জাতীয় পদ্ধতিতে যারাই গায়েব সম্পর্কে কিছু জানার দাবী করে তাদেরকেই আররাফ [عراف] বলে।
আব্দুল্লাহ ইবন আববাস এমন এক কওমের ব্যাপারে যারা আরবী أباجاد লিখে নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি দেয় তাদের ব্যাপারে বলেছেন: (পরকালে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে কোনো ভালো ফল আছে বলে আমি মনে করি না।)
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: গণনাকারীকে সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং কুরআনের প্রতি ঈমান রাখা, এ দুটি বিষয় একই ব্যক্তির অন্তরে এক সাথে অবস্থান করতে পারে না।
দুই: ভাগ্য গণনা করা কুফরী হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা।
তিন: যার জন্য গণনা করা হয়, তার উল্লেখ।
চার: যার জন্য অশুভ লক্ষণ গ্রহণ করা হয়, তার উল্লেখ।
পাঁচ: যার জন্য যাদু করা হয়, তার উল্লেখ।
ছয়: ভাগ্য গণনা করার জন্যে যে ব্যক্তি ‘‘আবাজাদ’’ শিক্ষা করেছে তার উল্লেখ্য।
সাত: কাহেন, [كاهن] এবং ‘আররাফ’ [عراف] এ মধ্যে পার্থক্য।
পরিচ্ছেদ: নুশরাহ বা প্রতিরোধমূলক যাদু বিষয়ে আলোচনা
জাবের থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নুশরাহ বা প্রতিরোধমূলক যাদু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো। জবাবে তিনি বললেন, “এটা হচ্ছে শয়তানের কাজ।” আবূ দাউদ বলেন, ইমাম আহমাদকে নুশরাহ [প্রতিরোধমূলক যাদু] সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘ইবন মাসউদ এর [নুশরাহর] সব কিছুই অপছন্দ করতেন।’’
সহীহ বুখারীতে কাতাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, আমি ইবনুল মুসাইয়্যিবকে বললাম, “একজন মানুষের অসুখ হয়েছে অথবা তাকে তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, এমতাবস্থায় তার এ সমস্যার সমধান করা কিংবা প্রতিরোধমূলক যাদু [নুশরাহ] এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যাবে কি?
তিনি বললেন, ‘এতে কোনো দোষ নেই।’ কারণ তারা এর [নুশরাহ] দ্বারা সংশোধন ও কল্যাণ সাধন করতে চায়। যা দ্বারা মানুষের কল্যাণ ও উপকার সাধিত হয় তা নিষিদ্ধ নয়।”
হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যাদুকর ছাড়া কেউ যাদু খণ্ডন করতে পারে না।
ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, ‘নুশারাহ’ হচ্ছে যাদুকৃত ব্যক্তি বা বস্ত্তর উপর থেকে যাদুর প্রভাব দূর করা। আর তা দু’ধরনের:
প্রথমটি হচ্ছে, যাদুকৃত ব্যক্তি বা বস্ত্তর উপর হতে যাদুর ক্রিয়া নষ্ট করার জন্য অনুরূপ যাদু দ্বারা চিকিৎসা করা। আর এটাই হচ্ছে শয়তানের কাজ। হাসান বসরী এর বক্তব্য দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নাশের [যাদুর চিকিৎসক] ও মুনতাশার [যাদুকৃত রোগী] উভয়ই শয়তানের পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে শয়তানের নিকটবর্তী হয়। যার ফলে শয়তান যাদুকৃত রোগীর উপর থেকে তার প্রভাব মিটিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ঝাড়-ফুঁক, বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ঔষধ-পত্র প্রয়োগ ও শরীয়ত সম্মত দোয়া ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা এ ধরনের চিকিৎসা জায়েয।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: নুশরাহ (প্রতিরোধমূলক যাদু) এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
দুই: নিষিদ্ধ বস্তু ও অনুমোদিত বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করণ, যা সন্দেহ দূরে করে দেয়।
পরিচ্ছেদ: কুলক্ষণ সম্পর্কীয় বিবরণ
আল্লাহর বাণী: ‘‘মনে রেখো, আল্লাহর কাছেই রয়েছে তাদের কুলক্ষণসমূহের চাবিকাঠি। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই তা জানে না।” [আল-আরাফ: ১৩১]
এবং তাঁর বাণী: “তারা বললেন, তোমাদের অমঙ্গল তোমাদেরই সাথে; এটা কি এজন্যে যে, তোমাদেরকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে? বরং তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।” [ইয়াছিন: ১৯]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “রোগের সংক্রমণ, অশুভ লক্ষণ, অশুভ পেঁচা ও সফর মাসের অনিষ্ট বলতে কিছু নেই।” এটিকে তারা দুইজন (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনা করেছেন।
মুসলিমের হাদীসে ‘নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টিপাত, রাক্ষস বা দৈত্য বলতে কিছুই নেই’ এ কথাটুকু অতিরিক্ত আছে
বুখারী ও মুসলিমে আনাস থেকে আরো বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “সংক্রমণ বলতে কোনো কিছু নেই এবং কুলক্ষণও নেই। তবে আমকে খুশি করে ফাল (শুভ লক্ষণ)। তারা বলল, ফাল কি?
তিনি বললেন, ভালো কথা।”
আবূ দাউদ বিশুদ্ধ সনদে উকবা ইবন আমের থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, কুলক্ষণের বা দূর্ভাগ্যের বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে উল্লেখ করা হলো। জবাবে তিনি বললেন, “এগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে ‘ফাল’। কুলক্ষণ কোনো মুসলিমকে স্বীয় কর্তব্য পালনে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। তোমাদের কেউ যদি অপছন্দনীয় কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করে তখন সে যেন বলে, ‘‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কেউ কল্যাণ দিতে পারে না। তুমি ছাড়া কেউ অকল্যাণ ও দূরাবস্থা দূর করতে পারে না। ক্ষমতা ও শক্তির আধার একমাত্র তুমিই।’’
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, “অশুভ লক্ষণ (বিশ্বাস করা) শিরকী কাজ। অশুভ লক্ষণ শিরকী কাজ। আমাদের মধ্যে অশুভ লক্ষণের ধারণা আসে, তবে আল্লাহর উপর ভরসার দ্বারা তা দূরীভূত হয়।” এটি আবূ দাউদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসের শেষ কথাটি ইবন মাসউদের কথার অংশ বলেছেন।
ইমাম আহমাদ ইবন আমর থেকে বর্ণনা করেন, “কুলক্ষণ যাকে তার প্রয়োজন থেকে ফিরিয়ে রাখল সে শির্ক করল।” তারা বলল, তার কাফ্ফারা কী? তিনি বললেন, এ কথা বলা: “হে আল্লাহ তোমার কল্যাণ ছাড়া কোনো কল্যাণ নেই, তোমার অকল্যাণ ছাড়া কোনো অকল্যাণ নেই এবং তুমি ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই।”
ইমাম আহমাদের মুসনাদে রয়েছে, ফদল ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, “কুসংস্কার হলো যা তোমাকে চালায় অথবা তোমাকে বিরত রাখে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: {اَلَاۤ اِنَّمَا طٰٓىِٕرُهُمْ عِنْدَ اللّٰهِ} [জেনে রেখো তাদের দুর্ভাগ্য আল্লাহর কাছে নিহিত] এবং طَآىِٕرُكُمْ مَّعَكُمْ [তোমাদের দুর্ভাগ্য তোমাদের সাথেই রয়েছে] এ আয়াত দু’টির ব্যাপারে সতর্কীকরণ।
দুই: সংক্রামক রোগকে অস্বীকার করা।
তিন: কুলক্ষণের অস্বীকৃতি।
চার: দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে অস্বীকৃতি [অর্থাৎ দুর্ভাগ্য বলতে ইসলামে কোনো কিছু নেই]
পাঁচ: কুলক্ষণ ‘সফর’ এর অস্বীকৃতি জ্ঞাপন।
ছয়: ‘ফাল’ উপরোক্ত নিষিদ্ধ বা অপছন্দনীয় জিনিসের অন্তর্ভূক্ত নয়; বরং এটা মুস্তাহাব।
সাত: ‘ফাল’ এর ব্যাখ্যা।
আট: তা অপছন্দ করার সাথে যদি তা কারো অন্তরে এসে যায় তাতে কোনো ক্ষতি নাই, বরং আল্লাহ তা তাওয়াক্কুল দ্বারা দূর করে দেন।
নয়: যাকে অশুভ লক্ষণে পাবে সে কি বলবে তার আলোচনা।
দশ: এ কথা স্পষ্ট করা যে তিয়ারাহ (অশুভ লক্ষণ) শির্ক
এগারো: নিন্দনীয় কুলক্ষণের ব্যাখ্যা।
পরিচ্ছেদ: জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে
ইমাম বুখারি তাঁর সহীহ গ্রন্থে বলেছেন, কাতাদাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা এসব নক্ষত্রকে তিনটি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, আকাশের সৌন্দর্যের জন্য, আঘাতের মাধ্যমে শয়তান বিতাড়নের জন্য এবং [দিক ভ্রান্ত পথিকদের] নিদর্শন হিসেবে পথের দিশা পাওয়ার জন্য। যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্য ছাড়া এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিল সে ভুল করল এবং তার ভাগ্য নষ্ট করল। আর এমন জটিল কাজ তার ঘাড়ে নিল যে সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞানই নেই।” সমাপ্ত।
কাতাদাহ চাঁদের কক্ষ সংক্রান্ত বিদ্যার্জন অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যা অপছন্দ করতেন। আর উ’য়াইনা এ বিদ্যার্জনের অনুমতি দেননি। উভয়ের কাছ থেকে হারব একথা বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ এবং ইসহাক [চাদের] কক্ষপথ জানার অনুমতি দিয়েছেন।
এবং
আবু মূসা আশআরী থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না: ১। মাদকাসক্ত ব্যক্তি ২। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী এবং ৩। যাদুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী।” এটি আহমাদ ও ইবন হিব্বান স্বীয় সহীহে বর্ননা করেছেন,
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: নক্ষত্র সৃষ্টির রহস্য।
দুই: নক্ষত্র সৃষ্টির ভিন্ন উদ্দেশ্য বর্ণনাকারীর সমুচিত জবাব প্রদান।
তিন: কক্ষ সংক্রান্ত বিদ্যার্জনের ব্যাপারে মতভেদের উল্লেখ।
চার: যাদু বাতিল জানা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি যাদুর অন্তর্ভুক্ত সামান্য জিনিসেও বিশ্বাস করবে, তার প্রতি কঠোর হুশিয়ারী।
পরিচ্ছেদ: নক্ষত্রের ওসীলায় বৃষ্টি কামনা করা
আর আল্লাহর বাণী: “আর তোমরা তোমাদের রিযিক বানিয়ে নিয়েছ যে, তোমরা মিথ্যা আরোপ করবে।” [আল-ওয়াকিয়াহ: ৮২]
আবূ মালিক আল আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “জাহেলী যুগের চারটি কুস্বভাব আমার উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, যা তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে পারবেনা। এক: আভিজাত্যের অহংকার করা। দুই: বংশের বদনাম গাওয়া। তিন: নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি কামনা করা এবং চার: মৃত ব্যাক্তির জন্য বিলাপ করা।”
তিনি আরো বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপকারিনী তার মৃত্যুর পূর্বে যদি তাওবা না করে, তবে কেয়ামতের দিন আল-কাতরার পায়জামা আর খোস-পাচঁড়ার বর্ম পরিধান করে উঠবে।’ মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারি ও মুসলিম যায়েদ ইবন খালেদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘তিনি বলেছেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে বৃষ্টি হবার পর হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। সালাত শেষ করে তিনি লোকদের দিকে ফিরে বললেন: তোমরা কি জান, তোমাদের পরাক্রমশালী ও মহিমাময় প্রতিপালক কী বলেছেন? তাঁরা বললেন: আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই বেশি জানেন। তিনি বললেন: (রব) বলেন, “আমার বান্দাদের মধ্য কেউ আমার প্রতি মু’মিন হয়ে গেল এবং কেউ কাফির। যে বলেছে, আল্লাহর করুণা ও রহমতে আমরা বৃষ্টি লাভ করেছি, সে হল আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী হয়েছে।”
ইমাম বুখারি ও মুসলিম
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস হতে এ অর্থেই হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে এ কথা আছে যে, “কেউ কেউ বলেছেন, ‘অমুক অমুক নক্ষত্র সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াত নাযিল করেন, “অতঃপর আমি শপথ করছি নক্ষত্ররাজির অস্তাচলের, আর নিশ্চয় এটা এক মহাশপথ, যদি তোমারা জানতে। নিশ্চয় এটা মহিমান্বিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে। যারা সম্পূর্ণ পবিত্র তারা ছাড়া অন্য কেউ তা সম্পর্শ করে না। এটা সৃষ্টিকুলের রবের কাছ থেকে নাযিলকৃত। তবুও কি তোমরা এ বাণীকে তুচ্ছ গণ্য করছ? আর তোমরা তোমাদের রিযিক বানিয়ে নিয়েছ যে, তোমরা মিথ্যা আরোপ করবে।” [আল-ওয়াকিয়া: ৭৫—৮২]
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা ওয়াকেয়ার উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর।
দুই: জাহেলী যুগের চারটি স্বভাবের উল্লেখ।
তিন: উল্লেখিত স্বভাবগুলোর কোন কোনটির কুফরী হওয়া উল্লেখ।
চার: এমন কিছু কুফরী আছে যা মুসলিমকে মিল্লাত থেকে বের করে দেয় না।
পাঁচ: তার বাণী: বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি বিশ্বাসী আবার কেউ অবিশ্বাসী হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নেয়ামত [বৃষ্টি] নাযিল হওয়া।
ছয়: এসব জায়গায় ঈমানের ব্যপারে সজাগ থাকা প্রয়োজন।
সাত: এসব জায়গায় কুফরের ব্যাপারে সজাগ থাকা প্রয়োজন।
আট: لقد صدق نوء كذا وكذا [অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাব সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে] এর মর্মার্থ বুঝা।
নয়: তোমরা জানো কি ‘তোমাদের রব কি বলেছেন?’ এ কথা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, কোন বিষয় শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করতে পারেন।
দশ: মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপকারিণীর জন্য কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: ‘‘মানুষের মধ্যে এমন মানুষও রয়েছে যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সদৃশ স্থির করে, আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে।” [আল-বাকারাহ: ১৬৬]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: “বলুন, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানেরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমার ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ্ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।” [আত-তাওবাহ: ২৪]
আনাস থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই।” এটিকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
বুখারী ও মুসলিমে আনাস থেকে আরো বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে, সে তার দ্বারা ঈমানের স্বাদ লাভ করবে: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে অধিক প্রিয় হবে; কাউকে ভালোবাসলে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে। আর কুফরী থেকে তাকে আল্লাহর বাঁচানোর পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করবে, যেমন সে নিজেকে আগুনে নিক্ষিপ্ত করাকে অপছন্দ করে।”
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “কেউ ঈমানের স্বাদ পাবে না যতক্ষণ না...।” (হাদীসের শেষ পর্যন্ত।
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসে, আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ঘৃণা করে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে; সে ব্যক্তি এ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভ করবে। আর এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া ব্যতীত সালাতের ও সাওমের পরিমাণ যত বেশীই হোক না কেন, কোনো বান্দাই ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না। সাধারণতঃ মানুষের মধ্যে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্থিব স্বার্থ। এ জাতীয় ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের দ্বারা কোনো উপকার সাধিত হয় না।” ইবন জারীর এটি বর্ণনা করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস বলেন وَ تَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْاَسْبَابُ অর্থাৎ তাদের সম্পর্ক বিছিন্ন হয়ে যাবে। এ সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা বাকারার উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: সূরা তাওবার উপরোক্তআয়াতের তাফসীর।
