আল্লাহর দিকে আহ্বান ও দা‘ঈর গুণাবলি

﴿ الدعوة إلى الله وأخلاق الدعاة ﴾

 আল্লাহর দিকে আহ্বান ও দা‘ঈর গুণাবলি

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আর শুভপরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য, যালেম ছাড়া আর কারও উপর আক্রমণ নেই। আর আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ, যিনি শরীকবিহীন তিনি ছাড়া হক কোনো ইলাহ নেই, তিনি পূর্বাপর সবার ইলাহ, আসমান ও যমীনসমূহের ধারণকারী। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তাঁর বন্ধু, তাঁর ওহীর আমানতদার। তাকে তিনি সমস্ত মানুষের কাছে সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী হিসেবে এবং তাঁর অনুমতিক্রমে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীরূপে ও আলোকিত ছেরাগরূপে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তার উপর, তার পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী দের উপর সালাত পাঠ করুন, যারা আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে তার প্রদর্শিত পথে চলেছেন এবং এর উপর ধৈর্যধারণ করেছেন, আর এ পথে জ্বিহাদ করেছেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের দ্বারা তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন, তার বাণীকে সমুন্নত করেছেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। আর তার উপর অনেক অনেক সালাম পেশ করুন। তারপর,

আল্লাহ জ্বিন-ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। তাঁর আদেশ-নিষেধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে, এবং  তাঁর নাম ও গুণাবলিসহ তাকে  জানার জন্য।

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ﴾ [سورة الذاريات: 56.]

‘আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। [1]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴾ [سورة البقرة: 21]

‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।’[2]

তিনি আরও বলেন,

﴿ ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖ وَمِنَ ٱلۡأَرۡضِ مِثۡلَهُنَّۖ يَتَنَزَّلُ ٱلۡأَمۡرُ بَيۡنَهُنَّ لِتَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ وَأَنَّ ٱللَّهَ قَدۡ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عِلۡمَۢا ١٢ ﴾ [الطلاق: ١٢] 

‘তিনি আল্লাহ, যিনি সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন সৃষ্টি করেছেন; এগুলির মাঝে তাঁর নির্দেশ অবতীর্ণ হয় যেন তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞানতো সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে।’[3]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা সুষ্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি সৃষ্টিকুল সৃজন করেছেন, যেন তাঁর ইবাদত করা হয়, যথাযথ ভাবে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধের অনুসরণ করা হয়। কারণ ইবাদত হল: আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহকে সম্মান করার সাথে সাথে তাঁর একত্ববাদকে স্বীকার করা এবং তাঁর আনুগত্য করা। আকাশ-যমীন ও এ দুয়ের মাঝে সবকিছুর সৃষ্টির রহস্য বর্ণনা করে তিনি বলেন, এসব সৃষ্টি করেছেন, যাতে সৃষ্টিকুল এটা জানতে পারে যে, আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং তাঁর জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে-সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের অধীন।

এর মাধ্যমে তা জানা গেল সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি ও অস্তিত্বদানের রহস্য কি, আর তা হচ্ছে, সৃষ্টিকুল আল্লাহর নাম ও গুণাবলিসহ তাঁর পরিচয় জানবে এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান ও সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত মর্মে জ্ঞান লাভ করবে। যেমনিভাবে এদের সৃষ্টি ও অস্তিত্বদানের হিকমত হল, তারা তাঁর ইবাদত করবে, তাঁকে সম্মান করবে, তাঁর মহত্ব স্বীকার করবে এবং তাঁর বড়ত্বের কারণে তারা তাঁর কাছে নত হবে।

ইবাদত হচ্ছে: আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে নিবেদন করা এবং তাঁর কাছে অবনত হওয়া। মহান আল্লাহ মুকাল্লাফ তথা শরীয়ত প্রতিপালনের দায়িত্বপ্রাপ্তদেরকে আদেশ-নিষেধ বিষয়ক দায়িত্বগুলো সম্পাদন করার যে হুকুম দিয়েছেন সে সব আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে দূরে অবস্থান করাকেও ইবাদত বলা হয়েছে; কারণ এগুলো আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর কাছে নতশির হওয়ার মাধ্যমে আদায় করা হয়ে থাকে।

যখন মানুষের পক্ষে শুধুমাত্র বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে ইবাদতের স্বরূপ ও তার মূল তত্ত্বকথা বিস্তারিতভাবে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়, অনুরূপভাবে ওই বিবেকের মাধ্যমে আহকাম তথা শরয়ী বিধি-নিষেধ সবিস্তারে জানাও অসম্ভব, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা যে উদ্দেশ্যে মাখলুক সৃষ্টি করেছেন সে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য প্রেরণ করলেন অসংখ্য নবী-রাসূল, অবতীর্ণ করলেন অনেক কিতাব। যাতে তারা জেনে শুনে আল্লাহর ইবাদত করে, এবং জেনে শুনে নিষিদ্ধ কাজসমূহ ত্যাগ করে। সে বিচারে রাসূলগণ হলেন মাখলুকের পথ প্রদর্শক এবং হেদায়াতের ইমাম। জ্বিন-ইনসান সকলকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের দিকে আহ্বানকারী। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে স্বীয় বান্দাদের সম্মানিত করেছেন, তাদের প্রেরণ করে নিজ বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদের হাতেই স্পষ্ট করেছেন সঠিক ও সরল পথ; যাতে বান্দাদের নিজেদের ভালো-মন্দ বিষয়ে পরিষ্কার জানা থাকে, এবং বলতে না পারে যে আল্লাহ আমাদের কাছে কী চেয়েছেন তা আমরা জানতে পারি নি, আমাদের কাছে কোন সুসংবাদদাতা এবং ভীতিপ্রদর্শনকারী আসে নি। এভাবেই আল্লাহ এরূপ ওজর-আপত্তির রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন রাসূলদের প্রেরণ ও কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করে ।

যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ﴾ [النحل: ٣٦] 

‘আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি এই বার্তা দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর বন্দেগি কর, এবং তাগুতকে বর্জন কর। ’[4]

তিনি আরও বলেন,

﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥ ﴾ [الانبياء: ٢٥]

‘আমি তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করেনি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই; সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর।’[5]

আরও বলেন,

﴿ لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَنزَلۡنَا مَعَهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡمِيزَانَ لِيَقُومَ ٱلنَّاسُ بِٱلۡقِسۡطِۖ ﴾ [الحديد: ٢٥] 

‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদের প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এবং তাদের সঙ্গে পাঠিয়েছি কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদণ্ড; যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।’[6]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿ كَانَ ٱلنَّاسُ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ فَبَعَثَ ٱللَّهُ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ وَأَنزَلَ مَعَهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ لِيَحۡكُمَ بَيۡنَ ٱلنَّاسِ فِيمَا ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِۚ ﴾ [البقرة: ٢١٣] 

‘মানব জাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল; অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত।’[7]

অতঃএব আল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে তিনি রাসূলদের প্রেরণ করেছেন এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন, মানুষের মাঝে হক এবং ইনসাফ ভিত্তিক ফায়সালা করার জন্য, আর শরীয়ত ও আকীদার যে সব বিষয়ে তারা বিরোধ করেছিল তা স্পষ্ট করার জন্য। কারণ আল্লাহর বাণী كان الناس أمة واحدة ‘মানব জাতি ছিল একটি উম্মাহ-জাতি, এর অর্থ হলো তারা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, হক বিষয়ে তারা কোন মতবিরোধ করত না; আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে আল্লাহর রাসূল নূহ আলাইহিস সালামের নবুয়্যত কাল পর্যন্ত। তারা ছিল হিদায়াতের উপর, আয়াতের এ তাফসীরই করেছেন সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও পূর্ববর্তী-পরবর্তী অনেক মনীষীগণ। অতঃপর নূহ আলাইহিস সালামের কওমের মাঝে শির্কের অনুপ্রবেশ ঘটে। তারা পরস্পর মতবিরোধ করলো এবং বিরোধ করলো তাদের উপর অবশ্য পালনীয় আল্লাহর হক বিষয়ে। আর তারা যখন শির্ক ও ঝগড়া-বিবাদে জড়ালো তখন আল্লাহ তা‘আলা নূহ এবং পরবর্তী  রাসূলদের প্রেরণ করলেন।

যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

﴿ ۞إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ ﴾ [النساء: ١٦٣] 

‘নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি যেরূপ প্রত্যাদেশ করেছিলাম নূহ ও তৎপরবর্তী নবীগণের প্রতি।’[8]

﴿ وَمَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ ٱلَّذِي ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٦٤ ﴾ [النحل: ٦٤]

‘আমি তো তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে এবং মুমিনদের জন্যে পথনির্দেশ ও দয়াস্বরূপ।’[9]

সুতরাং আল্লাহ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, মানুষ যে সব বিষয়ে মতভেদ করেছিল সে বিষয়ে আল্লাহর হুকুম বর্ণনা করার জন্যে, মানুষের অজানা বিষয়ে আল্লাহর বিধানের বর্ণনা দেয়ার জন্যে, তাদেরকে শরীয়ত আঁকড়ে ধরা ও তার নির্ধারিত সীমায় অবস্থানের আদেশ দান এবং ইহকাল ও পরকালে তাদের জন্যে ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে বারণ করার জন্যে। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল প্রেরণের ধারা সমাপ্ত করেছেন রাসূলদের ইমাম, আমাদের নবী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহর মাধ্যমে। তিনিসহ সকল নবীদের উপর আল্লাহ্‌র উত্তম সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত রিসালত পৌঁছিয়েছেন, আমানত আদায় করেছেন, উম্মতের কল্যাণ কামনা করেছেন, আল্লাহর জন্যে যথার্থভাবে লড়েছেন, গোপন ও প্রকাশ্যে আল্লাহর প্রতি দা‘ওয়াত দিয়েছেন এবং আল্লাহর খাতিরে কঠিন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন তাঁর পূর্বে আগমনকারী নবী-রাসূলগণ -আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম। তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন যেমন তারা ধৈর্য ধারণ করেছিলেন এবং রিসালত পৌঁছানোর দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন যেমনি করে তারা এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে তিনি নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন অনেক বেশি এবং সহ্যও করেছেন অনেক বেশি। আর তিনি রিসালতের দায়িত্ব পরিপূর্ণরূপে সম্পাদন করেছেন। তাঁর ও তাদের সকলের উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক। তেইশ বছর অবস্থান করে আল্লাহর রিসালাত পৌঁছিয়েছেন এবং তাঁর দিকে আহ্বান করেছেন, তাঁর আহকাম তথা বিধি-বিধান প্রচার-প্রসার করেছেন। তন্মধ্যে উম্মুল কুরা তথা মক্কায় তের বছর, প্রথমে গোপনে পরে প্রকাশ্যে। হক প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছেন এবং নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, দা‘ওয়াতে এবং মানুষ কর্তৃক অত্যাচারে তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন। অথচ তারা তাঁর সততা এবং আমানতদারী বিষয়ে জানতো। তারা স্বীকৃতি দিত তার শ্রেষ্ঠত্বের, তাঁর বংশ, তাঁর মান-মর্যাদার। তবে নেতাদের কামনা-বাসনা ও হিংসা-বিদ্বেষ আর সাধারণের মূর্খতা এবং অন্ধানুকরণ ছিল এর কারণ। তাই নেতারা অস্বীকার করলো, অহংকার করলো, হিংসা করলো, আর সাধারণ লোকেরা অন্ধানুকরণ করল এবং নেতাদের অনুসরণ করল ও খারাপ কাজ করল, এ কারণে তিনি অনেক কঠিন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। তাঁর উপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক। তাদের নেতারা যে জেনে-শুনে ও গোয়ার্তুমি করে সত্যের বিরোধিতা করেছিল তার প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿قَدۡ نَعۡلَمُ إِنَّهُۥ لَيَحۡزُنُكَ ٱلَّذِي يَقُولُونَۖ فَإِنَّهُمۡ لَا يُكَذِّبُونَكَ وَلَٰكِنَّ ٱلظَّٰلِمِينَ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ يَجۡحَدُونَ ٣٣ ﴾ [الانعام: ٣٣]

‘আমি অবশ্যই জানি যে, তারা যা বলে তা তোমাকে দুঃখ দেয়। কিন্তু তারা তো তোমাকে অস্বীকার করে না, বরং যালিমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে।’[10]

আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যারোপ করতো না, তাদের অন্তরে গোপনে তাঁর সততা ও আমানতদারী সম্পর্কে সম্যক জানত। বরং তারা তাঁকে সম্বোধনই করতো ‘আল আমীন’ বলে; এবং এটি ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই। তবে তারা সত্যকে অস্বীকার করল, বিদ্বেষ ও অবাধ্যতাবশত। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সবের কোন পরওয়া করেন নি, বরং ধৈর্য ধারণ করেছেন, সওয়াবের আশা করেছেন এবং আপন লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন অবিচলতার সাথে। এ ভাবেই তিনি ছিলেন সর্বদা মহান আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী, নির্যাতনে ধৈর্যশীল, দা‘ওয়াতের প্রতি জিহাদকারী, যন্ত্রনা প্রদান থেকে দূরে অবস্থানকারী, কষ্ট সহ্যকারী, এবং যথাসাধ্য তাদের থেকে সংঘটিত অসৌজন্যমূলক আচার-আচরণ মার্জনাকারী। এক পর্যায়ে অবস্থা খুব মারাত্মক আকার ধারণ করল। তারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক এ সময়ে আল্লাহ তাঁকে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দিলেন, তিনি মদীনায় হিজরত করে চলে আসলেন, আর মদীনা হয়ে গেল ইসলামের প্রথম রাজধানী। মদীনায় আল্লাহর দ্বীনের বিজয় হলো এবং সেখানে মুসলিমদের একটি রাষ্ট্র ও শক্তির ভিত সূচিত হল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা­ম হকের প্রচার ও প্রসারতার ধারা চালিয়ে গেলেন নির্ভীকভাবে। তরবারির মাধ্যমে জিহাদ শুরু করলেন। মানুষকে কল্যাণ ও হিদায়াতের দিকে আহ্বানের জন্য দূত পাঠাতে লাগলেন দিকে দিকে। তারা মানুষকে তাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দা‘ওয়াতের মর্ম ব্যাখ্যা করতে থাকলেন অবিরাম। আর তিনি তাঁর সাথীদেরকে যুদ্ধাভিযানে পাঠিয়েছেন, নিজেও বিখ্যাত যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তার হাতে আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করলেন, দ্বীনকে পূর্ণতা দিলেন, তাঁর ও তাঁর উম্মতের উপর নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করলেন। এ দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ এবং যথাযথভাবে পৌঁছানোর পর তাঁকে মৃত্যু দান করা হয়েছে। তাঁর অবর্তমানে এ আমানত সাহাবায়ে কেরাম বহন করলেন এবং তাঁর পথ অনুসরণ করলেন। আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন এবং তারা হকের দা‘ঈ, আল্লাহর পথে জিহাদকারী হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লেন। আল্লাহর স্বার্থে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে তারা ভয় করতেন না। তারা আল্লাহর রিসালাতকে পৌঁছাতেন, তাঁকে ভয় করতেন অন্য কাউকে নয়। ছড়িয়ে পড়লেন বিশ্বময় বিজয়ী মুজাহিদ, সরল পথের দা‘ঈ, কার্যকর সংস্কারক হিসেবে। তারা আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতেন, তাঁর শরীয়ত মানুষকে শিক্ষা দিতেন এবং তারা মানুষের জন্যে আকীদাহ বিষয় ব্যাখ্যা করতেন যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছিল রাসূলগণ। যে আকীদার মূল ভাষ্য হলো, আন্তরিকভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং তিনি ব্যতীত  অন্য সবকিছু-গাছ, পাথর, মূর্তি ইত্যাদির ইবাদাত পরিত্যাগ করা। অতএব ডাকা যাবে না আল্লাহকে ছাড়া, সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে না আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে, বিচার-ফায়সালা মানা যাবে না আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া, নামায আদায় করা যাবে না তাঁর উদ্দেশ্যে ব্যতীত, মান্নত করা যাবে না তাঁর নামে ছাড়া, এক কথায় সকল ইবাদত তাঁর জন্য হওয়া।  

এবং তারা মানুষের কল্যাণে ব্যাখ্যা করেছেন যে,  ইবাদত আল্লাহর হক্ব এবং তাদের সামনে এ বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতগুলো পাঠ করেছেন। যেমন-

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ﴾ [البقرة: ٢١] 

‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর’[11]

﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ﴾ [الاسراء: ٢٣]

‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না’[12]

﴿ إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥ ﴾ [الفاتحة: ٥]

‘আমরা শুধুমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।’[13]

﴿فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]

‘সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকেও ডেকো না’[14]

﴿ قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣ ﴾ [الانعام: ١٦٢،  ١٦٣]

‘বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহর জন্যে, যিনি সকল সৃষ্টির রব। তাঁর কোন শরীক নেই, আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম।’[15]

তারা এর উপর ইস্পাত কঠিন ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং আল্লাহর পথে মহা সংগ্রাম করেছেন। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন। তাদের অনুসরণ করেছেন আরব- অনারবের তাবেঈন তাবে তাবেঈন- হিদায়েতের ইমামগণ। তারা এ পথের পথিক হয়েছেন, দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ্‌র পথে চলেছেন, বহন করেছেন দা‘ওয়াতের বোঝা, আমানত আদায় করেছেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন ধৈর্য, সততা, আন্তরিকতার সাথে। যারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে গেছে এবং দ্বীনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অথচ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত জিযয়া আদায় করে নি, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কারণ তারাই দা‘ওয়াতের প্রকৃত ধ্বজাধারী। সুতরাং রাসূলের পর তারাই দা‘ওয়াতের বাহক, পথ প্রদর্শনের ইমাম। এমনিভাবে সাহাবাদের পরবর্তী যারা এসেছেন তারাও এ পথ অনুসরণ করেছেন। এ পথে ধৈর্য ধারণ করেছেন। আর আল্লাহর দ্বীন প্রসার লাভ করেছে, সাহাবা এবং পর্যায়ক্রমে তাদের পরবর্তী দ্বীনী জ্ঞানে জ্ঞানী ও ঈমানদারদের হাতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ দা‘ওয়াতী মিশনে আরব- অনারব, আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিনের এবং এর বাইরে সমগ্র বিশ্ব হতে অংশ গ্রহণ করেছেন অনেক দ্বীনদার মানুষ; যাদের ভাগ্য আল্লাহ সুপ্রসন্ন করেছেন,  যারা ইসলাম কবুল করেছেন, দা‘ওয়াত ও জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন, এর জন্যে ধৈর্য ধারণ করেছেন। যাদের ধৈর্য, ঈমান, আল্লাহর পথে লড়াইয়ের ফলস্বরূপ এসেছিল সৌভাগ্য, নেতৃত্ব, দ্বীনের ইমামত। তাদের ক্ষেত্রে বনী ইসরাঈলদের প্রসঙ্গে আগত আল্লাহর বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। 

﴿ وَجَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُواْۖ وَكَانُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا يُوقِنُونَ ٢٤ ﴾ [السجدة: ٢٤]

‘আর আমি তাদের মধ্য হতে কিছু লোককে নেতা মনোনীত করেছিলাম যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতো। তারা ধৈর্যধারণ করতো আর তারা ছিল আমার নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী।’[16]

কুরআনের এ অমোঘ বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে রাসূলের সাহাবা ও তাদের অনুগামীদের মাঝে। তারা ইমাম, হেদায়েতের পথ প্রদর্শক, হক্বের প্রতি আহ্বানকারী ও অনুকরণীয় আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাদের ইস্পাত কঠিন ধৈর্য ও দৃঢ় ঈমান তাদেরকে এ মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। কারণ ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে দ্বীনের ইমামত ও নেতৃত্ব লাভ হয়। সুতরাং নবী সহচরবৃন্দ ও অদ্যাবধি যারা সর্বকাজে তাদের অনুসরণ করেছে তারাই মূলত: সত্যের পথপ্রদর্শক ও ন্যায়ের পথে নেতৃত্বদানকারী।

উপরোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে সত্যানুসন্ধিৎসু প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নিকট পরিস্কার হয়ে গেল যে, আল্লাহর দিকে আহ্বান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সর্বকালে সর্বস্থানে উম্মতের জন্য এ দা‘ওয়াতের প্রয়োজনীয়তা অত্যাধিক বরং এটি অত্যাবশ্যকীয়ও বটে।   

 দা‘ওয়াত বিষয়ক বক্ষমান নিবন্ধে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোচনায় স্থান পাবে।

1.        দা‘ওয়াতের হুকুম ও ফযিলত

2.        আদায় ও পদ্ধতি

3.        দা‘ওয়াতী বিষয়বস্তু

4.        দা‘ওয়াত কর্মীর জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি, যা তাকে অবশ্যই অর্জন করতে ও সে পথে চলতে হয়।

 প্রথম বিষয়: আল্লাহর দিকে আহ্বানের হুকুম ও ফযিলত।

দা‘ওয়াতের হুকুমঃ

দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর পথে আহ্বান অন্যান্য ফরযের ন্যায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফরয। কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য দলীল এটির প্রমাণ বহন করে। যেমন আল্লাহর বাণী:

﴿ وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ ﴾ [ال عمران: ١٠٤]

‘আর যেন তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আরা তারাই সফলকাম।’[17]

অনুরূপভাবে আল্লাহর বাণী:

﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥ ﴾ [النحل: ١٢٥]

‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তাঁর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন।’[18]

অনুরূপ আল্লাহর বাণী:

﴿وَٱدۡعُ إِلَىٰ رَبِّكَۖ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٨٧ ﴾ [القصص: ٨٧]

‘তুমি তোমার রবের দিকে আহ্বান কর এবং কিছুতেই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’[19]

তদ্রূপ মহান আল্লাহর বাণী:

﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ﴾ [يوسف: ١٠٨] 

‘তুমি বল: এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করি সজ্ঞানে, আমি এবং যে আমার অনুসারী...’[20]

উল্লে­খিত আয়াতগুলোতে আমরা দেখলাম আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীগণই দা‘ঈ ইলাল্লাহ এবং তারাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, তাঁর মতাদর্শের উপর চলা গুরুত্বপূর্ণ ফরয। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب: ٢١]

‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’[21]

প্রাজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম ষ্পষ্ট করে বলেছেন, দা‘ঈগণ যে অঞ্চলে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেন সে অঞ্চল অনুপাতে দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ ফরযে কিফায়া; কারণ প্রতিটি অঞ্চলে দা‘ওয়াত ও দা‘ওয়াতের নানাবিধ তৎপরতা বিদ্যমান থাকা জরুরি। এ দা‘ওয়াত ফরযে কিফায়া। যদি কোন অঞ্চলে প্রয়োজনীয়তা অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণ লোক দা‘ওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন তাহলে সে অঞ্চলে বসবাসকারী অন্যদের উপর থেকে আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে যাবে। তাদের ক্ষেত্রে এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ও একটি অতি উন্নত নেক আমল হিসেবে বিবেচিত হবে।

আর যদি সে অঞ্চলে দা‘ওয়াতী কোন তৎপরতাই না থাকে, কেউই এ দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব না দেয় তাহলে, সকলেই অপরাধী বলে গণ্য হবে। সাথে সাথে দা‘ওয়াতীকর্ম সকলের উপরই ফরয হিসেবে বর্তাবে, সকলকেই সামর্থ অনুযায়ী দা‘ওয়াতকর্মের সাথে নিজেকে জড়াতে হবে। হ্যাঁ সামগ্রিকতার বিচারে পুরো দেশের জন্যে একটি জামাআত থাকতে হবে; থাকা ওয়াজিব, যারা সর্বত্র আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেবে, সাধ্যমত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্বন্ধে লোকদের অবহিত করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন নেতৃবর্গ ও রাষ্ট্র প্রধানের কাছে দা‘ঈ প্রেরণ করেছেন, পত্র দিয়েছেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন।

বর্তমান যুগে আল্লাহ তা‘আলা দা‘ওয়াতী কাজকে আমাদের জন্য বিভিন্নভাবে সহজ করে দিয়েছেন, যা আমাদের পূর্বেকার লোকদের জন্য ছিল না। আজকের যুগে ইসলাম প্রচার, দা‘ওয়াতকর্ম পরিচালনা ও মানুষের কাছে  দলিল প্রমাণ উপস্থাপন অনেক দিক দিয়েই সহজ। বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে দা‘ওয়াত ও প্রচার কর্ম আরোও সহজ হয়ে গিয়েছে। একাজে বর্তমানে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ নানা মাধ্যমের সাহায্যে অতি সহজে কর্মে অগ্রগতী সাধন করা যায়।

অতএব জ্ঞানবান, ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ ও নায়েবে রাসূলদের উপর  অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ কাজে আত্মনিয়োগ করা, পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহর বার্তা তাঁর বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেয়া। এ মহৎ কাজে জড়িত হলে চারিদিক থেকে অসহযোগিতা, বাঁধা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হবে তখন এসব আমলে না নিয়ে নির্ভয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়া। এ দায়িত্ব পালনকালে বড়-ছোট ধনী-গরীবে কোন ভেদাভেদ ও তারতম্য সৃষ্টি না করা। বরং আল্লাহর হুকুম যেভাবে আল্লাহ অবর্তীণ করেছেন, যেভাবে প্রবর্তন করেছেন ঠিক সেভাবে তা আল্লাহর বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেয়া।

অবস্থার আলোকে কখনো কখনো এ দা‘ওয়াতী কাজ ‘ফরযে আইন’ হয়ে থাকে। যেমন আপনি যদি এমন কোন স্থানে অবস্থান করেন যেখানে আপনি ছাড়া এ দায়িত্ব পালনের অন্য কেউ নেই, যে সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে বাধা দেবে তখন এটি আপনার জন্যে ফরযে আইন হবে। আবার অবস্থাভেদে কখনো কখনো ফরযে কেফায়া, ইতঃপূর্বে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করে এসেছি। সুতরাং যখন আপনি এমন স্থানে থাকবেন, যেখানে আপনি ব্যতীত এ দায়িত্ব পালনের উপর আর কারও ক্ষমতা থাকবে না, তখন এতে আত্মনিয়োগ করা আপনার জন্যে অবশ্য কর্তব্য হয়ে যাবে। আর অন্য কেউ দা‘ওয়াত, প্রচার, আদেশ-নিষেধের কাজে রত থাকলে, আপনার জন্য হবে সুন্নত। আর যদি আপনি সে কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং এর প্রতি যত্নবান হন, তবে আপনি হয়ে যাবেন সৎকর্মে প্রতিযোগিতাকারী।

দা‘ওয়াত ‘ফরযে কিফায়া’ এর দলিল হিসাবে নিম্নোক্ত আয়াত পেশ করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

﴿وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ﴾ [ال عمران: ١٠٤]

‘এবং তোমাদের মধ্যে এরূপ একটি দল থাকা উচিৎ যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে।’[22]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে কাসির এবং ওলামাদের বিরাট একদল যা বলেছেন তার অর্থ হচ্ছে: এ মহান কাজে তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল নিয়োজিত থাকা চাই। যারা আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে, তাঁর দ্বীন প্রচার করবে, তাঁর আদেশ-নিষেধ বান্দাদের নিকট পৌঁছাবে। এ কথা সকলেরই জানা আছে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন, সাধ্যানুযায়ী মক্কায় আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেছেন। অনুরূপভাবে তাঁর সাহাবীরাও একাজে অংশ গ্রহণ করেছেন তাদের সামর্থানুপাতে। হিজরতের পর এর চেয়েও অধিক দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন এবং শক্তি-সামর্থ্য ও ইলমী যোগ্যতা অনুযায়ী এ দায়িত্ব চালিয়ে গিয়েছেন নিরলসভাবে।

দা‘ওয়াত কর্মীর স্বল্পতা, অন্যায়-অশ্লীলতা বৃদ্ধি, অজ্ঞতার প্রাবল্যের সময় -যেমন আমাদের এ সময়ের কথাই বলা যায়- দা‘ওয়াতের হুকুম হবে ফরযে আইন। প্রত্যেক মুসলিমকেই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করতে হবে। হ্যাঁ কেউ যদি নির্দিষ্ট কোন গ্রাম, শহর বা এ জাতীয় কোন স্থানে বসবাস করে আর সেখানে এ কাজের দায়িত্বভার গ্রহণকারী কাউকে পাওয়া যায় এবং সে ব্যক্তি  দা‘ওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান মানুষের নিকট এমনভাবে প্রচার করেছে যে সেস্থানে বসবাসকারী সকলের পক্ষ হতে যথেষ্ট, এমতাবস্থায় অন্যদের জন্য এ প্রচার-প্রসার সুন্নাত, কারণ অন্যের হাতে এর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, তার হাত ছাড়াও অন্য হস্তে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু (যেখানে এ অবস্থা নেই বা পর্যাপ্ত  দা‘ওয়াত দাতা নেই) অন্যান্য স্থানে, অন্য মানুষের কাছে এ দা‘ওয়াতের দায়িত্ব আলেমদের উপর তাদের সাধ্যানুযায়ী অত্যাবশ্যকীয়, অনুরূপভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রশাসকদের উপরও ক্ষমতা ও সাধ্য অনুসারে তা নিয়ে দাঁড়ানো অত্যাবশ্যক।

এতে বুঝা যায় দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ ফরযে আইন বা ফরযে কিফায়া হওয়াটা আপেক্ষিক বিষয়। কোনো কোনো সম্প্রদায় ও কোনো কোনো ব্যক্তির জন্য এটা ফরযে আইন আবার কোনো সম্প্রদায় ও কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা ফরযে কিফায়া; যখন সেখানে ও সে অবস্থানে এ কাজটির জন্য পর্যাপ্ত পরিমান লোক দাঁড়িয়ে যাবে এবং তারা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।

তবে শাসক এবং সামর্থবান ব্যক্তির উপর এ ক্ষেত্রে দায়িত্বটা আরো বড়। তাদের উপর অবশ্যই করণীয় হচ্ছে তাদের সাধ্যমত পৃথিবীর সকল প্রান্তে আল্লাহর রিসালত পৌঁছে দেয়া সম্ভাব্য সকল পন্থায়, মানুষের ব্যবহৃত সকল ভাষায়। এতে করে পৃথিবীর সকলের কাছে তাদের নিজস্ব ভাষায় দ্বীন পৌঁছে যাবে। সে লোক আরবী ভাষা ভাষী হোক কিংবা অন্য কোনো ভাষা ভাষী। কেননা আমরা কিছু পূর্বেও উল্লে­খ করেছি যে, বর্তমানে আগের তুলনায় দা‘ওয়াতী প্রচারণা খুবই সহজ হয়ে গিয়েছে রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র (ইন্টারনেট) সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের উদ্ভাবনের কারণে; যা পূর্বে সম্ভব ছিল না। এমনিভাবে ওয়ায়েজ, খতিব ও বক্তাদের উপরও অবশ্য কর্তব্য মাহফিল, সমাবেশ জুম‘আ ইত্যাদিতে সাধ্যমত আল্লাহর বিধান প্রচার করা, সাধ্য ও জ্ঞান অনুযায়ী আল্লাহর দ্বীন প্রচার-প্রসার করা।

বর্তমান সময়ে ইসলামী আকীদা বিরোধী নানাবিধ ষড়যন্ত্র, তাদের বিশ্বাসের মৌলিকত্ব বিনাশ, নাস্তিকতার দিকে আহ্বান, প্রতিপালক, রিসালাত ও পরকালকে অস্বীকার  এবং বহুদেশে খৃষ্টধর্মের দিকে দা‘ওয়াতের বহুবিধ কর্মসূচির বিস্তৃতিসহ বহু ভ্রান্ত আহ্বানের ব্যাপকতার কারণে দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ এযুগে সকল মুসলিমের উপর ব্যাপকভাবে ফরয হয়ে পড়েছে। সর্বস্তরের আলেম ও  ইসলামে বিশ্বাসী সকল শাসক-প্রশাসকের উপর অবশ্য পালনীয় ফরয হয়ে গিয়েছে যে, তারা নিজ নিজ সাধ্যমত লেখনি, বক্তৃতা, বিবৃতি এবং প্রচারযন্ত্রসহ সকল মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন প্রচার করবে। এতে গড়িমসি বা অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই, অন্য ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভর করারও অবকাশ নেই। বরং এক্ষেত্রে সহযোগিতা, অংশগ্রহণ ও পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো পূর্বের তুলনায় বর্তমানে আরো অধিক প্রয়োজন। কারণ ইসলামের শত্রুরা যাবতীয় উপায়-উপকরণাদির মাধ্যমে লোকদের দ্বীন থেকে দূরে সরানো, দ্বীন বিষয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি ও তাদের ধর্মের প্রতি অন্য ধর্মাবলম্বী বিশেষত:মুসলিমদের আকৃষ্ট করার উদ্দেশে একে অপরকে সাহায্য- সহযোগিতা ও কাঁধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।  সুতরাং তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে ইসলামপন্থীদেরও প্রয়োজন এসব ক্ষেত্রে তৎপর হওয়া এবং শত্রুদের এহেন ভ্রান্ত তৎপরতার ও দ্বীন-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের মোকাবেলায় সকল ক্ষেত্রে হকের দা‘ওয়াতকে জোরদার করতে সদা কর্মতৎপর থাকা, দ্বীনের প্রচার-প্রচারণাকে ব্যাপকতা দানের লক্ষ্যে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য গ্রহণ করে সকল পর্যায়ে দ্বীনের পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়ার ব্রত সম্পন্ন করা। দা‘ওয়াত কর্মে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর মাধ্যমে দা‘ওয়াতী কর্মসূচির ব্যাপকতা দান আল্লাহ কর্তৃক তাঁর বান্দার উপর ফরযকৃত আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতেরই অংশ।

 দ্বিতীয় বিষয়: দা‘ওয়াতের পন্থা ও পদ্ধতি

দা‘ওয়াতের পন্থা ও পদ্ধতি সম্পর্কে, তার প্রকৃতি ও ধরন সর্ম্পকে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্‌র হাদীসেও এ বিষয়টি এসেছে প্রকৃষ্টভাবে।

আল্লাহ তা‘আলা খুব স্পষ্টকরে বলেছেন:

﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ﴾ [النحل: ١٢٥]

‘তুমি তোমার রবের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দরতম পন্থায়’[23]

দা‘ওয়াত পদ্ধতি কি হবে এবং একজন দা‘ওয়াতী কর্মীকে  কি কি গুণ অর্জন করতে হবে যা সে দা‘ওয়াতি ময়দানে প্রয়োগ করবে উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সে দা‘ওয়াত শুরু করবে হিকমত ও পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবেচনায় বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে। এখানে হিকমত বলতে বুঝানো হয়েছে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণসমূহ যা স্বচ্ছ ও সন্তোষজনক পন্থায় হক্ব প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অসার ও বাতুলতাকে খণ্ডন করবে।

কতিপয় মুফাসি্সরের মতে, ‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমতের মাধ্যমে দা‘ওয়াত দিবে’ একথার অর্থ কুরআনের মাধ্যমে, কারণ কুরআনই হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের হিকমত, এর মধ্যে হক্ব ও সত্য সম্পর্কে খুবই স্বচ্ছতার সাথে পূর্ণাঙ্গরূপে বলা হয়েছে।

আবার কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন, কুরআন-হাদীস বর্ণিত দলিল প্রমাণাদির সাহায্যে।

যাই হোক হিকমত একটি তাৎপর্যময় অতি উচ্চ অর্থবোধক শব্দ যার মর্ম হচ্ছে, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সুস্পষ্ট প্রমাণ ও সত্যস্পষ্টকারী দলিলের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। এবং এটি সমার্থবোধক একটি শব্দ, নবুওয়ত, দ্বীনের বুঝ, বোধ-বিবেক, পরহেযগারী প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইমাম শাওকানীর বক্তব্য মতে মৌলিকত্বের বিবেচনায় হিকমতের অর্থ হচ্ছে, যে বিষয় মূর্খতা প্রসূত কার্যাদি থেকে বিরত রাখে সেটিই হিকমত। অর্থাৎ যেসব বক্তব্য, লেখনি কিংবা উক্তি আপনাকে নির্বুদ্ধিতা ও বাতুলতা থেকে রক্ষা করবে সেটিই হিকমত।

এমনি ভাবে প্রত্যেক স্পষ্ট কথা যা প্রকৃত অর্থেই শুদ্ধ সেটিই হিকমত। এসব বিবেচনায় কুরআনের আয়াত সর্বোত্তম হিকমত, এর পর সহীহ হাদীস এবং আল্লাহ উভয়টিকেই তাঁর মহান কিতাবে হিকমত বলে নামকরণও করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে,

﴿وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ﴾ [البقرة: ١٢٩]

‘এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত’। [সূরা আল-বাক্বারাহ্: ১২৯]

আয়াতে বর্ণিত হিকমত অর্থ সুন্নত। অন্য আয়াতে এসেছে,

﴿ يُؤۡتِي ٱلۡحِكۡمَةَ مَن يَشَآءُۚ وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِيَ خَيۡرٗا كَثِيرٗا﴾ [البقرة: ٢٦٩] 

“তিনি যাকে ইচ্ছে হেকমত দান করেন। আর যাকে হেকমত  প্রদান করা হয় তাকে তো প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়”[সূরা আল-বাকারাহ: ২৬৯]

অতএব সারকথা হল, সুস্পষ্ট শর‘য়ী দলিলাদিকে হিকমত বলা হয় এবং যেসব পরিস্কার ও স্পষ্ট কথা হক্ব বুঝতে ও গ্রহণ করতে সহায়তা করে তাও হিকমত। এ বিবেচনায় ঘোড়ার মুখে স্থাপিত লাগামকে ‘হাকাম’ বলা হয়। কারণ ঘোড়ার মালিক ‘হাকামা, (লাগাম) টেনে ধরলে ঘোড়া থামতে বাধ্য হয়ে যায়। ঐ হাকামাই তাকে চলা অব্যাহত রাখতে বাধা দেয়। একইভাবে ‘হিকমত’ ও এমনই কথা যা শ্রবণকারীকে বাতিলের পথে চলতে বাধা প্রদান করে, হক্ব ও সত্যের প্রতি প্রভাবিত করে তা গ্রহণ করতে প্রেরণা যোগায় এবং আল্লাহ নির্ধারিত সীমায় অবস্থান নিতে সাহায্য করে।

তাই দা‘ঈ ইলাল্লাহর দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহর দিকে আহ্বানের এ গুরু দায়িত্ব পালনকালে হিকমতের পথ অবলম্বন করা এবং দা‘ওয়াত কর্ম হিকমত দিয়েই শুরু করা, এর প্রতি বিশেষ যত্নবান  হওয়া। যদি দা‘ওয়াত প্রদত্ত ব্যক্তির মাঝে কোনো সংকীর্ণতা বা আপত্তি থাকে তাহলে উত্তম উপদেশের স্মরণাপন্ন হওয়া, উৎসাহব্যঞ্জক পবিত্র আয়াত ও হাদীসের উপদেশ দ্বারা দা‘ওয়াত পেশ করা। যদি কাঙ্খিত ব্যক্তি সন্দিহান হয়, তাহলে উত্তম পন্থায় বিতর্কের রাস্তা গ্রহণ করা এবং কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছার নিমিত্তে ধৈর্য ধারণ করা, তাড়াহুড়ো বা বল প্রয়োগ কিংবা রূঢ় আচরণের চিন্তা পরিহার করা। বরং সন্দেহ নিরসনের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে অব্যাহতভাবে এবং দলিলাদি উপস্থাপন করবে উত্তম পদ্ধতিতে।

হে আল্লাহর পথের দা‘ঈ! এভাবে আপনাকে হতে হবে সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল। কঠোরতা অবলম্বন করা যাবে না। কারণ এ পদ্ধতিই হচ্ছে, হক্বের মাধ্যমে উপকৃত হওয়া, হক্ব গ্রহণ করা এবং হক্বের দা‘ওয়াত দ্বারা পেশকৃত ব্যক্তিকে প্রভাবিত করার বেশি উপযোগী। (হে দা‘ঈ) আপনাকে আরও হতে হবে বিতর্ক-আলোচনায় ধৈর্যশীল। আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামকে ফির‘আউনের কাছে দা‘ওয়াত দানের জন্য প্রেরণকালে তার সাথে নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিলেন, অথচ সে ছিল সবচে বড় সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহ বলেন:

﴿ فَقُولَا لَهُۥ قَوۡلٗا لَّيِّنٗا لَّعَلَّهُۥ يَتَذَكَّرُ أَوۡ يَخۡشَىٰ ٤٤ ﴾ [طه: ٤٤]

‘তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে, অথবা ভয় করবে।[24]

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ বিষয়ে বললেন:

﴿ فَبِمَا رَحۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ وَلَوۡ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ ٱلۡقَلۡبِ لَٱنفَضُّواْ مِنۡ حَوۡلِكَۖ ﴾ [ال عمران: ١٥٩]

‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে আপনি তাদের জন্য নরম হয়েছিলে। আর যদি আপনি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত’।[25]

বুঝা গেল দা‘ওয়াতের প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতি এবং সঠিক পন্থা হলো, দা‘ঈকে প্রজ্ঞাপূর্ণ, দূরদর্শী হয়ে দা‘ওয়াত দানে প্রবৃত্ত হতে হবে। তাড়াহুড়ো ও বল প্রয়োগের মানসিকতা ত্যাগ করে হিকমতের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া। আর তা হচ্ছে, কুরআন ও হাদীসের প্রভাবপূর্ণ উপদেশ বাণীর মাধ্যমে দা‘ওয়াত পেশ করা। দা‘ওয়াত দানের ক্ষেত্রে দা‘ঈ আরও যে পদ্ধতি অবলম্বন করবে তা হচ্ছে,  উত্তম নসীহত বা উপদেশ প্রদান, আর বিতর্ক করার প্রয়োজন দেখা দিলে সেখানেও উত্তম আদর্শের স্বাক্ষর রাখা। এগুলোই হচ্ছে দা‘ওয়াত দানের পদ্ধতি দা‘ওয়াত দানের ক্ষেত্রে যার প্রতি খেয়াল রাখা আবশ্যক। কুরআন, হাদীস ও শরয়ী বিষয়ে অজ্ঞতা নিয়ে দা‘ওয়াত প্রদান ক্ষতিকারক ও অনোপকারী। -এবিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ একটু পরে দা‘ঈর আখলাক শীর্ষক অনুচ্ছেদে দেয়া হবে- কারণ দলিল প্রমাণ বিষয়ে অজ্ঞ থেকে দা‘ওয়াত প্রদান বিনা ইলমে আল্লাহর উপর কথা বলার নামান্তর। এমনিভাবে কর্কশ ভাষায়, বল প্রয়োগের মাধ্যমে দা‘ওয়াত প্রদানের ক্ষতিও অপরিসীম।

এ প্রসঙ্গে সূরা আন নাহলে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন করা অতি জরুরি। আর তা হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ﴾ [النحل: ١٢٥]

‘তুমি তোমার রবের দিকে আহ্বান কর হিকমতের মাধ্যমে’।[26]

তবে যদি দা‘ওয়াত পেশকৃত ব্যক্তি থেকে নির্যাতন, একগুঁয়েমি প্রকাশ পায় তাহলে তার উপর কঠোরতা করাতে বাধা নেই। যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱغۡلُظۡ عَلَيۡهِمۡۚ﴾ [التحريم: ٩]

‘হে নবী কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হন।[27]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,

﴿ ۞وَلَا تُجَٰدِلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡۖ﴾ [العنكبوت: ٤٦] 

“আর আহলে কিতাবদের সাথে উত্তম পদ্ধতি ব্যতীত বাক-বিতণ্ডা করবেন না, তবে তাদের মধ্যে যারা অন্যায় আচরণ করে সেটা ভিন্ন”[28]

 তৃতীয় বিষয়: দা‘ওয়াতের বিষয় বস্তু        

দা‘ওয়াত কর্মী বা দা‘ঈ লোক অপরকে কোন বিষয়ের প্রতি দা‘ওয়াত দিবে:

যে বস্তুর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া হবে, আর যে বিষয়টি আল্লাহর পথে আহ্বানকারীগণকে মানুষদের নিকট ব্যাখ্য-বিশ্লে­ষনসহ উপস্থাপন করতে হবে, যেমনটি করেছিলেন যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ,  সেটি হচ্ছে, ‘‘আল্লাহর সরল পথের দিকে দা‘ওয়াত’’। অন্যভাবে বললে ‘‘ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত’’। এটাই আল্লাহর সত্য ধর্ম এবং এটাই দা‘ওয়াত স্থল। যেমন আল্লাহ বলেছেন:

﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ﴾ [النحل: ١٢٥]

‘তুমি তোমার রবের পথের দিকে আহ্বান কর’। অতএব আল্লাহর পথ হল ইসলাম, এটাই সিরাতুল মুসতাকিম, এটা ঐ দ্বীন যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন স্বীয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। এদিকেই দা‘ওয়াত দেয়া ফরয। কোন মাযহাব, কোন ব্যাক্তির বিশ্বাস-মতবাদ নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের দিকে, সিরাতে মুস্তাকিমের দিকে, যা দিয়ে আল্লাহ স্বীয় নবী ও খলিল মুহাম্মদ আলাইহিসসালাতু ওয়াসসালামকে প্রেরণ করেছেন। এটাই কুরআনুল কারিম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হাদিস থেকে বুঝা যায়।

সিরাতে মুস্তাকিম তথা ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দানের ক্ষেত্রে গুরুত্বের ক্রমধারা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। তাই সর্বাগ্রে দা‘ওয়াত দিতে হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির প্রতি।

· এর মধ্যে সর্বপ্রথম দা‘ওয়াত হবে সহিহ আক্বিদাহর প্রতি, ইখলাস ও ইবাদত-উপাসনায় আল্লাহর তাওহীদের প্রতি, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের উপর ঈমান আনয়নের প্রতি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছুর সংবাদ দিয়েছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনয়নের তার প্রতি। এগুলোই সিরাতুল মুস্তাকিমের ভিত্তিমূল। এটিই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এর প্রতি দা‘ওয়াতের প্রতিভূ। ব্যাপকভাবে এর বিশে­ষণ করলে অর্থ এই দাড়ায়, তাওহীদ তথা একত্ববাদ ও ইখলাসের দিকে দা‘ওয়াত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমানের দিকে দা‘ওয়াত। এ ব্যাপকতার ভিতর ঐ সকল বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সংবাদ দিয়েছেন এবং যা ইতঃপূর্বে ঘটেছে আর যা কেয়ামতের পূর্বে ও পরে ঘটবে, আর শেষ যমানায় যা যা সংঘটিত হবে।

· একইভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ফরযকৃত বিষয়াবলী যেমন, নামায কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রোযা পালন করা ও আল্লাহর পবিত্র ঘরে হজ্জ করার প্রতি দা‘ওয়াত।

· আরও যুক্ত হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ, পবিত্রতা,  লেন-দেন, বিবাহ-তালাক, ভরণ পোষণ, যুদ্ধ-শান্তি অর্থাৎ সকল ব্যাপারে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করার প্রতি দা‘ওয়াত। কারণ আল্লাহর দ্বীন হচ্ছে ব্যাপক ও পরিপূর্ণ, ইহকাল ও পরকালে বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন ও কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে।

· আরো আহ্বান করবে উত্তম চরিত্র এবং সুন্দর কাজের দিকে, নিষেধ করবে অসৎ চরিত্র এবং খারাপ কাজ থেকে। সুতরাং তা হবে ইবাদাত (উপাসনা) ও ক্বিয়াদাত (নেতৃত্বদান)। একজন দা‘ওয়াত কর্মী একই সাথে ‘আবেদ (উপাসক) ও সেনাবাহিনীর কায়েদ (নেতা) হিসেবে গড়ে উঠবে।

· অনুরূপভাবে  দা‘ওয়াত ইবাদাত ও বিচার ব্যবস্থাকে শামিল করে, সুতরাং একজন দা‘ঈ যেভাবে নামায ও রোযা পালনকারী, তদ্রূপ সে আল্লাহর বিধান মত বিচারক ও আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়নকারীরূপে বিবেচিত হবে।

· এভাবেই দা‘ওয়াত ইবাদাত ও জিহাদকেও শামিল করে, সে হিসাবে একজন দা‘ঈ আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে এবং যে আল্লাহর দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।

· দা‘ওয়াত হল- কুরআন ও হাতিয়ার, সুতরাং দা‘ঈ কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, শক্তি সাহস দিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে আর যদি প্রয়োজন হয় অস্ত্র ব্যবহার করবে।

· দা‘ওয়াত হল- রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা, তাই দা‘ঈ একই সাথে আহ্বান করবে উন্নত চরিত্র, ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দিকে এবং মুসলিমদের মাঝে হৃদ্যতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতি দৃষ্টি দিবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ﴾ [ال عمران: ١٠٣]

‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।’[29]

সম্মানিত পাঠক! আমরা আপাত দৃষ্টিতে বিচার করলে দ্বীন ইসলামীর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাব যে, আল্লাহর দ্বীন ঐক্যের দিকে আহ্বান করে, প্রজ্ঞাপূর্ণ বিশুদ্ধ রাজনীতির দিকে আহ্বান করে, যা পারস্পরিক সম্পর্ক ও মিল সৃষ্টি করে অমিল ও বিচ্ছিন্নতা দূর করে। হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ করে দূরত্ব ও ভিন্নতা অপসারণ করে।

· ইসলামী জীবন বিধান আত্মার শুদ্ধিতা ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বকে সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানায়।

· আবেদন জানায় নেক ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতার, আল্লাহ ও বান্দার জন্য কল্যাণ কামনার।

· এমনি ভাবে আবেদন জানায় আমানত আদায় ও শরয়ী রীতি অনুযায়ী বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনার এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন নি এমন বিচার পরিহারের দিকে। যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ﴾ [النساء: ٥٨]

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানত তার হকদারের নিকট প্রত্যার্পণ করতে। এবং তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’[30]

· এমনিভাবে দা‘ওয়াত হল, রাজনীতি ও অর্থনীতি; যেমনিকরে এটি রাজনীতি, ইবাদত ও জিহাদ। তাই এটি আহ্বান জানায় সুষম শর‘য়ী অর্থনীতির দিকে। জুলুম নির্ভর পুজিবাদী অর্থনীতি নয়, যা বৈধতা ও শালীনতার ধার ধারে না, বরং মূল লক্ষ্য হচ্ছে যেকোন পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা। নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমের অর্থনীতিও নয়, যাতে মানুষের সম্পদের প্রতি প্রতি কোন শ্রদ্ধবোধ নেই তাদের উপর জুলুম-নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা-সংকোচ করে না। ইসলামী অর্থনীতি এর কোনটিই নয় বরং উভয় অর্থ ব্যবস্থার মাঝামাঝি, উভয় পথের মাঝামাঝি, দুইটি বাতিলের মাঝে একটি হক্ব-সঠিক পথ।

পাশ্চাত্য সমাজ সম্পদকে অনেক বড় করে দেখেছে তাই সম্পদ বৃদ্ধির অভিপায়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। সম্পদ জমা করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল পন্থায় চেষ্টা করেছে এমনকি আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ পন্থাও। অন্যদিকে প্রাচ্যের সোভিয়েতী নাস্তিক্য সমাজ এবং যারা তাদের মতবাদ অবলম্বন করেছে তারা মানুষের সম্পদের ন্যূনতম মর্যাদা দেয় নি বরং গণমানুষের সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের করে নিয়েছে; বৈধ করে নিয়েছে। এসব কাজ করতে তাদের বিবেক মোটেও বাধা দেয়নি। তারা জনসাধারণকে দাসে পরিণত করেছে, তাদের উপর নির্যাতন করেছে নির্দয়ভাবে। আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে, আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মসমূহকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতবাদ ছিল, لاإله، والحياة مادة ‘কোন ইলাহ নেই, সম্পদ বা বস্তুই জীবন’। এভাবে সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে তারা নীতি- নৈতিকতা নিয়ে ভাবে নি, অবৈধ উপায়ে আহরণের ব্যাপারে সামান্যতম দ্বিধাও করে নি। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে কোনরূপ কসুর করে নি। মানুষ ও  সম্পদ উপার্জন ও উপকৃত হওয়ার যে প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি আল্লাহ তাদের মধ্যে দিয়েছেন সে ব্যাপারটি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে নি। মানুষের মাঝে যে ক্ষমতা ও বিবেক ও তাদেরকে যে উপায়-উপকরণ আল্লাহ দিয়েছেন তা থেকে উপকৃত হতে সচেষ্ট হয় নি। সুতরাং তারা এটাও করে নি ওটাও করে নি।

ইসলাম জুলুম, প্রতারণা, সুদ ও অনৈতিক পন্থাকে এড়িয়ে অর্থনীতিতে সম্পদ উপার্জন ও সংরক্ষণের একটি বৈধ শরয়ী নীতি প্রবর্তন করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। যেমনি করে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা, যৌথ মালিকানাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এর স্বীকৃতি দিয়েছে আগেই। সুতরাং ইসলাম উক্ত দু’অর্থ ব্যবস্থার মধ্যবর্তী ব্যবস্থা। দু’অস্পষ্ট পন্থার মধ্যবর্তী পন্থা। ইসলাম সম্পদকে হালাল সাব্যস্ত করে তৎপ্রতি উৎসাহ দিয়েছে। প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতিতে উপার্জনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য এবং আরোপিত বিধানাবলির ব্যাপারে উদাসীন হবার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ﴾ [النساء: ٢٩] 

‘হে মু’মিনগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায় ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করো না’[31]

নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলেছেন:

«كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ، دَمُهُ، وَمَالُهُ، وَعِرْضُهُ»

‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের রক্ত, সম্পদ, সম্ভ্রম হারাম বা সম্মানিত আমানত (তা কোনোক্রমেই নষ্ট করা যাবে না)[32]

তিনি আরো বলেছেন:

«إنَّ دِمَاءَكُمْ وَأمْوَالَكُمْ وَأعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيْ شَهْرِكُمْ فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا.....»

‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ, সম্ভ্রম তোমাদের উপর এ সম্মানিত দিন এ সম্মানিত মাস এবং এ সম্মানিত শহরের মতই সম্মানিত’[33]

তিনি আরো বলেছেন:

«لَأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ أَحْبُلًا، فَيَأْخُذَ حُزْمَةً مِنْ حَطَبٍ، فَيَبِيعَ، فَيَكُفَّ اللَّهُ بِهِ وَجْهَهُ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النَّاسَ، أُعْطِيَ أَمْ مُنِعَ»

‘তোমাদের কেউ কিছু রশি সংগ্রহ করে, একটি লাকড়ির আঁটি সংগ্রহ করে বিক্রয়ের মাধ্যমে নিজের চেহারা তথা সম্ভ্রম রক্ষা করা লোকদের নিকট প্রার্থনা অপেক্ষা অতি উত্তম চাই লোকেরা দান করুন বা ফিরিয়ে দিক[34]।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন উপার্জন সবচেয়ে উত্তম, তিনি বললেন:

«عمل الرجل بيده وكل بيع مبرور»

“ব্যক্তির নিজ হাতের উপার্জন এবং প্রত্যেক বৈধ বেচা- কেনা[35]।”

তিনি আরো বলেছেন:

«مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ، خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ»

“নিজ হাতে উপার্জিত সম্পদ থেকে আহারের চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ নিজের উপার্জন থেকে আহার করতেন[36]।”

উপরোক্ত বিষয়গুলো আমাদের নিকট প্রচ্ছন্নভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামী অর্থব্যবস্থা মধ্যপন্থী অর্থব্যবস্থা। পাশ্চাত্য ও তাদের অনুসারীদের অন্যায় পূঁজিবাদও নয়, আবার নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমও নয়, যারা জনসম্পদকে নিজেদের সম্পদ জ্ঞান করেছে, সম্পদের প্রকৃত মালিকদের সম্মানকে অপদস্ত করেছে, কোনো ভ্রুক্ষেপই করে নি, সাধারণ জনগণকে দাসে পরিণত করেছে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হালাল জ্ঞান করেছে। পক্ষান্তরে (ইসলামে) সম্পদ উপার্জনের অধিকার আপনার রয়েছে তবে শরিয়ত অনুমোদিত পন্থায়ই তা হওয়া উচিত। আপনিই আপনার সম্পদের ও তা উপার্জনের অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি, তবে তা হতে হবে আল্লাহ প্রদর্শিত শরয়ী ও হালাল পথে।

ইসলাম তার অনুসারীদের ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, পর হিতাকাংখিতা ও অপর মুসলিমকে সম্মান প্রদর্শনের প্রতি আহ্বান জানায় এবং হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতাসহ যাবতীয় অসদাচরণ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ ﴾ [التوبة: ٧١] 

‘আর মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা হচ্ছে পরস্পর একে অপরের বন্ধু,[37]

﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ﴾ [الحجرات: ١٠]

‘নিশ্চয় মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই’[38]

নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলেন:

«المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يحقره ولا يخذله»

এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে না, তাকে নিরাশ করে না...।

অতএব মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে অপর মুসলিম ভাইকে সম্মান করা, তুচ্ছ জ্ঞান না করা, তার প্রতি ন্যায়বিচার করা এবং শরিয়তসম্মত তার সকল অধিকার প্রদান করা। এসব দায়িত্ব পালন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«إِنَّ المُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا»

“নিশ্চয় একজন মুমিন অপর মুমিনের সাথে যেন একটি স্থাপনা যার একাংশ অপর অংশকে শক্ত করে ধরে রাখে”[39]

তিনি আরও বলেন,

« «الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ»

‘মুমিন মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ; আর মুমিন মুমিনের ভাই[40]

প্রিয় ভাই! আপনি আপনার মুমিন ভাইয়ের আয়না। ঈমানী ভ্রতৃত্বের বন্ধন যে ভীতের উপর প্রতিষ্ঠিত আপনি তার একটি ইট। আপনার ভাইয়ের অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন, তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হোন। তার সাথে হক, কল্যাণ ও সততার সাথে লেন-দেন করুন। আপনার একান্ত কর্তব্য হল ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরা। কিছু অংশ গ্রহণ করলেন আর বাকি অংশ ছেড়ে দিলেন; এমনটি হলে চলবে না। আক্বীদা গ্রহণ করলেন আর  আহকাম ও আমল ছেড়ে দিলেন কিংবা আহকাম ও আমল গ্রহণ করলেন আর আক্বিদা ছেড়ে দিলেন এমন যেন না হয়। বরং পুরো ইসলামকে গ্রহণ করুন; আক্বিদা, আমল, ইবাদত, জিহাদ, সামাজিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছু। অর্থাৎ ইসলামকে গ্রহণ করুন সামগ্রিকভাবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱدۡخُلُواْ فِي ٱلسِّلۡمِ كَآفَّةٗ وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ٢٠٨ ﴾ [البقرة: ٢٠٨]

‘হে মু’মিনগণ, তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবিষ্ট হও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’[41]

সালাফে সালেহীনদের একটি বৃহৎ দল এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন: এর অর্থ হল তোমরা পূর্ণাঙ্গ ‘নিরাপত্তা’ তথা ইসলামের মাঝে প্রবেশ কর।

ইসলামকে ‘নিরাপত্তা’ বলা হয়েছে, কারণ এটা নিরাপত্তার পথ, ইহকাল ও পরকালে মুক্তির পথ। সুতরাং এটা নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পন। ইসলাম রক্তের হেফাযত করে, মানবতাকে নিরাপত্তার দিকে আহ্বান করে, এ জন্যই নির্ধারিত দন্ডবিধি, কেসাস, ও সত্যিকার জিহাদের প্রবর্তন করেছে (এরই মাধ্যমে বিরত রাখে রক্তপাত ও হানাহানি হতে)। অতএব এটা নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পন, নিরাপত্তা ও ঈমান তথা সার্বিক স্বীকৃতি।

এজন্য আল্লাহ বলেছেন: ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّة অর্থাৎ ইসলামের সকল শাখায় প্রবেশ কর, কিছু গ্রহণ আর কিছু বর্জন এমনটি যেন না হয়। বরং তোমাদের কর্তব্য পুরো ইসলামকে আঁকড়ে ধরা। وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ‘‘আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না’’ অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ গুনাহ ও অবাধ্যতার রাস্তা গ্রহণ করো না। কারণ শয়তান  গুনাহ ও অবাধ্যতার দিকে ডাকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে। অতএব দেখা যাচ্ছে শয়তান হচ্ছে সবচে’ বড় শত্রু, তাই প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে আঁকড়ে ধরা, তার যাবতীয় বিধি-বিধান নিয়মিত পালন করে চলা এবং আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধরা। একই সাথে মতবিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার কারণসমূহ হতে দূরে থাকা। সুতরাং একজন মুসলিম হিসেবে আপনার করণীয় হচ্ছে, ইবাদাত-বন্দেগি, লেন-দেন, আচার-আচরণ, বিবাহ-তালাক, ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন এক কথায় মানবীয় সব কার্যাদি সম্পাদন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর শরিয়ত পরিপূর্ণ রূপে মেনে চলা, শরিয়তের বিধি-বিধান মতে কাজ করা। এমনিভাবে শরিয়ত নির্ধারিত বিধি মেনে চলার ব্যাপারে যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা, শত্রু ও মিত্র মোট কথা সকল ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান সব ক্ষেত্রেই কার্যকর করা জরুরি, একজন আপনার মতের সাথে একমত পোষণ করেছে তাই তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন আর অন্যজন ভিন্নমত পোষণ করায় তার সাথে বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করবেন এটি কিন্তু কোনভাবেই ন্যায় সঙ্গত নয়। সুতরাং আপনাকে এসব ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। লক্ষ্য করে দেখুন, নবী সহচরবৃন্দের জীবনাচারের দিকে, কত মাসআলাতেই না তারা পরস্পর মতভিন্নতায় উপনীত হতেন অথচ এত কিছুর পরও তাদের মাঝে কি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থেকেছে। মাসআলা ও সিদ্ধান্তগত মতবিরোধের কারণে পারস্পরিক সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়ে নি। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন, আর তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন।

সুতরাং মুমিন তার সার্বিক জীবন পরিচালনা করবে আল্লাহর বিধান মত। দ্বীনের হক সিদ্ধান্তের অনুকূলে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যুক্তি প্রমাণসহ দ্বীনকে সবার সামনে তুলে ধরবে। তবে দলিল প্রমাণ উহ্য এ ধরণের ইজতেহাদী বিষয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণের কারণে কোনোক্রমেই যেন অন্য ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করতে প্ররোচিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে খুবই সচেতনতার সাথে।

এমনিভাবে ঐ সব মাসআলাতেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেখানে আয়াত বা হাদীসের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হওয়ার অবকাশ রয়েছে। কারণ এ ওজর গ্রহণযোগ্য। তাই আপনার কর্তব্য হচ্ছে তার কল্যাণ কামনা করা, তার মঙ্গলের চিন্তা করা। এসমস্ত কারণে আপনাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ যাতে সৃষ্টি না হতে পারে সে সম্পর্কে সজাগ থাকা। কোনো শত্রু যেন আপনার বা আপনার ভাইয়ের উপর চড়াও না হতে পারে সে দিকেও খেয়াল রাখা। ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’।  

ইসলাম ইনসাফের দ্বীন, হক এবং কল্যাণ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার দ্বীন, যেগুলো আল্লাহ ব্যতিক্রম ঘোষণা করেছেন সেগুলো ব্যতীত ইসলাম সাম্যের দ্বীন। এতে রয়েছে সর্বপ্রকার মঙ্গলের আহ্বান, উন্নত চরিত্রের প্রতি আহ্বান, সুন্দর কাজের প্রতি আহ্বান, ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রতি আহ্বান এবং সকল অশ্লীল আচার-আচরণ থেকে দূরে থাকার আহ্বান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ وَإِيتَآيِٕ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَيَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِ وَٱلۡبَغۡيِۚ يَعِظُكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ٩٠ ﴾ [النحل: ٩٠]

‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও নিকটাত্মীয়- পরিজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং নিষেধ করেন অশ­ীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘনকে, তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।’[42] আরও বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣ ﴾ [الحجرات: ١٣]

‘হে লোকসকল! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।’[43]

সারকথা: ইসলামের দা‘ওয়াত প্রদানকারী (‘দা‘ঈ’) এর উচিত পরিপূর্ণ ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দেয়া, মানুষের মাঝে কোন পার্থক্য ভেদাভেদ না করা। গোঁড়ামি করে এক মাযহাবকে বাদ দিয়ে অন্য মাযহাবের, কিংবা কোন গোত্রকে বাদ দিয়ে অন্য গোত্রের, অথবা কোন নেতা বা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে অন্য নেতা বা ব্যক্তির পক্ষপাতিত্ব না করা। বরং তার লক্ষ্য হবে হক প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্লেষণ করা এবং মানুষদেরকে এর উপর অবিচল রাখা যদিও এটা করতে গিয়ে কারো কোনো মতামতের বিরোধিতা হয়।

যখন মানুষের মাঝে মতবাদ ও মাযহাবের প্রতি গোঁড়ামির ধারা শুরু হয় তখন তাদের কেউ কেউ এমনও বলে যে, অমুকের মাযহাব অমুকের মাযহাব হতে উত্তম, এতে করে মতবিরোধ ও দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে অবস্থা এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, কতিপয় মানুষ ভিন্ন মাযহাবালম্বী ইমামের ইমামতিতে নামায পড়ে না। শাফেয়ি মাযহাবের লোক হানাফি ইমামের পেছনে নামায় পড়ে না, অনুরূপভাবে হানাফি লোক মালেকি ও হাম্বলি ইমামের পেছনে। এমনটি উগ্রপন্থী-গোঁড়া লোকদের পক্ষ হতে হয়ে থাকে। এটা একটা বিশাল সমস্যা বরং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ। কারণ, সকল ইমামই হেদায়েতের পথ প্রদর্শক। ইমাম শাফে‘য়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আওযা‘ঈ, ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়াইহ প্রমুখ সকলেই হেদায়েতের পথ প্রদর্শক ও হকের দা‘ঈ হিসাবে স্বীকৃত। তারা মানুষদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান করেছেন, হকের দিকে পথনির্দেশ করেছেন। দা‘ওয়াতের এ গুরু দায়িত্ব সম্পাদন ক্ষেত্রে তারা অনেক জটিল জটিল বিষয়াদির সম্মুখীন হয়েছেন। সমাধান খুঁজতে গিয়ে দলিল প্রমাণ অস্পষ্ট থাকার কারণে পারস্পরিক মতভিন্নতায় পতিত হয়েছেন। এ ইজতেহাদের ক্ষেত্রে তারা হয়তো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ, যার ফলে দ্বিগুণ সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন, নয়তো ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ যাতে একগুণ সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন। তাহলে ইসলামের স্বীকৃত ইমামবৃন্দ সকলেই (সঠিক করুক বা ভুল) সাওয়াবের অধিকারী হয়েছেন। সুতরাং আপনার উচিত তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিজ মনে প্রতিষ্ঠিত করা, তাদের প্রতি রহমতের দো‘আ করা, তারা ইসলামের ইমাম, হেদায়েতের দিকে আহ্বানকারী ও সত্যান্বেষী বলে বিশ্বাস করা। তবে এ শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস যেন আপনাকে উগ্রতা, গোঁড়ামী ও অন্ধানুকরণের দিকে নিয়ে না যায় (যে বলবেন অমুকের মাযহাব সর্বাবস্থায় হক হওয়ার উপযোগী, অথবা অমুকের মাযহাব সর্বক্ষেত্রে সঠিক, ভুল করেই না, (না) এটা অবশ্যই ভুল।

আপনার দায়িত্ব হচ্ছে হক ও সত্য আঁকড়ে ধরা এবং দলিল পাওয়া গেলে হকের অনুসরণ করা, এতে অমুক বা অমুকের বিরোধিতা হলেও। অনুরূপভাবে গোঁড়ামি ও কারো অন্ধানুকরণ না করা। বরং  ইমামগণের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে সচেতন থাকুন, স্ব স্থানে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দান করুন। তবে নিজ দ্বীন সম্পর্কে সর্বাধিক সতর্ক-সচেতন থাকুন। তাই হককে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করুন, যদি আপনার নিকট কেউ হক সম্পর্কে জানতে চায় তবে সঠিক পথনির্দেশ করুন। মহান আল্লাহকে ভয় করবেন, তাঁর অস্তিত্বের কথা সর্বাবস্থায় মনে জাগরুক রাখুন। এ বিশ্বাস রাখবেন যে হক একটাই। আর মুজতাহিদগণ যদি সঠিক করেন তাহলে দ্বিগুণ সাওয়াব আর ভুল করলে একগুণ। তবে এখানে আমরা মুজতাহিদ বলতে বুঝাচ্ছি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মুজতাহিদগণকে, যারা দ্বীন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ঈমান ও হিদায়াতের উপর অবিচল। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

 দা‘ওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

দা‘ওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে (গোমরাহীর) অন্ধকার থেকে বের করে (হেদায়াতের) আলোয় নিয়ে আসা।  হকের দিকে পথনির্দেশ করা যাতে তারা তা নিজেদের মাঝে ধারণ করতে পারে এবং জাহান্নাম ও আল্লাহর ক্রোধ হতে বাঁচতে পারে।

অনুরূপভাবে কাফেরদেরকে কুফরির অমানিশা থেকে বের করে হেদায়াতের নূর, অজ্ঞদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলো এবং পাপীদেরকে পাপের কৃষ্ণতা থেকে মুক্ত করে আনুগত্যের দ্যূতির দিকে নিয়ে আসা। দা‘ওয়াতের মূল উদ্দেশ্য এটিই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿ ٱللَّهُ وَلِيُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۖ﴾ [البقرة: ٢٥٧]

‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।’[44]

রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন মানুষদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনার জন্যে। এমনিভাবে হকের দা‘ঈগণও দা‘ওয়াতী কর্মে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন, আল্লাহর বান্দাদেরকে অন্ধকার হতে আলোয় নিয়ে আসার জন্যে, জাহান্নাম ও শয়তানের অনুসরণ এবং প্রবৃত্তি পূজা থেকে উদ্ধার করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের উদ্দেশ্যে।

 চতুর্থ বিষয়: দা‘ঈর জন্য আবশ্যকীয় চরিত্র ও গুণাবলির বিবরণ:

দা‘ওয়াতী ময়দানে সফল হবার জন্যে একজন দা‘ওয়াত কর্মী তথা দা‘ঈর যেসব গুণাবলি থাকা প্রয়োজন; আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সেসব বিষয় নানাভাবে উল্লে­খ করেছেন। তন্মধ্য এখানে কিছু উল্লে­খ করা হলো,

 প্রথমত: ইখলাস বা আন্তরিক হওয়া:

একজন দা‘ঈর জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয় হচ্ছে আল্লাহর জন্য আন্তরিক হওয়া। লোক দেখানো, খ্যাতি লাভ, প্রশংসা কুড়ানোর মনোবৃত্তি তার উদ্দেশ্য হওয়া কাম্য নয়। দা‘ঈ মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য। আল্লাহ বলেন:

﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ ﴾ [يوسف: ١٠٨]

‘তুমি বলঃ এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি’[45]। মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿ وَمَنۡ أَحۡسَنُ قَوۡلٗا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ﴾ [فصلت: ٣٣]

‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে।’[46]

সুতরাং দা‘ঈ হিসাবে আপনার কর্তব্য হচ্ছে দা‘ওয়াত কর্মে ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর জন্য নিষ্ঠা সহকারে তা সম্পন্ন  করা। এটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, এটাই হচ্ছে বড় গুণ, দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে যার প্রয়োজন সর্বাধিক। দা‘ওয়াতি কাজে আপনার কামনা হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের সফলতা।

দ্বিতীয়ত: দা‘ওয়াত হতে হবে জ্ঞান ভিত্তিক। যে বিষয়ে আপনি দা‘ওয়াত দিবেন সে বিষয়ে আপনার পূর্ণ বুৎপত্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। সে সম্পর্কে আপনার অজানা থাকা চলবে না।

﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ ﴾ [يوسف: ١٠٨]

‘তুমি বল: এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সম্পূর্ণ জেনে-বুঝে।[47]

অতএব জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনিস্বীকার্য। ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরয করা হয়েছে, অজ্ঞতায় থেকে দা‘ওয়াত দেয়া থেকে সাবধান। না জানা বিষয়ে কথা বলা থেকে সাবধান। অজ্ঞ-মূর্খরা বিনাশ করে, গঠন করতে পারে না। নষ্ট করে, সংশোধন করে না। হে আল্লাহর বান্দা আল্লাহকে ভয় করুন, আল্লাহ সম্পর্কে না জেনে কথা বলা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। একটি বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা না নিয়ে অপরকে দা‘ওয়াত দিবেন না। আর প্রকৃত জ্ঞান তো সেটিই যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বলেছেন। সুতরাং সচেতন ও জ্ঞানবান হওয়া জরুরি।

একজন শিক্ষার্থী ও দা‘ওয়াত কর্মীর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, যে বিষয়ে দা‘ওয়াত দিচ্ছে তা নিরীক্ষণ করা, বিষয়বস্তু ও দলীলের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা। যদি বিষয়বস্তুর সত্যতা সুস্পষ্ট ও বোধগম্য বলে অনুভূত হয় তবেই কেবল দা‘ওয়াত দিবে। সেটি বাস্তবায়নধর্মী হোক কিংবা বর্জনধর্মী। সুতরাং বিষয়টি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যধর্মী হয় তাহলে বাস্তবায়ন করার জন্য আহ্বান করবে, আর যদি আল্লাহ বা রাসূল কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় তাহলে পরিত্যাগ করার প্রতি দা‘ওয়াত দিবে, তবে করতে হবে সম্পূর্ণরূপে দলীল-প্রমাণ ও জ্ঞানের ভিত্তিতে।

তৃতীয়ত: দা‘ওয়াত কর্মী বা দা‘ঈ হিসাবে আপনাকে অতিমাত্রায় সহনশীল ও কোমল মনোভাবাপন্ন হতে হবে। হতে হবে পরমত সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল। যেমনটি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাড়াহুড়ো, কঠোরতা ও রূঢ় নীতি গ্রহণ করা হতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কঠিনভাবে। এ প্রসঙ্গে আমরা পূর্বেও বেশ কয়েকটি দলিল উপস্থাপন করে বিষয়টির বিশ্লে­ষনের চেষ্টা করেছি। যেমন:

﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ﴾ [النحل: ١٢٥]

 ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর উত্তম পন্থায়।’[48]

আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামকে যখন ফির‘আউনের কাছে দা‘ওয়াত দানের উদ্দেশ্যে পাঠালেন তখন তাদেরকে ফেরাউনের সাথে সাথে নম্র্তা বজায় রেখে কথা বলার জন্য আদেশ করলেন, অথচ সে ছিল সবচে’ বড় সীমালঙ্ঘনকারী।

আল্লাহ বলেন:

﴿ فَقُولَا لَهُۥ قَوۡلٗا لَّيِّنٗا لَّعَلَّهُۥ يَتَذَكَّرُ أَوۡ يَخۡشَىٰ ٤٤ ﴾ [طه: ٤٤]

‘তোমরা তার সাথে কোমল কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে, অথবা ভয় করবে।[49]

এ ছাড়াও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়ে বললেন:

﴿ فَبِمَا رَحۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ وَلَوۡ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ ٱلۡقَلۡبِ لَٱنفَضُّواْ مِنۡ حَوۡلِكَۖ﴾ [ال عمران: ١٥٩]

‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে আপনি তাদের জন্য কোমল হয়েছিলেন। আর যদি আপনি হতেন কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত’।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«اللهم من ولي من أمر أمتي شيئا فرفق بهم فارفق به و من ولي من أمر أمتي شيئا فشق عليهم فاشقق عليه». خرجه مسلم في الصحيح

‘হে আল্লাহ! যার উপর আমার উম্মতের কোনো দায়িত্ব অর্পিত হল এবং সে তাদের উপর সদয় আচরণ করল আপনি তার প্রতি সদয় ব্যবহার করুন, আর যার উপর আমার উম্মতের কোনো দায়িত্ব অর্পিত হল এবং সে তাদের প্রতি নির্দয় আচরণ করল, আপনিও তার প্রতি নির্দয় আচরণ করুন।’[50]

সুতরাং হে আল্লাহর বান্দা! তাই আপনার উপর কর্তব্য হচ্ছে,  দা‘ওয়াত কর্মে কোমল হওয়া, মানুষের উপর কঠোর হবেন না। তাদেরকে দ্বীন থেকে বীতশ্রদ্ধ করবেন না। আপনার রূঢ় আচরণ ও অজ্ঞতার দ্বারা, কঠোর-কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর আচার-আচরণের মাধ্যমে তাদেরকে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন না। আপনাকে ধৈর্য ও সহনশীল হতে হবে। হতে হবে নেতৃত্বে সাবলীল, কোমল কথা ও উত্তম বাণীসম্পন্ন। যাতে আপনার মুসলিম ভাইয়ের অন্তরে প্রভাব পড়ে, আর যাতে ‘মাদউ’ অর্থাৎ যাকে দা‘ওয়াত দিচ্ছেন তার অন্তরে দাগ কাটে, আর যাতে সে আপনার দা‘ওয়াতের প্রতি উৎসুক হয় এবং সেটার জন্য কোমল হয়, আর  সেটা দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেটার জন্য আপনার প্রশংসা করে, সেটার উপর আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। মনে রাখবেন রূঢ়তা অপরকে নিজ হতে বিচ্ছিন্ন করে-দূরে ঠেলে দেয়, কাছে আনে না। পৃথক করে দেয়, একত্রিত করে না।

দা‘ঈর জন্য বাঞ্ছনীয় বরং আবশ্যক গুণাবলীর মধ্যে এটিও একটি যে, লোকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি দা‘ওয়াত দিবে নিজের মধ্যে আগে তা বাস্তবায়ন করবে। তাকে সে বিষয়ে ‘কুদওয়া’ তথা  আদর্শ হতে হবে। এমন হওয়া চলবে না, যে অপরকে হকের দা‘ওয়াত দিল, কোন ভাল কাজ করতে বলল আর নিজে তা থেকে দূরে সরে রইল অথবা  কোন বিষয়ে নিষেধ করল  এরপর  নিজে তাতে জড়িয়ে পড়ল। এটা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কাজ।

মূলত: সফল মুমিন ও স্বার্থক দা‘ঈ তারাই, যারা আহ্বানকৃত বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল থেকে- নিজেরা আমল করে বরং এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর থাকে, আর নিষেধকৃত বিষয়াদি হতে নিজেরা দূরে থাকে এবং বর্জনের দিক দিয়ে অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفۡعَلُونَ ٢ كَبُرَ مَقۡتًا عِندَ ٱللَّهِ أَن تَقُولُواْ مَا لَا تَفۡعَلُونَ ٣ ﴾ [الصف: ٢،  ٣]

‘হে মু’মিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা বল কেন? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা, আল্লাহর নিকট অতিশয় অসন্তোষজনক।’[51]

আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহুদীদের ভৎর্সনা করেছেন যে, তারা মানুষকে কল্যাণের কথা বলে, অথচ নিজেদের ভুলে থাকে:

﴿ ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٤٤ ﴾ [البقرة: ٤٤]

‘তবে কি তোমরা লোকদেরকে সৎকার্যে আদেশ করছো এবং তোমাদের নিজেদের ভুলে যাচ্ছ- অথচ তোমরা গ্রন্থ পাঠ কর; তবে কি তোমরা হৃদয়ঙ্গম করছো না?’[52]

বিশুদ্ধ সনদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম হতে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেয়ামতের দিন একজন লোককে নিয়ে আসা হবে, এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, অত:পর তার পেটের নাড়ীভূড়ী বেরিয়ে আসবে, তাতে সে  ঘোরতে থাকবে যেমন গাধা চাক্কি নিয়ে ঘোরে, এরই মাঝে জাহান্নামিরা একত্র হবে এবং তাকে বলবে; হে অমুক তোমার কি হয়েছে? তুমি কি আমাদের সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে না? সে বলবে হ্যাঁ, আমি তোমাদের সৎকাজের কথা বলতাম, তবে আমি নিজে তা করতাম না, অসৎ কাজে নিষেধ করতাম এবং নিজে করতাম।’ এ হচ্ছে ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে মানুষকে ভাল কাজের দিকে আহ্বান করে ও খারাপ কাজে নিষেধ করে। অতঃপর তার কথা কাজের এবং কাজ কথার বিপরীত হয়। আল্লাহর কাছে আমরা এ অবস্থা থেকে আশ্রয় কামনা করছি।

সুতরাং সকলের নিকট স্পষ্ট হল যে একজন দা‘ঈর জন্য যে সব গুণাগুণ থাকতে হবে তার মধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মানুষকে যে বিষয়ের দা‘ওয়াত দিবে তা আগে নিজে আমল করা এবং যা  নিষেধ করবে তা থেকে সর্বাগ্রে নিজে বিরত থাকা। তাকে প্রশংসনীয় চরিত্রের অধিকারী, ধৈর্যশীল, বিপদে অবিচল, ও দা‘ওয়াত কর্মে আন্তরিক হতে হবে। যে সব কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয়, হক তাদের নিকট দ্রুত পৌঁছে যায় এবং বাতিল দূর হয় সেসব কাজের জন্য চেষ্টা করা। উপরন্তু তাদের হিদায়াতের জন্য দো‘আ করা। এ সবই হচ্ছে একজন আদর্শ দা‘ঈর আখলাকের অংশ।

দা‘ওয়াত কর্মীকে আরও একটি বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। আর তা হচ্ছে, দা‘ওয়াত পেশকৃত ব্যক্তির জন্যে দো‘আ করা। বলবে:

هَدَاكَ الله. ‘আল্লাহ তোমাকে হিদায়াত দিন’

وَفَّقَكَ اللهُ لِقُبُوْلِ الحَقِّ. ‘আল্লাহ তোমাকে হক গ্রহণের তাওফিক দিন।’

أعَانَكَ اللهُ على قُبُوْلِ الْحَقِّ আল্লাহ তোমাকে হক গ্রহণে অনুগ্রহ করুন।

তাকে দা‘ওয়াত দিবেন, দিক-নির্দেশনা দিবেন, সে কোন কষ্ট দিলে সহ্য করবেন, সাথে সাথে তার জন্য হিদায়েতের দো‘আ করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন ‘দাউস’ গোত্র সম্পর্কে বলা হল, যে তারা দ্বীন অমান্য করেছে, তিনি বললেন:

«اللهم اهدِ دوساً وائت بهم»

‘হে আল্লাহ, দাউসদেরকে হিদায়াত দাও এবং তাদের দ্বীনের পথে নিয়ে আস’। তার হেদায়াতের জন্য, হক গ্রহণ করার তাওফীক লাভের জন্য দো‘আ করবেন, এর উপর ধৈর্যধারণ করবেন, অপরকে ধৈর্যের উপর অবিচল থাকবেন, কখনও নিরাশ ও হতাশ হবেন না। ভালো ও কল্যাণকর ছাড়া অন্য কিছু বলবেন না, কোন কঠোরতা বা তিরস্কার করবেন না। তাদের প্রতি কোনো খারাপ কথা বলবেন না; যাতে হক গ্রহণে তাদের মধ্যে ঘৃণার উদ্রেক হয়। তবে হ্যাঁ কেউ জুলুম বা সীমা লঙ্ঘন করলে ভিন্ন কথা। যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ ۞وَلَا تُجَٰدِلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡۖ ﴾ [العنكبوت: ٤٦]

‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী....’[53]

সুতরাং অত্যাচারী ব্যক্তি যে বিদ্বেষ, কষ্ট ও অনাচারের মাধ্যমে দা‘ওয়াতকে প্রতিহত করতে চায় তার বিধান ব্যতিক্রম। তাকে এর জন্য গ্রেফতার ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। আর এ শাস্তি অত্যাচার বা অন্যায়ের আনুপাতিক হারে হবে। কিন্তু যতক্ষণ সে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে ততক্ষণ আপনার উপর কর্তব্য হবে তার উপর ধৈর্যধারণ করা এবং সওয়াবের আশা করা, আর উত্তম পদ্ধতিতে তার সাথে বিতর্ক করা, আপনার ব্যক্তির সাথে যে সকল কষ্টদায়ক বিষয় সে সম্পৃক্ত করে দেয় তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দেওয়া, যেমন ধৈর্যধারণ করেছিলেন রাসূল ও তাদের উত্তম অনুসারীগণ।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা,  হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে আপনার রাস্তায় উত্তমভাবে দা‘ওয়াত দেয়ার তাওফীক দিন। আমাদের অন্তরসমূহ ও আমাদের কর্মকাণ্ডগুলো সংশোধন করে দিন। আমাদের সকলকে দ্বীনের বিশুদ্ধ ফিকহ তথা বুঝ দান করুন। দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন। আমাদেরকে হিদায়াতপ্রাপ্ত ও হিদায়েতের পথপ্রদর্শক- নেককাজ কারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। নিশ্চয়ই আপনি বড় দয়ালু, মহান দাতা।

সালাত ও সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবীগণ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা উত্তমভাবে তাঁর অনুসরণ করবে তাদের সকলের উপর।

সমাপ্ত



[1] যারিয়াত, ৫৬।

[2] বাকারাহ, ২১।

[3] সূরা ত্বালাক্ব, ১২।

[4] সূলা নাহল ৩৬।

সূরা  আম্বিয়া, ২৫।

[6] সূরা হাদীদ, ২৫।

[7] সূরা বাক্বারা, ২২৫।

[8] সূরা নিসা, ১৬৩।

[9] সূরা নাহাল, ৬৪।

[10] সূরা আনআম, ৩৩।

[11] সূরা বাকারাহ ,২১।

[12] সূরা ইসরা, ২৩

[13] সূরা ফাতিহা, ০৫।

[14] সূরা জ্বীন, ১৮।

[15] সূরা আনআম, ১৬২-১৬৩।

[16] সূরা সাজদাহ, ২৪।

[17] সূরা আলে ইমরান, ১০৪।

[18] সূরা নাহল:১২৫

[19] সূরা কাসাস, ৮৭।

[20] সূরা ইউসুফ, ১০৮।

[21] সূরা আহযাব, ২১।

[22] সূরা আলে ইমরান:১০৪

[23] সূরা নাহল, ১২৫।

[24] সূরা ত্বাহা, ৪৪।

[25] সূরা আলে ইমরান:১৫৯

[26] সূরা আন-নাহল:১২৫

[27] সূরা আত-তাহরীম: ৯।

[28] সূরা আল-আনকাবূত: ৪৬।

[29] সূরা আলে ইমরান:১০৩

[30] সূরা নিসা:৫৮

[31] সূরা নিসা, ২৯।

[32] মুসলিম: ২৫৬৪।

[33] বুখারী : ৬৭।

[34] বুখারী : ২৩৭৩।

[35] মুসনাদে আহমাদ ৪/১৪১।

[36] বুখারী : ২০৭২।

[37] সূরা তাওবা, ৭১।

[38] সূরা হুজরাত, ১০।

[39] বুখারী : ৪৮১।

[40] আবু দাউদ: ৪৯১৮।

[41] সূরা রাকারা, ২০৮।

[42] সূরা নাহল: ৯০।

[43] সূরা হুজুরাত:১৩।

[44] সূরা বাকারা. ২৫৭।

[45] সূরা ইউছুফ, ১০৮।

[46]  হা-মীম আসসাজদাহ, ৩৩।

[47] সূরা ইউসুফ: ১০৮।

[48] সূরা নাহল, ১২৫।

[49] সূরা ত্বাহা, ৪৪।

[50] মুসলিম।

[51] সূরা সাফফ:২-৩।

[52] সূরা বাকারা:৪৪।

[53] সূরা আনকাকুত, ৪৬।