(1) আলিফ-লাম-মীম।
(2) তিনি আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোনো প্রকৃত ইলাহ (‘ইবাদাতের উপযুক্ত) নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক।
(3) (হে নবী) তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী। আর তিনিই নাযিল করেছেন তাওরাত ও ইনজীল(১)।
(4) ইতোপূর্বে মানবজাতির হিদায়াতের জন্যে। আর তিনি ফুরকান (কুরআন) নাযিল করেছেন। নিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ (১) অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
(5) নিশ্চয় আল্লাহর কাছে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই গোপন থাকে না।(১)
(6) তিনিই সেই সত্তা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।(১) তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ (উপাস্য) নেই; তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, মহা প্রজ্ঞাময়।
(7) তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন যার কিছু আয়াত ‘মুহ্কাম’ (সুস্পষ্ট আয়াত), এগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহ্’ (অস্পষ্ট ও একাধিক অর্থবহ )। সুতরাং যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে শুধু তারাই ফেৎনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ব (আলেম) তারা বলে, ‘আমরা এগুলোতে (পুরো কুরআনে) ঈমান রাখি, সবই আমাদের রবের কাছ থেকে অবতীর্ণ’। আসলে (সঠিক) জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা ব্যতীত আর কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না।
(8) (জ্ঞানে পরিপক্ব ব্যক্তিরা বলে) হে আমাদের রব, আপনি হিদায়াত দেওয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দাতা।
(9) হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি সমস্ত মানুষকে (হিসাবের জন্যে) একদিন একত্রে সমবেত করবেন, সে দিনটির (আগমনের) ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
(10) নিশ্চয় যারা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের সাথে) কুফরী করে, (দুনিয়া ও আখিরাতে) আল্লাহর নিকট তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। আর তারা হবে জাহান্নামের জ্বালানি।
(11) তাদের স্বভাব চরিত্র ফিরা‘ঊন সম্প্রদায় ও তাদের পূর্ববর্তীদের স্বভাব চরিত্রের মতোই। তারা আমার আয়াতগুলোতে মিথ্যারোপ করেছিল। ফলে আল্লাহ তাদের পাপের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছিলেন।(১) আর আল্লাহ (কাফির ও মিথ্যাবাদীকে) শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর।
(12) (হে রাসূল!) তুমি কাফিরদেরকে বলে দাও: ‘তোমরা অচিরেই পরাজিত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে সমবেত করা হবে। আর সেটি কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল।’
(13) নিশ্চয় তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে দু’টি দলের মধ্যে, যারা (বদরের যুদ্ধে) পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দলটি (মক্কার) কাফির। মু’মিনগণ তাদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে (কাফির বাহিনীকে) নিজেদের দ্বিগুণ দেখছিল।১ আর আল্লাহ নিজ সাহায্য দ্বারা যাকে চান শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা। ১) এখানে দুটি মত পরিলক্ষিত হয়, একটি আয়াতের অনুবাদে বর্ণিত হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো, কাফিরগণ তাদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে (মু’মিন বাহিনীকে) নিজেদের দ্বিগুণ দেখছিল।
(14) মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালোবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চিহ্নত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের (ক্ষণস্থায়ী) ভোগসামগ্রী। আর একমাত্র আল্লাহর নিকটেই রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল (জান্নাত)।
(15) (হে রাসূল!) তুমি বলে দাও: আমি কি তোমাদেরকে এ ভোগ-বিলাসের চেয়েও উৎকৃষ্টতর কোনো কিছুর সংবাদ দিব? যারা তাকওয়া অর্জন করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত রয়েছে নদ-নদী-ঝর্ণাধারা। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর সেখানে তাদের জন্যে রয়েছে পবিত্র স্ত্রীগণ এবং আরো রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
(16) (জান্নাতের অধিবাসীগণ তারাই) যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা ঈমান আনলাম।(১) অতএব, আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।’
(17) (তাদের বৈশিষ্ট্য হলো) তারা (আল্লাহর আনুগত্যে এবং বিপদাপদে) ধৈর্যশীল, (কথা ও কাজে) সত্যবাদী, (আল্লাহর পরিপূর্ণ) আনুগত্যকারী, (আল্লাহর পথে) ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থী।
(18) আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফিরিশতা ও জ্ঞানীগণও (এ সাক্ষী দেয়)। আল্লাহ ন্যায় ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি মহা পরাক্রমশালী, মহা প্রজ্ঞাময়।
(19) নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দীন।(১) আর (ইহুদি ও খৃস্টান) যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারা কেবল পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরও মতানৈক্য করেছিল। আর যে কেউ আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করবে, (তাদের জানা উচিত যে,) নিশ্চয় আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।
(20) (হে রাসূল!) যদি তারা তোমার সাথে (তোমার ওপর নাযিলকৃত সত্য নিয়ে) বিতর্ক করে, তবে তুমি তাদেরকে বলো, ‘আমি আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছি এবং আমার অনুসারীরাও।’ আর (ইহুদি ও খৃস্টান) যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং নিরক্ষরদেরকে (মুশরিকদেরকে) বলো, ‘তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ’? তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা অবশ্যই হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার দায়িত্ব শুধু (আমার রিসালাত) পৌঁছিয়ে দেয়া। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
(21) নিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করে, আর মানুষের মধ্য থেকে যারা ন্যায় ও ইনসাফের আদেশ দেয় তাদেরকেও হত্যা করে, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।