তিন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসাকে জীবন, পরিবার ও ধন-সম্পদের উপর অগ্রাধিকার দেয়া ওয়াজিব।
চার: ঈমান নেই বললে ইসলাম থেকে বহিষ্কারকে বুঝায় না।
পাঁচ: ঈমানের একটা স্বাদ আছে। মানুষ কখনো তা অনুভব করতে পারে, আবার কখনো তা অনুভব করতে পারে না।
ছয়: অন্তরের এমন চারটি আমল আছে যা ছাড়া আল্লাহর বন্ধুত্ব ও নৈকট্য লাভ করা যায় না, ঈমানের স্বাদও অনুভব করা যায় না।
সাত: একজন প্রখ্যাত সাহাবী দুনিয়ার এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সাধারণত গড়ে উঠে পার্থিব বিষয়ের ভিত্তিতে।
আট: وَ تَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْاَسْبَابُ এ আয়াতের তাফসীর।
নয়: মুশরিকদের মধ্যেও এমন লোক রয়েছে যারা আল্লাহকে খুব ভালবাসে [কিন্তু শিরকের কারণে এ ভালবাসা অর্থহীন।]
দশ: যার মধ্যে তার দীনের চেয়ে উল্লেখিত আটটি বিষয়ের প্রতি অধিক মহব্বত থাকবে তার প্রতি ধমক।
এগারো: যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে এবং ঐ শরীককে আল্লাহকে ভালবাসার মতই ভালবাসে সে শিরকে আকবার অর্থাৎ বড় ধরনের শিরক করলো।
পরিচ্ছেদ: আল্লা্হর বাণী: “সে তো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়; কাজেই যদি তোমরা মুমিন হও তবে তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর।” [আলু ইমরান: ১৭৫]
এবং তাঁর বাণী “তারাই তো আল্লাহর মসজিদের আবাদ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব আশা করা যায়, তারা হবে সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [আত-তাওবাহ: ১৮]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: ‘‘মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। এরপর যখন আল্লাহর পথে তারা দুঃখ কষ্ট পায় তখন মানুষের চাপানো দুঃখ কষ্টের পরীক্ষাকে তারা আল্লাহর আযাবের সমতূল্য মনে করে।’’ [আল-আনকাবূত: ১০]
আবূ সাঈদ আল খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত, “বিশ্বাসের (ঈমানের) দুর্বলতা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা, আল্লাহর রিযিক ভোগ করে মানুষের গুণগান করা, তোমাকে আল্লাহ যা দান করেননি তার ওপর মানুষের বদনাম করা। কোন লোভীর লোভ আল্লাহর রিযিক টেনে আনতে পারে না। আবার কোন ঘৃণাকারীর ঘৃণা আল্লাহর রিযিক বন্ধ করতে পারে না।”
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন।” এটি ইবনু হিব্বান স্বীয় সহীহ-তে বর্ননা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা আলে ইমরানের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: সূরা তাওবার উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
তিন: সূরা আনকাবূতের আয়াতের তাফসীর।
চার: বিশ্বাস দুর্বল হয় ও শক্তিশালী হয়।
পাঁচ: উপরোক্ত তিনটি ঈমানের দুর্বলতার আলামত।
ছয়: আল্লাহর জন্য ভয়কে খাঁটি/ নিবিষ্ট করা ফরযের একটি।
সাত: যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে তার সাওয়াবের আলোচনা।
আট: যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে না তার শাস্তির বিবরণ।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “যদি মুমিন হও তাহলে আল্লাহর ওপরই ভরসা করো।” [আল-মায়েদা: ২৩]
এবং আল্লাহর বাণী: “মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় আল্লাহকে স্মরণ করা হলে কম্পিত হয় এবং তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট পাঠ করা হলে তা তাদের ঈমান বর্ধিত করে। আর তারা তাদের রব –এর উপরই নির্ভর করে।” [আল-আনফাল: ২]
এবং মহান আল্লাহর বাণী: “হে নবী! আপনার জন্য ও আপনার অনুসারীদের জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট।” [আল-আনফাল: ৬৪]
এবং আল্লাহর বাণী: “আর যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” [তালাক: ৩]
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আর তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক।”” ইবারাহীম ‘আলাইহিস সালামকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হলো তখন তিনি এ কথা বলেছেন। আর মুহাম্মা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন যখন তারা তাকে বলল, “এদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহ্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক।” [আলে ইমরান: ১৭৩] এটি বুখারী ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: তাওয়াক্কুল করা ফরয।
দুই: তাওয়াক্কুল ঈমানের শর্ত।
তিন: সূরা আনফালের উক্ত আয়াতের তা্ফসীর।
চার: তার শেষে আয়াতের তাফসীর।
পাঁচ: সূরা তালাকের উল্লিখিত আয়াতের তাফসীর।
ছয়: তাওয়াক্কুলের উক্ত কথার গুরুত্ব বর্ণনা করা; কারণ এটি ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম উভয়ের কথা।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকেও নিরাপদ হয়ে গেছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া কেউই আল্লাহর কৌশলকে নিরাপদ মনে করে না।” [আল-আরাফ: ৯৯]
এবং আল্লাহর বাণী: “তিনি বললেন, যারা পথভ্রষ্ট তারা ছাড়া আর কে তার রবের অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়?” [আল-হিজর: ৫৬]
ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো। জবাবে তিনি বললেন, “আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা।”
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “সবেচয়ে বড় কবীরাহ গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে শির্ক করা, আল্লাহর পাঁকড়াও থেকে নিরাপদ হওয়া, আল্লাহর রহমত হতে হতাশ হওয়া ও আল্লাহর প্রশস্ততা হতে নিরাশ হওয়া।” এটি আব্দুর রাজ্জাক বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা আরাফের উক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: সূরা হিজরের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
তিন: আল্লাহর পাকড়াও থেকে ভয়হীন ব্যক্তির জন্য কঠোর শাস্তির হুশিয়ারী।
চার: হতাশ হওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন হুমকি প্রদান।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর তাকদীরের [ফায়সালার] উপর ধৈর্য ধারণ করা ঈমান।
আল্লাহর বাণী: “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান আনে, তার অন্তরকে তিনি হেদায়াত দান করেন। আল্লাহ তো সব বিষয়ে অবগত।” [আত-তাগাবুন: ১১]
আলকামা বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তিই মুমিন, যে ব্যক্তি বিপদ আসলে মনে করে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এর ফলে সে বিপদগ্রস্থ হয়েও সন্তুষ্ট থাকে এবং বিপদকে খুব সহজেই স্বীকার করে নেয়।’
সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মানুষের মধ্যে দু’টি স্বভাব আছে: সে দু’টি স্বভাব তাদের ভেতর কুফুরী। বংশের বদনাম করা এবং মৃতের ওপর কান্নাকাটি করা।”
ইমাম বুখারি ও মুসলিম ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে মারফু হাদীসে বর্ণনা করেন, “সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে (শোকের সময়) গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের চিৎকারের ন্যায় চিৎকার করে।”
‘আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা যখন তার কোনো বান্দার কল্যাণ চান তখন তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে তাকে শাস্তি প্রদান করেন। আর যখন তিনি তার কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তাকে তার অপরাধের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। যাতে কিয়ামতের দিন তিনি তাকে পুরাপুরি শাস্তি দেন।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “বিপদ যত বড় হবে, প্রতিদানও তত মহান হবে। আল্লাহ তা'আলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তখন তাদেরকে (বিপদে ফেলে) পরীক্ষা করেন। যে লোক তাতে (বিপদে) সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহ্ তা'আলার) সন্তুষ্টি বিদ্যমান। আর যে লোক তাতে অসন্তুষ্ট হয় তার জন্য (আল্লাহ তা'আলার) অসন্তুষ্টি বিদ্যমান।” তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা তাগাবুনের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: বিপদে ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা ঈমানের অঙ্গ।
তিন: কারো বংশের প্রতি অপবাদ দেয়া বা দুর্নাম করা কুফরীর শামিল।
চার: যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে, গাল- চাপড়ায়, জামার আস্তিন ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহেলী যুগের কোনো রীতি নীতির প্রতি আহবান জানায়, তার প্রতি কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন।
পাঁচ: আল্লাহর স্বীয় বান্দার সঙ্গে কল্যাণের ইচ্ছা করার নিদর্শন।
ছয়: আল্লাহর স্বীয় বান্দার সঙ্গে অনিষ্টের ইচ্ছা করার নিদর্শন।
সাত: বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার নিদর্শন।
আট: আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া হারাম।
নয়: বিপদে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকার সওয়াব।
পরিচ্ছেদ: রিয়া বিষয়ে আলোচনা
আর আল্লাহর বাণী: “বলুন, ‘আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষ, আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র সত্য ইলাহ। কাজেই যে তার রব-এর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকাজ করে ও তার রব-এর ‘ইবাদাতে কাউকেও শরীক না করে।” [আল-কাহাফ: ১১০]
আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত, “আমি সমস্ত অংশীদারদের চাইতে অংশীদারী [শিরক] থেকে অধিক অমুখাপেক্ষী। যদি কেউ এমন কাজ করে যাতে সে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি তাকে ও তার শির্ককে বর্জন করি।” ইমাম মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
আবূ সাঈদ থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত, “আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ে সংবাদ দেব না? যে বিষয়টি আমার কাছে ‘মসীহ দাজ্জালের’ চেয়েও ভয়ঙ্কর?”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তা হচ্ছে ‘শিরকে খফী’ বা গুপ্ত শিরক। [আর এর উদাহরণ হচ্ছে] একজন মানুষ দাঁড়িয়ে শুধু এ জন্যই তার সালাতকে খুব সুন্দরভাবে আদায় করে যে, কোনো মানুষ তার সালাত দেখছে [বলে সে মনে করছে]। এটি আহমদ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা কাহাফের উক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: নেক আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক ত্রুটি হচ্ছে উক্ত নেক কাজ করতে গিয়ে আল্লাহ ছাড়ও অন্যকে খুশী করার নিয়ত।
তিন: শির্কযুক্ত নেক আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণের উল্লেখ। আর তা হলো তিনি পরিপূর্ণ ও মুখাপেক্ষীহীন।
চার: শির্কযুক্ত নেক আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আরেকটি কারণের উল্লেখ। আর তা হলো তিনি সবচেয়ে উত্তম অংশীদার।
পাঁচ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় সাহাবীদেরকে রিয়ার ব্যাপারে ভয় দেখান।
ছয়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রিয়ার ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, একজন মানুষ মূলত সালাত আদায় করবে আল্লাহরই জন্যে। তবে সালাতকে সুন্দরভাবে আদায় করবে শুধু এজন্য যে, সে মনে করে কোনো মানুষ তার সালাত দেখছে।
পরিচ্ছেদ: আরেকটি শিরক হলো মানুষের তার আমল দ্বারা দুনিয়া ইচ্ছা করা।
আল্লাহর বাণী: “যে কেউ দুনিয়ার জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমরা তাদের কাজের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না।“ তাদের জন্য আখিরাতে আগুন ছাড়া অন্য কিছুই নেই এবং তারা যা করেছিল আখিরাতে তা নিস্ফল হবে। আর তারা যা করত তা ছিল নিরর্থক।” [হুদ: ১৫-১৬]
সহীহ হাদীসে আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দীনার ও দেরহাম অর্থাৎ টাকা-পয়সার পূজারীরা ধ্বংস হোক।
রেশম পূজারী [পোষাক- বিলাসী] ধ্বংস হোক।
পোষাক পুজারী ধ্বংস হোক।
দেওয়া হলে খুশী হয় আর না দেওয়া হলে রাগান্বিত হয়। সে ধ্বংস হোক, তার আরো খারাপ হোক, কাঁটা-ফুটলে সে তা খুলতে সক্ষম না হয় [অর্থাৎ সে বিপদ থেকে উদ্ধার না পাক।
সে বান্দা সৌভাগ্যের অধিকারী যে আল্লাহর রাস্তায় তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছে, মাথার চুলগুলোকে এলো-মেলো করেছে আর পদযুগলকে করেছে ধূলি মলিন।
তাকে পাহারার দায়িত্ব দিলে সে পাহারাতেই লেগে থাকে।
সেনাদলের শেষ ভাগে তাকে নিয়োজিত করলে সে শেষ ভাগেই লেগে থাকে।
সে অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। আর সে সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গৃহীত হয় না।“
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আখেরাতের আমল দ্বারা মানুষের দুনিয়া হাসিলের ইচ্ছা।
দুই: সূরা হুদের উল্লিখিত আয়াতের তাফসীর।
তিন: একজন মুসলিম মানুষকে দিনার-দেরহাম ও পোষাকের বিলাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা।
চার: উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা হচ্ছে, বান্দাকে যদি দেওয়া হয় তাহলে সে খুশী হয় আর যদি দেওয়া না হয় তাহলে সে অসন্তুষ্ট হয়। এ ধরনের লোক দুনিয়াদার।
পাঁচ: দুনিয়াদারকে আল্লাহর নবী এ বদদোয়া করেছেন, ‘‘সে ধ্বংস হোক, সে অপমানিত হোক বা অপদস্ত হোক।’’
ছয়: দুনিয়াদারকে এ বলেও বদদোয়া করেছেন, ‘‘তার গায়ে কাঁটা ফুটলে তা যেন বের না হয়।”
সাত: হাদীসে বর্ণিত গুণাবলীতে গুণান্বিত মুজাহিদের প্রশংসা করা হয়েছে। সে সৌভাগ্যের অধিকারী বলে জানান হয়েছে।
পরিচ্ছেদ: যে ব্যাক্তি আল্লাহর হালালকৃত জিনিস হারাম এবং হারামকৃত জিনিসকে হালাল করার ব্যাপারে আলেম, বজুর্গ ও নেতাদের আনুগত্য করলো, সে মূলত তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করলো।
ইবন আব্বাস বলেন, ‘তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কারণ, আমি বলছি, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন’ আর তোমরা বলছো, ‘‘আবুবকর ও উমার বলেছেন।’
আহমাদ ইবন হাম্বল বলেছেন, ‘ঐ সব লোকদের ব্যাপারে আমার কাছে খুবই অবাক লাগে, যারা হাদীসের সনদ ও ‘সিহহাত’ [বিশুদ্ধতা] অর্থাৎ হাদিসের পরস্পরা ও সহীহ হওয়ার বিষয়টি জানার পরও সুফইয়ান সওরীর মতামতকে গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “যারা তাঁর আদেশের বিপরীত করে তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত যে, যেন তাদেরকে কোনো ফিতনা কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি না পেয়ে বসে।” [আন-নূর: ৬৩] তুমি কি জানো ফিতনা কি? ফিতনা হচ্ছে শিরক। কারণ, তাঁর কোনো কথা প্রত্যাখ্যান করলে তার অন্তরে বক্রতার সৃষ্টি হবে এর ফলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’
আদী ইবন হাতিম থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ আয়াত পড়তে শুনেছেন, “তারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগিদেরকে তাদের রবরূপে গ্রহণ করেছে এবং মার্’ইয়াম- পুত্র মসীহ্কেও। অথচ এক ইলাহের ‘ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ্ নাই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্র।” [তাওবাহ: ৩১] আমি বললাম, আমি তাকে বলেছি: ‘আমরাতো তাদের ইবাদত করি না।’
তিন বললেন, ‘আচ্ছা আল্লাহর হালাল ঘোষিত জিনিসকে তারা হারাম বললে, তোমরা কি তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করো না? আবার আল্লাহর হারাম ঘোষিত জিনিসকে তারা হালাল বললেন, তোমরা কি তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করো না?
