12 - Yusuf ()

|

(1) আলিফ-লাম-রা। এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।

(2) (হে আরব জাতি!) নিশ্চয় আমি কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা (সহজেই) বুঝতে পারো।

(3) (হে রাসূল!) আমি তোমার কাছে ওহীর মাধ্যমে এই আল-কুরআন অবতীর্ণ করে তোমার নিকট (সত্যতা, ভাষার বিশুদ্ধতা এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে) সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি; যদিও তুমি এর পূর্বে এ বিষয়ে অনবহিতদের (না জানা) লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।(১)

(4) (হে রাসূল! তুমি) স্মরণ করো, যখন ইউসুফ তার পিতাকে বললো: ‘হে আমার পিতা! আমি (স্বপ্নে) দেখেছি এগারোটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে, আমি তাদেরকে আমার প্রতি সাজদাবনত অবস্থায় দেখেছি।’ (অর্থাৎ তারা আমাকে সাজদা করছে।)

(5) (এ কথা শুনে) সে (ইউসুফের পিতা ইয়াকূব) বললো: ‘হে আমার পুত্র! তুমি তোমার ভাইদের কাছে তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিও না, তাহলে তারা (স্বপ্নের মর্ম বুঝে হিংসাবশত) তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’

(6) আর (হে ইউসুফ! তুমি যেমন ওই স্বপ্ন দেখেছ) এভাবে তোমার রব (ভবিষ্যতে ) তোমাকে (নবী হিসেবে) মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিবেন। আর তোমার ওপর ও ইয়াকূবের পরিবারের ওপর তাঁর নি‘আমত পূর্ণ করবেন, যেভাবে তিনি তা ইতঃপূর্বে পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের ওপর। নিশ্চয় তোমার রব সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

(7) নিশ্চয়ই ইউসুফ ও তার ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্য রয়েছে, অনেক নিদর্শন (ও শিক্ষা)

(8) (স্মরণ করো, ) যখন তারা (ইউসুফের সৎ ভাইয়েরা) বলেছিল: ‘নিশ্চয় ইউসুফ ও তার (সহোদর) ভাই (বিনইয়ামিন ) আমাদের পিতার নিকট আমাদের চেয়ে অধিক প্রিয়; অথচ আমরা (দশ ভাই ) বৃহৎ সংখ্যার একটি দল। নিশ্চয় আমাদের পিতা (তাদেরকে অযৌক্তিকভাবে আমাদের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে) সুস্পষ্ট ভুলের মধ্যে আছেন।’

(9) (ইউসুফের ভাইদের কেউ কেউ পরামর্শস্বরূপ বলল:) ‘তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো অথবা তাকে (দূরে) কোনো স্থানে ফেলে আসো, তাহলে ( তার অবর্তমানে) তোমাদের পিতার দৃষ্টি তোমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হবে(১) এবং (তাকে হত্যার পরে তাওবা করে) তোমরা সৎ লোক হয়ে যাবে।’

(10) তাদের (ভাইদের) মধ্য থেকে একজন বললো: ‘তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না; বরং যদি কিছু করতেই হয়, তবে তাকে কোনো কূপের গভীরে ফেলে দাও, তাহলে পথিকদলের কেউ (পথ চলার সময় ) তাকে তুলে (দূর দেশে) নিয়ে যাবে।’

(11) তারা (তাদের পিতা ইয়াকূবকে) বললো: ‘হে আমাদের পিতা! আপনার কী হলো , ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে নিরাপদ মনে করছেন না? অথচ আমরাই তার হিতাকাঙ্ক্ষী?’

(12) ‘আপনি আগামী কাল তাকে আমাদের সাথে পাঠান। সে সানন্দে ঘোরাফেরা করবে ও খেলবে। আর অবশ্যই আমরা তার হিফাযতকারী।’

(13) সে বললো: ‘নিশ্চয় এটা আমাকে চিন্তিত করে যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি, যখন তোমরা (খেল-তামাশায় ব্যস্ত হয়ে) তার প্রতি অমনোযোগী হয়ে যাবে, তখন নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলবে ।’

(14) (পিতার আশঙ্কার কথা শুনে) তারা বলল: ‘আমরা বৃহৎ সংখ্যার একটি দল হওয়া সত্ত্বেও যদি নেকড়ে বাঘ তাকে (ইউসুফকে) খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।’

(15) ( এভাবে অনেক বলে-কয়ে, চাপ দিয়ে) যখন তারা তাকে তাদের সাথে নিয়ে গেলো এবং তাকে কূপের গভীরে ফেলে দিতে একমত হলো (তখন তারা তাই করল) এবং আমি তাকে (ইউসুফকে) ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম, ‘অবশ্যই তুমি তাদেরকে (ভবিষ্যতে) তাদের এই কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানাবে; অথচ তারা তা উপলব্ধি করতে পারবে না।’

(16) আর (ইউসুফকে কূপে ফেলে দিয়ে) তারা (ষড়যন্ত্রকে গোপন রাখার জন্য ভান করে) রাতের প্রথম ভাগে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার নিকট আসলো।