(22) এরা এমন লোক (যারা উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী), যাদের দুনিয়া ও আখিরাতে আমলসমূহ নিষ্ফল হয়ে গেছে এবং তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।
(23) (হে নবী!) তুমি কি তাদের (ইহুদিদের) প্রতি লক্ষ্য করনি যাদেরকে কিতাবের (তাওরাতের) অংশ বিশেষ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে, যাতে তা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে। অতঃপর তাদের একদল (তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী না হওয়ায়) মুখ ফিরিয়ে নেয়, মূলত এরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ারই লোক।
(24) এটা এ জন্যে যে, তারা বলে: ‘গুটি কয়েকদিন ব্যতীত জাহান্নামের আগুন আমাদেরকে কখনই স্পর্শ করবে না’। আর তারা যা মিথ্যা (বাতিল ও বানোয়াট) রচনা করত, তা তাদেরকে তাদের দীনের ব্যাপারে প্রতারণা করেছে।
(25) সুতরাং সেদিন তাদের কী অবস্থা হবে যেদিন আমি তাদেরকে (হিসাবের জন্য) একত্রিত করবো, যাতে কোন সন্দেহ নেই। আর প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিদান পূর্ণভাবে দেয়া হবে এবং তাদেরকে কোন ধরনের যুলম করা হবে না।
(26) (হে রাসূল!) তুমি বলো: ‘হে আল্লাহ, আপনি (দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত) রাজত্বের মালিক। আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন। আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন, আর যাকে চান অপমানিত করেন।(১) আপনার হাতেই সমস্ত কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
(27) (আপনার ক্ষমতার একটি বহিঃপ্রকাশ হলো) আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান(১) এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান।(২) আর মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন।(৩) আর যাকে চান অপরিমিত রিযক দান করেন।
(28) মু’মিনরা যেন মু’মিনদের ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধু না বানায়।(১) আর যে কেউ এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবে যদি তাদের পক্ষ থেকে তোমাদের কোন ভয়ের আশঙ্কা থাকে।(২) আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের ব্যাপারে সতর্ক করছেন এবং আল্লাহর নিকটই (সকলের) প্রত্যাবর্তন।
(29) (হে নবী!)তুমি বলে দাও: ‘তোমাদের অন্তরে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন করো অথবা প্রকাশ করো, (সর্বাবস্থায়ই) আল্লাহ তা জানেন। আর তিনি তাও জানেন, যা আছে আসমানসমূহে এবং যা আছে জমিনে। আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
(30) যেদিন প্রত্যেকেই উপস্থিত পাবে (পার্থিব জীবনে) সে যা ভাল আমল করেছে তা, এবং সে যা মন্দ আমল করেছে তাও। সেদিন সে (মন্দ কর্ম সম্পন্নকারী) কামনা করবে- যদি তার এবং এর (মন্দ কর্মের) মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকত! আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন। আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল।
(31) (হে রাসূল!) তুমি বলে দাও: ‘তোমরা যদি (সত্যিকারার্থে) আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে (প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে) আমাকে অনুসরণ করো। তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
(32) (হে রাসূল!) তুমি বলে দাও: ‘তোমরা (সকল আদেশ মান্য করে ও নিষেধ থেকে বিরত থেকে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো।’ তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে (তুমি জেনে রাখ,) নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্যকারী) কাফিরদেরকে ভালোবাসেন না।
(33) নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নূহ ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর মনোনীত করেছেন।(১)
(34) তারা একে অপরের বংশধর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।(১)
(35) (হে রাসূল!) তুমি স্মরণ কর, যখন (মারয়ামের মা) ইমরানের স্ত্রী বলেছিল: ‘হে আমার রব, আমার গর্ভে যা (যে সন্তান) আছে, নিশ্চয় আমি তা (সব কিছু থেকে মুক্ত করে) একান্তভাবেই আপনার জন্য মানত (উৎসর্গ ) করলাম। অতএব, আপনি আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি (আমার দু‘আ) শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ।’
(36) অতঃপর সে যখন তা প্রসব করল, তখন বলল: ‘হে আমার রব! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি। অথচ সে যা প্রসব করেছে সে সম্পর্কে আল্লাহ তো সর্বাধিক জানতেন। বস্তুত পুত্র সন্তান (শক্তি ও গঠনে) কন্যা সন্তানের মত নয়। এবং আমি তার নাম রেখেছি মারয়াম। আর নিশ্চয় আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয়ে দিচ্ছি।
(37) অতঃপর তার (মারয়ামের ) রব তাকে (মানতকে) উত্তমভাবে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমভাবে গড়ে তুললেন। আর তাকে যাকারিয়্যার দায়িত্বে দিলেন। যখনই যাকারিয়্যা তার কাছে তার কক্ষে (ইবাদাতের জায়গায়) প্রবেশ করতেন, তখনই তার নিকট খাদ্যসামগ্রী পেতেন। তিনি বলতেন: ‘হে মারয়াম, এ সব তুমি কোথায় পেলে?’ সে (মারয়াম) বলত, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ নিশ্চয় আল্লাহ যাকে চান অপরিমিত রিযিক দান করেন।
(38) সেখানে (১) যাকারিয়্যা তাঁর রবের কাছে প্রার্থনা করে বলল: ‘হে আমার রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে পবিত্র (উত্তম) সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি দু‘আ শ্রবণকারী।’
(39) অতঃপর যখন (সে) যাকারিয়্যা ইবাদাতের জায়গায় (মিহরাবে) সালাতে দাঁড়িয়েছিল তখন ফিরিশতাগণ তাঁকে ডেকে বলল: ‘নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে ইয়াহ্ইয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন, তিনি হবেন আল্লাহর কালেমার (বাণীর) সত্যায়নকারী, নেতা, পরিপূর্ণ সংযমী(১) এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত একজন নবী।
(40) তিনি (যাকারি্য়্যা) বলল: ‘হে আমার রব! কীভাবে আমার পুত্র হবে? অথচ আমার তো বার্ধক্য এসে গেছে, তাছাড়া আমার স্ত্রী বন্ধ্যা।’ তিনি বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করেন।’(১)
(41) তিনি (যাকারি্য়্যা) বলল: ‘হে আমার রব! (এ অস্বাভাবিক ঘটনার জন্যে) আমাকে একটি নিদর্শন দিন।’ তিনি বললেন: তোমার নিদর্শন এই যে, তিন দিন তুমি ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া মানুষের সাথে কথা বলবে না। আর তোমার রবের বেশি যিকির কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ পাঠ কর।
