11 - Hud ()

|

(1) আলিফ-লাম-রা। এ কিতাব (আল-কুরআন) যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত, অতঃপর (হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ, নি‘আমতের প্রতিশ্রুতি, শাস্তির হুঁশিয়ারি, ঘটনাবলি ইত্যাদি) বিশদভাবে বিবৃত, এক পরম প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত সত্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।

(2) (হে রাসূল! ‍তুমি জানিয়ে দাও) যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ‘ইবাদাত করো না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা।

(3) আরো বলা হয়েছে যে, (হে মানবজাতি!) তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তারপর তাঁর কাছে ফিরে আসো। (তাহলে) তিনি তোমাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত উত্তম ভোগ-উপকরণ দিবেন এবং প্রত্যেক আনুগত্যশীলকে তাঁর আনুগত্য অনুসারে দান করবেন। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে নিশ্চয় আমি তোমাদের ওপর মহা দিনের (কিয়ামতের ভয়াবহ কঠিন দিনের) শাস্তির আশঙ্কা করি।

(4) (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তন (করতে হবে) এবং তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

(5) জেনে রেখো, নিশ্চয় তারা (মুশরিকরা আল্লাহর বিষয়ে অজ্ঞতাবশত: অন্তরে যে সব সন্দেহ পোষণ করে, তা গোপন করতে) তাদের বুক ভাঁজ করে রাখে, যাতে তারা তার (রাসূলের) থেকে আত্মগোপন করতে পারে। জেনে রাখো, যখন তারা (মাথাগুলো ঢাকতে) নিজেদেরকে বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে, তখন তিনি জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে। নিশ্চয় তিনি নিশ্চয় তিনি অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে সবিশেষে অবগত।

(6) আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিযকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি তাদের (পৃথিবীতে) আবাসস্থল ও সমাধিস্থল সম্পর্কে অবগত আছেন। সবকিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।

(7) আর তিনিই ছয় দিনে আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন । আর (এদু’টি সৃষ্টির পূর্বে) তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর, (হে মানবজাতি!) যাতে তিনি তোমাদের মধ্যে কে আমলে সর্বোত্তম, তা পরীক্ষা করেন। আর (রাসূল!) তুমি যদি বলো: ‘নিশ্চয়ই তোমাদেরকে মৃত্যুর পর (হিসাবের জন্য) পুনরুত্থিত করা হবে’, তবে কাফিররা অবশ্যই বলবে: ‘এতো সুস্পষ্ট যাদু।’

(8) আর আমি যদি (দুনিয়াতে) নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের থেকে শাস্তি বিলম্বিত করি, তবে তারা অবশ্যই বলবে: ‘কোন জিনিস তাকে (শাস্তিকে) আটকে রাখল? সাবধান ! যেদিন সেটি (শাস্তি) তাদের ওপর নেমেই আসবে, সেদিন তাদের থেকে তা ফেরানো হবে না এবং তারা যা (শাস্তি) নিয়ে ঠাট্টা- বিদ্রুপ করত, তাদেরকে তা ঘেরাও করে ফেলবে।

(9) আর যদি আমি মানুষকে আমার পক্ষ থেকে রহমত(১) আস্বাদন করাই, অতঃপর তার থেকে তা ছিনিয়ে নেই, নিশ্চয় তখন সে হয়ে পড়ে হতাশ ও অকৃতজ্ঞ।

(10) আর দুঃখ-দুর্দশা স্পর্শ করার পর আমি যদি তাকে নি‘আমত আস্বাদন(১) করাই, তাহলে সে অবশ্যই বলবে: ‘আমার থেকে বিপদ-আপদ দূর হয়ে গেছে(২), আর সে হয় অতি উৎফুল্ল, অহংকারী।

(11) তবে যারা (বিপদ-আপদে ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে কষ্ট স্বীকারের মাধ্যমে) ধৈর্য ধারণ এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।

(12) (হে রাসূল!) তবে কি তুমি তোমার ওপর অবতীর্ণ ওহীর কিছু বিষয় (প্রচার করা ) বর্জন করবে এবং তোমার বুক সঙ্কুচিত হবে এ জন্য যে, তারা (কাফিররা) বলে: ‘কেন তার ওপর ধন-ভাণ্ডার নাযিল হলো না কিংবা (তাকে সত্যায়ন করতে) তার সাথে কেন ফিরিশতা এলো না?’ (হে রাসূল!) তুমি তো শুধু সতর্ককারী, আর আল্লাহ সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক।

(13) নাকি তারা (মুশরিকরা এ কথা) বলে: ‘সে (মুহাম্মাদ) নিজেই এটা (আল-কুরআন) রচনা করেছে?’ (হে রাসূল! তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে) তুমি বলো: ‘তোমরা যদি (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হও তবে তোমরা আল-কুরআনের অনুরূপ দশটি সূরা রচনা করে নিয়ে আসো এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার (এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্য) ডেকে নাও।’

(14) অতঃপর তারা যদি তোমাদের (সাহায্যের) আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রেখো, এটা ( এই আল-কুরআন যা) আল্লাহর জ্ঞান অনুসারেই নাযিল করা হয়েছে এবং তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। অতঃপর তোমরা (এ অকাট্য দলীলের পরও) কি আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হবে না?

