ভালোবাসা ()

মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

নিষিদ্ধ প্রেম-ভালোবাসা বর্তমানযুগের একটি বড় সামাজিক আপদে পরিণত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে বিষয়টির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ ও এ-বিষয়ে ইসলামী শরী‘আহ’র অবস্থান কী -তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুব সমাজকে কীভাবে এই অবৈধ সম্পর্কের শৃঙ্খল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে তা আলোচনায় উঠে এসেছে।

    |

    ভালোবাসা

    শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

    অনুবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ

    সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    الحب والعشق

    (باللغة البنغالية)

    الشيخ محمد صالح المنجد

    ترجمة: ثناء الله نذير أحمد

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............

    নিষিদ্ধ প্রেম-ভালোবাসা বর্তমানযুগের একটি বড় সামাজিক আপদে পরিণত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে বিষয়টির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ ও এ-বিষয়ে ইসলামী শরী‘আহ’র অবস্থান কী -তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুব সমাজকে কীভাবে এই অবৈধ সম্পর্কের শৃঙ্খল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে তা আলোচনায় উঠে এসেছে।

    ভালোবাসা

    প্রশ্ন: আমি যদি দূর থেকে কোনো নারীকে ভালোবাসি তাহলে কি গুনাহ হবে?

    উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ

    গোনাহ ও দুষ্কর্মের দরজাগুলো বন্ধ করার জন্য শরী‘আত এসেছে। যা কিছু মানুষের মনোজগৎ ও বিচার-বিবেচনা শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়ার মাধ্যম তা বন্ধ করার জন্য শরী‘আত সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছে। আর প্রেম-ভালোবাসা, নর-নারীর সম্পর্ক, সবচেয়ে বড় ব্যাধি ও মারাত্মক আপদ।

    শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, ‘ইশক বা প্রেম একটি মানসিক ব্যাধি। আর যখন তা প্রকট আকার ধারণ করে শরীরকেও তা প্রভাবিত করে। সে হিসেবে তা শরীরের পক্ষেও ব্যাধি। মস্তিষ্কের জন্যও তা ব্যাধি। এ জন্যই বলা হয়েছে, এটা একটা হৃদয়জাত ব্যাধি। শরীরের ক্ষেত্রে এ ব্যাধির প্রকাশ ঘটে দুর্বলতা ও শরীর শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।’ (দ্র: মাজমু‘ ফাতাওয়া: ১০/১২৯)

    তিনি আরও বলেন, ‘পরনারীর প্রেমে এমন সব ফাসাদ রয়েছে যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেও গণনা করে শেষ করতে পারবে না। এটা এমন ব্যাধি একটি যা মানুষের দীনকে নষ্ট করে দেয়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে নষ্ট করে দেয়, অতঃপর শরীরকেও নষ্ট করে।’ (দ্র: মাজমু‘ ফাতাওয়া: ১০/১৩২)

    বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষতি জানার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটা হলো হৃদয়ের বন্দীদশা, আর প্রীতিভাজনের জন্য দাসত্ব, প্রেম-ভালোবাসা অসম্মান, অপদস্থতা ও কষ্টের দরজা। এগুলো একজন সচেতন মানুষকে এ ব্যাধি থেকে দূরে সরাতে যথেষ্ট।

    ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, পুরুষের হৃদয় যদি কোনো নারীর সাথে এঁটে যায়, যদিও সে নারী তার জন্য বৈধ হয়, তাহলেও তার হৃদয় থাকে ঐ নারীর কাছে বন্দী। নারী তার অধিপতি হয়ে বসে, পুরুষ তার ক্রীড়নকে পরিণত হয়, যদিও সে প্রকাশ্যে তার অভিভাবক। কেননা সে তার স্বামী। তবে বাস্তবে সে নারীর কাছে বন্দী, তার দাস। বিশেষত নারী যদি জানতে পারে যে পুরুষ তার প্রেমে মুগ্ধ। এমতাবস্থায় নারী তার ওপর আধিপত্য চালায়, যালিম ও স্বৈরাচারী শাসক যেমন তার মযলুম, নিষ্কৃতি পেতে অপারগ দাসের ওপর শাসন চালায়, ঠিক সেভাবেই নারী তার প্রেমে হাবুডুবু-খাওয়া পুরুষের ওপর শাসন চালায়; বরং এর থেকেও বেশি চালায়। আর হৃদয়ের বন্দীদশা শরীরের বন্দীদশা থেকে মারাত্মক। হৃদয়ের দাসত্ব শরীরে দাসত্বের চেয়েও কঠিনতর।’ (দ্র: মাজমু‘ ফাতাওয়া: ১০/১৮৫)