(17) তারা বললো: ‘হে আমাদের পিতা, আমরা (দৌড় ও তীর নিক্ষেপ) প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম, আর ইউসুফকে রেখে গিয়েছিলাম আমাদের মালপত্রের নিকট (পাহারা দিতে), অতঃপর নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলেছে। আর আপনি আমাদেরকে তো বিশ্বাসই করবেন না; যদিও আমরা সত্যবাদী হই।’

(18) আর তারা (পিতার কাছে নিজেদেরকে সত্যবাদী প্রমাণ করতে) ইউসুফের জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। (সব দেখে-শুনে) সে বললো: ‘বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি গল্প সাজিয়েছে। সুতরাং আমার কর্তব্য হল উত্তমরূপে ধৈর্যধারণ করা। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।’

(19) আর একটি যাত্রীদল (কূপের নিকট) আসলো এবং তারা তাদের পানি সংগ্রহকারীকে (পানি আনতে কূপের দিকে) প্রেরণ করলো। অতঃপর সে তার বালতি ফেললো। (সেই বালতিতে উঠে এলো ইউসুফ। ) তখন সে বলে উঠলো, ‘কী সুখবর, এ যে একটি বালক!’ এবং তারা তাকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে গোপন করে ফেললো। আর তারা (ইউসুফকে কেনা-বেচা নিয়ে) যা কিছু করছিলো, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত।

(20) আর তারা (পানি সংগ্রহকারীরা) তাকে অতি নগণ্য মূল্যে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলো। আসলে, (সে বিনা পুঁজিতে পাওয়া পণ্য বিধায়) তারা তার ব্যাপারে ছিল অনাগ্রহী।(১)

(21) আর মিসরের যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করেছিল, (বাড়ী ফিরে ) সে তার স্ত্রীকে বললো: ‘(তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার করো এবং) এর থাকার সুব্যবস্থা করো। আশা করা যায়, সে (ভবিষ্যতে) আমাদের উপকার করবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করবো।’ আর এভাবেই আমি ইউসুফকে সে দেশে অধিষ্ঠিত করলাম এবং যাতে আমি তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিতে পারি। আল্লাহ নিজ কর্ম সম্পাদনে অপ্রতিহত; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।

(22) আর সে যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো, আমি তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম এবং এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।

(23) আর যে মহিলার ঘরে সে ছিল, সে তাকে ( অসৎ উদ্দেশ্যে ) কুপ্ররোচনা দিলো এবং (একান্ত নির্জনতার জন্য) দরজাগুলো বন্ধ করে দিল। আর বললো, ‘এসো।’ সে বললো:(তুমি আমাকে যে পথে আহ্বান করছ,) আমি তা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। নিশ্চয় তিনি (মিশরের অধিপতি) আমার মনিব, তিনি আমার থাকার সুব্যবস্থা করেছেন।(১) নিশ্চয় যালিমগণ সফল হয় না।

(24) আর সে মহিলা তার প্রতি (অসৎকাজের জন্যে) আসক্ত হলো, আর সেও তার প্রতি আসক্ত হতো; যদি না তার রবের সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখতে পেতো। আমি তাকে এ জন্যেই তা দেখিয়েছি, যাতে আমি তার থেকে মন্দকাজ ও অশ্লীলতা (ব্যভিচার) দূর করে দিতে পারি। নিশ্চয় সে আমার একনিষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।(১)

(25) আর তারা উভয়ে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো(১) এবং মহিলাটি পেছন হতে তার জামা ছিঁড়ে ফেললো। আচমকা তারা মহিলার স্বামীকে দরজার কাছে পেলো। মহিলাটি (তার স্বামীকে দেখেই ছলনা করে) বলল: ‘যে লোক তোমার পরিবারের সাথে মন্দকর্ম করতে চায়, তাকে কারাবন্দি করা বা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া ছাড়া, তার আর কী শাস্তি হতে পারে?’

(26) সে (ইউসুফ) বলল: ‘সেই আমাকে (অসৎকর্ম করতে) কুপ্ররোচনা দিয়েছে।’ আর মহিলার পরিবার থেকে একজন সাক্ষ্যদাতা এ মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করলো, (সে বললো:) ‘যদি তার জামা সামনের দিক থেকে ছেঁড়া হয় তাহলে সে (মহিলা) সত্য বলেছে এবং সে (পুরুষ) মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।’

(27) ‘আর তার জামা যদি পেছন থেকে ছেঁড়া হয়, তাহলে সে (মহিলা) মিথ্যা বলেছে এবং সে (ইউসুফ) হচ্ছে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।’

(28) অতঃপর সে (স্বামী) যখন দেখলো, তার (ইউসুফের) জামা পেছন থেকে ছেঁড়া, তখন (প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পেরে ) সে (তার স্ত্রীকে) বললো: ‘নিশ্চয় এটি তোমাদের ষড়যন্ত্র। (হে নারী জাতি!) নিশ্চয় তোমাদের ষড়যন্ত্র তো ভীষণ ভয়ানক।’

(29) (তারপর সে ইউসুফকে বলল:) ‘ইউসুফ! তুমি এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাও, (এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না । ) আর (হে নারী) তুমি তোমার অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তুমি (ইউসুফকে আকৃষ্ট করার কারণে) অপরাধীদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলে।’