(15) যে ব্যক্তি (তার আমলের পরকালে বিনিময় না চেয়ে) দুনিয়ার জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমি তাদের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দান করি এবং সেখানে তাদেরকে কোন প্রকার কম দেয়া হবে না।

(16) তাদের (এ নিন্দনীয় উদ্দেশ্যের লোকদের) জন্য আখিরাতে (জাহান্নামের) আগুন ছাড়া অন্য কিছুই নেই এবং তারা (দুনিয়াতে) যা করেছিল, আখিরাতে তা নিস্ফল হবে। আর তারা যা আমল করত, তা ছিল নিরর্থক।(১)

(17) (তারা কি তাদের সমতুল্য) যারা তার রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং অনুসরণ করে তাঁর পক্ষ থেকে একজন সাক্ষী (জিবরীল) এবং যার পূর্বে (তার নবুয়াতের সাক্ষ্য) রয়েছে মূসার কিতাব, যা (মানুষের জন্যে অনুকরণীয়) পথপ্রদর্শক ও রহমতস্বরূপ? বস্তুত তারা এক হতে পারে না।) তারাই এটাতে প্রতি ঈমান রাখে। আর যে সকল দল তা অস্বীকার করে, (জাহান্নামের) আগুনই হবে তাদের প্রতিশ্রুত স্থান। সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি এতে ( আল-কুরআন ও তাদের প্রতিশ্রুত ঠিকানার ব্যাপারে) মোটেও সন্দেহের মধ্যে থেকো না, নিশ্চয় তা তোমার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই (সুস্পষ্ট দলীল এবং অকাট্য প্রমাণ সত্ত্বেও তার ওপর) ঈমান আনে না।

(18) আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা রটনা(১) করে তাদের চেয়ে আর অধিক যালিম কে? তাদেরকে (কিয়ামতের দিন) তাদের রবের সামনে উপস্থিত করা হবে এবং সাক্ষীরা বলবে, এরাই তাদের রবের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলেছিল। সাবধান! যালিমদের ওপরই আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে।

(19) যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং এ ক্ষেত্রে (সরলতার স্থলে) বক্রতা অনুসন্ধান করে। আর এরাই তো আখিরাত অস্বীকারকারী।

(20) তারা জমিনে (আল্লাহকে) অপরাগ করতে পারত না(১) এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের অন্য কোনো সাহায্যকারী ছিল না। তাদের শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে। তাদের (দুনিয়াতে হিদায়াতের বাণী) শোনার সামর্থ্যও ছিল না এবং তারা (আল্লাহর উপকারী নিদর্শনাবলি) দেখতেও পেত না।

(21) এরা তো (আল্লাহর সাথে শরিক বানিয়ে) নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করল এবং তারা যা মিথ্যা রচনা করত, তা তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেল।

(22) নিঃসন্দেহে তারাই আখিরাতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।

(23) নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং তাদের রবের প্রতি বিনয়ী হয়েছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।

(24) (মু’মিন ও কাফির) দল দুটির উপমা অন্ধ ও বধিরের এবং চক্ষুষ্মান ও শ্রবণশক্তি সম্পন্নের ন্যায়, এ দু’টি শ্রেণি কি কোন রূপে ও কোন অবস্থায় সমান হতে পারে? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?

(25) আর অবশ্যই আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে (একজন রাসূল হিসেবে) পাঠিয়েছিলাম। সে তার জাতিকে বলেছিল: ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য (আল্লাহর শাস্তি থেকে) একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী।’

(26) ‘যেন তোমরা এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ‘ইবাদাত না করো। অন্যথায় আমি তো তোমাদের জন্য এক যন্ত্রণাদায়ক দিনের শাস্তির আশঙ্কা করছি।’

(27) অতঃপর (প্রতিউত্তরে) তার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় কাফিররা বললো, ‘আমরা তো তোমাকে আমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া অন্য কিছু দেখছি না; আমরা তো দেখছি, তোমার অনুসরণ তারাই করছে, যারা আমাদের মধ্যে বাহ্যিক দৃষ্টিতেই অধম এবং আমরা আমাদের ওপর তোমাদের (ধন-সম্পদ ও মর্যাদায়) কোনো শ্রেষ্ঠত্ব দেখছি না। বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করছি।’

(28) সে বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আমাকে বলো, যদি আমি আমার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকি এবং তিনি আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে রহমত(১) দিয়ে থাকেন, আর তা (তোমাদের অজ্ঞতার কারণে) তোমাদের কাছে গোপন রাখা হয়, তবে কি আমরা এ বিষয়ে তোমাদেরকে বাধ্য করতে পারি, যখন তোমার এটা অপছন্দ কর?’(২)

(29) (নূহ আরো বললো:) ‘হে আমার সম্প্রদায়! এর (রিসালাতের দাওয়াতের) পরিবর্তে আমি তোমাদের কাছে কোনো ধন-সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহরই কাছে। (অভাবগ্রস্ত মু’মিনদের) যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে (আমার মজলিশ থেকে) তাড়িয়ে দেয়াও আমার কাজ নয়। তারা নিশ্চিতভাবে তাদের রবের সাক্ষাৎ লাভ করবে। কিন্তু আমি তো দেখছি, তোমরা এক অজ্ঞ সম্প্রদায়।’

(30) ‘হে আমার সম্প্রদায়! (তোমাদের চাওয়া মতো ) আমি যদি তাদেরকে (অভাবগ্রস্ত মু’মিনদেরকে) তাড়িয়ে দেই, তবে আল্লাহর পাকড়াও থেকে আমাকে কে রক্ষা করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’