    আর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা ঐ হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না, যে হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা ভর্তি রয়েছে। সে-তো কেবল ঐ হৃদয়েই স্থান পায় যা শূন্য, দুর্বল, পরাস্ত। এ ধরনের হৃদয়েই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা স্থান পায়। আর এটা যখন শক্তিশালী পর্যায়ে পৌঁছে, প্রকট আকার ধারণ করে তখন কখনো আল্লাহর ভালোবাসাকেও অতিক্রম করে যায় এবং ব্যক্তিকে শির্কের দিকে ঠেলে দেয়। এজন্যই বলা হয়েছে, প্রেম-প্রীতি শূন্য হৃদয়ের আন্দোলন।

    হৃদয় যখন আল্লাহর মহব্বত ও স্মরণ থেকে শূন্য হয়ে যায়, আল্লাহর কাছে দো‘আ-মোনাজাত ও আল্লাহর কালামের স্বাদ গ্রহণ করা থেকে যখন শূন্য হয়ে যায়, তখন নারীর ভালোবাসা, ছবির প্রতি আগ্রহ, গান-বাজনা শোনার আগ্রহ তার জায়গা দখল করে।

    শাইখ ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, হৃদয় যদি একমাত্র আল্লাহকে ভালোবাসে, দীনকে একমাত্র তার জন্য একনিষ্ঠ করে, তাহলে অন্য কারও ভালোবাসার মুসীবত তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসার কথা তো বহু দূরে। প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত হওয়ার অর্থ, হৃদয়ে আল্লাহর মহব্বতের অপূর্ণতা। এ কারণে ইউসূফ আলাইহিস সালাম, যিনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে মহব্বত করতেন, তিনি এ মানবীয় ইশক-মহব্বত থেকে বেঁচে গেছেন। আল-কুরআনে এসেছে:

    ﴿كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ﴾ [يوسف: ٢٤]

    “এমনিভাবেই হয়েছে যাতে আমরা তার থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দিই। নিশ্চয় তিনি আমাদের মনোনীত বান্দাদের মধ্যে একজন ছিলেন”[সূরা ইউসূফ, আয়াত: ২৪]

    পক্ষান্তরে মিসর প্রধানের স্ত্রী ও সম্প্রদায় ছিল মুশরিক। ফলে সে প্রেম-ভালোবাসায় আক্রান্ত হয়।’ (দ্র: মাজমু‘ ফাতাওয়া: ১০/১৩৫)

    তাই একজন মুসলিমের উচিৎ এই ধ্বংসের পথ থেকে সরে আসা। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করা ও নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। যদি এ-ক্ষেত্রে ঢিল দেয় বা কমতি করে এবং প্রেমের নদীতে তরী ভাসায় -যার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হারাম তাকে বার বার দেখে, যা শোনা হারাম তা বার বার শোনে, বিপরীত লিঙ্গের সাথে কথা বলাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে করে, আর এভাবেই ডুবে যায় প্রেম-ভালোবাসায়, তাহলে সে নিশ্চয় গোনাহগার, পাপী, শাস্তি ও আযাবের উপযোগী।

    এমন অনেক মানুষ আছে যে শুরুতে ঢিল দিয়েছে, মনে করেছে যখন ইচ্ছে করবে ফিরে আসতে পারবে, নিজেকে মুক্ত করতে পারবে অথবা বিশেষ সীমানা পর্যন্তই যাবে। কিন্তু যখন ব্যাধি রগরেশায় অনুপ্রবেশ করেছে, তখন না কাজে এসেছে কোনো ডাক্তার আর না কোনো ঔষধ।

    কবি বলেন:

    প্রেম প্রেম খেলেছে

    এক পর্যায়ে বনে গেছে প্রেমিক,

    তারপর প্রেম যখন তাকে করেছে বিজয়

    হয়েছে সে অপারগ,

    ভ্রম হয়েছে বিশাল ঢেউকে ছোট্ট বলে,

    ফলে যখন দাঁড়িয়েছে তাতে শক্তভাবে,

    গিয়েছে সে চির নিমজ্জনে।

    রাওজাতুল মুহিব্বীন গ্রন্থে ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘যখন কারণটা তার ইচ্ছায় সংঘটিত হয়েছে, তখন এর থেকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও যা জন্ম নিবে সে ব্যাপারে সে মা‘যুর নয়, তথা অযর পেশ করার অধিকার সে হারিয়ে ফেলে। আর এতে সন্দেহ নেই যে, বার বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করে যাওয়া মাদক সেবনের মতোই, অর্থাৎ ব্যক্তিকে কারণ সংঘটিত করার অপরাধেই কেবল অভিযুক্ত করা হয়।’ (দ্র: পৃষ্ঠা: ১৪৭)