(42) (হে রাসূল!) তুমি সে সময়ের কথা স্মরণ কর যখন ফিরিশতারা বললো: ‘হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে (প্রশংসনীয় কিছু গুণাবলীর জন্য) মনোনীত করেছেন ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বজগতের (সে সময়কার) নারীদের উপর আপনাকে মনোনীত করেছেন।
(43) হে মারইয়াম! তোমার রবের জন্য বিনয়ী ও অনুগত হও,(১) তাঁর সিজদা করো এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ করো।
(44) (হে রাসূল!) এটি (১) গায়েবের সংবাদসমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানাচ্ছি। আর তুমি তাদের নিকট ছিলেন না, যখন তারা তাদের কলমগুলো (পানিতে) নিক্ষেপ করছিল (বিশেষ লটারির ব্যবস্থার জন্যে), তাদের মধ্যে কে মারয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিবে? আর তুমি তাদের নিকট ছিলেন না, যখন তারা বিতর্ক করছিল।
(45) (হে রাসূল!) তুমি স্মরণ কর, যখন ফিরিশতারা বললেন: ‘হে মারয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালিমার (পুত্রের) (১) সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মাসীহ ঈসা ইবনু মারয়াম, তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং আল্লাহর নৈকট্যলাভকারী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।’
(46) আর তিনি দোলনায় থাকা অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং পরিণত বয়সেও। আর তিনি নেককার পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(47) (তার স্বামী ছাড়া সন্তান হবে জেনে আশ্চর্য হয়ে) সে বলল: ‘হে আমার রব! আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি, এমতাবস্থায় আমার সন্তান হবে কীভাবে?’ তিনি (আল্লাহ) বললেন: এভাবেই আল্লাহ যাকে চান (চিরাচরিত নিয়ম ছাড়াই) সৃষ্টি করেন।(১) তিনি যখন কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, ‘হও’, ফলে (সাথে সাথেই) তা হয়ে যায়।
(48) আর (তিনি) আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জীল শিক্ষা দিবেন।
(49) তেমনিভাবে তিনি তাঁকে বনী ইসরাঈলদের রাসূল বানাবেন। (তিনি তাদেরকে বলবেন) ‘নিশ্চয় আমি (১) তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। তা হলো, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানাবো, অতঃপর আমি তাতে ফুঁক দেব। ফলে আল্লাহর নির্দেশে সেটি পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহর নির্দেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করবো এবং মৃতকে জীবিত করবো। আর তোমরা যা আহার করো এবং তোমাদের ঘরে যা জমা করে রাখো তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবো। নিশ্চয় এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো।
(50) আর আমার পূর্বে নাযিলকৃত তাওরাতে যা আছে, আমি তার সত্যায়নকারী হিসেবে এসেছি, তাছাড়া (পূর্বে) তোমাদের ওপর যা হারাম করা হয়েছিল তার কিছু তোমাদের জন্য হালাল করতে এবং আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন (সুষ্পষ্ট দলিল প্রমাণ) নিয়ে তোমাদের নিকট এসেছি। অতএব, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং আমার (দাওয়াতে সাড়া দিয়ে) আনুগত্য করো।
(51) নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব।(১) সুতরাং তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো। এটাই সরল সঠিক পথ।(২)
(52) অতঃপর যখন ঈসা তাদের (বনী ইসরাঈলদের) পক্ষ হতে কুফরী উপলব্ধি করল তখন সে (তাদেরকে লক্ষ্য করে) বলল: ‘কে আল্লাহর জন্য আমার সাহায্যকারী হবে’? হাওয়ারীগণ বললো: ‘আমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি (এবং আপনার আনুগত্য করেছি)। (হে ঈসা) আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা মুসলিম।(১)
(53) (হাওয়ারিগণ আরো বললো) ‘হে আমাদের রব! আপনি যা নাযিল করেছেন তার (ইঞ্জীলের) প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এ রাসূলের (‘ঈসার) অনুসরণ করেছি। কাজেই আমাদেরকে (সত্যের) সাক্ষ্যদানকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
(54) আর তারা (বনী ইসরাঈলের কাফিররা ঈসার বিরুদ্ধে) কূটকৌশল ও গোপন ষড়যন্ত্র (হত্যা চেষ্টা) করতে লাগলো। জবাবে আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করলেন। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশল অবলম্বনকারী।(১)
(55) (হে নবী!) তুমি স্মরণ কর, যখন আল্লাহ (তাদের ষড়যন্ত্রের জবাবে) বললেন: ‘হে ঈসা, নিশ্চয় আমি তোমাকে মৃত্যু ছাড়াই জান কবজ করবো(১), তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেবো এবং কাফিরদের থেকে তোমাকে পবিত্র করবো। আর যারা তোমার আনুগত্য করেছে(২) তাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপরে প্রাধান্য দিবো। অতঃপর আমার নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে। তখন আমি তোমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবো, যে ব্যাপারে তোমরা (পৃথিবীতে) মতবিরোধ করতে।’
(56) তারপর যারা (তোমার ও তোমার আনিত সত্যের সাথে) কুফরী করেছে, আমি তাদেরকে দুনিয়াতে (হত্যা, বন্দিদশা, লাঞ্ছনা ইত্যাদি) ও আখিরাতে (জাহান্নামের আগুনের) কঠোর শাস্তি দিবো এবং তাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।
(57) আর যারা(তোমার ও তোমার আনিত সত্যের প্রতি) ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদের প্রতিদান পুরোপুরিভাবে প্রদান করবেন। আর আল্লাহ্ যালিমদেরকে পছন্দ করেন না।
(58) বস্তুত, এগুলো(১) হলো আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ, যা আমি তোমার নিকট তিলাওয়াত করছি।
(59) নিশ্চয় আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের (সৃষ্টির) মতো।(১) তিনি তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে বললেন: কুন-‘হও’। ফলে সে হয়ে গেল।
(60) (হে নবী! ঈসা- এর ব্যাপারে প্রকৃত) সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে এসেছে। কাজেই তুমি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
(61) অতঃপর (হে রাসূল!) তোমার নিকট (‘ঈসার ব্যাপারে সঠিক) জ্ঞান আসার পর যে তোমার সাথে এ বিষয়ে (অনর্থক) ঝগড়া করে, তবে তুমি তাকে বল: ‘এসো আমরা আমাদের ছেলেদেরকে ও তোমাদের ছেলেদেরকে , আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে এবং আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে আহবান করি। তারপর আমরা বিনীত প্রার্থনা (মুবাহালা) করি, (আমাদের ও তোমাদের মধ্যকার) ‘মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত) করি।’