(31) ‘আর আমি তোমাদের বলছি না যে, ‘আমার কাছে আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ আছে এবং আমি গায়িব জানি। আর আমি এও বলছি না যে, ‘আমি ফিরিশতা।’ তোমাদের চোখে যারা হীন (অভাবী), তাদের সম্পর্কে আমি বলছি না যে, ‘আল্লাহ তাদেরকে কখনো কোনো কল্যাণ দান করবেন না।’ তাদের অন্তরে যা আছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ অধিক জ্ঞাত। আমি এমন দাবি করলে, অবশ্যই আমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’

(32) তারা বললো: ‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে বাক-বিতণ্ডা করছো এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিবাদ করেছো। অতএব যার (যে শাস্তির) প্রতিশ্রুতি তুমি আমাদেরকে দিচ্ছো, তা আমাদের কাছে নিয়ে আসো, যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকো।’

(33) সে (নূহ)বললো: আল্লাহই তো তোমাদের কাছে তা (শাস্তি) নিয়ে আসবেন, যদি তিনি চান। আর তোমরা তা ব্যর্থ করতে পারবে না।’

(34) ‘আর আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের উপকারে আসবে না, যদি আল্লাহ তোমাদেরকে (তোমাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে সরল পথ থেকে) বিভ্রান্ত করতে চান। তিনিই তোমাদের রব এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

(35) নাকি তারা(১) বলে যে, সে(২) এটা রচনা করেছে? (হে রাসূল অথবা নূহ! তুমি) বলো: ‘আমি যদি এটা রচনা করে থাকি, তবে আমিই আমার অপরাধের জন্য দায়ী হরো। আর তোমরা যে অপরাধ করছ, তা থেকে আমি দায়মুক্ত।‘

(36) আর নূহের প্রতি ওহী নাযিল করা হলো, ‘ইতিপূর্বে যারা ঈমান এনেছে তারা ছাড়া তোমার সম্প্রদায়ের অন্য কেউ কখনো ঈমান আনবে না। কাজেই তারা যা (মিথ্যারোপ ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ) করে তার জন্য তুমি চিন্তিত হয়ো না।’

(37) ‘আর তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার ওহী অনুসারে নৌকা তৈরি করো। আর যারা (কুফরি করে নিজেদের ওপর) যুলম করেছে, তাদের ব্যাপারে তুমি (অবকাশ চেয়ে) আমার কাছে কোনো আবেদন করো না। নিশ্চয় তারা নিমজ্জিত হবে।’

(38) আর সে (নূহ তার রবের নির্দেশে) নৌকা তৈরি করতে লাগল এবং যখনই তার জাতির নেতৃস্থানীয় কোনো ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে যেতো, তাকে নিয়ে উপহাস করতো। সে বললো: ‘যদি তোমরা আমাদেরকে নিয়ে উপহাস করো, তবে (মহাপ্লাবনের দিনে) আমরাও নিশ্চয় তোমাদেরকে নিয়ে উপহাস করবো, যেমন তোমরা উপহাস করছো।’

(39) অতঃপর শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কার ওপর (দুনিয়াতেই) এমন শাস্তি আসবে, যা তাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবে, আর (কিয়ামতের দিন) তার ওপর আপতিত হবে স্থায়ী শাস্তি ।’

(40) অবশেষে যখন (তাদেরকে ধ্বংস করার ব্যাপারে) আমার আদেশ আসলো এবং চুলা (থেকে পানি ) উথলে উঠলো (১); তখন আমি (নূহকে) বললাম: ‘তুমি এতে তুলে নাও প্রত্যেক শ্রেণি থেকে জোড়া জোড়া এবং তোমার পরিবারকে আর যারা ঈমান এনেছ, তবে তাদেরকে নয় যাদের ব্যাপারে আগেই (ডুবে মরার) সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। আর তার সাথে অল্পসংখ্যকই ঈমান এনেছিল।

(41) আর সে (নূহ) বললো: ‘তোমরা এতে আরোহণ করো। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি (বয়ে যাওয়া এবং এর নোঙর ফেলা)। নিশ্চয় আমার রব অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

(42) আর নৌকাটি পাহাড় সদৃশ ঢেউয়ের মধ্যে তাদেরকে নিয়ে চলছিলো এবং নূহ তার পুত্রকে ডাক দিলো, আর সে ছিল আলাদা স্থানে, ‘হে আমার পুত্র, আমাদের সাথে নৌকায় আরোহণ করো এবং কাফিরদের সঙ্গী হয়ো না।’

(43) সে (পুত্র) বলল: কোন প্রয়োজন নেই) ‘আমি এমন এক সুউচ্চ পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিবো, যা আমাকে (প্লাবনের) পানি থেকে রক্ষা করবে।’ সে (নূহ তার পুত্রকে) বললো: ‘আজ আল্লাহর হুকুম (শাস্তি) থেকে রক্ষা করার কেউ নেই, তবে যাকে আল্লাহ দয়া করবেন, সে ছাড়া।’ আর ঢেউ তাদের মধ্যে অন্তরায় হয়ে গেল, ফলে সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হলো।

(44) আর (তুফান শেষ হওয়ার পর আল্লাহ কর্তৃক) বলা হলো: ‘হে জমিন! তুমি তোমার পানি চুষে নাও, আর হে আসমান! (বৃষ্টি বর্ষণ করা থেকে) বিরত হও।’ অতঃপর পানি কমে গেলো এবং (আল্লাহর কাফিরদেরকে ধ্বংস করার) সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলো, আর নৌকা জুদী(১) পাহাড়ের ওপর এসে থামলো এবং ঘোষণা করা হলো, ‘ধ্বংস যালিম জাতির জন্য।’