তখন আমি বললাম, হ্যাঁ,
তিনি তখন বললেন, ‘এটাই তাদের ইবাদত (করার মধ্যে গণ্য।)’ এটি আহমাদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা নূরের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
দুই: সূরা তাওবার উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
তিন: আদী ইবন হাতেম ইবাদতের যে অর্থ অস্বীকার করেছেন, সে ব্যাপারে সতর্কীকরণ।
চার: ইবনু আব্বাস কর্তৃক আবু বকর ও উমারের দৃষ্টান্ত পেশ করা আর আহমাদ কর্তৃক সুফইয়ান সাওরীর দৃষ্টান্ত পেশ করা।
পাঁচ: অবস্থার পরিবর্তন মানুষকে এমন [গোমরাহীর] পর্যায়ে উপনীত করেছে, যার ফলে পন্ডিত ও পীর বুজুর্গের পূজা করাটাই তাদের কাছে সর্বোত্তম ইবাদতে পরিণত হয়েছে। আর এরই নাম দেয়া হয় ‘‘বেলায়াত।’’ ‘আহবার’ তথা পন্ডিত ব্যক্তিদের ইবাদত হচ্ছে, তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। অতঃপর অবস্থার পরিবর্তন হয়ে এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি নেককার নয় তারও ইবাদত করা শুরু হয়েছে। আর দ্বিতীয় অর্থে তারও ইবাদত করা হয়েছে যে ব্যক্তি জাহিল ও মূর্খ।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা ঈমান এনেছে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়? তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে আপনি আপনার কাছ থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবেন। (৬৩) অতঃপর কি অবস্থঅ হবে, যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের কোন মুসীবত হবে? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে আপনার কাছে এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ছাড়া অন্য কিছুই চাইনি।” [আন-নিসা: ৬০-৬২]
মহান আল্লাহর বাণী: “আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না। তারা বলে, ‘আমরা তো কেবল সংশোধনকারী।” [আল-বাকারাহ: ১১]
আল্লাহর বাণী: “আর যমীনে শান্তি স্থাপনের পর তোমরা সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। আর আল্লাহকে ভয় ও আশার সাথে ডাক। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ মুহসিনদের (সৎকর্মশীলদের) খুব নিকটে।” [আল-আরাফ: ৫৬]
মহান আল্লাহ আরও বলেন, “তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?” [আল-মায়েদা: ৫০]
আব্দুল্লাহ ইবন আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ ঈমানাদর হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত আদর্শের অধীন হয়।”
নববী বলেন, হাদীসটি সহীহ। এটিকে আমরা “হুজ্জাহ” গ্রন্থে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছি।
ইমাম শা’বী বলেছেন, একজন মুনাফিক এবং একজন ইহুদীর মধ্যে (একটি ব্যাপারে) ঝগড়া ছিলো।
ইহুদী বললো, ‘আমরা এর বিচার- ফয়সালার জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাবো,
সে জানত যে, তিনি ঘুষ গ্রহণ করেন না।
আর মুনাফিক বললো, ‘ফায়সালার জন্য আমরা ইহুদী বিচারকের কাছে যাবো, কেননা সে জানত যে, ইয়াহুদীরা ঘুষ খায়।
পরিশেষে তারা উভয়েই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, তারা এর বিচার ও ফয়সালার জন্য জোহাইনা গোত্রের এক গণকের কাছে যাবে। তখন এ আয়াত নাযিল হয়: “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবি করে।” [আন-নিসা: ৬০-৬২]
আরেকটি বর্ণনা মতে জানা যায়, ঝগড়া- বিবাদে লিপ্ত দু’জন লোকের ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। তাদের একজন বলেছিলো, মীমাংসার জন্য আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাবো, অপরজন বলেছিলো, কা’ব ইবন আশরাফের কাছে যাবো।’ পরিশেষে তারা উভয়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য ওমর এর কাছে সোপর্দ করলো। তারপর তাদের একজন ঘটনাটি তাঁর কাছে উল্লেখ করলো।
যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিল না, তাকে লক্ষ্য করে উমার বললেন, ঘটনাটি কি সত্যিই এরকম?
সে বললো, হ্যাঁ, তখন তিনি তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করে ফেললেন।’’
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতের তাফসীর এবং তাতে রয়েছে তাগুতের মর্মার্থ বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা।
দুই: সূরা বাকারার ১১ নং আয়াত “আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না“এর ব্যাখ্যা।
তিন: সূরা আরাফের ৫৬ নং আয়াত “আর যমীনে শান্তি স্থাপনের পর তোমরা সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না” এর তাফসীর।
চার: সূরা মায়েদার اَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُوْنَ “তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে?-”এর তাফসীর।
পাঁচ: এ অধ্যায়ের প্রথম আয়াত اَلَمْ تَرَ اِلَى الَّذِيْنَ يَزْعُمُوْنَ, الأية নাযিল হওয়ার সম্পর্কে শা’বী এর বক্তব্য।
ছয়: সত্যিকারের ঈমান এবং মিথ্যা ঈমানের ব্যাখ্যা।
সাত: মুনাফিকের সাথে উমারের ঘটনা।
আট: প্রবৃত্তি যতক্ষণ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত আদর্শের অনুগত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার বিষয়।
পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তি আল্লাহর ‘আসমা ও সিফাত’ [নাম ও গুণাবলী] অস্বীকার করল।
আর আল্লাহর বাণী: “এবং তারা রহমান [আল্লাহর গুণবাচক নাম]-কে অস্বীকার করে। আপনি বলুন, তিনিই আমার রব, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। ভরসা তাঁরই ওপর এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাওয়া’’ [আর-রাআদ: ৩০]
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে আলী বলেন, ‘‘লোকদেরকে এমন কথা বলো, যা দ্বারা তারা [আল্লাহ ও রাসূল সম্পর্কে সঠিক কথা জানতে পারে। তোমরা কি চাও যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক?’’
আব্দুর রাজ্জাক মা‘মার থেকে, তিনি ইবন তাউস থেকে, তিনি তার পিতা থেকে। তিনি ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন: তিনি এক লোককে দেখলেন সে যখন সিফাত সম্পর্কীয় একটি হাদীস শুনল তখন তার প্রতি বিরক্ত হয়ে লাপিয়ে উঠল। তখন তিনি বললেন, এদেরকে কোন জিনিসটি বিভক্ত করল। তারা সুস্পষ্ট বিষয়গুলোতে ঢিলেমি করে আর অস্পষ্ট বিষয়সমূহে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
কুরাইশরা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে [আল্লাহর গুণবাচক নাম] ‘রাহমানের উল্লেখ করতে শুনতে পেলো, তখন তারা ‘রাহমান’ গুণটিকে অস্বীকার করলো। আল্লাহ তাদের ব্যাপারেই নাযিল করেছেন। “আর তারা রহমানের প্রতি কুফরী করে।” [আর-রাআদ: ৩০]
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর কোনো নাম ও গুণ অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে ঈমান না থাকা।
দুই: সূরা রা‘আদের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
তিন: যে কথা শ্রোতার বোধগম্য নয়, তা পরিহার করা।
চার: এমন একটি কারণের উল্লেখ, যা আল্লাহ ও তার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার দিকে নিয়ে যায়, যদিও অস্বীকারকারীর তা উদ্দেশ্য না হয়।
পাঁচ: ইবন আব্বাসের বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর কোনো একটি অস্বীকারকারীর ধ্বংস অনিবার্য।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “তারা আল্লাহর নি’আমত চিনতে পারে; তারপরও সেগুলো তারা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।” [আন-নাহাল: ৮৩]
এর অর্থ প্রসঙ্গে মুজাহিদ বলেন, কোন মানুষের এ কথা বলা ‘এ সম্পদ আমার, যা আমার পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।’
‘আওন ইবন ‘আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে, কোন ব্যক্তির এ কথা বলা, ‘অমুক ব্যক্তি না হলে এমনটি হতো না।
ইবনু কুতাইবা এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মুশরিকরা বলে, ‘‘এটা হয়েছে আমাদের ইলাহদের সুপারিশের বদৌলতে।’’
আবুল আববাস যায়েদ ইবন খালেদের হাদীসের পরে- যাতে একথা আছে, ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘আমার কতক বান্দা ভোর করেছে ঈমান অবস্থায় আর কতক কাফির অবস্থায়’’- উল্লেখ করে বলেন,
এ ধরনের অনেক বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহ-তে উল্লেখ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি তার নেয়ামতসমূহকে গাইরুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করে, আল্লাহ তার নিন্দা করেন।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো সালাফে-সালেহীন বলেন, ‘বিষয়টি মুশরিকদের এ কথার মতোই, ‘অঘটন থেকে বাঁচার কারণ হচ্ছে অনুকুল বাতাস, আর মাঝির বিচক্ষণতা’ এ ধরনের আরো অনেক কথা রয়েছে যা সাধারণ মানুষের মুখে বহুল প্রচলিত।’
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: নিয়ামত চেনার ব্যাখ্যা ও নিয়ামত অস্বীকার করা।
দুই: জানা যে, এটি (আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করা) অনেক মানুষের মুখেই প্রচলিত।
তিন: (অমুক তারকার বদৌলতে বৃষ্টি লাভ করেছি) এরূপ কথাকে আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করা বলা হয়।
চার: অন্তরে দুটি বিপরীতধর্মী বিষয়ের সমাবেশ।
পরিচ্ছেদ: আল্লা্হর বাণী: “অতএব জেনে শুনে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না।’’ [আল-বাকারাহ: ২২]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আববাস বলেন أنداد [আন্দাদ] হচ্ছে এমন শিরক যা অন্ধকার রাত্রে নির্মল কাল পাথরের উপর পিপিলিকার পদচারণার চেয়েও সুক্ষ্ম।
এর উদাহরণ হচ্ছে, তোমার এ কথা বলা, ‘আল্লাহর কসম এবং হে অমুক, তোমার জীবনের কসম ও আমার জীবনের কসম।
এবং তোমরা বলা যে, ‘যদি ছোট্ট কুকুরটি না থাকতো, তাহলে অবশ্যই আমাদের ঘরে চোর প্রবেশ করতো।
‘হাঁসটি যদি ঘরে না থাকতো, তাহলে অবশ্যই চোর আসতো।
কোনো ব্যক্তির তার সাথীকে এ কথা বলা, ‘আল্লাহ তা‘আলা এবং তুমি যা চেয়েছো।”
কোনো ব্যক্তির এ কথা বলা, ‘আল্লাহ এবং অমুক ব্যক্তি যদি না থাকে, তাহলে অমুক ব্যক্তিকে এ কাজে রেখো না।’ এগুলো সবই শিরক।” এটি ইবন আবী হাতিম বর্ণনা করেছেন।
আর ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে শপথ করল, সে কুফুরী অথবা শির্ক করল।” এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং হাসান আখ্যায়িত করেছেন আর হাকেম এটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন।
ইবন মাসউদ বলেন, আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে সত্য শপথ করার চেয়ে শ্রেয়।
‘হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা বলো না যে, আল্লাহ যা চান এবং অমুক লোক যা চায়। সুতরাং তোমরা বলো, আল্লাহ যা চান, অতঃপর অমুক যা চায়।” এটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন। এর সনদ সহীহ।
ইব্রাহীম আন-নাখঈ‘ থেকে এসেছে: তিনি এমন বলা অপছন্দ করতেন যে, আমি আল্লাহর কাছে ও তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তবে এমনভাবে বলা বৈধ আছে যে, “আল্লাহর নিকট অতঃপর তোমার নিকট”। তিনি বলেন, এবং তিনি বলতেন: “যদি আল্লাহ অতঃপর অমুক না হত”। তবে তোমারা এভাবে বলো না, “যদি আল্লাহ ও অমুক না হতো”।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর সাথে শরিক করা সংক্রান্ত সূরা বাকারার উল্লিখিত আয়াতের তাফসীর।
দুই: শিরকে আকবার অর্থাৎ বড় শিরকের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতকে সাহাবায়ে কেরাম ছোট শিরকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে তাফসীর করেছেন।
তিন: গাইরুল্লাহর নামে কসম করা শিরক।
চার: গাইরুল্লাহর নামে সত্য কসম করা, আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করার চেয়েও জঘন্য গুনাহ।
পাঁচ: বাক্যস্থিত و এবং ثم এর মধ্যে পার্থক্য।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর নামের কসমকে যথেষ্ট না করা প্রসঙ্গে।
ইবনু ‘উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা তোমাদের বাপ- দাদার নামে কসম করো না, যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কসম করে, তার উচিৎ কসমকে বাস্তবায়িত করা। আর যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে কসম করা হলো, তার উচিৎ উক্ত কসমে সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহর কসমে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট হলো না, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কল্যাণের কোনো আশা নেই।” এটি ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: বাপ-দাদার নামে কসম করার উপর নিষেধাজ্ঞা।
দুই: যার জন্য আল্লাহর নামে কসম করা হলো, তার প্রতি নির্দেশ হলো [কসমের বিষয়ে] সন্তুষ্ট থাকা।
তিন: আল্লাহর নামে কসম করার পর, যে উহাতে সন্তুষ্ট থাকে না, তার প্রতি ভয় প্রদর্শন ও হুশিয়ারি উচ্চারণ।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন’ বলা
কুতাইলা থেকে বর্ণিত আছে, একজন ইহুদী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললো, ‘আপনারাও আল্লাহর সাথে শিরক করে থাকেন।
’কারণ আপনারা বলে থাকেন, ما شاء الله وشئت আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন।
আপনারা আরো বলে থাকেন والكعبة অর্থাৎ কাবার কসম।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুসলমানদের মধ্যে যারা কসম বা হলফ করতে চায়, তারা যেন বলে, ورب الكعبة ‘কাবার রবের কসম।
আর যেন ما شاء الله ثم شئت আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন’ একথা বলে।” এটি নাসাঈ বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।
ইবন আব্বাস থেকে হাদীসে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্যে বললো, ما شاء الله وشئت[আপনি এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন], অতপর তিনি বললেন, “তুমি কি আমাকে আল্লাহর শরীক বানালে?! বরং আল্লাহ একাই যা চেয়েছেন।”
ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এর বৈমাত্রিয় ভাই, তোফায়েল থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি দেখতে পেলাম, আমি কয়েকজন ইয়াহুদীর কাছে এসেছি।
আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা অবশ্যই একটা ভাল জাতি, যদি তোমরা ওযাইর ‘আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র না বলতে।
তারা বললো, ‘তোমরাও অবশ্যই একটি ভাল জাতি যদি তোমরা ما شاء الله وشاء محمد [আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন এবং মুহাম্মদ যা ইচ্ছা করেছেন] এ কথা না বলতে!