(30) আর (এ খবর নগরে ছড়িয়ে পড়লে) নগরীর মহিলারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো: ‘আযীযের পত্নী স্বীয় যুবককে উন্মত্ত করেছে। (যুবকের প্রতি) গভীর প্রেম তাকে উন্মাদ করে দিয়েছে। নিশ্চয় আমরা তাকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতেই দেখতে পাচ্ছি।’

(31) অতঃপর সে (আযীযের স্ত্রী) যখন তাদের ষড়যন্ত্র ও কানাঘুষার কথা শুনতে পেলো, তখন তাদেরকে ডেকে পাঠালো এবং তাদের জন্য হেলানবিশিষ্ট আসন প্রস্তুত করলো। আর তাদের প্রত্যেককে একটি করে ছুরি প্রদান করলো(১) এবং ইউসুফকে বললো: ‘তাদের সামনে বেরিয়ে আসো।’ অতঃপর তারা যখন তাকে দেখলো, তখন তারা তার অনিন্দ সৌন্দর্যে অভিভূত হলো এবং তারা (খাদ্য কেটে খাওয়ার সময় ছুরি দিয়ে) নিজেদের হাত কেটে ফেললো আর বললো: ‘আল্লাহই মহা পবিত্র! এতো মানুষ নয়। এ তো এক মহিমান্বিত ফিরিশতা।’

(32) সে (আযীযের স্ত্রী মহিলাদের অবস্থা দেখে) বললো: ‘এই সে (দাস), যার (ভালোবাসার) ব্যাপারে তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করেছিলে। আর আমিই তাকে কুপ্ররোচনা দিয়েছিলাম; কিন্তু সে বিরত থেকেছে এবং আমি তাকে যা আদেশ করছি সে যদি তা না করে, তবে অবশ্যই সে কারারুদ্ধ হবে এবং নিশ্চয় সে (জেলে প্রবেশ করে) অপদস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’

(33) সে (ইউসুফ তার রবকে ডেকে) বললো: ‘হে আমার রব, তারা আমাকে যে অসৎকর্মের প্রতি আহ্বান করছে, তা থেকে কারাগারই আমার নিকট অধিক প্রিয়। আর আপনি যদি আমার থেকে তাদের চক্রান্ত প্রতিহত না করেন, তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বো এবং আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব।’

(34) অতঃপর তার রব তার ডাকে সাড়া দিলেন এবং তার থেকে তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয় তিনি (ইউসুফ ও সকল বান্দার দু‘আর) সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

(35) তারপর (ইউসুফের নির্দোষ প্রমাণের ও নারীদের ছলচাতুরীর) বিভিন্ন নিদর্শনাবলি দেখার পরে তাদের কাছে মনে হলো যে, তাকে কিছু কাল পর্যন্ত অবশ্যই কারাগারে রাখতে হবে, (যাতে উক্ত অপমানজনক খবর প্রকাশ না পায়)

(36) আর তার সাথে আরো দুই যুবক একই কারাগারে প্রবেশ করল। তাদের একজন বললো: ‘আমি স্বপ্নে আমাকে দেখতে পেলাম, আমি মদের জন্য আংগুর নিংড়াচ্ছি’। আর অপর জন বললো: ‘আমি স্বপ্নে আমাকে দেখলাম যে, আমি আমার মাথার ওপর রুটি বহন করছি, তা থেকে পাখি (ঠুকরে) খাচ্ছে। (হে ইউসুফ!) তুমি আমাদেরকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা অবহিত করো। নিশ্চয় আমরা আপনাকে ইহসানকারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাচ্ছি।’

(37) সে (ইউসুফ) বললো: ‘তোমাদেরকে যে খাদ্য দেয়া হয়, তা তোমাদের কাছে আসার পূর্বেই আমি তোমাদেরকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানিয়ে দিবো। সেটি এমন জ্ঞান থেকেই বলবো, যা আমার রব আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।(১) নিশ্চয় আমি পরিত্যাগ করেছি সে জাতির আদর্শ, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং যারা আখিরাতকে অস্বীকারকারী।’

(38) আর আমি অনুসরণ করেছি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের ধর্ম (মতাদর্শ)। আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করা আমাদের জন্য সংগত নয়। (যে তাওহীদ ও ঈমানের ওপর আমি ও আমার পূর্বপুরুষ প্রতিষ্ঠিত রয়েছি) এটি আমাদের ও সকল মানুষের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ (ও তাঁর তাওফিক); কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না (বরং তারা তাঁর সাথে কুফরি করে)।’

(39) (ইউসুফ তার জেলের সঙ্গীদ্বয়কে সম্বোধন করে বলল:) ‘হে আমার কারা সঙ্গীদ্বয়! (তোমরা বলো তো দেখি ) বহু সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন রব উত্তম, নাকি মহাপরাক্রমশালী এক আল্লাহ উত্তম ?‘

(40) ‘তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদাত করছো, যাদের নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা করেছো, যাদের (উপাস্য হওয়ার) ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাযিল করেননি। বিধান দেয়ার অধিকার শুধু আল্লাহরই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, ‘তাঁকে ছাড়া আর কারো ইবাদাত করো না।’ এটিই সরল সঠিক দীন; কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’

(41) ‘হে আমার কারা সঙ্গীদ্বয়! তোমাদের দুজনের একজন স্বীয় মনিবকে মদপান করাবে। আর অন্যজনকে শূলে চড়ানো হবে, অতঃপর পাখি তার মাথা থেকে আহার করবে। যে বিষয়ে তোমরা জানতে চাচ্ছো তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে(১)