(45) আর নূহ তার রবকে ডেকে বললো: ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার সন্তান আমার পরিবারভুক্ত(১) এবং আপনার প্রতিশ্রুতি নিশ্চয় সত্য। আর আপনি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক।’

(46) তিনি (আল্লাহ) বললেন: ‘হে নূহ, নিশ্চয় সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়।(১) সে অবশ্যই অসৎ কর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার (প্রকৃত) কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করো না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না ।’

(47) সে (নূহ) বললো: ‘হে আমার রব, যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, তা চাওয়া থেকে আমি অবশ্যই আপনার নিকট আশ্রয় চাই। আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমার প্রতি দয়া না করেন, তবে আমি (দুনিয়া ও আখিরাতে) ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’

(48) (অতঃপর নূহকে উদ্দেশ্য করে) বলা হলো: ‘হে নূহ, তোমার ও তোমার সাথে যেসব সম্প্রদায় রয়েছে, তাদের ওপর আমার পক্ষ থেকে শান্তি ও বরকতসহ (নৌকা থেকে জমিনে) অবতরণ করো। আর আরো অনেক সম্প্রদায়সমূহকে(১) আমি জীবন উপভোগ করতে দিবো। তারপর আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে স্পর্শ করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’

(49) (হে রাসূল!) এগুলো (নূহের সময়ের ঘটনাবলি) গায়িবের সংবাদ, আমি তোমাকে ওহীর মাধ্যমে অবহিত করছি। ইতঃপূর্বে না তুমি তা জানতে এবং না তোমার সম্প্রদায়। সুতরাং তুমি ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয় শুভ পরিণাম কেবল মুত্তাকীদের জন্য।

(50) আর ‘আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হূদকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিলো: ‘হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের জন্য কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তোমরা তো শুধু মিথ্যা রটনাকারী।’

(51) ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে এর (আল্লাহ দিকে দাওয়াতের) বিনিময়ে কোনো প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো কেবল তাঁরই কাছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না’?(১)

(52) ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও, অতঃপর তাঁর কাছে (পাপসমূহ থেকে) তাওবা করো, তাহলে তিনি তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টিবর্ষণ করবেন এবং তোমাদেরকে আরো শক্তি দিয়ে(১) তোমাদের শক্তি (সম্মান) বৃদ্ধি করবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে, (আমার দাওয়াত থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিও না।’

(53) তারা বললো: ‘হে হূদ, তুমি আমাদের কাছে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসোনি। আর তোমার কথায় আমরা আমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করবো না এবং আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসীও নই।’

(54) ‘আমরা তো কেবল এ কথাই বলছি যে, ‘আমাদের কোন কোন উপাস্য তোমাকে অমঙ্গল দ্বারা আক্রান্ত করেছে।’(১) সে বললো: ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি, আর তোমরা সাক্ষী থাকো যে, অবশ্যই আমি তা (সেসব উপাসকদের উপাসনা) থেকে মুক্ত, যাকে তোমরা শরিক করো।’

(55) ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে (১) তোমরা সকলে একত্রিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো, তারপর আমাকে অবকাশ দিও না।’

(56) ‘অবশ্যই আমি (সকল কর্মকাণ্ডে) আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছি। (জমিনের বুকে) এমন কোন বিচরণশীল প্রাণী নেই, যে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই। নিশ্চয় আমার রব সরল সঠিক পথে আছেন।’(১)

(57) ‘এরপরও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমি যা (যে ওহী) নিয়ে তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি, আমি তো তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। আর আমার রব (তোমাদেরকে ধ্বংস করে) তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেন। আর তোমরা (নিজেদের মিথ্যারোপ ও বিমুখতার দ্বারা) তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আমার রব সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।’

(58) আর যখন (তাদেরকে ধ্বংস করার) আমার নির্দেশ আসল, তখন আমি হূদকে ও যারা তার সাথে ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে রহমতের উসিলায় রক্ষা করলাম এবং আমি তাদেরকে কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি দিলাম।

(59) আর এই ‘আদ জাতি, তারা তাদের রবের আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছিলো এবং অমান্য করেছিল, তাঁর রাসূলগণকে। আর তারা অনুসরণ করেছিল, প্রত্যেক উদ্ধত, স্বৈরাচারীর নির্দেশ।

(60) আর এই দুনিয়াতে অভিসম্পাত তাদের পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং কিয়ামত দিবসেও(১)। জেনে রেখো! নিশ্চয় ‘আদ জাতি তাদের রবের সাথে কুফরি করেছিল। জেনে রাখো! হূদের জাতি ‘আদ সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে ধ্বংস।

(61) আর সামূদ জাতির প্রতি পাঠিয়েছিলাম তাদেরই ভাই সালিহকে। সে বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে(১) এবং সেটিকে তোমাদের জন্য আবাদের ব্যবস্থা করেছেন । সুতরাং তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাও, অতঃপর তাঁরই কাছে তাওবা করো। নিশ্চয় আমার রব খুব কাছেই, (আহ্বানকারীর ডাকে) সাড়া দানকারী।’ (২)

