সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতের রব আল্লাহর জন্য এবং সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমানতদার নবী মুহাম্মাদ এবং তাঁর পরিবার ও তাঁর সকল সাহাবীর ওপর। অতঃপর:
আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা বলেন,
)قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ[ [الزمر: 9]
“বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?” [আয-যুমার : ৯]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ يُرِدِ الله بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ» [متفق عليه]
“আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দীনের ‘ইলম দান করেন।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] আলেমগণ বলেছেন, হাদীসের অর্থ : আল্লাহ যার কল্যাণ চান না, তাকে দীনের ‘ইলম দান করেন না।
শিক্ষা করা ওয়াজিব বিবেচনায় শরয়ী ইলম দুই ভাগে বিভক্ত:
প্রথম প্রকার: যা প্রতিটি মুসলিমের ওপর শিক্ষা করা ওয়াজিব। আর তা হলো এমন ইলম যার দ্বারা একজন ব্যক্তি তার আকীদা (বিশ্বাস), ইবাদাত ও যেসব লেনদেন সে আঞ্জাম দেয় তা সহিহ ও শুদ্ধ করতে পারে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ» [متفق عليه]
“যে কেউ এমন আমল করল যা আমাদের শরী‘আতে নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এমন ইবাদাত দ্বারা আল্লাহর ইবাদাত করল যা আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমোদন দেননি, তার আমল তার ওপরই প্রত্যাখ্যাত এবং আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য নয়।
দ্বিতীয় প্রকার: যা ওয়াজিব ইলমের অতিরিক্ত ইলম। এটি ফরযে কিফায়াহ। যখন তার শিক্ষার ভার এমন কেউ গ্রহণ করবে যে উম্মাতের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে, তখন বাকীদের থেকে পাপ ওঠে যাবে।
আমি এ কিতাবে আকীদা, আহকাম, আখলাক ও মুআমালাত সম্পর্কীয় এমন সব বিষয় জমা করার চেষ্টা করেছি যা কোনো মুসলিমের অজানা থাকা সমীচিন নয়। [[1]]
আমি এটিকে সহজ পদ্ধতি ও সহজ ভাষায় করার চেষ্টা করেছি যেন তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। তারপর আমি এটিকে বিভিন্ন আসর ও ছোট ছোট মজলিসে ভাগ করেছি যাতে তা শেখা ও শিখানো সহজ হয়।
আশা করছি এ বইটি বিভিন্ন পেশার মুসলিম ভাইদের জন্য উপকারী হবে:
সুতরাং একটি মুসলিম পরিবার পালাক্রমে এক সভার আয়োজন করতে পারে যেখানে এ কিতাব ও অন্যান্য উপকারী কিতাব পাঠ করা হবে।
মসজিদের ইমামের পক্ষে সালাত শেষে তার মসজিদের মুসল্লিদের সামনে এটি উপস্থাপন করা সম্ভবপর।
আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর পক্ষে তার আলোচনা ও দারসে এ কিতাবটি রাখা ও তার দ্বারা উপদেশ ও নসিহত প্রদান করা সম্ভব।
শিক্ষক তার দারসে তার ছাত্রদের উপযোগী বিষয়গুলো এ কিতাব থেকে বাছাই করবেন যেন তিনি তাদেরকে তাদের দীনি বিষর্য়ে শিক্ষা দিতে পারেন।
আবার তার বিষয়গুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অডিও সম্প্রচারে ভিডিও ও অডিও পর্বে পেশ করা সম্ভব।
একজন ব্যক্তি, মুসলিম পুরুষ হোক বা মুসলিম নারী হোক, সে এটি একাকী বা তার আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের নিয়ে পাঠ করে তার থেকে উপকৃত হতে পারে।
এ ছাড়া প্রভৃতি তরিকা রয়েছে এ কিতাব থেকে উপকৃত হওয়ার। আল্লাহর নিকট আশা করি, যেন কিতাবটি তার পাঠক, শ্রোতা ও লেখকের ওপর বরকতময় হয়।
এই বইয়ের বিষয় আলেম ও গুণীদের কিতাব এবং বড় আলেমদের ফতোয়া [[2]] থেকে সংগ্রহ করেছি এবং আমি তা সাজিয়েছি ও সুবিন্যস্ত করেছি। এটি মানুষিক প্রচেষ্টা যাতে ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। তাই তা প্রথমত আল্লাহর সংশোধন তারপর যিনি তা দেখবেন তার সংশোধনীর মুখাপেক্ষী।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি এটিকে একমাত্র তাঁর নিজের জন্যে গ্রহণযোগ্য ও উপকারী বানিয়ে দিন। আর এতে যা ভুল-ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা রয়েছে তা ক্ষমা করে দিন। এমনিভাবে তাঁর কাছে চাই যে, যারা এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং ভালো পরামর্শ দিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে উত্তম বিনিময় দান করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
তুরকী ইবন ইবরাহীম আল-খানীযান
৫/১২/১৪৪০ হি.
আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সামনের পাঠে এমন কতক ধারাবাহিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব যা প্রতিটি মুসলিমের ঈমান, ইবাদাত এবং মুআমালাতের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদেরকে তার দ্বারা উপকৃত করুন।
এ পাঠে আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব যেটিকে আল্লাহ আমল কবুল হওয়ার এবং জান্নাতে প্রবেশ করার শর্ত নির্ধারণ করেছেন। আর সেটি হলো ঈমান। যেমন, আল্লাহ বলেন.
}وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا{ [الإسراء: 19].
“আর যে আখিরাত চায় এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মুমিন অবস্থায়, তাদের চেষ্টা হবে পুরস্কারযোগ্য।” [আল-ইসরা : ১৯]
ঈমান হলো, মুখে বলা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা আমল করা। আনুগত্যের কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায় আর গুনাহের কারণে তা হ্রাস পায়। মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদের ঈমানকে বাড়িয়ে দিন এবং আমাদের অন্তরে তা নবায়ন করুন।
হাদীসে জিবরীল আলাইহিস সালামে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের রুকনসমূহ বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে সংবাদ দিন।
উত্তরে তিনি বললেন,
«أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ، وَمَلَائِكَتِهِ، وَكُتُبِهِ، وَرُسُلِهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ» [رواه مسلم].
“তুমি আল্লাহর প্রতি, তাঁর মালায়েকা, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, আখেরাত দিবস ও তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান আনবে।” [হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]
এটি স্পষ্ট হওয়ার পর তোমার নিকট ঈমানের কিছু ফল এবং তার উত্তম প্রভাব তুলে ধরা হলো যেগুলো তোমার ঈমান কামেল হওয়া অনুযায়ী তোমার মধ্যে বাস্তবায়ন ঘটবে-
- তার মধ্যে একটি হলো দুনিয়া ও আখিরাতে হায়াতে তাইয়্যেবা (পবিত্র জীবন) লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ{ [النحل: 97]
“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে তারা যা করত তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দেব।” [আন-নাহাল : ৯৭]
- আরেকটি হলো, নিরাপত্তা ও হিদায়াত লাভ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ{ [الأنعام: 82].
“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুম (শির্ক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।” [আল-আন‘আম : ৮২]
- আরেকটি হলো অন্তরের দৃঢ়তা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}يُثَبِّتُ الله الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ{ [إبراهيم: 27].
“আল্লাহ অবিচল রাখেন ঈমানদারদেরকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে।” [ইবরাহীম : ২৭]
- আরেকটি হলো: মুমিনের জন্য মালায়েকাদের ক্ষমা প্রার্থনা করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا{ [غافر: 7].
“যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চায়।” [গাফের (মু‘মিন) : ৭]
- আরেকটি হলো মুমিনের ওপর শয়তানের প্রভাব বিস্তার লাভ না করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ{ [النحل: 99].
“নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও তাদের রবেরই উপর নির্ভর করে তাদের উপর তার কোনো আধিপত্য নেই।” [আন-নাহাল : ৯৯]
- আরেকটি হলো আল্লাহ কর্তৃক মুমিনদের পক্ষে প্রতিহত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}إِنَّ الله يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آَمَنُوا { [الحج: 38].
“নিশ্চয় যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের পক্ষে প্রতিহত করেন।” [আল-হাজ : ৩৮]
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আগামী দারসে ঈমানের রুকনসমূহ হতে প্রথম রুকন সম্পর্কে আলোচনা করব, আর তা হচ্ছে ‘আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান।
এ পাঠে ঈমানের রুকনসমূহ হতে প্রথম রুকন অর্থাৎ, আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে আলোচনা করব। এটি চারটি বিষয়কে অর্ন্তভূক্ত করে-
১। আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রতি ঈমান আনা। শরীআতের অসংখ্য দলীল ছাড়াও জ্ঞান, বুদ্ধি ও স্বভাব সবই আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে। পূর্ব-গবেষণা ও শিক্ষা ছাড়াই প্রতিটি সৃষ্টিকে তার স্রষ্টার প্রতি ঈমানের ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلا يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ» [متفق عليه]،
“সব শিশুই ফিতরাতের ওপর (মুসলিম হয়ে) জন্ম গ্রহণ করে। কিন্তু তার পিতা মাতা তাকে ইয়াহুদী অথবা নাসারা বা অগ্নিপুজক বানায়।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর ‘আকলী (যৌক্তিক) দলিল হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
}أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ { [الطور: 35]
“তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা?” [আত-তূর : ৩৫] অর্থাৎ. এসব মাখলুককে কোনো স্রষ্টা ছাড়া এমনিতেই সৃষ্টি করা হয়নি, যেমন সে নিজে নিজেকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং এটি স্বীকার করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই যে, এগুলো প্রজ্ঞাবান ক্ষমতাধর আল্লাহর কুদরাতে সৃষ্টি করা হয়েছে। যিনি সৃষ্টি ও সুসম করেন। আর যিনি নিরূপণ করেন অতঃপর পথ দেখান।
২। আল্লাহর প্রতি ঈমান তার রুবূবিয়্যাতের প্রতি ঈমানকে অর্ন্তভুক্ত করে। অর্থাৎ এ কথার প্রতি বিশ্বাস করা যে, এক আল্লাহই হলো রব, প্রতিটি বস্তুর স্রষ্টা, সবকিছুর তিনিই মালিক, সব বিষয়ের তিনি পরিচালক। যেমন, রিযিক দান করা, জীবন দান করা, মৃত্যু দান করা, আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন,
}أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ الله رَبُّ الْعَالَمِينَ{ [الأعراف: 54].
“জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব।” [আল-আরাফ : ৫৪]
৩। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা তার উলুহিয়্যাতের প্রতি ঈমান আনাকে অর্ন্তভুক্ত করে। আর তা হলো, ইবাদতে আল্লাহকে একক সাব্যস্ত করা। ফলে ইবাদাতের কোনো অংশকে গাইরুল্লাহর জন্য সোপর্দ করব না। তিনি ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়, তাদের থেকে মুক্ত থাকবো। আর এটিই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর সাক্ষ্য দানের দাবি।
যে সব ইবাদত কেবল এক আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা ওয়াজিব, সেগুলো অর্ন্তভুক্ত করে- এমন সব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কর্মকে যা আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যার প্রতি তিনি খুশি হন। ফলে এটি সালাত, দুআ, জবেহ করা, মান্নত করা, সাহায্য চাওয়া, আশ্রয়া চাওয়া, ভয় করা, আশা করা ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
- আর তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ, যাকে তাওহীদুল ইবাদাহ নামকরণ করা হয়। তাই হচ্ছে সকল আসমানী পয়গামে মূল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا الله وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ{ [النحل: 36]
“আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং পরিহার কর তাগূতকে।” [আন-নাহল ৩৬]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাগুত অর্থ হলো, বান্দা যে উপাস্য বা অনুকরণীয় বা অনুসরণীয় সত্ত্বাকে নিয়ে সীমালঙ্ঘন করে তাই।’
ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাগুত অসংখ্য। আর তাদের প্রধান হলো পাঁচজন: অভিশপ্ত ইবলিস, যার সম্মতিতে তার ইবাদত করা হয়, যে মানুষকে তার নিজের ইবাদাতের দিকে আহ্বান করে, যে গাইবী ইলমে দাবী করে আর যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে বাদ দিয়ে বিচার ফায়সালা করে।’ [[3]]
৪। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ এবং তাঁর মহৎ গুণসমূহের প্রতি ঈমান আনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর তা হলো, আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য এবং তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য যে সব নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, তাতে কোন প্রকার বিকৃতি, অর্থহীন করা, পদ্ধতি বর্ণনা করা এবং সদৃশ্য সাব্যস্ত করা ছাড়া তাঁর মর্যাদা অনুযায়ী তাঁর প্রতি বিশ্বাস করা।[[4]] মহান আল্লাহ বলেন,
}لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ{ [الشورى: 11]
“তাঁর মতো কিছু নেই, আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” [আশ-শূরা : ১১]
সুতরাং, সদৃশ ও ধরন নিষিদ্ধ করা হয়েছে আল্লাহর বাণী (لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ) দ্বারা আর বিকৃতি ও অর্থহীন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে আল্লাহর বাণী (وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ) দ্বারা।
দানশীল মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন ঈমান দ্বারা আমাদের অন্তরসমূহকে পূর্ণ করে দেন। বিশ্বাসের দ্ধারা অটুট রাখেন এবং ইখলাসের দ্বারা সজ্জিত করেন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে বড় গুনাহ যার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী করা হয়েছে- সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো শির্ক।
এ পাঠে বড় গুনাহ যার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী করা হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর তাওহীদ বিনষ্টকারী শির্ক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ{ [لقمان:13]
“নিশ্চয় শির্ক হলো মহা অন্যায়।” [লুকমান : ১৩]
আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট বড় পাপ কোনটি? তিনি বলেলেন,
«أَنْ تَجْعَلَ لِله نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ» [متفق عليه]
“আল্লাহর জন্য শরীক সাব্যস্ত করা; অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম) আন-নিদ্দ (النِدّ) অর্থ হলো, শরীক
শির্ক দুই প্রকার: বড় শির্ক ও ছোট শির্ক
- বড় শির্ক হলো, সবচেয়ে বড় পাপ যা তাওবা করা ব্যতীত কারো জন্যেই আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এটি সব আমল বিনষ্টকারী। যে ব্যক্তি শিরকে আকবারের ওপর মারা যাবে সে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আল্লাহ বলেন,
}إِنَّ الله لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ وَمَن يُشْرِكْ بِالله فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا{ [النساء: 48]
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন। আর যে-ই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে।” [আন-নিসা : ৪৮]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ بَلِ الله فَاعْبُدْ وَكُن مِّنَ الشَّاكِرِينَ{ [الزمر: 65-66].
“আর আপনার প্রতি ও আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী করা হয়েছে যে, 'যদি আপনি শির্ক করেন তবে আপনার সমস্ত আমল তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্যই আপনি হবেন ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [যুমার : ৬৫-৬৬]
বড় শির্কের হাকীকত হলো, মানুষের আল্লাহর রুবূবিয়্যাত বা উলুহিয়্যাত বা নাম ও সিফাতসমূহে কোনো শরীক বা কোনো সমকক্ষ সাব্যস্ত করা।
- শির্ক কখনো প্রকাশ্য হয়, যেমন কোনো ব্যক্তি মূর্তি পুজা করল এবং কবরবাসী ও মূর্তিদের আহ্বান করল।
- আবার কখনো অপ্রকাশ্য হয়, যেমন আল্লাহ ছাড়া বিভিন্ন ইলাহের ওপর ভরসাকারীগণের শির্ক অথবা যেমন মুনাফিকদের কুফর ও শির্ক।
- আবার কখনো শির্ক বিশ্বাসে হয়, যেমন কেউ বিশ্বাস করল যে, এখানে এমন লোক আছে যিনি আল্লাহর সঙ্গে সৃষ্টি করেন, রিযিক দেন এবং গায়েব জানেন। অথবা বিশ্বাস করল যে, গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত সমর্পণ করা বৈধ বা বিশ্বাস করল যে, এখানে এমন কোনো সত্ত্বা রয়েছে আল্লাহর সাথে যার বিনা শর্তে অনুকরণ করা যায় অথবা কোনো মাখলুককে ইবাদাতের ন্যায় মহব্বত করল যেমন আল্লাহকে মহব্বত করে।
- আবার কখনো শির্ক কথায় হয়, যেমন মৃত ও অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে দোয়া, আশ্রয় ও সাহায্য চাওয়া।
- আবার শির্ক কখনো কাজে হয়, যেমন গাইরুল্লাহর জন্য জবেহ করা, সালাত আদায় করা বা সেজদা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِله رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ{ [الأنعام: 162-163].
“বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, কুরবানী, জীবন ও মৃত্যু জগতের রব আল্লাহর জন্য। তার কোনো শরীক নেই। এ বিষয়েই আমাকে আদেশ করা হয়েছে এবং আমিই প্রথম মুসলিম।” [আল-আনআম : ১৬২-১৬৩]
আল্লাহ আমাদেরকে প্রকাশ্য ও গোপন শির্ক থেকে হিফাযত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী পাঠে আমরা দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ ছোট শির্ক সম্পর্কে আলোচনা শেষ করব।
বিভিন্ন প্রকার শির্ক সম্পর্কে আমরা আমাদের আলোচনা অব্যাহত রাখব। আর এই পাঠে আমরা শির্কের বিভিন্ন প্রকার থেকে দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ ছোট শির্ক সম্পর্কে আলোচনা করব।
- ছোট শির্ক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, কুরআন ও হাদীসে যেগুলোকে শির্ক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শারী‘আতের অন্যান্য নসসমূহ দ্বারা প্রমাণ করে যে, ছোট শিরক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكَ الأَصْغَرَ» قالوا: وما الشرك الأصغر يا رسول الله؟ قال: الرِّيَاءُ، يَقُولُ الله لَهُمْ يَوْمَ يُجَازِي الْعِبَادَ بِأَعْمَالِهِمُ: اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُم تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً» [رواه الإمام أحمد وصححه الألباني].
“আমি তোমাদের ওপর যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হচ্ছে ছোট শির্ক।” সাহাবীগণ বললেন, ছোট শির্ক কি হে আল্লাহর রাসূল!, তিনি বলেন: রিয়া (লোক দেখানো)। যে দিন আল্লাহ বান্দাদের তাদের আমল অনুযায়ী বিনিময় দিবেন সেদিন বলবেন, তোমরা তাদের কাছে যাও দুনিয়াতে যাদের তোমরা তোমাদের আমল দেখাতে, দেখ তাদের নিকট কোনো বিনিময় পাও কিনা।” [ইমাম আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ সাব্যস্ত করেছেন]
রিয়া হলো মানুষকে দেখানো ও তাদের প্রসংশা লাভের উদ্দেশ্যে বাহ্যিকভাবে ইবাদতকে সুন্দর করা বা তা প্রকাশ করা অথবা তার সম্পর্কে সংবাদ দেয়া।
আর যেসব বিষয় শির্কে আসগরের অন্তর্ভুক্ত হয় তা নিম্নরূপ:
১। কোনো বস্তুতে বিশ্বাস করা যে, তা উপকার লাভ বা ক্ষতি প্রতিহত করার উপকরণ, অথচ আল্লাহ তাকে উপকরণ বানাননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ» [رواه أبو داود وصححه الألباني]
“নিশ্চয় মন্ত্র, তাবীজ, গিটযুক্ত মন্ত্রের সূতা হলো শির্কের অন্তর্ভুক্ত।” [এটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
হাদীসে বর্ণিত রুকা (الرُّقى) দ্বারা উদ্দেশ্য: সে-সব ঝাঁড় ফুক যার অর্থ বুঝা যায় না অথবা সে-সব ঝাঁড় ফুক যা আল্লাহর সাথে শির্ক করাকে শামিল করে।
তাবীজ (التمائم): বদ নজর ইত্যাদি প্রতিহত করার জন্য যে সব বস্তু মানুষ বা জীব-জন্তু বা মালিকানা বস্তুতে ঝুলানো হয়।[[5]]
আর তিওয়ালা (التِّوَلة) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এক প্রকার জাদু : তারা ধারনা করে যে, এটি স্ত্রীকে স্বামীর কাছে ও স্বামীকে স্ত্রীর কাছে প্রিয় করে দেয়।
২। শব্দের মধ্যে শির্ক: যেমন, গাইরুল্লাহর নামে শপথ করা এবং কোনো ব্যক্তির বলা যে, আল্লাহ যা চান আর তুমি যা চাও। যদি আল্লাহ ও অমুক না হত ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ» [رواه الترمذي، وصححه الألباني].
“যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে শপথ করল, সে কুফুরী অথবা শির্ক করল।” [হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا تَقُولُوا: مَا شَاءَ الله وَشَاءَ فُلانٌ وَلَكِنْ قُولُوا: مَا شَاءَ الله ثُمَّ شَاءَ فُلانٌ» [رواه أبوداود والنسائي وصححه الألباني].
“তোমরা বলো না যে, আল্লাহ যা চান এবং অমুক লোক যা চায়। বরং তোমরা বলো, আল্লাহ যা চান, অতঃপর অমুক যা চায়।” [হাদীসটি আবূ দাউদ ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]।[6]
আল্লাহ আমাদেরকে ইখলাস ও সুন্দর আমলের তাওফীক দান করুন। আর কম ও বেশি সব ধরবের রিয়া (লৌকিকতা) থেকে হিফাজত করুন।
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। পরবর্তী দারসে আল্লাহর ইচ্ছায় ঈমানের রুকনসমূহ থেকে দ্বিতীয় রুকন অর্থাৎ ‘মালায়েকাদের প্রতি ঈমান আনা’ বিষয়ে আলোচনা করব।
ঈমানের রুকন সম্পর্কে আমরা আমাদের আলোচনা পূর্ণ করব আর এ পাঠে আমরা ঈমানের দ্বিতীয় রুকন সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো-
মালায়েকাদের প্রতি ঈমান আনা: আর তা হলো, আমরা বিশ্বাস করব যে, তারা বিদ্যমান আছেন এবং তারা সম্মানিত বান্দা। আল্লাহ তাদেরকে নূর দিয়ে সৃষ্টি করেছেন আর তাদেরকে তার আনুগত্যে নিয়োজিত রেখেছেন। তাদের যা নির্দেশ করা হয়েছে সে বিষয়ে তারা আল্লাহর নাফরমানি করেন না এবং তাদের যা আদেশ করা হয় তারা তাই করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِالله وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ{ [البقرة: 285].
“রাসূল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর মালায়েকা, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর।” [আল-বাকারাহ : ২৮৫]
- মালায়েকা (ফিরিশতাগণ) হলেন আল্লাহ তা‘আলার অনুগত বান্দা। তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
}لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُم بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ{ [الأنبياء: 27]
“তারা তাঁর আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে।” [আল-আম্বিয়া : ২৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
}لَّا يَعْصُونَ الله مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ{ [التحريم: 6].
“আল্লাহ তাদের যা নির্দেশ করেন সে বিষয়ে তারা তাঁর নাফরমানি করেন না আর তাদের যা আদেশ করা হয় তারা তাই করেন।” [আত-তাহরীম : ৬]
- তাদের সৃষ্টিগত গুণাবলী সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তা হলো- মহান আল্লাহর বাণী:
}الْحَمْدُ لِله فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَاعِلِ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا أُولِي أَجْنِحَةٍ مَّثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ يَزِيدُ فِي الْخَلْقِ مَا يَشَاءُ إِنَّ الله عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ { [فاطر: 1]
“সকল প্রশংসা আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই, যিনি রাসূল করেন মালায়েকাদেরকে যারা দুই দুই, তিন তিন অথবা চার চার পক্ষবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টিতে যা ইচ্ছে বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” [ফাতির : ১]
আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«خُلِقَتِ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُورٍ» [رواه مسلم
“মালায়েকাদের নূর দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।” [মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«أُذِنَ لِي أَنْ أُحَدِّثَ عَنْ مَلَكٍ مِنْ مَلَائِكَةِ الله مِنْ حَمَلَةِ الْعَرْشِ إِنَّ مَا بَيْنَ شَحْمَةِ أُذُنِهِ إِلَى عَاتِقِهِ مَسِيرَةُ سَبْعِ مِائَةِ عَامٍ» [رواه أبوداود].
“আরশ বহনকারী আল্লাহর মালায়েকাদের থেকে একজন মালাক সম্পর্কে বর্ণনা দিতে আমাকে বলা হয়েছে—তার কানের লতি থেকে গাড় পর্যন্তের দূরত্ব হলো সাতশত বছরের রাস্তা।” [আবূ দাঊদ]
- তাদের নামসমূহ ও কর্মসমূহ সম্পর্কে নিম্ন লিখিত বর্ণনা এসেছে- জিবরীল আলাইহিস সালাম: তিনি অহীর জিম্মাদার। আল্লাহ বলেন,
}نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَىٰ قَلْبِكَ{ [الشعراء:193-194]
“তোমার অন্তরের ওপর (এ কুরআন) রুহুল আমীন নাযিল করেছেন।” [আশ-শুআরা : ১৯৩-১৯৪]
মিকাঈল আলাইহিস সালাম যিনি মেঘমালা ও বৃষ্টি বর্ষণের জিম্মাদার।
ইসরাফিল আলাইহিস সালাম। শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার জিম্মাদার।
মালাকুল মাওত আলাইহিস সালাম, যিনি রুহসমূহ কবজ করার জিম্মাদার।
আরও কতক মালায়েকা: নিরাপত্তাদানকারী ও কিরামান কাতেবীন, জান্নাতের দারোয়ান, জাহান্নামের দারোয়ান ইত্যাদি যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না।
- মালায়েকাদের প্রতি ঈমান আনা তাদের ভালোবাসা ও মুহাব্বাতকে দাবি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}مَن كَانَ عَدُوًّا لله وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ الله عَدُوٌّ لِّلْكَافِرِينَ{ [البقرة:98].
“যে কেউ আল্লাহ, তাঁর মালায়েকা, তাঁর রাসূলগণ এবং জিব্রীল ও মীকাঈলের শত্রু হবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের শত্রু।” [আল-বাকারাহ : ৯৮]
- একজন মুসলিমের ওপর দায়িত্ব হলো মালায়েকাদের কষ্ট হয় বা খারাপ লাগে এমন সব কর্ম থেকে বিরত থাকা। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
«مَنْ أَكَلَ الْبَصَلَ، وَالثُّومَ، وَالْكُرَّاثَ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مَسْجِدَنَا، فَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ تَتَأَذَّى مِمَّا يَتَأَذَّى مِنْهُ بَنُو آدَمَ » [رواه مسلم]
“যে ব্যক্তি পেয়াজ, রসুন ও দূর্গন্ধ যাতীয় কিছু খায়, সে যেন আমাদের মসজিদসমূহের কাছে না আসে। কারণ যে সব বস্তুর কারণে আদম সন্তান কষ্ট পায় তাতে মালায়েকাও কষ্ট পায়।” [মুসলিম]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
«لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ وَلَا صُورَةٌ» [رواه مسلم].
“মালায়েকা সে ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর ও ছবি রয়েছে।” [মুসলিম]
আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা মালায়েকার প্রতি বিশ্বাস করেন তাদের মুহাব্বাত করেন এবং তাদের কষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকেন। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা ঈমানের রুকনসমূহ হতে তৃতীয় রুকন অর্থাৎ কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনা বিষয়ে আলোচনা করব।
এ দারসে ঈমানের রুকনসমূহ হতে তৃতীয় রুকন অর্থাৎ কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনা বিষয়ে আলোচনা করব। আর তা হচ্ছে:
কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান: যেমন হিদায়াত অন্বেষীদের হিদায়াতের জন্য এবং জগতের ওপর দলীলস্বরূপ আল্লাহ তার স্বীয় রাসূলগণের ওপর যে সব কিতাব নাযিল করেছেন তার প্রতি আমাদের ঈমান আনা।
- বিশেষভাবে আল্লাহ আমাদের জন্য যে সব কিতাবের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন, তাওরাত যেটি আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালামের ওপর নাযিল করেছেন, ইন্জিল যেটি আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর নাযিল করেছেন, যাবূর যেটি আল্লাহ দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর নাযিল করেছেন এবং কুরআন যেটি আল্লাহ শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওপর নাযিল করেছেন। মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন,
}قُولُوا آمَنَّا بِالله وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَبِّهِم{ [البقرة: 136].
“তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, এবং যা ইবরাহীম, ইসমা’ঈল, ইসহাক, ইয়া’কূব ও তার বংশধরদের প্রতি করা নাযিল হয়েছে এবং যা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের রব-এর নিকট হতে দেয়া হয়েছে।” [আল বাকারাহ: ১৩৬]
- আল-কুরআনুল কারীম হলো আসমানী কিতাবসমূহের সর্বশেষ কিতাব। এটি পূর্বে অবতীর্ণ সকল আসমানী কিতাবসমূহের রহিতকারী। মহান আল্লাহ বলেন,
}وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ{ [المائدة: 48]
“আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও তার উপর তদারককারীরূপে।” [আল-মায়িদাহ: ৪৮]
আল্লাহর বাণী (وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ) দাবি করে যে, আল-কুরআনুল কারীম পূর্বের সব কিতাবের ওপর ফায়সালাকারী এবং ক্ষমতা কেবল তারই। এটি তার পূর্বের সব কিতাবের রহিতকারী।
- মুসলিমের ওপর ওয়াজিব হল, আল্লাহর কিতাবের হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জেনে, তার কাহিনী ও দৃষ্টান্তসমূহ হতে উপদেশ গ্রহণ করে, তার দাবি অনুযায়ী আমল করে, যথাযথভাবে তার তিলাওয়াত করে ও তার ওপর থেকে প্রতিহত করার মাধ্যমে আল্লাহর কিতাবের সম্মান করা ও তার কল্যাণকামী হওয়া।
আল্লাহ আমাদেরকে তার কিতাবের বুঝ এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। এটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে ঈমানের রুকনসমূহ হতে চতুর্থ রুকন অর্থাৎ রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে ঈমানের রুকনসমূহ হতে চতুর্থ রুকন সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হচ্ছে:
রাসূলগণের ওপর ঈমান: আর তা হলো, আমাদের ঈমান আনা যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক উম্মাতের নিকট তাদের থেকে রাসূল পাঠিয়েছেন। যিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করতেন যার কোনো শরীক নেই আর তাগুতের ইবাদত বর্জন করতে বলতেন। আর রাসূলগণ সবাই হলো পুতপবিত্র এবং আমানতদার এবং হিদায়াতকারী ও হিদায়াতপ্রাপ্ত। আল্লাহ তাদেরকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তারা তাদের সবই পৌঁছে দিয়েছেন। তারা কোনো কিছু গোপন করেননি এবং বিকৃত করেননি, তাতে তারা তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে একটি শব্দও বাড়াননি এবং কমাননি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
رُّسُلًا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى الله حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ الله عَزِيزًا حَكِيمًا{ [النساء: 165]،
“সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণ আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ না থাকে। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [আন-নিসা : ১৬৫]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا الله وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ{ [النحل: 36].
“আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং পরিহার কর তাগূতকে।” [আন-নাহল ৩৬]
- বিশেষ করে তাদের মধ্য হতে যাদের নাম নিয়েছেন তাদের ওপর ঈমান আনব। যেমন, মুহাম্মাদ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা, নূহ প্রমূখ সম্মানিত রাসূলগণ।
- যে ব্যক্তি তাদের একজনের রিসালাতকে অস্বীকার করল সে সবার প্রতি কুফরী করল। এ কারণেই আল্লাহ বলেন,
كَذَّبَتْ قَوْمُ نُوحٍ الْمُرْسَلِينَ{ [الشعراء: 105]
“নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল।” [আশ-শুআরা : ১০৫]
তিনি আরও বলেছেন,
كَذَّبَتْ عَادٌ الْمُرْسَلِينَ { [الشعراء: 123]
“আদ সম্প্রদায় রাসূলদের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল।” [আশ-শুআরা : ১২৩]
এটি আমাদের সবারই জানা যে, প্রত্যেক উম্মতই তাদের রাসূলদের অস্বীকার করেছে। দীন এক হওয়া এবং প্রেরণকারী একই হওয়ার কারণে একজন রাসূলকে অস্বীকার করার অর্থ হলো সব রাসূলকেই অস্বীকার করা।
- আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা নবীদের সমাপ্তি টানেন। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
}مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ الله وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ{ [الأحزاب: 40]
“মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী।” [আল-আহযাব : ৪০]
আল্লাহ তা‘আলা তার দীনকে পূর্বের সব দীনের রহিতকারী বানিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
}وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ{ [آل عمران: 85]
“আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [আলে ইমরান : ৮৫]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلَا نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّار» [رواه مسلم].
“সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! ইয়াহুদী হোক আর খৃস্টান হোক, যে ব্যক্তিই আমার এ রিসালাতের খবর শুনেছে অথচ আমার রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে।” [হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]
- আর যে ব্যক্তি ধারণা করল যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরী‘আত ছাড়া অন্য কোনো দীন কবুল করবেন সে অবশ্যই কাফির। কারণ, সে কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম আলেমগণের ইজমাকে অস্বীকার করছে।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এই যে, আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন যিনি রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছেন, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন এবং তাদের অনুকরণ করেছেন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আগামী দারসে ঈমানের রুকনসমূহ হতে পঞ্চম রুকন সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনা।
ঈমানের রুকনসমূহ সম্পর্কে আমরা আমাদের আলোচনা শেষ করব। আর এই দারসে পঞ্চম রুকন সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো-
আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান: আর তা হলো কিয়ামত দিবস। অর্থাৎ আমরা অকাট্যভাবে বিশ্বাস করব যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কবর থেকে উঠাবেন তারপর তাদের হিসাব নিবেন এবং তাদের কর্মের ওপর তাদের বিনিময় দান করবেন, অবশেষে জান্নাতীগণ তাদের স্তরে এবং জাহান্নামীগণ তাদের স্তরে অবস্থান করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِالله وَالْيَوْمِ الْآخِرِ{ [البقرة: 177]
“বরং ভালো কাজ হলো যে ঈমান আনে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি।” [আল-বাকারাহ : ১৭৭] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
}وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِن كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَىٰ بِنَا حَاسِبِينَ{ [الأنبياء: 47].
