অধ্যায়: আল্লাহ তা‘আলাকে জানা এবং তাঁর ওপর ঈমান আনা (⮫)


 অধ্যায়: আল্লাহ তা‘আলাকে জানা এবং তাঁর ওপর ঈমান আনা

১- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আমি সমস্ত শরীকদের ভেতর অংশীদারি অংশ [শিরক] থেকে অধিক অমুখাপেক্ষী। যদি কেউ এমন কাজ করে যাতে সে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করেছে, আমি তাকে ও তার শিরককে বর্জন করি।’

মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

২- আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আমাদের মাঝে দণ্ডায়মান হলেন, অতঃপর তিনি বললেন:

“আল্লাহ তা‘আলা ঘুমান না, আর তাঁর জন্য ঘুম শোভনীয়ও নয়। তিনি মীযানের পাল্লা উঠা-নামা করান। দিনের কাজের আগেই তাঁর কাছে রাতের কাজ পেশ করা হয়। আবার রাতের কাজের আগেই দিনের কাজ পেশ করা হয়। তাঁর পর্দা (আড়ালকারী বস্তু) হচ্ছে নূর, যদি তিনি তার প্রকাশ ঘটাতেন, তবে তাঁর চেহারার চমক তাঁর সৃষ্টির মধ্য হতে যতদূর তাঁর দৃষ্টি যেত তার সবকিছুকে পুড়িয়ে দিত।”

মুসলিম তা বর্ণনা করেছেন।

৩- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত,

“আল্লাহর ডান হাত পরিপূর্ণ, কোনো খরচ তা হ্রাস করে না। তিনি রাত ও দিনের দাতা। তোমরা কি দেখনি যে, আসমান ও যমীন সৃষ্টির পর থেকে তিনি কত পরিমাণ খরচ করেছেন? তবুও তাঁর ডান হাতে যা আছে, তা হতে কোনো কমতি হয়নি। আর অন্য হাতে রয়েছে ন্যায়ের পাল্লা, তিনি তা উঠা-নামা করান।”

তারা দুইজন (বুখারী ও মুসলিম) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৪- আবূ যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি ছাগলকে মাথা দিয়ে গুতোগুতি করতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন: “হে আবূ যার! তুমি কি জান যে, তারা কী নিয়ে গুতোগুতি করছে? আমি বললাম: না। তিনি বললেন: কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর অচিরেই তিনি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দিবেন।”

এটি আহমাদ বর্ণনা করেছেন।

৫- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন:اِنَّ اللّٰهَ يَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤى اَهْلِهَا١” অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানত তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও।” এখান থেকে আল্লাহর বাণী: “اِنَّ اللّٰهَ كَانَ سَمِيْعًۢا بَصِيْرًا” অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু দেখেন।” পর্যন্ত। [আন-নিসা: ৫৮]। আর তখন তার বৃদ্ধাঙ্গুল দুটি তার দুই কানের উপরে আর তার পরের আঙ্গুল তার দুই চোখের উপরে রেখেছিলেন।”

আবূ দাঊদ, ইবনু হিব্বান ও ইবনু আবূ হাতিম এটি বর্ণনা করেছেন।

৬- ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“গায়েবের চাবি পাঁচটি, যা আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ জানে না: (১) আগামীকাল কী হবে, তা আল্লাহ ব্যতীত কেউই জানে না। (২) মাতৃগর্ভে কী রয়েছে, তা আল্লাহ ব্যতীত কেউই জানে না। (৩) কখন বৃষ্টি আসবে, তা আল্লাহ্ ব্যতীত কেউই জানে না। (৪) কোন ব্যক্তি কোন ভূমিতে মারা যাবে, তা আল্লাহ্ ব্যতীত কেউই জানে না। (৫) আর কিয়ামত কখন কায়েম হবে, তা আল্লাহ্ ছাড়া কেউই জানে না।”

এটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৭- আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“তোমাদের মধ্য হতে যখন কোন বান্দা আল্লাহর কাছে তাওবা করে ফিরে আসে, তখন আল্লাহ বান্দার তাওবার কারণে ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যে ব্যক্তি একটি নির্জন মরুভূমিতে নিজ সাওয়ারী উটের পিঠে ছিল। তারপর উক্ত উটটি তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় এমতাবস্থায় যে, তার সকল খাদ্য ও পানীয় ঐ উটের পিঠেই ছিল। এরপর সে নিরাশ হয়ে যায় এবং সে একটি গাছের ছায়ায় হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম করে আর তার উটটির ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হঠাৎ তার কাছেই উটটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আর সে তার লাগাম ধরে ফেলে। এরপর সে অধিক আনন্দে বলে ফেলে: “হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা আর আমি আপনার রব।” অধিক আনন্দে ভুল করে ফেলল।”

এটিকে তারা দুইজন (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনা করেছেন।

৮- আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাত রাতে প্রসারিত করেন যেন দিনের অপরাধীরা তাওবা করে এবং দিনে তার হাত প্রসারিত করেন যেন রাতের অপরাধীরা তাওবা করে, [এমন করতে থাকবেন] যে পর্যন্ত না পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠবে।”

মুসলিম তা বর্ণনা করেছেন।

৯- বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের নিকট হাওয়াযিন গোত্রের কিছু সংখ্যক বন্দী এল। তিনি দেখলেন যে, বন্দীদের মধ্যে একজন মহিলা খোঁজাখুঁজি করছে। হঠাৎ সে বন্দীদের মধ্যে একটি শিশুকে পেলো, আর তাকে ঝাপটে ধরে পেটের সাথে মিলিয়ে নিল ও তাকে দুধ পান করাল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমরা কি মনে কর যে, এই মহিলা তার সন্তানকে আগুনে ফেলতে পারে?” আমরা বললাম, ‘না, আল্লাহর কসম!’ তিনি বললেন, “এই মহিলাটি তার সন্তানের ওপর যতটা দয়ালু, আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর তার চেয়ে অধিক দয়ালু।”

১০- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ যখন সৃষ্টিজগত তৈরি করলেন, তখন একটি কিতাবে লিখে রাখলেন, যা তাঁরই কাছে ‘আরশের উপর রয়েছে, “অবশ্যই আমার রহমত আমার গযবের উপর জয়ী হবে।”

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

১১- তাঁর থেকেই বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ রহমতকে একশ ভাগ করেছেন। তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আর পৃথিবীতে একভাগ অবতীর্ণ করেছেন। ঐ এক ভাগের কারণেই মাখলুকেরা একে অন্যের ওপর দয়া করে। এমনকি জন্তু তার বাচ্চার উপর থেকে স্বীয় পা তুলে নেয় তাকে কষ্ট দিবে আশঙ্কায়।”

১২। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত একই অর্থে সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস রয়েছে, তাতে রয়েছে:

“প্রতিটি রহমত আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের সমান।” তাতে আরো রয়েছে: “যখন কিয়ামাত হবে, তখন এই রহমতটির মাধ্যমে তাদেরকে পূর্ণ করা হবে।”

১৩- আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“কাফির যখন দুনিয়াতে কোনো পুণ্য কাজ করে, তখন বিনিময়ে তাকে দুনিয়ার (কিছু আনন্দ) উপভোগ করতে দেওয়া হয়। (আখেরাতে সে এর কিছুই প্রতিদান পাবে না)। কিন্তু মুমিন, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য আখেরাতে তার প্রতিদান সঞ্চিত করে রাখেন, তদুপরি দুনিয়াতে তিনি তাকে জীবিকা দেন তাঁর আনুগত্যের কারণে।”

মুসলিম তা বর্ণনা করেছেন।

১৪- মুসলিমের বর্ণনাতে তার থেকে মারফূ হিসেবে এসেছে:

“নিশ্চয় আল্লাহ সে বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন, যে কোনো খাবার গ্রহণের পরে সেটার জন্য আল্লাহর প্রশংসা তথা আল-হামদুলিল্লাহ বলে এবং কোনো পানীয় পান করার পরে সেটার জন্য আল্লাহর প্রশংসা তথা আলহামদুলিল্লাহ বলে।”

১১- আবূ যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আসমান চিৎকার করে উঠছে, আর চিৎকার করা তার জন্যে ঠিক আছে। তাতে চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গা এমন নেই যেখানে কোনো ফিরিশতা নিজের মাথা আল্লাহর জন্যে সাজদার নিমিত্তে অবনত করেনি। আল্লাহর কসম! আমি যা জানি যদি তোমরা তা জানতে, অবশ্যই তোমরা কম হাসতে ও অনেক বেশি কাঁদতে, আর নারীদের নিয়ে বিছানায় আরাম করতে না; বরং উচ্চ স্বরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে পানাহ চাইতে চাইতে টিলায় গিয়ে উঠতে।”

এটি তিরমিযী. বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বলেছেন: হাসান হাদীছ।

১৬- মুসলিমে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফূ হিসেবে বর্ণিত আছে:

‘‘এক ব্যক্তি বললো, ‘‘আল্লাহর কসম, অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তখন আল্লাহর তাআলা বললেন, ‘আমি অমুককে ক্ষমা করবো না’ একথা বলে দেয়ার আস্পর্ধা কার আছে? আমি তাকেই ক্ষমা করে দিলাম। আর তোমার [কসমকারীর] আমল বাতিল করে দিলাম।’’

১৭- মুসলিমে মারফূ হিসেবে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত রয়েছে:

“যদি মুমিন জানত যে, আল্লাহর নিকট কী শাস্তি রয়েছে, তাহলে কেউ তার জান্নাতের আশা করত না। আর যদি কাফের জানত যে, আল্লাহর নিকট কী রহমত রয়েছে, তাহলে কেউ তার জান্নাত থেকে নিরাশ হত না “

বুখারীতে ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“জান্নাত তোমাদের কারো জুতার রশি থেকেও অতি নিকটে এবং জাহান্নামও অনুরূপ।”

১৯- মারফূ হিসেবে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,

“নিশ্চয় একজন ব্যাভিচারী নারী একদা একটি কুকুরকে গরমের দিনে একটি কুয়ার পাশে ঘুরতে দেখলো, কুকুরটির পিপাসার কারণে জিহ্বা বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন সে তার চামড়ার মোজাটি খুলে (তাতে পানি এনে) তাকে পান করালো। আর এ কারণে আল্লাহ তাকে (ঐ নারীকে) ক্ষমা করে দিলেন।”

২০- তিনি আরো বলেছেন: “একটি নারী একটি বিড়ালকে আটকে রাখার কারণে সে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে: সে তাকে খেতেও দেয়নি, আবার সে তাকে যমীন থেকে পোকা-মাকড় খাওয়ার জন্যও ছেড়ে দেয়নি।”

যুহরী বলেছেন: যাতে করে কোনো ব্যক্তি নিরেট ভরসা না করে বসে থাকে, আবার কেউ যেন একদম নিরাশও না হয়ে পড়ে।

হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

২১- তাঁর থেকেই মারফূ হিসেবে বর্ণিত,

“আমাদের রব এমন একটি কওমের প্রতি আশ্চর্য হন, যাদেরকে জান্নাতের দিকে শিকলবন্ধী করে নিয়ে যাওয়া হবে।”

এটি আহমাদ ও বুখারী বর্ণনা করেছেন।

২২- আবু মূসা আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কোনো কষ্টদায়ক কথা শুনে আল্লাহর চেয়ে সবরকারী আর কেউ নেই। তারা (আহলে কিতাবগণ) দাবী করে যে, তাঁর সন্তান আছে, এরপরেও তিনি তাদেরকে ক্ষমা করেন এবং রিযিক দেন।”

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

২৩- বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা‘আলা যখন কোনো বান্দাকে ভালবাসেন, তখন তিনি ডেকে বলেন: হে জিবরীল! নিশ্চয় আল্লাহ এই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসবে। তখন জিবরীল তাকে ভালোবাসে। তারপরে জিবরীল আসমানে ঘোষণা দেয়: নিশ্চয় আল্লাহ এই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, আর তাই তোমরাও তাকে ভালোবাসবে। তখন আসমানের অধিবাসীরা তাকে ভালোবাসতে থাকে। আর যমীনে তার কবূলিয়্যাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।”

২৪- জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-বাজালী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসে ছিলাম। হটাৎ তিনি পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকালেন আর বললেন:

“তোমরা শীঘ্রই তোমাদের রববকে দেখতে পাবে, যেমনি তোমরা এ চাঁদটিকে দেখতে পাচ্ছ। অথচ এটিকে দেখতে তোমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। অতএব, তোমরা যদি সক্ষম হও যে, সূর্য উঠার আগের সালাত ও সূর্য ডুবার আগের সালাত (যথাযথভাবে) আদায় করতে পরাজিত হবে না, তাহলে তাই কর।” অতপর তিনি তিলাওয়াত করলেন: “আর তুমি সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের আগে তোমার রবের প্রশংসা ও তাসবীহ (পবিত্রতা ঘোষণা) কর।” [ত্বহা: ১৩০]

(৭জন) একদল মুহাদ্দিস হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

২৫- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: যে আমার কোনো অলীর সাথে শত্রুতা করবে, আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছি। আর আমি বান্দার উপর যা ফরয করেছি তার চেয়ে প্রিয় কোনো জিনিস নেই যার দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করবে, আর বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, এক সময় আমি তাকে মহব্বত করি। আর আমি যখন তাকে মহব্বত করি, আমি তার কানে পরিণত হই, যার দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং তার চোখে পরিণত হই, যার দ্বারা সে দেখে এবং তার হাতে পরিণত হই যার দ্বারা সে স্পর্শ করে এবং তার পায়ে পরিণত হই, যার দ্বারা সে হাঁটে, আর যদি সে আমার নিকট প্রশ্ন করে, আমি অবশ্যই তাকে দিব, আর যদি আমার নিকট পানাহ চায়, আমি অবশ্যই তাকে পানাহ দিব, আমি যা করতে চাই সেটা করতে কোনো দ্বিধা করি না, যেরূপ দ্বিধা করি মুমিনের নফসকে গ্রহণ করতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তাকে কষ্ট দিতে অপছন্দ করি।”

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

২৬- তাঁর থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“রাতের শেষাংশের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে প্রতি রাতে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব?”