(62) তারা বললো: ‘হে সালিহ! তুমি তো ইতঃপূর্বে (তোমার এ দাওয়াত দেওয়ার আগে) আমাদের মধ্যে ছিলে আশা-ভরসার স্থল।(১) তুমি কি আমাদেরকে নিষেধ করছো তাদের ইবাদাত করতে, যাদের ইবাদাত করতো আমাদের পিতৃপুরুষরা? তুমি আমাদেরকে যে (তাওহীদের) দিকে আহ্বান করছো, সে ব্যাপারে নিশ্চয় আমরা বড় সংশয়ে আছি।’

(63) সে বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কী মনে কর, যদি আমি আমার রবের পক্ষ থেকে (নবুওয়াতের) সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর থাকি এবং তিনি আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে রহমত (নবুওয়াত) দান করেন, তাহলে কে আমাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে, যদি আমি তাঁর (দাওয়াত না দিয়ে) অবাধ্য হই? সুতরাং তোমরা তো কেবল আমার ক্ষতিই বাড়িয়ে দিচ্ছ।’

(64) ‘আর হে আমার সম্প্রদায়! এটি আল্লাহর উটনী, (আমার নবুওয়াতের সত্যতার ওপর) তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন। তাই তোমরা একে (নিজের মতো করে চলতে-ফিরতে) ছেড়ে দাও, সে আল্লাহর জমিনে (বিচরণ করে) খাবে এবং (ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্য) কোনোরূপ মন্দভাবে তাকে স্পর্শ করো না, তাহলে তোমাদেরকে আশু শাস্তি পাকড়াও করবে।’

(65) অতঃপর তারা তাকে (উটনীকে) হত্যা করলো। তাই সে (সালিহ তার জাতিকে) বললো: ‘তোমরা তিন দিন নিজ নিজ গৃহে আনন্দে-ফূর্তিতে কাটাও। এটা (আল্লাহর শাস্তি) আসাটা) এমন এক প্রতিশ্রুতি, যা মিথ্যা হওয়ার নয়।’

(66) অতঃপর যখন (তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য) আমার আদেশ আসলো, তখন সালিহ ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে রহমতের উসিলায় মুক্তি দিলাম এবং সেই দিনের লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করলাম। নিশ্চয় তোমার রব মহাশক্তিশালী, মহাপরাক্রমশালী।

(67) আর যারা যুলম করেছিলো, তাদেরকে পাকড়াও করলো (শাস্তি হিসেবে) এক বিকট শব্দ। ফলে তারা নিজেদের গৃহে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল।

(68) যেন তারা সেখানে কখনো বসবাসই করেনি। জেনে রেখো! নিশ্চয় সামূদ সম্প্রদায় তাদের রবের সাথে কুফরি করেছে। জেনে রেখো! (মর্মান্তিকভাবে) ধ্বংসই হলো সামূদ জাতির পরিণাম।

(69) আর অবশ্যই আমার ফিরিশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইবরাহীমের কাছে এসেছিল। তারা বললো: ‘আপনার প্রতি সালাম (শান্তি)।’ জবাবে সেও (ইবরাহীমও) বললো: ‘আপনাদের প্রতিও সালাম।’ অতঃপর সে (তাদের আপ্যায়নের জন্যে) বিলম্ব না করে, একটি ভুনা গো বাছুর নিয়ে আসলো।

(70) অতঃপর যখন সে (ইবরাহীম) দেখতে পেলো, তাদের হাত এর দিকে প্রসারিত হচ্ছে না(১), তখন সে তাদেরকে অস্বাভাবিক মনে করল এবং তাদের থেকে ভীতি অনুভব করলো। তারা বললো:(হে ইবরাহীম!) ভয় করো না, নিশ্চয় আমরা লূত সম্প্রদায়ের নিকট (শাস্তি দেয়ার জন্য) প্রেরিত হয়েছি।’

(71) আর তার স্ত্রী (সারা) দাঁড়ানো ছিল, সে হেসে উঠলো।(১) অতঃপর আমরা তাকে সুসংবাদ দিলাম ইসহাকের(২) ও ইসহাকের পরে ইয়া‘কূবের।

(72) সে (ফিরিশতাগণ কর্তৃক সন্তানের সুসংবাদ শুনে) বললো: ‘হায়, কী আশ্চর্য! আমি সন্তান প্রসব করবো; অথচ আমি বৃদ্ধা, আর এ আমার স্বামী, সেও বৃদ্ধ? এটা তো অবশ্যই এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার!’

(73) তারা (ফিরিশতাগণ) বললো: ‘আল্লাহর সিদ্ধান্তে তুমি আশ্চর্য হচ্ছো? হে নবী পরিবার! তোমাদের ওপর রয়েছে আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত। নিশ্চয় তিনি (স্বীয় গুণাবলি ও কার্যাবলিতে) বড়ই প্রশংসিত, অত্যন্ত সম্মানিত।’

(74) অতঃপর (মেহমানদেরকে নিশ্চিত ফিরিশতা জেনে) যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হলো এবং তার কাছে (পুত্র সন্তানের) সুসংবাদ এলো, তখন সে লূতের সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার সাথে বাদানুবাদ করতে লাগল।(১)

(75) নিশ্চয় ইবরাহীম অত্যন্ত সহনশীল, অধিক অনুনয় বিনয়কারী, আল্লাহমুখী (একজন মানুষ)

(76) (ফিরিশতাগণ বললো) হে ইবরাহীম! তুমি এ থেকে(১) বিরত হও। নিশ্চয় (শাস্তি পতিত হওয়ার ব্যাপারে) তোমার রবের সিদ্ধান্ত এসে গেছে । নিশ্চয় তাদের উপর মহা শাস্তি আসছে , যা প্রতিহত হবার নয়।