অতঃপর নাসারাদের কিছু লোকের কাছে আমি গেলাম এবং বললাম, ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর পুত্র’ এ কথা না বললে তোমরা একটি উত্তম জাতি হতে।
তারা বললো, ‘তোমরাও অবশ্যই একটি ভাল জাতি যদি তোমরা ما شاء الله وشاء محمد [আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন এবং মুহাম্মদ যা ইচ্ছা করেছেন] এ কথা না বলতে!
সকালে এ (স্বপ্নের) খবর যাকে পেলাম তাকে দিলাম।
তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলাম এবং তাকে আমার স্বপ্নের কথা বললাম।
তিনি বললেন, ‘এ স্বপ্নের কথা কি আর কাউকে বলেছো?’’
আমি বললাম, হ্যাঁ।
তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং গুণ বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন,
“তোফায়েল একটা স্বপ্ন দেখেছে, যার খবর তোমাদের মধ্যে যাকে বলার বলেছে।
তোমরা এমন কথাই বলেছো, যা বলতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। আর আমিও তোমাদেরকে এভাবে বলতে নিষেধ করছি।
অতএব তোমরা ما شاء الله وشاء محمد অর্থাৎ ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন এবং মুহাম্মদ যা ইচ্ছা করেছেন’ একথা বলো না বরং তোমরা বলো, ما شاء الله وحده অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ যা ইচ্ছা চেয়েছেন তাই হয়েছে।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: ছোট শিরক সম্পর্কে ইহুদীরাও অবগত ছিলো।
দুই: কুপ্রবৃত্তি সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি থাকা।
তিন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি أجعلتني لله ندا ‘তুমি কি আমাকে আল্রাহর শরীক বানিয়েছো?’ [অর্থাৎ ما شاء الله وشئت এ কথা বললেই যদি শিরক হয়]
তাহলে সে ব্যক্তির অবস্থা কী দাঁড়ায়, যে ব্যক্তি বলে, يا أكرم الخلق ما لي من ألوذ به سواك হে সৃষ্টির সেরা, আপনি ছাড়া আমার আশ্রয়দাতা কেউ নেই এবং [ এ কবিতাংশের] পরবর্তী দুটি লাইন।
চার: নবী সাল্লাল্রাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী يمنعني كذا وكذا দ্বারা বুঝা যায় যে, এটা শিরকে আকবার [বড় শিরক] নয়।
পাঁচ: নেক স্বপ্ন অহীর শ্রেণীর্ভুক্ত।
ছয়: (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবিত থাকাকালীন) স্বপ্ন শরী‘আতের কোনো কোনো বিধান জারির কারণ হতে পারে।
পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তি যমানাকে গালি দেয় সে আল্লাহকে কষ্ট দেয়
আল্লাহর বাণী: “আর তারা বলে, ‘একমাত্র দুনিয়ার জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি, আর কাল-ই কেবল আমাদেরকে ধ্বংস করে।’ বস্তুত এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই, তারা তো শুধু ধারণাই করে।” [আল-জাসিয়া: ২৪]
বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থে আবূ হুরায়রাহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। সে যমানাকে গাল দেয়; অথচ আমিই যমানা।”
অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, ‘‘তোমরা যমানাকে গালি দিওনা। কারণ, আল্লাহই হচ্ছেন যমানা।’’
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: কাল বা যমানাকে গালি দেয়া নিষেধ।
দুই: যমানাকে গালি দেয়া আল্লাহকে কষ্ট দেয়ারই নামান্তর।
তিন: فإن الله هو الدهر ‘আল্লাহই হচ্ছেন যমানা’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীর মধ্যে গভীর চিন্তা করা।
চার: বান্দার অন্তরে আল্লাহকে গালি দেয়ার ইচ্ছা না থাকলেও অসাবধানতা বশতঃ মনের অগোচরে তাঁকে গালি দিয়ে ফেলতে পারে।
পরিচ্ছেদ: কাযীউল কুযাত [মহা বিচারক] প্রভৃতি নামকরণ প্রসঙ্গে
সহীহ গ্রন্থে আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তাআলার কাছে ঐ ব্যক্তির নাম সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যার নামকরণ করা হয় ‘রাজাধিরাজ’ বা ‘প্রভূর প্রভূ’। আল্লাহ ব্যতীত কোনো প্রভূ নেই।”
সুফিয়ান সওরী বলেছেন, ‘রাজাধিরাজ’ কথাটি ‘শাহানশাহ’ এর মতই একটি নাম।
আরেকটি বর্ণনা মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং খারাপ ব্যক্তি হচ্ছে [যার নামকরণ করা হয় রাজাধিরাজ]।”
উল্লেখিত হাদীসে أخنع শব্দের অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: ‘রাজাধিরাজ’ নামকরণের প্রতি নিষেধাজ্ঞা
দুই: ‘রাজাধিরাজ’ এর অর্থ সুফিয়ান সওরী কর্তৃক বর্ণিত ‘শাহানশাহ’ এর অর্থের অনুরূপ।
তিন: বর্ণিত ব্যাপারে এবং এ জাতীয় বিষয়ে কঠোরতার বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করা, অথচ নিশ্চিত যে, অন্তর তার অর্থ উদ্দেশ্য নেয়নি।
চার: আরো বুঝা যে, এ জাতীয় সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর নামসমূহের সম্মান করা এবং তার কারণে নাম [শিরকীনাম] পরিবর্তন করা।
আবূ শুরাইহ হতে বর্ণিত আছে, এক সময় তার কুনিয়াত ছিল আবুল হাকাম [জ্ঞানের পিতা] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বিচারক এবং বিচার তার দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।”
তখন আবু শুরাইহ বললেন, ‘আমার কওমের লোকেরা যখন কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করে, তখন ফয়সালার জন্য আমার কাছে চলে আসে। তারপর আমি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেই। এতে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট হয়ে যায়।’
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, “এটা কতইনা ভাল! তোমার কি সন্তানাদি আছে?”
আমি বললাম, ‘শুরাইহ’ ‘মুসলিম’ এবং ‘আবদুল্লাহ’ নামের তিনটি ছেলে আছে।
’তিনি বললেন, ‘তাদের মধ্যে সবার বড় কে?’
আমি বললাম,‘শুরাইহ’
তিনি বললেন, ‘‘অতএব তুমি আবু শুরাইহ [শুরাইহের পিতা]” আবূ দাউদ ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর আসমা ও সিফাত অর্থাৎ নাম ও গুণাবলীর সম্মান করা; যদিও এর অর্থ বান্দার উদ্দেশ্য না হয়।
দুই: আল্লাহর নাম ও সিফাতের সম্মানার্থে ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করা।
তিন: কুনিয়াতের জন্য বড় সন্তানের নাম পছন্দ করা।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর যিকির, কুরআন এবং রাসূল সম্পর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে খেল- তামাশা করা প্রসঙ্গে
আল্লাহর বাণী: “আর আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করলে অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও খেলা-তামাশা করছিলাম।‘ বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহ্, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” [তাওবাহ: ৬৫]
ইবন ‘উমার, মুহাম্মদ ইবন কা’ব, যায়েদ ইবন আসলাম এবং কাতাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, [তাদের একের হাদীস অপরের হাদীসে প্রবেশ করেছে] তাবুক যুদ্ধে একজন লোক বললো, এ কারীদের [কুরআন পাঠকারীর] মত এত অধিক পেটুক, কথায় এত অধিক মিথ্যুক এবং যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাক্ষাতে এত অধিক ভীরু আর কোনো লোক দেখিনি। অর্থাৎ লোকটি তার কথা দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর ক্বারী সাহাবায়ে কেরামের দিকে ইঙ্গিত করেছিলো। আওফ ইবন মালেক লোকটিকে বললেন, ‘তুমি মিথ্যা কথা বলেছো। কারণ, তুমি মুনাফিক।’ আমি অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ খবর জানাবো।
আওফ তখন এ খবর জানানোর জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন কুরআন তাঁর চেয়েও আগে পৌঁছে গেছে।
এ ফাঁকে মুনাফিক লোকটি তার উটে চড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে আসলো।
তারপর সে বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, চলার পথে আমরা অন্যান্য পথচারীদের মত পরস্পরের হাসি, রং- তামাশা করছিলাম’ যাতে করে আমাদের পথ চলার কষ্ট লাঘব হয়। ইবন ‘উমার বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটের গদির রশির সাথে লেগে আমি যেন তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। আর পাথর তার পায়ে আঘাত করছিল, আর সে বলছিলো, ‘আমরা হাসি ঠাট্টা করছিলাম।’ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, قُلْ اَبِاللّٰهِ وَ اٰيٰتِهٖ وَ رَسُوْلِهٖ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِءُوْنَ۠ ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত [কুরআন] এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছিলে? তিনি তার দিকে [মুনাফিকের দিকে] দৃষ্টিও দেননি। আর তার অতিরিক্ত কোনো কথাও বলেননি।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একথা অনুধাবন করা যে, আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলের সাথে যারা ঠাট্টা বিদ্রুপ করে তারা কাফের।
দুই: এটিই হলো আয়াতের তাফসীর ঐ ব্যক্তির জন্য যে, এ ধরনের কাজ করে অর্থাৎ আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। সে যেই হোক না কেন।
তিন: চোগলখুরী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে নসীহতের মধ্যে পার্থক্য।
চার: যাকে আল্লাহ পছন্দ করেন তাকে ক্ষমা করা এবং আল্লাহর দুশমনদের ওপর কঠোরতা করার মধ্যকার পার্থক্য।
পাচঁ:এমন ওযরও রয়েছে যা গ্রহণ করা উচিৎ নয়।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর যদি দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর আমরা তাকে আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহের আস্বাদন দেই, তখন সে অবশ্যই বলে থাকে, 'এ আমার প্রাপ্য এবং আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর যদি আমাকে আমার রবের কাছে ফিরিয়ে নেয়াও হয়, তবুও তাঁর কাছে আমার জন্য কল্যাণই থাকবে।' অতএব, আমরা অবশ্যই কাফিরদেরকে তাদের আমল সম্বন্ধে অবহিত করব এবং তাদেরকে অবশ্যই আস্বাদন করাব কঠোর শাস্তি।” [আল-ফুস্সিলাত:৫০]
মুজাহিদ বলেন, (উক্ত কথার অর্থ হলো) ”ইহা আমার আমলের ফল এবং আমিই তার হকদার।”
’ইবনে আব্বাস বলেন, সে এ কথা বলতে চায়, ‘নেয়ামত আমার আমলের কারণেই’ এসেছে অর্থাৎ এর প্রকৃত হকদার আমিই।
এবং তার বাণী: “সে বলে, ‘নিশ্চয়ই এ নেয়ামত আমার ইলম ও জ্ঞানের জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে।’’ কাতাদাহ বলেন, ‘উপার্জনের রকমারী পন্থা সম্পর্কিত জ্ঞান থাকার কারণে আমি এ নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছি।’
অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার ইলম মোতাবেক আমি এর [নেয়ামতের] হকদার।
এটিই হলো মুজাহিদের কথা: “আমার মর্যাদার বদৌলতেই এ নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছি।” এর অর্থ।
আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, “বনী ইসরাইলের তিনজন লোক ছিল . যাদের একজন ছিল কুষ্ঠরোগী, আরেকজন টাক পড়া, অপরজন ছিল অন্ধ।
এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তখন তাদের কাছে তিনি ফিরিশতা পাঠালেন।
কুষ্ঠরোগীর কাছে ফিরিশতা এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী?