    ব্যক্তি যদি এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে দূরে থাকার জন্য আগ্রহী হয়, অতঃপর সে হারাম জিনিস দেখা থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখে, হারাম জিনিস শোনা থেকে কান বন্ধ করে রাখে, মনের মধ্যে শয়তান যে কুমন্ত্রণা দেয় তা দূরে সরিয়ে দেয়, এর পরেও যদি এই ব্যাধির অগ্নিকণা তাকে স্পর্শ করে ক্ষণিক দৃষ্টির কারণে অথবা এমন কোনো লেনদেনের কারণে যা মূলতঃ বৈধ ছিল, অতঃপর এভাবে যদি কোনো নারীর প্রতি মহব্বত জন্মে যায়, তাহলে আশা করা যায় কোনো গোনাহ হবে না, ইনশাআল্লাহ। আল কুরআনে এসেছে:

    ﴿لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ﴾ [البقرة: ٢٨٦]

    “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না”[সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬]

    ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন ‘যদি ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোনো বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন না হয়, তাহলে, তাকে যা পেয়ে বসল তাতে গোনাহ হবে না।’ (মাজমু‘ ফাতওয়া: দ্র: ১১/১০)

    ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘যদি, অবৈধ নয় এমন কারণ হেতু প্রেম জন্ম নেয়, তাহলে ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হবে না। যেমন কেউ তার স্ত্রী অথবা ক্রিতদাসীর প্রেমাক্রান্ত ছিল, অতঃপর যেকোনো কারণে তাদের বিচ্ছেদ ঘটল, কিন্তু প্রেমের ভাব থেকে সে নিষ্কৃতি পেল না, এমতাবস্থায় তাকে দোষারোপ করা হবে না। অনুরূপভাবে যদি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায় এবং সে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়; কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবেই তার হৃদয় প্রেমাক্রান্ত হয়, তাহলেও তাকে দোষারোপ করা যাবে না। তবে তাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে দমন করার জন্য এবং তা থেকে সরে আসার জন্য।’ (দ্র: রাউযাতুল মুহিব্বীন: ১৪৭)

    ব্যক্তিকে চেষ্টা করে যেতে হবে তার হৃদয়ের চিকিৎসার জন্য প্রীতিভাজনের সকল স্মৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে -আল্লাহর মহব্বত দিয়ে নিজ হৃদয়কে ভরপুর করে, আল্লাহর মহব্বত আঁকড়ে ধরে নিজেকে অমুখাপেক্ষী করে। আর যারা বুদ্ধিমান ও আমানতদার নসিহতকারী এমন ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতেও সঙ্কোচবোধ করবে না অথবা মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতেও ভুলবে না। তাদের কাছে হয়তো কোনো প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি সে হবে ধৈর্যশীল, আল্লাহর কাছে সাওয়াব প্রার্থী, পবিত্রতা অবলম্বনকারী, গোপনকারী। এরূপ করলে আল্লাহ তার জন্য সাওয়াব লিখবেন ইনশাআল্লাহ।

    শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি প্রেমাক্রান্ত হয়, অতঃপর সে পবিত্রতা অবলম্বন করে, ধৈর্য ধরে, তাহলে আল্লাহ তার তাকওয়ার জন্য সাওয়াব দিবেন। কেননা শরী‘আতের দলীল থেকে জানা যায়, ব্যক্তি যদি দৃষ্টি-কথা-কর্মের ক্ষেত্রে হারাম বিষয় থেকে বেঁচে থাকে, আর ব্যাপারটা ফাঁস করে না দিয়ে গোপন করে, কোনো মাখলুকের কাছে অভিযোগ করতে গিয়ে হারাম কথায় জড়িয়ে না যায়, সে যদি কোনো নির্লজ্জ বিষয় ফাঁস না করে দেয়, প্রীতিভাজনের অন্বেষণে বের না হয়, আল্লাহর আনুগত্য ও পাপ থেকে ধৈর্য ধরে, তার হৃদয়ে যে প্রেমযন্ত্রণা রয়েছে তার ক্ষেত্রেও ধৈর্য ধরে, যেভাবে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বিপদে ধৈর্য ধরে, তাহলে আল্লাহকে ভয়কারী ও ধৈর্যধারণকারীদের মধ্যে সে শামিল হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿إِنَّهُۥ مَن يَتَّقِ وَيَصۡبِرۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ﴾ [يوسف: ٩٠]

    “নিশ্চয় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে ও সবর করে, নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না”।’ [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৯০] (দ্র: মাজমু‘ ফাতাওয়া: ১০/১৩৩) আল্লাহই ভালো জানেন।