(42) আর তাদের দু’জনের মধ্যে যে মুক্তি পাবে বলে সে (ইউসুফ) ধারণা করল, তাকে বলে দিলো: ‘তোমার মনিবের কাছে আমার কথা উল্লেখ করবে।’ কিন্তু শয়তান তাকে স্বীয় মনিবের নিকট উল্লেখ করার বিষয়টি ভুলিয়ে দিলো। ফলে সে কয়েক বছর কারাগারে অবস্থান করলো।

(43) একদা (মিসরের) বাদশাহ (দরবারে তার সভাসদদের ) বললো: ‘আমি স্বপ্নে দেখছি, সাতটি মোটা তাজা গাভি, তাদের খেয়ে ফেলছে সাতটি ক্ষীণকায় গাভি এবং দেখলাম সাতটি সবুজ শিষ ও অপর সাতটি শুষ্ক। হে পরিষদবর্গ! তোমরা আমাকে আমার এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দাও; যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী হও।’

(44) তারা বললো: ‘এটি কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। আর আমরা এরূপ স্বপ্ন ব্যাখ্যায় জ্ঞানী নই।’

(45) আর সে দু’জন কারাবন্দির মধ্যে যে (বাদশাহকে মদ্যপানকারী) মুক্তি পেয়েছিল, সে বললো এবং দীর্ঘ দিন পর তার (স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইউসুফের গভীর জ্ঞানের কথা) স্মরণ হলো: ‘আমি তোমাদেরকে এর ব্যাখ্যা জানিয়ে দিচ্ছি, অতএব তোমরা আমাকে (ইউসুফের কাছে) পাঠিয়ে দাও।’

(46) (সে কারাগারে গিয়ে বলল:) ‘হে ইউসুফ, হে সত্যবাদী! আপনি আমাদের (সেই লোকের স্বপ্নের) ব্যাখ্যা দিন, (যে স্বপ্নে দেখেছে যে), সাতটি মোটা তাজা গাভি, যাদের খাচ্ছে সাতটি ক্ষীণকায় গাভি এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অপর সাতটি শুষ্ক শিষ সম্পর্কে, যাতে আমি লোকদের কাছে ফিরে যেতে পারি, যেনো তারা (স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও আপনার মান-মর্যাদা সম্পর্কে) জানতে পারে।’

(47) ইউসুফ বললো: ‘ শোনো, তোমরা সাত বছর একাধারে চাষাবাদ করবে, এ সময়ে তোমরা যে শস্য কেটে ঘরে তুলবে, তার মধ্য থেকে যে সামান্য পরিমাণ খাবে, সেগুলো ছাড়া অবশিষ্ট শস্য (পোকা থেকে রক্ষা পেতে) শিষসহ রেখে দিবে।’

(48) ‘তারপর (উৎপাদনশীল সাত বছরের পর) আসবে সাতটি কঠিন (দুর্ভিক্ষের) বছর। এ সাত বছর, তোমরা যা আগে সঞ্চয় করে রাখবে, লোকেরা তা খাবে; শুধুমাত্র সামান্য কিছু শস্য ছাড়া, যা তোমরা (বীজের জন্য) সংরক্ষণ করবে।’

(49) ‘এরপর (দুর্ভিক্ষের সাত বছর পর) আসবে এমন এক বছর, যাতে মানুষ বৃষ্টি সিক্ত হবে এবং(অসংখ্য ফল-ফলাদি- শস্য উৎপন্ন হওয়াই) তাতে তারা (ফলের) রস নিংড়াবে।’(১)

(50) আর বাদশাহ (ইউসুফের দেওয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে) বললো: ‘তোমরা তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো।’ অতঃপর যখন দূত তার কাছে আসলো, তখন সে বললো: ‘তুমি তোমার (বাদশাহ) মনিবের নিকট ফিরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করো, (বহুকাল পূর্বে ভোজ সবায়) যে সব মহিলা নিজ নিজ হাত কেটে ফেলেছিল, তাদের অবস্থা কী?(১) নিশ্চয় আমার রব তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।’

(51) বাদশাহ (সেসব মহিলাদেরকে সম্বোধন করে) বললো: ‘তোমরা যখন ইউসুফকে কুপ্ররোচনা দিয়েছিলে, তখন তোমাদের কী হয়েছিল?’ তারা বলল: ‘মহিমা আল্লাহর! আমরা তার ব্যাপারে খারাপ কিছু জানি না।’ আযীয পত্নী বললো: ‘এখন সত্য প্রমাণিত। আমিই তাকে কুপ্ররোচনা দিয়েছি। আর নিশ্চয় সে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।’

(52) (আযীযের স্ত্রী বলল:) ‘এটি এ জন্য যে, যাতে সে (আমার স্বামী বাদশা) জানতে পারে, আমি তার অনুপস্থিতিতে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।(১) আর (এ কথা আমার কাছে স্পষ্ট যে,) নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্ত সফল করেন না।’

(53) (আযীযপত্নী আরো বললো:) ‘আর আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না। নিশ্চয় মানুষের নফস তো মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, তবে আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া (সেই কেবল প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকতে পারে।)। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’(১)