(77) আর যখন লূতের কাছে আমার ফিরিশতাগণ আসলো, তখন তাদের (আগমনে) সে বিষন্ন হয়ে পড়লো এবং (তার জাতির থেকে তাদেরকে রক্ষার ব্যাপারে ভয় পেয়ে) তার অন্তর খুব সংকুচিত হয়ে গেলো। আর সে বললো: ‘এ তো বড়ই কঠিন দিন।’(১)

(78) আর তার সম্প্রদায় (সুদর্শন যুবক-বেশধারী মেহমান ফিরিশতাদের সাথে অসৎ কর্মে লিপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে) তার কাছে দৌড়ে আসলো এবং আগে থেকেই তারা কুকর্মে (সমকামিতায়) লিপ্ত ছিল। সে বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়! এরা আমার মেয়ে, (তাদেরকে বিবাহ করো) তারা তোমাদের জন্য পবিত্র। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে তোমরা আমাকে অপমানিত করো না। আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কি বিবেক সম্পন্ন কেউ নেই?’(১)

(79) তারা (লূতের সম্প্রদায়) বললো: (হে লূত!) ‘তুমি অবশ্যই জানো, তোমার মেয়েদের ব্যাপারে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।(১) আর আমরা কী চাই, তা তুমি নিশ্চয় জানো।’(২)

(80) সে বললো: ‘তোমাদের প্রতিরোধে যদি আমার কোনা শক্তি থাকতো অথবা আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় নিতে পারতাম!’(১)

(81) তারা (ফিরিশতারা) বললো: ‘হে লূত! আমরা তোমার রবের প্রেরিত ফিরিশতা (দূত)। তারা কখনো তোমার কাছে (অসৎ উদ্দেশ্যে) পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি তোমার পরিবার নিয়ে রাতের কোনো এক অংশে রওয়ানা হও, আর তোমাদের কেউ পিছে তাকাবে না। তবে তোমার স্ত্রী ব্যতীত (সে রওয়ানা হবে না)। কেননা তাকে সে শাস্তিই আক্রান্ত করবে, যে (শাস্তি) তাদেরকে আক্রান্ত করবে। নিশ্চয় তাদের (শাস্তি আসার) নির্ধারিত সময় হচ্ছে সকালবেলা। সকাল কি খুবই নিকটে নয়?’

(82) অতঃপর (লূতের সম্প্রদায় ধ্বংসের ব্যাপারে) যখন আমার আদেশ এসে গেলো, তখন আমি জনপদকে উল্টে দিলাম এবং ক্রমাগত পোড়ামাটির পাথর বর্ষণ করলাম।

(83) যা (যে পাথরগুলো বিশেষ আলামত দ্বারা) চিহ্নিত ছিলো তোমার রবের কাছে। আর তা যালিমদের থেকে মোটেও দূরে নয়।

(84) আর মাদইয়ানে আমি তাদের ভাই শু‘আইবকে (নবী হিসেবে) পাঠিয়েছিলাম। সে বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো (সত্য) ইলাহ নেই এবং মাপে ও ওজনে কম করো না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে প্রাচুর্যশীল দেখছি; কিন্তু আমি তোমাদের ওপর এক সর্বগ্রাসী দিনের শাস্তির আশঙ্কা করছি।’

(85) ‘আর হে আমার সম্প্রদায়! মাপ ও ওজন ইনসাফের সাথে পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের পণ্য কম দিও না। আর জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িও না।’

(86) ‘(ওজনে কম দিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে ও জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে অধিক অর্জন করার চেয়ে) আল্লাহর দেয়া উদ্বৃত্ত লাভ তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা মু’মিন হও। আর মনে রেখো, আমি তো তোমাদের পর্যবেক্ষণকারী নই।’

(87) তারা বললো: ‘হে শু‘আইব! তোমার সালাত কি তোমাকে এই নির্দেশ প্রদান করে যে, আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের ইবাদাত করত, আমরা তাদের ত্যাগ করি? অথবা আমাদের সম্পদে আমরা ইচ্ছামতো যা করি তাও (ত্যাগ করি?) তুমি তো বেশ সহনশীল সুবোধ’!(১)

(88) সে (শু‘আইব) বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা কি মনে করো, আমি যদি আমার রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর থাকি এবং তিনি আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে উত্তম রিযক দান করে থাকেন, (তাহলে কী করে আমি আমার দায়িত্ব পরিত্যাগ করব)? যে কাজ থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি, তোমাদের বিরোধিতা করে সে কাজটি আমি করতে চাই না। আমি আমার সাধ্যমতো (তাওহীদ ও আল্লাহর আনুগত্যের দিকে দাওয়াতের মাধ্যমে তোমাদের) সংশোধন চাই। আল্লাহর সহায়তা ছাড়া আমার কোন তাওফীক নেই। আমি তাঁরই ওপর তাওয়াক্কুল করেছি এবং তাঁরই কাছেই ফিরে যাবো।’

(89) ‘আর হে আমার সম্প্রদায়! আমার সাথে বিরোধ যেন কিছুতেই তোমাদেরকে এমন অপরাধ না করায় যার ফলে তোমাদের ওপর তেমন শাস্তি আসবে যেমন শাস্তি এসেছিল নূহের সম্প্রদায়ের ওপর অথবা হূদের সম্প্রদায়ের ওপর অথবা সালিহের সম্প্রদায়ের ওপর । আর লূতের জাতির ঘটনা তো তোমাদের থেকে বেশি দূরেরও নয়।’