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি।

২২- আবু মূসা আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“দু’টি জান্নাতের পাত্রসমূহ ও অন্যান্য জিনিস পত্র হবে সোনার তৈরি। আর দু’টি জান্নাতের পাত্রসমূহ ও অন্যান্য জিনিস পত্র হবে রূপার তৈরি। আদন নামক জান্নাতে জান্নাতীগণ ও তাদের মহান রবকে দেখার মাঝে রবের চেহারার উপর বড়ত্বের চাদরের প্রতিবন্ধক ব্যতীত কিছুই থাকবে না।”

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।


 অধ্যায়: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ‘‘এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন লোকদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে তখন তারা বলবে, তোমাদের রব কি জবাব দিয়েছেন? তারা বলবে: সঠিক জবাবই পাওয়া গিয়েছে আর তিনিই মহান ও শ্রেষ্ঠ। [সূরা সাবা: ২৩]

২৮- ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনসারদের মধ্য হতে একজন সাহাবী আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, তারা একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রাতের বেলায় বসে ছিলেন, তখন একটি তারকা প্রক্ষিপ্ত হয়ে আলোকিত করল, তখন তিনি বললেন:

“এই তারকার ন্যায় প্রক্ষিপ্ত হলে তোমরা কী বলতে?”

তারা বললেন: আমরা বলতাম: আজকের রাতে কোনো সম্মানিত ব্যক্তি জন্ম নিয়েছেন অথবা কোনো সম্মানিত ব্যক্তি মারা গেছেন।

তখন তিনি বললেন: নিশ্চয় কারো মৃত্যু কিংবা কারো জন্মের কারণে তা প্রক্ষিপ্ত হয় না। বরং আমাদের মহান সম্মানিত রব যখন কোনো বিষয়ের ফয়সালা করেন, তখন আরশ বহনকারী ফেরেশতারা তাসবীহ পাঠ করে। অবশেষে তাদের কাছে থাকা আসমানের অধিবাসী তথা ফেরেশতারা তাসবীহ পাঠ করে, এভাবে করে পেশ পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ এ নিকটবর্তী (পৃথিবীর) আসমানের অধিবাসীদের পর্যন্ত পৌছে। অতঃপর আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের পার্শ্ববর্তী যারা, তারা আরশ বহনকারীদের জিজ্ঞাসা করে: তোমাদের রব কি বললেন? সে সময় তিনি তাদের যা কিছু বলেছেন, তারা সে সংবাদ জানায়। এরপরে আসমানসমূহের অধিবাসীরা একে অপরকে সংবাদ জিজ্ঞাসা করে, এবং পরিশেষে এ কথা নিকটবর্তী আসমানের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে। সে সময় ওৎ পেতে থাকা জিনেরা গোপন খবরটি শুনে নেয় এবং তাদের দোসর বা বন্ধুদের (জ্যোতিষী বা গণকদের) কাছে তা পৌঁছিয়ে দেয়। ফলে যা তারা সঠিকভাবে নিয়ে আসতে পারে, তা ঠিক হয়। তবে তারা উক্ত কথার সাথে অন্য কথা মিলিয়ে ও নতুন করে সংযোজন করে বলে।

এটি মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন।

২৯- নাওয়াস ইবন সাম‘আন রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“যখন আল্লাহ কোনো বিষয়ে ওহী করার ইচ্ছা করেন, তখন তিনি ওহীর মাধ্যমে কথা বলেন, তার কারণে আসমান কম্পিত হয় অথবা তিনি বলেছেন আল্লাহর ভয়ে বিকট শব্দ হয়। যখন আসমানবাসী তা শুনতে পান তখন তারা বেহুশ হয়ে যান এবং আল্লাহর জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। সর্ব প্রথম জিবরীল মাথা উঠান, তারপর আল্লাহ তা‘আলা যে ওহী প্রেরণের ইচ্ছা করেন সে বিষয়ে তাকে বলেন। তারপর জীবরিল ফিরিশতাদের নিকট দিয়ে যান। যখনই তিনি কোনো আসমান অতিক্রম করেন তখন ফিরিশতাগণ তাকে জিজ্ঞাসা করেন, হে জিবরীল আমাদের রব কি বলেছেন? তখন জিবরীল বলেন সত্যই বলেছেন। তিনিই বড় ও মহান। তারা সবাই জিবরীল যা বলেছেন তার মতোই কথা বলেন। তারপর আল্লাহ যেখানে আদেশ করেন সেখানে তিনি ওহী নিয়ে যান।”

ইবনু জারীর, ইবনু খুযাইমা, তাবরানী এবং ইবনু আবী হাতিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। বর্ণিত শব্দটি ইবনু আবী হাতিমের।


 অধ্যায়: আল্লাহর বাণী: “আর তারা আল্লাহকে যথোচিত সম্মান করেনি; অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে এবং আসমানসমূহ থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের থেকে উর্ধ্বে।” [যুমার:৬৭]

৩০- আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“আল্লাহ যমীনকে মুষ্টিতে ধারণ করবেন আর আসমানকে তাঁর ডান হাতে ভাজ করে রাখবেন। তারপরে বলবেন: আমিই মালিক। কোথায় সব দুনিয়ার মালিকেরা (বাদশাহ)?” হাদীসটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

৩১- বুখারীতে ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সমস্ত যমীনকে মুষ্টিতে ধারণ করবেন এবং আসমানসমূহ তাঁর ডানহাতে থাকবে। তারপরে তিনি বলবেন: আমিই মালিক।”

৩২- তাঁর থেকেই অন্য বর্ণনাতে এসেছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন মিম্বারের উপরে এই আয়াত পাঠ করলেন: “আর তারা আল্লাহকে যথোচিত সম্মান করেনি; অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে এবং আসমানসমূহ থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের থেকে উর্ধ্বে।” আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত আগে-পিছে নাড়িয়ে বলছিলেন: “রব (আল্লাহ) নিজের প্রশংসা করে বলেন, আমিই মহা প্রতাপশালী, আমিই মহা-মহিম, আমিই পরাক্রমশালী আর আমিই মহা সম্মানিত।” তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মিম্বারটি কেঁপে উঠল, এমনকি আমরা বললাম: মনে হচ্ছে সে তাকে নিয়ে পড়ে যাবে।”

এটি আহমাদ বর্ণনা করেছেন।

৩৩- মুসলিম উবাইদুল্লাহ ইবন মিকসাম হতে এটি বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার দিকে তাকিয়ে দেখেছেন যে, তিনি কিভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে আবৃত্তি করেছেন যে, তিনি বলেছেন:

“আল্লাহ তাঁর আসমানসমূহ ও যমীনকে স্বীয় দুইহাতে ধরবেন আর মুষ্টিবদ্ধ করে বলবেন: আমিই মালিক! তিনি তাঁর আঙ্গুলগুলোকে খুলবেন আবার বন্ধ করে বলবেন: ‘আমিই মালিক’। তখন আমি মিম্বারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তার নিচ হতে প্রকম্পিত হচ্ছে, এমনকি আমি বলছিলাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে এটি পড়ে যাবে কী?”

৩৪। সহীহাইনে ইমরান ইবনু হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, হে বানী তামীম।”

তারা বলল: আমরা সুসংবাদ গ্রহণ করলাম, তবে আমাদেরকে কিছু দান করুন।

তিনি বললেন: “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, হে ইয়ামানের অধিবাসীগণ।”

তারা বললেন: আমরা গ্রহণ করলাম। আমাদেরকে এই বিষয়ের প্রথম বস্তু সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করুন।

তিনি বললেন: “সর্বপ্রথম আল্লাহই ছিলেন, তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে, আর তিনি লাওহে মাহফূজে প্রতিটি বস্তুর আলোচনা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।”

তিনি বললেন: আমার কাছে একজন আগন্তুক আসলেন, তারপরে সে বলল: হে ইমরান! আপনার উট তার লাগাম থেকে ছুটে গেছে।

তিনি বলেছেন: তখন আমি তার পিছনে বের হলাম। আমি জানি না যে, আমার পরে কী হয়েছিল।

৩৫- জুবায়ের ইবন মুহাম্মাদ ইবন জুবায়ের ইবন মুত‘ঈম হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করে বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একজন বেদুঈন আসলো, তারপরে সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! প্রাণগুলো (মানুষেরা) কষ্ট পাচ্ছে, পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মালগুলো নষ্ট হচ্ছে আর পশুগুলো মারা যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে পানি (বৃষ্টি) প্রার্থনা করুন। আমরা আপনাকে আল্লাহর কাছে শাফা‘আতকারী হিসেবে পেশ করি আর আপনার কাছে আল্লাহকে শাফা‘আতকারী হিসেবে পেশ করি।

তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

তোমার জন্য আফসোস! তুমি কি জানো যে তুমি কি বলছো? আর আল্লাহর রাসূল তাসবীহ পড়তে (অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করতে) লাগলেন, এমনকি তার সাহাবীদের মধ্যেও তা (অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণার চিহ্ন) পরিলক্ষিত হওয়া পর্যন্ত তিনি তাসবীহ পড়তেই লাগলেন। তিনি আবার বললেন: তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহর সুপারিশ নিয়ে তাঁর সৃষ্টির মধ্য হতে কারো কাছে যাওয়া যায় না। আল্লাহর মর্যাদা এর চেয়ে অনেক উর্ধ্বে। তোমার জন্য আফসোস! তুমি কি জানো যে, আল্লাহ কে? নিশ্চয় তাঁর আরশ আসমানসমূহের উপর এভাবে আছে। তিনি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে আসমানসমূহের ওপর তা গম্বুজ সদৃশ বললেন। তবুও তা তাঁকে নিয়ে কটকট আওয়াজ করে, যেমনটি আরোহীর কারণে পশুর পিঠের গদি আওয়াজ করে থাকে।

এটি আহমদ ও আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন।

৩৬- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “বনী আদম আমাকে মিথ্যারোপ করেছে; অথচ এরূপ করা তার পক্ষে বৈধ নয়। আর সে আমাকে গালমন্দ করেছে; অথচ এরূপ করাও তার পক্ষে বৈধ নয়। আমাকে তার মিথ্যারোপ করার একটি রূপ হচ্ছে, যেমন সে বলে: আমাকে পুনরায় উত্থিত করা হবে না, যেমন আমাকে প্রথমবার সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ দ্বিতীয়বার উত্থিত করা থেকে প্রথমবার সৃষ্টি করা বেশি কঠিন। আর আমাকে তার গালমন্দ হচ্ছে, যেমন তার কথা: আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন, অথচ আমি এক ও অমুখাপেক্ষী, আমি সন্তান জন্ম দিই না এবং আমাকেও জন্ম দেওয়া হয় নি, আর আমার সমকক্ষ কেউ নেই।”

৩৭- ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার অন্য একটি বর্ণনাতে রয়েছে:

“আর আমাকে গালি দেওয়া হচ্ছে, বান্দার এ কথা বলা: ‘আমার সন্তান রয়েছে’, আর আমি কোনো সঙ্গিনী অথবা কোনো সন্তান গ্রহণ করা হতে নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করছি।”

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

৩৮- বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। সে যমানাকে গালি দেয় অথচ আমিই যমানা, আমার হাতেই সকল কর্ম, আমিই রাত-দিনের পরিবর্তন ঘটাই।”


 অধ্যায়: তাকদীরের প্রতি ঈমান

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “নিশ্চয় যাদের জন্য আমাদের কাছ থেকে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে।” [আল-আম্বিয়া: ১০১]

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর আল্লাহর ফয়সালা সুনির্ধারিত, অবশ্যম্ভাবী।” [আল-আহযাব: ৩৮]

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “অথচ আল্লাহ্ই তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা সৃষ্টি করেছেন।” [আস-সাফফাত: ৯৬]

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “নিশ্চয় আমরা প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।” [আল-কামার: ৪৯]

৩৯- সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন: আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে।”

৪০- আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“তোমাদের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তিই নেই, যার স্থান জাহান্নামে অথবা জান্নাতে নির্দিষ্ট করে লিখে রাখা হয়নি।” এ কথা শুনে সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তাহলে আমল বাদ দিয়ে আমাদের লিখিত বিষয়ের উপর কি নির্ভর করে থাকব না? তখন তিনি বললেন:

“তোমরা ‘আমল করতে থাকবে; কারণ, যাকে যে ‘আমলের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সেটাকে সহজ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যের অধিকারী হবে, তার জন্য সৌভাগ্যের অধিকারী লোকদের ‘আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে। আর যে দুর্ভাগ্যের অধিকারী হবে, তার জন্য দুর্ভাগ্যের অধিকারীদের আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে। এরপরে তিনি পাঠ করলেন: “কাজেই কেউ দান করলে, তাকওয়া অবলম্বন করলে (৫) এবং যা উত্তম তা সত্য বলে গ্ৰহণ করলে (৬) আমরা তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ।” [আল-লাইল: ৫-৮]

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি

৪১- মুসলিম ইবন ইয়াসার আল-জুহানী হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “আর স্মরণ কর ঐ সময়ের কথা, যখন তোমার রব আদম-সন্তানের পিঠ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করেছিলেন।” [আল-আরাফ: ১৭২] উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন: আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বলেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করে তাঁর (আল্লাহর) ডান হাত দ্বারা তার (আদমের) পিঠে হাত বুলালেন। আর সেখান থেকে একটি বংশধর বের করে বললেন:

আমি জান্নাতের জন্য এবং জান্নাতীদের কাজ করবে বলে এদেরকে সৃষ্টি করেছি। তিনি পুনরায় আদমের পিঠে হাত বুলালেন এবং সেখান থেকে তার আরো কতিপয় সন্তান বের করলেন। তারপরে তিনি বললেন: এদের আমি জাহান্নামের জন্য এবং জাহান্নামীদের মত কাজ করবে বলে সৃষ্টি করেছি। তখন একজন বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমলের কী আর বাকী থাকলো?