(54) আর (ইউসুফের দোষমুক্ত প্রমাণিত হওয়ায়) বাদশাহ বললো: ‘তোমরা তাকে আমার নিকট নিয়ে আসো। আমি তাকে নিজের জন্যে (একনিষ্ঠ সাথি হিসেবে) মনোনীত করবো।’ অতঃপর যখন সে (বাদশাহ) তার সাথে কথা বলল, তখন বললো:(হে ইউসুফ!) নিশ্চয় আজ তুমি আমাদের নিকট উচ্চ মর্যাদাশীল, পূর্ণ আস্থাভাজন ব্যক্তি।’

(55) সে বললো: ‘(আপনি যদি আমাকে বিশ্বস্ত মনে করে থাকেন তাহলে ) আমাকে (মিশরের) রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্ব দিন। নিশ্চয় আমি তা যথাযথ হিফাযতকারী, সুবিজ্ঞ।’

(56) আর এমনিভাবে আমি ইউসুফকে (মিসরের) জমিনের কর্তৃত্ব প্রদান করেছি, তার যেখানে ইচ্ছা সে সেখানেই তো অবস্থান করতে পারতো। আমি যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমত দান করি, আর আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করি না।

(57) আর যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং (তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে) একমাত্র তাঁকেই ভয় করে, তাদের জন্য আখিরাতের প্রতিদানই উত্তম।

(58) আর ইউসুফের (সৎ) ভাইয়েরা (খাদ্য শস্য লাভের জন্যে মিসরে) আসল এবং তার কাছে প্রবেশ করলো। অতঃপর সে তাদেরকে (দেখেই) চিনে ফেলল; অথচ তারা তাকে চিনতে পারলো না।

(59) আর সে যখন তাদেরকে তাদের রসদ সামগ্রী প্রস্তুত করে দিলো, তখন বললো: ‘তোমরা (পরের বারে আসার সময়) তোমাদের পিতার পক্ষ হতে তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।(১) তোমরা কি দেখো না যে, আমি পরিমাপে পূর্ণমাত্রায় দেই এবং আমি উত্তম অতিথিপরায়ণ।

(60) ‘আর তোমরা যদি তাকে নিয়ে না আসো, তাহলে আমার নিকট তোমাদের জন্য কোন পরিমাপ (বরাদ্দ) কৃত রসদ নেই এবং তোমরা আমার ধারে-কাছেও আর আসবে না।’

(61) তারা বললো: ‘অচিরেই আমরা তার ব্যাপারে তার পিতাকে রাজি করাবো এবং আমরা নিশ্চয়ই এটা করবো।’

(62) আর ইউসুফ তার কর্মচারীদেরকে বললো: ‘তাদের পণ্যমূল্য (ফিরিয়ে দিয়ে তা) তাদের মালপত্রের মধ্যে রেখে দাও, যাতে তারা পরিবারের নিকট ফিরে গিয়ে তা চিনতে পারে(১), যাতে তারা (দ্বিতীয়বার) আবার ফিরে আসে।’

(63) অতঃপর যখন তারা তাদের বাবার কাছে ফিরে আসলো, তখন বললো: ‘হে আমাদের পিতা! (ভবিষ্যতের জন্য ) আমাদের জন্য বরাদ্দ খাদ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে(১)। অতএব আমাদের সাথে আমাদের ভাইকে পাঠান, যেন আমরা পরিমাপ করে খাদ্য আনতে পারি। আর অবশ্যই আমরা তার হিফাযত করবো।’

(64) সে (তাদের পিতা) বললো: ‘তোমাদেরকে কি আমি তার ব্যাপারে নিরাপদ মনে করবো, যেমন নিরাপদ মনে করেছিলাম ইতঃপূর্বে তার ভাইয়ের (ইউসুফের) ব্যাপারে? তবে আল্লাহ উত্তম হিফাযতকারী এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’

(65) আর (বাড়ী ফেরার পর ) যখন তারা তাদের খাদ্য সামগ্রী (এর বস্তা) খুললো, তখন তারা দেখতে পেলো তাদের পণ্যমূল্য তাদের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে। তারা বললো: ‘হে আমাদের পিতা! আমরা আর কী চাই? এই আমাদের পণ্যমূল্য, তা আমাদেরকে (দয়া করে) ফেরত দেয়া হয়েছে (এখন তাহলে অনুমতি দিন, ভাইকে সাথে নিয়ে যাই)। তাহলে আমরা আমাদের পরিবারবর্গের জন্য আরো বেশী খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসবো। আর আমরা আমাদের ভাইকে হিফাযত করবো উপরন্তু (সে থাকার কারণে) আরো এক উট বোঝাই খাদ্য সামগ্রী বেশি পাবো। (বাদশাহর জন্য) ঐ খাদ্য সামগ্রী প্রদান করা খুবই সহজ।’

(66) সে (তাদের পিতা) বললো: ‘আমি তোমাদের সাথে তাকে কখনো পাঠাবো না; যতক্ষণ না তোমরা আমাকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার প্রদান করো যে, তাকে অবশ্যই আমার নিকট ফিরিয়ে দিবে। তবে তোমরা (শত্রু বা বিপদ দ্বারা) বেষ্টিত হলে ভিন্ন কথা।’ অতঃপর যখন তারা তাকে অঙ্গীকার প্রদান করলো, তখন সে বললো: ‘আমরা যা বলছি সে ব্যাপারে আল্লাহই সাক্ষী।’