সে বললো, ‘সুন্দর চেহারা এবং সুন্দর ত্বক [শরীরের চামড়া]। আর যে রোগের কারণে মানুষ আমাকে ঘৃণা করে তা থেকে মুক্তি আমার কাম্য।
তিনি বলেন, তখন ফিরিশতা তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিলো। এতে তার রোগ দূর হয়ে গেলো তাকে সুন্দর রং আর সুন্দর ত্বক দেয়া হলো।
তারপর ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘তোমার প্রিয় সম্পদ কী?
সে বললো, ‘‘উট অথবা গরু’’। [ইসহাক অর্থাৎ হাদীস বর্ণনাকারী উট কিংবা গরু এ দু'য়ের মধ্যে সন্দেহ করছেন] তখন তাকে দশ মাসের গর্ভবতী উট দেয়া হলো।
ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করে বললো, ‘‘আল্লাহ এ সম্পদে তোমাকে বরকত দান করুন।’’
তারপর ফিরিশতা টাক পড়া লোকটির কাছে গিয়ে বললো,
‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী?
লোকটি বললো, ‘‘আমার প্রিয় জিনিস হচ্ছে সুন্দর চুল। আর লোকজন আমাকে যার জন্য ঘৃণা করে তা থেকে মুক্ত হতে চাই।’’
ফিরিশতা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এতে তার মাথার টাক দূর হয়ে গেলো। তাকে সুন্দর চুল দেয়া হলো।
তারপর ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘তোমার প্রিয় সম্পদ কী?
সে বললো, ‘‘উট অথবা গরু।’’ তখন তাকে গর্ভবতী গাভী দেয়া হলো।’’
ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করে বললো, ‘‘আল্লাহ এ সম্পদে তোমাকে বরকত দান করুন।’’
“তারপর ফিরিশতা অন্ধ লোকটির কাছে আসলো।”
‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী?
লোকটি বললো, ‘‘আল্লাহ যেন আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। যার ফলে আমি লোকজনকে দেখতে পাবো, এটাই আমার প্রিয় জিনিস।’’ ফিরিশতা তখন তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলো। এতে লোকটির দৃষ্টিশক্তি আল্লাহ তা‘আলা ফিরেয়ে দিলেন।
তারপর ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘তোমার প্রিয় সম্পদ কী?
সে বললো, ‘‘ছাগল আমার বেশী প্রিয়।’’
তখন তাকে একটি গর্ভবতী ছাগল দেয়া হলো। তারপর ছাগল বংশ বৃদ্ধি করতে লাগলো। এমনিভাবে উট ও গরু বংশ বৃদ্ধি করতে লাগলো।
অবশেষে অবস্থা এই দাঁড়ালো যে, একজনের উটে মাঠ ভরে গেলো, আরেকজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেলো এবং আরেকজনের ছাগলে মাঠ ভর্তি হয়ে গেলো।
তিনি বলেন, অতঃপর একদিন ফিরিশতা তার স্বীয় বিশেষ আকৃতিতে কুষ্ঠরোগীর কাছে উপস্থিত হয়ে বললো, ‘‘আমি একজন মিসকিন।’’ আমার সফরের সম্বল শেষ হয়ে গেছে [আমি খুবই বিপদগ্রস্ত] আমার গন্তব্যে পৌছার জন্য প্রথমে আল্লাহর তারপর আপনার সাহায্য দরকার।
যে আল্লাহ আপনাকে এত সুন্দর রং এবং সুন্দর ত্বক এবং সম্পদ দান করেছেন, তাঁর নামে আমি আপনার কাছে একটা উট সাহায্য চাই, যাতে আমি নিজ গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পারি।
তখন লোকটি বললো, ‘দেখুন, আমার অনেক দায়-দায়িত্ব ও হক আছে।
ফিরিশতা বললো, ‘আমার মনে হয়, আমি আপনাকে চিনি।’ আপনি কি মানুষের ঘৃণার পাত্র কুষ্ঠরোগী ছিলেন না? এবং গরীব ছিলেন না, তারপর আল্লাহ আপনাকে এ সম্পদ দান করেছেন?
তখন লোকটি বললো, ‘এ সম্পদ আমার পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।’
ফিরিশতা তখন বললো, ‘‘তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ যেন তোমাকে পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে দেন।’
তিনি বলেন, তারপর ফিরিশতা স্বীয় বেশে ভুষায় মাথায় টাক- পড়া লোকটির কাছে গেল।
অতপর ইতিপূর্বে কুষ্ঠরোগীর সাথে যে ধরনের কথা বলেছিলো, তার [টাক পড়া লোকটির] সাথেও সে ধরনের কথা বললো। প্রতি উত্তরে কুষ্ঠরোগী যে ধরনের জবাব দিযেছিলে, এ লোকটিও সেই একই ধরনের জবাব দিলো।
ফিরিশতা তখন বললো, ‘‘তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ যেন তোমাকে পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে দেন।’
তিনি বলেন, আরেক দিন ফিরিশতা তার স্বীয় বিশেষ আকৃতিতে অন্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে বললো, ‘‘আমি একজন মিসকিন।’’ আমার সফরের সম্বল শেষ হয়ে গেছে [আমি খুবই বিপদগ্রস্ত] আমার গন্তব্যে পৌছার জন্য প্রথমে আল্লাহর তারপর আপনার সাহায্য দরকার।
যিনি আপনার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁর নামে একটি ‘ছাগল’ আপনার কাছে সাহায্য চাই, যাতে আমার সফরে নিজ গন্তব্যস্থানে পৌছতে পারি।
তখন লোকটি বললো, ‘আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ তাআলা আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার যা খুশি নিয়ে যান, আর যা খুশি রেখে যান। আল্লাহর কসম, আল্লাহর নামে আপনি আজ যা নিয়ে যাবেন, তার বিন্দুমাত্র আমি বাধা দেব না।’
তখন ফিরিশতা বললো, ‘আপনার মাল আপনি রাখুন। আপনাদেরকে শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হলো। আপনার আচরণে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন, আপনার সঙ্গীদ্বয়ের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’’ (৪) (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: উল্লিখিত আয়াতের তাফসীর
দুই: (তারা অবশ্যই বলবে এটি আমার) এ কথার অর্থ কী।
তিন: তার কথা {اِنَّمَاۤ اُوْتِيْتُهٗ عَلٰى عِلْمٍ عِنْدِيْ} “সে বলে, ‘নিশ্চয়ই এ নেয়ামত আমার ইলম ও জ্ঞানের জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে” এর অর্থ কী।
চার: এই মহান কিসসার ভেতর আশ্চর্য ধরনের উপদেশাবলী নিহিত রয়েছে।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “অতঃপর তিনি (আল্লাহ) যখন তাদেরকে এক পূর্ণাঙ্গ সুসন্তান দান করেন, তখন তারা তাদেরকে তিনি যা দিয়েছেন সেটাতে আল্লাহর বহু শরীক নির্ধারণ করে; বস্তুত তারা যাদেরকে (তাঁর সাথে) শরীক করে আল্লাহ্ তার চেয়ে অনেক উর্ধ্বে।” [আল-আরাফ: ১৯০]
ইবন হাযম বলেন, ঊলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এমন প্রত্যেক নামই হারাম, যা দ্বারা গাইরুল্লাহর ইবাদত করার অর্থ বুঝায়। যেমন, আবদু ‘আমর, আবদুল কা’বা এবং এ জাতীয় অন্যান্য নাম। তবে আবদুল মোত্তালিব এর ব্যতিক্রম।
ইবন আব্বাস এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আদম যখন বিবি হাওয়ার সাথে মিলিত হলেন, তখন হাওয়া গর্ভবতী হলেন। এমতাবস্থায় শয়তান আদম ও হাওয়ার কাছে এসে বললো, ‘আমি তোমাদের সেই বন্ধু ও সাথী, যে নাকী তোমাদের জান্নাত থেকে বের করেছে। তোমরা অবশ্যই আমার আনুগত্য করো, নতুবা গর্ভস্থ সন্তানের মাথায় উটের শিং গজিয়ে দিবো, তখন সন্তান তোমার পেট কেটে বের করতে হবে।
আমি অবশ্যই করবো, আমি অবশ্যই করবো। শয়তান এভাবে তাদেরকে ভয় দেখাচ্ছিল।
শয়তান বললো, তোমরা তোমাদের সন্তানের নাম ‘আব্দুল হারিছ’ রেখো।
তখন তাঁরা শয়তানের আনুগত্য করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর তাদের একটি মৃত সন্তান ভূমিষ্ট হলো।
আবারো বিবি হাওয়া গর্ভবতী হলেন। শয়তানও পুনরায় তাঁদের কাছে এসে পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। তখন তাঁরা শয়তানের আনুগত্য করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর তাদের একটি মৃত সন্তান ভূমিষ্ট হলো।
এর ফলে তাঁদের অন্তরে সন্তানের প্রতি ভালবাসা তীব্র হয়ে দেখা দিলো। তখন তাঁরা সন্তানের নাম ‘আবদুল হারিস’ রাখলেন।
এটাই হচ্ছে فَلَمَّاۤ اٰتٰىهُمَا صَالِحًا جَعَلَا لَهٗ شُرَكَآءَ তারা উভয়ে আল্লাহ তাদেরকে যা দিযেছেন তাতে তার বহু শরীক সাব্যস্ত করল। এটি ইবন আবী হাতিম বর্ণনা করেছেন।
কাতাদাহ থেকে সহীহ সনদে অপর একটি হাদীসে বর্নিত আছে, তিনি বলেন, তাঁরা আল্লাহর সাথে শরীক করেছিলেন আনুগত্যের ক্ষেত্রে, ইবাদতের ক্ষেত্রে নয়।’
মুজাহিদ থেকে সহীহ সনদে لَىِٕنْ اٰتَيْتَنَا صَالِحًا এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্নিত আছে, তিনি বলেন, সন্তানটি মানুষ না হওয়ার আশংকা তাঁরা [পিতা-মাতা] করেছিলেন।
হাসান ও সাঈদ প্রমুখের কাছ থেকে এর অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: যেসব নামের মধ্যে গাইরুল্লাহর ইবাদতের অর্থ নিহিত রয়েছে সে নাম রাখা হারাম।
দুই: উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর।
তিন: আলোচিত অধ্যায়ে বর্ণিত শিরক হচ্ছে শুধুমাত্র নাম রাখার জন্য। এর দ্বারা তার হাকীকত [অর্থাৎ শিরক করা] উদ্দেশ্য ছিল না।
চার: আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নিখূঁত ও পূর্ণাঙ্গ কন্যা সন্তান লাভ করা একজন মানুষের জন্য নেয়ামতের বিষয়।
পাঁচ: আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে শিরক এবং ইবাদতের মধ্যে শিরকের ব্যাপারে সালাফে-সালেহীন পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী: “আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। অতএব তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক; আর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন কর।” [আল আরাফ: ১৮০]
ইবনু আবি হাতিম ইবন আববাস থেকে বর্ণনা করেছেন, يُلْحِدُوْنَ فِيْۤ اَسْمَآىِٕهٖ [তারা তাঁর নামগুলো বিকৃত করে] এর অর্থ হচ্ছে তারা শিরক করে।
ইবন আববাস থেকে আরো বর্ণিত আছে, মুশরিকরা ‘ইলাহ’ থেকে ‘লাত’ আর ‘আজীজ’ থেকে ‘উযযা’ নামকরণ করছে।
আ’মাশ থেকে বর্ণিত আছে, মুশরিকরা আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে এমন কিছু [শিরকী বিষয়] প্রবেশ করিয়েছে, যার অস্তিত্ব আদৌ তাতে নেই।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর নামসমূহ সাব্যস্ত করা।
দুই: আল্লাহর নামসমূহ সবচাইতে সুন্দর হওয়া।
তিন: আল্লাহকে সুন্দর ও পবিত্র নামসমূহের দ্বারা ডাকার নির্দেশ।
চার: যেসব মূর্খ ও নাস্তিক লোকেরা আল্লাহর পবিত্র নামের বিরুদ্ধাচারণ করে তাদেরকে পরিহার করে চলা।
পাঁচ: আল্লাহর নামে বিকৃতি ঘটানোর ব্যাখ্যা।
ছয়: যে বিকৃতি করে তার প্রতি হুমকি।
পরিচ্ছেদ: ‘আল্লাহর উপর শান্তি বর্ষিত হোক’ বলা যাবে না।
সহীহ হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, যখন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সালাতে থাকতাম তখন আমরা বললাম, السلام على الله قبل عباده، السلام على فلان وفلان ‘আল্লাহর উপর তাঁর বান্দাদের পক্ষ থেকে শান্তি বর্ষিত হোক, অমুক অমুকের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’’ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, لا تقولوا: السلام على الله؛ فإن الله هو السلام ‘‘আল্লাহর উপর শান্তি বর্ষিত হোক, এমন কথা তোমরা বলো না। কেননা আল্লাহ নিজেই ‘সালাম’ [শান্তি]’’
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: ‘সালাম’ এর ব্যাখ্যা।
২য়: ‘সালাম’ হচ্ছে সম্মানজনক সম্ভাষণ।
তিন: এ [‘সালাম’] সম্ভাষণ আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়।
চার: আল্লাহর জন্য ‘সালাম’ প্রযোজ্য না হওয়ার কারণ।
পাঁচ: বান্দাদেরকে এমন সম্ভাষণ শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহর জন্য সমীচীন ও শোভনীয়।
পরিচ্ছেদ: হে আল্লাহ! তোমার মর্জি হলে আমাকে মাফ করো’ প্রসঙ্গে।
সহীহ গ্রন্থে আবু হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ বলবে না: হে আল্লাহ যদি তুমি চাও আমাকে ক্ষমা কর। হে আল্লাহ যদি তুমি চাও আমাকে রহম কর। বরং তার উচিৎ নিশ্চিতভাবেই প্রার্থনা করা। কারণ, আল্লাহকে বাধ্যকারী কেউ নেই।
মুসলিমে রয়েছে, ‘‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার বিষয়ে উৎসাহ বৃদ্ধি করা উচিৎ। কেননা আল্লাহ বান্দাকে যাই দান করেন না কেন তার কোনটাই তাঁর কাছে বড় কিংবা কঠিন কিছুই নয়।’’