তখন তিনি বললেন: “আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করবেন, তখন তার দ্বারা জান্নাতীদের কাজই করিয়ে নেবেন। এমনকি সে জান্নাতীদের আমলসমূহের ওপর আমল করে মারা যায়, যার দ্বারা আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যখন আল্লাহ কোনো বান্দাকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তার দ্বারা জাহান্নামীদের কাজ করিয়ে নেন। এমনকি সে জাহান্নামীদের আমলসমূহের ওপর আমল করে মারা যায়। যা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে।”

হাদীসটি ইমাম মালিক ও হাকিম বর্ণনা করেছেন। হাকিম বলেছেন: এটি মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ।

এবং আবূ দাঊদও অন্য একটি সূত্রে মুসলিম ইবন ইয়াসার হতে, তিনি নু‘আইম ইবন রবী‘আহ হতে এবং তিনি উমার হতে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৪২- ইসহাক ইবন রাহওয়াইহি বলেছেন: আমাদেরকে বাকিয়্যাহ ইবনুল ওয়ালিদ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন: আমাকে যুবাইদী মুহাম্মাদ ইবনুল ওয়ালিদ সংবাদ দিয়েছেন, তিনি রাশিদ ইবন সা‘দ হতে, তিনি আব্দুর রহমান ইবন আবী কাতাদা হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি হিশাম ইবন হাকীম ইবন হিযাম হতে বর্ণনা করে বলেছেন যে, এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমল কি নতুন করে শুরু হয় নাকি চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গিয়েছে? তখন তিনি বললেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ যখন আদমের পিঠ হতে আদমের সন্তানদেরকে বের করেছিলেন, তাদেরকে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। তারপরে তিনি তার হাতের তালুতে তাদেরকে রেখে বলেছিলেন: এরা জান্নাতের জন্য আর এরা জাহান্নামের জন্য। আর তাই জান্নাতীদের জন্য জান্নাতীদের আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে আর জাহান্নামীদের জন্য জাহান্নামীদের আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে।”

৪৩- আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বর্ণনা করেছেন, আর তিনি সত্যবাদী ও সত্যায়িত ব্যক্তি:

“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপকরণকে তার মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন শুক্ররূপে জমা করা হয়। এরপর তা অনুরূপ (চল্লিশদিন) জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়ে থাকে। এরপর তা অনুরূপ (চল্লিশদিন) মাংসপিন্ডে রুপান্তরিত হয়ে থাকে। এরপর আল্লাহ তার কাছে চারটি বিষয়ের নির্দেশ সহকারে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন, আর সে এসে তার আমল, তার হায়াত, তার রিযিক এবং সে কি দূর্ভাগা হবে নাকি পূণ্যবান হবে এ বিষয়গুলো লিখে দেয়। তারপর তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেওয়া হয়। সুতরাং ঐ সত্তার কসম, যিনি ছাড়া আর কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই! নিশ্চয় তোমাদের কেউ জান্নাতীদের ন্যায় আমল করতে থাকবে এমনকি তার এবং জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত দূরত্ব থাকবে, তখন তার তাকদীরের লেখনী এগিয়ে আসবে আর সে জাহান্নামীদের মত আমল করবে; যার ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আবার তোমাদের কেউ জাহান্নামীদের ন্যায় আমল করতে থাকবে, এমনকি তার এবং জাহান্নামের মধ্যে মাত্র এক হাত দূরত্ব থাকবে, তখন তার তাকদীরের লেখনী এগিয়ে আসবে আর সে জান্নাতীদের মত আমল করবে; যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি

৪৪- আর হুযায়ফা ইবন উসাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন:

“রিহম বা জরায়ুতে চল্লিশ অথবা পয়তাল্লিশ দিন নুতফা হিসেবে জমা থাকার পর সেখানে একজন ফেরেশতা প্রবেশ করে। অতঃপর সে বলে: হে আমার রব! সে কি দুর্ভাগা না সৌভাগ্যবান? তখন এ দুটি লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর সে বলে: হে আমার রব! পুরুষ নাকি মহিলা? তখন এ দুটিও লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর তার আমল, পরিণাম, মৃত্যু-সময় ও রিযিক লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর ফলকটিকে ভাজ করে দেওয়া হয়; সুতরাং তাতে বৃদ্ধি করা হবে না আবার তার থেকে হ্রাসও করা হবে না।”

মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৪৫- সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আনসারদের একটি ছোট বালকের জানাযার জন্য ডাকা হলে আমি বললাম: তার জন্য সুসংবাদ, সে জান্নাতের চড়ুই পাখিদের মধ্য হতে একটি চড়ুই। সে কোন খারাপ কাজ করেনি, আর তার সুযোগও পায়নি। তখন তিনি বললেন:

“এটা ছাড়া আরো কিছু আছে, হে আয়েশা! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের জন্যই একদল অধিবাসী সৃষ্টি করেছেন, যাদেরকে উক্ত উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন এমন অবস্থায় যে, তারা তাদের বাপ-দাদাদের মেরুদন্ডের মধ্যে ছিল। আবার তিনি জাহান্নামের জন্য একদল অধিবাসী সৃষ্টি করেছেন, যাদেরকে উক্ত উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন এমন অবস্থায় যে, তারা তাদের বাপ-দাদাদের মেরুদন্ডের মধ্যে ছিল।”

৪৬- আর ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “প্রতিটি বস্তুই নির্দিষ্ট পরিমাণে রয়েছে, এমনকি অলসতা ও বুদ্ধিমত্তাও ।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৪৭- কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: {تَنَزَّلُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَ الرُّوْحُ فِيْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ١ۚ مِنْ كُلِّ اَمْرٍۙ} [অর্থ: সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ্ নাযিল হয়, তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে।] [কদর: ০৪] প্রসঙ্গে রয়েছে: তিনি বলেছেন: “উক্ত রাতে ফয়সালা করা হয় যা উক্ত বছর থেকে অন্য বছর পর্যন্ত হবে।”

এটি বর্ণনা করেছেন আব্দুর রাযযাক ও ইবনু জারীর।

এই অর্থ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, হাসান, আবূ আব্দুর রহমান আস-সুলামী, সাঈদ ইবন জুবায়ের ও মুকাতিল হতে বর্ণিত হয়েছে।

৪৮- ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ শুভ্র মুক্তা থেকে লাওহে মাহফুজ সৃষ্টি করেছেন। যার দুই পাশ হচ্ছে লাল ইয়াক্বূতের তৈরী। আর তার কলম হচ্ছে নূর। তার কিতাব হচ্ছে নূর। তার প্রস্থ আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী যা কিছু আছে, তার সমান। প্রতিদিন সেখানে তিনশত ষাটবার দৃষ্টি দেওয়া হয়, প্রতিটি দৃষ্টিতেই আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেন, রিযিক দেন, জীবন ও মৃত্যু দান করেন, ইযযত দান করেন এবং অপমানিত করেন আর তাঁর যা ইচ্ছা তিনি তাই করেন। আর তারই বর্ণনা হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “প্রতি দিনই তিনি কোনো না কোন কাজে রত থাকেন।” [আর-রহমান: ২৯]

হাদীসটি আব্দুর রাযযাক, ইবনুল মুনযির, তাববারানী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন।

ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেছেন: যখনই এই হাদীসগুলো ও এই অর্থে বর্ণিত অন্যান্য হাদীস উল্লেখ করা হত, তখন তিনি বলতেন:

এটা হচ্ছে ‘দৈনিক তাকদীর’, এর আগের তাকদীর হচ্ছে ‘বাৎসরিক তাকদীর’, তার আগে যেটি রয়েছে তা হচ্ছে ‘জীবন তাকদীর’, যা তাকে (রুহ ফুঁকে দেওয়া বা) জীবনদানের সময়ে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অনুরূপভাবে তার আগে যেটি রয়েছে, তা হচ্ছে তাকে মাংসপিণ্ড থেকে প্রথম সৃষ্টির সময়ের তাকদীর। তার আগে যেটি রয়েছে, তা হচ্ছে তাকে সৃষ্টির আগে তবে আসমান-যমীনের সৃষ্টির পরের তাকদীর। তার আগে যেটি রয়েছে, তা হচ্ছে আসমান-যমীনকে সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছরের আগের তাকদীর। এগুলোর প্রত্যেকটিই তার আগের তাকদীরের বিস্তৃতরূপ মাত্র।

আর এতে দলীল রয়েছে, মহান রব আল্লাহ তা‘আলার ইলম, কুদরত, হিকমত ইত্যাদির পূর্ণতার প্রমাণ। এবং ফেরেশতাগণ ও তার মুমিন বান্দাদের তাঁর নিজের সম্পর্কে এবং তাঁর নামসমূহের ব্যাপারে অধিক পরিচয় প্রদান করা।

তারপরে তিনি বলেছেন: এ সকল হাদীসসমূহ ও তার অনুরূপ হাদীসগুলো এ ব্যাপারে এক যে, পূর্বে নির্ধারিত তাকদীর আমলকে বাধা দেয় না এবং তাকদীরের উপরে নির্ভর করে বসে থাকাও আবশ্যক করে না; বরং তা প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম অব্যাহত রাখাকে আবশ্যক করে।

আর এ জন্যই যখন কতিপয় সাহাবী এটি শুনলেন, তখন বললেন: আমি ইতোপূর্বে এখনকার চেয়ে কখনো বেশি প্রচেষ্টা করিনি।

আবূ উসমান আন-নাহদী সালমানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: নিশ্চয় আমি আমার তাকদীরের প্রথম বিষয়ের প্রতি শেষ বিষয় অপেক্ষা বেশী খুশী।

আর তা এ কারণে যে, যখন আল্লাহর পক্ষ হতে তার জন্য কোনো পূর্ব নির্ধারিত বিষয় থাকে, আর তিনি তা ঐ ব্যক্তির জন্য প্রস্তুত করে দেন এবং উক্ত কাজের দিকে তাকে পৌঁছিয়ে দেন, তখন উক্ত পূর্ব নির্ধারিত বিষয় যা আল্লাহ আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন, তার ব্যাপারে আনন্দিত হওয়া তার পরবর্তীতে যে সকল উপায় আসবে তা (নিয়ে আনন্দিত হওয়া) অপেক্ষা বেশী।

৪৯- আল-ওয়ালিদ ইবনু উবাদাহ থেতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আমি আমার পিতার কাছে গমন করলাম, তিনি অসুস্থ ছিলেন, আমি তার মৃত্যুর আশংকা করলাম, আর আমি বললাম: হে আমার পিতা! আমার জন্য একটু কষ্ট করুন, আমাকে কিছু নসীহত করুন। তিনি বললেন: তোমরা আমাকে বসাও। যখন তারা তাকে বসালেন, তিনি বললেন: হে আমার পুত্র! তুমি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না, এবং আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার ব্যাপারে প্রকৃত জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ তুমি তাকদীরের ভাল-মন্দের উপরে ঈমান না আনবে। আমি বললাম: হে আমার পিতা! আমার জন্য তাকদীরের ভাল-মন্দ জানা কীভাবে সম্ভব হবে? তিনি বললেন: তুমি জানবে যে, যা তুমি পাওনি, তা তুমি কখনোই পেতে না। আর যা তুমি পেয়েছ, তা কখনো তোমার থেকে ছুটে যেত না। হে আমার পুত্র! আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“সর্বপ্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। তারপর তিনি বললেন: লেখ। তখন ঐ সময় থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, তা (কলম) লিখল।” হে আমার পুত্র! যদি তুমি মারা যাও, আর এটার উপরে না থাক, তবে তুমি জাহান্নামে যাবে।

এটি আহমাদ বর্ণনা করেছেন।

৫০- আবূ খুযামাহ তার পিতা -রদিয়াল্লাহু আনহু- হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি মনে করেন যে, আমরা যে ঝাঁড়-ফুঁক গ্রহণ করি অথবা ঔষধ হিসেবে যা গ্রহণ করি এবং রোগ প্রতিরোধে যে সতর্কতা গ্রহণ করি, তা আল্লাহর তাকদীর থেকে কোনো কিছুকে রদ করতে পারে?