(62) নিশ্চয় এগুলো(১) সত্য বিবরণ এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। আর নিশ্চয় আল্লাহ (ক্ষমতায়) পরম পরাক্রমশালী, (পরিচালনা, আদেশ ও সৃষ্টিতে) প্রজ্ঞাময়।
(63) তবুও যদি তারা (তোমার ওপর নাযিলকৃত বিধান থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা জেনে রাখুক, নিশ্চয় আল্লাহ ফ্যাসাদ (বিপর্যয়) সৃষ্টিকারীদেরকে ভালোভাবেই জানেন।
(64) (হে রাসূল!) তুমি বল: ‘হে আহলে কিতাব! (ইয়াহুদি ও খৃস্টানগণ) তোমরা এমন (ইনসাফপূর্ণ একটি) কথার দিকে আসো, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান। আর তা হচ্ছে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবো না। আর তার সাথে কোনো কিছুকেই শরীক করবো না এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ করবো না।’ তারপর যদি তারা (সত্য ও ইনসাফের থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বল: ‘তোমরা সাক্ষী থাকো যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী )।’
(65) হে আহলে কিতাব! (ইয়াহুদি ও খৃস্টানগণ,) তোমরা ইবরাহীমের (ধর্মের) ব্যাপারে বিতর্ক করছ কেন?(১) অথচ তাওরাত ও ইঞ্জীল তো তার পরেই নাযিল হয়েছে। সুতরাং তোমরা কি বুঝো না? (যে, তোমাদের কথা বাতিল ও তোমাদের ধারণা মিথ্যা)।
(66) (হে আহলে কিতাব) সাবধান! তোমরা তো সেসব লোক, যারা তর্ক করেছো যে বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান আছে(১); কিন্তু (ইবরাহীম ও তাঁর ধর্ম সম্পর্কীয়) যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞানই নেই, সে বিষয়ে তর্ক করছো কেন? আর আল্লাহ (মূল ব্যাপারটি) জানেন এবং তোমরা জানো না।
(67) মূলত ইবরাহীম ইয়াহুদীও ছিল না, খৃস্টানও ছিল না; বরং সে ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।(১)
(68) নিশ্চয় মানুষের মধ্যে তারাই ইবরাহীমের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অধিক উপযুক্ত, যারা তাঁর অনুসরণ করেছে(১) এবং এ নবী (মুহাম্মাদ), আর (এ উম্মতের) যারা ঈমান এনেছে তারা। মূলত আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক ও রক্ষাকারী।
(69) আহলে কিতাবের একদল লোক (ইয়াহুদি ও খৃস্টান ধর্মজাযকরা) কামনা করে যদি তাঁরা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারত; অথচ তারা নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না।
(70) হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন আল্লাহর আয়াতসমূহকে(১) অস্বীকার করছো; অথচ তোমরাই (তা সত্য হওয়ার ব্যাপারে) সাক্ষ্য বহন করো।
(71) হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করছো(১) এবং সত্য গোপন করছো?(২) অথচ তোমরা তা জানো।
(72) আর আহলে কিতাবের একদল লোক (ইহুদি আলিমদের একদল) বলে: ‘মু’মিনদের ওপর যা নাযিল করা হয়েছে, তোমরা তার প্রতি দিনের প্রথমভাগে ঈমান আনো, আর শেষ ভাগে তা অস্বীকার করো; সম্ভবত তারা (নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে) ঈমান থেকে ফিরে আসবে।’
(73) আর (তারা নিজেদের মধ্যে) বলাবলি করে তোমরা কেবল তাদেরকে বিশ্বাস করো, যারা তোমাদের দীনের অনুসরণ করে। (হে রাসূল!) তুমি (তাদেরকে ) বলে দাও: ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই একমাত্র হিদায়াত। এটা এ জন্য যে, একসময় তোমাদেরকে যে অনুগ্রহ (ইলম প্রদান) করা হয়েছে, অনুরূপ অনুগ্রহ অন্য কাউকেও করা হবে। অথবা তারা তোমাদের রবের নিকট তোমাদের সাথে বিতর্ক করবে।’ (হে নবী) তুমি তাদেরকে বলে দাও: ‘নিশ্চয় আল্লাহর হাতে রয়েছে সকল অনুগ্রহ। তিনি যাকে চান, তা দান করেন।(১) আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’
(74) তিনি নিজ রহমতের জন্যে (সৃষ্টিকুলের) যাকে ইচ্ছা তাকে নির্ধারণ করেন।(১) আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।
(75) আর আহলে কিতাবের মধ্যে এমন লোকও আছে, যদি তার নিকট আপনি অঢেল সম্পদ আমানত রাখেন; তবুও সে তা আপনাকে চাওয়ামাত্রই ফেরত দিবে এবং তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে, যদি আপনি তার নিকট এক দীনারও (সামান্য সম্পদও) আমানত রাখেন, তবে সর্বোচ্চ তাগাদা (এমনকি বিচার-সালিশ) ছাড়া সে তা আপনাকে ফেরত দিবে না। এটি এ কারণে (তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস) যে, তারা বলে, ‘উম্মীদের(১) (সম্পদ ভোগ করার) ব্যাপারে আমাদের ওপর কোন পাপ নেই।’(২) আর তারা জেনে-শুনে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা বলে।
(76) হ্যাঁ অবশ্যই, কেউ যদি (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনার) অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে (শিরক থেকে বেঁচে থাকে), তবে নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।(১)
(77) নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে, আখিরাতে তাদের (সাওয়াবের) কোনো অংশ নেই। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সাথে (সন্তোষজনক) কথা বলবেন না, তাদের দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেনও না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(78) আর নিশ্চয়ই তাদের (ইয়াহুদিদের) মধ্যে একদল লোক আছে, যারা (তাওরাত) কিতাব পড়ার সময় জিহ্বা দ্বারা বিকৃতি করে(১), যাতে তোমরা সেটাকে আল্লাহর কিতাবের (তাওরাতে) অংশ মনে করো; অথচ সেটা কিতাবের অংশ নয়। আর তারা বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে’; অথচ সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে (নাযিলকৃত) নয়। আর তারা জেনে-বুঝে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করছে।
(79) এটা কোনো ব্যক্তির জন্যে সংগত নয় যে, আল্লাহ তাকে (তাঁর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত) কিতাব, হিকমত (জ্ঞান-বুঝ) ও নবুওয়াত দান করবেন, অতঃপর তিনি মানুষকে বলবেন: ‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হয়ে যাও’। বরং তিনি বলবেন: ‘তোমরা আল্লাহভক্ত (ধার্মিক) হয়ে যাও, যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দাও এবং যেহেতু তোমরা তা অধ্যয়ন করো।’
(80) অনুরূপভাবে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দেন না যে, (আল্লাহকে ছাড়া) ফিরিশতা ও নবীগণকে রবরূপে গ্রহণ করো (এবং তাদের ইবাদত করো)। তোমাদের মুসলিম হওয়ার পরও তিনি কি তোমাদেরকে (পুনরায়) আল্লাহর সাথে কুফরী করার নির্দেশ দিবেন?