(67) (যাত্রার প্রাক্কালে) সে (তাদের পিতা) বললো: ‘হে আমার পুত্রগণ! (মিসরে পৌছার পর ) তোমরা সকলে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না; বরং ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। (মনে রাখবে ) আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিপরীতে আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারবো না।(১) হুকুমের মালিক তো আল্লাহই। আমি তাঁরই উপর তাওয়াক্কুল করি। আর তাঁরই ওপর যেন সকল তাওয়াক্কুলকারী তাওয়াক্কুল (ভরসা) করে।’

(68) আর যখন তারা তাদের পিতা যেভাবে আদেশ করেছিলেন সেভাবেই (বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে মিসরে) প্রবেশ করলো, তখন তা আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে তাদের কোনো উপকারে আসেনি, তবে তা ছিল ইয়া‘কূবের মনের একটি অভিপ্রায় (অসিয়ত), যা এর ফলে পূর্ণ হয়েছে। আর অবশ্যই সে আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিল; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।

(69) আর যখন তারা ইউসুফের নিকট প্রবেশ করলো, তখন সে তার (সহোদর) ভাইকে নিজের কাছে আনলো এবং (গোপনে তাকে) বললো: ‘আমিই তোমার (হারানো) ভাই। কাজেই ইতঃপূর্বে তারা ( সৎ ভাইরা তোমার-আমার সাথে) যা কিছু করেছে, তাতে তুমি দুঃখ পেয়ো না।’(১)

(70) অতঃপর সে যখন তাদের রসদ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিল, তখন সে (তার সহোদর ভাইকে কাছে রাখার মাধ্যম হিসেবে) তার সহোদরের মালপত্রের মধ্যে (সু- কৌশলে) একটি (রাজকীয় ) পানপাত্র রেখে দিল। তারপর এক আহ্বায়ক চিৎকার করে বলল: ‘হে কাফিলার লোকজন! তোমরা নিশ্চয় চোর।’

(71) তারা পেছন থেকে ঘোষকদের দিকে ফিরে বললো: ‘তোমরা কী হারিয়েছ?’

(72) তারা (কর্মচারীরা) বললো, ‘আমরা বাদশাহর পানপাত্র হারিয়েছি। যে তা (খুঁজে) এনে দিবে, তার জন্য রয়েছে, এক উট বোঝাই পুরস্কার। আর আমি সেজন্য জামিনদার।’

(73) তারা (ইউসুফের ভাইয়েরা) বললো: ‘আল্লাহর শপথ, তোমরা নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছ, আমরা এ দেশে (মিসরে) অশান্তি সৃষ্টি করতে আসিনি। আর আমরা চোর-ও নই।’

(74) তারা বললো: ‘তাহলে তার শাস্তি কি হবে, যদি (তল্লাশি করার পর ) তোমরা মিথ্যাবাদী (সাব্যস্ত) হও?’(১)

(75) তারা বললো: ‘(আমাদের নিকট) তার শাস্তি হবে, যার মালপত্রের ভিতর চুরিকৃত জিনিসটি পাওয়া যাবে, সে নিজই হবে তার বিনিময় । (অর্থাৎ তাকে দাস হিসেবে রেখে দিবে) এভাবেই আমি যালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।

(76) তারপর সে তার (আপন) ভাইয়ের পাত্রের পূর্বে তাদের (সৎ ভাইদের) পাত্রগুলো দিয়ে তল্লাশি শুরু করলো। তারপর সেটি তার (আপন) ভাইয়ের পাত্র থেকে বের করলো। এভাবে আমি ইউসুফের জন্য কৌশল করলাম।(১) আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া বাদশাহর আইনে সে তার ভাইকে রেখে দিতে পারত না। আমি যাকে ইচ্ছা তার মর্যাদা উঁচু করে দেই এবং প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর রয়েছে একজন মহাজ্ঞানী।

(77) (পানপাত্রটি যখন বিন ইয়ামিনের বস্তায় পাওয়া গেল, তখন) তারা (ইউসুফের ভাইয়েরা) বললো: ‘যদি সে চুরি করে থাকে (তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই), কারণ ইতঃপূর্বে তার এক সহোদর ভাই চুরি করেছিল।’(১) ইউসুফ এ কথার আঘাতের কষ্টটি নিজের কাছে লুকিয়ে রাখলো, তাদের কাছে প্রকাশ করলো না, সে (মনে মনে) বললো: ‘তোমাদের অবস্থান তো (পূর্বের মতোই) নিকৃষ্টতর। আর তোমরা যা বলছো, সে সম্পর্কে আল্লাহ ভালোভাবেই অবগত রয়েছেন।’

(78) তারা বললো: ‘হে আযীয, তার পিতা অতিশয় বৃদ্ধ। আপনি তার স্থলে আমাদের একজনকে রেখে দিন। আমরা তো আপনাকে সৎকর্মশীলদের একজন দেখছি ।

(79) সে বললো: ‘যার কাছে আমাদের মাল পেয়েছি তাকে ছাড়া (নির্দোষ) কাউকে পাকড়াও করা হতে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি। এমন করলে আমরা নিশ্চিত যালিম হয়ে যাবো।’