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: দোয়ার মধ্যে ইসস্তিছনা (যদি চান দ্বারা দোয়া) করা নিষেধ।
দুই: দোয়ার মধ্যে ইসস্তিছনা করা নিষেধ এর কারণ বর্ণনা করা।
তিন: তার বাণী: প্রার্থিত বিষয়টি দৃঢ়ভাবে চাওয়া।
চার: আগ্রহকে বড় করা।
পাঁচ: এ বিষয়টির কারণ বর্ণনা করা।
পরিচ্ছেদ: আমার দাস- দাসী বলা নিষিদ্ধ।
সহীহ গ্রন্থে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন না বলে, ‘তোমার প্রভুকে খাইয়ে দাও’ ‘তোমার প্রভুকে অজু করাও’। বরং সে যেন বলে, ‘আমার নেতা’ ‘আমার মনিব’। তোমাদের কেউ যেন না বলে ‘আমার দাস’ ‘আমার দাসী’। বরং সে যেন বলে, ‘আমার যুবক, আমার যুবতী, আমার চাকর।’’
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আমার দাস- দাসী বলা নিষিদ্ধ।
দুই: কোনো গোলাম তার মনিবকে ‘আমার প্রভু’ বলবে না। আবার তাকে এরূপ বলা যাবে না, ‘তোমার রবকে আহার করাও’।
তিন: প্রথম ব্যক্তিকে এরূপ বলতে শিখানো যে, ‘আমার যুবক’ ‘আমার যুবতী’ ও ‘আমার চাকর’।
চার: দ্বিতীয় ব্যক্তিকে এরূপ বলতে শিখানো যে, ‘আমার নেতা,’ ‘আমার মনিব’।
পাঁচ: লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি শতর্কতা অবলম্বন। আর তা হচ্ছে, শব্দ ব্যবহার ও প্রয়োগের মধ্যেও তাওহীদ বাস্তবায়ন করা।
অনুচ্ছেদ: যে আল্লাহর নামে চাইবে তাকে ফেরত দেওয়া যাবে না।
ইবন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাকে আশ্রয় দাও। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে চায় তাকে দান করো। যে ব্যক্তি তোমাদেরকে দাওয়াত করে, তার ডাকে সাড়া দাও। যে ব্যক্তি তোমাদের জন্য ভাল কাজ করে, তার যথোপযুক্ত প্রতিদান দাও। তার প্রতিদানের জন্য যদি তোমরা কিছুই না পাও, তাহলে তার জন্য এমন দোয়া করো, যার ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তোমরা তার প্রতিদান দিতে পেরেছো।’’ এটি আবূদাউদ ও নাসাঈ সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর ওয়াস্তে আশ্রয় প্রার্থনাকারীকে আশ্রয় দান।
দুই: আল্লাহর ওয়াস্তে সাহায্য প্রার্থনাকারীকে সাহায্য প্রদান করা।
তিন: দাওয়াতে সাড়া দেয়া।
চার: ভাল কাজের প্রতিদান দেয়া।
পাঁচ: ভালো কাজের প্রতিদানে অক্ষম হলে উপকার সাধনকারীর জন্য দোয়া করা।
ছয়: তার বাণী: “যাতে মনে হয়, তোমরা তার যথোপযুক্ত প্রতিদান দিয়েছো।
‘বি ওয়াজহিল্লাহ’ বলে একমাত্র জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই প্রার্থনা করা যায় না।
জাবের থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘বি ওয়াজহিল্লাহ’ বলে একমাত্র জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই প্রার্থনা করা যায় না। এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ জান্নাত ব্যতীত ‘বিওয়াজহিল্লাহ’’ দ্বারা অন্য কিছু চাওয়া যায় না।
দুই: ‘চেহারা’ এর সিফাত সাব্যস্ত করা।
পরিচ্ছেদ: ‘যদি’ ব্যবহার প্রসঙ্গে।
আর আল্লাহর বাণী: ‘তারা বলে, ‘যদি’ এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কিছু থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’’ [আলু ইমরান: ১৫৪]
এবং আল্লাহর বাণী: “যারা ঘরে বসে থেকে [যুদ্ধেরত] তাদের ভাইদেরকে বলে, আমাদের কথা মতো যদি তারা চলতো। তবে তারা নিহত হতো না।” [আলু ইমরান: ১৬৮]
সহীহ গ্রন্থে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাকে যা উপকার করবে, তার প্রতি তুমি আগ্রহী হও এবং আল্লাহর সাহায্য গ্রহণ কর, তবে অক্ষম হয়ো না। আর যদি কোনো বিপদ তোমাকে স্পর্শ করে, বলো না: আমি যদি এরূপ করতাম, তাহলে এরূপ ও এরূপ হতো। তবে বলো: আল্লাহই নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন করেছেন। কারণ, «لو» শব্দটি শয়তানের আমলকে উন্মুক্ত করে দেয়।”
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সূরা আলে- ইমরানের ১৫৪ ও ১৬৮ নং আয়াতের উল্লিখিত অংশের তাফসীর।
দুই: কোনো বিপদাপদ হলে ‘যদি’ প্রয়োগ করে কথা বলার উপর সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা।
তিন: বিষয়টির কারণ দর্শানো যে, ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কাজের সুযোগ তৈরী দেয়।
চার: উত্তম কথার দিক-নির্দেশনা প্রদান করা।
পাঁচ: উপকারী ও কল্যাণজনক বিষয়ে আগ্রহী হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করা।
ছয়: এর বিপরীত অর্থাৎ ভালো কাজে অপারগতা ও অক্ষমতা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা।
অনুচ্ছেদ: বাতাসকে গালি দেয়া নিষেধ।
উবাই ইবন কাআব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা বাতাসকে গালি দিয়ো না, যখন তোমরা অপছন্দ কিছু দেখ, তখন বলো: হে আল্লাহ, তোমার নিকট এই বাতাস ও তার ভেতরে থাকা কল্যাণ এবং তাকে যে নির্দেশ করা হয়েছে, তার কল্যাণ প্রার্থনা করি আর তোমার নিকট এই বাতাস ও তার ভেতরে থাকা অনিষ্ট এবং তাকে যে নির্দেশ করা হয়েছে, তার অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই।” হাদীসটিকে তিরমিযী সহীহ বলেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: বাতাসকে গালি দেয়া নিষেধ।
দুই: মানুষ যখন অপছন্দনীয় কোনো জিনিস দেখবে তখন উপকারী কথার দিকে নির্দেশনা প্রদান করবে।
তিন: বাতাস আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট, একথার দিক নির্দেশনা প্রদান করা।
চার: বাতাস কখনো কল্যাণ সাধনের জন্য আবার কখনো অকল্যাণ করার জন্য আদিষ্ট হয়।
অনুচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: একদল জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, ‘আমাদের কি কোন কিছু করার আছে?’ বলুন, ‘সব বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে’। যা তারা আপনার কাছে প্রকাশ করে না, তারা তাদের অন্তরে সেগুলো গোপন রাখে। তারা বলে, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’ [২]। বলুন, ‘যদি তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করতে তবুও নিহত হওয়া যাদের জন্য অবধারিত ছিল তারা নিজেদের মৃত্যুস্থানে বের হত। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশোধণ করেন। আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবগত।” [আলু ইমরান: ১৫৪]
এবং আল্লাহর বাণী: “আর যাতে তিনি মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী, মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারী যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে শাস্তি দেন। অমঙ্গল চক্ৰ তাদের উপরই আপতিত হয়। আর আল্লাহ তাদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে লা’নত করেছেন; আর তাদের জন্য জাহান্নাম প্ৰস্তুত রেখেছেন। আর সেটা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল !” [আল-ফাতহ: ৬]
প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়্যিম বলেছেন, ظن এর ব্যাখ্যা এটাই করা হয়েছে যে, মুনাফিকদের ধারণা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে সাহায্য করবেন না। তাঁর বিষয়টি অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যে সব বিপদাপদ এসেছে তা আদৌ আল্লাহর ফয়সালা, তাকদীর এবং হিকমত মোতাবেক ছিল না। ফলে ধারনাকে আল্লাহর হিকমত, তাকদীর, রাসূলের বিষয়টি পূর্ণ করা এবং তিনি তার দীনকে সকল দীনের ওপর বিজয় করবেন প্রভৃতি বিষয়কে অস্বীকার করার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে সেই খারাপ ধারণা যা সূরা ‘ফাতহে’ উল্লিখিত মুনাফিক ও মুশরিকরা পোষণ করতো। এ ধারণা খারাপ হওয়ার কারণ এটাই যে, আল্লাহ তাআলার সুমহান মর্যাদার জন্য ইহা শোভনীয় ছিল না। তাঁর হিকমত প্রশংসা এবং সত্য ওয়াদার জন্যও উক্ত ধারণা ছিল বেমানান, অসৌজন্যমুলক।
যে ব্যক্তি মনে করে যে, আল্লাহ তাআলা বাতিলকে হকের উপর এতটুকু বিজয় দান করেন, যাতে হক অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, অথবা যে ব্যক্তি আল্লাহর ফয়সালা, তাকদীরের নিয়মকে অস্বীকার করে, অথবা তাকদীর যে আল্লাহর মহা কৌশল এবং প্রশংসার দাবীদার এ কথা অস্বীকার করে, সাথে সাথে এ দাবীও করে যে, এসব আল্লাহ তাআলার নিছক অর্থহীন ইচ্ছামাত্র; তার এ ধারণা কাফেরদের ধারণা বৈ কিছু নয়। তাই জাহান্নামের কঠিন শাস্তি এ সব কাফেরদের জন্যই নির্ধারিত রয়েছে। অধিকাংশ লোকই নিজেদের [সাথে সংশ্লিষ্ট] বিষয়ে এবং অন্যান্য লোকদের বেলায় আল্লাহ তাআলার ফয়সালার ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আসমা ও সিফাত [নাম ও গুণাবলী] এবং তাঁর হিকমত ও প্রশংসা সম্পর্কে অবগত রয়েছে, কেবলমাত্র সেই আল্লাহর প্রতি এ খারাপ ধারণা থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
যে ব্যক্তি প্রজ্ঞা সম্পন্ন, বুদ্ধিমান এবং নিজের জন্য কল্যাণকামী, তার উচিৎ এ আলোচনা দ্বারা বিষয়টির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করা। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি স্বীয় রব সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে, তার উচিৎ নিজ বদ-ধারণার জন্য আল্লাহর নিকট তওবা করা।
আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণকারী কোন ব্যক্তিকে যদি তুমি পরীক্ষা করো, তাহলে দেখতে পাবে তার মধ্যে রয়েছে তাকদীরের প্রতি হিংসাত্মক বিরোধিতা এবং দোষারোপ করার মানসিকতা। তারা বলে, বিষয়টি এমন হওয়া উচিৎ ছিলো। এ ব্যাপারে কেউ বেশী, কেউ কম বলে থাকে তুমি তোমার নিজেকে পরীক্ষা করে দেখো, তুমি কি এ খারাপ ধারণা থেকে মুক্ত?
মুক্ত যদি থাকো তুমি এ খারাবী থেকে, বেঁচে গেলে তুমি এক মহাবিপদ থেকে। আর যদি নাহি পারো ত্যাগিতে এ রীতি, বাঁচার তরে তোমার লাগি নাইকো কোন গতি।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাস’আলা রয়েছে:
এক: সূরা আলু ইমরানের আয়াতের তাফসীর।
দুই: সূরা ফাতহের আয়াতের তা্ফসীর
তিন: জানানো যে, আলোচিত বিষয়ের অনেক প্রকার রয়েছে, যা গণনার বাইরে।
চার: যে ব্যক্তি আল্লাহর আসমা ও সিফাত, [নাম ও গুণাবলী] এবং নিজের সত্ত্বা সম্পর্কে অবহিত রয়েছে, কেবলমাত্র সেই আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা পোষণ করা থেকে বাঁচতে পারে।
পরিচ্ছেদ: তাকদীর অস্বীকারকারীদের পরিণতি
‘ইবন ওমর বলেছেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে ইবন ওমরের জীবন, তাদের (তাকদীর অস্বীকারীদের) কারো কাছে যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও থাকে, অতঃপর তা আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা উক্ত দান কবুল করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাকদীরের প্রতি ঈমান আনে’’। অতঃপর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী দ্বারা নিজ বক্তব্যের পক্ষে দলীল পেশ করেন, ঈমান হলো, “তুমি আল্লাহর প্রতি, তাঁর মালায়েকা, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, আখেরাত দিবস ও তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান আনবে।” মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
উবাদাহ ইবন সামেত থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তার ছেলেকে বললেন, ‘‘হে বৎস, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি এ কথা বিশ্বাস করবে, ‘তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। আর তোমার জীবনে যা ঘটেনি তা কোনদিন তোমার জীবনে ঘটার ছিলোনা।’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি এ কথা বলতে শুনেছি, ‘‘সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করেন তা হচ্ছে ‘কলম’। সৃষ্টির পরই তিনি কলমকে বললেন, ‘‘লিখ’’। কলম বললো, ‘হে আমার রব, ‘আমি কী লিখবো?’
তিনি বললেন, ‘কেয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সব জিনিসের তাকদীর লিপিবদ্ধ করো।’’
হে বৎস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, ‘‘যে ব্যক্তি [তাকদীরের উপর] বিশ্বাস ব্যতীত মৃত্যু বরণ করলো, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।’’
আহমাদের অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘‘আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি করলেন তা হচ্ছে ‘কলম’। এরপরই তিনি কলমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘লিখ’। কেয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে, সে মুহুর্তে কলম তা লিখে ফেলল।
ইবনু ওয়াহাবের একটি বর্ণনা মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি তাকদীর এবং তাকদীরের ভাল- মন্দ বিশ্বাস করে না, তাকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবেন।’’
ইবনুদ্দাইলামী থেকে মুসনাদ ও সুনান গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ‘আমি উবাই ইবনে কা’ব এর কাছে আসলাম। তারপর বললাম, ‘তাকদীরের ব্যাপারে আমার মনে কিছু কথা আছে। আপনি আমাকে তাকদীর সম্পর্কে কিছু উপদেশমূলক কথা বলুন। এর ফলে হয়তো আল্লাহ তাআলা আমার অন্তর থেকে উক্ত জমাট বাধা কাদা দূর করে দিবেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যদি উহুদ [পাহাড়] পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় দান করো, আল্লাহ তোমার এ দান ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না তুমি তাকদীরকে বিশ্বাস করবে। আর এ কথা জেনে রাখো, তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটতে কখনো ব্যতিক্রম হতো না। আর তোমার জীবনে যা ঘটেনি তা কখনো তোমাকে স্পর্শ করত না। আর যদি এ বিশ্বাস পোষণ না করে মৃত্যু বরণ করো, তা হলে অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।
তিনি বলেন, অতঃপর আমি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এবং যায়েদ বিন ছাবিত এর নিকট গেলাম। তাঁদের প্রত্যেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এরকম হাদীসই বর্ণনা করেছেন।’’ এটি সহীহ হাদীস- হাকেম স্বীয় সহীহ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা ফরয সম্পর্কিত বর্ণনা।
দুই: তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার ধরন সম্পর্কে বর্ণনা।
তিন: তাকদীরের প্রতি যার ঈমান নেই তার আমল বাতিল।
চার: জানানো যে, যে ব্যক্তি তাকদীরের প্রতি ঈমান আনেনা সে ঈমানের স্বাদ অনুধাবন করবে না।
পাঁচ: সর্বাগ্রে যা সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখ।
ছয়: কেয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে, ওই সময় তা লিখা হয়ে গেছে।
সাত: যে ব্যক্তি তাকদীর বিশ্বাস করে না তার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দায়িত্বমুক্ত।
আট: সালাফে সালেহীনের রীতি ছিল, কোনো বিষয়ের সংশয় নিরসনের জন্য জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনকে প্রশ্ন করা।
নয়: ঊলামায়ে কেরাম এমন ভাবে প্রশ্ন কারীকে জবাব দিতেন যা দ্বারা সন্দেহ দূর হয়ে যেতো। জবাবের নিয়ম এই যে, তাঁরা কথাকে শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর [কথা ও কাজের] দিকে সম্পৃক্ত করতেন।
পরিচ্ছেদ: ছবি অঙ্কনকারী ও চিত্র শিল্পীদের পরিণাম
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে চায়। তাদের শক্তি থাকলে তারা একটা অনু সৃষ্টি করুক অথবা একটি খাদ্যের দানা সৃষ্টি করুক অথবা একটি গমের দানা তৈরী করুক।’’ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
বুখারী ও মুসলিম ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরো বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কেয়ামতের দিন সবচেয়ে শাস্তি পাবে তারাই যারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মতো ছবি ও চিত্র অঙ্কন করে।’’
বুখারী ও মুসলিমে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘প্রত্যেক চিত্র অঙ্কনকারীই জাহান্নামী। চিত্রকর যতটি [প্রাণীর] চিত্র এঁকেছে ততটি প্রাণ তাকে দেয়া হবে। এর মাধ্যমে তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে।’’
বুখারী ও মুসলিমে তার থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত, ‘‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো [প্রাণীর] চিত্র অঙ্কন করবে, কিয়ামতের দিন তাকে ঐ চিত্রে আত্মা দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। অথচ সে আত্মা দিতে সক্ষম হবে না।’’
সহীহ মুসলিমে আবুল হাইয়াজ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আলী আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে সে বিষয়ে প্রেরণ করবো যে বিষয়ে আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরণ করেছেন? তুমি কোন মূর্তি দেখলে তাকে ধুলিষ্যাৎ না করে ছাড়বে না এবং কোনো উঁচু কবর দেখলে তাকে মাটির সাথে সমান না করে ছাড়বে না।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: চিত্রকরদের ব্যাপারে ব্যাপক কঠোরতা অবলম্বন।
দুই: কঠোরতা অবলম্বনের কারণ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া। আর তা হচ্ছে, আল্লাহর সাথে আদব রক্ষা না করা। এর প্রমাণ আল্লাহ বাণী: (ومن أظلم ممن ذهب يخلق كخلقي)
তিন: সৃষ্টি করার ব্যাপারে আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও এ ব্যাপারে বান্দার অক্ষমতা সম্বন্ধে সতর্কীকরণ। তাই আল্লাহ চিত্রকরদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলে তারা যেন একটা অনু অথবা একটা শস্য দানা কিংবা একটা গম তৈরী করে।’
চার: স্পষ্ট ঘোষণা যে, তারা (চিত্রকররা) সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রাপ্ত হবে।
পাঁচ: চিত্রকর যতটা [প্রাণীর] ছবি আকবে, শাস্তি ভোগ করার জন্য ততটা প্রাণ তাকে দেয়া হবে। এবং তার দ্বারাই জাহান্নামে তাঁকে শাস্তি দেয়া হবে।
ছয়: অঙ্কিত ছবিতে রূহ বা আত্মা দেয়ার জন্য চিত্রকরকে বাধ্য করা হবে।
সাত: [প্রাণীর] ছবি পাওয়া গেলেই তা ধ্বংস করার নির্দেশ।
পরিচ্ছেদ: অধিক কসম সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
আর আল্লাহর বাণী: ‘তোমাদের শপথসমূহকে তোমরা হেফাজত করো’। [আল-মায়েদা: ৮৯]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘[অধিক] শপথ, সম্পদ বিনষ্টকারী এবং উপার্জন ধ্বংসকারী।’ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
সালমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিন শ্রেণির লোকদের সাথে আল্লাহ তা‘আলা [কিয়ামতের দিন] কথা বলবেন না, তাদেরকে [গুনাহ মাফের মাধ্যমে] পবিত্র করবেন না, বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তারা হচ্ছে, বৃদ্ধ জিনাকারী, অহংকারী গরীব, আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে তার ব্যবসায়ী পণ্য বানিয়েছে অর্থাৎ কসম করা ব্যতীত সে পণ্য ক্রয় করে না, কসম করা ব্যতীত পণ্য বিক্রয়ও করে না।” এটি তাবরানী সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।
সহীহ গ্রন্থে ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে আমার যুগ, তারপর উত্তম হচ্ছে তাদের পরবর্তীতে যারা আসবে তারা। তারপর উত্তম হচ্ছে তাদের পরবর্তীতে যারা আসবে তারা।” ইমরান বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরে দু’যুগের কথা বলেছেন নাকি তিন যুগের কথা বলেছেন তা আমি বলতে পারছিনা। অতঃপর তিনি বলেন, ‘তোমাদের পরে এমন কওম আসবে যারা সাক্ষ্য দিবে, অথচ তাদের থেকে সাক্ষ্য তলব করা হবে না। তারা খিয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবে না। তারা মান্নত করবে, কিন্তু তা পূর্ণ করবে না। আর তাদের শরীরে চর্বি দেখা দিবে।’’
ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার যুগের মানুষ। এরপর উত্তম হলো এর পরবর্তীতে আগমনকারী লোকেরা। তারপর উত্তম হলো যারা তাদের পরবর্তীতে আসবে তারা। অতঃপর এমন এক জাতির আগমন ঘটবে যাদের কারো সাক্ষ্য কসমের আগেই হয়ে যাবে, আবার কসম সাক্ষ্যের আগেই হয়ে যাবে।’’
ইবরাহীম নাখ‘ঈ বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন সাক্ষ্যের ওপর ও অঙ্গীকারের ওপর আমাদের অভিভাবকগণ শাস্তি দিতেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: কসম রক্ষা করার জন্য উপদেশ দান।
দুই: কসম বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষতি টেনে আনে, কামাই রোজগারের বরকত নষ্ট করে।
তিন: যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম ছাড়া ক্রয় বিক্রয় করেনা তার প্রতি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ।
চার: সতর্ক করা যে, পাপের দিকে আহ্বানকারী উপকরণ কম বা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও পাপ সংঘটিত হলে পাপটি কঠিন হয়।
পাঁচ: কসম না তলব করা সত্ত্বেও কসমকারীদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন।
ছয়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তিন অথবা চার যুগ বা কালের লোকদের প্রশংসা জ্ঞাপন এবং তাদের পরবর্তীতে যা ঘটবে তার উল্লেখ।
সাত: সাক্ষ্য না তলব করা সত্ত্বেও সাক্ষীদাতাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন।
আট: সাক্ষ্য ও ওয়াদার জন্য সালাফে সালেহীন কর্তৃক ছোটদেরকে শাস্তি প্রদান।
পরিচ্চেদ: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জিম্মাদারী সম্পর্কিত বিবরণ
আল্লাহর বাণী: “আর তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর এবং তোমরা আল্লাহ্কে তোমাদের জামিন করে শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ জানেন যা তোমরা কর।” [আন-নাহাল: ৯১]
বুরাইদাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছোট বা বড় [কোন যুদ্ধে] যখন সেনাবাহিনীতে কাউকে আমীর বা সেনাপতি নিযুক্ত করতেন, তখন তাকে তার বিশেষ ব্যক্তিবর্গ ও যেসব মুসলিম তার সঙ্গে রয়েছে তাদের বিষয়ে আল্লাহর ‘তাকওয়ার’ উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন, “তোমরা আল্লাহর নামে যুদ্ধ করো। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করো। তোমরা যুদ্ধ করো, কিন্তু খিয়ানত করোনা, বিশ্বাস ঘাতকতা করোনা। তোমরা শত্রুর নাক-কান কেটোনা বা অঙ্গ বিকৃত করোনা, বাচ্চাদের হত্যা করো না। তুমি যখন তোমার মুশরিক শত্রুদের মোকাবেলা করবে, তখন তিনিটি বিষয়ের দিকে তাদেরকে আহবান জানাবে। যে কোন একটি বিষয়ে তারা তোমার আহবানে সাড়া দিলে তা গ্রহণ করে নিও, আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করে দিও। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করো। যদি তারা তোমার আহবানে সাড়া দেয়, তাহলে তাদেরকে গ্রহণ করে নিও। এরপর তাদেরকে তাদের বাড়ী-ঘর ছেড়ে দারুল মুহাজিরীনে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য (হিজরত করার জন্য) আহবান জানাও। হিজরত করলে তাদেরকে একথা জানিয়ে দাও, ‘মুহাজিরদের জন্য যে অধিকার রয়েছে, তাদেরও সে অধিকার আছে, সাথে সাথে মোহাজিরদের যা করণীয় তাদেরও তাই করণীয়। আর যদি তারা হিজরতের মাধ্যমে স্থান পরিবর্তন করতে অস্বীকার করে, তাহলে তাদেরকে বলে দিও যে, তারা গ্রাম্য সাধারণ মুসলিম বেদুঈনদের মর্যাদা পাবে। তাদের উপর আল্লাহর হুকুম আহকাম [বিধি- নিষেধ] জারি হবে। তবে ‘গনিমত’ বা যুদ্ধ-লব্ধ অতিরিক্ত সম্পদের ভাগ তারা মুসলমানদের সাথে জিহাদে অংশ গ্রহণ ব্যতীত পাবে না। এটাও যদি তারা অস্বীকার করে তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, ‘তারা কর দিতে সম্মত কিনা। যদি কর দিতে সম্মত হয়, তবে তা গ্রহণ করো, আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করো। কিন্তু যদি কর দিতে তারা অস্বীকার করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তুমি যদি কোন দুর্গের লোকদেরকে অবরোধ করো, আর দূর্গের লোকেরা যদি তখন চায় যে, তুমি তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জিম্মায় রেখে দাও, তবে তুমি কিন্তু তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জিম্মায় রেখোনা বরং তোমার এবং তোমার সঙ্গী সাথীদের জিম্মায় রেখে দিও। কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জিম্মাদারী ভঙ্গ করার চেয়ে তোমার এবং তোমার- সাথীদের জিম্মাদারী ভঙ্গ করা অনেক সহজ। তুমি যদি কোন দূর্গের অধিবাসীদেরকে অবরোধ করো। অতঃপর তারা তোমার কাছে চায় যে, তুমি তাদেরকে আল্লাহর বিধানের ওপর রেখে দাও, তখন তাদেরকে আল্লাহর ফয়সালার ওপর রেখে দিয়ো না, বরং তোমার ফয়সালার ওপর তাদেরকে রেখো দাও। কারণ তুমি জান না যে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহর সঠিক ফায়সালা গ্রহণ করতে পারবে কিনা।” মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর জিম্মা, নবীর জিম্মা এবং মোমিনদের জিম্মার মধ্যে পার্থক্য।