(81) (হে রাসূল!) তুমি স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের কাছ থেকে এ বলে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, ‘আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি; তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসূল (মুহাম্মাদ) আসবেন, তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে।’ তিনি বললেন: (হে নবীগণ!) ‘ তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার করলে?’ তাঁরা উত্তরে বলল: ‘আমরা স্বীকার করলাম’। তিনি বললেন: ‘তবে তোমরা এ ব্যাপারে (নিজেরা ও নিজেদের উম্মতের উপর) সাক্ষী থাকো এবং আমি নিজেও তোমাদের (ও তাদের) উপর সাক্ষী থাকলাম।’
(82) সুতরাং এরপরেও (১) যারা (কৃত প্রতিশ্রুতি থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলো তারাই তো ফাসিক(২)।
(83) তারা কি আল্লাহর (পছন্দনীয় দীন) ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য দীন চায়? অথচ আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই ইচ্ছায় (মু’মিনরা) বা অনিচ্ছায় (কাফিররা) তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আর (কিয়ামতের দিন হিসাব ও প্রতিদানের জন্য সবাইকে) তাঁর দিকেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
(84) হে রাসূল! তুমি বল: ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তার (কুরআনের) প্রতি, ইবরাহীম, ইসমা’ঈল, ইসহাক, ইয়া’কূব ও তাঁর বংশধরগণের প্রতি যা নাযিল হয়েছিল তার প্রতি এবং যা মূসা, ‘ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাঁদের রবের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়েছিল তার প্রতিও। আমরা তাঁদের কারও মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।(১) আর আমরা তাঁরই কাছে একান্তভাবে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।
(85) আর যে ব্যক্তি (আল্লাহর পছন্দনীয় দীন) ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন (জীবন বিধান) গ্রহণ করতে চায়, তার কাছ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।
(86) আল্লাহ কিভাবে সে জাতিকে হিদায়াত করবেন , যারা ঈমান আনার পর ও রাসূল (মুহাম্মাদ ) কে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ার পর এবং তাদের কাছে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরেও কুফরী করে? আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।
(87) আসলে এরা হলো সেসব লোক, যাদের প্রতিদান হলো, তাদের উপর আল্লাহর, ফিরিশতাগণের এবং সকল মানুষের লা’নত বর্ষিত হবে।(১)
(88) তারা তাতে ( জাহান্নামে) চিরকাল থাকবে, তাদের শাস্তি শিথিল করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না।(১)
(89) কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা এরপরে (কুফরী ও যুলমের পরে) তাওবা করেছে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ (তাওবাকারী বান্দার প্রতি) অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(90) নিশ্চয় যারা ঈমান আনার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে, তারপর তারা তাদের কুফরী বৃদ্ধি করেছে , তাদের তাওবা কখনো কবুল করা হবে না।(১) আর তারাই পথভ্রষ্ট।
(91) নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে , তাদের কারো কাছ থেকে পৃথিবী সমপরিমাণ স্বর্ণ বিনিময়স্বরূপ প্রদান করলেও তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। (কিয়ামতের দিন) তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং তাদের কোনো সাহায্যকারীও থাকবে না।
(92) (হে মু’মিনগণ) তোমরা যা ভালোবাসো তা (প্রিয় সম্পদের কিয়দংশ) থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো সাওয়াব ও মর্যাদা লাভ করতে পারবে না। আর তোমরা (কম-বেশি) যা কিছু ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে ভালো করেই জানেন।(১)
(93) তাওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইসরাঈল (ইয়াকূব) তার নিজের উপর যা হারাম করেছিল তা ছাড়া বনী ইসরাঈলের জন্য যাবতীয় (পবিত্র) খাদ্যই হালাল ছিল।(১) (হে নবী!) তুমি তাদেরকে বলে দাও: ‘যদি তোমরা (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হও, তবে তাওরাত আনো এবং তা পাঠ করে দেখাও।’
(94) এরপরও (সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও) যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করবে, তারাই যালিম।
(95) (হে নবী!) তুমি বলে দাও: ‘আল্লাহ সত্য বলেছেন।(১) কাজেই তোমরা একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের ধর্ম (ইসলামকে) অনুসরণ করো। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।
(96) নিশ্চয় মানব জাতির (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটি বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত, যা বরকতময় ও বিশ্ববাসীর জন্যে হিদায়াত (পথনির্দেশ)।
(97) এটিতে (এ ঘরটিতে) রয়েছে (সম্মান ও ফযীলতের) সুস্পষ্ট নির্দশনসমূহ। (যার একটি হলো:) মাকামু ইবরাহীম। (আরেকটি হলো) যে তাতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ হয়ে যাবে। আর এ ঘরে পৌঁছার শক্তি-সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। আর যে কুফরী করে(১), তবে (তাদের জেনে রাখা উচিত) নিশ্চয় আল্লাহ সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।
(98) (হে নবী!) তুমি বলো: ‘হে আহলু কিতাব! (ইয়াহূদী ও খৃস্টানগণ,) তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের সাথে কেন কুফরী করছো?(১) আর তোমরা যা করো আল্লাহ তার সাক্ষী।’