(80) তারপর তারা যখন (তাদের সৎ ভাইয়ের মুক্তির ব্যাপারে) তার (বাদশাহের অথবা ইউসুফের) কাছ থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হলো, তখন তারা পরামর্শ করতে একান্তে মিলিত হলো। তাদের বড়জন বললো: ‘তোমরা কি জানো না যে, তোমাদের পিতা তোমাদের কাছ থেকে (বিনইয়ামিনকে তার কাছে ফিরিয়ে নিতে) আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন। আর ইতঃপূর্বে তোমরা ইউসুফের ব্যাপারেও অন্যায় করেছো? সুতরাং যতক্ষণ না আমার পিতা আমাকে অনুমতি দিবেন অথবা আল্লাহ আমার ব্যাপারে ফয়সালা করবেন; ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এ দেশ (মিসর) ছেড়ে যাবো না এবং তিনি সর্বোত্তম ফয়সালাকারী।’

(81) (বড় ভাই আরো বললো:) ‘তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও এবং বলো: ‘হে আমাদের পিতা! নিশ্চয়ই আপনার পুত্র চুরি করেছে এবং আমরা যা জানি, তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম।(১) আর আমরা তো গায়িব সংরক্ষণকারী নই।’

(82) ‘আর (হে আমাদের পিতা! আমাদের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য) যে জনপদে আমরা ছিলাম সেখানকার অধিবাসীদেরকে জিজ্ঞেস করুন এবং যে কাফিলার সাথে আমরা এসেছি তাদেরকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমরা (চুরির সংবাদ প্রসঙ্গে) অবশ্যই সত্য বলছি।’

(83) সে (ইয়া‘কূব) বললো: ‘বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্য একটি গালগল্প সাজিয়েছে। সুতরাং (আমার করণীয় হচ্ছে) উত্তম ধৈর্যধারণ। আশা করি, আল্লাহ তাদেরকে একসঙ্গে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’

(84) আর তাদের থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং (সুগভীর শোকার্ত গলায় হাহাকার করে ) বললো: ‘আমার ইউসুফের জন্য আফসোস!’ আর দুঃখে (বেশি কান্নার কারণে) তার চক্ষুদ্বয় সাদা (দৃষ্টিহীন) হয়ে গেলো, কিন্তু সে ছিল সংবরণকারী।(১)

(85) তারা বললো: ‘আল্লাহর শপথ, আপনি তো ইউসুফকে সবসময় স্মরণ করতেই থাকবেন; যতক্ষণ না আপনি মুমূর্ষু হবেন বা মারা যাবেন।’

(86) সে (পিতা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে) বললো: ‘আমি আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ আল্লাহর কাছেই নিবেদন করছি এবং আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তা জানি, যা তোমরা জানো না।’

(87) ‘হে আমার পুত্রগণ! তোমরা (আবার মিসরে ) যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের খোঁজ খবর নাও। আর তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। কেননা কাফির জাতি ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।’

(88) অতঃপর যখন তারা ইউসুফের কাছে (আবার) প্রবেশ করলো, তখন তারা বললো: ‘হে আযীয, অভাব-অনটন ও দুঃখ-কষ্ট আমাদেরকে ও আমাদের পরিবারকে পেয়ে বসেছে। আর আমরা (এবার ) অতি নগণ্য পণ্যমূল্য নিয়ে এসেছি। অতএব, আমাদেরকে খাদ্যের রসদ পূর্ণমাত্রায় দিন (যেমনিভাবে আপনি আমাদেরকে ইতঃপূর্বে দিতেন) এবং (বিপদগ্রস্ত হিসেবে ) আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে উত্তম প্রতিদান দেন।’

(89) সে (তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরে) বললো: ‘তোমাদের জানা আছে কি, ইউসুফ ও তার (আপন) ভাইয়ের সাথে তোমরা কীরূপ আচরণ করেছিলে, যখন তোমরা (নিজেদের উক্ত কর্মের পরিণামের ব্যাপারে) অজ্ঞ ছিলে?’

(90) তারা বললো: ‘তুমি কি সত্যিই ইউসুফ?’ সে বললো: আমিই ইউসুফ, আর এ আমার সহোদর। আল্লাহ আমাদের ওপর (দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে এবং আমাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়ে) অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহকে (তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে) ভয় করে এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, অবশ্যই আল্লাহ (সেই) সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।’

(91) তারা (নিজেদের কৃতকর্মের ওজর পেশ করে) বললো: ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আমাদের ওপর তোমাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর আমরা সত্যিই ছিলাম অপরাধী।’

(92) ইউসুফ (তাদের ওজর গ্রহণ করে) বলল: ‘আজ তোমাদের ওপর কোন নিন্দা-ভর্ৎসনা নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আর তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’

(93) (ইউসুফ তাদেরকে নিজের জামাটি দিয়ে বললো:) ‘তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও, অতঃপর সেটি আমার পিতার চেহারারওপর রেখো; এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর তোমরা তোমাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসো।’