দুই: দু’টি বিষয়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বিপদজনক বিষয়টি গ্রহণ করার প্রতি দিক নির্দেশনা।
তিন: তার বাণী: “আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা।”
চার: তার বাণী: “যে আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।”
পাঁচ: তার বাণী: (আল্লাহর সাহায্য চাও এবং তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ কর।)
ছয়: আল্লাহর হুকুম এবং আলেমদের হুকুমের মধ্যে পার্থক্য।
সাত: প্রয়োজনের মুহূর্তে সাহাবী এমন বিচারও করেন, যা আল্লাহর বিধানের সাথে মিলবে কিনা তাও তিনি জানেন না।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর ওপর কসম করার পরিণতি
জুনদুব ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন, “এক ব্যক্তি বললো, ‘আল্লাহর কসম, অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ‘আমি অমুককে ক্ষমা করবো না’ একথা বলে দেয়ার স্পর্ধা কার আছে? আমি তাকেই ক্ষমা করে দিলাম। আর তোমার [কসম কারীর] আমল বাতিল করে দিলাম।” মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
আবূ হুরায়রার হাদীসে আছে, “যে ব্যক্তি কসম করে উল্লেখিত কথা বলেছিলো, সে ছিলো একজন আবেদ।” আবু হুরায়রা বলেন, ঐ ব্যক্তি একটি কথার মাধ্যমে তাঁর দুনিয়া বরবাদ করে ফেলেছে
এবং আখেরাতও
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: আল্লাহর ইচ্ছাধীন বিষয়ে মাতব্বরী করা থেকে সতর্ক করা।
দুই: আমাদের কারো জাহান্নাম তার জুতার ফিতার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী।
তিন: জান্নাতও অনুরূপ নিকটবর্তী।
চার: এ অধ্যায়ে এ কথার প্রমাণ রয়েছে যে, একজন লোক মাত্র একটি কথার মাধ্যমে তার দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ করে ফেলেছে।
পাঁচ: কোন কোন সময় মানুষকে এমন সামান্য কারণেও মাফ করে দেয়া হয়, যা তার কাছে সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়।
পরিচ্ছেদ: আল্লাহর সৃষ্টির কাছে আল্লাহর সুপারিশ পেশ করা যায় না
জুবাইর ইবন মুত‘য়িম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক বেদুঈন এসে বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত, পরিবার পরিজন ক্ষুধার্ত, সম্পদ ধ্বংস প্রাপ্ত। অতএব আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্যে বৃষ্টির প্রার্থনা করুন। আমরা আপনার কাছে আল্লাহকে সুপারিশকারী হিসেবে পেশ করছি, আর আল্লাহর কাছে আপনাকে সুপারিশকারী হিসেবে পেশ করছি’। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ!! এভাবে তিনি আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করতে লাগলেন যে তাঁর এবং সাহাবায়ে কেরামের চেহারায় রাগভাব প্রতিফলিত হচ্ছিল। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার ধ্বংস হোক, আল্লাহর মর্যাদা কত বড়, তা কি তুমি জানো? তুমি যা মনে করছো আল্লাহর মর্যাদা ও শান এর চেয়ে অনেক বেশী। কোন সৃষ্টির কাছেই আল্লাহকে সুপারিশকারী হিসেবে পেশ করা যায় না।” এবং পুরো হাদীসটি উল্লেখ করেন। হাদীসটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: যে বলল, ‘আপনার কাছে আল্লাহর সুপারিশ পেশ করছি’ তাকে বারণ করা।
দুই: এই কথার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের চেহারায় লক্ষণীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল।
তিন: [আমরা আল্লাহর কাছে আপনার সুপারিশ পেশ করছি] এ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথ্যাখ্যান করেননি।
চার: ‘সুবহানাল্লা’ এর তাফসীরের ব্যাপারে সতর্ক করা।
পাঁচ: মুসলিমগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি চাওয়ার জন্য আবেদন করতেন।
পরিচ্ছেদ: তাওহীদের হেফাযত ও শিরকের সকল পথ বন্ধ করার ক্ষেত্রে নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবদান প্রসঙ্গে
আব্দুল্লাহ ইবন আশ-শিখখির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি বনু আমেরের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গেলাম। আমরা তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, أنت سيدنا [আপনি আমাদের প্রভু]
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, (السيد الله تبارك وتعالى) বরকতময় আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন (সায়্যেদ) প্রভু।
আমরা বললাম, ‘আমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমাদের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল।’
এরপর তিনি বললেন, ‘‘তোমরা তোমাদের কথা অথবা তার কিয়দংশ বলে যাও। শয়তান যেন তোমাদের উপর সওয়ার না হতে পারে।’’ এটি আবূদাউদ জায্যেদ সনদে বর্ণনা করেছেন।
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, কতিপয় লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বললো, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল, হে আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি, হে আমাদের উত্তম ব্যক্তির তনয়, আমাদের সরদার এবং আমাদের সরদারের তনয়’ তখন তিনি বললেন, “হে লোক সকল, তোমরা তোমাদের কথা বলে যাও। শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করতে না পারে। আমি হচ্ছি মুহাম্মদ, আল্লাহর বান্দা এবং তার রাসূল। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে মর্যাদার স্থানে অধিষ্টিত করেছেন, তোমরা এর উর্ধ্বে আমাকে স্থান দিবে এটা আমি পছন্দ করি না।” নাসায়ী উক্ত হাদীসটিকে জায়্যেদ সনদে বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: সীমালংঘন থেকে মানুষকে হুশিয়ার করা।
দুই: ‘আপনি আমাদের প্রভূ বা মনিব’ বলে সম্বোধন করা হলে জবাবে তার কি বলা উচিৎ, এ ব্যাপারে জ্ঞান লাভ।
তিন: তার বাণী: ‘‘শয়তান যে তোমাদের উপর চড়াও না হয়।’’ অথচ তারা তাঁর ব্যাপারে হক কথাই বলেছিল। এর তাৎপর্য অনুধাবন করা।
চার: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী ما أحب أن ترفعوني فوق منزلتي অর্থাৎ তোমরা আমাকে স্বীয় মর্যাদার উপরে স্থান দাও এটা আমি পছন্দ করিনা। একথার তাৎপর্য উপলব্ধি করা।
পরিচ্চেদ: আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী সর্ম্পকে যা বর্ণিত হয়েছে: “আর তারা আল্লাহকে যথোচিত সম্মান করেনি অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে এবং আসমানসমূহ থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের উর্ধ্বে।” [আয-যুমার: ৬৭]
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একজন ইহুদী পন্ডিত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললো, ‘হে মুহাম্মদ, আমরা [তাওরাত কিতাবে] দেখতে পাই যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত আকাশ মন্ডলীকে এক আঙ্গুলে, সমস্ত যমীনকে এক আঙ্গুলে, বৃক্ষরাজিকে এক আঙ্গুলে, পানি এক আঙ্গুলে ভূতলের সমস্ত জিনিসকে এক আঙ্গুলে এবং সমস্ত সৃষ্টি জগতকে এক আঙ্গুলে রেখে বলবেন, আমিই সম্রাট।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদী পন্ডিতের কথার সমর্থনে এমন ভাবে হেসে দিলেন যে তাঁর দন্ত মোবারক দেখা যাচ্ছিল। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করলেন, “আর তারা আল্লাহকে যথোচিত সম্মান করেনি; অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে।”
সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, “পাহাড়- পর্বত এবং বৃক্ষরাজি এক হাতে থাকবে তারপর এগুলোকে ঝাকুনি দিয়ে তিনি বলবেন, ‘আমি রাজাধিরাজ, আমিই আল্লাহ।”
বুখারীর এক বর্ণনায় আছে, “সমস্ত আকাশকে এক আঙ্গুলে রাখবেন। পানি এবং ভূতলে যা কিছু আছে তা এক আঙ্গুলে রাখবেন। আরেক আঙ্গুলে রাখবেন সমস্ত সৃষ্টি।” এটিকে তারা দুইজন (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনা করেছেন।
মুসলিম ইবন উমার হতে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেন, “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাঁর আকাশমণ্ডলীকে গুটিয়ে ফেলবেন। অতঃপর স্বীয় ডান হাত দ্বারা তা ধরবেন। তারপর তিনি বলবেন, আমিই অধিপতি, প্রতাপশালীরা কোথায়? দাম্ভিকেরা কোথায়? তারপর সাত যমীনকে গুটিয়ে নিবেন। তারপর এগুলো বাম হাত দ্বারা তালুবদ্ধ করবেন। তারপর তিনি বলবেন, আমি অধিপতি, প্রতাপশালীরা কোথায়? দাম্ভিকেরা কোথায়?”
ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সাত আসমান ও সাত যমীন রহমানের হাতের তালুতে, তোমাদের কারো হাতে একটি শস্য দানার মতোই ক্ষুদ্র।”
ইবন জারীর বলেন, আমাকে ইউনুস হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাকে ইবন ওহাব সংবাদ দিয়েছেন, তিনি বলেন, ইবন যায়েদ বলেছেন, আমাকে আমার পিতা বলেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কুরসীর সামনে সপ্ত আকাশ সাতটি দিরহামের মতো যা একটি প্রশস্ত ময়দানে রেখে দেওয়া হলো।”
তিনি বলেন, আবূ যার রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, “কুরসী ‘আরশের তুলনায় যমীনের বিশাল মরুভুমির উপর একটি লোহার আংটির মতো।”
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “দুনিয়ার আকাশ এবং তার পরবর্তী আকাশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। আর এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের। এমনিভাবে সপ্তমাকাশ ও কুরসির মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। একইভাবে কুরসী এবং পানির মাঝখানে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের। আরশ হচ্ছে পানির উপরে। আর আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে। তোমাদের আমলের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই।” এটি ইবন মাহদী হাম্মাদ ইবন সালমাহ থেকে তিনি আছেম থেকে, তিনিস যারর থেকে তিনি আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এটিকে অনুরূপভাবে বর্ণনা করেছেন, মাসউদী ‘আছেম থেকে, তিনি আবু ওয়ায়েল থেকে তিনি আব্দুল্লাহ থেকে। এ কথাগুলো হাফেয যাহবী বলেছেন। হাদীসটির একাধিক সনদ রয়েছে।
আব্বাস ইবন আবদুল মোত্তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমরা কি জানো, আসমান ও যমীনের মধ্যে দূরত্ব কত?’’ আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন। তিনি বললেন, ‘‘আসমান ও যমীনের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। প্রতিটি আকাশের ঘনত্বও (পুরু ও মোটা) পাঁচশ’ বছরের পথ। সপ্তমাকাশ ও আরশের মধ্যখানে রয়েছে একটি সাগর। যার উপরিভাগ ও তলদেশের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের সমান। আল্লাহ তা‘আলা তার উপরে রয়েছেন। আর আদম সন্তানের কোনো কর্মকান্ডই তাঁর অজানা নয়।’’
[এটি আবূ দাঊদ ও অন্যরা বর্ণনা করেছেন]
পরিচ্ছেদটিতে অনেক মাসআলা রয়েছে-
এক: وَ الْاَرْضُ جَمِيْعًا قَبْضَتُهٗ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ “আর কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে।” এর তাফসীর।
দুই: এ অধ্যায়ে আলোচিত ইলম ও এতদসংশিষ্ট জ্ঞানের চর্চা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের ইহুদীদের মধ্যেও বিদ্যমান ছিলো। তারা তা অস্বীকার করেনি এবং তাতে অপব্যাখ্যাও করেনি।
তিন: ইহুদী পন্ডিত ব্যক্তি যখন কেয়ামতের দিনে আল্লাহর ক্ষমতা সংক্রান্ত কথা বললো, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথাকে সত্যায়িত করলেন এবং এর সমর্থনে কোরআনের আয়াতও নাযিল হলো।
চার: ইহুদী পন্ডিত কর্তৃক আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কিত মহাজ্ঞানের কথা উল্লেখ করা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাসির উদ্রেক হওয়া।
পাঁচ: আল্লাহ তাআলার দু’হস্ত মোবারকের সুস্পষ্ট উল্লেখ্য। আকাশ মন্ডলী তাঁর ডান হাতে, আর সমগ্র যমীন তাঁর অপর হাতে নিবদ্ধ থাকবে।
ছয়: অপর হাতকে বাম হাত বলে নামকরণ করার সুস্পষ্ট ঘোষণা।
সাত: তার সঙ্গে অত্যাচারী ও অহংকারীদের উল্লেখ।
আট: তার বাণী: “তোমাদের কারো হাতে একটি শস্য দানার মতোই ক্ষুদ্র”।
নয়: আসমানের তুলনায় কুরসীর বড়ত্ব।
দশ: কুরসীর তুলনায় আরশের বিশালতা।
এগারো: কুরসী এবং পানি থেকে আরশ সম্পূর্ণ আলাদা।
বারো: প্রতিটি আকাশের মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধানের উল্লেখ।
তের: সপ্তমাকাশ ও কুরসীর মধ্যে কত দূরত্ব তা উল্লেখ।
চৌদ্দ: কুরসী এবং পানির মধ্যে দূরত্ব।
পনেরো: আরশের অবস্থান পানির উপর।
ষোল: আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে।
সতেরো: আকাশ ও যমীনের দূরত্বের উল্লেখ।
আঠারো: প্রতিটি আকাশের ঘনত্ব (পুরো) একশ বছরের পথ।
ঊনিশ: আকাশ মন্ডলীর উপরে যে সমুদ্র রয়েছে তার উর্ধ্বদেশ ও তলদেশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। আল্লাহই অধিক জানেন।
আল্লাহর অনুগ্রহে ‘কিতাবুত তাওহীদ’ সম্পন্ন হলো।