তিনি বললেন: সেটাও আল্লাহর তাকদীরের অংশ।

হাদীসটি আহমাদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

৫১- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিকতর উত্তম ও পছন্দনীয়। তবে তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং যা তোমাকে উপকৃত করবে, তা অর্জনে তুমি আগ্রহী হও এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর। তুমি কখনো অক্ষম হয়ে যেও না। যদি তোমার কাছে কোন বিপদ আপতিত হয়, তাহলে এ কথা বলবে না: যদি আমি এমন এমন করতাম, তাহলে এমনটি হত না। বরং এ কথা বলবে: ‘আল্লাহ তা’আলা যা নির্দিষ্ট করেছেন এবং যা চেয়েছেন তাই করেছেন।” কেননা لَوْ (যদি) শব্দটি শয়তানের কাজকে উদ্বোধন করে বা খুলে দেয়।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।


 অধ্যায়: ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামদের বর্ণনা এবং তাদের প্রতি ঈমান

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “ভালো কাজ শুধু এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ব্যক্তি ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের উপরে।" আয়াত। [আল-বাকারাহ: ১৭৭]

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “নিশ্চয় যারা বলে: ‘আমাদের রব আল্লাহ’, তারপর তাতে অবিচল থাকে, তাদের কাছে নাযিল হয় ফেরেশতা (এ বলে) যে, 'তোমরা ভীত হয়ে না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও।” [ফুসসিলাত: ৩০]

আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মাসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় মনে করেন না এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণও না।” [আন-নিসা: ১৭২]

আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর আসমানসমূহ ও যমীনে যারা আছে তারা তাঁরই; আর তাঁর সান্নিধ্যে যারা আছে, তারা অহংকার-বশে তাঁর ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং বিরক্তি বোধও করে না।” (১৯) “তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে , তারা ক্লান্তও হয় না।” [আল-আম্বিয়া: ১৯-২০]

আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: (আল্লাহ) যিনি ফেরেশতাদেরকে রাসূল করেন যারা দুই দুই, তিন তিন অথবা চার চার পাখাবিশিষ্ট।” [ফাতির: ১]

আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চায়।” আয়াত। [মুমিন: ০৭]

৫২- আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

‘ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে অগ্নিশিখা থেকে। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই বস্তু থেকে, যা তোমাদেরকে বর্ণনা করা হয়েছে।’

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৫৩- কতিপয় মিরাজ সংক্রান্ত হাদীসের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বাইতুল মামুরকে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যা সপ্তম আসমানে রয়েছে। আরো বলা হয়েছে: তা ষষ্ঠ আকাশে, আর তা হচ্ছে দুনিয়ার কাবা শরীফের স্থলাভিষিক্ত। আর সেটি কাবার বরাবর আসমানে রয়েছে। এটির মর্যাদা হলো দুনিয়ার বুকে কাবার মর্যাদার ন্যায়। সেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে, তারপরে তাদের কেউই পরবর্তীতে আর সেখানে পুনরায় আসতে পারে না।

৫৪- আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘আসমানের মধ্যে একটি পায়ের স্থানও নেই, যেখানে কোনো ফেরেশতা সিজদা অবস্থায়, অথবা দন্ডায়মান অবস্থায় নেই। আর এটাই হল ফেরেশতাদের নিম্নের কথা ব্যাখ্যা।’ “আর আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান।” (১৬৫) “এবং আমরা অবশ্যই তাঁর পবিত্ৰতা ও মহিমা ঘোষনাকারী।” [সফফাত: ১৬৫-১৬৬]

মুহাম্মদ ইবন নছর এবং ইবন আবি হাতেম, ইবন জারীর ও আবুশ শায়েখ এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৫৫- জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে তাববরানী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন:

‘‘সাত আসমানে এক পা পরিমাণ স্থান নেই, আর না এক বিঘত ও এক মুঠো জায়গা রয়েছে, যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা দণ্ডয়মান অথবা সিজদারত অবস্থায় অথবা রুকু করা অবস্থায় নেই। যখন কিয়ামতের দিন আসবে তখন তারা সকলে বলবে: “আপনার মহান পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আমরা আপনার যথার্থভাবে ইবাদত করতে পারি নি, তবে শুধুমাত্র এতোটুকুই পেরেছি যে, আমরা আপনার সাথে কাউকে শরীক করি নি।”

৫৬- জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আরশ বহনকারী আল্লাহর ফেরেশতাদের থেকে একজন ফিরিশতা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে আমাকে বলা হয়েছে—তার কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত দূরত্ব হলো সাতশত বছরের রাস্তা।”

হাদীসটি আবু দাউদ, বাইহাকী তার ‘আল-আসমাউ ওয়াস সিফাত’ গ্রন্থে এবং দ্বিয়া (আল-মাকদেসী) তার ‘আল-মুখতারাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

আর তাদের নেতৃত্বের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন: জিবরীল আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা‘আলা তাকে গুণান্বিত করেছেন বিশ্বস্ত, উত্তম আখলাক এবং শক্তির দ্বারা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “তাকে শিক্ষা দান করেছেন প্ৰচণ্ড শক্তিশালী,” (৫) “সৌন্দর্যপূর্ণ সত্তা। অতঃপর তিনি স্থির হয়েছিলেন।” [আন-নাজম: ৫-৬]

জিবরীলের শক্তির প্রচণ্ডতার পরিচয় পাওয়া যায় এভাবে- তিনি লূত আলাইহিস সালামের কওমের শহরসমূহকে -যার সংখ্যা ছিল সাতটি- এবং তাতে থাকা সকল অধিবাসীকে -যাদের সংখ্যা প্রায় চার লক্ষ- এছাড়াও তাদের সাথে পশু-প্রাণী, উক্ত শহরসমূহে বিদ্যমান যমীন ও প্রাসাদসমূহ ইত্যাদি তার ডানার একটি প্রান্তে উত্তোলন করে আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন, যার ফলে ফেরেশতারা (আসমানে) তাদের কুকুরের ডাক ও মোরগের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। এরপরে তিনি তা উল্টিয়ে দিয়ে তাদের যমীনের উপরের অংশকে নিচে আর নিচের অংশকে উপরে করে দেন।

আর এটাই প্রমাণ করে- তিনি প্রচণ্ড শক্তিধর।

আল্লাহর বাণী: ذو مرة – এর অর্থ হচ্ছে: উত্তম আখলাক, দীপ্তি, উজ্জলতা এবং প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা তার এ অর্থে বলেছেন।

আর অন্যান্যরা বলেছেন: ذو مرة (সৌন্দর্যপূর্ণ সত্তা), তথা: শক্তির অধিকারী।

আল্লাহ তা‘আলা তার সিফাত সম্পর্কে বলেন: “নিশ্চয় এ কুরআন এক সম্মানিত রাসূলের (বাহিত) বাণী। (১৯) “যে সামর্থ্যশালী, আরশের মালিকের কাছে মর্যাদা সম্পন্ন, (২০) সে মান্য সেখানে, বিশ্বাসভাজন ।” [তাকভীর: ১৯-২১] অর্থাৎ তার রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও ক্ষমতা। আরশের অধিপতির কাছেও রয়েছে তার মর্যাদা ও উচ্চতম অবস্থান। “সে মান্য সেখানে, বিশ্বাসভাজন ।” তথা: সে ফেরেশতাদের কাছে মান্য বা অনুসৃত, মহা আমানতের অধিকারী; আর একারণেই তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের মধ্যকার দূত।

৫৭- তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসতেন, বিভিন্ন সিফাতে/ আকৃতিতে, তিনি তাকে দুইবার এমন অবস্থায় দেখেছিলেন, যে অবস্থায় আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন, আর তার ছয়শত ডানা ছিল।

হাদীসটি বুখারী ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন।

৫৮- ইমাম আহমাদ আব্দুল্লাহ (ইবন মাসঊদ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলকে তার প্রকৃতরূপে দেখেছিলেন, তখন তার ছয়শ ডানা ছিল। যার প্রতিটি ডানা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। তার ডানা হতে বিভিন্ন রঙের ইয়াকূত ও মণি-মুক্তা ঝরছিল, যার ব্যাপারে আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

এর সনদ শক্তিশালী।

৫৯- আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলকে একটি সবুজ পোষাকে দেখেছিলেন, যা আসমান ও যমীনের মধ্যবতী সকল কিছু জুড়ে ছিল।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৬০- আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“অবতরণ অবস্থায় আমি জিবরীলকে দেখেছি, সে দিগন্তদ্বয় (পূর্ব ও পশ্চিম) জুড়ে ছিল, আর তার উপরে একটি রেশমী কাপড় ছিল, যার সাথে ইয়াকূত ও মণি-মুক্তা লাগানো ছিল।”

এটি আবূশ শাইখ বর্ণনা করেছেন।

৬১- ইবনু জারীর ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, জিবরীল (অর্থ) আল্লাহর বান্দা, মিকাঈল (অর্থ) আল্লাহর ছোট বান্দা। আর প্রতিটি এমন নাম যাতে إِيل ‘ঈল’ শব্দটি রয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে: আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা।

৬২- তার অন্য একটি বর্ণনাতে অনুরূপ রয়েছে, যা তিনি আলী ইবনুল হুসাইনের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তবে সেখানে অতিরিক্ত রয়েছে: ‘ইসরাফীল (অর্থ) রহমানের বান্দা’।

৬৩- তাবরানী ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আমি কী তোমাদেরকে সর্বোত্তম ফেরেশতা সম্পর্কে সংবাদ দেব না? তিনি হচ্ছেন: জিবরীল।”

৬৪- আবূ ইমরান আল-জুওয়ানী হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: তার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একদা জিবরীল কাঁদতে কাঁদতে আসেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন:

“কোন বস্তু আপনাকে কাঁদাচ্ছে?”

তিনি বললেন: “আমি কেন কাঁদবো না? আল্লাহর কসম! আল্লাহ জাহান্নাম সৃষ্টি করার পর থেকে আমার চোখ কখনো শুকায়নি; এ ভয়ে যে, আমি আল্লাহর কোন অবাধ্যতা করে ফেলবো, আর তিনি তার কারণে আমাকে সেখানে নিক্ষেপ করবেন।”

ইমাম আহমাদ ‘আয-যুহদ’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৬৫- ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সূত্রে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: জিবরীলকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আপনি কি আমাদের সাথে যতটুকু সাক্ষাত করছেন তার চেয়ে বেশী সাক্ষাত করবেন না?”

তখন এই আয়াত নাযিল হল: “আমরা আপনার রবের আদেশ ব্যতীত অবতরণ করতে পারি না, আমাদের সামনে ও আমাদের পিছনে যা কিছু আছে তা সবই তাঁর।” আয়াত। [মারইয়াম: ৬৪]

আর তাদের নেতৃত্বের মধ্যে আরো অন্যতম হচ্ছেন: মিকাঈল আলাইহিস সালাম, তিনি হচ্ছেন বৃষ্টিপাত ও উদ্ভিদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।

৬৬- ইমাম আহমাদ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করে বলেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলকে বলেছেন:

“আমি মীকাঈলকে কখনো হাসতে দেখিনি কেন? তিনি বললেন: জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে মীকাঈল আর কখনো হাসেন নি।”

আর তাদের নেতৃত্বের মধ্যে আরো অন্যতম হচ্ছেন: ইসরাফীল আলাইহিস সালাম, তিনি একজন আরশ বহনকারী ফেরেশতা। আর তিনিই শিঙ্গাতে ফুঁ দিবেন।

৬৭- তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। হাকিমও আবূ সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“কীভাবে আমি আয়েশ করতে পারি? অথচ শিঙ্গাওয়ালা (ইসরাফীল) শিঙ্গা মুখে ধরে কান পেতে রয়েছেন আর অপেক্ষা করছেন যে, কখন তাকে আদেশ দেওয়া হবে, আর সাথে সাথে তিনি তাতে ফূঁ দিবেন।”

সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আমরা কী বলবো?

তিনি বললেন: তোমরা বলবে: حَسْبُنَا اللّٰهُ وَ نِعْمَ الْوَكِيْلُ,عَلَى اللّٰهِ تَوَكَّلْنَا, যার অর্থ: “আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক, আমরা তাঁর উপরই তাওয়াক্কুল করেছি।”

৬৮- ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহর আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের মধ্যে একজন রয়েছেন যার নাম ইসরাফীল, আরশের কোণাগুলোর একটি কোণা তার কাঁধের উপরে। আর তার দুই পা সাত যমীনের তলদেশ ভেদ করেছে। আর তার মাথা সপ্ত আসমানের উচুঁ ভেদ করেছে।”

আবূ নু‘আইম তার ‘হিলইয়াহ’ এবং আবুশ শায়খ এটি বর্ণনা করেছেন।

৬৯- আওযাঈ হতে আবুশ শায়খ বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে ইসরাফীলের চেয়ে সুন্দর আওয়াজের আর কেউ নেই। তিনি যখন তাসবীহ (আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা) করেন, তখন সাত আসমানের অধিবাসীদের তাসবীহ এবং সালাত বন্ধ হয়ে যায়।

তাদের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আরো রয়েছেন: মালকুল মাওত (মৃত্যুর ফেরেশতা) আলাইহিস সালাম।

কুরআন ও সহীহ হাদীসে তার নাম সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু আসেনি। তবে ইবনু কাছীর বলেছেন: কিছু হাদীসে তাকে ‘আযরাঈল’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন। তিনি আরো বলেছেন: তাদেরকে যে কাজের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে, সেদিক হতে তারা কয়েক প্রকার:

তাদের মধ্যে কেউ কেউ রয়েছেন: আরশ বহনকারী।

তাদের মধ্যে রয়েছেন কারূবীন, যারা আরশের পাশে থাকেন, তারাও আরশ বহনকারীদের সাথে সবচেয়ে সম্মানিত ফেরেশতাদের মধ্যে গণ্য। আর তারাই হচ্ছেন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা। যেমন আল্লাহ বলেছেন: “মাসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় মনে করেন না, এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণও না।” [আন-নিসা: ১৭২]

তাদের মধ্যে আরো রয়েছেন: সাত আসমানকে রাত-দিন ও সকাল-সন্ধ্যা ইবাদাতের মাধ্যমে আবাদ রাখা ফেরেশতাগণ। যেমন আল্লাহ বলেছেন: “তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেন, তারা ক্লান্তও হয় না।” [আল-আম্বিয়া: ২০]

তাদের মধ্যে আরো রয়েছেন: যারা একের পর এক বাইতুল মা‘মূরে প্রবেশ করেন।

আমি বলি: স্পষ্ট কথা হচ্ছে, যারা একের পর এক বাইতুল মা‘মূরে প্রবেশ করেন, তারাই আসমানের অধিবাসী ফেরেশতাবৃন্দ।

তাদের মধ্যে আরো রয়েছেন: জান্নাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ। জান্নাতীদের মর্যাদা রক্ষণাবেক্ষণ, জান্নাতীদের আতিথিয়তা বা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা, যেমন: পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পানীয়, অলঙ্কারাদি বা অনুরূপ অন্যান্য বস্তুসমূহ, যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি আর না কোন মানুষের অন্তরে কখনো তার কল্পনা এসেছে।

তাদের মধ্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুনের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ, আল্লাহ আগুন থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। তারা হচ্ছে: ‘যাবানিয়াহ’ [মানুষকে জাহান্নামে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত], তাদের অগ্রভাগে থাকবে ঊনিশজন। আর জাহান্নামের প্রধান প্রহরী হবে মালেক। সে সকল প্রহরীদের আগে থাকবে। যাদের বর্ণনা আল্লাহর এই বাণীর মধ্যে রয়েছে: “আর যারা আগুনের অধিবাসী হবে তারা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে, ‘তোমাদের রবকে ডাক, তিনি যেন আমাদের থেকে শাস্তি লাঘব করেন এক দিনের জন্য।” [আল-মুমিনূন: ৪৯] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “তারা চিৎকার করে বলবে: ‘হে মালেক, তোমার রব যেন আমাদেরকে নিঃশেষ করে দেন।’ সে বলবে: ‘নিশ্চয় তোমারা অবস্থানকারী হবে।’’ [যুখরুফ: ৭৭] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “যেখানে নিয়োজিত আছে নির্মম-কঠোর ফেরেশতাগণ, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন তা তারা অমান্য করে না। আর তারা যা করতে আদেশপ্ৰাপ্ত হয় তাই করে।” [আত-তাহরীম: ৬] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “তার উপরে রয়েছে ঊনিশজন (প্রহরী)। আর আমি তো জাহান্নামের প্রহরী কেবল ফেরেশতাদেরকেই করেছি” এখান থেকে “আর আপনার রবের সৈন্য-সামন্ত সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউই জানে না।” এ পর্যন্ত। [আল-মুদ্দাচ্ছির: ৩০-৩১]

তাদের মধ্যে আরো রয়েছেন: বানী আদমকে হিফাজতের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “আর মানুষের জন্য রয়েছে তার সামনে এবং পিছনে একের পর এক আগমনকারী প্রহরীগণ, তারা আল্লাহর আদেশে তার হিফাজত করে।” [আর-রা‘দ: ১১]

ইবনু আব্বাস বলেছেন: সামনে এবং পিছন থেকে মানুষকে হিফাজত করতে থাকে এমন একদল ফেরেশতা রয়েছেন, যখন (মৃত্যুর ব্যাপারে) আল্লাহর আদেশ চলে আসে তখন তারা তাকে ছেড়ে চলে যায়।

মুজাহিদ বলেছেন: প্রতিটি বান্দারই জিন, মানুষ ও ক্ষতিকর প্রাণী হতে হিফাজতের জন্য একজন করে ফেরেশতা রয়েছেন, যা ঘুমের মধ্যে ও জাগ্রত অবস্থায়ও হয়ে থাকে। উক্ত কোনো বিপদ তার উদ্দেশ্যে আসলেই সে বিপদকে বলে: তোমার পিছনে যাও, তবে এমন বিপদ ছাড়া যার ব্যাপারে আল্লাহ অনুমতি দেন আর তা তার উপরে আপতিত হয়।

তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন, যারা বান্দার আমলসমূহের হিফাজত করেন; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “যখন তার ডানে ও বামে বসা দু’জন ফেরেশতা পরস্পর (তার আমল লিখার জন্য) গ্ৰহণ করে; (১৭) সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে।” [কাফ: ১৭-১৮] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “আর নিশ্চয় নিয়োজিত আছেন তোমাদের উপর সংরক্ষকদল; (১০) সম্মানিত লেখকবৃন্দ (১১) তারা জানে তোমরা যা কর।” [আল-ইনফিতার: ১০-১২]

৭০- বাযযার ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সূত্রে বর্ণনা করে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে উলঙ্গ হওয়া থেকে নিষেধ করছেন, তোমরা আল্লাহর এমন ফেরেশতাদের থেকে লজ্জাবোধ কর যারা তোমাদের সাথেই থাকে। তারা হচ্ছেন সম্মানিত লেখকবৃন্দ, যারা তিন অবস্থার যে কোন একটি না হলে, তোমাদেরকে ছেড়ে যায় না, তিনটি অবস্থা হচ্ছে: পায়খানা করার সময়ে, জুনুবী অবস্থায় এবং গোসলের সময়ে। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন খোলা জায়গাতে গোসল করবে, তখন সে যেন তার কাপড় দিয়ে অথবা গাছের মূল অথবা অন্য কিছু দিয়ে পর্দা টানিয়ে নেয়।”

হাফেজ ইবনে কাছীর বলেছেন: ফেরেশতাদেরকে সম্মান করার অর্থ হচ্ছে তাদের থেকে লজ্জাবোধ করা, তাদেরকে তারা যা লিপিবদ্ধ করে, তাতে কোন মন্দ কাজ লিখতে বাধ্য না করা; যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের আখলাক ও আচরণের ব্যাপারে সম্মানিত করে।

এরপরে তিনি বলেছেন, যার অর্থ: তাদের সম্মানের মধ্যে রয়েছে, তারা এমন বাড়ীতে প্রবেশ করেন না, যেখানে কোন কুকুর থাকে, অথবা কোন ছবি থাকে, অথবা কোন জুনুবী ব্যক্তি থাকে, অথবা কোন মূর্তি থাকে। তারা এমন কারো সঙ্গী হন না, যাদের সাথে কুকুর থাকে অথবা কোন ঘণ্টা থাকে।

৭১- মালিক, বুখারী এবং মুসলিম আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“একের পর এক তোমাদের কাছে রাতের ফেরেশতা এবং দিনের ফেরেশতা আসতে থাকে, তারা ফজরের সালাতে এবং আছরের সালাতে একত্রিত হয়, তারপরে যারা তোমাদের কাছে রাতে ছিল তারা আল্লাহর দিকে উত্থিত হয়। তিনি সবচেয়ে ভাল জানা সত্ত্বেও তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন: আমার বান্দাদেরকে তোমরা কেমন অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? তারা জবাবে বলেন: আমরা তাদেরকে সালাতরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি, আবার তাদের কাছে যখন আগমন করেছি তখনো তারা সালাতরত অবস্থায় ছিল।”

৭২- অপর বর্ণনায় রয়েছে, আবূ হুরায়রা বলেছেন: ইচ্ছা হলে তোমরা পাঠ করো: “আর ফজরের কুরআন পাঠ; নিশ্চয় ফজরের কুরআন পাঠ উপস্থিতির সময়।” [আল-ইসরা: ৭৮]

৭৩। ইমাম আহমাদ ও মুসলিম একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন:

“যখনই কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহসমূহের মধ্য হতে কোনো একটি গৃহে একত্রিত হয়, তারপরে তারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং পরষ্পরে (কুরআন-হাদীস) অধ্যয়ন করতে থাকে, তখন তাদের উপর সাকীনাহ বা শান্তিধারা নাযিল হয়। আর রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। আর আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তীদের কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন। আর যে লোককে তার আমল পিছিয়ে দেবে, তার বংশ-মর্যাদা তাকে অগ্রসর করতে পারবে না।”

৭৪- সুনান ও মুসনাদে একটি হাদীস রয়েছে:

“নিশ্চয় ফেরেশতাগণ ইলম অণ্বেষণকারীর কাজে খুশি হয়ে তাদের জন্যে ডানা বিছিয়ে দেন।”

আর ফেরেশতাদের আলোচনা সম্বলিত হাদীসের সংখ্যা অনেক অনেক।


 অধ্যায়: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের ব্যাপারে অসীয়ত

আল্লাহর বাণী: “তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যা নাযিল করা হয়েছে, তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবকরূপে অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর।” [আল-আ‘রাফ: ৩]

৭৫- যাইদ ইবনু আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিলেন, তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং তাঁর তারিফ করলেন। তারপরে তিনি বললেন:

“অতপর; সাবধান, হে মানুষ সকল! নিশ্চয় আমি মানুষ। অচিরেই আমার রবের দূত (রাসূল) আসবে আর আমি সাড়া দেব। আর আমি তোমাদের মধ্যে দুটি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি: প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (কুরআন), যাতে রয়েছে হিদায়াত ও নূর, সুতরাং তোমরা আল্লাহর কিতাবকে ধারণ করো আর তাকে আঁকড়ে থাকো।” তিনি আল্লাহর কিতাবের উপরে বিশেষ তাকীদ দিলেন আর বললেন: “আহলে বাইত’ তথা আমার পরিবারের সদস্যদের।” অন্য বর্ণনাতে এসেছে: “আল্লাহর কিতাব হচ্ছে আল্লাহর সুদৃঢ রজ্জু, যে তা ধারণ করবে, সে হিদায়াতের উপরে থাকবে। আর যে তাকে ছেড়ে দেবে, সে ভ্রান্তির উপরে থাকবে।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৭৬- মুসলিম জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি লম্বা হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিনে খুতবাবার মধ্যে বলেছেন যে,

“আমি তোমাদের মধ্যে এমন বস্তু রেখে গেলাম, তা আঁকড়ে থাকলে তোমরা পথচ্যুথ হবে না। তা হচ্ছে: আল্লাহর কিতাব। আর তোমরা আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে, তোমরা তখন কী বলবে? সাহাবীরা বললেন: আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি পৌঁছে দিয়েছেন, (আমানত) আদায় করেছেন এবং নসীহত করেছেন। তখন তিনি আকাশের দিকে তার শাহাদাত আঙুল উঁচু করে মানুষের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন: “হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকেন” তিনি এ কথা তিনবার বললেন।

৭৭- আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“সাবধান! অচিরেই ফিতনা শুরু হবে।”

আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! সেখান থেকে কীসে মুক্তি দেবে?

তিনি বলেছেন: “আল্লাহর কিতাবে রয়েছে: তোমাদের আগেকার সংবাদ এবং তোমাদের পরের খবর ও তোমাদের মধ্যকার বিচার। এটিই চূড়ান্ত ফয়সালা। কোন ঠাট্টার বিষয় নয়, যে এটিকে অহঙ্কারের কারণে পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিবেন। আর যে এটি বাদে অন্য কিছু থেকে হিদায়াত অন্বেষণ করবে আল্লাহ তাকে গোমরাহ করে দিবেন। এটা আল্লাহর সুদৃঢ় রজ্জু, এটা প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ, এটাই সিরাতে মুস্তাকীম (সুদৃঢ় পথ), এটা দ্বারা চিন্তা বিপথগামী হবে না এবং জিহ্বাও তার দ্বারা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হবে না, আলিমগণ এটা থেকে তৃপ্ত হয় না (বরং আগ্রহ থেকেই যায়), বারবার পড়লেও এটা পুরাতন মনে হবে না, আর এর বিস্ময় কখনো শেষ হবে না। আর এটাই সেই কিতাব, যা শোনা মাত্রই জিনেরা বলেছিল: “নিশ্চয় আমরা আশ্চর্য এক কুরআন শুনেছি। (১) যা সৎপথের দিকে হিদায়াত করে, সুতরাং আমরা তার উপরে ঈমান এনেছি।” [আল-জিন: ১-২] যে এটার মাধ্যমে কথা বলবে, সে সত্য বলবে। যে সে অনুযায়ী কাজ করবে, সে পৃরষ্কার পাবে। যে সেটা দ্বারা ফয়সালা করবে, সে ন্যায় করবে। আর যে সেদিকে আহ্বান করবে তাকে সিরাতুম মুস্তাকীম তথা সরল-সুদৃঢ় পথের নির্দেশনা প্রদান করা হবে।

হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন: এটি গরীব হাদীস।

৭৮- আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“যা আল্লাহর কিতাবে আল্লাহ হালাল করেছেন তা হালাল। আর যা তিনি হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে ব্যাপারে তিনি চুপ থেকেছেন, তা অনুগ্রহ। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহকে গ্রহণ কর; কেননা আল্লাহ কোন জিনিসই ভুলে যাননি। এরপরে তিনি তেলাওয়াত করেছেন: “আর তোমার রব ভুলে যাননি।” [মারইয়াম: ৬৪]

তাববরানী, ইবনু আবী হাতিম ও বাযযার এটি বর্ণনা করেছেন।

৭৯- ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ সিরাতুম মুস্তাক্বীমের (সরল-সুদৃঢ় পথের) উদাহরণ পেশ করেছেন। যার দুই দিকে দুইটি দেয়াল রয়েছে। দেয়াল দুইটিতে অনেকগুলো খোলা দরজা রয়েছে এবং দরজাসমূহে পর্দা টানানো রয়েছে। পথের মাথায় একজন আহবানকারী রয়েছে, যে বলতে থাকে, তোমরা এই পথে দৃঢ় থাকো, কোনো বক্রতার দিকে যেও না। আর এ আহবানকারীর উপরে আরো একজন আহবানকারী রয়েছে। যখনই কোন বান্দা সে দরজাগুলোর কোন একটি দরজা খুলতে চায়, তখনই সে বলে: সর্বনাশ! এ দরজা খুলো না। যদি তুমি এটা খুলে ফেল, তাহলে ভিতরে ঢুকে যাবে।”

এরপরে আল্লাহর রাসূল ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন যে, এই সিরাত বা পথ হচ্ছে ইসলাম, খোলা দরজাসমূহ হচ্ছে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়সমূহ। সামনে টানিয়ে রাখা পর্দা হচ্ছে আল্লাহর হদসমূহ বা সীমারেখা। পথের মাথার আহবানকারী হচ্ছে কুরআন, আর তার উপরের আহবানকারী হচ্ছে, প্রতিটি মুমিনের অন্তরে থাকা আল্লাহর পক্ষ থেকে নসীহতকারী।

হাদীসটি রাযীন বর্ণনা করেছেন। আহমাদ ও তিরমিযী নাওয়াস ইবনু সাম‘আন হতে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

৮০- আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন: “আর তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন, এর মধ্যে রয়েছে মুহকামাত আয়াতসমূহ, এগুলোই কিতাবের মূল।” তারপরে তিনি আল্লাহর বাণী হতে এ পর্যন্ত তেলাওয়াত করেন: “জ্ঞানী সম্প্রদায় ছাড়া আর কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না।” [আলে ইমরান: ৭]

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেছেন: তিনি বলেছেন:

“যখন তোমরা এমন কাউকে দেখবে, যারা মুতাশাবিহাত আয়াতের পেছনে ছুটে, তাহলে জেনে রেখ! তাদের কথাই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে তোমরা সাবধান থাকবে।”

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি

৮১- আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেছেন: আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দাগ টানলেন তার নিজ হাত দিয়ে, তারপরে বললেন:

“এটি আল্লাহর পথ” তারপরে তিনি তার ডানে এবং বামে একটি করে দাগ টানলেন। আর বললেন: “এগুলো অন্যান্য পথসমূহ। প্রতিটি পথের উপরেই একটি করে শয়তান আছে, যে সেদিকে আহ্বান করতে থাকে।” এরপরে তিনি পড়লেন: “আর এ পথই আমার সরল পথ। কাজেই তোমরা এর অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমারা তাকওয়ার অধিকারী হও।’ [আল-আন‘আম: ১৫৩]

এটি আহমাদ, দারিমী ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন।

৮২- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু সাহাবী তাওরাত থেকে লিখে নিত। যখন তারা এটা আল্লাহর রাসূলের কাছে বললেন: তখন তিনি বললেন:

“সবচেয়ে বোকাদের বোকা ও সবচেয়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে একটি এমন দল, যারা তাদের নবীর উপরে নাযিল হওয়া বিষয় থেকে অন্য নবীর উপরে এবং তাদের জাতি রেখে অন্য জাতির উপরে নাযিল হওয়া বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে।” তারপরে আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করলেন: “এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমরা আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে তো অবশ্যই অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ঈমান আনে।” [আল-আনকাবূত: ৫১]

ইসমাঈলী তার ‘মু‘জাম’ গ্রন্থে এবং ইবনু মারদাওয়াই বর্ণনা করেছেন।

৮৩- আব্দুল্লাহ ইবনু ছাবিত ইবন আল-হারিছ আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “একদা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একটি কিতাব নিয়ে আসলেন যাতে তাওরাতের কিছু অংশ লিপিবদ্ধ ছিল, তখন তিনি বললেন: আমি আহলে কিতাবদের মধ্য হতে এক ব্যক্তির সাথে এ ব্যাপারে জয়ী হয়েছি, যা আমি আপনার সামনে পেশ করছি। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা কঠিনভাবে বদলে গেল, যেমনটি ইতোপূর্বে আমি কখনো দেখিনি। আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিস উমার -রাদিয়াল্লাহু আনহুমা- কে উদ্দেশ্য করে বললেন: আপনি কি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা দেখেননি?! তখন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আমরা আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দীন হিসেবে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় আনন্দ দেখা দিল। আর তিনি বললেন:

“যদি মূসাও অবতরণ করতেন, আর তোমরা আমাকে ছেড়ে তার অনুসরণ করতে, তবুও তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে। নবীদের মধ্য হতে আমি তোমাদের অংশ (নবী), আর উম্মাতদের মধ্য থেকে তোমরাই আমার অংশ (উম্মত)।”

এটি আব্দুর রাযযাক, ইবনু সা‘দ এবং হাকিম এটিকে “আল-কুনা” নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

 অধ্যায়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারসমূহ

আল্লাহ তা‘আলারর বাণী: “হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, আর তোমাদের শাসকদেরও ।” [আন-নিসা: ৫৯] আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।” [আন-নূর: ৫৬] আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও।” আয়াত। [আল-হাশর: ৭]

৮৪- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমাকে লোকেদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে; যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি ও আমি যা নিয়ে এসছি তার প্রতি ঈমান আনবে। যখন তারা এ কাজগুলো সম্পাদন করবে, তখন তারা আমার নিকট থেকে তাদের রক্ত (জান) এবং মাল সংক্রান্ত নিরাপত্তা লাভ করবে; কিন্তু ইসলামের হক ব্যতীত। আর তাদের হিসাব আল্লাহর ওপর ন্যস্ত হবে।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৮৫- বুখারী ও মুসলিম আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে, সে তার দ্বারা ঈমানের সুমিষ্টতা লাভ করে: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে অধিক প্রিয় হবে; কাউকে ভালোবাসলে কেবল আল্লাহ’র জন্যই ভালবাসবে। আর কুফরী থেকে তাকে আল্লাহর বাঁচানোর পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করবে, যেমন সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।”

৮৬- বুখারী ও মুসলিমে তার থেকে (আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু) মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না; যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান, তার পিতা ও সকল মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই।”

৮৭- মিকদাম ইবন মা‘দীকারিব আল-কিন্দী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“অচিরেই কোন ব্যক্তি তার আসনে হেলান দেওয়া অবস্থায় থাকবে আর তার সামনে আমার হাদীস থেকে কোন একটি হাদীস বর্ণনা করা হলে সে বলবে: আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব রয়েছে। আমরা তাতে যা হালাল পাবো, তাকেই হালাল গণ্য করবো। আর তাতে যা হারাম পাবো তাকেই হারাম গণ্য করবো। [তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:] সাবধান! নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যা হারাম করেছেন, তা আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারই অনুরূপ (সত্য)।”

এটি তিরমিযী ও ইবন মাযাহ বর্ণনা করেছেন।


 অধ্যায়: আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর সাথে থাকা ও এর ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান। ইখতিলাফ, দলে দলে বিভক্ত হওয়া এবং বিদ‘আতকে পরিত্যাগ করার ব্যাপারে উৎসাহ দান এবং এগুলোর ব্যাপারে সতর্ককরণ

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আর্দশ, তার জন্য যে আসা রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের এবং আল্লাহ্কে বেশী স্মরণ করা।” [আল-আহযাব: ২১] আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে, তাদের ব্যাপারে তোমার কোনো দায়িত্ব নেই।” [আল-আন‘আম: ১৫৯]

আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “তিনি তোমাদের জন্য দীন নির্ধারণ করেছেন, যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে। আর যা আমরা অহী হিসেবে নাযিল করেছি তোমার কাছে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকেও। এ বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি করো না।” [আশ-শুরা: ১৩]

৮৮- আল-ইরবাধ ইবনে সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা আমাদেরকে অতি উত্তম ভাষায় উপদেশ দিলেন, যাতে চোখ অশ্রু ঝড়াল, অন্তরসমূহ প্রকম্পিত হল। তখন একজন বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে এটি আপনার বিদায়ী ভাষণ। সুতরাং আপনি আমাদেরকে কী উপদেশ দিবেন? তিনি বললেন: “আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারে, শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার ব্যাপারে, যদিও তোমাদের উপরে একজন ক্রীতদাসকে আমীর বানানো হয়। আমার পরে তোমাদের মধ্য হতে যে বেঁচে থাকবে, সে অচিরেই অসংখ্য মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমাদের উপরে আবশ্যক হবে আমার সুন্নাত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদ্বীনের সুন্নাত পালন করা। আর তোমরা তা দাঁত দিয়ে শক্তভাবে কামড়ে ধরবে। অবশ্যই তোমরা নতুন সৃষ্ট (বিদ‘আতী) কাজ পরিহার করবে। কারণ প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”

এটি আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী এটিকে সহীহ বলেছেন।

তার (আল-ইরবাধ ইবনে সারিয়ার) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে,

“আমি তোমাদেরকে রেখে যাচ্ছি এমন শুভ্রতার উপরে, যার রাতও দিনের ন্যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত ছাড়া কেউই এখান থেকে বিচ্যুত হবে না। আর আমার পরে যে বেঁচে থাকবে, সে অচিরেই অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে।”

এরপরে তিনি উক্ত অর্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৮৯- মুসলিমে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“অতঃপর: নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। সবচেয়ে উত্তম হিদায়াত হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত। সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে নতুন তৈরী করা কাজ (বিদ‘আত), আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”

৯০- আর বুখারীর বর্ণনাতে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আমার উম্মাতের প্রত্যেকেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যে অস্বীকার করবে, সে নয়।”

জিজ্ঞাসা করা হল: কে অস্বীকার করেছে?

তিনি বললেন: “যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে, সে অস্বীকার করবে।”

৯১- বুখারী ও মুসলিমে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “তিনজনের একটি দল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের কাছে আসলেন। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। যখন তাদেরকে এ ব্যাপারে জানানো হলো, তখন তারা ইবাদাতের পরিমাণকে কম মনে করলেন এবং বললেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আমাদের অবস্থা কোথায়? কারণ, তাঁর আগের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তারপরে তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন: আমি রাতভর সালাত আদায় করব। অপর একজন বললেন: আমি সব সময় সিয়াম পালন করব এবং কখনো তা বাদ দেব না। অপরজন বললেন: আমি নারীদের থেকে দূরে থাকব, আর কখনো বিয়ে করব না। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট আসলেন এবং বললেন: ‘‘তোমরা কি ঐ সব লোক যারা এমন এমন কথা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশি তাকওয়াবান; অথচ আমি সিয়াম পালন করি, আবার তা বাদ দিয়েও থাকি। সালাত আদায় করি এবং ঘুমাই। নারীদেরকে বিয়েও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়।”

৯২- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“ইসলাম অপরিচিত অবস্থাতে শুরু হয়েছে, আর অচিরেই তা অপরিচিত হয়ে যাবে, যেভাবে তা শুরু হয়েছিল। সুতরাং অপরিচিতদের জন্য সুসংবাদ।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

৯৩- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“তোমাদের কেউ ঈমানাদর হতে পারবে না; যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত আদর্শের অধীন হয়।”

বাগভী এটি (শারহুস সুন্নাহ)-তে বর্ণনা করেছেন এবং নববী তা সহীহ বলেছেন।

৯৪- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “বনী ইসরাঈল যে অবস্থায় উপনীত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, জুতোর একটি যেভাবে আরেকটির মতো হয়। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উম্মতের মধ্যে হতেও কেউ কেউ তাই করবে। আর বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। তারা সকলেই জাহান্নামী, তবে একটি দল ব্যতীত।”

সাহাবীরা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা?

তিনি বললেন: “আমি এবং আমার সাহাবীরা যার উপরে আছে।”

এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

৯৫- মুসলিমে মারফূ হিসেবে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,

“যে ব্যক্তি কোনো সৎপথের দিকে আহ্বান করবে, সে তার অনুসরণকারীদের সমান সাওয়াব পাবে। এটা তাদের সাওয়াবসমূহ থেকে কিছুই কম করবে না। আর যে ব্যক্তি কোনো ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে, তার উপর তার সমস্ত অনুসারীদের গোনাহ বর্তাবে।এটা তাদের গোনাহসমূহ থেকে কিছুই কম করবে না।”

৯৬- মুসলিমে আবূ মাসঊদ আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন: সে (উটটি) আমাকে নিয়ে অচল হয়ে গিয়েছে, আপনি একটি বাহনের ব্যবস্থা করে দিন। তখন তিনি বললেন: আমার কাছে নেই। তখন আরেকজন বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে দেখিয়ে দিচ্ছি এমন একজনকে যে তাকে বাহন দিতে পারবে। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

“যে ব্যক্তি কোনো কল্যাণের পথ দেখালো, তার জন্য রয়েছে আমলকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব।”

৯৭- আমর ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“যে ব্যক্তি আমার কোনো মৃত সুন্নাত (সমাজ থেকে উঠে যাওয়ার) পরে তাকে জীবিত করবে, তার জন্য ঐ পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে, যে পরিমাণ সাওয়াব তার উপরে আমল করা মানষেরা পাবে। তবে এতে তাদের থেকে কোনো সাওয়াব কমতি করা হবে না। আর যে ব্যক্তি কোনো এমন বিদ‘আত চালু করবে, যার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট নন, তার উপরে ঐ পরিমাণ গুনাহ বর্তাবে, যে পরিমাণ গুনাহ উক্ত কাজে জড়িত মানুষেরা করবে, তবে তাতে উক্ত ব্যক্তিদের গুনাহ হতে কোনো কমতি করা হবে না।”

এটি তিরমিযী বর্ণনা করে হাসান বলেছেন, এবং ইবন মাযাহও বর্ণনা করেছেন। আর এটি তার বর্ণিত শব্দ:

৯৮- আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

“তোমাদের কী হবে, যখন তোমাদেরকে ফিতনা গ্রাস করে ফেলবে, যার মধ্যে ছোটরা বড় হবে ও বড়রা বৃদ্ধ হবে। ঐ ফিতনাকে সুন্নাত হিসেবে গ্রহণ করা হবে; যদি তাতে কোনো পরিবর্তন করা হয়, তখন বলা হবে: ‘সুন্নাতকে বর্জন করা হল।’ বলা হল: হে আবূ আব্দুর রহমান! সেটা কখন হবে? তিনি বললেন: যখন তোমাদের কারীর (পাঠকের) সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আর তোমাদের ফকীহদের সংখ্যা কমে যাবে। তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে আর তোমাদের আমানতদারীর সংখ্যা কমে যাবে, আখেরাতের কাজের বিনিময়ে দুনিয়া তলব করা হবে, আর দীন ব্যতিরেকে অন্য কারণে বা বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা হবে।”

এটি দারিমী বর্ণনা করেছেন।

৯৯- যিয়াদ ইবন হুদাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাকে বলেছেন: “কোন বস্তু ইসলামকে ধ্বংস করে, তুমি কি জান? আমি বললাম: না। তিনি বললেন: ইসলামকে ধ্বংস করে: আলিমের বিভ্রান্তি, কিতাব নিয়ে মুনাফিকের বাদানুবাদ এবং পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসন।”

এটিও দারিমী বর্ণনা করেছেন।

১০০- হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “প্রতিটি এমন ইবাদাত, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ ইবাদাত মনে করেননি, তোমরা উক্ত ইবাদাত করবে না। কেননা প্রথম যুগের মানুষেরা পরবর্তীদের জন্য কোনো কথাই বাদ দেননি। সুতরাং হে কারী সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর তোমাদের পূর্ববর্তীদের পথকেই গ্রহণ করো।”

এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

১০১- ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি কারো অনুসারী হবে, সে যেন যারা মারা গেছে তাদের অনুসারী হয়; কেননা জীবিত ব্যক্তি ফিতনাহ হতে নিরাপদ নয়। আর তারা (মৃত ব্যক্তিরা) হচ্ছেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ। তারাই এ উম্মাতের সর্বশ্রেষ্ট ব্যক্তি, সবচেয়ে নেক অন্তরের অধিকারী, সবচেয়ে গভীর জ্ঞানী ও কৃত্রিমতা বর্জনকারী। আল্লাহ তাদেরকে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাঁর নবীর সঙ্গী হিসেবে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা তাদের মর্যাদা সম্পর্কে জানো, তাদের পথ অনুসরণ কর, তাদের জীবন চরিত ও চরিত্রকে সাধ্যমত আঁকড়ে ধর; কেননা তারা ছিলেন সরল-সুদৃঢ় হিদায়াতের উপরে।

এটি রাযীন বর্ণনা করেছেন।

১০২- আমর ইবন শু‘আইব, তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করে বলেছেন যে: “একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দল সম্পর্কে শুনলেন, তারা পরস্পর কুরআন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত রয়েছে। তখন তিনি বললেন: নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছিল। তারা আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের উপরে পেশ করত (তা বাতিল করার জন্য)। অথচ আল্লাহর কিতাব নাযিল হয়েছে তার এক অংশ অন্য অংশের সত্যায়নকারী হিসেবে, সুতরাং তোমরা এর এক অংশকে অন্য অংশের দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করো না। বরং তোমরা যা জানো, তা-ই বলো, আর যা তোমরা জানো না, তা কুরআনের আলিমের দিকে সোপর্দ কর।”

এটি আহমাদ ও ইবন মাযাহ বর্ণনা করেছেন।


 অধ্যায়: ইলম অন্বেষণের উপরে তাকিদ এবং অন্বেষণের পদ্ধতি

১০৩- এই অধ্যায়ে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে কবরের আযাব সম্পর্কে বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে: “নিয়ামত প্রাপ্ত ব্যক্তি বলবে: আমাদের কাছে হিদায়াত এবং সুস্পষ্ট দলিল নিয়ে তিনি আগমন করেছিলেন, আর আমরা ঈমান এনেছিলাম, তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং অনুসরণ করেছিলাম। আর আযাব প্রাপ্ত ব্যক্তি বলবে: আমি মানুষকে বলতে শুনেছিলাম আর সেটাই বলেছিলাম।”

১০৪- আর সহীহ বুখারী ও মুসলিমে মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দীনের গভীর ‘ইলম দান করেন।”

১০৫- বুখারী ও মুসলিমে আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

‘‘যে সরল পথ ও জ্ঞান দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা ঐ বৃষ্টি সদৃশ যা যমীনে পৌঁছে। অতঃপর তার উর্বর অংশ নিজের মধ্যে তা শোষণ করে। অতঃপর তা ঘাস এবং প্রচুর শাক-সবজি উৎপন্ন করে এবং তার এক অংশ চাষের অযোগ্য (খাল জমি); যা পানি আটকে রাখে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারা মানুষকে উপকৃত করেন। সুতরাং তারা তা হতে পান করে এবং (পশুদেরকে) পান করায়, জমি সেচে ও ফসল ফলায়। তার আর এক অংশ শক্ত সমতল ভূমি; যা না পানি শোষণ করে, না ঘাস উৎপন্ন করে। এই দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির যে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করল এবং আমি যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার দ্বারা আল্লাহ তাকে উপকৃত করলেন। সুতরাং সে (নিজেও) শিক্ষা করল এবং (অপরকেও) শিক্ষা দিল। আর এই দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তিরও যে এ ব্যাপারে মাথাও উঠাল না এবং আল্লাহর সেই হিদায়াতও গ্রহণ করল না, যা দিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি।’’

১০৬- আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, মারফূ হিসেবে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে:

“যখন তোমরা এমন কাউকে দেখবে, যারা মুতাশাবিহাত আয়াতের পেছনে ছুটে, তাহলে জেনে রেখ! তাদের কথাই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে তোমরা সাবধান থাকবে।”

১০৭- ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আমার পূর্বে আল্লাহ যে কোনো নবীকে যে কোনো উম্মতের মাঝে পাঠিয়েছেন তাদের মধ্যে তাঁর (কিছু) সহযোগী ও সঙ্গী হত। তারা তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করত এবং তাঁর আদেশের অনুসরণ করত। অতঃপর তাদের পরে এমন লোক আসল যে, তারা যা বলত, তা করত না এবং তারা তা করত, যার আদেশ তাদেরকে দেওয়া হত না। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ হাত দ্বারা জিহাদ করবে সে মু’মিন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ জিহ্বা বা ভাষা দ্বারা জিহাদ করবে সে মু’মিন এবং যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ অন্তর দ্বারা জিহাদ করবে, সেও মু’মিন। আর এর বাইরে সরিষা দানা পরিমাণও ঈমান নেই।”

হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

১০৮- জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, উমার রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন: হে আল্লাহর রাসূল আমরা ইহুদীদের কাছ থেকে কিছু বর্ণনা শুনি, যা আমাদেরকে আশ্চর্যান্বিত করে। আপনি কি মনে করেন যে, আমরা তার থেকে কিছু অংশ লিখে নেব? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

“তোমরা কি তোমাদের দীনের ব্যাপারে দিশেহারা হয়ে পড়েছ, যেভাবে ইহুদী-নাসারারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল! অথচ তোমাদের কাছে আমি অত্যন্ত স্পষ্ট দীন নিয়ে আগমণ করেছি। আজ যদি স্বয়ং মূসা আলাইহিস সালাম বেঁচে থাকতেন, তবুও আমার আনুগত্য ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর ছিল না।”

এটি আহমাদ বর্ণনা করেছেন।

১০৯- আবু ছা‘লাবা আল-খাশানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“আল্লাহ তা‘আলা কতিপয় জিনিস ফরয করেছেন। তোমরা সেগুলোকে বিনষ্ট করো না। তিনি কতিপয় সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা সেটা লঙ্ঘন করো না। আবার কতক বস্তু হারাম করেছেন, তোমরা সেটাতে লিপ্ত হয়ো না এবং ভুল ছাড়াই রহমত স্বরূপ কতক বিষয় থেকে চুপ থেকেছেন, তোমরা সেটা অনুসন্ধান করো না।”

হাদীসটি হাসান। দারাকুতনী ও অন্যান্যরা এটি বর্ণনা করেছেন।

১১০- সহীহায়নে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“আমি যখন তোমাদেরকে কোনো ব্যাপারে নিষেধ করি, তখন তা থেকে বেঁচে থাক। আর যদি কোনো বিষয়ে আদেশ করি, তাহলে সাধ্যানুসারে তা বাস্তবায়ন কর। কেননা, তোমাদের আগে যারা ছিল, তারা তাদের নবীদেরকে বেশি বেশি প্রশ্ন করা ও নবীদের সঙ্গে মতভেদ করার জন্যই ধ্বংস হয়েছে।”

১১১- ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহ এমন ব্যক্তির মুখমণ্ডলকে উজ্জল করুন, যে আমার একটি কথা শ্রবণ করে, মুখস্ত করে এবং ভালভাবে তা আয়ত্ব করে আর তারপরে তা পৌঁছে দেয়; কেননা কতিপয় ফিকহের বহনকারী ফকীহ (গভীর জ্ঞানসম্পন্ন) নয়। আবার কতিপয় ফিকহের বহনকারী তার থেকে অধিকতর ফিকহের জ্ঞানীর কাছে তা বহন করে। তিনটি ব্যাপারে কোনো মুসলিমের অন্তর বিদ্বেষ পোষণ করবে না: আল্লাহর জন্যই আমলকে খালেস করা, মুসলিমদের প্রতি নসীহত করা এবং তাদের জামা‘আতকে আঁকড়ে ধরা; কেননা তাদের দাওয়াত চতুর্দিক হতে তাদেরকে বেষ্টন করে রাখে।”

‘আল-মাদখাল’ গ্রন্থে বাইহাকী বর্ণনা করেছেন এবং শাফেয়ীও বর্ণনা করেছেন।

১১২- আহমাদ, আবু দাঊদ এবং তিরমিযী যায়েদ ইবন ছাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে এটি বর্ণনা করেছেন।

১১৩- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“ইলম তিন প্রকার: মুহকাম আয়াত, কায়েম থাকা সুন্নাত এবং ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টনের জ্ঞান। এছাড়া যা আছে তা অতিরিক্ত।”

এটি দারিমী ও আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন।

১১৪- ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাপারে তার বিবেক প্রসূত কথা বলবে, সে যেন তার অবস্থান আগুনে নির্ধারণ করে নিল।”

এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

১১৫- অন্য বর্ণনাতে এসেছে:

“যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছাড়া কথা বলবে, সে যেন তার অবস্থান আগুনে নির্ধারণ করে নিল।”

এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

১১৬- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি জ্ঞান ছাড়াই ফতোয়া দেবে, তার উপরে যাকে সে ফাতওয়া দেবে তার পাপের ভার অর্পিত হবে। আর যে ব্যক্তি তার ভাইকে এমন কোনো পথ দেখাবে, অথচ সে জানে যে, সত্য বা হিদায়াত অন্য পথে রয়েছে, সে আমানতের খিয়ানত করল।”

এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

১১৭- মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযথা প্রশ্ন বা বিভ্রান্তিকর কথা হতে নিষেধ করেছেন।

এটিও আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

১১৮- কাছীর ইবনু কায়েস হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবু দারদার সাথে দামেশকের মসজিদে বসে ছিলাম। তখন একজন ব্যক্তি এসে বলল: হে আবু দারদা আমি আপনার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহর (মদীনা) হতে এসেছি একটি হাদীসের জন্যে, আমার কাছে পৌঁছেছে যে, আপনি তা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বর্ণনা করেন, এ ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজনে আপনার কাছে আসিনি। তিনি বললেন: নিশ্চয় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে পৌঁছে দেন। ফেরেশতারা ইলম অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য তাদের ডানা বিছিয়ে দেন। আলিমের জন্য আসমান ও যমীনে যারা আছে তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও দু‘আ প্রার্থনা করে, এমন কি পানির গভীরে বসবাসকারী মাছও। আবেদ (সাধারণ ইবাদাতগুজারী) ব্যক্তির উপর ‘আলিমের ফাযীলত হলো যেমন সমস্ত তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা। আর আলিমরা হলেন নবীদের উত্তরসুরি। নবীগণ কোনো দীনার বা দিরহাম মীরাসরূপে রেখে যান না; তারা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে।”

এটি আহমাদ, দারিমী, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবন মাযাহ বর্ণনা করেছেন।

১১৯- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণিত,

“হিকমাতপূর্ণ কথা হচ্ছে মুমিনের হারিয়ে যাওয়া সম্পদের ন্যায়, তা যেখানেই পাবে, সে তা গ্রহণে অধিক হকদার।”

তিরমিযী এটি বর্ণনা করেছেন আর গরীব বলেছেন। ইবনু মাযাহও এটি বর্ণনা করেছেন।

১২০- আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “নিশ্চয় প্রকৃত ফকীহ হচ্ছে সে, যে মানুষকে আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ করে না, আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারে মানুষের জন্যে শিথিলতা কর না, তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে নিরাপদ করে দেয় না এবং কুরআন ছেড়ে অন্য বিষয়ে আগ্রহান্বিত হয় না। নিশ্চয় এমন ইবাদাতে কোনো কল্যাণ নেই যাতে ইলম নেই, আর এমন ইলমে কোনো কল্যাণ নেই, যাতে বুঝ নেই এবং এমন পড়াতে কোনো কল্যাণ নেই, যাতে চিন্তা-ভাবনা নেই।”

১২১- হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“কোনো ব্যক্তি ইসলামকে পুনরুজ্জিবীত করার লক্ষ্যে ইলম অর্জন করা অবস্থায় যদি তার মৃত্যু এসে যায়, তাহলে জান্নাতে তার ও নাবীদের মধ্যে মাত্র একটি স্তর থাকবে।”

হাদীস দুটি ইমাম দারিমী বর্ণনা করেছেন।


 অধ্যায়: ইলম উঠিয়ে নেওয়া

১২২- আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “আমরা একদা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, তিনি তার দৃষ্টিকে আকাশের দিকে দিয়ে বললেন: এটা এমন সময়, যখন মানুষের কাছ থেকে ইলমকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে, এমনকি তারা তার কোন অংশকেই ধারণ করতে পারবে না।”

এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

১২৩- যিয়াদ ইবন লাবীদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বিষয় উল্লেখ করলেন এবং বললেন সেটা হচ্ছে ইলম উঠে যাওয়ার সময়। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! ইলম কিভাবে উঠে যাবে, অথচ আমরা কুরআন পড়ছি, আমাদের সন্তানদেরকে তা পড়াচ্ছি এবং আমাদের সন্তানরাও তাদের সন্তানদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত তা পড়াতে থাকবে? তিনি বললেন: “হে যিয়াদ! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুন, যদিও আমি তোমাকে মদীনার সবচেয়ে বড় ফকীহ ব্যক্তি মনে করতাম। এই ইহুদী ও নাসারারাও কি তাওরাত-ইনজীল পড়ে না, অথচ তারা এই দুটি কিতাবে যা আছে সে অনুযায়ী কোনো আমলই করে না?”

এটি আহমাদ ও ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন।

১২৪- ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

“তোমাদের উপরে ইলম অর্জন করা আবশ্যক, তা উঠিয়ে নেওয়ার আগেই আর ইলম উঠিয়ে নেয়া মানে আলেমদের চলে যাওয়া। তোমাদের উপরে ইলম অর্জন করা আবশ্যক; কেননা তোমাদের কেউ জানে না কখন সে ইলমের মুখাপেক্ষী হবে, অথবা তার কাছে যা রয়েছে তার মুখাপেক্ষী অপর কেউ হবে। তোমরা অচিরেই এমন কতিপয় সম্প্রদায়কে দেখতে পাবে, যারা ধারণা করবে যে, তারা আল্লাহর কিতাবের দিকে আহবান করছে অথচ তারা তাকে (কুরআন) তাদের পিছনে নিক্ষেপ করবে। তোমাদের উপরে ইলম অর্জন করা আবশ্যক, আর বিদ‘আত, বাচলতা ও (নিষ্প্রয়োজন) কথার গভীরতা অর্জন হতে তোমরা সতর্ক থাকবে। তোমাদের উপরে আবশ্যক পুরাতন তথা সাহাবীদের অনুসরণ করা।”

দারিমী অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

১২৫। বুখারী ও মুসলিমে ইবন আমর হতে মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“নিশ্চয় আল্লাহ ইলমকে এমনভাবে ছিনিয়ে নেবেন না যা তিনি বান্দাদের থেকে ছিনিয়ে নেন, তবে আলিমদের কবজ করার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন, এক সময় যখন আলিম অবশিষ্ট থাকবে না। তখন লোকেরা মূর্খ লোকদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে, আর তাদের কাছে ফতোয়া চাওয়া হবে, তারাও ইলম ছাড়া ফতোয়া দেবে। ফলে নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।”

১২৬- আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“মানুষের কাছে অচিরেই এমন সময় আগমন করবে, যখন ইসলামের শুধু নামটুকুই বাকী থাকবে, কুরআনের শুধু রসম বা লিখিতরূপই বাকী থাকবে, মসজিদসমূহ আবাদ হবে, তবে তা হবে হিদায়াত হতে খালি। তাদের আলিমগণ হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে খারাপ মানুষ, তাদের কাছ থেকেই ফিতনার আবির্ভাব হয়ে তাদের কাছেই আবার প্রত্যাবর্তন করবে।”

এটি বাইহাকী শু‘আবুল ঈমানে বর্ণনা করেছেন।


 অধ্যায়: প্রতিযোগিতা ও বিতর্কের জন্য ইলম অর্জনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা

১২৭- কা‘ব ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করবে আলিমদের সাথে প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যে অথবা নির্বোধদের কাছে শ্রেষ্টত্ব লাভের আশায় অথবা মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করার নিমিত্তে, আল্লাহ তাকে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করাবেন।”

এটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

১২৮- আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোনো জাতি হিদায়াতের পর বিভ্রান্ত হয় না।” তারপরে তিনি আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী তেলাওয়াত করলেন: “তারা তো তোমার সামনে শুধু বিবাদই পেশ করে, আর তারাই হচ্ছে ঝগড়াটে।” [আয-যুখরুফ: ৫৮]

এটি আহমাদ, তিরমিযী ও ইবন মাযাহ বর্ণনা করেছেন।

১২৯- আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আল্লাহর নিকট সেই লোক সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত, যে অধিক ঝগড়াটে।”

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি

১৩০- আবূ ওয়ায়েল সূত্রে আব্দুল্লাহ (ইবন মাসঊদ) রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি চার কারণে ইলম অর্জন করবে, সে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে -অথবা এ রকম অন্য কোনো শব্দ- আর চারটি কারণ হচ্ছে: সে আলিমদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, অথবা মূর্খদের সাথে বাদানুবাদে বিজয়ী হবে, অথবা মানুষের মুখ (দৃষ্টি) তার দিকে ফিরাবে অথবা তা দ্বারা শাসকদের কাছ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করবে।”

এটি দারিমী বর্ণনা করেছেন।

১৩১- ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি দীনের ব্যাপারে কোনো একটি জাতিকে বিতর্ক করতে শুনে বললেন: তোমরা কি জানো না যে, আল্লাহর অসংখ্য বান্দা রয়েছে, আল্লাহর ভয় তাদেরকে চুপ করিয়ে দিয়েছে; অথচ তারা বোবাও নয়, আবার বধিরও নয়। আর তারাই জ্ঞানী, বাগ্মী, ভাষার ক্ষেত্রে পারঙ্গম ও সম্মানিত; আল্লাহর দিনসমূহ (অতীত শাস্তি) সম্পর্কে তারা জ্ঞানী। এ ছাড়াও তারা যখন আল্লাহর বড়ত্বের কথা স্মরণ করে, তাদের বিবেকসমূহ হতবুদ্ধি হয়ে যায়, তাদের অন্তরগুলো ভেঙ্গে যায়, তাদের ভাষা থেমে যায়। এমনকি যখন তারা সম্বিৎ ফিরে পায়, তখনই তারা উত্তম আমলসমূহের দ্বারা আল্লাহর দিকে দ্রুত গতিতে ধাবিত হয়। তারা নিজেদেরকে সীমালংঘনকারীদের কাতারে মনে করে; অথচ তারা অত্যন্ত সবল ও বিচক্ষণ। তারা নিজেদেরকে পথভ্রষ্ট ও পাপীদের কাতারে মনে করে; অথচ তারা পাপ থেকে দূরে থাকা এক সৎকর্মশীল দল। সাবধান! তাদের বেশী আমলকেও তারা বেশী মনে করে না, আর অল্প আমল নিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারে না। তারা তাদের আমলসমূহ নিয়ে গর্বও করে না। যেখানেই তুমি তাদেরকে দেখবে, দেখবে ইবাদাতে যত্নশীল, আল্লাহর ভয়ে ভীত, অন্তরের দিক থেকে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত।

এটি আবূ নু‘আইম বর্ণনা করেছেন।

১৩২- হাসান আল-বাসরী একদল মানুষকে বিতর্ক করতে দেখে বললেন: “এরা এমন লোক, যারা ইবাদাতে বিরক্ত হয়ে গেছে, কথা বলাকে সহজ ভেবে নিয়েছে, তাদের আল্লাহভীরুতা কমে গেছে, আর এ কারণেই তারা এত কথা বলছে।”


 অধ্যায়: কথা চালিয়ে যাওয়া, কৃত্রিমতা ত্যাগ করা ও বাড়িয়ে না বলা।

১৩৩- আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফূ হিসেবে বর্ণিত:

“লজ্জা ও কম কথা বলা ঈমানের দুটি অঙ্গ। আর অশ্লীলতা ও বেশী কথা মুনাফিক হওয়ার দুটি অঙ্গ।”

এটি ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

১৩৪- আবূ ছা‘লাবা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র ও ব্যবহার ভালো সে ব্যক্তি আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামত দিবসে সে আমার সবচেয়ে নিকট অবস্থান করবে। আর আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি এবং কিয়ামত দিবসে যারা আমার থেকে দূরে থাকবে সেই ব্যক্তিরা হলো, যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলে, ছন্দ মিলিয়ে কথা বলে ও বাচাল।”

এটি বাইহাকী শু‘আবুল ঈমানে বর্ণনা করেছেন।

১৩৫- জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে তিরমিযী অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

১৩৬- সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“কিয়ামত আসবে না, যতক্ষণ না এমন এক সম্প্রদায় বের হবে, যারা তাদের জিহ্বা দ্বারা খাবে যেভাবে গরু তার জিহ্বা দ্বারা খায়।”

হাদীসটি আহমাদ, আবূ দাউদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

১৩৭- আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে মারফূ হিসেবে বর্নিত:

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা অপছন্দ করেন ঐ সকল বাকপটু লোককে, যে ব্যক্তি তার জিহ্বাকে এমনভাবে কাজে লাগায়, যেভাবে গরু তার জিহ্বাকে কাজে লাগায়।”

এটি তিরমিযী ও আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন।

১৩৮- আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি লোকদের অথবা মানুষের অন্তরসমূহকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আকর্ষণীয় কথাবার্তা শিক্ষা করে, আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তার কোনো ফরয ও নফল গ্রহণ করবেন না।”

এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

১৩৯- আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ছিল আলাদা আলাদা, যা প্রতিটি শ্রবণকারীই বুঝতে পারত। এরপরে তিনি বলেছেন: তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন, যদি কোনো গণনাকারী তা গুনতে ইচ্ছা করত, তবে তা করতে পারত। তিনি আরো বলেন: নিশ্চয় তিনি তোমাদের মত একের এক কথা বলতেন না।”

এর কতিপয় অংশ আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

১৪০- আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যখন তোমরা এমন কাউকে দেখবে, যাকে দুনিয়া বিমুখতা ও অল্প কথা দান করা হয়েছে, তাহলে তোমরা তার নিকটবর্তী হও; কেননা সে হিকমাতের সঙ্গে সাক্ষাত কর।”

এটি বাইহাকী শু‘আবুল ঈমানে বর্ণনা করেছেন।

১৪১- আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“নিশ্চয় কিছু কথায় যাদু আছে, ইলমের মধ্যেও অজ্ঞতা রয়েছে, কবিতায় হিকমত আছে আর কথার মধ্যে আছে বিপদ।”

১৪২- আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি একদিন দুপুরে আরাম করছিলেন, আর একজন লোক দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলছিলেন। তখন আমর বললেন: যদি সে তার কথাকে সংক্ষিপ্ত করত, তাহলে তার জন্য তা উত্তম হত; কেননা আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “আমি মনে করি- অথবা আমাকে আদেশ করা হয়েছে- যে, আমি যেন কথাকে সংক্ষিপ্ত করি; কেননা সংক্ষিপ্ত কথাই উত্তম।”

এ দুটি হাদীস আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

সমাপ্ত। আর সকল ও অসংখ্য প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই জন্য।