(94) আর (ইউসুফের ভাইদের ) কাফিলাটি যখন (মিসর থেকে) বের হলো, তাদের পিতা (ইয়া‘কূব নিজ বাড়ীর নিকটস্থ লোকদেরকে) বললো: ‘নিশ্চয় আমি ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি; যদি তোমরা আমাকে নির্বোধ বৃদ্ধ মনে না করো।’

(95) তারা বললো: ‘আল্লাহর শপথ! আপনি তো সেই পুরোনো ভ্রান্তিতেই আছেন।’(১)

(96) অতঃপর যখন সুসংবাদদাতা (ইয়া‘কূবের কাছে) এলো, তখন সে জামাটি তার চেহারার ওপর রাখল। এতে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলো। সে বললো: ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা জানি, তোমরা তা জানো না।’

(97) তারা বলল: ‘হে আমাদের পিতা! আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন; নিশ্চয় আমরা (ইউসুফ ও তাঁর ভাইয়ের সাথে কৃত আচরণে) ছিলাম অপরাধী।’

(98) সে বললো: ‘অচিরেই আমি তোমাদের জন্য আমার রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

(99) অতঃপর যখন তারা (ইয়া’কুব ও তাঁর পরিবার) ইউসুফের নিকট প্রবেশ করলো, তখন সে তার পিতামাতাকে নিজের কাছে স্থান করে দিলো এবং বললো: ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আপনারা নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন।’

(100) আর সে তার পিতামাতাকে রাজ সিংহাসনে বসালো এবং তারা সকলে (এগারো ভাই তার সম্মানে) সাজদায় লুটিয়ে পড়লো। আর ইউসুফ বললো: ‘হে আমার পিতা! এই হলো আমার ইতঃপূর্বে স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার রব তা বাস্তবে পরিণত করেছেন। তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন এবং শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করার পরও তিনি তোমাদেরকে মরু অঞ্চল হতে এখানে এনে দিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা, নিপুণতার সাথেই করেন। নিশ্চয় তিনি সম্যক জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’

(101) (অতঃপর ইউসুফ তার রবকে ডেকে বললো:) ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে (মিসরের) রাজত্ব দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা! দুনিয়া ও আখিরাতে আপনিই আমার অভিভাবক, আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন।’

(102) (হে রাসূল!) এগুলো গায়িবের সংবাদ, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানালাম। তুমি তো তাদের নিকট ছিলে না, যখন তারা (ইউসুফের ভাইয়েরা তাকে কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে) একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করছিলো।

(103) আর (হে রাসূল!) তুমি (সকল মানুষের ঈমান আনার ব্যাপারে) আগ্রহ করলেও অধিকাংশ মানুষ মু’মিন হবার নয়।

(104) আর তুমি এর ওপর (দা‘ওয়াতী কাজে) তাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাও না। এ তো (আল-কুরআন) সমগ্র সৃষ্টির জন্য উপদেশমাত্র।

(105) আর আসমানসমূহ ও জমিনে (আল্লাহর তাওহীদ বোঝার) কত নিদর্শন (ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ) রয়েছে, যা তারা অতিক্রম করে চলে যায়; অথচ সেগুলো থেকে তারা বিমুখ (হিদায়াতের জন্য চিন্তা ভাবনা করে তাকিয়েও দেখে না)

(106) আর তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এ অবস্থায় যে, তারা (ইবাদতে আল্লাহর সাথে) শিরক করে।

(107) আর তারা (এ মুশরিকরা) কি নিরাপদ হয়ে গেছে যে, তাদের ওপর (দুনিয়াতে) আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সর্বগ্রাসী শাস্তি আসবে না অথবা হঠাৎ তাদের অজান্তে কিয়ামত উপস্থিত হবে না?

(108) (হে রাসূল! তুমি সবাইকে) বলো: ‘এটা আমার পথ। আমি জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দিই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’

(109) আর আমি তোমার পূর্বে জনপদবাসী থেকে পুরুষদেরকেই কেবল রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের ওপর আমি অহী নাযিল করতাম। তারা (মিথ্যারোপকারীরা) কি জমিনে বিচরণ করে না? তাহলে দেখত, তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের (মিথ্যারোপ করার) পরিণতি কীরূপ হয়েছিল? আর যারা আল্লাহকে (তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে) ভয় করে তাদের জন্য আখিরাতের আবাসনই উত্তম, তবুও কি তোমরা বুঝো না?

(110) অবশেষে যখন রাসূলগণ (স্বীয় জাতির ঈমান আনা থেকে) নিরাশ হয়ে গেল এবং তারা মনে করল (মিথ্যারোপকারীদের ব্যাপারে শাস্তির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে) তাদের সাথে মিথ্যা বলা হয়েছে, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য আসল। অতঃপর আমি যাকে ইচ্ছা (সেই শাস্তি থেকে) মুক্তি দেই, আর অপরাধী জাতি থেকে আমার শাস্তি কখনো ফিরিয়ে নেওয়া হয় না।

(111) তাদের (অতীতের জাতিসমূহের ) এসব কাহিনীগুলোতে(১) অবশ্যই বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। এটা (এ ঘটনাবলি সম্বলিত আল- কুরআন) কোনো বানানো গল্প নয়; বরং এগুলো তাদের পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের (তাওরাত ও ইঞ্জীলের ) সত্যায়নকারী এবং প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ। উপরন্তু যারা ঈমান আনে এমন সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমত।