ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (২)
লেখকবৃন্দ : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া - আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান - কামাল উদ্দীন মোল্লা
সম্পাদনা: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া - আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
বর্ণনা
ঈমান: মুসলিম হিসেবে একজন ব্যক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়, সে মুমিন বান্দা। আত্মায়-কলবে, মানবীয় আচরণের যাবতীয় অনুষঙ্গে যে ব্যক্তি ঈমান আনয়ন ও রূপায়নে অভিলাষী, তার প্রথমে ঈমানের যাবতীয় দিক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ অবগতি প্রয়োজন। প্রবন্ধটি এমন অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য ঈমানের অপরাপর অঙ্গসমূহ অর্থাৎ রাসূলদের উপর ঈমান, কিতাবের ওপর ঈমান, আখেরাতের ওপর ঈমান এবং তাকদীরের ওপর ঈমানের পদ্ধতি ও উপকারিতা তুলে ধরছে।
- 1
DOCX 5.5 MB 2019-05-02
- 2
PDF 626 KB 2019-05-02
সম্পূর্ণ বিবরণ
ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (২)
الإيمان (2)
< বাংলা - بنغالي - Bengali >
অনুবাদক: কামাল উদ্দীন মোল্লা
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ترجمة: كمال الدين ملا
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (২)
চতুর্থত: নবী ও রাসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন:
প্রথম রাসূল নূহ আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন :
﴿إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ﴾ [النساء: ١٦٣]
“আমরা আপনার প্রতি অহী পাঠিয়েছি, যেমন করে অহী পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং সে সমস্ত নবী রাসূলের প্রতি যারা তার পরে প্রেরিত হয়েছেন।" [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৩] এবং শেষ নবী ও রাসূল হলেন আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
দলীল: আল্লাহর বাণী:
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّۧنَۗ ﴾ [الاحزاب: ٤٠]
“মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তির পিতা নয়; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন আল্লাহর একজন নবী। আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান এবং তাঁর সাথে শির্ক থেকে মুক্ত থাকার আহ্বানের ক্ষেত্রে সকল নবী-রাসূলের আহবান ছিল অভিন্ন। প্রমাণ হিসেবে নিম্নোক্ত আয়াতটি দ্রষ্টব্য:
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل: ٣٦]
“নিশ্চয় আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এই বার্তা দিয়ে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করবে এবং তাগুতকে প্রত্যাখান করবে।" [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
তবে বিধি-বিধান এবং অবশ্যই করণীয় ফরয কাজসমূহের আহ্বানের ক্ষেত্রে সকলই একই বক্তব্যের অধিকারী ছিলেন না; বরং প্রেক্ষাপট অনুসারে তাদের বক্তব্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন এবং অবস্থা ভেদে বিবিধ। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿لِكُلّٖ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةٗ وَمِنۡهَاجٗاۚ﴾ [المائدة: ٤٨]
“আমরা তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি।" [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৮]
নবী রাসূলগণের প্রতি ঈমানের প্রকৃতি:
রাসূলগণের প্রতি ঈমান বলতে কতিপয় বিশ্বাসকে বোঝায়:
১. বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন :
﴿وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤ ﴾ [فاطر: ٢٤]
“কোনো জাতি নেই যে তার কাছে সর্তককারী প্রেরণ করা হয় নি। [সূরা ফাতির, আয়াত: ২৪]
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন:
﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا﴾ [النحل: ٣٦]
“আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি।" [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
২. নবীগণ আল্লাহর কাছ থেকে যা প্রাপ্ত হয়েছেন, তার ব্যাপারে ছিলেন পূর্ণ সত্যবাদী- এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন। তাদের সবার দীন ছিল ইসলাম। তাদের আহ্বান ছিল একত্ববাদ। তাদের যে কোনো একজনের রিসালাতকে অস্বীকার এবং মিথ্যা মনে করার অর্থ হচ্ছে সকলের রিসালাত অস্বীকার এবং সকলের প্রতি মিথ্যারোপ করা।
৩. এ অভিমত পোষণ করা যে, তারা হলেন নেককার, পরহেজগার রাসূল। আল্লাহ তাদের উত্তম চরিত্র এবং প্রশংসনীয় গুণাবলী দ্বারা সুশোভিত করেছেন। তাদের কাছে প্রেরিত অহীর সবটুকুই তারা মানুষকে অবগত করিয়েছেন। সামান্যতম গোপনতা, বৃদ্ধি ও কিংবা বিকৃতির আশ্রয় তারা নেন নি।
৪. কুরআনুল কারীমে এবং বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তাদের যে সকল নাম আমরা জানি যেমন, নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তা বিশ্বাস করা এবং যে সকল নাম আমরা অবগত নই, তাও সাধারণভাবে বিশ্বাস করা।
৫. কুরআনুল কারীম এবং বিশুদ্ধ হাদীসে তাদের সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা এসেছে তা গ্রহণ করা।
৬. তাদের মধ্য হতে যাকে আমাদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে তার শরীয়ত অনুসারে জীবন যাপন করা। তিনি হলেন শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
৭. বিশ্বাস করা যে, তাদের একে অপরের মর্যাদার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন উলুল আযমবৃন্দ: নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবার কতিপয়কে আল্লাহ তা'আলা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। যেমন, ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ কর্তৃক তাঁর বন্ধু বলে সম্বোধন করা, মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করা, ইবরাহীমের মতো তাকেও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা এবং মি'রাজের রজনীতে তার সাথে কথোপকথন ইত্যাদি।
৮. বিশ্বাস করা যে, কেউ নবী হওয়া তার আপন ইচ্ছাধীন নয়; বরং আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কেউ নিজের চেষ্টায় নবী হতে পারবে না। নবুওয়াতপ্রাপ্তির ধারাবাহিকতা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের মধ্য দিয়ে শেষ এবং পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
নবীগণের ওপর ঈমানের উকারিতা:
নবীগণের ওপর ঈমান আনয়নের অনেক উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে:
১. বান্দার ওপর আল্লাহ অনুগ্রহ এবং দয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নবীদের প্রেরণ করেছেন।
২. এ মহা মূল্যবান নি'আমতের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৩. প্রত্যেক নবী রাসূলের যোগ্যতানুযায়ী তাদের প্রশংসা, সম্মান এবং মুহাব্বত করা।
৪. আল্লাহ তা'আলার যে কোনো আদেশ বাস্তবায়নে তাদের কায়মনোবৃত্তিতে আমাদের জন্য মহৎ শিক্ষা নিহিত রয়েছে। যেমন, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক আল্লাহর আদেশে তার সন্তানকে কুরবানী করা। আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বানে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া এবং এ কাজে যে কোনো ধরনের কষ্ট হাসি মুখে সহ্য করা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখা আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষনীয়।