“আর কিয়ামতের দিনে আমরা ন্যায়বিচারের পাল্লাসমূহ স্থাপন করব, সুতরাং কারো প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না এবং আমল যদি শস্য দানা পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও তা আমরা উপস্থিত করব; আর হিসেব গ্রহণকারীরূপে আমরাই যথেষ্ট।” [আল-আম্বিয়া : ৪৭]
- আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান অন্তর্ভুক্ত করে: কবরের প্রশ্ন, কবরের আযাব ও নিআমত, কবর থেকে মানুষকে পুনরুত্থানের ঈমান, হাশরের মাঠে তাদের একত্রীকরণ, তাদের হিসাব নেওয়া ও তাদের আমলের প্রতিদান দেওয়া এবং মিযান ও পুসিরাতের প্রতি ঈমান, আমলনামা যেটি ডান অথবা পিছন দিয়ে বাম হাতে দেওয়া হবে তার প্রতি ঈমানকে।
- কিয়ামতের দিন রয়েছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَىٰ وَمَا هُم بِسُكَارَىٰ وَلَٰكِنَّ عَذَابَ الله شَدِيدٌ{ [الحج: 1-2]
“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা দেখবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্য দানকারিনী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতাল সদৃশ; অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর আযাবই কঠিন।” [আল-হাজ : ১-২]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُ رَأْيُ عَيْنٍ فَلْيَقْرَأْ إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ وَإِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ» [رواه الترمذي وصححه الألباني].
“কিয়াম দিবসের প্রতি তাকাতে যার সখ হয় যেন তা বাস্তবের মতই সে যেন সূরা তাকবীর, ইনফিতার ও ইনশিকাক তিলাওয়াত করে।” [হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
- আখিরাত দিবসের প্রতি যে ঈমান আনবে, নেক আমল করার প্রতি তার আগ্রহ বেড়ে যাবে এবং গুনাহ ও মন্দ কর্মসমূহ করতে ভয় পাবে। এ দ্বারা আল্লাহ যাদেরকে অভাব অনটনে লিপ্ত করেন অথবা যাদের ওপর জুলুম আপতিত করার দ্বারা পরীক্ষা করেন তাদেরকে শান্তনা দেন যে, তাদের জন্য এমন একটি দিবস রয়েছে যেখানে তারা তাদের জুলমের বদলা ফিরে পাবে। আর যখন মুমিনগণ জান্নাতে প্রবেশ করবেন তখন তারা তাদের কষ্ট ও দুঃখগুলো ভুলে যাবেন। যেমননিভাবে জাহান্নামীগণ যখন তাতে প্রবেশ করবেন তখন যেসব সুখ-ভোগ তাদের সঙ্গী হয়েছিল তারা তা ভুলে যাবে। জাহান্নাম থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই।
আল্লাহ আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করুন যারা কিয়ামাতের দিন নিরাপদে আসবে আর আমাদেরকে হাজির করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দলে।
এতটুকুতে আলোচনা যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে আমরা কিয়ামাতের আলামাত সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা কিয়ামতের আলামাত সম্পর্কে আলোচনা করব। অর্থাৎ যে সব আলামত কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে দেখা যাবে এবং কিয়ামত কাছাকাছি হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
- কিয়ামতের আলামতসমূহকে ছোট ও বড় দুটি ভাগে ভাগ করার পরিভাষা তৈরি হয়েছে: ছোট আলামত হলো যেগুলো কিয়ামতের অনেক আগে সংঘটিত হয়। এ সবের কতক সংঘটিত হয়েছে ও নিঃশেষ হয়ে গেছে আবার কতক আছে যেগুলো বারবার সংঘটিত হয়। আবার কতক আছে যেগুলো প্রকাশ পেয়েছে, এখনো প্রকাশ পাচ্ছে এবং একের পর এক সংটিত হচ্ছে। আবার কতক আছে যেগুলো এখনও সংঘটিত হয়নি, তবে অবশ্যই পরম সত্যবাদি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সংবাদ দিয়েছেন সেভাবে সংঘটিত হবে।
- কিয়ামতের ছোট আলামত অসংখ্য, যেমন, ইলম ছিনিয়ে নেওয়া, ফিতনা ছড়িয়ে পড়া, অশ্লীল কর্ম ব্যাপক হওয়া, হত্যা ও ভুমিকম্প বেশি হওয়া, সময় কাছাকাছি হওয়া (অর্থাৎ সময় দ্রুত চলে যাওয়া), অনেক মিথ্যাচারের পক্ষ হতে নবুওয়াতের দাবি করা, খালি পা ও বস্ত্রহীন অভাবী ছাগলের রাখালদের প্রাসাদ নিয়ে বড়াই করা, উম্মতদেরকে মুসলিমদের বিপক্ষে ডাকাডাকি করা। তারপর শেষের দিকে ইয়াহুদীদের ওপর মুসলিমদের বিজয় লাভ করা, তখন পাথর ও গাছ কথা বলবে তারা মুসলিমদেরকে ইয়াহুদীদের আত্মগোপন করার স্থানকে দেখিয়ে দেবে। এ ধরনের আরও অনেক আলামত।
যেমন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ، وَيَكْثُرَ الْجَهْلُ، وَيَكْثُرَ الزِّنَا، وَيَكْثُرَ شُرْبُ الْخَمْرِ، وَيَقِلَّ الرِّجَالُ، وَيَكْثُرَ النِّسَاءُ، حَتَّى يَكُونَ لِخَمْسِينَ امْرَأَةً الْقَيِّمُ الْوَاحِدُ»، وَفِي رِوَايَةٍ: «يَقِلُّ الْعِلْمُ وَيَظْهَرُ الْجَهْلُ» [متفق عليه].
“কিয়ামতের আলামত হলো ইলম তুলে নেওয়া হবে। অজ্ঞতা বাড়বে, ব্যভিচার বাড়বে, মদ্যপান বাড়বে, পুরুষের সংখ্যা কমবে এবং নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, এমনকি পঞ্চাশ জন নারীর জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া যাবে।“ অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, “ইলম কমে যাবে এবং অজ্ঞতা প্রকাশ পাবে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- কিয়ামতের বড় আলামতসমূহ: তা হলো বড় বড় বিষয় যা প্রকাশ পাওয়া দ্বারা বুঝা যাবে যে, কিয়ামত অতি নিকটে এবং এ মহা দিবসটি সংঘটিত হওয়ার খুব কম সময় অবশিষ্ট আছে।
- মুসলিম তার সহীহতে হুযাইফা ইবন উসাই আল-গিফারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমরা আলোচনা করতে ছিলাম, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি আলোচনা করছ?” তারা বলল, আমরা কিয়ামতের আলোচনা করছি। তিনি বললেন,
«إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتَّى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ عليه السلام وَيَأَجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلاثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ، وَآخِرُ ذَلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنْ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ».
“দশটি আলামত না দেখা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। আর তা হলো দাজ্জাল, ধোঁয়াশা, দাব্বাতুল আরদ, পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয়, ঈসা আল্লাইহিস সালামের অবতরণ, ইয়াজুজ মাযুযের প্রকাশ এবং তিনটি ভুমি ধস, একটি পশ্চিমে এবং অপরটি পূর্ব প্রান্তে। আর একটি জাযীরাতুল আরবে। আর এর সর্বশেষ আলামত হলো ইয়ামান থেকে একটি অগ্নি বের হবে যা মানুষকে তাদের হাশরের দিকে নিয়ে যাবে।”
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদের সঠিক বুঝ দান করেন এবং তিনি যেন, আমাদেরকে প্রকাশ্য ও গোপনীয় ফিতনার অনিষ্টতা থেকে বাঁচান। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা ঈমানের রুকনসমূহ হতে ষষ্ঠ ও সর্বশেষ রুকন অর্থাৎ তাকদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান আনা বিষয়ে আলোচনা করব।
এ দারসে ঈমানের রুকনসমূহ হতে ষষ্ঠ রুকন অর্থাৎ তাকাদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান আনা বিষয়ে আলোচনা করব। আর তা হচ্ছে:
তাকাদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান আনা: আর তা হলো আমাদের ঈমান আনা যে, যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ আল্লাহর ফায়সালায় ও নির্ধারণের কারণে হয়ে থাকে। আর আল্লাহ কোনো কিছু হওয়ার আগে তা যে হবে তা জানতেন। এটি তার নিকট লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করেছেন। আর কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া হয় না। আল্লাহ প্রতি বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি যা চান তাই করেন।
- আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে নিজের পূর্বইলম থাকা এবং নিজের জন্যে তা লিপিবদ্ধ করার সংবাদ দিয়ে বলেন,
}أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ الله يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى الله يَسِيرٌ{ [الحج: 70]
“আপনি কি জানেন না যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন। এসবই তো আছে এক কিতাবে; নিশ্চয় তা আল্লাহর নিকট অতি সহজ।” [আল-হজ: ৭০]
আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«كَتَبَ اللـه مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ قَالَ: وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ» [رواه مسلم]
“আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। তিনি বলেন, আর তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর।” [হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]।
আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি বস্তুতে তাঁর ইচ্ছা কার্যকর হওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
}وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللـه رَبُّ الْعَالَمِينَ{ [التكوير: 29]
“আর তোমরা ইচ্ছে করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্ ইচ্ছে করেন।” [আত-তাকবীর: ২৯]
আল্লাহ সুবহানাহু স্পষ্টভাবে বলেন যে, তিনিই সমগ্র জগত ও তাদের আমলসমূহ সৃষ্টি করেছেন,
}وَالله خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ{ [الصافات: 96].
“অথচ আল্লাহ্ই তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা সৃষ্টি করেছেন।” [আস-সাফফাত: ৯৬]
- তাকদীরের ওপর ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, আমরা ঈমান আনব যে-
- বান্দার ইচ্ছা ও স্বাধীনতা রয়েছে যার ফলে তার কর্মসমূহ সংঘটিত হয়, যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
}لِمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ{ [التكوير: 28]
“তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্য।” [আত-তাকবীর : ২৮]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}لَا يُكَلِّفُ الله نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا{ [البقرة: 286].
“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।” [আল-বাকারাহ : ২৮৬]
- বান্দার চাওয়া ও তার কুদরাত আল্লাহর কুদরাত ও ইচ্ছার বাহিরে নয়। তিনিই বান্দাকে তা দিয়েছেন এবং তাকে গ্রহণ করার সক্ষম বানিয়েছেন।
যেমন আল্লাহ বলেন,
}وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ الله رَبُّ الْعَالَمِينَ{ [التكوير: 29].
“আর তোমরা ইচ্ছে করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্ ইচ্ছে করেন।” [আত-তাকবীর : ২৯]
- আর আমরা ঈমান আনব যে, কদর হলো মাখলুকের মধ্যে আল্লাহর রহস্য। তিনি আমাদের জন্য যা বর্ণনা করেছেন আমরা তা জানি এবং তার প্রতি ঈমান আনি আর যা আমাদের থেকে অদৃশ্য তা আমরা মেনে নিই এবং তার প্রতি ঈমান আনি। আর আমরা আমাদের অসম্পূর্ণ জ্ঞান ও দুর্বল বুদ্ধি দ্বারা তাঁর বিধান ও কর্মসমূহে আল্লাহর সাথে বিবাদ করি না। বরং আমরা আল্লাহর পরিপূর্ণ ইনসাফ ও তাঁর অসীম প্রজ্ঞার ওপর ঈমান আনি। আর আল্লাহ যা করেন সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদের জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন ও তার মাধ্যমসমূহ আমাদের জন্যে প্রস্তুত করে দিন। আর তাতে আমাদের সন্তুষ্ট ও প্রশান্ত চিত্ত থাকার তাওফীক দান করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে তাকদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমানের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করব।
পূর্বের দারসে আমরা তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আর এটি অন্তর্ভুক্ত করে, প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে আল্লাহর পূর্ব জ্ঞান। আল্লাহ এটি লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করেছেন। আর কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সংঘটিত হয় না। আর আল্লাহ প্রতিটি বস্তুর স্রষ্টা।
এ দারসে আমরা তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করব। তন্মধ্যে:
- তাকদীর হলো এ দুনিয়াতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমল করা, চেষ্টা করা ও উদ্যমতা হাসিল করার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। একজন মুমিন আল্লাহর ওপর ভরসা করার সঙ্গে উপকরণ গ্রহণ করার ব্যাপারে আদিষ্ট। আর এ কথা বিশ্বাস করা যে, উপকরণ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো ফল দেয় না। কারণ, আল্লাহ নিজেই উপকরণ সৃষ্টি করেন এবং তিনিই নিজেই ফলাফল সৃষ্টি করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، وَاسْتَعِنْ بِالله وَلَا تَعْجَزْ، وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلَا تَقُلْ: لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ: قَدَرُ الله وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ» [رواه مسلم]
“তোমাকে যা উপকার করবে, তার প্রতি তুমি আগ্রহী হও এবং আল্লাহর সাহায্য গ্রহণ কর, তবে অক্ষম হয়ো না। আর যদি কোনো বিপদ তোমাকে স্পর্শ করে, বলো না: আমি যদি এরূপ করতাম, তাহলে এরূপ ও এরূপ হতো। তবে বলো: আল্লাহই নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন করেছেন। কারণ, «لو» শব্দটি শয়তানের আমলকে উন্মুক্ত করে দেয়।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
«اعْمَلُوا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ» [رواه البخاري].
“তোমরা কাজ সম্পাদন করতে থাক। কেননা, যাকে যে কাজের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য সেই কাজকে সহজ করে দেয়া হয়।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
- কদরের প্রতি ঈমানের ফলাফল হলো, একজন মুমিনের ওপর আল্লাহ যখন কোনো নিয়ামত দান করেন তখন সে শুকরিয়া আদায় করে, অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে না, আর আল্লাহ যখন দুনিয়াবি কোনো মুসীবত দ্বারা তাকে পরীক্ষা করেন তখন সে সবর করে, হায় হুতাস করে না ও ভেঙ্গে পড়ে না, যেমন আল্লাহ বলেন,
}مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى الله يَسِيرٌ (22) لِّكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَىٰ مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَالله لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ { [الحديد: 22-23].
“যমীনে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয়ই আসে তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমরা তা কিতাবে লিপিবদ্ধ রেখেছি। নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষে এটা খুব সহজ।” (২২) এটা এ জন্যে যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য আনন্দিত না হও। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না কোনো উদ্ধত - অহংকারীদেরকে।” [আল-হাদীদ : ২২-২৩]
- তাকদীরের প্রতি ঈমানের আরেকটি ফল হলো: এটি নগ্ন হিংসাকে শেষ করে দেয়। ফলে মানুষকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ দান করেছেন তার ওপর একজন মুমিন হিংসা করেন না। কারণ, আল্লাহই তাদের তাওফীক দিয়েছেন এবং তাদের জন্য তা নির্ধারণ করেছেন। আর হিংসুক যখন অপরকে হিংসা করে তখন সে তার এ কর্ম দ্বারা আল্লাহর কাদর ও বন্টনের ওপর আপত্তি আরোপ করে।
- আরেকটি ফল হলো: কাদরের প্রতি ঈমান অন্তরের মধ্যে বিপদ আপদ মোকাবালা করার জন্য সাহস যোগায় এবং তাতে মনোবলকে শক্তিশালী করে। কারণ সে বিশ্বাস করে যে মৃত্যু এবং রিযিক নির্ধারিত। আর একজন মানুষের ভাগ্যে তাই হবে যা তার জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ الله لَنَا هُوَ مَوْلَانَا وَعَلَى الله فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ{ [التوبة: 51].
“বলুন, ‘আমাদের জন্য আল্লাহ্ যা লিখেছেন তা ছাড়া আমাদের অন্য কিছু ঘটবে না; তিনি আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর উপরই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত।” [আত-তাওবাহ : ৫]
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদের ঈমান ও বিশ্বাসকে বৃদ্ধি করে দিন ও আমাদেরকে তার দিনের ওপর অটুট রাখেন। আর আমাদের শেষ পরিণতি সুন্দর করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা ইসলামের রুকনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা ইসলামের রুকনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো পাঁচটি রুকন যার ওপর ইসলামের দীন দাঁড়িয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«بُنِيَ الإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ، شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا الله وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَحَجِّ الْبَيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ» [متفق عليه].
“ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে পাঁচটির ওপর। সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, বাইতুল্লাহর হজ করা এবং রমযানের সাওম আদায় করা।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
সুতরাং প্রথম রুকন হলো দুটি সাক্ষ্য: আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।
এ দুটি সাক্ষ্য হলো ইসলামের চাবি। এ দুটি ছাড়া ইসলামে প্রবেশ করা সম্ভব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أُمِرْتُ أنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حتَّى يَشْهَدُوا أنْ لا إلَهَ إلَّا اللهُ، وأنَّ مُحَمَّدًا رَسولُ اللَّهِ، ويُقِيمُوا الصَّلَاةَ، ويُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذلكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وأَمْوَالَهُمْ إلَّا بحَقِّ الإسْلَامِ، وحِسَابُهُمْ علَى اللَّهِ» [رواه البخاري].
“আমাকে লোকেদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে; যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া (সত্য) কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তাঁরা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত প্রদান করবে। যখন তারা এ কাজগুলো সম্পাদন করবে, তখন তারা আমার নিকট থেকে তাদের রক্ত (জান) এবং মাল বাঁচিয়ে নেবে; কিন্তু ইসলামের হক ব্যতীত। আর তাদের হিসাব আল্লাহর ওপর ন্যস্ত হবে।” [হাদীসটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا الله دَخَلَ الْجَنَّةَ» [رواه أبو داود].
“যার সর্বশেষ বাক্য হবে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই), সে জান্নতে প্রবেশ করবে।” [হাদীসটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন]।
- ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু’ এর অর্থ হলো একজন মানুষ মুখে স্বীকার করবে এবং অন্তরে বিশ্বাস করবে যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই। তিনি ছাড়া অন্য সব ইলাহ বাতিল এবং অন্যায়ভাবে তাদের উপাসনা করা হয়।
সুতরাং ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু’ - আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর সত্যিকার ইলাহ হওয়াকে না করে এবং তা একমাত্র এক আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}فمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِالله فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقىَ{ [البقرة: 256]
“অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়।” [আল-বাকারাহ : ২৫৬]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
‘তাগুত অর্থ হলো, যদ্বারা একজন বান্দা তার সীমাকে লঙ্ঘন করে, চাই তা উপাস্য হোক বা অনুকরণীয় হোক বা অনুসরনীয় হোক।’
ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
‘তাগুত অসংখ্য। আর তাদের নেতা হলো পাঁচজন: অভিশপ্ত ইবলিস, যার সম্মতিতে তার ইবাদত করা হয়, যে মানুষকে তাদের গোলামীর দিকে আহ্বান করে, যে গাইবী ইলমের দাবী করে আর যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে বাদ দিয়ে বিচার ফায়সালা করে।’[[7]]
রাসূলগণকে প্রেরণ করা দ্বারা মহান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর তাওহীদ এবং ইবাদাতে তাকে একক সাব্যস্ত করা। আল্লাহ বলেন,
}وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا الله وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ{ [النحل: 36].
“আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং পরিহার কর তাগূতকে।” [আন-নাহল ৩৬]
আল্লাহ আমাদেরকে তার তাওহীদে বিশ্বাসী মুখলিস এবং তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াতের অনুসারী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল সাক্ষ্যের অর্থ সম্পর্কে আলোচনা সম্পন্ন করব।
আমরা ইসলামের রুকনসমূহ হতে প্রথম রুকন সম্পর্কে আলোচনা শেষ করব। এখন আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আল্লাহর রাসূল সাক্ষ্যের আলোচনায় অবস্থান করছি।
- এর অর্থ: স্বীকার করা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহ তাকে তাঁর দীন পৌছানোর জন্য এবং সমগ্র মাখলুকের হিদায়াতের জন্য পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا{ [سبأ: 28]
“আর আমি তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি।” [সাবা : ২৮]
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
}وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ{ [الأنبياء: 107].
“আর আমরা তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই পাঠিয়েছি।” [আল-আম্বিয়া : ১০৭]
- আর এ স্বীকারুক্তি দাবি করে যে, তিনি যে সব সংবাদ দিয়েছেন তা বিশ্বাস করা এবং যা আদেশ করেছেন তার অনুসরণ করা এবং যা থেকে তিনি নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। আর তিনি যার অনুমোদন দিয়েছেন তার ব্যতিরেকে আল্লাহর ইবাদাত না করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ{ [الزمر]
“আর যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে তা সত্য বলে মেনেছে তারাই তো মুত্তাকী।” [আয-যুমার : ৩৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
}وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ { [النجم: 3-4]
“আর তিনি নিজের পক্ষ হতে কোনো কথা বলেন না, তা কেবলই ওহী যা তার প্রতি প্রেরণ করা হয়েছিল।” [আন-নাজম : ৩-৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ الله { [النساء: 64]
“তোমাদের কাছে কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি; কিন্তু আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের অনুকরণ করার জন্যই।” [আন-নিসা : ৬৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
}فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا{ [النساء: 65].
“কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” [আন-নিসা : ৬৫]
- শুধু অন্তরের বিশ্বাস দ্বারা শাহাদত (সাক্ষ্য প্রদান) বিশুদ্ধ হবে না। বরং যে ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করতে চায় তার জন্যে শর্ত হচ্ছে শাহাদাত দুটি মুখে উচ্চারণ করা এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করা।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা যে, তিনি আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদের অর্ন্তভুক্ত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। পরবর্তী দারসে আমরা সে সব গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করব যা কতক মুসলিম করে থাকে, অথচ তারা মনে করে যে তারা ভালো কাজ করছে।
এ দারসে আমরা সে সব গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করব যা কতক মুসলিম করে থাকে আর তারা মনে করে যে তারা ভালো কাজ করছে। আর তা হলো দীনের মধ্যে বিদ‘আত করা।
দীনের মধ্যে বিদআত: শরীআতে যার কোনো ভিত্তি নাই তা দ্বারা আল্লাহর ইবাদত করা। অথবা এমন বিষয় দ্বারা আল্লাহর ইবাদত করা যার ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার রাশিদ খলীফাগণ ছিলেন না।
অথচ আল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন যে, দীন পরিপূর্ণ হয়েগেছে। আল্লাহ বলেন,
}الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا{ [المائدة:3]
“আজকের দিন আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আর তোমাদের ওপর আমার নিআমতকে সম্পন্ন করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে মনোনিত করলাম।” [আল-মায়েদা : ৩]
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে বিদআত এবং দীনের মধ্যে নব আবিষ্কার করা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন,
«مَن أَحْدَثَ في أَمْرِنَا هذا ما ليسَ فِيهِ، فَهو رَدٌّ» [متفق عليه]
যে ব্যক্তি আমাদের এ দীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল যা তাতে নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]। অর্থাৎ ‘রাদ্দ’ শব্দের অর্থ প্রত্যাখ্যাত অগ্রহণযোগ্য।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«أُوصيكُم بتقوى اللهِ والسمعِ والطاعةِ وإنْ عبدًا حَبشيًّا، فإنَّه من يَعِشْ منكم بعدي فسيرى اختلافًا كثيرًا، فعليكم بسُنَّتِي وسُنَّةِ الخُلَفاءِ المهدِيِّين الراشِدِين تمسَّكُوا بها، وعَضُّوا عليها بالنواجِذِ، وإياكم ومُحدَثاتِ الأمورِ فإنَّ كلَّ مُحدثةٍ بدعةٌ، وكلَّ بدعةٍ ضلالةٌ» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
“আমি তোমাদেরকে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করা, শোনা ও আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি যদিও (তোমাদের আমীর) কোনো হাবসী গোলাম হয়। কারণ, আমার পর তোমাদের থেকে যারা বেচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং আমার সুন্নাত এবং হিদায়াত প্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর। তোমরা তা মজবুত করে ধর এবং দাঁত দ্বারা তার ওপর কামড় দাও। আর তোমরা নব আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ হতে বিরত থাকো। কারণ সব নব আবিষ্কৃত বস্তু বিদআত। আর সব বিদআতই গোমরাহী।” [আবূ দাউদ। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।
বিদআতের অনেক প্রকার রয়েছে। তার মধ্যে কিছু হলো বিশ্বাসগত বিদআত। যেমন, আল্লাহর নাম ও সিফতাসমূহকে অস্বীকার করা। অথবা নবী ও রাসূলগণ ছাড়া অন্য কোনো মানুষকে নিষ্পাপ বলে বিশ্বাস করা। অথবা কোনো বস্তুর মধ্যে উপকার, ক্ষতি ও বরকত আছে বলে বিশ্বাস করা যাতে আল্লাহ তা রাখেননি। এ ধরনের আরও বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস করা যার কোনো ভিত্তি শরীআতে নাই।
বিদআতের প্রকারসমূহ হতে কিছু বিদআত হলো, আমলী বিদআত। এগুলো আবার কয়েক প্রকার: আর তা হলো,
১- এমন কিছু ইবাদত আবিষ্কার করা শরীআতে যার কোনো ভিত্তি নাই। যেমন, শরীয়ত অননুমোদিত সালাত আবিষ্কার করা, বা শরীয়ত অননুমোদিত সাওম আবিষ্কার করা বা শরীয়ত অননুমোদিত উৎসব আবিষ্কার করা। যেমন, ঈদে মীলাদুন্নবীর ন্যায় অন্যান্য নব আবিষ্কৃত ঈদসমূহ।
২- শরীয়ত অনুমোদিত ইবাদতে বৃদ্ধি করা। যেমন, যুহরের সালাতে ইচ্ছাকৃত পঞ্চম রাকাত বৃদ্ধি করা এই বিশ্বাসে যে এরূপ করা বৈধ।
৩- শরীয়ত অনুমোদিত ইবাদত শরীয়ত অননুমোদিত পদ্ধতিতে আদায় করা। যেমন, জামাতবদ্ধভাবে (একই আওয়াযে)[[8]] যিকির করা এবং বৈধ মনে করে ওযুতে দুই হাত ধোয়ার আগে দুই পা ধোয়া।
৪- শরীত অনুমোদিত ইবাদতের জন্য কোনো সময়কে খাস করা, যা শরীয়ত খাস করেনি। যেমন, শাবানের ১৫ তারিখের রাত ও দিনকে কিয়াম ও সিয়ামের জন্য খাস করা। মৌলিকভাবে সিয়াম ও কিয়াম বৈধ, কিন্তু এটিকে কোনো সময়ের সাথে নির্ধারণ করতে হলে দলীল লাগবে।
বিদআত প্রকাশ পাওয়ার কারণসমূহ: দীনের বিধানসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রবৃত্তির অনুসরণ, বিভিন্ন মানুষের মতামতের পক্ষাবলম্বন করা এবং তাকে কুরআন ও সুন্নাহের ওপর প্রাধান্য দেয়া, কাফেরদের সাথে সাদৃস্য অবলম্বন করা। দূর্বল ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর বানোয়াট হাদীসসমূহের ওপর ভরসা করা। আর বিদআতের সবচেয়ে বড় ও অন্যতম কারণ হলো বাড়াবাড়ি করা।
আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা সুন্নাতের অনুসরণ করে এবং আমাদেরকে বিদআত ও কু-সংস্কার হতে দূরে রাখুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আগামী পাঠে ইসলামের রুকনসমূহ হতে ২য় রুকন ও ইসলামের খুটি অর্থাৎ সালাত সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে ইসলানের রুকনসমূহ হতে দ্বিতীয় রুকন অর্থাৎ সালাত বিষয়ে আলোচনা করব।
- মুসলিম ও কাফিরের মাঝে প্রার্থক্য নির্ধারণকারী হলো সালাত। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
«إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ» [رواه مسلم]
“একজন মানুষ এবং শির্ক ও কুফরের মধ্যে প্রার্থক্য হলো সালাত ছেড়ে দেওয়া।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]।
- এটি ইসলামের খুঁটি। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ» [رواه الترمذي]
“যাবতীয় বিষয়ের মাথা হলো ইসলাম আর তার খুঁটি হলো সালাত।” হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন]।
সালাত হলো এমন একটি আমল যার সম্পর্কে সর্ব প্রথম হিসাব নেওয়া হবে, যদি তা শুদ্ধ হয় তার সব আমলই শুদ্ধ হবে। আর যদি তা খারাপ হয়, তার সমস্ত আমলই নষ্ট হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهِ صَلَاتُهُ فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ» [رواه أبو داود والترمذي والنسائي].
“কিয়ামাতের দিন বান্দার আমল হতে সর্ব প্রথম তার সালাতের হিসাব হবে। যদি তা ঠিক হয়, তাহলে সফল ও কামিয়াব হল। আর যদি তা ফাসিদ হয় তবে সে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হল।” [হাদীসটি আবূ দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন]
- এ দুনিয়া হতে সালাতই হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখের শীথিলতা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَجُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلاةِ» [رواه النسائي].
“আমার চোখের শীথিলতা সালাতে রাখা হয়েছে।” [এটি নাসায়ী বর্ণনা করেছেন।]
চোখের শীথিলতা: অর্থাৎ যার দ্বারা চোখ শীতল হয় এবং অন্তর তৃপ্তি পায়।
- সালাত হলো বান্দা ও মহান রবের মাঝে সেতু বন্ধন। যে সালাতকে ইখলাস ও বিনয়ের সাথে আদায় করবে তাকে এটি মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
}إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ{ [العنكبوت: 45].
“নিশ্চয় সালাত মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে।” [আল-আনকাবূত : ৪৫]
- সালাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী আদায় না করলে তা শুদ্ধ হবে না। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي» [متفق عليه]
“তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ সেভাবে সালাত আদায় কর।” মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।
সুতরাং একজন মুসলিমের ওপর ওয়াজিব হলো সালাতের বিধান এবং আদায়ের পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী শিখবে যাতে সে তা পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে পারে এবং তা আদায় করে সাওয়াব ও মহা বিনিময় লাভ করতে পারে।
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে সালাতের বিধান সম্পর্কে আলোচনা সম্পন্ন করবো।
এ দারসে আমরা সালাত বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহ হতে একটি শর্ত অর্থাৎ পবিত্রতা বিষয়ে আলোচনা করব।
অভিধানে তাহারাত অর্থ হলো, ময়লা থেকে পরিচ্ছন্ন হওয়া। আর শরীআতের পরিভাষায় এর অর্থ হলো হাদাস (অপবিত্রতা) তুলে দেওয়া এবং নাজাসাত (নাপাকী) দূর করা।
- এর ফলে পবিত্রতা দুই ভাগে বিভক্ত হল:
প্রথম প্রকার: হাদাস (অপবিত্র) থেকে পবিত্র হওয়া। এটি যদি বড় নাপাকি হয়, তাহলে তা দূর করতে হবে গোসল করার দ্বারা। আর যদি ছোট নাপাকি হয় তাহলে তা দূর করতে হবে ওযূ দ্বারা। আর তাহারাত পানি দ্বারা হবে অথবা পানি না থাকা অবস্থায় বা পানি ব্যবহারে অক্ষম হলে তায়াম্মুম দ্বারা হবে।
দ্বিতীয় প্রকার: নাজাসাত (নাপাকী) হতে পবিত্রতা অর্জন করা। আর তা হলো দেহ, পোশাক এবং যে যমীনে সালাত আদায় করা হয় তা থেকে নাপাকী দূর করা। যদি মুল নাপাকী দূর করা হয় তবে রং ও দূগর্ন্ধ দূর করতে অক্ষম হলে তা অবশিষ্ট থাকাতে কোনো অসুবিধা নাই।
কতক নাপকী রয়েছে যা শরীর, পোশাক ও স্থান থেকে দূর করা ওয়াজিব: মানুষের পেশাব, পায়খানা ও রক্ত[[9]] (অল্প রুক্তে সমস্যা নেই), যে সব জন্তুর গোস্ত খাওয়া হারাম তার পেশাব ও গোবর নাপাক। (আর যেসব জন্তুর গোসত খাওয়া হালাল তার পেশাব ও গোবর পবিত্র।) আরও নাপাক বস্তু হলো: মৃত[[10]], শুকর, কুকুর[[11]], মাযী ও ওদী।[[12]] সামান্য নাপাকী যা থেকে বিরত থাকা কষ্টকর তা ক্ষমাযোগ্য।
- যখন একজন মুসলিম পায়খানা ও পেশাবের রাস্তা দিয়ে বের হওয়া নাপাকি দূর করতে চায় তখন সে পানি দ্বারা ইস্তেঞ্জা করবে অথবা ঢিলা ব্যবহার করবে অথবা টিস্যু ইত্যাদি[[13]] দিয়ে পরিষ্কার করবে। যখনই ওযূ করার ইচ্ছা করবে তখনই পরিস্কার করা জরুরি নয়। বরং যখন পেশাব করবে তখন সে তার লজ্জাস্থান ধুয়ে ফেলবে অনুরূপভাবে যখন সে পায়খানা করবে তখন সে তার পায়ূপথ ধুয়ে ফেলবে। আর যদি বাতাস বের হয় তখন তার থেকে পবিত্রতা হাসিল করবে না।
আল্লাহ আমাদের অন্তর ও দেহকে বাহ্যিক ও আত্মিক আবর্জনা থেকে পবিত্র করুন।
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে আমরা ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হবে ওযূ দ্বারা।
- ওযূ পবিত্র পানি দিয়ে হতে হবে। যদি পানিতে নাপাকি পড়ে তার রং, স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যায় তবে তা দিয়ে ওযূ বা গোসল করা বৈধ হবে না।
ওযূর শর্ত: ওযূ অঙ্গসমূহে সরাসরি পানি পৌছতে বাধা হয় এমন বস্তু দূর করা। যেমন, মাটি, আঠালো বস্তু, মোম, ঘন রং এবং নক পালিশ যা মহিলারা লাগায় ইত্যাদি।
- দু’টি সহীহ গ্রন্থে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هَذَا ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ لَا يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَهُ غَفَرَ الله لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».
“যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম উযূ করবে, অতঃপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবে, যাতে সে নিজের নফসের সঙ্গে কথা বলবে না, তার পূর্বের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুযায়ী ওযূ করার পদ্ধতি-
- অন্তরে ওযূর নিয়ত করবে, তবে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বৈধ নয়।
- তারপর বলবে, বিছমিল্লাহ, তারপর দুই হাতের কবজি তিনবার ধুইবে।
- তারপর তিন অঞ্জলিতে তিনবার কুলি করবে এবং নাকে পানি দেবে। তারপর তিনবার চেহারা ধুইবে। আর চেহারার পাশাপাশি সীমানা হলো এক কান থেকে অপর কান পর্যন্ত। আর লম্বালম্বি সীমানা হলো কপালের উপরিভাগ থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত। যদি ওযূকারীর দাড়ি পাতলা হয় যার ভেতর দিয়ে চামড়ার রং দেখা যায় তা হলো দাড়ির ভেতর বাহির উভয় অংশ ধোয়া ওয়াজিব। আর যদি দাড়ি ঘন হয় যা চামড়া ঢেকে রাখে, তাহলে বাহিরের অংশ ধোয়াই যথেষ্ট হবে। আর দাড়ি খেলাল করা মুস্তাহাব।
- তারপর দুই হাত আঙ্গুলের মাথা থেকে নিয়ে কনুই পর্যন্ত ধুইবে। (কনুই ধোয়ার অন্তর্ভুক্ত) প্রথমে ডান হাত তারপর বাম হাত ধুইবে।
- তারপর মাথা ও দুই কান নতুন পানি দিয়ে মাসেহ করবে। তার নিয়ম হলো, দুই হাত দিয়ে মাথার সামনে থেকে পিছন দিকে গরদান পর্যন্ত ফিরাবে। তারপর যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। অর্থাৎ গর্দান থেকে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত ফিরাবে। তারপর সে তার দুটি তর্জনী আঙ্গুলকে কানের মধ্যে প্রবেশ করাবে এবং দুই কানের বাহ্যিক অংশকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে একবার মাসেহ করবে।[[14]]
- তারপর দুই পা টাখনুসহ তিনবার ধৌত করবে। প্রথমে ডান পা তারপর বাম পা। টাখনু হলো: পা ও গোড়ালির জোড়ার স্থানে দুটি উঁচা হাড্ডি।
- ওযূর ফরযসমূহের আরেকটি হলো: ওযূর অঙ্গগুলোর মাঝে ধারাবাহিকতা বঝায় রাখা। একটি অঙ্গ ধোয়ার পর পরবর্তী অঙ্গ ধোয়ার মধ্যে দীর্ঘ বিরতি গ্রহণ না করা।
- ওযূর পরে এ কথা বলা সুন্নাত।
«أشهدُ أنْ لا إلهَ إلَّا اللهُ، وأنَّ مُحمَّدًا عبدُ الله ورسولُه» [رواه مسلم].
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।” [হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]
হে আল্লাহ আপনি আমাদের তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের অর্ন্তভুক্ত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে এমন কিছু ভুল নিয়ে আলোচনা করব কতক মানুষ ওযূ করার সময় যেগুলোতে পতিত হয়।
পূর্বের পাঠে আমরা ওযূ ও ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আর এই পাঠে আমরা এমন কিছু ভুল সম্পর্কে আলোচনা করব কতক মানুষ তাদের ওযূতে যেসব ভুলে পতিত হয়। যেমন,
- নাকে পানি দেওয়া ও কুলি করা ছেড়ে দেওয়া। ফতওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণ বলেছেন:
‘ওযূতে নাকে পানি দেওয়া ও কুলি করা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ও কর্ম দ্বারা প্রমাণিত। তাই এ দুটি আমল চেহারা ধোয়ার অর্ন্তভূক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি এ দুটি বা তার যে কোনো একটি ছেড়ে দেবে তার ওযূ শুদ্ধ হবে না।’[[15]]
- ওযূর আরও ভুল হলো, দুই হাতের সাথে দুই কবজি না ধোয়া আর ওযূর শুরুতে কবজি ধোয়াকে যথেষ্ট মনে করা। বিশুদ্ধ নিয়ম হলো দুই হাতের সাথে দুই কবজি ধোয়া যদিও ওযূর শুরুতে ধুয়ে থাকে। ওযূর শুরুতে কবজিদ্বয় ধোয়া হলো মুস্তাহাব আর দুই হাতের সাথে ধোয়া ওয়াজিব।
- ওযূর আরও ভূল হলো, দুই কনুই বা দুই টাখনু বা দুই গোড়ালী ধোয়াতে অলসতা করা বা ছেড়ে দেওয়া, অথচ এ বিষয়ে হাদীসে ধমকি এসেছে। যেমন, হাদীসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَيْلٌ لِلْأَعْقَابِ مِنْ النَّارِ أَسْبِغُوا الْوُضُوءَ» [رواه مسلم]
“গোড়ালীসমূহের জন্য রয়েছে ওয়াইল জাহান্নাম। তোমরা ওযূকে পূর্ণ করো।” [হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]। গোড়ালী হলো পায়ের শেষ অংশ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে দেখলেন, তার পায়ে এক নখ পরিমাণ জায়গা ছেড়ে সে ওযূ করেছে। তখন তিনি তাকে বললেন,
«ارْجِعْ فَأَحْسِنْ وُضُوءَكَ» [رواه مسلم]
“তুমি ফিরে যাও তুমি তোমার ওযূকে সম্পন্ন করো।” [এটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]। অপর হাদীসে এসছে-
«أن النبي صلى الله عليه وسلم رأى رجُلا يُصلّي ، وفِي ظَهْرِ قَدَمَهِ لمعَةٌ قدْرَ الدِّرهَمِ لم يُصبها الماءُ فأمَرَهُ النبي صلى الله عليه وسلم أن يُعِيدَ الوضوءَ والصلاةَ» [رواه أبو داود وصححه الألباني].
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে সালাত আদায় করতে দেখলেন, এ অবস্থায় যে তার পায়ের ওপর এক দিরহাম পরিমাণ শুকনা ছিল যাতে পানি পৌছেনি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ওযূ এবং সালাত দুটোই পুনরায় আদায় করতে বললেন।” [এটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
- ওযূর আরও ভূল হলো ওযূর সব বা কতক অঙ্গকে তিনবারের বেশি ধোয়া। এটি সুন্নাতের পরিপন্থী।
- ওযূর প্রচলিত ভূল হলো: পানি ব্যবহারে অপচয় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
}وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ{ [الأعراف: 31].
“তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।” [আল-আরাফ: ৩১]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার নবীর সুন্নাত ও পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফীক দিন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা মোজার উপর মাসেহ করা বিষয়ে আলোচনা করব।
আমরা পবিত্রতার বিধান সম্পর্কীয় যে আলোচনা শুরু করেছিলাম তার ধারাবাহিকতায় আমরা এ পাঠে চামড়ার মোজা, কাপড়ের মোজা ও এ জাতীয় বস্তুর উপর মাসেহ করা সম্পর্কে আলোচনা করব। [[16]]
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য একটি ছাড় ও সুযোগ। এটি এ শরীআতের মধ্যে সহজীকরণের একটি নিদর্শন।
- মোজার ওপর মাসেহ করার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে-
প্রথম শর্ত: মোজা পবিত্র হতে হবে। সুতরাং নাপাক মোজার ওপর মাসেহ করা শুদ্ধ হবে না।
দ্বিতীয় শর্ত: মোজাদ্বয় পবিত্র অবস্থায় পরিধান করা।
তৃতীয় শর্ত: ছোট নাপাকির ক্ষেত্রে মাসেহ করবে। আর যদি বড় নাপাকী হয় তখন মোজা খোলা এবং দুই পা ধোয়া ওয়াজিব।
চতুর্থ শর্ত: মাসেহ শরীআত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হতে হবে। আর তা হলো মুকীমের জন্য এক দিন এক রাত (অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা) আর মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত (অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা)। মাসেহ করার সময় গণনা শুরু হবে অযু ভঙ্গের পর প্রথম মাসেহ করা থেকে।
- মোজার ওপর মাসেহ করার পদ্ধতি:
মোজার ওপরের অংশে মাসে করবে, যেমন দুই হাতের ভেজা আঙ্গুলগুলো দুই পায়ের আঙ্গুলগুলোর ওপর রাখবে। তারপর সে গুলোকে তার গোড়ালির শুরুর দিকে টানবে। আর মাসে একাধিকবার করবে না।
আমরা আল্লাহর নিকট দীনের বিষয়ে সঠিক বুঝ ও সাইয়্যেদুল মুরসালীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা তাওফীক প্রার্থনা করছি। এতটুকুতে আলোচনাতে যথেষ্ঠ করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে আমরা ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ এবং যার ওযূ ভেঙ্গে যায় তার করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করব।
- ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ হলো-
১- পায়খানা ও পেশাবের রাস্তা দিয়ে বর্হিগত বস্তু : এগুলো সবই ওযূ ভেঙ্গে দেয়।
২- জ্ঞানহারা হওয়া বা পাগল বা বেহুশ বা মাতাল হওয়াতে জ্ঞান না থাকা [[17]] অথবা ঘুম। কারণ এতে নাপাক বের হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর অগভীর ঘুম ওযূ ভঙ্গ করে না। (অর্থাৎ যে ঘুমে নাপাক বের হলে মানুষ বুঝতে পারে যে, নাপাক বের হয়েছে, যেমন পায়ু বের হওয়া)।
৩- উটের গোশত খাওয়া।
৪- পর্দা ছাড়া লজ্জাস্থান স্পর্শ করা [[18]] বিষয়ে আহলে ইলমগণ ইখতিলাফ করেছেন। তবে উত্তম হলো ওযূ করে নেয়া।
- ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ হতে কোনো কারণে যার ওযূ ভাঙ্গবে তার ওপর ওযূ করা ছাড়া সালাত আদায় করা বা কুরআন স্পর্শ করা হারাম।
- যে ব্যক্তি ওযূ করল অতঃপর সন্দেহ করল যে তার ওযূ নষ্ট হয়েছে কি-না, তাহলে তার ওযূ করা জরুরি নয়। কারণ, ইয়াকীন (অর্থাৎ ওযূ) সন্দেহ দ্বারা দূরীভুত হয় না।
- অনুরূপভাবে যে নাপাক হল অতঃপর সন্দেহ করল যে, সে ওযূ করেছে নাকি করে নি, তখন তার ওযূ করা জরুরি। কারণ, ইয়াকীন (অর্থাৎ নাপাক) সন্দেহ দ্বারা দূরীভুত হয় না।
আল্লাহ আমাদেরকে উপকারী ইলম এবং নেক আমলের তাওফীক দান করুন। এ টুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা গোসলের ওয়াজিবসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
উপরে আমরা ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতার বিধান বিষয়ে আলোচনা করেছি। আর এ পাঠে আমরা আলোচনা করব:
গোসল ফরয হওয়ার কারণসমূহ সম্পর্কে। আর তা হলো:
১- জাগ্রত অবস্থায় উপভোগের সাথে উত্তেজিত হয়ে বীর্য বের হওয়া। অনুরূপভাবে স্বপ্নদোষ হওয়ার পর বীর্য নির্গত হওয়া।
২- লিঙ্গকে নারীদের লজ্জাস্থানে প্রবেশ করানো। যদিও তাতে বীর্য বের না হয়। কারণ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«إذَا قَعَدَ بَيْنَ شُعَبِهَا الْأَرْبَعِ، ثُمَّ مَسَّ الْخِتَانُ الْخِتَانَ فَقَدْ وَجَبَ الْغُسْلُ» [رواه مسلم].
“যখন কোনো ব্যক্তি স্ত্রীর চার শাখার মাঝে বসে, অতঃপর খতনার স্থান খতনার স্থানকে স্পর্শ করে, তাহলেই গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]।
“খতনার স্থান খতনার স্থানকে স্পর্শ করা” দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হলো: পুরুষাঙ্গ স্ত্রীর গুপ্তাঙ্গে প্রবেশ করানো। অতএব পুরুষ যদি তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তবে তাদের প্রত্যেকের উপর গোসল ফরয হয়; যদিও বীর্যপাত না হয়।
৩- হায়েয ও নিফাসের রক্তস্রাব বন্ধ হওয়া।
- যার ওপর গোসল ফরয: সে ছোট নাপাকী অবস্থায় যে সব আমল থেকে বিরত থাকবে বড় নাপাকী অবস্থায়ও সে সব কর্ম থেকে বিরত থাকবে। তবে তাকে আরো যা করতে হবে তা হলো কুরআন পাঠ থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে ঋতুবতী ও প্রসূতি মহিলার কুরআন স্পর্শ করা ছাড়া তা তিলাওয়াত করা বৈধ। বড় নাপাকীতে নাপাক ব্যক্তির জন্য মসজিদে বসা বৈধ নয়।[[19]]
ঋতুবতী ও প্রসূতি নারীদের সঙ্গে যেমনিভাবে সহবাস করা এবং তালাক দেওয়া বৈধ নয় অনুরূপভাবে তাদের ওপর সাওম ও সালাত হারাম। তবে তারা সাওম কাজা করবে; কিন্তু সালাত কাজা করবে না।
হে আল্লাহ আপনি আমাদের তাদের দলভুক্ত করুন যারা কথা শোনে এবং সুন্দর কথার অনুসরণ করে। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে বিশুদ্ধভাবে গোসলের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা বড় নাপাকি থেকে গোসলের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করব। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে- আর তা হচ্ছে নিম্নরূপ:
১- অন্তরে গোসলের নিয়ত করবে
২- তারপর বিছমিল্লাহ বলবে এবং দুই হাত তিনবার ধুইবে তারপর লজ্জাস্থান ধুইবে।
৩- তারপর পরিপূর্ণ ওযূ করবে।
৪- তারপর মাথার ওপর তিনবার পানি প্রবাহিত করবে এবং চুলের গোড়া ভেজাবে।[[20]]
৫- তারপর ডানদিক থেকে শরীরের ওপর পানি প্রবাহিত করবে তারপর বাম দিকে। পানি দ্বারা সারা শরীর শামিল করবে এবং শরীরের পশমের গোড়া ভেজাবে। শরীরের ওপর হাত দিয়ে ঘষা দেওয়া মুস্তাহাব যাতে সারা শরীরে পানি পৌছার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত এটিই হলো গোসলের পরিপূর্ণ পদ্ধতি। যেমনটি বুখারীতে ও মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا اغْتَسَلَ مِنْ الْجَنَابَةِ غَسَلَ يَدَيْهِ وَتَوَضَّأَ وُضُوءَهُ لِلصَّلَاةِ ثُمَّ اغْتَسَلَ ثُمَّ يُخَلِّلُ بِيَدِهِ شَعَرَهُ حَتَّى إِذَا ظَنَّ أَنَّهُ قَدْ أَرْوَى بَشَرَتَهُ أَفَاضَ عَلَيْهِ الماءَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ غَسَلَ سَائِرَ جَسَدِهِ وَقَالَتْ كُنْتُ أَغْتَسِلُ أَنَا وَرَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم مِنْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ نَغْرِفُ مِنْهُ جَمِيعًا».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নাপাকি হতে গোসল করতেন দুই হাত ধুইতেন, তারপর তিনি সালাতের ওযূর মতো করে ওযূ করতেন। তারপর গোসল করতেন। তারপর তিনি তার হাত দিয়ে চুল খিলাল করতেন। তারপর যখন তার বিশ্বাস হতো যে, সে চুলের গোড়ায় চামড়াতে পানি পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন তখন তিনি তার ওপর তিনবার পানি প্রবাহিত করতেন। তারপর তিনি সমগ্র শরীর ধৌত করতেন। আর তিনি (আয়েশা ) বলেন, আমি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই পাত্র থেকে পানি নিয়ে গোসল করতাম। আমরা উভয়েই তা থেকে পানি উঠাতাম।”
- তবে দু’টি কাজ দ্বারাই ফরয গোসল হয়ে যায়।
১- অন্তরে গোসলের নিয়ত করা।
২- অতঃপর নাকে পানি দেওয়া ও কুলি করার সাথে সমগ্র শরীর এবং চুলের গোড়ায় পানি পৌছানো।
আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন আমাদের অন্তরসমূহকে এবং দেহসমূহকে পবিত্র করেন এবং যাবতীয় নাপাকী থেকে তা পরিচ্ছন্ন করেন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা তায়াম্মুমের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা তায়াম্মুম সম্পর্কে আলোচনা করব।
- এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য একটি সুযোগ। এটি এ শরীআতের মধ্যে সহজীকরণের একটি নিদর্শন।
তায়াম্মুম: পানির পবিত্রতার (অর্থাৎ ওযূ ও গোসলের) বিকল্প। আর এটি তখন যখন পানি না থাকে[[21]] বা পানি না থাকার বিধান হয়। যেমন, অসুস্থতার কারণে পানি ব্যবহার করতে না পারা বা এ পরিমাণ পানি আছে যা তার পান করার জন্য প্রয়োজন অথবা পানি ব্যবহার দ্বারা তার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেমন, পানি এতই ঠান্ডা যে যদি তা ব্যবহার করে তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হবে আর তার নিকট গরম করারও কোনো ব্যবস্থা নাই।
- যমীনের অংশের যে টুকু যমীনের উপর ভেসে থাকে তার সবকিছু দিয়েই তায়াম্মুম করা বৈধ। যেমন, মাটি, কাদা, পাথর, বালি ও ইট (পোড়া মাটি)। কারণ, আল্লাহ বলেন,
}فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا{ [النساء: 43]
“তারপর তোমরা পবিত্র মাঠির ইচ্ছা করো।” [আন-নিসা : ৪৩]
সায়িদ (صعيد) হলো যে গুলো যমীনের ওপর ভাসে।
তাইয়্যিব (طيب) অর্থ হলো পবিত্র। একজন মুসলিমের জন্য পাত্রে মাটি অথবা বালি রেখে তার দ্বারা তায়াম্মুম করা বৈধ।
- তায়াম্মুম করার পদ্ধতি:
তায়াম্মুম করার নিয়তে বিছমিল্লাহ বলা। তারপর দুই হাতের কব্জি দ্বারা যমীনে একবার আঘাত করবে তারপর দুই হাতের তালু দ্বারা চেহারা মাসেহ করবে। তারপর দুই হাতের কব্জি মাসেহ করবে। তারপর তায়াম্মুমের পর তাই বলবে যা ওযূ করার পর বলে।
- তায়াম্মুমের মধ্যে পরম্পরা ওয়াজিব, যাতে চেহারা মাসেহ করা ও দুই কব্জি মাসেহ করার মাঝে লম্বা সময় অতিক্রম না করে।
- তাইয়াম্মুমের বিধানসমূহের মধ্যে:
- যে সব কারণে পানির পবিত্রতা বাতিল হয় সে সব কারণে তায়াম্মুমও বাতিল হবে। আর তা হলো ওযূ ভঙ্গ ও গোসল ওয়াজিব হওয়ার কারণসমূহ।
- বড় অথবা ছোট নাপাকী থেকে তায়াম্মুমকারী যে কারণে তায়াম্মুম করেছে সে কারণ যদি তার থেকে দূরীভুত হয়ে যায় তাহলে সে বড় নাপাক অথবা ছোট নাপাক অবস্থায় ফিরে আসবে, তবে তাকে তায়াম্মুম অবস্থায় আদায়কৃত সালাত আবার আদায় করতে হবে না।
- আর যে ব্যক্তি সামান্য পানি পেল, যদ্ধারা তার শরীরের কিছু অংশ ধৌত করা সম্ভব, তাহলে তার দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে। আর বাকি অংশের জন্য তায়াম্মুম করবে।
আমরা যা শুনলাম তা দ্বারা আল্লাহ আমাদের উপকৃত করুন এবং আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা নারীদের ন্যাচারাল যে রক্তস্রাব হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা এমন কতক বিধান নিয়ে আলোচনা করব যেগুলো শুধু নারীদের পবিত্রতার সাথে নির্দিষ্ট।[[22]] এ বিষয়ে আলোচনার আরম্ভ করার পূর্বে আমরা জানিয়ে দিতে চাই যে, একজন মুসলিম নারীর ওপর ওয়াজিব হলো এমন বিধানগুলো শিখে নেওয়া যেগুলো তাদের সাথে খাস। আর আমাদের সবাইর জন্য উচিত হলো আমরা আমাদের পবিবার ও আত্মীয় স্বজনদের শিক্ষা দেয়ার প্রতি যত্মবান হব এবং তাদের দীন, দুনিয়া বিষয়ে তাদের আকীদা, পবিত্রতা, সালাত চরিত্র ইত্যাদি বিষয়ে এমনভাবে দিক নির্দেশনা দেব যা তাদের উপকারে আসে।
নারীদের বিশেষ বিধানসমূহের মধ্যে রয়েছে হায়েয ও নিফাসের বিধান:
- হায়েয: এটি হলো সৃষ্টিগত ও স্বভাবজনিত রক্ত যা প্রাপ্ত বয়স্কা নারীদের যৌনাঙ্গ থেকে নির্ধারিত সময়ে বের হয়।
- হায়েযের রক্ত বের হওয়ার শুরু ও শেষের কোনো নির্ধারিত সীমা নেই। আর তার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সময়েরও কোনো সীমা নেই; বরং নির্ধারিত গুণে তা যখনই পাওয়া যাবে তা হায়েয বলে গণ্য হবে।[[23]]
- আর নিফাস হলো: প্রসবের সময় অথবা তার দুই বা তিন দিন আগে নারীর থেকে যে রক্ত লাগাতার বের হয়, তাকে নিফাস বলে। নিফাসের কমের কোনো সীমা নাই। আর তার সর্বোচ্চ সময় হলো চল্লিশ দিন।
- হায়েয ও নিফাসের নারী: তাদের উভয়ের জন্য সালাত ও সাওম হারাম। তবে তাদের ওপর সাওম কাজা করতে হবে সালাত নয়। তাদের সাথে সহবাস করা ও তাদেরকে তালাক দেওয়া হারাম। তাদের জন্য মসজিদে বসা হারাম। ছোট নাপাকে নাপাক ব্যক্তির ওপর যা হারাম তাদের জন্য তা হারাম। তারা যখন পবিত্র হবে তখন তাদের ওপর গোসল করা ওয়াজিব।
- যখন কোনো নারী সালাতের ওয়াক্তে ঋতুবতী হয় বা প্রসূতী হয় তখন তার ওপর ঐ সালাত কাজা করা ওয়াজিব নয়। কিন্তু যদি সে সালাতকে এতো দেরী করে যে, তা আদায় করার পর্যাপ্ত সময় না থাকে, তখন তার ওপর তা কাজা ওয়াজিব।
- আর যদি কোনো হায়িয বা নিফাসগ্রস্ত নারী সালাতের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পূর্বে পাক হয়ে যায়, তবে তাকে অবশ্যই সেই সালাত আদায় করতে হবে। এছাড়াও উক্ত সালাতের আগের ওয়াক্তের সালাতও আদায় করতে হবে; যদি তা জাম‘আ বাইনাস সালাতাইন তথা দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায় করা যোগ্য সালাত হয়।
সুতরাং কেউ যদি আসরের ওয়াক্তে পবিত্র হয়, তবে তার উপর আসর ও যোহরের সালাত একত্রে পড়া ফরয। আর যদি সে ইশা সালাতের ওয়াক্তে পবিত্র হয় তবে তার জন্যে মাগরিব ও ইশা একত্রে পড়া ফরয। তবে কেউ ফজরের ওয়াক্তে বা যোহরের ওয়াক্তে বা মাগরিবের ওয়াক্তে পবিত্র হলে তাকে শুধু এক ওয়াক্ত সালাতই আদায় করতে হবে যে ওয়াক্তে সে পবিত্র হয়েছে।
- কতক নারীর ইস্তেহাযার রক্ত বের হয়। আর তা হলো এমন রক্ত যা অভ্যাসগত সময়ের বাহিরে রেহমের নিম্নস্তর হতে বের হয়।[[24]]
- ইস্তেহাযার বিধান পবিত্র হালতের বিধানের মতো, তবে তার ওপর ওয়াজিব হলো:
- প্রত্যেক সালাতের জন্য ওযূ করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ثُمَّ تَوَضَّئِي لِكُلِّ صَلَاةٍ وَصَلِّي» [رواه البخاري]
“তারপর তুমি প্রতি সালাতের জন্য ওযূ কর এবং সালাত আদায় কর।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
অর্থাৎ ওয়াক্তিয়া সালাতে ওয়াক্ত প্রবেশ করা ছাড়া সালাতের জন্য ওযূ করবে না। [[25]] আর অনির্ধারিত সালাত যখন আদায় করার ইচ্ছা করবে তখন তার জন্যে ওযূ করবে।
- যখন ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারী ওযূ করতে চায় তখন সে রক্তের দাগগুলো ধুয়ে ফেলবে। আর লজ্জাস্থানের ওপর একটি কাপড়ের টুকরা পট্টি লাগিয়ে নেবে যাতে রক্ত আঁটকে থাকে। এর বিকল্প হিসেবে বর্তমান যুগে নারীরা যে ন্যাপকিন ব্যবহার করে তাই যথেষ্ট।
আল্লাহ আমাদেরকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণভাবে পবিত্রতা হাসিল করার তাওফীক দান করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা সালাতের শর্তসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
সামনে আমাদের আলোচনা হচ্ছে সালাতের বিধান সম্পর্কে। সালাতের কতক শর্ত আছে যেগুলো সালাতের পূর্বে ও মাঝে পূরণ করা ওয়াজিব। আর সালাতের কতক রুকন রয়েছে যে গুলো বাস্তবায়ন করা ওয়াজিব। যদি সে গুলো আদায় করা না হয়, সালাত বাতিল হয়ে যায়। আর সালাতের কতক ওয়াজিব রয়েছে যা পালন করা ওয়াজিব।
- সালাত শুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহ: ইসলাম, বুদ্ধিমান, ভালো ও মন্দের প্রার্থক্য করতে জানা। সুতরাং কাফেরের সালাত বিশুদ্ধ নয় এবং যার জ্ঞান নাই অথবা নেশা ইত্যাদির কারণে যার জ্ঞান চলে গেছে এবং যে ভালো মন্দ বুঝার কম বয়সী অর্থাৎ সাত বছরের কম তাদের সালাত বিশুদ্ধ নয়।
- সালাতের আরেকটি শর্ত হলো, ওয়াক্ত হওয়া। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا{ [النساء: 103].
“নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর ওয়াক্তের মধ্যে আদায় করা ফরয।” [আন-নিসা : ১০৩]
- সালাতের ওয়াক্তসমূহ নিম্নরূপ:
যোহরের সময় : সূর্য ঢলে পড়ার দ্বারা শুরু হয়। অর্থাৎ সূর্যের মধ্য আকাশে থাকার পর পশ্চিমের দিকে ঝুকে পড়া। আর এটি জানা যাবে পশ্চিমে ছায়া গায়েব হওয়ার পর পূর্ব দিকে দেখা যাওয়ার দ্বারা। আর যোহরের ওয়াক্ত শেষ হবে যখন কোনো বস্তুর ছায়া তার দৈর্ঘ্য পরিমাণ হয়ে যায়, তবে ঢলে যাওয়ার সময় যে ছায়া ছিল তা ব্যতিরেকে। [[26]]
আর আসরের সালাতের সময়: যোহরের ওয়াক্ত শেষ হওয়া থেকে সূর্য লাল হওয়া পর্যন্ত, আর প্রয়োজনীয় ওয়াক্ত সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ হয়।[[27]]
আর মাগরিবের সময়: সূর্য ডোবার সাথে শুরু হয়। অর্থাৎ সূর্যের সব দিক ডোবলে শুরু হয়। আর শফকে আহমার (লাল গোধুলি) অস্ত যাওয়া পর্যন্ত দীঘ হয়।
আর এশার ওয়াক্ত: মাগরিরেব ওয়াক্ত (রক্তিম আভা) শেষ হওয়ার সাথে শুরু হয়। আর অর্ধ রাত পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। আর প্রয়োজনীয় ওয়াক্ত হলো ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।
আর ফজরের ওয়াক্ত: দ্বিতীয় ফজর উদয় হওয়া থেকে শুরু হয় এবং সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শেষ হয়।
দ্বিতীয় ফজর হলো, (যেটিকে ফাজরে সাদিকও বলা হয়) পূর্ব প্রান্তের আকাশের কিনারায় ছড়িয়ে থাকা সাদা রং। এটি উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত দীর্ঘ হয়।[[28]]
আব্দুল্লাহ ইবন আমর রদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসে সালাতের ওয়াক্তসমূহ বিস্তারিতভাবে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَقْتُ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ، وَكَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ كَطُولِهِ، مَا لَمْ يَحْضُرِ الْعَصْرُ، وَوَقْتُ الْعَصْرِ، مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ، مَا لَمْ يَغِبْ الشَّفَقُ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْعِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ الأَوْسَطِ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الصُّبْحِ، مِنْ طُلُوعِ الْفَجْرِ، مَا لَمْ تَطْلُعِ الشَّمْسُ» [رواه مسلم].
“যুহরের ওয়াক্ত শুরু হয় যখন সূর্য (মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে) হেলে পড়ে এবং মানুষের ছায়া তার দৈর্ঘ্যের সমান হয়। আর আসরের সময় না হওয়া পর্যন্ত তা থাকে। আসরের সময় থাকে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত। মাগরিবের সময় থাকে লালিমা অন্তর্হিত না হওয়া পর্যন্ত। এশার সালাতের সময় থাকে অর্ধরাত্রি অর্থাৎ- মধ্যরাত পর্যন্ত। আর ফজরের সালাতের সময় শুরু হয় ফাজর উদয় থেকে শুরু করে সূর্যোদয় পর্যন্ত।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]।
- সালাত প্রথম ওয়াক্তে আদায় করা মুস্তাহাব। তবে এশার সালাত ছাড়া। যদি মানুষের কষ্ট না হয় তা দেরিতে আদায় করা মুস্তাহাব। আর যোহরের সালাত গরমকালে দেরীতে আদায় করা মুস্তাহাব যাতে গরমের তাপ কমে আসে।
- যদি কারো সালাত ছুটে যায়, তা ধারাবাহিকভাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাযা করা ওয়াজিব। যদি তারতীব ভুলে যায় বা তারতীব ওয়াজিব হওয়ার কথা না জানা থাকে তাহলে তার ওপর কোনো কিছু ওয়াজিব নয়। অথবা যদি বর্তমান সালাতের ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা করে তখন তার মাঝে এবং ছুটে যাওয়া সালাতের মাঝে তারতীব জরুরী থাকে না।
আল্লাহ আমাদেরকে এবং আমাদের প্রজন্মকে পরিপূর্ণভাবে সময় মতো সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী আলোচনায় সালাতের অন্যান্য শর্তসমূহ সম্পর্কে আলোচনা পূর্ণ করব।
পূর্বের দারসে আমরা সালাতের শর্তসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। শর্তসমূহের মধ্যে আমরা ইসলাম, জ্ঞান, ভালো-মন্দ পার্থক্য করা ও ওয়াক্ত প্রবেশ করা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আর সালাত বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহ হলো-
- সতর ঢাকা: এমন কাপড় দ্বারা যাতে চামড়া দেখা না যায়।
পুরুষের সতর: নাভি ও হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থান।
নারীর সতর: সালাতে তার চেহারা ও কব্জি ছাড়া তার পুরো শরীরই হলো সতর। আর যদি সালাত বেগানা পুরুষের সামনে হয় তবে পুরো শরীরই ঢেকে ফেলবে।
যে বিষয়ে সতর্ক করা উত্তম: কতক মানুষ এমন আছে যারা এমন কাপড় বা শর্ট প্যান্ট পরিধান করে, যার ফলে তাদের রানের কিছু অংশ বা পিঠের নিচে কিছু অংশ দেখা যায় যেটুকু সতরের অন্তভুর্ক্ত। এতে সালাত বিশুদ্ধ হবে না।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি এমন পাতলা কাপড় পরিধান করে যা তার ভেতরকার অবস্থা ব্যাখ্যা করে দেয়, ফলে কাপড়ের নিচ দিয়ে চামড়ার রং দেখতে পাওয়া যায়, তবে এ ব্যক্তির সালাত শুদ্ধ হবে না।
- সালাতের আরেকটি শর্ত হলো ছোট ও পড় নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়া। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
- তার আরও শর্ত হলো, শরীর, পোশাক ও সালাতের স্থান থেকে নাপাকি দূর করা।
সালাতের পর কেউ তার দেহে কোনো নাপাক বস্তু দেখতে পেল; অথচ সে জানে না কখন এমন ঘটল বা সে ভুলে গেছে তাহলে তার সালাত সহীহ হয়ে যাবে। আর যদি সালাতের মাঝখানে সে জানে এবং সতর খোলা ছাড়া তা দূর করা সম্ভব তখন সে তা দূর করবে এবং সালাত পুরো করবে।
- সালাতের শর্তসমূহের মধ্যে রয়েছে: কিবলামূখী হওয়া, অর্থাৎ কাবাকে সামনে রাখা।[[29]] এটি মুসলিমদের কিবলা।
- সালাতের আরেকটি শর্ত হলো নিয়ত করা। নিয়তের স্থান হলো অন্তর। মুখে উচ্চারণ করা বৈধ নয়।
- জানাযার সালাত ছাড়া আর কোনো সালাত কবরের ওপর আদায় করা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে উটের গোয়ালে সালাত আদায় করা শুদ্ধ নয়।[[30]]
হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো যারা সালাতকে এমনভাবে আদায় করে যে সালাত আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে সন্তুষ্ট করে। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা সালাতের রুকনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
গত পর্বে আমরা সালাতের শর্তসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ দারসে আমরা সালাতের রুকনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
- সালাতের রুকনসমূহ ইচ্ছাকৃত ও ভুলে কোনভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। আর তা হলো:
প্রথম রুকন: সক্ষম অবস্থায় দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صَلِّ قَائِمًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَقَاعِدًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَعَلَى جَنْبٍ» [رواه البخاري].
“দাঁড়িয়ে সলাত আদায় কর, তা না পারলে বসে; যদি তাও না পার তাহলে কাত হয়ে।” [হাদীসটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
এটি ফরয সালাতে। আর নফল সালাত কোনো প্রকার অপারগতা ছাড়া বসে পড়া বৈধ। তবে সাওয়াব অর্ধেক। কারণ, হাদীসে এসেছে-
«وَمَنْ صَلَّى قَاعِدًا فَلَهُ نِصْفُ أَجْرِ الْقَائِمِ» [رواه البخاري].
“যে ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করে তার জন্য দাড়িয়ে সালাত আদায়কারীর অর্ধেক সাওয়াব।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
দ্বিতীয় রুকন: সালাতের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমা বলা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ثُمَّ اسْتَقْبِلِ الْقِبْلَةَ، فَكَبِّرْ» [رواه البخاري].
“তারপর তুমি কিবলামুখী হও ও তাকবীর বলো।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
তৃতীয় রুকন: প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহা পড়া।
কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ» [متفق عليه]
“যে ব্যক্তি ফাতিহাতুল কিতাব (সূরা ফাতিহা) পড়ল না তার সালাত নেই।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
যে ব্যক্তি ইমামকে রুকু অবস্থায় বা রুকুর পূর্বে পেল; কিন্তু সূরা ফাতিহা পড়তে পারেনি তার জন্য সূরা ফাতেহা পড়া মাফ।
চতুর্থ রুকন: রুকু করা।
পঞ্চম রুকন: রুকু থেকে উঠা।
ষষ্ঠ রুকন: রুকুর পূর্বের অবস্থার মতো সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
সপ্তম রুকন: সাতটি অঙ্গের ওপর সেজদা করা। আর তা হলো কপাল, নাক, দুই হাত, দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের আঙ্গুলের মাথাসমূহ।
অষ্টম রুকন: সেজদা হতে উঠা।
নবম রুকন: দুই সেজদার মাঝখানে বসা।
দশম ও একাদশ রুকন হলো শেষ বৈঠক ও শেষ তাশাহুদ। আর তাশাহুদ হলো বর্ণিত দোয়া- আত-তাহিয়্যাত পড়া।
দ্বাদশ রুকন: সালাম ফিরানো।
ত্রয়োদশ রুকন ধীরস্থিরতা: প্রতি কর্মময় রুকনে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা। যদিও কম হয়।
চতুর্দশ রুকন: রুকনসমূহে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
হে আল্লাহ তুমি আমাদের দীনের বুঝ দান করো। আর আমাদেরকে এমন ইলম দান করো যা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে উপকার করে। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা এসব রুকন হতে যে কোনো জিনিস ছেড়ে দিল বা ভুলে গেল তার বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
পূর্বের দারসে আমরা সালাতের চৌদ্দটি রুকন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এ দারসে আমরা যে তার কোনো একটি রুকন ছেড়ে দিল বা ভুলে গেল তার বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
- যদি কেউ তাকবীরে তাহরীমা ছেড়ে দেয় বা ভুলে যায় তার সালাত আরম্ভ করা হলো না। অর্থাৎ সে সালাতে প্রবেশ করেনি।
- আর যদি অন্য কোনো রুকন হয় এবং তা যদি ইচ্ছা করে ছাড়ে তাহলে তার সালাত বাতিল। আর যদি ভুলে ছাড়ে তাহলে তাতে ব্যাখ্যা আছে:
ক- যদি পরবর্তী রাকাতের একই স্থানে পৌঁছার আগে স্মরণ করে তাহলে সে ফিরে আসবে এবং তা পালন করে সালাত পূর্ণ করবে এবং সেজদা সাহু করবে।
এর দৃষ্টান্ত: যদি কোনো ব্যক্তি রুকু করা ভুলে যায় অতঃপর এটিকে একই রাকাতের সেজদায় বা পরবর্তী রাকাতের কিরাতে গিয়ে স্মরণ করল তখন সে সেজদা বা কিরাত ছেড়ে দিয়ে রুকু করবে তারপর সালাত পূর্ণ করবে এবং সেজদা সাহু করবে।
খ- আর যদি দ্বিতীয় রাকাতের একইস্থানে এসে মনে পড়ে তাহলে সে অপূর্ণ রাকাত বাদ দিয়ে দিবে। আর এ রাকাতটি তার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারপর সে সালাত পূর্ণ করবে এবং সেজদা সাহু করবে।
এর দৃষ্টান্ত: যদি প্রথম রাকাতের রুকু ভুলে যায় তারপর দ্বিতীয় রাকাতে রুকু করার সময় তা মনে পড়ে তখন সে প্রথম রাকাত বাদ দিবে এবং দ্বিতীয় রাকাতই হবে তার জন্য প্রথম রাকাত। সে সালাত পুরো করবে এবং সেজদা সাহু করবে।
গ- আর যদি সালামের পরে স্মরণ করে তখন যদি ছুটে যাওয়াটি শেষ রাকাতে হয় তা হলে তা আদায় করবে এবং পরবর্তী কাজ সম্পন্ন করে সালাত শেষ করবে এবং সেজদা সাহু করবে।
আর যদি ছুটে যাওয়াটি শেষ রাকাতের পূর্বে হয়, তখণ সে পূর্ণ একটি রাকাত আদায় করবে। যতক্ষণ তার সালাম এবং স্মরণের মাঝে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত না হয়। যদি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয় বা তার ওযূ নষ্ট হয় তখন অবশ্যই সালাত পুনরায় আদায় করতে হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে সালাতের ওয়াজিবসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
পূর্ববর্তী দারসে সালাতের রুকনসমূহ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এ পাঠে আমরা সালাতের ওয়াজিবসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো
১- তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত সকল তাকবীর।
২- ইমাম ও একা সালাত আদায়কারীর জন্য «سمع الله لمن حمده» বলা, তবে মুক্তাদী তা বলবে না।
৩- ইমাম, একা সালাত আদায়কারী ও মুক্তাদীর জন্য «ربنا ولك الحمد» বলা
৪- রুকুতে «سبحان ربي العظيم» বলা, আর মুস্তাহাব হলো তিনবার বা তার চেয়ে বেশি বলা।
৫- সেজদাতে «سبحان ربي الأعلى» বলা, আর মুস্তাহাব হলো তিনবার বা তার চেয়ে বেশি বলা।
৬- প্রথম তাশাহুদ। আর তা হলো:
«التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ الله وَبَرَكَاتُهُ السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا الله وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ» [متفق عليه].
“সকল মৌখিক, দৈহিক ও আর্থিক ‘ইবাদত আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার উপর আল্লাহর সালাম, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।সালাম আমাদের এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপর বর্ষিত হোক।আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো মা‘বূদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
৭- প্রথম তাশাহুদের জন্য বসা।
- এসব ওয়াজিব হতে কোনো ওয়াজিব যে ইচ্ছা করে ছেড়ে দিল তার সালাত বাতিল।
- আর যে তা ভুলে বা না জেনে ছেড়ে দিল, তাহলে সে সেজদা সাহুর মাধ্যমে তার প্রতিকার করবে।
আল্লাহর নিকট উপকারী ইলম এবং নেক আমলের তাওফীক প্রার্থনা করি। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে আমরা সালাতে গমন করার আদবসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
ইতোপূর্বে আমরা সালাতের শর্তসমূহ, রুকসমূহ এবং ওয়াজিবসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ দারসে আমরা সালাতের দিকে গমন করার আদাব সম্পর্কে আলোচনা করব।
- এক জন মুসলিমের ওপর ওয়াজিব হলো সালাত জামাতে আদায় করা। আল্লাহ বলেন,
}وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ{ [البقرة: 43]
“তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।” [আল-বাকারাহ : ৪৩]
আরও যেহেতু মুসলিম তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلَاةِ فَتُقَامَ ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ».
“আমি ইচ্ছা করেছি যে, আমি সালাতের নির্দেশ দেই ও তা কায়েম করা হোক এবং একজনকে নির্দেশ দেই মানুষদের নিয়ে সালাত আদায় করতে অতঃপর আমি এমন কতক লোক যাদের সঙ্গে জ্বালানী কাঠ থাকবে আমার সঙ্গে নিয়ে সেসব লোকদের অভিমুখে বের হই যারা সালাতে উপস্থিত হয় না এবং তাদের ওপর তাদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই।”
- মুস্তাহাব হচ্ছে ওযূর হালতে এমন অবস্থায় সালাতে আসা যে তার ওপর গাম্ভীর্যতা ও ধীরতা থাকবে।
কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إذا أُقيمتِ الصَّلاةُ فلا تأتوها وأنتم تَسعَونَ، ولكن ائتوها وأنتم تَمشُونَ وعليكم السَّكينةُ، فما أدركتُم فصلُّوا، وما فاتكم فأتمُّوا» [متفق عليه].
‘‘যখন সালাতের ইক্বামত (তাকবীর) দেওয়া হয় তখন তোমরা তাতে দৌড়ে আসবে না, বরং তোমরা গাম্ভীর্য-সহকারে স্বাভাবিকরূপে হেঁটে আসবে। তারপর যতটা সালাত পাবে, পড়ে নেবে। আর যতটা ছুটে যাবে, ততটা (নিজে) পূরণ করে নেবে।’’ [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- যখন মসজিদে প্রবেশ করার ইচ্ছা করে তখন ডান পা এগিয়ে দেবে এবং বলবে,
«اللَّهُمَّ افتَحْ لي أبوابَ رَحْمَتِك» [رواه مسلم].
“হে আল্লাহ তুমি আমার জন্য তোমার রহমাতের দরজাসমূহ খুলে দাও।” [এটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]
- যখন মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করবে তখন বাম পা এগিয়ে দেবে এবং বলবে,
« اللَّهُمَّ إنِّي أسألُكَ مِنْ فَضْلِك» [رواه مسلم].
“হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি।” [হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন]
- মুস্তাহাব হলো আগে আগে সালাতে উপস্থিত হওয়া প্রথম তাকবীর ধরার চেষ্টা করা। প্রথম কাতার ও ইমামের কাছাকাছি দাড়ানো। সালাত কাতার সোজা করা ও ফাঁকাগুলো পুরণ করা।
- মসজিদে প্রবেশকারীর জন্যে মুস্তাহাব হলো দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া ছাড়া না বসা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمْ الْمَسْجِدَ فَلَا يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ» [متفق عليه].
“যখন তোমাদের কেউ মসজিদ প্রবেশ করবে, তখন সে যেন দু’ রাকআত সালাত না পড়া অবধি না বসে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
হে আল্লাহ তোমার রহমত ও ক্ষমা দ্বারা আমাদেরকে শামিল করো এবং তোমার ক্ষমা ও অনুগ্রহ দ্বারা আমাদের দয়া করো। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী পাঠে আমরা সালাতের বিশুদ্ধ পদ্ধতি সুন্নাহ অনুযায়ী বর্ণনা করব।
এ পাঠে আমরা হাদীসে যেভাবে সালাতের বিশুদ্ধ পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো নিম্নরূপ:
- সালাত আদায়কারী কিবলামুখ হয়ে দাঁড়াবে এবং দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত বা দুই কান পর্যন্ত উঠিয়ে আল্লাহু আকবার বলবে। আর সেজদার স্থানের দিকে দৃষ্টি দেবে।
- তারপর ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখবে। হাত দুটি বুকের ওপর বা নাভীর ওপর বুকের নীচে অথবা নাভীর নীচে রাখবে। রাখার পদ্ধতি হলো:
১- হয়তো ডান হাতের কব্জি বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহুর ওপর রাখবে।
রুসগ [الرُّسغ] হলো: বাহু ও কব্জির জোড়ার স্থান।
২- অথবা ডান হাতকে বাম হাতের বাহুর ওপর রাখবে।
- তারপর সানা পড়বে। «سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلا إِلَهَ غَيْرُكَ» অথবা অন্য কোনো দোয়া যা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে পড়বে।
- তারপর أعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم، পড়বে। তারপর সূরা ফাতেহা পড়বে । আর তার শেষে আমীন বলবে। সালাত যদি উচ্চ স্বরের হয় তবে উচ্চ স্বরে বলবে আর যদি নিম্ন স্বরের হয় তবে নিম্ন স্বরে বলবে।
- তারপর সূরা ফাতেহার পর প্রথম দুই রাকাআতে কুরআন থেকে যতটুকু পড়া সহজ হয় তা পড়বে।
- তারপর দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত বা কান পর্যন্ত উঁচু করে রুকু করার জন্য তাকবীর বলবে। আর দুই হাতকে দুই হাঁটুর ওপর আঙ্গুলগুলো ফাঁকা করে রাখবে। আর মাথাকে পিঠের বরাবর রাখবে এবং তার পিঠকে লম্বা ও সোজা রাখবে। তারপর রুকুতে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করবে এবং বলবে,سبحان ربي العظيم তিনবার অথবা তার অধিক।
- তারপর سمع الله لمن حمده বলে ও দুই হাত তুলে মাথা তুলবে। ইমাম অথবা একা সালাত আদায়কারী سمع الله لمن حمده বলবে। কিন্তু মুক্তাদি তা বলবে না।
- যখন সোজা হয়ে দাড়াবে তখন «ربنا ولك الحمد» বা ربنا لك الحمد বা اللهم ربنا ولك الحمد বা اللهم ربنا لك الحمد বলবে। আর যদি কেউ হাদীসে বর্ণিত দো‘আ বৃদ্ধি করে তা উত্তম।
- তারপর তাকবীর বলবে এবং সেজদায় লুটে পড়বে। তবে এ সময় দুই হাত উঠাবে না। আর সাতটি অঙ্গের ওপর সেজদা করবে অর্থাৎ, কপাল, নাক, দুই হাত, দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের আঙ্গুল। আর দুই হাত ও দুই পায়ের আঙ্গুল কিবলা মুখ করবে এবং দুই হাত কাঁধ অথবা দুই কান বরাবর রাখবে। কপাল ও নাককে যমীনে রাখবে, দুই বাহুকে যমীন থেকে আলাদা করবে। আর দুই উরূকে প্রশস্ত করবে এবং পেট তা থেকে আলগে রাখবে। এ গুলো সে তার সক্ষমতা অনুযায়ী করবে এবং তার পাশের লোকের যাতে কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখবে। আর সে তার সেজদায় «سبحان ربي الأعلى» তিনবার বা তার চেয়ে বেশিবার বলবে। আর সেজদায় বেশি বেশি দোআ করবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ، فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ» [رواه مسلم].
“বান্দা স্বীয় রবের সর্বাধিক নিকটবর্তী হয় তখন, যখন সে সাজদার অবস্থায় হয়। সুতরাং (ঐ সময়) তোমরা বেশি মাত্রায় দুআ কর।” [বর্ণনায় মুসলিম]।
- তারপর তাকবীর বলে সেজদা থেকে উঠবে এবং পা বিছিয়ে বসবে। তার পদ্ধতি হলো বাম পা বিছাবে এবং তার ওপর বসবে আর ডান পা খাড়া করে রাখবে [[31]]। ডান হাত ডান উরুর ওপর এবং বাম হাত বাম উরুর ওপর হাঁটুর কাছে বা হাঁটুর উপর রাখবে। স্বীয় বৈঠকে স্থীর হবে এবং বলবে, (ربِّ اغفر لي) হে আল্লাহ তুমি আমাকে ক্ষমা করো তিনাবার বা ততোধিক।
- তারপর তাকবীর বলবে ও সেজদা করবে এবং প্রথম সেজদায় যা করেছে দ্বিতীয় সেজদায় তাই করবে।
- তারপর তাকবীর বলে মাথা উঁচু করবে এবং দ্বিতীয় রাকাতের জন্য উঠে দাঁড়াবে আর প্রথম রাকাতে যাই করেছে দ্বিতীয় রাকাতে তাই করবে।
- তারপর তিন রাকাত বা চার রাকাত বিশিষ্ট সালাতে দুই সেজদার মাঝখানে যেভাবে পা বিছিয়ে বসেছিল সেভাবে বসবে। দুই হাত দুই উরুর ওপর রাখবে এবং ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল মধ্যমার সঙ্গে মিলে বৃত্ত বানাবে, কনিষ্ঠা ও অনামিকাকে ভাঁজ করে রাখবে। আর তর্জনী দ্বারা ইশারা করবে। অথবা সব আঙ্গুল ভাঁজ করে রাখবে এবং তর্জনী দ্বারা ইশারা করবে। আর দৃষ্টি তার দিকে রাখবে এবং বলবে-
«التَّحِيَّاتُ لِله وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ الله وَبَرَكَاتُهُ السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ الله الصَّالِحِينَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا الله، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ» [متفق عليه].
“সকল মৌখিক, দৈহিক ও আর্থিক ‘ইবাদত আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার উপর আল্লাহর সালাম, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। সালাম আমাদের এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপর বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো মা‘বূদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রসূল।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- তারপর তাকবীর বলে দুই হাত তুলে তৃতীয় রাকাতের জন্য উঠবে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত আদায় করবে এবং তাতে ফাতেহা পাঠ করবে।
- তারপর শেষ বৈঠকের তাওয়াররুক করে বসবে। তার পদ্ধতি হলো, বাম পা বিছিয়ে দিয়ে তার ডান দিকে বের করে দেবে এবং ডান পা খাড়া করে রাখবে। তারপর সে তার নিতম্বের ওপর বসবে [[32]] এবং শেষ বৈঠকে তাশাহুদ পড়বে। আর তা হলো প্রথম তাশাহুদ আর তার ওপর বাড়তি পড়বে,
«اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، وبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ».
“হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেরূপ আপনি ইবরাহীম ও ইবরাহীমের বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি অতি প্রশংসিত, অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। [বর্ণনায় বুখারী]।
- আর চারটি বস্তু থেকে আশ্রয় চাইবে ও বলবে,
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَمِنْ عَذَابِ القَبْرِ وَمِنْ فِتْنَةِ المَحْيَا وَالمَمَاتِ وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ».
“হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি জাহান্নাম ও কবরের আযাব থেকে, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং কানা দাজ্জালের ফিতনার অনিষ্ট থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” [বর্ণনায় মুসলিম]
- আর যা ইচ্ছা দোআ করবে।
- তারপর «السلام عليكم ورحمة الله ,السلام عليكم ورحمة الله»
বলে ডানে ও বামে সালাম ফিরাবে।
- যখন সালাম ফিরাবে তখন أستغفر الله তিনবার বলবে। আর এ দোআ পাঠ করবে-
«اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلامُ وَمِنْكَ السَّلامُ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلالِ وَالإِكْرَامِ»
“হে আল্লাহ তুমি শান্তি, তোমার থেকেই শান্তি, তুমি রবকতময়, হে মহিমান্বিত ও সম্মানের অধিকারী।”
- তারপর সালাতের পরে বর্ণিত দুআগুলো পাঠ করবে।
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা কতক মানুষ সালাতে যে সব ভুল করে থাকেন সে বিষয়ে আলোচনা করব।
পূর্বের পাঠে আমরা সালাতের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং এই দারসে আমরা মানুষ সালাতে যে সব ভুলত্রুটি করে থাকে সে বিষয়ে আলোচনা করব। আমরা তা সংক্ষেপে আলোচনা করবো যাতে আমরা তার থেকে বিরত থাকতে পারি এবং অন্যদেরও সতর্ক করতে পারি। সে সব ভুলগুলো হলো:
- সালাতের শুরুতে উচ্চ আওয়াযে নিয়ত করা। এটি বিদআত, এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীগণ করেননি। নিয়তের স্থান হলো অন্তর তা মুখে উচ্চারণ করা শরীআত সম্মত নয়।
- আরও ভুল: যখন কোনো ব্যক্তি ইমামের রুকু অবস্থা মসজিদে প্রবেশ করে তখন সে রুকুর জন্য ঝুকে তাকবীরে ইহরাম বাঁধে এতে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, তাকবীরে তাহরীমা দাঁড়িয়ে বাঁধা ওয়াজিব। তারপর রুকুর তাকবীর বলবে এবং রুকু করবে।
আর যদি সে তাড়াহুড়া করে রুকুর তাকবীর ছেড়ে দেয় এবং শুধু দাঁড়িয়ে তাকবীরে ইহরাম বাঁধে, তখন সালাত হয়ে যাবে।
- আরও ভুল হলো ইকামতা শোনার পর বা রাকাআত ছুটে যাওয়ার ভয়ে দৌঁড় দেয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا سَمِعْتُمْ الْإِقَامَةَ، فَامْشُوا إِلَى الصَّلَاةِ، وَعَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَالْوَقَارِ، وَلَا تُسْرِعُوا، فَمَا أَدْرَكْتُمْ، فَصَلُّوا، وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا» [رواه البخاري]
‘‘যখন ইক্বামত শোন তখন তোমরা সালাতে হেঁটে আসবে এ অবস্থায় যে, তোমাদের ওপর ধীরতা ও গাম্ভীর্যতা থাকে। আর দৌড়ে আসবে না। তারপর যতটা সালাত পাবে, পড়ে নেবে। আর যতটা ছুটে যাবে, ততটা (নিজে) পূরণ করে নেবে।’’ [বর্ণনায় বুখারী]। সুন্নাত হলো ধীরে ধীরে হাঁটবে যেভাবে স্বাভাবিক হাঁটা হয়ে থাকে।
-আরেকটি ভুল হলো কাতার সোজা না করা। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«سَوُّوا صُفُوفَكُمْ فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصُّفُوفِ مِنْ إِقَامَةِ الصَّلَاةِ» [رواه البخاري ومسلم]
“তোমরা তোমাদের কাতারগুলো সোজা কর। কেননা, কাতার সোজা করা সালাত কায়েমের অন্তর্ভুক্ত।” [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম] কাতার সোজা করার মধ্যে গ্রহণযোগ্য হলো শরীরের উপরিভাগে কাঁধ বরাবর করা আর শরীরের নীচের অংশে টাখনু বরাবর করা।
-আরেকটি ভূল হলো, পেঁয়াজ ও রসুন খেয়ে মসজিদে আসা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ أَكَلَ ثُومًا أَوْ بَصَلًا، فَلْيَعْتَزِلْنَا، أَوْ قَالَ: فَلْيَعْتَزِلْ مَسْجِدَنَا، وَلْيَقْعُدْ فِي بَيْتِهِ» [متفق عليه]
“যে ব্যক্তি (কাঁচা) রসূন অথবা পিঁয়াজ খায়, সে আমাদের থেকে দূরে অবস্থান করবে অথবা আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকবে এবং সে তার ঘরে অবস্থান করবে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম] এর সাথে সম্পৃক্ত করা হবে সে সব বস্তু যাতে মুসল্লিদের কষ্ট হয় এমন দুগন্ধ রয়েছে। যেমন, সিগারেট। এটি এমননিতেই ঘৃণিত আর তার দর্গন্ধ দ্বারা মুসল্লিদের কষ্ট দেয়া আরও একটি ঘৃণিত কাজ।
- আরেকটি ভুল হলো সালাতে আঙ্গুল ফুটানো বা মসজিদের দিকে যাওয়ার সময় এমনটি করা। এটি মাকরুহ। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا تَوَضَّأَ أَحَدُكُمْ فَأَحْسَنَ وُضُوءَهُ ثُمَّ خَرَجَ عَامِدًا إِلَى الْمَسْجِدِ فَلا يُشَبِّكَنَّ يَدَيْهِ، فَإِنَّهُ فِي صَلاةٍ» [رواه أبو داود وصححه الألباني].
“যখন কোনো ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযূ করে তারপর সে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে যে তার আঙ্গুল না ফোটায়। কারণ সে এখন সালাতে আছে।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।
আল্লাহ আমাদের ভুল ত্রুটি থেকে হিফাযত করুন এবং আমাদের বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আলোচনা সম্পন্ন করবো।
পূর্বের দারসে আমরা মুসল্লিদের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ করেছি। এ দারসেও সে আলোচনা চালিয়ে যাবো।
- আরও ভুল হলো সালাত আদায়ে জন্য সাজ-সজ্জা গ্রহণ না করা। কতক মানুষ বিশেষ করে ফজরের সালাতে ঘুমের পোশাক পরে সালাত আসে বা নিম্নমানের কাপড় পরে সালাতে আসে যা তারা তাদের কর্ম ক্ষেত্রে পরিধান করে না। আল্লাহ বলেন,
}يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ{ [الأعراف: 31].
“হে আদম সন্তান প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা তোমাদের সৌন্দর্যকে অবলম্বন করো।” [আল-আরাফ : ৩১]
- আরও ভুল হলো, ফরয সালাতে দাঁড়ানো অবস্থায় কোনো ওযর ছাড়া খুঁটি বা দেয়ালের সাথে হেলান দেওয়া। এটি সালাত নষ্টকারী। কারণ, সক্ষম অবস্থায় সালাতে কিয়াম করা সালাতের একটি রুকন।
- আরও ভুল হলো, সালাতের মাঝে আসমানের দিকে মাথা উঠানো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَرْفَعُونَ أَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِي صَلَاتِهِمْ -فَاشْتَدَّ قَوْلُهُ فِي ذَلِكَ حَتَّى قَالَ-: لَيَنْتَهُنَّ عَنْ ذَلِكَ أَوْ لَتُخْطَفَنَّ أَبْصَارُهُمْ» [رواه البخاري].
“লোকদের কী হয়েছে যে, তারা তাদের সালাতে আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলছে?” এ ব্যাপারে তিনি কঠোর বক্তব্য রাখলেন; এমনকি তিনি বললেন, “তারা যেন অবশ্যই এ কাজ হতে বিরত থাকে; নচেৎ অবশ্যই তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া হবে।” [বর্ণনায় বুখারী]
- আরো ভূল: কতক মুক্তাদী ইমাম যখন (إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ) পড়ে তখন সে বলে আমরা আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি। এটি সন্নাতের পরিপন্থী। ইমাম নববী এটিকে বিদআত বলে গণ্য করেছেন।
- আরেকটি ভূল: মুক্তাদি ফরয সালাতে কুরআন পড়া ও যিকির পাঠের সময় আওয়াজ এমন বড় করে যার ফলে পাশের মুসল্লির বিঘ্ন ঘটে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا كَانَ فِي الصَّلاةِ، فَإِنَّمَا يُنَاجِي رَبَّهُ فَلا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ بِالْقُرْآنِ فتُؤذوا المؤمنين» [صححه الألباني].
“তোমাদের কেউ যখন সালাতে থাকে তখন সে অবশ্যই তার রবের সাথে মুনাজাত করে। ফলে তোমরা তিলাওয়াতের আওয়াযকে এত বড় করো না যাতে মুমিনদের কষ্ট হয়।” [আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।
- আরেকটি ভূল: ইমামের সাথে কতক মুক্তাদির আমীন না বলা; অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إذا أمَّنَ الإمامُ فأمِّنوا، فإنه من وافقَ تأمينُه تأمينَ الملائكةِ، غُفِرَ له ما تقدَّمَ من ذنبِه». وقال ابنُ شهابٍ: وكان الرسولُ صلى الله عليه وسلم يقولُ: «آمين» [رواه البخاري].
“ইমাম যখন আমীন বলবে, তখন তোমরাও আমীন বলবে; কেননা যে ব্যক্তির আমীন ফিরিশতাদের আমীনের সাথে মিলবে তার পূর্ব-জীবনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” ইবন শিহাব বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমীন’ বলতেন। [বর্ণনায় বুখারী]
আল্লাহ আমাদেরকে দীনের বুঝ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আলোচনা সম্পন্ন করব।
কতক মুসল্লির ভুল-ত্রুটি বিষয়ে আমাদের আলোচনা সম্পন্ন করবো।
- আরেকটি ভুল: মাসবুকের ইমাম যদি সেজদা অবস্থা বা বসা অবস্থায় থাকে তখন ইমামের দাঁড়ানোর অপেক্ষায় সালাতে শরীক না হওয়া। অথচ বিধান হলো যেই রুকনেই ইমামকে পাওয়া যাবে তাতে শরীক হওয়া। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসটি ব্যাপক।
«فَمَا أَدْرَكْتُمْ، فَصَلُّوا، وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا» [رواه البخاري].
“যতটুকু পাও তা আদায় করো আর যতটুকু ছুটে গেছে তা পূর্ণ কর।” [বর্ণনায় বুখারী]
- যে ভুল সালাত বাতিল করে, তা হলো সাত অঙ্গের ওপর সেজদা না করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أُمِرْتُ أَنْ أَسْجُدَ عَلَى سَبْعَةِ أَعْظُمٍ: عَلَى الْجَبْهَةِ - وَأَشَارَ بِيَدِهِ عَلَى أَنْفِهِ، وَالْيَدَيْنِ، وَالرُّكْبَتَيْنِ، وَأَطْرَافِ الْقَدَمَيْنِ» [متفق عليه]
“আমি সাতটি অঙ্গের দ্বারা সাজদাহ্ করার জন্য নির্দেশিত হয়েছি। কপালের উপর এবং তিনি হাত দিয়ে নাকের প্রতি ইশারা করে নাককে এর অন্তর্ভুক্ত করেন, আর দু’ হাত, দু’ হাঁটু এবং দু’ পায়ের আঙ্গুলসমূহের উপর।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)
- কতক মুসল্লি সেজদার অবস্থায় দুই পা যমীন থেকে সামান্য তুলে ফেলে অথবা এক পা আরেক পায়ের ওপর রাখে আবার কেউ কেউ নাক বা কপাল যমীনে লাগায় না। এটি সালাত বিনষ্টকারী।
- সেজদায় আরেকটি ভুল: বাহুদ্বয়কে যমীনে বিছিয়ে দেয়া। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা থেকে নিষেধ করেছেন,
«اعْتَدِلُوا فِي السُّجُودِ وَلَا يَبْسُطْ أَحَدُكُمْ ذِرَاعَيْهِ انْبِسَاطَ الْكَلْبِ» [متفق عليه].
“তোমরা সিজদায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। তোমাদের কেউ যেন তার বাহুদ্বয় কুকুরের ন্যায় বিছিয়ে না রাখে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] মধ্যপন্থা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, বিছিয়ে দেওয়া এবং পাকড়া ও বক্রতার মাঝে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। সেজদা আলাদায় রাখা এবং দূরে থাকা সুন্নাত। আর তার পদ্ধতি হলো কনুদ্বয়কে উঁচা করা এবং দুই বাহুকে দুই পার্শ্ব থেকে দূরে রাখা। আর পেটকে দুই উরু থেকে এবং দুই উরুকে দুই গোড়ালি থেকে দুরে রাখা। এ গুলো সবই কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি ছাড়া সাধ্য অনুযায়ী বা পাশের কাউকে কষ্ট না দিয়ে করবে।
- আরো ভূল: সালাতে ইমামের অনুসরণ না করা। যেমন, কারো ইমামের আগে চলা বা সাথে সাথে চলা বা তার থেকে দেরী করা। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ، فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا، وإِذَا سَجَدَ فَاسْجُدُوا، وإِذَا رَفَعَ فَارْفَعُوا» [متفق عليه]
“ইমাম এজন্যে যে, মুক্তাদীরা তার অনুসরণ করবে। সুতরাং ইমাম তাকবীর বললে তোমরাও তাকবীর বলবে, তিনি সেজদা করলে তোমরাও সেজদা করবে। তিনি মাথা তুললে তোমরাও মাথা তুলবে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«أَمَا يَخْشَى أَحَدُكُمْ أَحَدُكُمْ إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ قَبْلَ الْإِمَامِ أَنْ يَجْعَلَ الله رَأْسَهُ رَأْسَ حِمَارٍ أَوْ يَجْعَلَ الله صُورَتَهُ صُورَةَ حِمَارٍ» [ رواه البخاري].
“তোমাদের কেউ যখন ইমামের আগে মাথা তোলে, তখন তার মনে কি ভয় হয় না যে, মহান আল্লাহ তার মাথা, গাধার মাথায় পরিণত ক’রে দেবেন অথবা তার আকৃতি গাধার আকৃতি ক’রে দেবেন?” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
আল্লাহ আমাদেরকে উপকারী ইলমের সরু পথে ও তার আলোতে পথচারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আলোচনা সম্পন্ন করবো।
কতক মুসল্লির ভুলত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা সম্পন্ন করবো আমাদের নিজেদের সংশোধন এবং অন্যদের সতর্ক করার উদ্দেশ্যে।
- সালাত বিনষ্টকারী আরও ভুল: সালাতে স্থিরতা বাস্তবায়ন না করা। আবূ হুরাইরাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসজিদে প্রবেশ করলেন, তখন একজন সাহাবীও প্রবেশ করে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম করলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
«اِرجِعْ فَصَلِّ، فإنَّكَ لم تُصَلِّ» فرجعَ يُصلِّي كما صلَّى، ثم جاءَ، فسلَّمَ على النبيِّ صلى الله عليه وسلم، فقال: «ارجعْ فصَلِّ فإنَّكَ لم تُصَلِّ» حتى فعل ذلك ثلاث مرات، فقال: والذي بعثَكَ بالحقِّ، ما أُحْسِنُ غيرَهُ، فعَلِّمْنِي؟ فقال: «إذا قمتَ إلى الصلاةِ فكَبِّرْ، ثم اقرأْ ما تيسَّرَ معكَ من القرآنِ، ثم ارْكَعْ حتى تطمئِنَّ راكعًا، ثم ارفعْ حتى تعتدلَ قائمًا، ثم اسجُدْ حتى تطمئِنَّ ساجدًا، ثم ارفعْ حتى تطمئِنَّ جالسًا، وافعلْ ذلكَ في صلاتِكَ كُلِّهَا». [رواه البخاري]
“তুমি যাও সালাত আদায় কর কারণ, তুমি সালাত আদায় করোনি।” তিনি ফিরে গিয়ে পূর্বের মত সালাত আদায় করলেন। অতঃপর এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম করলেন। তিনি বললেন, “তুমি যাও সালাত আদায় কর কারণ, তুমি সালাত আদায় করোনি।” এমনকি এটি সে তিনবার করল। তারপর সাহাবী বললেন, সেই মহান সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমিতো এর চেয়ে সুন্দর করে সলাত আদায় করতে জানি না। কাজেই আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, “যখন তুমি সালাতের জন্য দাঁড়াবে, তখন তাকবীর বলবে। অতঃপর কুরআন হতে যা তোমার পক্ষে সহজ তা পড়বে। অতঃপর রুকু‘তে যাবে এবং ধীরস্থিরভাবে রুকূ‘ করবে। অতঃপর সাজদাহ্ হতে উঠে স্থির হয়ে বসবে। আর তোমার পুরো সলাতে এটি করবে।” [বর্ণনায় বুখারী]। ধীরস্থীরতা প্রতিটি কর্মময় রুকনে অঙ্গসমূহের শান্ত ও স্থির হওয়ার দ্বারা হাসিল হয়। যেমন, রুকু, সেজদা, কিয়াম ও বসা।
- সালাত বিনষ্টকারী আরও ভুল: সালাতের যিকিরসমূহ আদায়ে উচ্চারণ না করা এবং মুখ না নাড়ানো। ফলে সূরা ফাতিহা, তাসবীহ ও তাকবীর ইত্যাদি মুখে উচ্চারণ করা ছাড়া অন্তরে পাঠ করে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ও সালাত বিনষ্টকারী। ওয়াজিব হলো এগুলো মুখে উচ্চারণ করা এবং মুখ নাড়ানো। সুতরাং যে ব্যক্তি মুখ নাড়বে না, তার এটি পাঠ করা হবে না, বরং চিন্তা করা মাত্র।
- আরও ভুল: দুই সালামের মাঝখানে মাথা উঁচু করা ও নিচু করা। এটি সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয় এবং কোনো আলেম থেকে বর্ণিত নয়।
- আরও ভুল: সালাতের সালাম ফিরানোর পর পাশের মুসাল্লির সাথে সব সময় মুসাফাহা করা এবং এ কথা বলা আল্লাহ কবুল করুন। এটি শরীআত সম্মত নয়। আর এটি বিদআত।
- আরেকটি ভুল: ইমাম দ্বিতীয় সালাম ফিরানোর পূর্বে মাসবূক তার ছূটে যাওয়া সালাত আদায় করার জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া।
- আরেকটি ভুল: ইমাম সাহেব সালাতে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় জামাত কায়েম করা। আলেমগণ এটি নিষেধ করেছেন। কারণ, এটি মুসলিমদের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা এবং কতককে কতকের ওপর বিঘ্ন ঘটানো।
আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা সুন্দর কথা শোনে ও তার অনুসরণ করে। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আলোচনা সম্পন্ন করবো।
কতক মুসল্লির ভুল-ত্রুটি বিষয়ে আমরা আলোচনা অব্যাহত রাখছি।
- সেসব ভুলের আরও হচ্ছে, এতো খাঁটো পোশাক পরিধান করে সালাত আদায় করা, যার কারণে সতরের কিছু অংশ যেমন উরু বা পিঠের নীচ খোলা থাকে। এটি সালাত বিনষ্টকারী। (সালাতে পুরুষের সতর হলো নাভী ও হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থান, আর নারীর জন্য চেহারা ও কব্জি ছাড়া পুরো শরীরই সতর। আর যদি পর পুরুষের সামনে হয় তখন নারীরা তাদের পুরো শরীর ঢেকে রাখবে।)
- আরেকটি ভুল: অনেক অসুস্থ ব্যক্তির সক্ষমতা অনুযায়ী সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে অলসতা করা। যেমন কোনো রোগী দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে সক্ষম তবে সে রুকু পর্যন্ত দাঁড়ানোটা সম্পন্ন করতে সক্ষম নয়, তাহলে তার ওপর ওয়াজিব হলো তার সাধ্য অনুযায়ী দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে। যখন ক্লান্ত হবে তখন বসে যাবে। অনুরূপভাবে যে সেজদা আদায় করতে সক্ষম কিন্তু রুকু করতে সক্ষম নয়, তাহলে তার ওপর ওয়াজিব হলো শরয়ী নিয়মে সে সেজদা আদায় করবে। আর রুকু সে বসে আদায় করবে বা সাধ্য মতে আদায় করবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«صَلِّ قائمًا، فإن لم تستَطِع فقاعدًا، فإن لم تستَطِعْ فعلى جَنبٍ» [رواه البخاري].
“দাঁড়িয়ে সালাত আদায় কর, তা না পারলে বসে; যদি তাও না পার তাহলে কাত হয়ে।” [বর্ণনায় বুখারী]।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ» [متفق عليه].
“আমি তোমাদের যে আদেশ দিয়ে থাকি তা তোমরা সাধ্য অনুযায়ী পালন করো।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- আরেকটি ভুল হলো, যে কুরআন ভালো পড়ে তাকে ছোট হওয়ার কারণে বা মানুষের মধ্যে তার মুল্যায়ন না থাকার কারণে ইমামতির সুযোগ না দেয়া। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللَّهِ، فَإِنْ كَانُوا فِي الْقِرَاءَةِ سَوَاءً فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ، فَإِنْ كَانُوا فِي السُّنَّةِ سَوَاءً فَأَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً، فَإِنْ كَانُوا فِي الْهِجْرَةِ سَوَاءً فَأَقْدَمُهُمْ سِلْمًا» وفي رواية: «فَأَكْبَرُهُمْ سِنًّا..» [رواه مسلم].
“জামাআতের ইমামতি ঐ ব্যক্তি করবে, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল কুরআন পড়তে জানে। যদি তারা পড়াতে সমান হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সুন্নাহ (হাদীস) বেশী জানে সে (ইমামতি করবে)। অতঃপর তারা যদি সুন্নাহতে সমান হয়, তাহলে তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে হিজরতকারী। যদি হিজরতে সমান হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে‘সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণ করছে সে (ইমামতি করবে)।” অপর বর্ণনায় এসেছে, “তাহলে তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যে সে (ইমামতি করবে)।” [বর্ণনায় মুসলিম]
- আরেকটি ভুল: কোনো প্রকার ওজর ছাড়া আযানের পরে মসজিদ থেকে বের হওয়া। কারণ, মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে আবূ সা‘ছা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মসজিদে বসা ছিলাম। তখন মুয়াজ্জিন আযান দিল। তখন এক লোক দাঁড়িয়ে মসজিদ থেকে চলে যাচ্ছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু চোখ ফিরিয়ে দেখলেন লোকটি মসজিদ থেকে বের হয়ে গেছে। তখন আবূ হুরায়রাহ বললেন, “কিন্তু এ লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করেছে।”
এ থেকে বাদ যাবে: যে ব্যক্তি ওযু করার জন্য বা সময়ের মধ্যে প্রশস্ততা রয়েছে বলে আবার ফিরে আসার নিয়তে বের হল। যেমন, কেউ তার পরিবারকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য গেল আবার ফিরে আসবে বলে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি অপর মসজিদে সালাতের জন্যে বের হল, যদি জানে সেখানে সে জামাত পাবে।
আল্লাহ আমাদেরকে দীনের ইলম ও বুঝ বাড়িয়ে দিন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা সেজদা সাহু এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করব।
সেজদা সাহুর বিধান (১)
এ দারসে আমরা সেজদা সাহু এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করব।
সেজদা সাহু: একজন মুসল্লি তার সালাতে ভুল করার কারণে যে ত্রুটি হয় তা দূর করার জন্য যে দুটি সেজদা করে তা হলো সেজদা সাহু। এর কারণ তিনটি: বাড়তি করা, কম করা বা সন্দেহ করা।
প্রথম কারণ: সালাতে বাড়তি করা।
- যদি মুসল্লী তার সালাতে ভুলে সালাত জাতীয় কোনো কর্ম যেমন, কিয়াম, রুকু বা এ ধরনের কোনো কর্ম বাড়তি করে ফেলে এবং সালাত শেষ করার আগে বাড়তি করার বিষয়টি তার স্মরণ না হয়, তখন তার ওপর সেজদা সাহু ছাড়া আর কিছুই নেই।
এর দৃষ্টান্ত: এক ব্যক্তি যোহরের সালাত পাঁচ রাকাআত আদায় করল। কিন্তু বাড়তি এক রাকাতের কথা তাশাহুদে যাওয়ার পর স্মরণ আসছে, তখন সে সালাত পূর্ণ করবে ও সালাম ফিরাবে তারপর সেজদা সাহু করবে তারপর সালাম ফিরাবে, আর যদি সালামের পূর্বে সেজদা করে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
- আর যদি সালাতের মাঝখানে স্মরণ আসে তখন তা থেকে ফিরে আসা এবং সালাত পূর্ণ করা ও সালামের পরে সেজদা সাহু করা ওয়াজিব, যদি সালামের পূর্বে সেজদা করে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
এর প্রমাণ হলো আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস:
أن النبي صلى الله عليه وسلم، صَلَّى الظُّهْرَ خَمْسًا فَقِيلَ لَهُ أَزِيدَ فِي الصَّلَاةِ فَقَالَ: «وَمَا ذَاكَ»؟ قَالَ: صَلَّيْتَ خَمْسًا فَسَجَدَ سَجْدَتَيْنِ بَعْدَ مَا سَلَّمَ، وفي رواية: فَثَنَى رِجْلَيْهِ وَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ وَسَجَدَ سَجْدَتَيْنِ ثُمَّ سَلَّمَ [متفق عليه].
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সালাত পাঁচ রাক‘আত আদায় করেন। তখন মুসল্লীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সালাতে কি কিছু বৃদ্ধি করা হয়েছে? তিনি বললেন, “তা কী?” তারা বললেন, আপনি পাঁচ রাক‘আত সালাত আদায় করেছেন। তারপর তিনি সালাম ফিরানোর পর দু’ সাজদাহ (সাজদাহ সাহু) করে নিলেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “তিনি নিজের পা ঘুরিয়ে (ক্বিবলাহ্মুখী হয়ে) দু’ সাজদাহ (সাজদাহ সাহু) করলেন তারপর সালাম ফিরালেন। [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]।
- যদি কোনো মুসল্লি ভুলে সালাত পূর্ণ করার পূর্বে সালাম ফিরায় তখন যদি দীর্ঘ সময় পর স্মরণ আসে বা তার ওযূ ভেঙ্গে যায় তাহলে তার সাালাত বাতিল। তাকে এ সালাত আবার আদায় করতে হবে। আর যদি সামান্য সময় পর স্মরণে আসে তখন সে তার সালাত পূর্ণ করবে এবং সালামের পর সেজদা সাহু করবে। যদি সালামের পূর্বে সেজদা করে তাতে কোনো অসুবিধা নাই।[33]
এর প্রমাণ: ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীস।
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم «صَلَّى الْعَصْرَ فَسَلَّمَ فِي ثَلَاثِ رَكَعَاتٍ ثُمَّ دَخَلَ مَنْزِلَهُ فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ الْخِرْبَاقُ وَكَانَ فِي يَدَيْهِ طُولٌ فَقَالَ: يَا رَسُولَ الله فَذَكَرَ لَهُ صَنِيعَهُ وَخَرَجَ غَضْبَانَ يَجُرُّ رِدَاءَهُ حَتَّى انْتَهَى إِلَى النَّاسِ فَقَالَ: أَصَدَقَ هَذَا قَالُوا: نَعَمْ فَصَلَّى رَكْعَةً ثُمَّ سَلَّمَ ثُمَّ سَجَدَ سَجْدَتَيْنِ ثُمَّ سَلَّمَ» [رواه مسلم].
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের সালাতে তিন রাকাতের পর সালাম ফিরালেন, তারপর তিনি তার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়ালো যাকে খেরবাক বলা হতো। তার হাত ছিল লম্বা। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল। সে তার কাজটি (ভুলটি) তাকে স্মরণ করে দিল। তিনি চাদর টানতে টানতে ক্ষুব্ধ হয়ে বের হলেন এমনকি মানুষের দলের মধ্যে পৌঁছে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি সত্য বলছে? তারা বলল, হ্যাঁ। তারপর তিনি এক রাকাত আদায় করলেন। তারপর সালাম ফিরালেন তারপর দুটি সেজদা করলেন তারপর সালাম ফিরালেন। [মুসলিম]।
এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। পরবর্তী দারসে আমরা সেজদা সাহুর কারণসমূহ হতে দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে আলোচনা করব আর তা হলো সন্দেহ।
সেজদা সাহুর বিধান সম্পর্কে যে আলোচনা আমরা শুরু করেছি তা আমরা চালিয়ে যাব। এ দারসে আমরা আলোচনা করব:
- সেজদা সাহুর কারণসমূহ হতে দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে। আর তা হলো সন্দেহ এবং দুটি বিষয়ের মাঝে ঘুরপাক খাওয়া।
- যদি তার ধারণায় কোনো একটি প্রাধান্য পায় তখন সে অনুযায়ী আমল করবে এবং সালামের পর সেজদা সাহু আদায় করবে, আর যদি সালামের পূর্বে সেজদা করে তাতে কোনো অসুবিধা নাই।
যেহেতু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«إذَا شَكَّ أَحَدُكُمْ فِي صَلَاتِهِ فَلْيَتَحَرَّ الصَّوَابَ فَلْيُتِمَّ عَلَيْهِ ثُمَّ يُسَلِّمْ ثُمَّ يَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ» [متفق عليه].
তোমাদের কেউ সালাত সম্বন্ধে সন্দেহে পতিত হলে সে যেন নিঃসন্দেহ হবার চেষ্টা করে এবং সে অনুযায়ী সালাত পূর্ণ করে। অতঃপর যেন সালাম ফিরিয়ে দু’টি সাজদাহ দেয়।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]।
- যদি তার নিকট কোনো একটি প্রাধন্য না পায়, তখন সে নিশ্চিতটি ধরে আমল করবে, আর তা হলো দুটি কাজের মধ্যে কমটি। সে অনুযায়ী সালাত পূর্ণ করবে। অতঃপর যেন সালাম ফিরিয়ে দু’টি সাজদাহ দেয়।
এর প্রমাণ হলো, আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إذا شَكَّ أحدُكُم في صلاتِهِ فلم يَدرِ كَم صلَّى؟ ثلاثًا أمْ أربعًا؟ فليطرَحِ الشَّكَّ وليبنِ على ما استيقنَ، ثمَّ يسجُدُ سجدتينِ قبلَ أن يسلِّمَ، فإن كانَ صلَّى خَمسًا، شفَعنَ لَه صلاتَه، وإن كانَ صلَّى إتمامًا لأربعٍ، كانتَا تَرغيمًا للشَّيطانِ» [صححه الألباني].
তোমাদের কারো সালাতে যদি সন্দেহ হয়—কত রাকা‘আত পড়ছে তিন নাকি চার তা জানে না, সে যেন সন্দেহ পরিহার করে প্রবল ধারণার উপর ভিত্তি করে। তারপর সালামের পূর্বে দু’টি (সাহু) সাজদাহ করবে। যদি সে পাঁচ রাকা‘আত পড়ে থাকে তাহলে তা তার সালাতকে জোড় করবে। আর যদি সালাত চার রাকা‘আত পূর্ণ করার জন্য আদায় করে থাকে, তাহলে সাজদাহ দু’টি হবে শয়তানের জন্য নাকে খত দেয়ার মত অপ্রীতিকর।” [আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।
- ইবাদাতে সন্দেহ হলে নিম্নের দুই অবস্থায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করবে না:
১। যদি ইবাদত শেষ করার পরে হয় তখন তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। তবে যদি বিষয়টি নিশ্চিত হয়, তখন বিশ্বাস অনুযায়ী আমল করবে।
২। যখন কোনো মানুষের বেশি বেশি সন্দেহ হয়। যেমন, যখনই কোনো ইবাদত করে তাতে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তখন তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের ইলন, হিদায়াত ও তাওফীককে বাড়িয়ে দিন। এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। পরবর্তী দারসে সেজদা সাহুর কারণসমূহ হতে তিন নম্বর কারণ অর্থাৎ সালাতে কম করা সম্পর্কে আলোচনা করব।
সেজদা সাহুর বিধান সর্ম্পকে আমাদের আলোচনা সম্পন্ন করব। আর এই পাঠে আমরা সেজদা সাহুর কারণসমূহ হতে তৃতীয় কারণ অর্থাৎ সালাতে কম করা সম্পর্কে আলোচনা করে শেষ করব। কম করা কাজটি রুকন অথবা ওয়াজিব হওয়ার ভিন্নতার কারণে তার বিধান ভিন্ন হতে পারে:
প্রথমত: যদি কম করা আমলটি রুকন হয় যেমন, রুকু, সেজদা বা ফাতিয়হা ইত্যাদি:
- যদি পরবর্তী রাকাতের স্বীয় স্থানে পৌঁছার আগে (ছুটে যাওয়া রুকনটি) স্মরণ করে তাহলে সে ফিরে আসবে এবং তার সালাত পূর্ণ করবে ও সেজদা সাহু করবে।
এর দৃষ্টান্ত: যদি কোনো ব্যক্তি রুকু করা ভুলে যায় এবং সেটি একই রাকাতের সেজদায় বা পরবর্তী রাকাতের কিরাতে গিয়ে মনে পড়ে, তখন সে সেজদা বা কিরাত ছেড়ে দিয়ে রুকু করবে তারপর সালাত পূর্ণ করবে এবং সালামের পর সেজদা সাহু করবে। যদি আগে করে তাতে কোনো অসুবিধা নাই।
- আর যদি দ্বিতীয় রাকাতের একই স্থানে এসে মনে পড়ে তাহলে সে অপূর্ণ রাকাত গণনা করবে না। আর এ রাকাতটি উক্ত রাক‘আতের স্থলাভিষিক্ত করবে। তারপর সে সালাত পূর্ণ করবে এবং সালামের পর সেজদা সাহু করবে। আর যদি আগে করে তাতে কোনো অসুবিধা নাই।
এর দৃষ্টান্ত: যদি প্রথম রাকাতের রুকু ভুলে যায় তারপর দ্বিতীয় রাকাতে রুকু করার সময় মনে পড়ে তখন সে প্রথম রাকাত বাদ দিবে এবং দ্বিতীয় রাকাতই হবে তার জন্য প্রথম রাকাত।
- যদি রুকনটির কথা সালামের পরেই মনে পড়ে: যদি ছুটে যাওয়া রুকনটি শেষ রাকাতের হয়, তাহলে সেটি ও তার পরের অংশ আদায় করবে এবং সেজদা সাহু করবে। আর যদি ছুটে যাওয়া রুকনটি তার পূর্বের রাকাতের হয়, তখন সে পূর্ণ একটি রাকাত আদায় করবে তারপর সেজদা সাহু আদায় করবে, যতক্ষণ না তার সালাম ও স্মরণ আসার মাঝখানে লম্বা সময় অতিক্রম না করে। আর যদি লম্বা সময় অতিক্রম করে বা ওযূ ভেঙ্গে যায় তাহলে সে সালাত পুনরায় আদায় করবে।
- যদি ভুলে যাওয়া রুকনটি তাকবীরে ইহরাম হয়, তাহলে তার সালাত হবে না। আর তার ওপর ওয়াজিব হলো সালাত পূণরায় আদায় করা।
দ্বিতীয়ত: যদি ছুটে যাওয়া আমলটি ওয়াজিব হয়, যেমন, পরিবর্তনের তাকবীর বা প্রথম তাশাহুদ বা রুকুতে সুবহানা রাবিয়াল আযীম বলা প্রভৃতি:
- আর যদি তার স্থান ত্যাগের পূর্বে স্মরণ করে, তখন ওয়াজিব হলো তা পালন করা। আর তার ওপর কিছুই নেই এবং সে সেজদায় সাহুও করবে না।
- আর যদি তার স্থান ত্যাগের পরে ও তার পরবর্তী রুকনে পৌঁছার পূর্বে স্মরণ করে, তখন সে পিছনে ফিরে যাবে ও তা আদায় করবে এবং সালাত পূর্ণ করবে। তারপর সালাম শেষে সেজদা সাহু করবে। আর যদি তার আগে সেজদা করে তাতেও কোনো অসুবিধা নাই।
- আর যদি তার পরবর্তী রুকনে পৌঁছার পরে স্মরণ করে তাহলে সেটি তার জিম্মা থেকে বাদ হয়ে যাবে, তার কাছে ফিরে আসবে না। বরং সালাত পূর্ণ করবে এবং সালামের পূর্বে সাহু সেজদা করবে।[[34]]
এর দলিল হলো: ইমাম বুখারী ও মুসলিম আবদুল্লাহ্ ইবন বুহাইনাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم صَلَّى بِهِمُ الظُّهْرَ فَقَامَ فِي الرَّكْعَتَيْنِ الأُولَيَيْنِ لَمْ يَجْلِسْ، فَقَامَ النَّاسُ مَعَهُ، حَتَّى إِذَا قَضَى الصَّلاَةَ وَانْتَظَرَ النَّاسُ تَسْلِيمَهُ كَبَّرَ وَهْوَ جَالِسٌ، فَسَجَدَ سَجْدَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يُسَلِّمَ، ثُمَّ سَلَّمَ.
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের নিয়ে যোহরের সালাত আদায় করলেন। তিনি প্রথম দু’ রাকাআত পড়ার পর না বসে দাঁড়িয়ে গেলেন, ফলে মুক্তাদীগণও তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন। অবশেষে যখন তিনি সালাত শেষ করলেন আর মানুষেরা তার সালামের অপেক্ষা করছিল, তখন তিনি বসাবস্থায় তাকবীর বললেন এবং সালাম ফিরানোর পূর্বে দু’বার সাজদাহ্ করলেন তারপর সালাম ফিরালেন।”
আল্লাহ আমাদের তাঁর সন্তুষ্টির তাওফীক দান করুন। এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা এমন সব মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করব যা মাযুর-অপারগ লোকদের সালাতের সাথে সম্পৃক্ত।
এ দারসে আমরা এমন সব মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করব যা মাযুর তথা অপারগ লোকদের সালাতের সাথে সম্পৃক্ত। তারা হলো, অসুস্থ, মুসাফির এবং ভীত।
-সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তি:
• যদি মসজিদে জামাতে সালাত আদায় করার দ্বারা কোনো ক্ষতি বা কষ্ট তাকে স্পর্শ করে বা তাতে উপস্থিত হওয়াতে রোগ সৃষ্টি বা রোগ বৃদ্ধি বা রোগ সারতে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা করে তখন তার জন্যে তার ঘরে সালাত আদায় করা বৈধ রয়েছে।
• আর তার সক্ষমতা অনুযায়ী সে সালাত আদায় করবে। কারণ, আল্লাহ বলেন,
}فَاتَّقُوا الله مَا اسْتَطَعْتُمْ{ [التغابن: 16]
অতএব, তোমরা যথাসম্ভব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর।”
[আত-তাগাবুন : ১৬]
এ ছাড়াও রয়েছে ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লহু আনহুর হাদীস তিনি বলেন, আমার হেমোরয়েড (অর্শ্বরোগ) ছিল, তাই আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,
«صَلِّ قائمًا، فإن لم تستَطِع فقاعدًا، فإن لم تستَطِعْ فعلى جَنبٍ» [رواه البخاري].
দাঁড়িয়ে সালাত আদায় কর, তা না পারলে বসে; যদি তাও না পার তাহলে কাত হয়ে।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
• যদি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে সক্ষম হয়; কিন্তু রুকু পর্যন্ত দাঁড়াতে সক্ষম নয়, তখন তার ওপর ওয়াজিব হলো সাধ্য অনুযায়ী দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে বসে যাবে।
অনুরূপভাবে যদি কেউ সেজদা করতে সক্ষম কিন্তু রুকু করতে অক্ষম তাহলে তার জন্য ওয়াজিব হলো শরয়ী পদ্ধতিতে সেজদা করবে আর বসে রুকু করবে। অথবা তার সক্ষমতা অনুযায়ী করবে। পূর্বের হাদীস ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর কারণে,
«وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ» [متفق عليه].
আর আমি তোমাদের যে আদেশ দিয়ে থাকি তা তোমরা সাধ্য অনুযায়ী পালন করো।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
• আর যদি তার ওপর প্রত্যেক সালাত সময় মতো আদায় করতে কষ্টকর হয়, তখন তার জন্য যুহরকে আসরের সাথে ও মাগরিবকে এশার সাথে যে কোনো একটি ওয়াক্তে এক সঙ্গে আদায় করা বৈধ।
- মুসাফির ব্যক্তি [[35]] :
• তখন সে চার রাকাত বিশিষ্ট সালাত-যুহর আসর ও এশা- দুই রাকাত আদায় করবে। কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস, তিনি বলেন,
«فُرِضَتِ الصَّلَاةُ رَكْعَتَيْنِ رَكْعَتَيْنِ فِي الْحَضَرِ وَالسَّفَرِ، فَأُقِرَّتْ صَلَاةُ السَّفَرِ، وَزِيدَ فِي صَلَاةِ الْحَضَرِ» [متفق عليه].
“মুকীম ও মুসাফির উভয় অবস্থায় সালাত দুই রাকাত দুই রাকাত করে ফরয করা হয়েছে। মুসাফিরের সালাত বহাল রাখা হয়েছে আর মুকীমের সালাত বাড়ানো হয়েছে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]।
• মুসাফিরের জন্য যুহর ও আসর এবং মাগরিব ও এশার মাঝে তাদের একটির ওয়াক্তে জমা করা বৈধ।
সা‘ঈদ ইবন যুবাইর ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন,
عن ابْنُ عَبَّاسٍ رضي الله عنه، أَنَّ رَسُولَ الله صلى الله عليه وسلم جَمَعَ بَيْنَ الصَّلَاةِ فِي سَفْرَةٍ سَافَرَهَا فِي غَزْوَةِ تَبُوكَ فَجَمَعَ بَيْنَ الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ وَالْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ قَالَ سَعِيدٌ: فَقُلْتُ: لِابْنِ عَبَّاسٍ مَا حَمَلَهُ عَلَى ذَلِكَ؟ قَالَ: أَرَادَ أَنْ لَا يُحْرِجَ أُمَّتَهُ» [رواه مسلم].
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধের সফরে সালাত একত্র করেন। ফলে তিনি যুহর ও আসর এবং মাগরিব ও এশা একত্রে আদায় করেন। সাঈদ বলেন, আমি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটি করার উদ্দেশ্য কি? তিনি বললেন, তিনি চেয়েছেন যে, তার উম্মাতের যেন কষ্ট না হয়। [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]। অর্থাৎ, উম্মতকে যাতে কষ্ট বা বিপদে না পড়তে হয়।
- আর ভীত ব্যক্তি: যেমন, আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ। যখন তারা যুদ্ধের ময়দানে থাকেন এবং তারা তাদের ওপর কাফেরদের আক্রমণের আশঙ্কা করেন।
• তখন তাদের জন্য বৈধ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদায়কৃত যেকোনো এক পদ্ধতিতে ভয়ের সালাত আদায় করা। আর যখন ভয় কঠিন হয়, তখন পায়ে হেঁটে অর্থাৎ চলন্ত অবস্থায় নিজ পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ও তাদের সাওয়ারীর ওপর আরোহণ করে সালাত আদায় করবে। কিবলামুখ করে হোক বা না হোক। আর রুকু সেজদার জন্যে ইশারা করবে। কারণ, আল্লাহ বলেন,
}فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا{ [البقرة: 239].
আর যদি তোমরা ভয় করো তাহলে পায়ে হেঁটে বা বাহনে চড়ে।” [আল-বাকারাহ : ২৩৯]
• অনুরূপভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি যে তার নিজের ওপর ভয় করে সে তার অবস্থা অনুযায়ী সালাত আদায় করবে। আর সে দৌঁড়ে পালানো বা অন্য যা কিছু করার প্রয়োজন বোধ করবে তার সবকিছুই করবে। তবে যে হক তার ওপর আবশ্যক হয়েছে সে হক থেকে পলায়নকারী যেমন চোর ও তার মত ব্যক্তির জন্য সালাতুল খাওফ আদায় করা বৈধ নয়। কারণ, এটি একটি ছাড়, যা পাপ দ্বারা পাওয়া যায় না।
আল্লাহর কাছে দীনের সঠিক বুঝ প্রার্থনা করছি। এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা জুমুআর সালাতের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা জুমুআর সালাতের বিধান ও আদবসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
- জুমুআর সালাত ইসলামের একটি মহান নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
}يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ الله وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ{ [الجمعة: 9]
হে ঈমানদারগণ ! জুমু’আর দিনে যখন সালাতের জন্য ডাকা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনা-বেচা ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে।” [আল-জুমুআ : ৯]
যে ব্যক্তি কোনো প্রকার উযর ছাড়া জুমুআর সালাত থেকে বিরত থাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
«لَيَنتهِينَّ أقوامٌ عن وَدْعِهم الجُمُعاتِ، أو لَيختمنَّ اللهُ على قلوبِهم، ثم لَيكونُنَّ مِنَ الغافلِينَ» [رواه مسلم].
“লোকেরা যেন জুমআ ত্যাগ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকে; নচেৎ আল্লাহ অবশ্যই তাদের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দিবেন, অতপর তারা অবশ্যই উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন। (وَدْعِهِمْ) এর অর্থ ছেড়ে দেয়া, বিরত থাকা।
- এটি স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও মুকীম পুরুষ যাদের কোনো অপারগতা নাই তাদের ওপর ওয়াজিব।
- যে ব্যক্তি জুমুআতে আসবে তার জন্য মুস্তাহাব হলো গোসল করা, খুশবু লাগানো, সুন্দর কাপড় পরিধান করা এবং তাড়াতাড়ি জুমুআর সালাতে উপস্থিত হওয়া। আর যখন মসজিদে প্রবেশ করবে তখন দুই রাকাত সালাত আদায় করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ، وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ، ثُمَّ يَخْرُجُ فَلا يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ، ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ، ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الإمَامُ إِلا غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى» [رواه البخاري].
যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন গোসল করে এবং যথাসাধ্য ভালরূপে পবিত্রতা অর্জন করে ও নিজের তেল হতে ব্যবহার করে বা নিজ ঘরের সুগন্ধি ব্যবহার করে, অতঃপর বের হয় এবং দু’ জন লোকের মাঝে ফাঁক না করে, অতঃপর তার নির্ধারিত সলাত আদায় করে এবং ইমামের খুতবা দেয়ার সময় চুপ থাকে, তা হলে তার সে জুমু‘আহ হতে আরেক জুমু‘আহ পর্যন্ত সময়ের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]।
- জুমুআর রাতে এবং দিনে নবী সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়াসাল্লামের ওপর বেশি বেশি সালাত পড়া মুস্তাহাব। কারণ, তিনি বলেছেন,
«إنَّ مِن أفضلِ أيَّامِكم يومَ الجُمعةِ فيه خلَق اللهُ آدَمَ وفيه قُبِض وفيه النَّفخةُ وفيه الصَّعقةُ فأكثِروا علَيَّ مِن الصَّلاةِ فيه فإنَّ صلاتَكم معروضةٌ علَيَّ» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুমার দিন। এ দিনে আল্লাহ আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন, এ দিনে তার জান কবয করেছেন। এ দিনে শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। এদিনই বিকট শব্দ করা হবে। সুতরাং ঐ দিনে তোমরা আমার উপর বেশী বেশী সালাত পাঠ কর। কেননা, তোমাদের পাঠ করা সালাত আমার কাছে পেশ করা হয়।” [আবূ দাউদ। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]।
- যে ব্যক্তি জুমুআর সালাতে উপস্থিত হবে তার জন্য ওয়াজিব হলো খুতবা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা এবং কোনোভাবে তার থেকে অমনোযোগী না হওয়া, যেমন, জায়নামায বা মোবাইল বা অন্য কিছু নিয়ে খেলা করা।
কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إذَا قُلْتَ لِصَاحِبِكَ أَنْصِتْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَقَدْ لَغَوْتَ» [متفق عليه]
“জুম‘আর দিন ইমামের খুতবা প্রদানকালে যখন তুমি তোমার সাথীকে বললে, ‘চুপ করো’ তখন তুমি অনর্থক কাজ করলে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«وَمَنْ مَسَّ الحَصَا فَقَدْ لَغَا» [رواه مسلم].
যে ব্যক্তি কংকর স্পর্শ করল সে অনর্থক কাজ করল।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]।
- ইমামের সাথে জুমুআর এক রাকাত পেলেই জুমুআর সালাত পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَن أَدْرَك ركعةً من الصَّلاة، فقد أدركَ الصَّلاة» [متفق عليه]
“যে ব্যক্তি সালাতের এক রাকাআত পাবে সে (জুমু‘আর) সালাত পাবে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
অতএব, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে রুকু পেল সে জুমুআ পেল। অন্যথায় সে যুহরের নিয়তে চার রাকাত আদায় করবে।
আল্লাহ আমাদেরকে জুমুআর দিনের ফযীলতকে গণীমত হিসেবে গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। এ পরিমাণ আলোচনায় যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা দুই ঈদের সালাতের বিধানাবলি সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা দুই ঈদের সালাতের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
- ঈদ হলো দীনের প্রকাশ্য নিদর্শন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন তিনি দেখতে পান আনসারগণ বছরে দুটি দিনে আনন্দ উদযাপন করে। তখন তিনি বললেন,
«قدْ أبْدَلكم اللهُ تعالى بهما خيرًا منهما؛ يومَ الفِطرِ والأضحى» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দুটি দিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
- ঈদকে ঈদ বলার কারণ হলো এটি ফিরে আসে ও বার বার আসে এবং এটির আগমনকে শুভলক্ষণ গণ্য করা হয়। কাজেই এটি পাপহীন আনন্দ ও খুশির দিন।
- আযান ইকামত ছাড়া ঈদের সালাত দুই রাকাআত। ইমাম উভয় রাকাতে কিরাত উচ্চ আওয়াজে পড়বে। প্রথম রাকাতে তাকবীরে ইহরামা ছাড়া কিরাতের পূর্বে ছয় তাকবীর বলবে। আর দ্বিতীয় রাকাতে সেজদা হতে দাঁড়ানো তাকবীর ছাড়া পাঁচ তাকবীর বলবে। প্রতিটি তাকবীরের সাথে হাত উঠাবে। যখন সালাম ফিরাবে ইমাম দাঁড়াবে ও জুমুআর খুতবার মতো দুটি খুতবা প্রদান করবে।
- একজন মুসলিমের জন্য মুস্তাহাব হলো ঈদের জন্যে পরিস্কার হওয়া, খুশবু লাগানো, সুন্দর কাপড় পরিধান করা এবং এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফিরে আসা।
- ঈদুল ফিতরের দিন সুন্নাত হলো ঈদের সালাতে যাওয়ার আগে বেজোড় খেজুর খাওয়া। আর কুরবানীর ঈদের দিন সুন্নাহ হলো ঈদের সালাতের পর স্বীয় কুরবানীর পশুর মাংস আহার করার আগে কোনো কিছু আহার না করা।
- নারীদের জন্য সুন্নাহ হলো কোনো প্রকার বাহ্যিক সাজ সজ্জা গ্রহণ করা ছাড়া ও আতর লাগানো ব্যতীত ঈদের সালাতের উপস্থিত হওয়া। উম্মে ‘আতীয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,
«أَمَرَنَا -تَعْنِي النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم- أَنْ نُخْرِجَ فِي الْعِيدَيْنِ: الْعَوَاتِقَ وَذَوَاتِ الْخُدُورِ، وَأَمَرَ الْحُيَّضَ أَنْ يَعْتَزِلْنَ مُصَلَّى الْمُسْلِمِينَ» [متفق عليه].
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, “আমরা যেন আমাদের যুবতী ও উড়না বিশিষ্ট নারীদেরকে দুই ঈদে বের করে নিয়ে যাই এবং ঋতুবতী নারাীদেরকে তিনি মুসলিমদের সালাত আদায়ের স্থান থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] العَوَاتِق (আওয়াতেক): অর্থাৎ যে সব নারী এখনো প্রাপ্ত বরস্ক হয় নাই এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছেছে।
- তাকবীর বলা সুন্নাত। আর তা হলো ঈদের রাতে সূর্যাস্ত থেকে ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত।[[36]]
- ঈদের দিনে যা করা বৈধ: আল্লাহর ইবাদত পূর্ণ করতে পেরে খুশি হওয়া এবং আল্লাহর হিদায়াত ও তাওফীকের ওপর তার শোকর আদায় করা। আর এতে সাধারণভাবে মানুষের অন্তরে আনন্দ ও খুশি প্রবেশ করানো এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও তাদের প্রতি দয়া করা শরীয়ত অনুমোদিত।
- দুই ঈদের দিন সাওম পালন করা হারাম। অনুরূপভাবে ইদের দিন বিশেষ করে কবর যিয়ারত করা সৃষ্ট বিদআত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের ঈদসমূহকে কবুলকৃত আমল, ক্ষমাকৃত গুনাহ ও উচ্চ মর্যাদা দানের মাধ্যমে আনন্দ দায়ক বানান।
এ দারসে আমরা জানাযার বিধান ও মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করব:
এ বিষয়ে বিস্তারিত মাসায়েল আলোচনা করার পূর্বে আমাদের ওপর ওয়াজিব হলো এ দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেদিন আমাদের এ দুনিয়ার জীবন শেষ হয়ে যাবে এবং তাতে আমাদের কিয়ামত শুরু হয়ে যাবে। আর তা হলো তাড়াতাড়ি তাওবা করা ও হককে তার পাওনাদারের নিকট পৌছে দেওয়া এবং ইবাদাতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার দ্বারা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
} فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا { [الكهف:110]
“যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাতের আশা করে সে যেন নেক আমল করে।” [আল-কাহাফ : ১১০] বিচক্ষণ জ্ঞানী তো সে ব্যক্তি যে সব সময় এ মুহুর্তটি স্মরণ করে, যে সময়ে তার আমল বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারপর আমলের হিসাব শুরু হয়ে যাবে। আল্লাহ সাহায্যকারী।
- যে ব্যক্তি কোনো রোগীকে দেখতে যাবে তার জন্য করণীয় হলো: রোগীর সুস্থতার জন্য দোয়া করা, তার মধ্যে সুভ লক্ষণ ও আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা সৃষ্টি করা। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো রোগীকে দেখতে যেতেন তখন বলতেন,
«لَا بَأْسَ، طَهُورٌ إِنْ شَاءَ الله» [رواه البخاري].
“কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই, (পীড়াজনিত দুঃখ কষ্টের কারণে গুনাহ থেকে) তুমি পবিত্র হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
- যখন রোগীর মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হওয়ার আলামত দেখা দেয় তখন মুস্তাহাব হলো হিকমত ও সুন্দর নিয়মে তাকে তাওহীদের কালিমা ও জান্নাতের চাবি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর তালকীন দেওয়া ও তা পাঠের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا الله» [رواه مسلم]
তোমরা তোমাদের মুমূর্ষ ব্যক্তিদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর তালকীন দাও।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন] যদি বিরক্ত হওয়ার আশঙ্কা করো তবে তোমরা তাকে সরাসরি তালকীন করবে না; বরং তার সামনে বার বার কালিমা শাহাদাত পড়বে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ مِنَ الدُّنْيَا لَا إِلَهَ إِلَّا الله دَخَلَ الْجَنَّةَ» [رواه أبو داود وحسنه الألباني].
যে ব্যক্তির দুনিয়াতে শেষ কালিমা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ -সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” এটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী তা হাসান বলেছেন।
- যখন কোনো মুসিলম মারা যায় তখন মুস্তাহাব হলো তার দুই চোখ বন্ধ করে দেওয়া, তার জন্য রহমাত, মাগফিরাতের দোয়া করা, আর তাকে দ্রুত কবরস্ত করতে প্রস্তুত করা এবং তার পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَسْرِعُوا بِالْجَنَازَةِ فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا إِلَيْهِ وَإِنْ تَكُ سِوَى ذَلِكَ فَشَرٌّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ» [متفق عليه].
জানাযাকে দ্রুত নিয়ে যাও, কেননা যদি সে নেককার হয় তবে তোমরা তাকে তার কল্যাণের দিকে দ্রুত পৌঁছে দিবে। আর যদি সে ভিন্ন কিছু হয় তবে তোমরা একটা অকল্যাণ তোমাদের ঘাড় (দায়িত্বভার) থেকে দ্রুত নামিয়ে দিলে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর ইবন আবূ তালেবের শাহাদাতের পর বলেছেন,
«اصْنَعُوا لِآلِ جَعْفَرٍ طَعَامًا، فَقَدْ أَتَاهُمْ مَا يَشْغَلُهُمْ» [رواه أبوداود وحسنه الألباني].
তোমরা জাফরের পরিবারের জন্য খাওয়ার তৈরি কর। কারণ, তাদের সামনে তাদের ব্যস্ততা এসে পড়েছে।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]।
আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের আমল ও পরিণতিকে সুন্দর করে দেন এবং তার সঠিক পথের ওপর অটুট রাখেন। এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। পরবতী দারসে আমরা মৃতের কাফন দাফন, গোসল করানো এবং তার ওপর জানাযার সালাত সম্পর্কে আলোচনা করবো।
পূর্বের পাঠে আমরা জানাযার কতিপয় বিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছি । এ পাঠে আমরা মৃত ব্যক্তির গোসল, কাফন দাফন এবং তার ওপর সালাত সম্পর্কে আলোচনা করবো।
- একজন মুসলিমের মৃত্যুর পর ওয়াজিব হলো তাকে গোসল দেয়া। প্রথমে তার সতর ঢাকবে। তারপর তার দেহ থেকে নাপাকি দূর করবে। তারপর তাকে শরয়ী পদ্ধতিতে ওযূ করাবে। তারপর তাকে পানি ও বরই পাতা দিয়ে তিনবার গোসল দিবে। তারপর ডান দিক থেকে বাম দিকে তার শরীরের ওপর তিনবার পানি প্রবাহিত করবে। যদি আরও লাগে তবে তখন বেজোড় সংখ্যায় আরো বৃদ্ধি করবে। আর সর্বশেষ গোসলে কাফুর লাগাবে। এটি হলো মুস্তাহাব পদ্ধতি। যদি শুধু নাপাকি দূর করে এবং তার দেহের ওপর পানি ঢেলে দেয় তবে তাতেও যথেষ্ট হবে। নারীদেরকে তার মতো একজন নারী বা তার স্বামী গোসল দিবে।
- পুরুষকে তিনটি সাদা চাদরে কাফন দেওয়াবে। আর মৃতের নাক ও সেজদার স্থানসমূহে এবং কাফনে হানূত তথা খুশবু লাগাবে। আর নারীদেরকে লুঙ্গি, চাদর, ওড়না ও দুটি চাদরের মধ্যে কাফন পরিধান করাবে। যতটুকু দ্বারা ওয়াজিব আদায় হয় তা হলো এমন একটি কাপড় যা দ্বারা মৃতের পুরো শরীর ঢেকে যায়।
- তারপর লাশকে তার ওপর জানাযার সালাত পড়ার জন্য পেশ করা হবে। ইমাম পুরুষের মাথা বরাবর এবং নারীদের মাঝখান বরাবর দাঁড়াবে। চারবার তাকবীর বলবে। প্রথম তাকবীরের পর সূরা ফাতিহা আস্তে বলবে। তারপর আবার তাকবীর বলে রাসূলের ওপর সালাত পাঠ করবে। তারপর আবার তাকবীর বলে মৃতের জন্য দোআ করবে, তারপর আবার তাকবীর বলে ডান দিকে একবার সালাম ফিরাবে।
- যদি কারো সালাতের কিছু অংশ ছুটে যায়, তবে ইমামের সালামের পর তা আদায় করবে। যদি আশঙ্ক করে যে, লাশ তুলে ফেলা হবে, তথন সে তাকবীর বলে সালাম ফিরাবে। যদি কারো জানাযার সালাত ছুটে যায় তখন সে দাফন করার পূর্বে একা একা পড়ে নেবে। দাফন করার পরও পড়া জায়েয আছে।
- জানাযার সালাতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَن شَهِدَ الجَنازَةَ حتَّى يُصَلَّى عليها فَلَهُ قِيراطٌ، ومَن شَهِدَها حتَّى تُدْفَنَ فَلَهُ قِيراطانِ، قيلَ: وما القِيراطانِ؟ قالَ: مِثْلُ الجَبَلَيْنِ العَظِيمَيْنِ» [متفق عليه].
যে ব্যক্তি মৃতের জন্য সালাত আদায় করা পর্যন্ত জানাযায় উপস্থিত থাকবে, তার জন্য এক কীরাত, আর যে ব্যক্তি মৃতের দাফন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে তার জন্য দু’ কীরাত। জিজ্ঞেস করা হল দু’ কীরাত কী? তিনি বললেন, দু’টি বিশাল পর্বত সমতুল্য (সাওয়াব)।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«مَا مِنْ رَجُلٍ مُسْلِمٍ يَمُوتُ فَيَقُومُ عَلَى جَنَازَتِهِ أَرْبَعُونَ رَجُلًا لَا يُشْرِكُونَ بِالله شَيْئًا إِلَّا شَفَّعَهُمْ الله فِيهِ» [رواه مسلم].
“যে কোনো মুসলিম মারা যায় আর তার জানাযায় এমন চল্লিশজন লোক শরীক হয়, যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না। নিশ্চয় আল্লাহ তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ কবূল করেন।’’ [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম]
হে আল্লাহ! আমাদের শেষ আমলগুলোকে তুমি উত্তম আমল বানাও। আর আমাদের শেষ বয়সকে তুমি উত্তম বয়স বানাও। আর আমাদের দিনসমূহ হতে উত্তম দিন সেদিনটিকে বানাও যেদিন আমরা তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো, যে অবস্থায় তুমি আমাদের ওপর রাজি-খুশি থাকবে। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। পরবর্তী দারসে আমরা এমন কতক ভুল ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করব যেগুলো একজন মুসলিমের মৃত্যুর পর কোনো কোনো মানুষ করে থাকে।
পূর্বের দারসে আমরা জানাযা ও তার ওপর সালাতের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ পাঠে আমরা এমন কতিপয় ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করব যেগুলো একজন মুসলিমের মৃত্যুর পর কোনো কোনো মানুষ করে থাকে।
- শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এ সব বিষয়ে মুসলিমের ওপর ওয়াজিব হলো, সবর করা, সাওয়াবের আশা করা, উচ্চ আওয়াজে কান্নাকাটি না করা, পোশাক না ছেঁড়া ও চেহারায় আঘাত না করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ»
সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে (শোকের সময়) গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের চিৎকারের ন্যায় চিৎকার করে।”
এছাড়াও সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَرْبَعٌ فِي أُمَّتِي مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لَا يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِي الْأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِي الْأَنْسَابِ وَالْاسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ وَالنِّيَاحَةُ وَقَالَ: النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ» [رواه مسلم].
আমার উম্মাতের মধ্যে জাহিলিয়্যাতের চারটি স্বভাব রয়েছে, তারা তা ছাড়বে না। বংশ নিয়ে অহংকার করা, বংশের মধ্যে আপত্তি করা, তারকা দ্বারা বৃষ্টি কামনা করা এবং মৃতের ওপর উচ্চ আওয়াজে মাতম করা। নারী যদি মরণের পূর্বে তাওবাহ না করে, তাহলে আল-কাতরার পায়জামা এবং পাঁচড়ার জামা পরিহিতা অবস্থায় তাকে কিয়ামতের দিনে দাঁড় করানো হবে।’’ [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
নিয়াহা (النِّياحة) হলো, মৃত ব্যক্তির ওপর উচ্চ আওয়াজে কান্না কাটি করা। আবূ মূসা আব্দুল্লাহ ইবন কায়েস আল-আশআরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (বিপদে) চিৎকারকারী, মাথা মুণ্ডনকারী ও জামাকাপড় ছিড়েঁ ফেলা নারীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন।”
হালেকা (الحَالِقة): ঐ নারী যে মুসীবতের সময় মাথার চুল মুন্ডায় এবং তা উপড়ে ফেলে।
আর শাক্কা (الشاقة): যে নাবী মুসীবাতের সময় তার কাপড় ছিঁড়ে ফেলে।
আর ছালেকা (الصالقة): যে নারী মুসীবাতের সময় তার আওয়াজকে উচ্চ করে। এ গুলো সবই হলো হায় হুতাশ করার অংশ। নারীর জন্য এবং পুরুষের জন্য এ সবের কোনো কিছুই করা বৈধ নয়।[[37]]
- কতিপয় মানুষের ভুলের মধ্যে অন্যতম হলো মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে বা তার কৃত অসিয়াত বাস্তবায়নে বিলম্ব করা। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«نفْسُ المؤمِن مُعلَّقة بدَيْنِه؛ حتى يُقضَى عنه» [رواه ابن ماجه وصححه الألباني].
মুমিনের আত্মা তার ঋণের সাথে ঝুলন্ত; যতক্ষণ না তা আদায় না করবে।” [এটি ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
- যে নিকৃষ্ট বিদআত থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন তা হলো কবরকে সালাতের স্থান বানানো বা তার ওপর মসজিদ বানানো বা মৃত ব্যক্তিকে মসজিদে দাফন করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَلَا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ، أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ، إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ» [رواه مسلم].
জেনে রাখো! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবরগুলোকে মসজিদ বানাতো। খবরদার, তোমরা কবরগুলোকে মসজিদ বানাবে না, আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন,
(نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ)
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করতে, তার উপর বসতে এবং তার উপর ইমারত নির্মাণ করতে বারণ করেছেন।” তিরমিযী (وأن يكتب عليه). “এবং তার ওপর লেখা” শব্দ বৃদ্ধি করেছেন। আল-জিস্স (الجص): এমন বস্তু যার দ্বারা নির্মাণ করা হয় বা যার দ্বারা মেরামত করা হয়।
- কবরের বিদআতসমূহের আরেকটি হলো কবরে ফুল দেওয়া।
হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে আপনার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী বানান এবং তাঁর সুন্নাতের ধারক তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী বানান। আজরেক পাঠে এটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা ইসলামের তৃতীয় রুক যাকাত সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা ইসলামের তৃতীয় রুকন যাকাত সম্পর্কে আলোচনা করব। যাকাত হলো আর্থিক ফরয ইবাদত যা আল্লাহ তা‘আলা ধনী মুসলিমের ওপর ফরয করেছেন, তার সম্পদের পবিত্রতা, তার ফকির মিসকীন ভাই ও যাকাতের অন্যান্য হকদারদের প্রতি সহানুভুতি স্বরূপ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
}وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ{ [البقرة: 43]
আর তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো।” [আল-বাকারাহ : ৪৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
}خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا{ [التوبة: 103].
তাদের সম্পদ থেকে সাদকা (যাকাত) নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।” [তাওবাহ : ১০৩]
- সে সব খাতে যাকাত ব্যয় করা ওয়াজিব সে সব খাত আল্লাহ তার বাণীতে বলে দিয়েছেন-
}إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ الله وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ الله وَالله عَلِيمٌ حَكِيمٌ{ [التوبة: 60].
“সদকা তো শুধু ফকীর, মিসকীন ও সদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের জন্য, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তিতে, ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [আত-তাওবাহ : ৬০]
ফকীর: যার কোনো কিছুই নাই বা তার প্রয়োজনের অর্ধেক আছে।
আর মিসকীন হলো যার কাছে প্রয়োজনের অর্ধেক আছে বা বেশি আছে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় কম।
তার কর্মচারী: দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে যাদেরকে যাকাত একত্র করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা ও বন্টন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের পরিশ্রম অনুযায়ী শ্রমের বিনিময় যাকাত থেকে দেয়া হবে।
মুয়াল্লাফাতে কুলুব: কাফেরদের থেকে যাদের ইসলাম গ্রহণ অথবা যাদের অনিষ্ট থেকে বিরত থাকা উদ্দেশ্য বা মুসলিমদের থেকে যাদের সমাজে একটি অবস্থান রয়েছে তাদের অন্তরকে আকৃষ্ট করা ও তাদের ঈমানকে বাড়ানো উদ্দেশ্য।
রিকাব: হলো গোলাম আযাদ করা এবং মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা।
গারেম: যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ ও আদায় করতে অক্ষম। অথবা তার ঋণ দুইজনের মাঝে সমঝোতার জন্য যদিও সে সক্ষম।
আর আল্লাহর রাস্তা: তারা হলো আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ।
ইবনুস সাবীল: ঐ মুসাফির যে তার রাস্তায় সম্বল হারা হয়ে পড়ছে। তাকে তার শহরে ফিরে আসতে পারে সে পরিমাণ যাকাত দেয়া হবে।
- অন্তর আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্য ছাড়া কাফেরকে যাকাত দেয়া যাবে না। আর যার ওপর খরচ করা ওয়াজিব যেমন, স্ত্রী পিতা সন্তান তাদের যাকাত দেয়া যাবে না। বনু হাশেম তারা হলো রাসূলের পরিবার তাদের যাকাত দেয়া যাবে না।
- নিসাব পরিমাণ সম্পদেই যাকাত ওয়াজিব হয়। মানুষ সরাসরি উপকৃত হওয়ার জন্য যে সম্পদের মালিক হয় তাতে যাকাত ওয়াজিব হয় না। যেমন, থাকার ঘর, গাড়ী পোশাক ইত্যাদি। ব্যবসায়ের জন্য না হলে ব্যবহৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যের মধ্যে যাকাতের বিষয়ে আলেমগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন। তবে জমহুর আলেমদের মতে, ব্যবহৃত স্বর্ণে বা রৌপ্যে যাকাত নেই।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা হলো তিনি যেন আমাদেরকে ঐ সব লোকেদর অন্তর্ভুক্ত করেন যারা পুরোপুরিভাবে যাকাত আদায় করেন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে যে সব মালের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব হয় তার আলোচনা করব।
পূর্ববর্তী দারসে আমরা যাকাতের খাত ও তার কিছু বিধান আলোচনা করেছি। এ দারসে আমরা যে ধরনের সম্পদের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব হয় সে সম্পর্কে আলোচনা করব। তা হলো:
১- প্রথম প্রকার হলো নগদ অর্থ: আর তা হলো, স্বর্ণ (যে পরিমাণে যাকাত ওয়াজিব হয় তা হলো ৮৫ গ্রাম); রুপা (তার নিসাব হলো ৫৯৫ গ্রাম); নগদ অর্থ, যেমন, টাকা, রিয়াল, ডলার ইত্যাদি)। (এ গুলোর নিসাব হলো স্বর্ণ ও রুপার মধ্যে যেটির মূল্য কম সে পরিমাণ মূল্য) যখন সম্পদ নিসাব পরিমাণ হবে এবং তার ওপর (একজন মুসলিমের মালিকানায়) বছর পূর্ণ হবে তখন এক দশমাংসের চার ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। আর তা হলো ২.৫% এর সমান।
- তোমার মালের যাকাতের সহজভাবে হিসাব করার পদ্ধতি: পুরো মালকে চল্লিশ ভাগ করো। তাহলে তোমার জন্য যে পরিমাণ মাল যাকাত দিতে হবে তা বের হয়ে যাবে।
২- দ্বিতীয় প্রকার মাল যাতে যাকাত ওয়াজিব তা হলো চতুষ্পদ জন্তু: তা হলো উট, ছাগল ও গরু। এ গুলোর মধ্যে শর্ত হলো অধিকাংশ বছর তা ছাড়া থাকতে হবে।(আর তা হচ্ছে যেগুলো মাঠে চরে বেড়ায় এবং তার মালিক তাদের খাদ্য দেয় না।) আর যে গুলো রাখা হয় দুধ ও প্রজননের জন্য। চাষাবাদ বা পানি টেনে ওপরে তোলার জন্য রাখা হয়নি। আর উটের মধ্যে তার নিসাব হলো ৫টি, গরুর নিসাব ৩০টি এবং ছাগলের নিসাব ৪০টি। চতুষ্পদ জন্তুর যাকাতের নিসাবের বিস্তারিত আলোচনা বিশুদ্ধ হাদীস সমূহ এবং ফিকাহের কিতাবসমূহে রয়েছে।
৩- তৃতীয় প্রকার সম্পদ যার মধ্যে যাকাত ওয়াজিব: যমীন থেকে উৎপাদিত ফসল, ফলফলাদি ও শস্য। কেবল মাত্র যেগুলো সা ও অন্যান্য ওজনকরা পাত্র দ্বারা মাফা হয় এবং যেগুলো গুদামজাত করে জমা রাখা হয়, তার মধ্যে যাকাত ওয়াজিব হবে। যেমন, গম, খেজুর, কিসমিস ও দানাজাত ফসল। আর যে গুলো গুদামজাত করা যায় না যেমন, তরমুজ, আনার, কলা ইত্যাদি তাতে কোনো যাকাত নাই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমীনে উৎপন্ন ফসলের নিসাব স্বীয় বাণীতে বর্ণনা করেছেন-
«وَلَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ مِنَ التَّمْرِ صَدَقَةٌ» [متفق عليه]
“পাঁচ ওসকের কম পরিমাণ খেজুরের মধ্যে কোনো যাকাত নেই।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] ওসাক (الوسق) বলা হয় এমন একটি পরিমাপক যা পরিধি (দৈর্ঘ্য ও প্রশস্ত) দ্বারা পরিমাপ করা হয়, ওজন দ্বারা পরিমাপ করা হয় না। এটি তিনশত সা এর সমান হয়। আর তার ওজন ভালো গম দ্বারা ৬১২ গ্রামের সমান হবে।
যমীন থেকে উৎপাদিত ফসলে যাকাত ওয়াজিব হবে ফসল পাকার সময়। আর তা হলো যখন ফসলের দানা শক্ত হয় এবং ফলের উপযুক্ত হওয়া প্রকাশ পায়। কারণ, আল্লাহ বলেন,
}وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ{ [الأنعام: 141].
“তোমরা ফসল কাঁটার দিন তার হক আদায় করো।” [আল-আনআম ১৪১]
যে সব ভূমিতে কোনো প্রকার খরচ ছাড়া সেচ করা হয় তার যাকাতের পরিমাণ হলো দশ ভাগের এক ভাগ। যেমন, বৃষ্টির পানি, নদীর পানি বা প্রবাহিত পানি দ্বারা সেচ হওয়া। আর যে সব ভূমিতে খরচ করে সেচ দেওয়া হয়, যেমন যন্ত্রের সাহায্যে সেচ দেওয়া এবং পাম্পের সাহায্যে সেচ দেওয়া তাতে বিশভাগের একভাগ যাকাত দিতে হয়।
৪- চতুর্থ প্রকার যাতে যাকাত ওয়াজিব হয় তা হলো ব্যবসায়িক পণ্য। অর্থাৎ যেগুলোকে লাভের উদ্দেশ্যে বেচা-কেনার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়। তখন তার মুল্য নগদ অর্থের সাথে মিলানো হবে। তারপর সবগুলোর চল্লিশভাগের এক ভাগ যাকাত দেয়া হবে।[[38]]
হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে তাকওয়া দান করেন। আর আমাদের আত্মাকে পবিত্র করেন। আপনিই উত্তম পবিত্রতা দানকারী। আপনি তার নিয়ন্ত্রক ও অভিভাবক। এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা সাদকাতুল ফিতর সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা সাদকাতুল ফিতর সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো,
সাদকাতুল ফিতর হলো সাওম পালনকারীর জন্য পবিত্রতা এবং মিসকীনদের জন্য আহার স্বরূপ। আর একমাসের সাওম পালনের কারণে আল্লাহ কৃতজ্ঞতা।
- যে ব্যক্তির কাছে ঈদের দিনে বা রাতে তার নিজের ও তিনি যাদের দায়িত্বশীল তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং মৌলিক চাহিদার অতিরিক্ত এক সা‘ পরিমাণ সম্পদ থাকে, তার ওপর সাদকা ফিতর ওয়াজিব। আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«فَرَضَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ وَالذَّكَرِ وَالأنْثَى وَالصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ مِنْ الْمُسْلِمِينَ» [متفق عليه].
“প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- আর এর পরিমাণ: শহরের অধিকাংশ মানুষের খাদ্যের (গম বা আটা বা খেজুর বা কিসমিস বা চাল বা দানা ইত্যাদির) এক সা‘।
সা’ হলো এমন একটি পরিমাপক যদ্ধারা পরিমাপ করা যায়, ওজন করা যায় না। এটি পরিমাপকৃত খাদ্যের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। ফাতওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি সা‘ এর ওজন চাউলের থেকে তিন কিলোগ্রাম নির্ধারণ করেছে। জমহুর আলেমগণের নিকট খাদ্যের মুল্য দেওয়া যায়েয নাই।
- সাদকাতুল ফিতর দেয়ার সময়: ঈদের রাতে সূর্যাস্ত থেকে ইমামের ঈদের সালাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত। একদিন বা দুইদিন আগে তা আদায় করা বৈধ আছে। (অর্থাৎ ২৮ তারিখ সূর্যাস্তের পর থেকে)। আর যে ব্যক্তি সময় মতো আদায় করতে পারলো না তবে তাকে কাজা আদায় করতে হবে। আর যদি কোনো শরয়ী ওজর ছাড়া দেরি করে থাকে তাহলে তাকে তাওবা ও ইস্তেগফারের সাথে তা আদায় করতে হবে।
- মূল নিয়ম হলো সাদকায়ে ফিতর যে শহরে বা দেশে সে বসবাস করে সেখানেই সাদকা ফিতর আদায় করবে। তবে যদি কোনো শরয়ী কল্যাণ থাকে তখন তিনি যে শহরে অবস্থান করছেন তা থেকে অন্য শহরে নেয়া যাবে। যেমন, তার শহরে ফকীর পাওয়া যাচ্ছে না অথবা যারা অধিক অভাবী তাদের উদ্দেশ্যে স্থানান্তর করছে, তার গরীব আত্মীয়ের জন্য স্থানান্তর করছে। আর যদি কোনো কারণ ছাড়া স্থানান্তর করে তখন হারামের সাথে বা মাকরুহের সাথে তা আদায় করা হবে।
হে আল্লাহ আপনি হারাম ব্যতীত হালাল দ্বারা আমাদের যথেষ্ট করে দেন। আর আপনি আপনার অনুগ্রহ দ্বারা অন্যদের প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে আমাদের বাঁচান। এ টুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আগামী দারসে আমরা ইসলামের রুকসমূহ হতে চতুর্থ রুকন সাওম সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে ইসলামের রুকনসমূহ হতে চতুর্থ রুকন রমযানের সাওম বিষয়ে আলোচনা করব।
- সাওম হলো: আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ফজর উদয় [[39]] হওয়া (অর্থাৎ ফজরের আযানের সময়) থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত (অর্থাৎ মাগরিবের আযানের সময়) পর্যন্ত খাওয়া, পান করা ও যাবতীয় সাওম ভঙ্গের কারণসমূহ হতে বিরত থাকা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
}يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ{ [البقرة: 183].
“হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” [আল-বাকারাহ : ১৮৩]
- রমযান মাসের মহা ফযীলত রয়েছে। যেমন,
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتْ الشَّيَاطِينُ» [متفق عليه].
“যখন রমযান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানগুলোকে শিকলে বন্দী করা হয়।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«مَن صامَ رمضانَ إيمانًا واحتسابًا، غُفِرَ لَهُ ما تقدَّمَ من ذنبِهِ، ومَن قامَ ليلةَ القدرِ إيمانًا واحتِسابًا غُفِرَ لَهُ ما تقدَّمَ من ذنبِهِ» [متفق عليه].
“যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সাওয়াবের প্রত্যাশায় রমযানের সাওম পালন করে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সাওয়াবের আশায় কাদর রাতে কিয়াম করে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- সিয়ামের মর্যাদা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ، الْحَسَنَةُ عَشْرُ أمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ، قال اللهُ تعالى: إِلا الصَّوْمَ، فَإِنَّهُ لِي وَأنَا أجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أجْلِي، لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ، وَلَخُلُوفُ فِيهِ أطْيَبُ عِنْدَ الله مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ» [رواه البخاري].
“আদম সন্তানের প্রতিটি কর্ম বর্ধিত করা হয়। একেকটি নেকি দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে সাওম ছাড়া, কেননা সাওম আমার জন্যে এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো।’ সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে। সিয়াম পালনকারীর জন্যে দু’টি আনন্দ রয়েছে, একটি আনন্দ তার ইফতারির সময় আরেকটি আনন্দ তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময়। আর নিঃসন্দেহে সিয়ামপালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
- মুসলিম, প্রাপ্ত বয়স্ক, বুদ্ধিসম্পন্ন ও সক্ষম ব্যক্তির ওপর রমযানের সাওম ফরয। আর যে এমন অসুস্থ যে, সিয়াম তার ওপর কষ্টকর হয় বা সে তার সিয়ামের কারণে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে বা সে মুসাফির- তখন তাদের জন্যে সিয়াম ভঙ্গ করা বৈধ। যখন তাদের ওযর চলে যাবে তখন তারা কাযা করবে। আর যার রোগ স্থায়ী হয় তা হতে ভালো হওয়া আশা করা যায় না, সে সাওম ভঙ্গ করবে এবং প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি বার্ধক্যের কারণে সাওম পালন করতে পারছে না।[[40]]
- হায়েয ও প্রসূতি নারীর ওপর সাওম হারাম। পবিত্র হওয়ার পর তাদের ওপর সিয়াম কাযা করা ওয়াজিব।
- সায়েমের জন্য মুস্তাহাব: সেহরী খাওয়া এবং তা বিলম্বে খাওয়া। এমনিভাবে তার জন্য মুস্তাহাব হলো তাড়াতাড়ি ইফতার করা। তার ওপর ওয়াজিব হলো মৌখিক ও কর্মের মাধ্যমে সম্পন্ন সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকা। যদি তাকে কেউ গালি দেয় বা তার সাথে কেউ ঝগড়া করে সে যেন বলে আমি সাওম পালনকারী।
হে আল্লাহ আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করুন এবং আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা ঈমানের ও সাওয়াবের প্রত্যাশার সাথে সাওম পালন ও কিয়াম করে। আজকের জন্য এত টুকু আলোচনা যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা যে সব কারণে সাওম ভেঙ্গে যায় বা বাতিল হয়ে যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
পূর্বের দারসে আমরা রমযান মাস ও তার ফযীলত এবং তার কিছু বিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এ দারসে আমরা যে সব কারণে সাওম ভেঙ্গে যায় বা বাতিল হয় সে সম্পর্কে আলোচনা করব। সাওম ভঙ্গের কারণসমূহ হলো-
- সহবাস এবং হস্তমৈথুন।
- ইচ্ছাকৃত খাওয়া ও পান করা এবং যা কিছু খাওয়া ও পান করার অর্থে তা গ্রহণ করা, যেমন খাবার স্যালাইন নেওয়া ও রক্ত নেওয়া।
- সিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে রক্ত বের করা।
- ইচ্ছাকৃত বমি করা।
- নারীদের হায়েয ও নেফাসের রক্ত বের হওয়া।
- উপরে উল্লিখিত কারণগুলো তিনটি শর্ত না পাওয়া পর্যন্ত সাওম নষ্ট করবে না। এক- এগুলোর বিধান সম্পর্কে তার জ্ঞান থাকতে হবে। দুই- স্মরণ থাকতে হবে এবং তিন- ইচ্ছাকৃত হতে হবে।(কেবল হায়েয ও নিফাস ছাড়া)।
- যে সব বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করা হয়; অথচ তা সাওম ভঙ্গের কারণ নয়। সেগুলো হলো-
- রক্ত পরীক্ষা করা, দাঁত উঠানো, খাদ্যবিহীন ইনজেকশন, হাঁপানীর ইনহেলার, অক্সিজেন, মলদ্বারে সাপোজিটর ব্যবহার করা[[41]], নাকের ড্রপ; যদি তা গলায় না পৌঁছে এবং চোখ ও কানের ড্রপ।
- মিসওয়াক করা, দাতের মাজন ব্যবহার করা (গলাধঃকরণ যেন না হয় সে ব্যাপারে সতর্কতা সহকারে) এবং ধোঁয়া (তবে সে তা নাক দিয়ে টেনে নেবে না)।
- স্বপ্নদোষ হওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, নাকের শ্লেষ্মা গিলে ফেলা।
- নারীদের ইস্তেহাযাহ এবং তাদের স্বাভাবিক মাসিকের সময় ছাড়া অন্য সময় মাটি রং বা হলদে রংয়ের স্রাব বের হওয়া।
হে আল্লাহ আপনি আমাদের উপকারী ইলম শিক্ষা দান করুন, আর যা শিখিয়েছেন তা দ্বারা আমাদের উপকৃত করুন। আর আপনি আমাদের ইলমকে বাড়িয়ে দেন।এ টুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আগামী দারসে আমরা ইসলামের রুকসমূহ হতে পঞ্চম রুকন হজ সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা ইসলামের রুকসমূহ হতে পঞ্চম রুকন হজ সম্পর্কে আলোচনা করব।
- হজ ইসলামের নিদর্শনসমূহের অন্যতম। এতে দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক সব ধরনের ইবাদত একত্রিত হয়।
- এতে বান্দাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য উপকার। তন্মধ্যে আল্লাহর তাওহীদের ঘোষণা দেয়া, হাজীদের মাগফিরাত লাভ করা, মুসলিমদের মাঝে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব তৈরি করা ইত্যাদি ছাড়াও আরো অনেক হিকমত ও উপকার রয়েছে।
- হজের ফযীলত অপরিসীম এবং এর সাওয়াব অনেক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ حَجَّ لِله فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ» [متفق عليه]
“যে ব্যক্তি হজ পালন করল এবং (তাতে) কোনো অশ্লীল কাজ করল না ও পাপাচার করল না, সে ব্যক্তি ঠিক ঐ দিনকার মত (নিষ্পাপ হয়ে) বাড়ি ফিরবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] অর্থাৎ গুনাহ থেকে মুক্ত, যেন সে নবজাত শিশু।
- জীবনে একবার হজ করা [[42]] একজন স্বাধীন প্রাপ্ত বয়স্ক, জ্ঞানসম্পন্ন এবং দৈহিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম [[43]] মুসলিমের ওপর ফরয।
আল্লাহ বলেন,
}وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ{ [آل عمران: 97].
“এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।” [আলে ইমরান: ৮]
- যদি মৌলিক প্রয়োজন থেকে অতিরিক্ত মাল না থাকে এবং তাদের দায়িত্ব গ্রহণের কোনো লোক না থাকে তাহলে তার ওপর হজ ফরয হবে না। হজ করার জন্য ঋণ গ্রহণ করা ওয়াজিব নয়।
- যে ব্যক্তি অর্থ দিয়ে হজ করত সক্ষম; কিন্তু শারীরিকভাবে যাওয়ার সক্ষমতা নেই, যেমন, খুব বয়স্ক মানুষ বা স্থায়ীভাবে অসুস্থ মানুষ, তখন সে তার পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি বানাবে যে তার পক্ষ থেকে হজ করবে। আর সে তার হজের খরচ বহন করবে।
- হজের অনেক শর্ত, রুকন, ওয়াজিব ও নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে, যা ফিকহের কিতাব ও আহলে ইলমদের ফতওয়া থেকে জানা সম্ভবপর।
- হজের মতো উমরা জীবনে একবার করা ওয়াজিব। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«إِنَّهَا لَقَرِينَتُهَا فِي كِتَابِ الله (وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِله)». [رواه البخاري].
“এটি (উমরা) আল্লাহর কিতাবে হজের সঙ্গী। “তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও উমরা পালন করো।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
আল্লাহর অনুগ্রহে এ পর্যন্ত আমরা ঈমানের ও ইসলামের রুকনসমূহ জানা শেষ করেছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা মুসলিমদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় বিষয়ে আলোচনা করব। যেমন, ইসলামী আখলাক, লেনদেন, খাওয়া-দাওয়া ও পোশাকের বিধান।
এ দারসে আমরা একটি মহান হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করবো। কোনো কোনো আহলে ইলম বলেছেন এটি ইসলামের ভিত্তি। আর তা হলো,
আবু রুকাইয়া তামীম ইবন আওস আদ-দারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الدِّينُ النَّصِيحَةُ. قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ لِله، وَلِكِتَابِهِ، وَلِرَسُولِهِ، وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ». [رواه مسلم]
“দীন হলো নসীহত। আমরা বললাম কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য তার কিতাবের জন্য, তার রাসূলের জন্য এবং মুসলিম শাসক ও জনসাধারণের জন্য।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
হাদীসের শিক্ষণীয় বিষয়:
- দীন ইসলাম পুরোটাই নসীহতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর তা হলো সততা, ইখলাস, উপদেশকৃত ব্যক্তির কল্যাণ কামনা। নসীহত: এটি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য একটি ব্যাপক বাক্য। এটি উম্মতদের প্রতি নবীগণের পয়গাম। সব নবীই তার উম্মতকে নসীহত করেছেন।
- আল্লাহর জন্য নসীহত: এটি তার তাওহীদ এবং তাকে পরিপূর্ণ ও মহান গুণসমূহে গুণান্বিত করা এবং তার বিপরীত ও পরিপন্থী বিষয় থেকে তাঁকে পবিত্র জ্ঞান করা, তাঁর নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকা এবং তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁকে মহব্বত করা, তাঁর জন্য ভালোবাসা ও তাঁর জন্য ঘৃণা করা, যারা তাঁর সাথে কুফরী করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং এসবের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা এবং তার প্রতি উৎসাহ প্রদান করার মাধ্যমে হয়।
- তাঁর কিতাবের জন্য নসীহত: এটি কিতাবের উপর ঈমান আনা, তাকে মহান ও পবিত্র জানা এবং তার হক অনুযায়ী তার তিলাওয়াত করা, তার আয়াতসমূহে গভীর চিন্তা গবেষণা করা, তার দাবী অনুযাযী আমল করা, তার প্রতি দাওয়াত দেয়া এবং তার পক্ষে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করার মাধ্যমে হয়।
- তাঁর রাসূলের জন্য নসীহত: এটি রাসূলের উপর এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনা, তিনি যে বিষয়ে আদেশ করেছেন সেগুলোর আনুগত্য করা এবং যে সব বিষয়ে নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থাকা, তাঁকে সম্মান ও বড় জ্ঞান করা, তাঁর সুন্নাতকে জীবিত করা , তাঁর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া, তাঁর পরিবার ও সাহাবীদেরকে ভালোবাসা এবং তাঁর থেকে, তাঁর সুন্নাত থেকে, তাঁর পরিবার পরিজন, তাঁর সাহাবীদের এবং যারা তাদেরকে ইহসানের সাথে অনুসরণ করেন তাদের সকলের থেকে (সংন্দেহ, সংশয় ও বদনাম) প্রতিহত করার মাধ্যমে হয়।
- মুসলিমদের ইমামদের জন্য নসীহত: অর্থাৎ তাদের খলীফা ও নেতাদের জন্য। আর তা হয়ে থাকে তাদেরকে হক পথে সহযোগিতা করা, তাতে তাদের আনুগত্য করা, তাদেরকে নমনীয়তার সাথে নসিহত করা এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া, তাদের জন্য দোয়া করা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা দ্বারা।
- সাধারণ মুসলিমদের জন্য নসীহত: যেমন তুমি তোমার নিজের জন্য যা মুহব্বত করো তাদের জন্যও তাই মুহব্বত করবে, দীনি ও দুনিয়াবী কল্যাণের প্রতি তাদের পথ দেখাবে, তাদের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা, তাদের দুশমনদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে প্রতিরোধ করা এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ও ধোঁকা দেয়া থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা হলো তিনি যেন আমাদের সে সব লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা কথা শোনে এবং উত্তম কথার অনুসরণ করে। এ টুকু আলোচনায় যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা ইসলামের নিদর্শনসমূহ হতে মহান নিদর্শন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা সম্পর্কে আলোচনা করব।
- ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বাঁধা দেয়া মুমিনের বাহ্যিক গুণ। যেমন আল্লাহ বলেন,
}وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ الله وَرَسُولَهُ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ الله إِنَّ الله عَزِيزٌ حَكِيمٌ{ [التوبة: 71].
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; তারাই, যাদেরকে আল্লাহ্ অচিরেই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [আত-তাওবাহ : ৭১]
- যখন ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বাঁধা ব্যাপক হবে, তখন সুন্নাত বিদ‘আত হতে আলাদা হয়ে যাবে; হালালের বিপরীতে হারাম চেনা যাবে, মানুষ ওয়াজিব, সুন্নাত, মুবাহ ও মাকরুহ বুঝতে পারবে আর সৎ কাজের ওপর একটি প্রজন্মের আভির্ভাব ঘটবে, তারা সৎ কাজকে মহব্বত করবে আর বিদআত থেকে দূরে থাকবে ও তা ঘৃণা করবে।
- নিয়ম অনুসারে ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বাঁধা দেয়া আল্লাহর আযাব থেকে ব্যক্তি ও সমাজের নিরাপত্তার জিম্মাদার।
যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
}وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَىٰ بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُونَ{ [هود: 117]
“আর আপনারা রব এরূপ নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে জনপদ ধ্বংস করবেন অথচ তাঁর অধিবাসীরা সংশোধনকারী।” [হুদ : ১১৭]
- যে সমাজে মন্দ কর্ম প্রকাশ পায় আর তাতে বাঁধা দেয়ার কোনো লোক থাকে না, সে সমাজ ব্যাপক আযাবের সম্মূখীন।
- সহীহ বুখারী ও মুসলিমে যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে ধ্বংস করা হবে যখন আমাদের মধ্যে নেককার লোক থাকবে? তিনি বললেন,
«نَعَمْ إذَا كَثُرَ الخَبَثُ».
“হ্যাঁ যখন অপরাধ বেশি হবে।”
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
}فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ{ [الأعراف: 165].
“অতঃপর যে উপদেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল, তারা যখন তা ভুলে গেল, তখন যারা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করত তাদেরকে আমরা উদ্ধার করি। আর যারা যুলুম করেছিল তাদেরকে আমারা কঠোর শাস্তি দেই,কারণ তারা ফাসেকী করত।” [আরাফ : ১৬৫]
- কতক মানুষের নিকট এটি ব্যাপকতা লাভ করছে যে, এটি অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ। এটি কম বুঝ ও ঈমানের ত্রুটির আলামত।
আবূ বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে মানুষেরা, তোমরা এ আয়াতটি তিলাওয়াত করো-
}يَا أيُها الَّذِينَ أمنُوا عَلَيكُم أَنَفُسَكُم لاَ يَضُرُكُم مَّن ضَلّ إذَا اهتَدَيتُم{
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের নিজেরদেরকে রক্ষা করো। যদি তোমরা হিদায়াতের ওপর থাকো তবে যে গোমরাহ হলো সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।” আর আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوْا الظَّالِمَ فَلَمْ يَأْخُذُوا عَلَى يَدَيْهِ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ الله بِعِقَابٍ مِنْهُ» [رواه أبو داود وغيره].
“যখন লোকেরা অত্যাচারীকে (অত্যাচার করতে) দেখবে এবং তার হাত না ধরবে (বাঁধা দিবে না), তখন খুব শীঘ্র আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলকে ব্যাপকভাবে তার শাস্তির কবলে নিয়ে নেবেন।” [এটি আবূ দাঊদ ও অন্যরা বর্ণনা করেছেন]
আর আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ» [رواه مسلم].
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো গর্হিত কাজ দেখবে, সে যেন তা নিজ হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়। যদি (তাতে) ক্ষমতা না রাখে, তাহলে নিজ যবান দ্বারা (উপদেশ দিয়ে পরিবর্তন করে)। যদি (তাতেও) সামর্থ্য না রাখে, তাহলে অন্তরের দ্বারা পরিবর্তন করবে (ঘৃণা করে)। [[44]] আর এ হল সবচেয়ে দুর্বল ঈমান।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা হলো তিনি যেন আমাদেরকে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধকারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা ইসলামের সুন্দর চরিত্র বিষয়ে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা ইসলামের সুন্দর চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করব:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র দ্বারা চরিত্রবান হতে এবং প্রশংসনীয় আদব দ্বারা গুণান্বিত হতে উৎসাহ প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا» [رواه الترمذي وصححه الألباني].
“কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্য যে ব্যক্তি আমার কাছে সবার প্রিয় এবং আমার খুব কাছে বসবে সে হলো তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র সবার চেয়ে ভালো।” [বর্ণনায় তিরমিযী। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
যে সব সুন্দর চরিত্রসমূহের প্রতি ইসলাম আহ্বান করেছে:
- মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, স্ত্রী সন্তান ছেলে মেয়েদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে সু সম্পর্ক বঝায় রাখা। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
}وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا{ [الإسراء: 23]
“এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে।” [আল-ইসরা : ২৩]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي» [رواه ابن ماجه وصححه الألباني].
“তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে যে তোমাদের পরিবারের কাছে উত্তম। তোমাদের মাঝে আমি আমার পরিবারের কাছে সবচেয়ে উত্তম।” [এটি ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ» [متفق عليه].
“যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার ওপর রিযিক প্রশস্ত করা হোক এবং তার বয়সে বরকত হোক তাহলে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বঝায় রাখে।”[[45]] মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।
- আরও যে সব আখলাকের প্রতি ইসলাম উৎসাহ প্রদান করেছে: সুন্দর কথা বলা, ভালো বাক্যব্যয় করা, সত্য বলা, হাসি মুখ থাকা, মুচকি হাসি দেওয়া এবং মুমিনদের জন্য বিনয় অবলম্বন করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
}وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا{ [البقرة: 83]
“আর তোমরা মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলো।” [আল বাকারাহ: ৮৩]
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
}يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا الله وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ{ [التوبة: 119]
“হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” [তাওবাহ: ১১৯]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ» [متفق عليه]
“ভালো বাক্যব্যয় (উত্তম কথা) সাদাকা।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ» [رواه الترمذي وصححه الألباني]
“তোমার ভাইয়ের সামনে মুচকি হাসি দেওয়া তোমার জন্য সাদকা।” [বর্ণনায় তিরমিযী আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِله إِلَّا رَفَعَهُ الله» [رواه مسلم].
“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করবে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- যবানের হিফাযতের প্রতি উৎসাহ ও নিদের্শ এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}مَا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ{ [ق: 18]
“সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে।” [কাফ : ১৮]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِالله وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ» [متفق عليه]
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে সে যেন ভালো কথা বলে বা চুপ থাকে।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)] যবানের হিফাযত খারাপ বাক্য উচ্চারণ না করা, অভিশাপ ও গাল-মন্দ পরিহার করা এবং গীবত থেকে বেচে থাকা দ্বারা হয়। গীবত হলো কোনো মুসলিমের তার ভাইয়ের অনুপুস্থিতিতে এমন কথা বলা যা সে অপছ্ন্দ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا{ [الحجرات: 12]
“তোমরা কেউ কারো গীবত করবে না।” [আল-হুজরাত : ১২]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ليسَ المؤمِنُ بالطَّعَانِ، ولَا اللَّعَانِ، ولَا الفَاحِشِ، ولَا البَذِيءِ» [رواه الترمذي وصححه الألباني]
“মুমীন খোঁটা দানকারী, অভিশাপ-কারী, নির্লজ্জ ও অশ্লীল-ভাষী হয় না।” [বর্ণনায় তিরমিযী আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহংকার করা থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন,
«لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ» [رواه مسلم].
যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- ইসলাম খাদেমদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে এবং তাদেরকে তাদের সক্ষমতার বাহিরে কোনো কাজের দায়িত্ব না দিতে এবং তাদের কাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হক আদায় করতে উৎসাহ প্রদান করেছে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ -أي: خدمُكم- جَعَلَهُمُ الله تحْتَ أيْدِيكُمْ. فَمَنْ كَانَ أخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مما يأكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِما يَلْبَسُ. ولا تُكَلِّفُوهُمْ ما يَغْلِبُهُمْ فإنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فأعِينُوهُمْ» [متفق عليه]
“তোমাদের গোলামেরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন, কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে তবে সে যা খায়, তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে, তা হতে যেন পরিধান করায় এবং তাদের সাধ্যাতীত কোনো কাজে বাধ্য না করে। তোমরা যদি তাদের শক্তির ঊর্ধ্বে কোনো কাজ তাদের দাও তবে তাদের সহযোগিতা কর।” মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ» [رواه ابن ماجه وصححه الألباني].
“শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর আগে বিনিময় দিয়ে দাও ।”[[46]] [এটি ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
- সকল আখলাকের নীতিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত বাণী একত্র করেছে:
«لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ» [متفق عليه].
“তোমাদের কেউ নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা তার ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি]
হে আল্লাহ তুমি আমাদের সুন্দর চরিত্রের প্রতি পথ দেখাও। তুমি ছাড়া কেউ সুন্দর চরিত্রের প্রতি পথ দেখাবে না। আর আমাদের থেকে খারাপ স্বভাবগুলো দূর করো, তুমি ছাড়া কেউ আমাদের থেকে খারাপ স্বভাবগুলো দূর করতে পারে না। এতটুক আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা আলোচনা সম্পন্ন করব।
পূর্বের দারসে আমরা কতিপয় সুন্দর চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছি, যার প্রতি ইসলাম আমাদের উৎসাহ প্রদান করেছে। আমরা সে বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবো:
- যে সব সুন্দর চরিত্রের প্রতি ইসলাম আমাদের উৎসাহ প্রদান করেছেন তা হলো মানুষের মাঝে সমঝোতা করা। যেমন, আল্লাহ বলেন,
}وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ{ [الأنفال: 1]
“তোমরা তোমাদের মাঝে সমঝোতা (সংশোধন) কর।” [আল-আনফাল : ১]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামীমাহ তথা চোগলখোরি করা থেকে সতর্ক করেছেন। আর তা হলো মানুষের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এক জনের কথা আরেক জনের কাছে বলে বেড়ানো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ» [متفق عليه].
“চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- যে সব সুন্দর আখলাকের প্রতি ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে তন্মধ্যে কয়েকটি হলো, দয়া করা, সম্পদ ব্যয় করা, কৃপনতা ও অপচয়ের মাঝামাঝি অবস্থান করা। যেমন আল্লাহ বলেন,
}وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا{ [الفرقان: 67].
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কৃপনতাও করে না, আর তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।” [আল-ফুরকান :৬৭]
- ইসলাম যে সব আখলাকের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন তন্মধ্যে আরেকটি হলো, দীনি ভাইয়ের হকের প্রতি যত্নবান হওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«حَقُّ المسلِمِ عَلى المسلِمِ سِتٌّ. قِيلَ: مَا هُنَّ يا رَسَولَ اللهِ؟، قال: إذا لقِيتَه فسلِّمْ عليه. وإذا دَعَاكَ فأَجِبْه. وإذَا استنصَحَكَ فانصَحْ لَه. وإذا عَطِسَ فَحمِدَ اللهَ فشَمِّتْهُ وإذا مرِضَ فعُدْهُ. وإذا مات فاتَّبِعْهُ» [رواه مسلم].
“মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের অধিকার ছয়টি: বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সেগুলো কী? তিনি বললেন, তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তাকে সালাম দাও, সে তোমাকে দাওয়াত দিলে তার দাওয়াত গ্রহণ কর, সে তোমার কাছে উপদেশ চাইলে তুমি তাকে উপদেশ দাও, সে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে তার জবাব দাও, সে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাও এবং সে মারা গেলে তার জানাযায় অংশ গ্রহণ কর।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- অনুরূপভাবে ইসলাম প্রতিবেশী ও মেহমানকে সম্মান করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«من كانَ يؤمِنُ بالله واليومِ الآخِرِ فلا يؤذِ جارَه، ومن كانَ يؤمِنُ بالله واليومِ الآخرِ فليُكرِمْ ضيفَه، ومن كانَ يؤمنُ بالله واليومِ الآخرِ فليقُلْ خيرًا أو ليصمُتْ» [رواه مسلم].
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান (খাতির যত্ন) করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে, নচেৎ চুপ থাকে।” [বর্ণনায় মুসলিম]।
- ইসলাম সাদা চুল বিশিষ্ট মুসলিম, আলেম, কুরআনের ধারক ও ন্যায় পরায়ণ বাদশার সম্মান করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ الله إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ وَحَامِلِ الْقُرْآنِ غَيْرِ الْغَالِي فِيهِ وَالْجَافِي عَنْهُ وَإِكْرَامَ ذِي السُّلْطَانِ الْمُقْسِطِ» [رواه أبوداود]
“আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করার এক প্রকার হচ্ছে: পাকা চুলওয়ালা বয়স্ক মুসলিম, সীমালঙ্ঘন ও অতিরঞ্জন পরিহারকারী কুরআনের ধারক এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সম্মান করা।” [এটি বর্ণনা করেছেন আবূ দাঊদ]
- ইসলাম আমাদেরকে বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ليسَ منَّا من لَم يَرحَمْ صغيرَنا، و يعرِفْ حَقَّ كَبيرِنا» [رواه أبو داود والترمذي وأحمد وصححه الألباني].
“যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান জানে না সে আমার দলভুক্ত নয়।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ আর আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন]
- ইসলাম মুসলিমদের মুসিবাত দূর করা, তাদের ওপর সহজ করা এবং তাদের দোষগুলো ঢেকে রাখার প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ الله عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ الله عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ الله فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَالله فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ» [رواه مسلم].
“যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের পার্থিব দুর্ভোগসমূহ থেকে একটি দূর্ভোগ দূরীভূত করবে, আল্লাহ তার থেকে কিয়ামতের দিনের দুর্ভোগসমূহ থেকে একটি দুর্ভোগ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অসচ্চল ব্যক্তির ওপর সহজ করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার ওপর সহজ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য থাকে।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন।
এতটুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা মুসলিমদের মাঝে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা মুসলিমদের মাঝে আর্থিক লেনদেনের কিছু বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব। মহান আল্লাহ আমাদের যমীনে ভ্রমন করা ও হালাল সম্পদ উপার্জন করার আদেশ দিয়েছেন। কাজেই একজন মুসলিমের ওপর অত্যাবশ্যকীয় হলো আর্থিক লেনদেন বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা। যাতে সে জ্ঞান ও সুস্পষ্ট দলীলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এবং যাতে প্রজ্ঞাবান শরী‘আত প্রণেতা যে সব থেকে নিষেধ করেছে তাতে লিপ্ত না হয়।
- আর্থিক লেনদেনের আসল হলো হালাল হওয়া। তবে যেটি হারাম হওয়ার ওপর দলীল রয়েছে সেটি বাদে।
- যে সব লেনদেন ইসলাম হারাম করেছে: সূদ, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা, বেচা কেনায় ধোঁকা দেয়া, যে সব লেনদেনে জুলুম রয়েছে এবং মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا الله وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ{ [البقرة: 278].
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও।” [আল-বাকারাহ : ২৭৮]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَا تَحَاسَدُوا، وَلَا تَنَاجَشُوا، وَلَا تَبَاغَضُوا، وَلَا تَدَابَرُوا، وَلَا يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ، وَكُونُوا عِبَادَ الله إِخْوَانًا، الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَظْلِمُهُ، وَلَا يَخْذُلُهُ، وَلَا يَكْذِبُهُ، وَلَا يَحْقِرُهُ، التَّقْوَى هَاهُنَا - وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ - بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ المسْلِمَ، كُلُّ المسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ: دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ» [رواه مسلم].
“তোমরা এক অপরের প্রতি হিংসা করো না, কেনাবেচাতে জিনিসের মূল্য বাড়িয়ে এক অপরকে ধোঁকা দিয়ো না [[47]], একে অপরের প্রতি শত্রুতা রেখো না, একে অপর থেকে (ঘৃণাভরে) মুখ ফিরায়ো না এবং একে অপরের কেনাবেচার উপর কেনাবেচা করো না। আর হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ভাই-ভাই হয়ে যাও। মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি যুলুম করবে না, তাকে লাঞ্ছিত করবে না, তাকে মিথ্যারোপ করবে না এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না। আর তাকওয়া হচ্ছে এখানে। তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা তিনবার বললেন। কোনো মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ ভাবা একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রত্যেক মুসলিমের রক্ত, মাল এবং তার মর্যাদা অপর মুসলিমের ওপর হারাম।” [বর্ণনায় মুসলিম]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«نَهَى رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم عَنْ بَيْعِ الْحَصَاةِ وَعَنْ بَيْعِ الْغَرَرِ» [رواه مسلم].
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথরের টুকরা নিক্ষেপের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় ও ধোঁকাপূর্ণ ক্রয়-বিক্রয় থেকে নিষেধ করেছেন।”[[48]] [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- একজন মুসলিমের সাধারণত এবং বিশেষভাবে ব্যবসার ক্ষেত্রে যে গুণটি তার থাকা দরকার তা হলো সততা ও পবিত্রতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا» [رواه مسلم]
“যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَذَبَا وَكَتَمَا مُحِقَ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا» [متفق عليه].
“ক্রেতা ও বিক্রেতার একজন আরেকজন থেকে পৃথক হওয়া পর্যন্ত খিয়ার থাকবে। উভয়ে যদি সত্য কথা বলে এবং দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে দেয় তবে তাদের কেনা-বেচায় বরকত হবে। আর যদি তারা কেনা-বেচার মধ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে তবে তাতে বরকত থাকবে না।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
হে আল্রাহ আমরা আপনার কাছে উপকারী ইলম, পবিত্র রিযিক এবং নেক আমল চাই। এত টুকু আলোচনাতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তী দারসে আমরা ইসলামের খাবারের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা এমন সব বিধান আলোচনা করব যা মুসলিমের খাদ্যের সাথে সম্পৃক্ত। খাবারের মধ্যে আসল হলো হালাল হওয়া। তবে যার হারাম হওয়ার ওপর কোনো প্রমাণ থাকে সেটি বাদে।
- যে সব খাবার ইসলাম হারাম করেছে: মৃত জন্তু: আর তা হলো এমন জন্তু যেটি শরয়ী নিয়ম অনুযায়ী যবেহ করা হয়নি। এ থেকে বাদ পড়বে মাছ এবং যা পানিতে ছাড়া কোথাও বাস করে না। এগুলোকে জবেহ করার শর্ত নেই। অনুরীপভাবে ফড়িং। কারণ, দুটিকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
- হারামের মধ্যে আরও রয়েছে, শুকর, প্রবাহিত রক্ত এবং যে গুলো গাইরুল্লাহর নামে যবেহ করা হয়েছে। যেমন, যে গুলো মুর্তির নামে বা ওলীদের নামে বা জিনের নামে যবেহ করা হয় তাদের সম্মানে বা তাদের ভয়ে। আল্লাহ বলেন,
}حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ الله بِهِ{ [المائدة: 3].
“তোমাদের ওপর মৃত, রক্ত ও শুকরের গোস্ত হারাম করা হয়েছে এবং যা গাইরুল্লাহর নামে যবে করা হয় তা হারাম করা হয়েছে।” [আল-মায়েদা : ৩]
- আরও যে সব জন্তু খাওয়া হারাম: এমন প্রাণী যার নখ আছে যা দ্বারা সে শিকার করে। যেমন, বাঘ, শিংহ, চিতা, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি।
- আরও যে সব প্রাণী খাওয়া হারাম: এমন পাখি যার নখ আছে যার দ্বারা সে শিকার করে যেমন, বাজপাখী, ঈগল, চিল ইত্যাদি।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ كُلِّ ذِي نَابٍ مِنَ السِّبَاعِ، وَعَنْ كُلِّ ذِي مِخْلَبٍ مِنَ الطَّيْر» [رواه مسلم].
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নখ বিশিষ্ট জন্তু খেতে নিষেধ করেছেন এবং নখ বিশিষ্ট পাখি খেতে নিষেধ করেছেন।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- হারাম খাদ্যের মধ্যে আরও রয়েছে তা হলো বিভিন ধরন ও নামের নেশাজাত বস্তু। যেমন, গাজা যা মাতাল করে, মদ যে নামেই হোক না কেন, ড্রাগ ইত্যাদি যা নেশা তৈরি করে এবং মাতাল করে।“ কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ما أَسْكَرَ كثيرُه؛ فقليلُه حرامٌ» [رواه النسائي وابن ماجه وأحمد وصححه الألباني].
“যা মাতাল করে তার কম ও বেশি হারাম।” [বর্ণনায় নাসাঈ, ইবন মাযাহ, আহমাদ। এটিকে আলবানী সহীহ বলেছেন]
- অপবিত্র জিনিষ খাওয়া হারাম এবং যে সব খাদ্য, পানীয়, ঔষধ মানুষের ক্ষতি করে তা হারাম। যেমন, সিগারেট, এলকহেল, শিশা ইত্যাদি। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}ولاَ تَقْتُلُواْ أَنفُسَكُمْ إِنَّ الله كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا{ [النساء: 29]
“তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি দয়ালু।” [আন-নিসা : ২৯]
আল্লাহ তা‘আলার আরও বাণী,
}وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ{ [الأعراف:157]
“আর তাদের ওপর অপবিত্র বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করেন।” [আল-আরাফ : ১৫৭]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَار» [رواه ابن ماجه وصححه الألباني].
“নিজের ও অন্যের ক্ষতি করা যাবে না।” [এটি ইবন মাজাাহ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]
- শরী‘আত যে সব জন্তু সুনির্দিষ্টভাবে হারাম করেছে তা হলো: খচ্চর, গৃহ পালিত গাধা, অর্থাৎ যে গাধা বোঝা বহন করা ও বাহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«ذَبَحْنَا يَوْمَ خَيْبَرَ الْخَيْلَ، وَالْبِغَالَ، وَالْحَمِيرَ، فَنَهَانَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْبِغَالِ، وَالْحَمِيرِ، وَلَمْ يَنْهَنَا عَنِ الْخَيْلِ» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
“খাইবারের দিন আমরা ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা যবেহ করলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খচ্চর ও গাধা যবেহ করতে নিষেধ করেছেন। তবে ঘোড়া যবেহ করতে নিষেধ করেননি।” [এটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন।]
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা খাবারের আদব সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ দারসে আমরা খাবারের আদব সম্পর্কে আলোচনা করব। আর তা হলো,
- খাবারের আগে বিছমিল্লাহ বলা, ডান হাতে খাওয়া, নিজের সামনের দিক থেকে খাওয়া। উমার ইবন আবী সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বাল্যকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। আর আমার হাত খাবার পাত্রে ছুটাছুটি করছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন,
«يَا غُلَامُ: سَمِّ الله ، وَكُلْ بِيَمِينِك، وَكُلُّ مِمَّا يَلِيك» [متفق عليه]
“ওহে কিশোর! ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ডান হাতে খাও এবং তোমার সামনে থেকে খাও।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ طَعَامًا فَلْيَقُلْ بِسْمِ الله فَإِنْ نَسِيَ فِي أَوَّلِهِ فَلْيَقُلْ بِسْمِ الله فِي أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ» [رواه الترمذي وصححه الألباني]
“যখন তোমাদের কেউ খাবার খায় তখন সে যেন বিছমিল্লাহ বলে, যদি শুরুতে বিছমিল্লাহ বলতে ভুলে যায় তখন সে বলবে بِسْمِ الله فِي أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ (বিছমিল্রাহি শুরুতে এবং শেষে)।” [বর্ণনায় তিরমিযী। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لا يَأْكُلَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ بِشِمَالِهِ، وَلَا يَشْرَبَنَّ بِهَا، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ وَيَشْرَبُ بِهَا» [رواه مسلم].
“তোমাদের কেউ যেন বাম হাত দ্বারা না খায় এবং পান না করে। কারণ, শয়তান বাম হাতে খায় এবং বাম হাত দিয়ে পান করে।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- খাওয়ার আদাব হলো, খাদ্যের দুর্নাম না করা। কারণ, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَا عَابَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم طَعَامًا قَطُّ، إنْ اشْتَهَاهُ أَكَلَهُ، وَإِنْ كَرِهَهُ تَرَكَهُ» [متفق عليه]
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কোনো খাবারের দোষ-ত্রুটি বলেন নি। ভালো লাগলে তিনি খেতেন আর খারাপ লাগলে বর্জন করতেন।” [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)]
- খাওয়ারে দোষ ধরার অন্তর্ভুক্ত হলো এ কথা বলা, খাবারটি টক, নোনতা, লবনের পরিমাণ কম, পাক হয়নি ইত্যাদি।
- খাবারের আরেকটি আদব: পড়ে যাওয়া লোকমা থেকে ময়ল পরিস্কার করে তারপর তা খাওয়া। কারণ, আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِطْ عَنْهَا الْأَذَى وَلْيَأْكُلْهَا وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَان» [رواه مسلم].
“যখন তোমাদের কারো লোকমা পড়ে যায়, সে যেন তা থেকে ময়লা দূর করে এবং তা খেয়ে ফেলে। আর তা যেন শয়তানের জন্য রেখে না দেয়।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
- খাবারের আরেকটি আদব হলো, খাওয়ার মাঝে হেলান না দেয়া। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لا آكُلُ وأنا مُتَّكِئ» [رواه البخاري].
“আমি হেলান দেয়া অবস্থায় খাই না।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
- বসে পান করা মুস্তাহাব এবং তিনবার করে পান করা মুস্তাহাব। কারণ, আনাস রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يَتَنَفَّسُ فِي الشَّرَابِ ثَلَاثًا، وَيَقُولُ: إِنَّهُ أَرْوَى، وَأَبْرَأُ، وَأَمْرَأُ» [رواه مسلم].
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করার সময় তিনবার শ্বাস নিতেন। আর বলতেন, এটি বেশি তিপ্তি দায়ক, অধিক নিরাপদ এবং সুন্দর গলাধঃকরণ।”[[49]] [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]।
- পাত্রের ভিতরে শ্বাস ফেলবে না। কারণ, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا شَرِبَ أَحَدُكُمْ فَلَا يَتَنَفَّسْ فِي الْإِنَاءِ، فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَعُودَ فَلْيُنَحِّ الْإِنَاءَ، ثُمَّ لِيَعُدْ إِنْ كَانَ يُرِيد» [رواه ابن ماجه].
“যখন তোমাদের কেউ পান করে সে যেন পানির পাত্রে নিঃশ্বাস না ফেলে, যদি সে ফিরে আসতে চায় তাহলে সে যেন পাত্রকে দূরে সরায়, তারপর আবার ফিরিয়ে আনবে যদি সে চায়।” [ইবন মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন]।
- আল্লাহ তাআলা অপচয় করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন,
}وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ{ [الأعراف: 31].
“তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।” [আল-আরাফ: ৩১]
- খাবার শেষ হলে সুন্নাত হলো, হাদীসে বর্ণিত আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান বিশিষ্ট দোয়া পাঠ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দস্তরখান উঠানোর পর বলতেন,
«الْحَمْدُ لِله كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ غَيْرَ مَكْفِيٍّ وَلا مُوَدَّعٍ وَلا مُسْتَغْنًى عَنْهُ رَبَّنَا» [رواه البخاري].
“আল্লাহর জন্য অসংখ্য অগণিত পবিত্র ও বরকতময় প্রশংসা। কেউ তার বিনিময়দাতা নেই এবং তা পরিত্যক্ত নয় [[50]] আর কেউ তার থেকে অমুখাপেক্ষী নয় হে আমাদের রব।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় পরবতী দারসে আমরা মুসলিম নর ও নারীদের পোশাকের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
এ পাঠে আমরা মুসলিম নর ও নারীর পোশাকের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করব।
- আমাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামাতসমূহের একটি নিয়ামত হলো তিনি আমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছেন যাতে আমরা আমাদের সতর ঢাকতে পারি, তার দ্বারা সৌন্দর্য গ্রহণ করতে পারি এবং সেটি ব্যবহার করে গরম ও ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পারি। যেমন আল্লাহ বলেন,
}يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ{ [الأعراف: 26]
“হে বনী আদম, আমি তো তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকবে এবং যা সৌন্দর্যস্বরূপ। আর তাকওয়ার পোশাক, সেটিই উত্তম।” [আরাফ : ২৬]
আল্লাহ তাআলা বলেন,
}وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ{ [النحل: 81]
“আর ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদেরকে গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে তোমাদের যুদ্ধে।” [আন-নাহাল : ৮১] সারাবীল হলো: পোশাক ও কাপড়।
- মুসলিমদের পোশাক ও তার সৌন্দর্য অবলম্বনের মূলনীতি হলো মুবাহ তথা জায়েয হওয়া। তবে যার হারাম হওয়ার ওপর দলীল পাওয়া যায় সেটি বাদে।
পোশাকের নীতিমালা হলো:
• পোশাকে নারীদের সাথে পুরুষের সাদৃশ্য না হওয়া বা তার উল্টো না হওয়া। কারণ, বুখারী ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
«لَعَنَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنْ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنْ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষদেরকে এবং পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী মহিলাদেরকে অভিশাপ করেছেন।”
• পোশাকের আরেকটি মূলনীতি হলো, এ ক্ষেত্রে যেন কাফের, বিদআতী বা ফাসেকদের সাথে সাদৃস্য না হয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
“যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করল সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
• পোশাকের আরেকটি মূলনীতি হলো, প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য পোশাক না পড়া। আর তা হলো সামাজের কালচার ও তার অনুসারীরা যা ভালো চোখে দেখে না। এ ধরনের পোশাকের আকৃতি সমাজের কালচারের পরিপন্থী এবং তার রং সম্পর্কে তারা পরিচিত নয় এবং ভালো মনে করে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِي الدُّنْيَا أَلْبَسَهُ الله ثَوْبَ مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» [رواه أحمد وأبو داود وابن ماجه والنسائي].
“যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধির কাপড় পরিধান করবে আল্লাহ তাকে কিয়ামাতের দিন বে-ইজ্জতির কাপড় পরিধান করাবে।” [এটি আহমাদ, আবু দাউদ, ইবন মাজাহ ও নাসায়ী বর্ণনা করেছেন]।
• পোশাকের আরেকটি নিয়ম হলো, পোশাকটি হারাম হতে পারবে না। যেমন, পুরুষের জন্য রেশমি কাপড় ও স্বর্ণ ব্যবহার করা। কারণ, ‘আলী ইবন আবূ তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেশম নিলেন এবং এটিকে তিনি তার ডান হাতে নিলেন আর এক টুকরা স্বর্ণ নিয়ে তা তার বাম হাতে রাখলেন, তারপর তিনি বললেন,
«إنَّ هَذينِ حرامٌ على ذُكورِ أمَّتي» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
“এ দুটি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
• পোশাকের নিয়ম হলো তা সতর ঢেকে রাখার যোগ্য হতে হবে। আর পুরুষের সতর হলো নাভী ও হাঁটুর মাঝখান। অপরিচিত লোকদের সামনে নারীদের পুরো শরীরই সতর। আর নারীদের মাঝে এবং মাহরামদের মাঝে সে তার শরীর ঢেকে রাখবে তবে যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায়। যেমন, গর্দান, চুল, দুই পা ইত্যাদি।
• নারীর পর্দার ক্ষেত্রে পুরো শরীর ঢেকে রাখা শর্ত। এমন পোশাক হওয়া উচিত নয় যা তার শরীরের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেয় এবং এত সংকীর্ণ হওয়া উচিত নয় যা তার অঙ্গের পরিমাপ করে আর এটি তার নিজের মধ্যে শোভাকর হওয়া উচিত নয় এবং আতর ও সুগন্ধি ধোঁয়া যুক্ত হওয়া উচিত নয়।
হে আল্লাহ আপনি আমাদের তাকওয়ার পোশাক ও নিরাপত্তার পোশাক পরিধান করান। আর আপনি আমাদের আপনার সুন্দর পর্দা দ্বারা ঢেকে রাখুন। এতটুকুতে যথেষ্ট করছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা পরবর্তী দারসে আলোচনা সম্পন্ন করবো।
পূর্বের দারসে আমরা মুসলিম নারী ও পুরুষের পোশাকের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এখন আমরা বাকী অংশ সম্পন্ন করব।
- শরীআতের সীমা লঙ্ঘন, অপচয় ও অহংকার না করে সৌন্দর্য অবলম্বন করা মুস্তাহাব। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ الله جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ» [رواه مسلم]
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন] এ থেকে বাদ যাবে সে নারী যখন যে গাইরে মাহরাম (ভিন পুরুষ) লোকদের সামনে থাকবে, তখন সে তার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করবে না; বরং পুরো শরীর সে ঢেকে রাখবে।
- পোশাক পরিধান করার সময় ডান দিক থেকে পরিধান করা মুস্তাহাব। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا لَبِسْتُمْ وَإِذَا تَوَضَّأْتُمْ ، فَابْدَءُوا بِأَيَامِنِكُمْ» [رواه أبوداود وصححه الألباني].
“যখন তোমরা কাপড় পরিধান করবে ও ওযূ করবে তখন তোমরা তোমাদের ডান দিক থেকে আরম্ভ করবে।” [বর্ণনায় আবূ দাউদ। আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
- যত ধরনের কাপড় পরিধান করুক না কেন পুরুষের জন্য টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে দেয়া হারাম। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا أَسْفَلَ مِنْ الْكَعْبَيْنِ مِنْ الْإِزَارِ فَفِي النَّارِ» [رواه البخاري].
“লুঙ্গির (কাপড়ের) যে অংশ টাখনুর নিচে হবে তা জাহান্নামে যাবে।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
- যে কাপড়ে কুরআনের কোনো আয়াত বা আল্লাহর নাম লেখা আছে তা পরিধান করা হারাম। কারণ, এটি কুরআন ও আল্লাহর প্রতি অবমাননার দিকে ধাবিত করবে।
- যে সব কাপড়ে প্রাণির ছবি আছে সে সব কাপড় পরিধান করা হারাম; তবে যদি প্রাণির মাথা কাটা থাকে। কারণ, আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
«اسْتَأْذَنَ جَبْرَائِيلُ عليه السلام عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: اُدْخُلْ، فَقَالَ: كَيْفَ أَدْخُلُ، وَفِي بَيْتِك سِتْرٌ فِيهِ تَصَاوِيرُ؟ إمَّا أَنْ تَقْطَعَ رُؤُوسَهَا أَوْ يُجْعَلَ بِسَاطًا يُوطَأُ، فَإِنَّا مَعْشَرَ الْمَلَائِكَةِ لَا نَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ تَصَاوِيرُ» [أخرجه النسائي وصححه الألباني].
“জিবরীল আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে রাসূল ল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, প্রবেশ কর। তখন তিনি বললেন, কীভাবে প্রবেশ করর? আপনার ঘরে একটি পর্দা যাতে রয়েছে প্রাণীর ছবি। হয় আপনি তাদের মাথ কেটে ফেলেন আর না হয় তা বিছানা বানান যা পায়ে মাড়ানো হয়। কারণ, ফিরিশতাকুল এমন ঘরে প্রবেশ করে না যেখানে ছবি থাকে।” [এটি নাসাঈ বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন]।
- যে সব কাপড়ে অমুসলিমদের ধর্মীয় নিদর্শন যুক্ত রয়েছে সে ধরনের পোশাক পরিধান করা হারাম। যেমন, ক্রুশ ও ইয়াহুদীদের তারকা ইত্যাদি।
ইমরান ইবন হিত্তান বর্ণনা করেন,
(أنَّ عائِشةَ رَضِيَ اللهُ عنها حَدَّثَته: أَنَّ النَّبِيَ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَكُنْ يَتْرُكُ فِي بَيْتِهِ شَيْئًا فِيهِ تَصَالِيبُ إِلَّا نَقَضَهُ) [رواه البخاري].
‘আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা তাকে বলেছেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে ক্রুশ বিশিষ্ট জিনিস না ভেঙে ছাড়তেন না।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
সব প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে আমাদের আকীদা, ইবাদত, মুআমালাহ ও আখলাক সম্পর্কে শরীআতের বিধানসমূহ ও মাসায়েলগুলো শিখিয়েছেন।
আমাদের ওপর ওয়াজিব হলো আমরা যেন এই ইলমের অনুসরণ করি এবং সে অনুযায়ী আমল করি। যাতে তা উপকারী ইলম হয়, যার সুন্দর ফল আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে পাই। কারণ, যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করবে না, তা তার বিরুদ্ধে দলীল হবে। আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। আর তা হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত দুআর অর্ন্তভুক্ত:
« اللَّهُمَّ إنِّي أَعُوذُ بكَ مِن عِلْمٍ لا يَنْفَع» [رواه مسلم].
“হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে এমন ইলম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা কোনো উপকারে আসে না।” [মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন]
আলেমগণ আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীর ব্যখ্যায় বলেন,
}اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (6) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ{ [سورة الفاتحة: 7]
“আমাদেরকে সরল পথের হিদায়াত দিন। তাদের পথ, যাদেরকে আপনি নিয়ামত দিয়েছেন এবং যাদের উপর আপনার ক্রোধ আপতিত হয়নি আর যারা পথভ্রষ্টও নয়।” [আল-ফাতেহা : ৬-৭] যাদের ওপর অনুগ্রহ করা হয়েছে তারা হলেন যারা উপকারী ইলম ও সৎ আমল একত্রিত করেছেন। আর যাদের ওপর ক্ষুব্ধ, তারা হলো যারা ইলম হাসিল করেছে; তবে তার ওপর আমল করে নাই। আর পথভ্রষ্ট হলো, যারা ইলম ছাড়া আমল করেছে।
আমাদের উচিত হলো এই ইলমকে প্রচার করা এবং তা অপরের নিকট পৌঁছানো। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«بَلِّغُوا عَنِّي ولو آيَةً» [رواه البخاري].
“আমার পক্ষ হতে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও।” [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন]
আল্লাহর নিকট কামনা করি তিনি যে এ ইলকে আমাদের পক্ষে দলীল বানান; আমাদের বিপক্ষে নয়। আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার পরিজন ও তাঁর সাহাবীগণের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্ব জগতের রব।
- ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব, ছালাছাতুল উসূলি ওয়াআদিল্লাতুহা।
- ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলু সামাহাতুশ শায়েখ আব্দুল আযীয ইবন বায।
- ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলুশ শায়েখ মুহাম্মদ ইবন ‘উসাইমীন।
- শায়েখ ইবরাহীম আবা হুসাইন, মু‘জামুত তাওহীদ।
- শায়েখ সালিহ আল-ফাওযান, আল-বিদ‘আহ তা‘রীফুহা ওয়া বায়ানু আনওয়া‘ইহা ওয়া আহকামিহা।
- শায়েখ সা‘ঈদ ইবন ‘আলী ইবন ওয়াব আল-কাহকানী, নূরুস সুন্নাহ ওয়া যুলুমাতুল বিদ‘আহ।
- শায়েখ আব্দুর রহমান ইবন সা‘দী, মিনহাজুস সালিকীন।
- শায়েখ সালিহ আল-ফাওযান, আল-মুলাখখাসুল ফিকহী।
- মু‘আসসাসতুদ দুরারিস সানিয়্যাহ এর ইলমী বিভাগ, মুলাখখাসু ফিকহিল ইবাদাত।
- শায়েখ আব্দুল আযীয আস-সাদহান, সংক্ষিপ্তকরণ: আব্দুল্লাহ আল-ইজলান, মুখতাসারু মুখালাফাতিত তাহারাহ ওয়াসালাহ।
- শায়েখ ফাহাদ বাহাম্মাম, দালীলুল মুসলিমিল মুইয়াসসির।
- শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুসলিহ এবং শায়েখ সালিহ আস-সাভী, মা লা ইসা‘আল মুসলিমি জাহলুহু।
- শায়েখ আব্দুল্লাহ বাকরী, সুবুলুস সালাম।
- ওয়েবসাইট: ফাতওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ওয়েবসাইট, শায়েখ আব্দুল আযীয ইবন যাব-এর ওয়েবসাইট, আদ-দুরাসুস সানিয়্যাহ ওয়েবসাইট, আল-ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব ওয়েবসাইট, আল-আলূকাহ ওয়েবসাইট।
[1] মানুষ তার জীবনে যা চর্চা করে (বা যেসব পেশায় নিয়োজিত থাকে) তার ওপর ভিত্তি করে তার নির্দিষ্ট ইলম ও বিধান শিক্ষা করা ওয়াজিব। কাজেই যে ব্যক্তি শেয়ার ও স্টক এক্সচেঞ্জ-এর সাথে লেনদেন করে তার ওপর এ সংশ্লিষ্ট ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। আর একজন ডাক্তারকে ডাক্তারী পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। মোট কথা হলো, একজন মুসলিম তার জীবনে যা চর্চা করে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো শেখা তার ওপর ওয়াজিব, যাতে সে জেনে-বুঝে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে এবং অজ্ঞতাবশত কোনো নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত না হয়।
[2] আমি বইয়ের শেষে তথ্য সূত্র উল্লেখ করেছি।
[3] ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রচিত ছালাছাতুল উসূলি ওয়াআদিল্লাতুহা।
[4] তাহরীফ (التحريف) হলো, শব্দটি যে অর্থ প্রদান করে দলীল ছাড়াই সেই অর্থ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া। আর তা তা‘তীল (التعطيل) হলো, আল্লাহর সিফাত অথবা নামসমূহ অসাব্যস্ত করা। আর তাকয়ীফ (التكييف) হলো, এ কথা বিশ্বাস করা যে, বিবেক যেমন ধরন চিন্তা করে সেই ধরন অনুযায়ী আল্লাহর সিফাতসমূহ বিশ্বাস করা। আর তামসীল (التمثيل) হলো, আল্লাহর সিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতসমূহের মত মনে করা।
[5] এটিকে তামীমাহ (তাবীয) বলে নামকরণ করা হয়েছে, কারণ তাদের বিশ্বাস যে, এটি তাদের কর্ম তামাম (সম্পন্ন) করে এবং এর দ্বারা তারা নিরাপদ থাকে।
[6] বর্তমান যামানায় শিরকে আসগারের আরও কিছু উদাহরণ হলো: গলায় ও হাতে ব্রেসলেট বা চেইন ঝুলানো যাতে নীল চোখের ছবি থাকে; তাদের ধারণা এটি চক্ষু-দোষ প্রতিহত করে। এ ধরণের আরও উদাহরণ হলো: তথাকথিত প্রাচীর বা আশাপূরণ বৃক্ষ, যার উপর তারা তাদের প্রত্যাশাগুলো ঝুলিয়ে রাখে এবং মনে করে এগুলো পূরণ হবে। এসব বিষয় এবং অনুরূপ বিষয়গুলো মানুষের জন্য খুবই বিপজ্জনক। কারণ সে যদি বিশ্বাস করে যে এটি নিজের উপকার ও ক্ষতি করতে পারে, তবে এটি একটি বড় শিরক, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আর যদি সে মনে করে যে, এটি ভালো অথবা মন্দ প্রতিহত করার উপায় তবে এটি ছোট শিরক হিসেবে গণ্য হবে।
[7] ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহুর ‘ছালাছাতুল উসূলি ওয়া-আদ্দিলাতুহা’
[8] এ থেকে যা কিছু শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তা বাদ দেয়া হবে। তবে শর্ত হচ্ছে শিক্ষার জন্য যতটুকু জরুরী তার ওপর সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। স্থায়ীভাবে তা গ্রহণ করা যাবে না।
[9] নাপাক রক্ত হলো প্রবাহিত রক্ত। যেমন, যবেহ করার সময় যবেহকৃত জন্তু হতে বের হওয়া রক্ত। আর যে রক্ত জবেহ করার পর জন্তুর সাথে লেগে থাকে যেমন, রগের সাথে, কলিজাতে, তিল্লি ও হোসের সাথে সে সব রক্ত পাক।
[10] মৃতপ্রাণি: যে জন্তু শরয়ী বিধান অনুযায়ী যবেহ করা হয়নি। মৃতপ্রাণি থেকে বাদ দেওয়া হবে মাছ এবং যে সব জন্তু পানি ছাড়া অন্য কোথাও বসবাস করে না এবং মৃত ফড়িং। এ দুটি পাক এগুলো যবেহ করা ছাড়া খাওয়া হালাল। অনুরূপভাবে নাপাক মৃতপ্রাণি থেকে বাদ দেওয়া হবে যে সব জন্তুর প্রবাহিত রক্ত নাই যেমন, পিপড়া, মাছি ও বিটল। এ গুলো পবিত্র তবে খাওয়া হালাল নয়।
[11] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের কারো প্লেটে যখন কুকুর মুখ দেয় তখন তার পবিত্রতা হলো তা সাতবার ধোয়া যার প্রথমবার হলো মাটি দ্বারা।” [এটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।] ইমাম নববী বলেন, ‘যখন তার পেশাব, পায়খানা, রক্ত, ঘাম, তার চুল, লালা এবং তার কোনো অঙ্গ কোনো পবিত্র জিনিষের মধ্যে পড়ে যার কোনো একটি (অর্থাৎ কুকুরের অংশ বা পাত্র থেকে কোনো একটি) তরল তখন তা সাতবার ধোয়া ওয়াজিব এবং একবার মাটি দিয়ে ধুতে হবে।’
[12] মযী: এটি এক প্রকার পাতলা পিচ্ছিল পানি যা যৌন উত্তেজনার সময় নিক্ষিপ্ত হওয়া ও গতি ছাড়া বের হয়। এটি বের হওয়ার পর শরীর নিস্তেজ হয় না। এ থেকে পবিত্রতা: লিঙ্গ ও অন্ডকোষ দুটি ধুয়ে ফেলবে। আর যদি কাপড়ে লাগে তাহলে যে জায়গা লাগছে তা ধুয়ে ফেলবে। আর ওদী হলো গাঢ় সাদা পানি যা পেশাবের পর বের হয়। এ থেকে পবিত্রতা অর্জন পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করার মতোই।
[13] পাথর অথবা টিসূ ইত্যাদি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে পরিস্কার হওয়ার পরও ওয়াজিব হলো তিনবারের কম যাতে না হয়।
[14] মাথা থেকে ঝুলে পড়া চুল মাসেহ করা ওয়াজিব নয়।
[15] ফতওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। (৭৮/৪)।
[16] খুফফ হলো চামড়া দ্বারা নির্মিত বস্তু যা মানুষ তার দুই পায়ে পরিধান করে থাকে। আর জাওরাব হলো, পশম, তুলা বা লীনেন বা কাপড় ইত্যাদি জাতীয় পোশাক যা মানুষ পায়ে পরিধান করে থাকে। আর এটি শাররাব নামে পরিচিত।
[17] আমরা জানি যে, মদ ও নেশা জাতীয় কোনো কিছু পান করা কবীরাহ গুনাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
}يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنْصَابُ وَالأَزْلامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ{ [النساء: 103].
“হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” [আন-নিসা : ১০৩]
[18] পুরুষাঙ্গ বা পায়ূপথ স্পর্শ করা এবং অনুরূপভাবে নারী যখন তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করে এবং অনুরূপভাবে অপরের লিঙ্গ স্পর্শ করা চাই সে ছোট হোক বা বড় হোক।
[19] গোসল ফরয হওয়া ব্যক্তির জন্য মসজিদ অতিক্রম করা জায়েয। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৩]
[20] নারীর জন্যে গোসলের সময় চুলের বেনি খোলা ওয়াজিব নয়।
[21] ওয়াজিব হলো পানি তালাশ করা। তাই সে তার আশপাশে পানি তালাশ করবে। যদি সে না পায় অথবা না পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয় তবে সে তায়াম্মুম করবে।
[22] আরও বেশি জানার জন্য শায়খ মুহাম্মাদ ইবন উসাইমীনের পুস্তিকা (رسالة في الدماء الطبيعية للنساء) দেখা যেতে পারে।
[23] ঋতুস্রাবের রক্তের বৈশিষ্ট্য: ঘন, পাতলা নয়, খারাপ গন্ধে দুর্গন্ধময়, জমাটবাধা নয়।
[24] ইস্তেহাযার রক্তের ধরন: পাতলা গাঢ় নয়, দুর্গন্ধযুক্তও নয়। আর এটি বের হলে জমে যায়।
[25] মুস্তাহাযা নারীর জন্য যুহর ও আছরের মাঝে এবং মাগরিব ও এশার মাঝে একত্র করা যায়েয আছে, যখন প্রত্যেক সালাতের জন্য তার ওপর ওযূ করা কষ্টকর হবে।
[26] কারণ হলো সূর্য যখন উদয় হয়, তখন পশ্চিম দিকে প্রত্যেক দণ্ডায়মান বস্তুর একটি ছায়া দেখা যায়। সূর্য যতই উপরের দিকে উঠে ততই ছায়াটি ছোট হতে থাকে। যখন আকাশের মাঝখানে পৌছে, যেটি বরাবর হওয়ার অবস্থা- তখন ছোট হওয়া পূর্ণ হয়। তখন সামান্য ছায়া অবশিষ্ট থাকে, যেটি হেলে যাওয়ার ছায়া। এটি মাসসমূহের ভিত্তিতে বিভিন্ন হয়ে থাকে।
[27] আসরের সালাতকে সূর্য লাল হওয়ার পর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা জায়েয নাই। তবে যদি দেরি করতে বাধ্য হয়, তখন সূর্য ডোবার আগে পড়ে নেয়াতে কোনো অসুবিধা নাই। অনুরূপভাবে এশার সালাত সম্পর্কে বলা হবে যে, প্রয়োজন ছাড়া অর্ধ রাতের পর পর্যন্ত দেরী করা জায়েয নাই। তবে প্রয়োজনে ফজর উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত পড়তে পারবে।
[28] আর প্রথম ফজর হলো (কাযিব), পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত দীর্ঘ একটি আলো। সামান্য সময় থাকে তারপর আবার অন্ধকার। কিন্তু দ্বিতীয় ফজর উদয়ের পর আর অন্ধকার হয় না আলো বাড়তে থাকে।
[29] এ থেকে বাদ পড়বে সফর অবস্থায় বাহনের (যেমন গাড়ী বা প্লেন বা অন্য কিছুর) ওপর নফল সালাত। তখন বাহন তাকে নিয়ে যেদিকে ফিরবে সে দিকে ফিরেই সালাত আদায় করবে।
[30] এটি হলো সে জায়গা যেখানে উট রাত যাপন করে ও বিশ্রাম নেয় এবং যেখানে পানি থেকে উঠার সময় বা পানির জন্য অপেক্ষা করার সময় বসে।
[31] অথবা দুই পা খাড়া করে দু্ই গোড়ালির ওপর বসবে।
[32] অথবা ডান পা বিছিয়ে দেবে এবং ডান পায়ের গোড়ালী ও উরুর মাঝখান দিয়ে বাম পা প্রবেশ করাবে।
[33] সিজদা সাহুর জায়গায় ব্যাপারটিতে প্রশস্ততা রয়েছে। অতএব যেসব অবস্থায় সিজদা সাহু ওয়াজিব সেখানে সালাম ফিরানোর পূর্বে বা সালাম ফিরানোর পরে সিজদা দেওয়া বৈধ হবে।
[34] সেজদা সাহুর স্থানের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে। ফলে সেজদা সাহু যে সব অবস্থায় ওয়াজিব হয় তার সবটিতে সালামের পূর্বে অথবা তার পরে সেজদা দুরস্ত রয়েছে।
[35] সফরে সালাত কসর করার শর্ত হলো তার নিজ শহরের ঘরবাড়ি ত্যাগ করা।
[36] আর কুরবানীর ঈদে: সব সময় সাধারণ তাকবীর বলা মুস্তাহাব। অর্থাৎ যুল হজ মাস আরম্ব হওয়া থেকে নিয়ে আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন পর্যন্ত। আর সেটি হচ্ছে তেরতম তারিখ। আর নির্ধরিত তাকবীর যেগুলো পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর বলতে হয় সেগুলো আরাফার দিন ফজর থেকে আরম্ভ হয়ে সব সময় পঠিত সাধারণ তাকবীরের সঙ্গে তাশরীকের শেষ দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলতে থাকবে।
[37] মাজমুউল ফাওয়া: (১৩/৪১৪) হাদীসসমূহ উল্লেখ করার পর।
[38] এখানে আরও অনেক প্রকার যাকাতের মাল আছে তা হলো খনিজ সম্পদ এবং জাহিলয়্যাতের যুগের দাফনকৃত সম্পদ। এর যাকাত সম্পর্কে আহলে ইলমদেরকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে।
[39] কারো মুখে খাদ্য থাকা অবস্থায় যদি ফজর উদয় হয়ে যায় তখন তাকে অবশ্যই খাওয়া ফেলে দিতে হবে এবং সাওম পূর্ণ করবে, আর যদি সে খাদ্য গিলে ফেলে তাহলে তার সাওম বাতিল।
[40] গর্ববতী ও দুগ্ধপান কারিনীর জন্য রমযানে সাওম ভঙ্গ করা বৈধ। যদি তারা তাদের নিজেদের ওপর বা সন্তানের ওপর ভয় করে। আর তাদের ওপর কাযা ওয়াজিব।
[41] অনুরূপভাবে নারীদের লজ্জাস্থানে ড্রপ দেয়া, যৌনি সাপোজিটর এবং লোশন লাগানো।
[42] যখন শর্ত পাওয়া যাবে তখন তাড়াতাড়ি হজ করা ফরয। দেরী করার কারণে সে গুনাহগার হবে।
[43] নারীদের ওপর হজ আদায় করা ফরয হওয়ার জন্য মাহরামের সঙ্গ এবং স্বামীর মৃত্যুর ইদ্দতের মধ্যে না থাকা শর্ত।
[44] অন্তর দ্বার ঘৃণা করা হলো: খারাপ কাজটি ঘৃণা করা এবং সম্ভব হলে যে স্থানে খারাপ কর্ম হয় সে স্থান ত্যাগ করা।
[45] হাদীসটির অর্থ: যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বঝায় রাখে আল্লাহ তাকে সাওয়াব ও বিনিময় দেয়ার ওয়াদা দিয়েছেন। তার ইহসানের বিনিময়ে আল্লাহ তার হায়াতকে দীর্ঘ করবেন এবং তার রিযিক প্রশস্ত করে দিবেন।
[46] তার ঘাম শুকানোর আগে: কাজ শেষ হওয়ার পর যখন সে মুজুরী চায় তখন তা তাড়াহুড়া করে পরিশোধ করার প্রতি ইঙ্গিত, যদিও তার ঘাম বের না হয় বা হয়েছে এবং শুকিয়ে গেছে। এ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা এবং দীর্ঘায়িত ও গড়িমসি না করা।
[47] নাজাশ হলো যে ব্যক্তির ক্রয় করার ইচ্ছা নেই তার পক্ষ হতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া।
[48] কংকর নিক্ষেপের বেচা-কেনা: এককাধিক বস্তুর ওপর কংকর নিক্ষেপ করবে, যেটির ওপর কংকর পড়বে সেটিই পণ্য। (ধোঁকার বেচা-কেনা): এটি পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞাত একটি ব্যবসা বা যার কাছে এর পরিনতি অস্পষ্ট। যেমন, অধিক পানিতে মাছ বিক্রি করা, বাতাসে পাখি বিক্রি করা, তালাবদ্ধ সিন্দুকের বস্তু বিক্রি করা; অথচ সে জানেনা যে তাতে কি রয়েছে। নির্ধারণ করা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের গাঁট থেকে একটি কাপড় বিক্রি করা আর ফল উপযুক্ত হওয়ার আগে বিক্রি করা।
[49] আরওয়া অর্থ অধিক তৃপ্তিদায়ক, আর আবরায়ু অর্থ, তৃষ্ণা থেকে মুক্তিদায়ক বা রোগ থেকে মুক্তিদায়ক আর আমরান অর্থ সুন্দর গলাধঃকরণ।
[50] আর (غير مَكْفِيّ) অর্থ, তার নেয়ামাতের ওপর তাকে কেউ বিনিময় দানে সক্ষম নয়। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছাড়া তার বান্দাদের রিযিকের জন্য আর কেউ যথেষ্ট নয়। আর তার কথা (وَلا مُوَدَّع) এর অর্থ হলো, পরিত্যক্ত নয়।