(99) (হে নবী!) তুমি (ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের) বলে দাও: ‘হে আহলু কিতাব! যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে তাকে কেন তোমরা আল্লাহর পথে (তাঁর ধর্ম পালনে) তাতে বক্রতা সন্ধান করে বাধা দিচ্ছো,? অথচ তোমরা (এ ধর্মের সত্যতার ব্যাপারে) সাক্ষী। আর তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।(১)
(100) হে মুমিনগণ! যাদেরকে ইতোপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছে (ইয়াহুদি ও খৃস্টান), তোমরা যদি তাদের একটি দলেরও আনুগত্য কর, তাহলে তারা তোমাদেরকে (হিংসা ও ভ্রষ্টতাবশত) ঈমান আনার পরও কাফির বানিয়ে দিবে।
(101) আর কিভাবে তোমরা (ঈমান আনার পরে) কুফরী করবে; অথচ আল্লাহর আয়াতসমূহ (কুরআন) তোমাদের কাছে তিলাওয়াত করা হচ্ছে এবং তোমাদের মধ্যে রয়েছে তাঁর রাসূল (মুহাম্মাদ)? আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে (আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতকে) মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে, সে অবশ্যই সরল-সঠিক পথের হিদায়াত লাভ করবে।
(102) হে মুমিনগণ! তোমরা সত্যিকারার্থে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো।(১) আর তোমরা (দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে) মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না।
(103) (হে মু’মিনগণ!) তোমরা সবাই আল্লাহর রশি (আল-কুরআন ও বিশুদ্ধ সুন্নাহকে) দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (দলাদলি করো না)। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তোমরা (ইসলামের পূর্বে) ছিলে পরস্পর শত্রু। অতঃপর তিনি (ইসলামের মাধ্যমে) তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর (দ্বীনি) ভাই হয়ে গেলে। (আরো স্মরণ করো!) তোমরা তো (ইতঃপূর্বে কুফরীর কারণে) জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে ছিলে। তিনি তোমাদেরকে (ইসলামের মাধ্যমে) তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের (দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের) জন্যে তাঁর আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতের পথে পরিচালিত হও।
(104) (হে মুমিনগণ!) তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকা উচিত, যারা (মানুষকে আল্লাহর পছন্দনীয়) কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই (দুনিয়া ও আখিরাতে) পরিপূর্ণ সফলকাম হবে।
(105) (হে মুমিনগণ!) তোমরা তাদের (আহলু কিতাবের) মতো হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ও নিজেদের মধ্যে (ধর্ম নিয়ে) বিভেদ করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) কঠিন শাস্তি।
(106) সেদিন কিছু লোকের (ঈমানদারদের) চেহারাগুলো উজ্জল হবে এবং কিছু লোকের (কাফিরদের) চেহারাগুলো কালো হবে। যাদের মুখ কালো হবে (তাদেরকে বলা হবে), ‘তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফরী করেছিলে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর) শাস্তি ভোগ করো, যেহেতু তোমরা কুফরী করতে।
(107) আর যাদের চেহারা উজ্জল হবে, তারা তো আল্লাহর রহমতে (জান্নাতে) থাকবে। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে।
(108) (হে নবী!) এগুলো আল্লাহর আয়াত (নিদর্শনসমুহ, যাতে রয়েছে তাঁর ওয়াদা ও হুমকি), যা আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে তিলাওয়াত করছি। আর আল্লাহ সৃষ্টিজগতের প্রতি যুলম করার ইচ্ছা পোষণ করেন না।
(109) আর আসমানসমূহ ও যমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই (তিনিই এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আদেশ দেন) এবং আল্লাহর কাছেই এসব কিছুকে একদিন ফিরিয়ে নেয়া হবে।
(110) (হে উম্মতে মুহাম্মাদী!) তোমরাই শ্রেষ্ঠতম উম্মত, যাদেরকে মানব জাতির (কল্যাণের) জন্য বের (সৃষ্টি) করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে। আর আহলু কিতাবরা (ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা) যদি (আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি) ঈমান আনায়ন করতো, তবে তা ছিল তাদের (দুনিয়া ও আখিরাতের) জন্যে কল্যাণকর। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মু’মিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসিক (১)।
(111) (হে মু’মিনগণ!) তারা তোমাদের (ও তোমাদের দীনের) কোন ক্ষতি করতে পারবে না, (সাময়িক) কিছু কষ্ট দেয়া ছাড়া।(১) আর যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তবে তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে (পরাজিত হয়ে) পালাবে। তারপর তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।
(112) তাদেরকে (ইয়াহূদীদেরকে) আল্লাহর প্রতিশ্রুতির (নিরাপত্তার) বাইরে ও মানুষের প্রতিশ্রুতির (চুক্তির) বাইরে যেখানেই পাওয়া গেছে, সেখানেই তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে। আর তারা (অবাধ্যতার কারণে) আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে। উপরন্তু তাদের উপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করতো এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করতো। তাছাড়া এজন্যও যে, তারা অবাধ্যতা করতো এবং সীমালঙ্ঘন করতো।
(113) আহলু কিতাবের সবাই এক রকম নয়। তাদের মধ্যে একদল লোক আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল (এবং নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনয়নকারী)। তারা রাতে সিজদারত হয়ে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে ।
(114) তারা (১) আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে, সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজে নিষেধ করে এবং তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে। আর তারাই সৎলোকের অন্তর্ভুক্ত।