৫. আল্লাহর আদেশ পালনের মাধ্যমে রাসূলের মুহাব্বতের প্রকৃত বাস্তবায়নে আগ্রহী হওয়া।
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب: ٢١]
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।" [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
পঞ্চমত: আখেরাতের ওপর ঈমান আনয়ন করা:
আখেরাতের ওপর ঈমানের কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
১. পুনরুত্থানে বিশ্বাস: অর্থাৎ একদিন তাবৎ মৃতদের জীবিত করা হবে এবং তারা পুনরুত্থিত হবে বিশ্বপ্রতিপালকের দরবারে নগ্ন পায়ে, উলঙ্গ ও খতনাবিহীন অবস্থায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿ثُمَّ إِنَّكُم بَعۡدَ ذَٰلِكَ لَمَيِّتُونَ ١٥ ثُمَّ إِنَّكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ تُبۡعَثُونَ ١٦ ﴾ [المؤمنون: ١٥، ١٦]
“এরপর তোমরা অবশ্যই মারা যাবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন অবশ্যই তোমরা পুনরুত্থিত হবে। [সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১৫-১৬]
২। হিসাব এবং প্রতিদান দিবসে বিশ্বাস করা। বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা'আলা বান্দার ভালো-মন্দ সকল কাজের হিসাব নিবেন এবং এর জন্য বান্দা শাস্তি অথবা পুরস্কার লাভ করবে। আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨ ﴾ [الزلزلة: ٧، ٨]
“অতঃপর যে সামান্য পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে এবং যে সামান্য পরিমাণ মন্দ কাজ করবে তাও সে দেখতে পাবে।" [সূরা যিলযাল, আয়াত: ৭-৮]
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ إِلَيۡنَآ إِيَابَهُمۡ ٢٥ ثُمَّ إِنَّ عَلَيۡنَا حِسَابَهُم ٢٦ ﴾ [الغاشية: ٢٥، ٢٦]
“নিশ্চয় তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট, অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই দায়িত্ব।" [সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ২৫-২৬]
৩. জান্নাত এবং জাহান্নামকে সত্য বলে জানা ও বিশ্বাস করা এবং সৃষ্টির জন্য সর্বশেষ ও চিরস্থায়ী আবাসস্থল বলে মনে করা। জান্নাত হলো সুখ, শান্তি আরামের স্থান, যা সৃষ্টি করা হয়েছে ঈমানদারদের জন্য। আর জাহান্নাম হলো দুঃখ-কষ্ট ও অশান্তির স্থান, যা কাফেরদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
৪. যে সকল বিষয় মৃত্যুর পর সংঘটিত হবে বলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন সেসব বিষয়ের ওপর ঈমান আনা। যেমন, কবরে শাস্তি অথবা শান্তি, মুনকার এবং নাকীর ফেরেশতার প্রশ্ন করা, হাশরের ময়দানে সূর্যের একেবারে মাথার নিকটবর্তী হওয়া, পুলসিরাত, মিযান বা পাল্লা, আমলনামা, হাউযে কাউসার, আল্লাহর নবীর সুপারিশ- সবই আছে এবং সত্য।
আখেরাতে বিশ্বাসের সুফল:
আখেরাতে বিশ্বাসের অনেক লাভ রয়েছে। তন্মধ্যে:
১. পরকালে আল্লাহর পুরষ্কার লাভের আশায় বান্দার নেক আমলে আগ্রহী হওয়া।
২. পরকালে আল্লাহর শাস্তির ভয়ে বান্দার পাপাচার থেকে দূরে থাকা।
৩. পরকালে আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত সুখ, শান্তি অর্জনের আশায় ইহকালের যে আরাম-আয়েশ তার হাতছাড়া হচ্ছে তাতেও মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি লাভ করা।
ষষ্ঠ: তাকদীরের ওপর ঈমান আনয়ন করা:
তাকদীরের ওপর ঈমান: আল্লাহর রহস্যগুলোর মধ্যে একটি রহস্য হচ্ছে তাকদীর। কোনো নিকটতম ফিরিশতা অথবা প্রেরিত রাসূল পর্যন্ত এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাকদীরের ওপর ঈমানের অর্থ বান্দা এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তা'আলা তার ইলম এবং প্রজ্ঞার দাবি অনুসারে কী হয়েছে, কী হবে, কী হচ্ছে- সব কিছু পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।
তাকদীরের ওপর ঈমানের স্তরসমূহ: তাকদীরে বিশ্বাসের চারটি স্তর রয়েছে:
১. আল-ইলম বা জানা: এর দ্বারা উদ্দেশ্য সৃষ্টির জন্য কোনো বস্তু সৃষ্টির পূর্বেই তার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত এবং বিস্তারিত সবকিছুর সম্পর্কেই আল্লাহ তা'আলার অবগত হওয়া। আল্লাহ বলেন,
﴿وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ﴾ [الاحزاب: ٤٠]
“আর আল্লাহ সব বিষয় জ্ঞাত।" [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
২. আল-কিতাবাহ বা লিখন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য আকাশ এবং পৃথিবীসমূহ সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক সব কিছু লাওহে মাহফুযে লিখে রাখা। দলীল, আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِيٓ أَنفُسِكُمۡ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مِّن قَبۡلِ أَن نَّبۡرَأَهَآۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٢٢ ﴾ [الحديد: ٢٢]
“পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর এমন কোনো বিপদ আসে না, যা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হয় নি। নিশ্চয় এ আল্লাহর পক্ষে সহজ।" [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২২]
৩. আল-মাশিয়্যাত বা ইচ্ছা: এর উদ্দেশ্য আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা-ই হয়, আর তিনি যা ইচ্ছে করেন না তা কখনোই হয় না। দলীল, আল্লাহর বাণী:
﴿وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ﴾ [القصص: ٦٨]
“আপনার প্রভু যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন।" [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮]
৪. আল-খালকু বা সৃষ্টি: এর উদ্দেশ্য সারা জগত তার সকল অস্তিত্ব, রূপ এবং কর্মসহ একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্টি বা মাখলুক। দলীল: আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿وَخَلَقَ كُلَّ شَيۡءٖ فَقَدَّرَهُۥ تَقۡدِيرٗا﴾ [الفرقان: ٢]
“তিনি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছেন অতঃপর নির্ধারণ করেছেন পরিমিতভাবে।" [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২]
তাকদীরের ওপর ঈমানের ফযীলত:
তাকদীরে বিশ্বাস দ্বারা অনেক লাভ রয়েছে। তন্মধ্যে:
১. বান্দা আল্লাহর বড়ত্ব সম্পর্কে পরিচয় লাভ করে এবং তার জ্ঞানের প্রশস্ততা, ব্যাপকতা এবং জগতে ছোট-বড় সব কিছু তার আয়ত্বে তা সম্পর্কে জানে। আরো জানে তার রাজত্বের পরিপূর্ণতা সম্পর্কে যে, তার অনুমতি ছাড়া সেখানে কোনো কিছুই সংগঠিত হয় না।
২. বান্দা তার সকল কাজে একমাত্র আল্লাহ তা'আলার ওপর নির্ভর করবে, কোনো বস্তুর ওপর নয়। কারণ সব কিছুই আল্লাহরই কুদরতে চলে।
৩. মানুষ কোনো কাজে সফলতা পেলে অহংকার করবে না। কারণ, এ সফলতা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ওপর অনুগ্রহ মাত্র। আল্লাহই তাকে এ কাজ করার যোগ্যতা ও তাওফীক দান করেছেন।
৪. কোনো প্রিয় বস্তুর বিরহ অথবা কোনো বিপদ দেখা দিলে অন্তরে নিশ্চয়তা ও প্রশান্তি আনয়ন। কারণ, সকল কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা এবং হুকুমে হচ্ছে।
তাকদীরে নির্ভরতার যুক্তি দেখানোর শর'ঈ বিধান:
তাকদীরে বিশ্বাসীর ওপর অপরিহার্য যে, সে তাকদীরকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে ওয়াজিব পরিত্যাগ করা কিংবা হারাম কাজে জড়িত হবে না এবং নেক কাজে অলসতা প্রদর্শন করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর কে জাহান্নামে যাবে তা কি জানানো হয়েছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, প্রশ্নকারী বলল, তাহলে আমলের প্রয়োজন কি? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রত্যেকের জন্য সে পথে গমন সহজতর করা হয়েছে যে উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম)
যে ব্যক্তি তাকদীরকে গুনাহের কাজের বৈধতার যুক্তি হিসাবে পেশ করে, সে বলে আল্লাহ পাপ কাজ করাকে আমার নিয়তিতে লিপিবদ্ধ করেছেন, তাই আমি তা ছাড়বো কিভাবে? এই ব্যক্তির অবস্থা হল, কেউ যদি জোরপূর্বক তার সম্পত্তি নিয়ে যায় অথবা তার ইজ্জতহানী করে, সে বলে না এটা আমার নিয়তিতে ছিল, করার কিছুই নেই; বরং সে তার সম্পদ উদ্ধার এবং অপরাধীর বিচারের চেষ্টা চালিয়ে যায়। সুতরাং তাক্বদীরের দোহাই দিয়ে গুনাহ করা কীভাবে বৈধ হবে? সে যখন কোনো গুনাহ করে তখন কী করে বলবে এটা আমার তাকদীরে ছিল? অতঃপর তার গুনাহের ধারাবাহিকতা কী হিসেবে সে অব্যাহত রাখবে? বুঝার বিষয় হলো মানুষ জানে না ভবিষ্যতে কী হবে? তাহলে সে কীভাবে মনে করে যে, আল্লাহ তার নিয়তিতে গুনাহ করা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সে গুনাহ পরিত্যাগ করতে পারবে না? আল্লাহ তা'আলা রাসূল প্রেরণ করেছেন, কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সিরাতে মুস্তাকীমের বর্ণনা দিয়েছেন, আকল-বুদ্ধি, চোখ, কান দান করেছেন এবং ভালো-মন্দ যাচাই করে চলার যোগ্যতাও আল্লাহ তা'আলা মানুষকে দিয়েছেন। অতএব এ সব বলে কেউ তার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। আমাদের জানা দরকার বিবাহ ছাড়া যেমন সন্তান আসে না, খাবার ছাড়া যেমন পরিতৃপ্তি আসে না, তেমনি আল্লাহর আদেশগুলো বাস্তবায়ন এবং নিষেধগুলো বর্জন ছাড়া জান্নাতে যাওয়া যাবে না। তাই মানুষের জন্য অবশ্যই করণীয় হলো আল্লাহ খুশি হন এমন কাজ করা, আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কাজ বর্জন করে জান্নাতের অনুসন্ধান করা, আর এ জন্য আল্লাহ তা'আলার সাহায্য কামনা করা, দুর্বলতা ও অলসতা পরিহার করা। বাসনা করলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে না। কারণ, এটা আল্লাহর পণ্য। আর আল্লাহর পণ্য খুবই মূল্যবান।
হ্যাঁ, দুনিয়াতে বিপদ আপদ তো আসবেই। এটা দূর করা সম্ভব নয়। মানুষের জানা উচিত, বিপদ আপদ তাকদীরে আছে বলেই হয়। তখন বলবে “ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন"। বিপদে ধৈর্যধারণ করা, খুশি থাকা, মেনে নেওয়া পাক্কা ঈমানদারের কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«المؤمن القوي خير وأحب إلى الله من المؤمن الضعيف، وفي كل خير، احرص على ما ينفعك واستعن بالله ولا تعجز، وإن أصابك شيء فلا تقل: لو أني فعلت كذا وكذا، ولكن قل: قدرالله وما شاء الله فعل، فإن لو تفتح عمل الشيطان». رواه مسلم
“দুর্বল মুমিনের তূলনায় সবল মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর প্রিয়। প্রত্যেকের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে। তুমি প্রচেষ্টা কর তোমার মঙ্গলের জন্য এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। অক্ষমতা প্রকাশ করো না। আর যদি তোমার কোনো বিপদ দেখা দেয় বলো না, “যদি আমি এভাবে করতাম তাহলে এরকম হতো; বরং বল: আল্লাহই আমার নিয়তিতে এটা রেখেছেন। আর আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। কারণ 'যদি' শব্দটি শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়। (সহীহ মুসলিম)
সমাপ্ত