(90) ‘আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তাঁরই কাছে (পাপসমূহ থেকে) তাওবা করো। নিশ্চয় আমার রব (তাওবাকারীদের প্রতি) পরম দয়ালু, গভীর ভালোবাসা পোষণকারী।’

(91) তারা বললো: ‘হে শু‘আইব! তুমি যা বলো, তার অধিকাংশই আমরা বুঝি না।আর নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে (তোমার অন্ধত্বের কারণে) আমাদের মধ্যে দুর্বলই দেখতে পাচ্ছি। যদি তোমার আত্মীয়-স্বজন না থাকতো, তবে আমরা তোমাকে অবশ্যই পাথর মেরে হত্যা করতাম।(১) আর আমাদের ওপর তুমি পরাক্রমশালী নও।’

(92) সে (শুআইব) বললো: ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমার স্বজনরা কি তোমাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান? আর তোমরা তাঁকে (আল্লাহকে) একেবারে পেছনে ঠেলে দিলে! তোমরা যা-ই করো, নিশ্চয় আমার রব, তা পরিবেষ্টন করে আছেন।’

(93) ‘আর হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের অবস্থানে থেকে (যেভাবে খুশি সেভাবে) কাজ করে যাও, আমিও কাজ করছি। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর আসবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি এবং কে মিথ্যাবাদী। আর তোমরা (আল্লাহর ফয়সালার) অপেক্ষা করো, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় থাকলাম।’

(94) অবশেষে যখন (শু‘আইবের সম্প্রদায়ের ধ্বংসের ব্যাপারে) আমার নির্দেশ আসলো, তখন শু‘আইব ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমার রহমতের দ্বারা মুক্তি দিলাম। আর যারা যুলম করেছিল তাদেরকে (শাস্তি হিসেবে) পাকড়াও করল বিকট শব্দ। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলো।

(95) (তারা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল) যেন তারা সেখানে কখনোই বসবাস করেনি। জেনে রেখো, ধ্বংসই ছিল মাদইয়ানবাসীর পরিণাম, যেরূপ ধ্বংস হয়েছিল সামূদ জাতি।

(96) আর আমি মূসাকে আমার আয়াতসমূহ ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি।

(97) ফির‘আউন ও তার নেতৃবৃন্দের কাছে। কিন্তু তারা (নেতৃবৃন্দ আল্লাহর আদেশের বিপরীতে) ফির‘আউনের নির্দেশ অনুসরণ করলো। আর ফির‘আউনের নির্দেশ সঠিক ছিলো না।

(98) কিয়ামত দিবসে সে (ফির‘আউন) তার (অনুসরণকারী) জাতির অগ্রভাগে থাকবে এবং (নেতৃত্ব দিয়ে) তাদেরকে জাহান্নামে উপনীত করবে।(১) আর যেখানে তারা উপনীত হবে, সেটা উপনীত হওয়ার কতইনা নিকৃষ্ট স্থান!

(99) আর ইহকালীন জীবনে অভিসম্পাত তাদের পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং কিয়ামত দিবসেও। কতই না নিকৃষ্ট প্রতিদান, যা তাদের দেয়া হবে।

(100) (হে রাসূল) এগুলো জনপদসমূহের কিছু সংবাদ, যা আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি। তা থেকে কিছু নিদর্শন বিদ্যমান আছে এবং কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

(101) আর আমি তাদের ওপর (বিপদ দিয়ে ধ্বংস করে) যুলম করিনি; বরং তারা (আল্লাহর সাথে কুফরি করে) নিজেরাই নিজেদের ওপর যুলম করেছে। অতঃপর যখন তোমার রবের (শাস্তির) নির্দেশ আসলো, তখন আল্লাহ ছাড়া যেসব উপাস্যকে তারা ডাকতো, তারা তাদের কোনো কাজেই আসল না। আর তারা (ভ্রান্ত মাবূদগুলো) ধ্বংস ছাড়া তাদের আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি।

(102) আর তোমার রবের পাকড়াও এভাবেই হয় , যখন তিনি অত্যাচারী জনপদসমূহকে পাকড়াও করেন। নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও বড়ই যন্ত্রণাদায়ক, কঠিন।

(103) নিশ্চয় এতে রয়েছে নিদর্শন (মহা শিক্ষা) তার জন্য, যে আখিরাতের শাস্তিকে ভয় করে। সেটি এমন একটি দিন, যেদিন সকল মানুষকে সমবেত করা হবে এবং সেটি এমন এক দিন যেদিন সবাইকে (হিসাবের জন্য) উপস্থিত করা হবে।

(104) আর আমি নির্দিষ্ট কিছুকালের জন্যই তা ( সকলের উপস্থিতির সে দিনটি) বিলম্বিত করছি।

(105) যেদিন তা আসবে সেদিন, তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে কেউ হবে হতভাগা (জাহান্নামী), আর কেউ হবে সৌভাগ্যবান (জান্নাতী)

(106) অতঃপর যারা (কুফরি এবং ভ্রান্ত আমলের কারণে) হতভাগা হবে, তারা থাকবে জাহান্নামে। সেখানে (আগুনের কঠিন যন্ত্রণার কারণে) থাকবে তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ।

(107) সেখানে তারা (অনন্তকাল) স্থায়ী হবে; যতদিন পর্যন্ত আসমানসমূহ ও জমিন বিদ্যমান থাকবে । অবশ্য তোমার রব যা চান, (যেসব গুনাহগার তাওহীদবাদীদেরকে বের করতে চাইবেন) তারা ব্যতীত। নিশ্চয় তোমার রব তাই করেন, যা তিনি ইচ্ছা করেন।

(108) আর যারা (ঈমান ও সৎকাজের ফলে) ভাগ্যবান হবে, তারা জান্নাতে থাকবে, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; যতদিন পর্যন্ত আসমানসমূহ ও জমিন বিদ্যমান থাকবে, যদি না তোমার রব (কারো ব্যাপারে) ভিন্যরূপ ইচ্ছে করেন।(১) এটা এক নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।

(109) সুতরাং এরা (মুশরিকরা) যাদের ইবাদাত করে, তুমি তাদের (মিথ্যা হওয়ার) ব্যাপারে দ্বিধা-সংশয়ে থেকো না। পূর্বে তাদের পিতৃপুরুষেরা যেভাবে (মনগড়া কল্পিত দেবদেবীর) ‘ইবাদাত করত, তারাও তাদেরই মত ‘ইবাদত করে। নিশ্চয় আমি তাদের (শাস্তির প্রাপ্য) অংশ হ্রাস না করে, তাদেরকে পুরোপুরি দিবো।

(110) আর অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব (তাওরাত) দিয়েছিলাম, অতঃপর তা নিয়ে মতবিরোধ করা হয়েছিল। যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে (দ্রুত শাস্তি না আসার) পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকতো, তবে (দুনিয়াতেই শাস্তি এসে) তাদের মধ্যে মীমাংসা হয়ে যেতো। আর নিশ্চয় তারা এ (আল-কুরআনের) ব্যাপারে ঘোর সন্দেহে রয়েছে।

(111) আর নিশ্চয় তোমার রব প্রত্যেককে তার আমলের প্রতিদান পুরোপুরি দান করবেন। তারা যা আমল করে, অবশ্যই তিনি সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।

(112) সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছো সেভাবে তুমি এবং তোমার সাথী যারা তাওবা করেছে, সকলে অবিচল থাকো।(১) আর সীমালঙ্ঘন করো না। তোমরা যা করছো, নিশ্চয় তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।

(113) আর যারা যুলম করেছে তোমরা (তোষামোদ বা আন্তরিকতার কারণে) তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; পড়লে জাহান্নামের আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক থাকবে না। অতঃপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।

(114) আর (হে রাসূল!) তুমি দিনের দু’প্রান্তে এবং রাতের প্রথমাংশে সালাত কায়িম করো।(১) নিশ্চয় সৎ আমলসমূহ মন্দ কাজকে মিটিয়ে দেয়। এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ।

(115) তুমি (আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করতে) ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।

(116) অতএব তোমাদের পূর্ববর্তী (শাস্তিপ্রাপ্ত) সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এমন প্রজ্ঞাবান কেন হয়নি, যারা জমিনে (তাদের জাতিগুলোকে কুফরি এবং পাপ কাজের মাধ্যমে) ফ্যাসাদ করা থেকে নিষেধ করতো? অল্প সংখ্যক ছাড়া, যাদেরকে আমি তাদের মধ্য থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম। আর যারা যুলম করেছে, তারা বিলাসিতার পেছনে পড়ে ছিলো এবং তারা ছিলো অপরাধী।

(117) আর (হে রাসূল!) তোমার রব এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে জনপদসমূহ ধ্বংস করে দিবেন; অথচ তার অধিবাসীরা (শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায়) সংশোধনকারী।

(118) যদি তোমার রব চাইতেন, তবে সকল মানুষকে (হকের ওপর একত্রিত করে) এক উম্মতে পরিণত করতে পারতেন(১); ফলে তারা (প্রবৃত্তির অনুসরণ ও সীমালঙ্ঘনের কারণে) পরস্পর মতবিরোধকারীই রয়ে গেছে।

(119) তবে তারা নয়, যাদেরকে তোমার রব (হিদায়াতের তাওফীক দিয়ে) দয়া করেছেন। আর এজন্যই(১) তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া তোমার রবের এ ঘোষণা পূর্ণ হয়েছে: ‘নিশ্চয় আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবোই।’

(120) আর (হে রাসূল!) আমি তোমার অন্তরকে (হকের ওপর) দৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য তোমার কাছে পূর্বের রাসূলদের এ সকল সংবাদ বর্ণনা করছি। আর এর মাধ্যমে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মু’মিনদের জন্য উপদেশ ও স্মরণ।

(121) আর যারা ঈমান আনে না, তাদেরকে বলো: ‘তোমরা (সত্য বিমুখ হয়ে) স্ব স্ব অবস্থানে কাজ করতে থাকো, আমরাও (সত্যের প্রতি দাওয়াতের ও এর ওপর ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে) আমাদের কাজ করছি।

(122) এবং তোমরা (পরিণতির জন্য) অপেক্ষা করো, আমরাও অপেক্ষায় থাকলাম।’

(123) আসমানসমূহ ও জমিনের সব গোপন তথ্য আল্লাহরই মালিকানায় এবং (কিয়ামতের দিন) তাঁরই কাছে সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে। সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি একমাত্র তাঁর ইবাদাত করো এবং তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করো। আর তোমরা যা কিছু করো, সে ব্যাপারে তোমার রব গাফিল নন।