(115) আর তারা (কম-বেশি) যে ভালো কাজ করে, তা অস্বীকার করা হবে না।(১) আর আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।
(116) নিশ্চয় যারা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের সাথে) কুফরী করেছে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর কাছে কোনো কাজে আসবে না।(১) আর তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।
(117) তারা (কাফিররা) এ দুনিয়ার জীবনে (ছাওয়াবের আশায় কল্যাণকর কাজে) যা ব্যয় করে, তার উপমা হলো সেই বাতাসের ন্যায়, যাতে রয়েছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা (তুষার কণা), যা এমন জাতির শস্যক্ষেতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, যারা নিজদের উপর যুলম করেছে। অতঃপর তা শস্যক্ষেতকে ধ্বংস করে দেয়।(১) আর আল্লাহ তাদের ওপর যুলম করেননি; বরং তারা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে) নিজেরাই নিজেদের উপর যুলম করেছে।
(118) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা (যাদের সাথে তোমরা গোপন কথা বলতে পারো)। তারা (অমুসলিমরা সুযোগ পেলেই) তোমাদের ক্ষতি ও সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তাই তারা কামনা করে, যা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি করে (ও তোমাদেরকে কষ্ট দেয়)। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গেছে। আর তাদের অন্তরসমূহে যা (যে মারাত্মক ঘৃণা) গোপন রেখেছে তা এর চাইতেও অধিক ভয়ংকর। (হে মু’মিনগণ) অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য (দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণের) আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছি, যাতে তোমরা (তোমাদের রবের নাযিলকৃত বিধানসমূহ) বুঝতে পারো।
(119) (হে মু’মিনগণ!) তোমরা তাদেরকে ভালোবাসো ঠিকই (এবং তাদের কল্যাণ কামনা করো); কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসে না (এবং তোমাদের কল্যাণ কামনা করে না।) আর তোমরা সকল কিতাবের ওপর ঈমান রাখো (১)। আর তারা যখন তোমাদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে: ‘আমরা (তোমাদের রাসূল ও কিতাবের ওপর) ঈমান এনেছি; কিন্তু তারা নিজেরা যখন একান্তে মিলিত হয়, তখন তোমাদের প্রতি ক্রোধ ও আক্রোশে তারা নিজেদের আঙ্গুলের অগ্রভাগ দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে।’ (হে নবী!) তুমি তাদেরকে বল: ‘তোমরা তোমাদের ক্রোধে ও আক্রোশেই মরো।’ নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে (ঈমান ও কুফরী এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ), সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।
(120) (হে মু’মিনগণ!) যদি তোমাদেরকে কোন কল্যাণ (বিজয় ও সন্তান-সম্পদ ইত্যাদি লাভ) স্পর্শ করে, তখন তা তাদের মনে কষ্ট দেয়। আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে (শত্রুর বিজয় ও সন্তান-সম্পদ ইত্যাদিতে ঘাটতি হয়), তখন তাতে তারা আনন্দিত হয়। আর যদি তোমরা (আল্লাহর আদেশ ও তাঁর নির্ধারিত তাকদীরের উপর) ধৈর্যধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র (ও কষ্টদান) তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কর্মকাণ্ড (ষড়যন্ত্রগুলো) পরিবেষ্টন করে আছেন।
(121) আর (হে নবী!) স্মরণ কর, যখন তুমি তোমার পরিবার পরিজন থেকে সকাল বেলায় (মুশরিকদের বিরুদ্ধে উহুদের ময়দানে) বের হয়ে মু’মিনদেরকে যুদ্ধের ঘাঁটিসমূহে বিন্যস্ত করছিলে। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(122) (হে নবী!) স্মরণ কর, যখন তোমাদের মধ্য থেকে দুটি দলের (বনূ সালিমাহ ও বনূ হারিসাহ মুনাফিকদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া দেখে) সাহস হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছিলো (এবং যুদ্ধ থেকে পিছু হটার ইচ্ছা করলো); অথচ আল্লাহ তাদের উভয়ের (ভগ্ন সাহস ফিরিয়ে দেয়ার জন্য) অভিভাবক (ও সাহায্যকারী)। আর আল্লাহর ওপরই যেন মু’মিনগণ তাওয়াক্কুল করে।
(123) আর (ইতঃপূর্বে) আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে বদরের যুদ্ধে (মুশরিকদের বিরুদ্ধে) সাহায্য করেছেন; অথচ তোমরা তখন (শত্রুদের তুলনায়) ছিলে হীনবল (দুর্বল)। অতএব তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো। আশা করা যায়, তোমরা (আল্লাহর নি‘আমতের) শোকর আদায়কারী হবে।
(124) (হে নবী!) স্মরণ কর, যখন তুমি (বদরের যুদ্ধে দৃঢ়পদ করার জন্য) মুমিনদেরকে বলছিলে: ‘তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের রব তোমাদেরকে (তাঁর পক্ষ থেকে) তিন হাজার নাযিলকৃত ফিরিশতা দ্বারা সাহায্য করবেন?(১)
(125) অবশ্যই (এটা তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে)। যদি তোমরা (যুদ্ধের ময়দানে) ধৈর্যধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, আর তারা (শত্রুপক্ষ) আকস্মিক তোমাদের ওপর হামলা করে, তবে তোমাদের রব পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফিরিশতা দ্বারা তোমাদেরকে সাহায্য করবেন।
(126) আর আল্লাহ (ফিরিশতা কর্তৃক সাহায্যের) এ ব্যবস্থা করেছেন কেবল তোমাদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ এবং যাতে তোমাদের অন্তরসমূহ এর দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে। আর সাহায্য (ও সত্যিকার বিজয়) কেবল মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে।(১)
(127) (বদরের যুদ্ধের বিজয় এ কারণে হয়েছে) যাতে আল্লাহ কাফিরদের একটি অংশকে ধ্বংস করেন অথবা তাদের (আরেকটি অংশ) কে লাঞ্ছিত করেন। ফলে তারা ( যুদ্ধে পরাজিত হয়ে) নিরাশ মনে ফিরে যায়।
(128) (১) (হে নবী!) এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করার ক্ষমতা তোমার হাতে নেই।(২) তিনি হয় তাদের তাওবা কবুল করবেন অথবা (তারা নিজেদের কুফরির উপর অটল থাকলে) তিনি তাদেরকে (দুনিয়া-আখিরাতে) শাস্তি দিবেন। কারণ তারা তো যালিম।
(129) আর আসমানসমূহ ও যমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা (নিজ দয়ায়) ক্ষমা করেন, আর যাকে ইচ্ছা (স্বীয় ইনসাফের ভিত্তিতে) শাস্তি দেন। আর আল্লাহ (বান্দার প্রতি) অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(130) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা চক্রবৃ্দ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর তোমরা আল্লাহর (আদেশ-নিষেধ মেনে তাঁর) তাকওয়া অবলম্বন করো, যাতে তোমরা (দুনিয়া ও আখিরাতে) সফল হতে পারো।
(131) আর তোমরা (নেক আমল করা ও হারাম পরিত্যাগের মাধ্যমে) সে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো, যা কাফিরদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
(132) আর তোমরা (আদেশ ও নিষেধ মান্য করে) আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।
(133) আর তোমরা (কল্যাণ ও আনুগত্যের কাজের মাধ্যমে) দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের ক্ষমার দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আসমানসমূহ ও জমিনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
(134) (মুত্তাকী তারাই) যারা নিজেদের ধন-সম্পদ সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা (প্রতিশোধ নেয়ার শক্তি থাকা সত্ত্বেও) ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে (বিশেষত যালিমকে) ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন।
(135) আর (মুত্তাকী তারা) যারা কোন অশ্লীল কাজ (কবীরা গুনাহ) করে ফেললে কিংবা নিজেদের প্রতি যুলুম করলে(১) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের গুনাহের জন্য (লজ্জিত হয়ে তাওবা করে) আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা যা ( গুনাহ) করে ফেলে, জেনে-বুঝে তারা তা (সে গুনাহ) বারবার করে না।
(136) (উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের লোক) তারাই, যাদের প্রতিদান হলো তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা(১) এবং এমন জান্নাত, যার (অট্টালিকাগুলোর) পাদদেশে দিয়ে প্রবাহিত হবে নদ-নদী (ধর্ণাধারা)। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর (আল্লাহর আনুগত্যকারী) সৎকর্মশীলদের প্রতিদান কতইনা উত্তম!
(137) অবশ্যই তোমাদের(১) পূর্বে অনেক জাতি ( ও তাদের জীবন-পদ্ধতি, রীতি-নীতি ও উধাহরণ) অতিবাহিত হয়েছে।(২) অতএব তোমরা জমিনে ভ্রমণ করো, অতঃপর দেখো (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদেরকে) অস্বীকারকারীদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল।
(138) এটা (এ কুরআন) মানুষের জন্য সুস্পষ্ট বর্ণনা ও হিদায়াত এবং মুত্তাকীদের জন্য উপদেশ।
(139) (উহুদের দিন তোমাদের যা ঘটেছে সে ব্যাপারে) তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখ করো না। তোমরাই (আল্লাহর সাহায্যে) বিজয়ী হবে, যদি তোমরা (সত্যিকারের) মু’মিন হও।
(140) (হে মু’মিনগণ! উহুদের দিন) যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে (আহত ও নিহত হয়ে থাকো), অনুরূপ আঘাত তো তাদেরও (কাফিরদেরও তো) লেগেছিল। মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আমি এ দিনগুলোর আবর্তন ঘটাই(১), যাতে আল্লাহ (প্রকৃত) ’মুমিনগণকে (মুনাফিদের থেকে আলাদা করে) জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যককে শহীদরূপে গ্রহণ করতে পারেন। আর আল্লাহ (জিহাদ পরিত্যাগ করে নিজের ওপর যুলমকারী) যালিমদেরকে পছন্দ করেন না।
(141) আর (এর আরেকটি হিকমত হলো) আল্লাহ যাতে মু’মিনদেরকে (গুনাহ থেকে) পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে পারেন এবং কাফিরদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেন।
(142) (হে মু’মিনগণ!) তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে, তোমরা (ধৈর্য ও পরীক্ষা ছাড়া এমনিতেই) জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো (প্রকাশ্য পরীক্ষার মাধ্যমে) জানেননি (১) তোমাদের মধ্যে কে (আল্লাহর রাস্তায়) জিহাদকারী এবং কে (জিহাদে ও অন্যান্য বিপদে) ধৈর্যশীল?
(143) আর (হে মু’মিনগণ!) তোমরা তো ইতঃপূর্বে (বদরের যুদ্ধের পরে) মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার আগেই তা (মৃত্যুকে) কামনা করতে। (১) অতএব (উহুদ যুদ্ধে) এখন তো তোমরা তা স্বচক্ষে দেখলে।
(144) আর মুহাম্মদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়; তাঁর আগে অনেক রাসূল চলে গেছেন। কাজেই তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন (তাঁকে হত্যা করা হয়) তবে কি তোমরা (নিজেদের দ্বীন ও জিহাদ ত্যাগ করে) পেছনে ফিরে যাবে?(১) আর যে কেউ (দ্বীন ত্যাগ করে) পেছনে ফিরে যাবে, সে কখনোই আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের (তাঁর দ্বীনের উপর অবিচল ও জিহাদে দৃঢ়পদ বান্দাদের)কে পুরস্কার দান করবেন।
(145) আল্লাহর অনুমতি (ফায়সালা) ছাড়া কোন প্রাণীই মরতে পারে না। কারণ মৃত্যুর সময় (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সুনির্ধারিত। যে ব্যক্তি (স্বীয় আমলের বিনিময়ে) পার্থিব পুরস্কার চায়, আমি তাকে তা (তার বরাদ্দকৃত প্রতিদান) দিয়ে দেই(১) এবং যে ব্যক্তি (নিজ আমলের বিনিময়ে) আখিরাতের পুরস্কার চায়, আমি তাকে তা (পরকালে) দিয়ে দিবো। আর অচিরেই আমি (আল্লাহর প্রতি) কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কার প্রদান করবো।
(146) আর অতীতে বহু নবী (এ পৃথিবীতে) আগমন করেছিল, যাদের অনুসারীদের বিরাট সংখ্যক আল্লাহওয়ালা লোক তাদের সাথে মিলে যুদ্ধ করেছে। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল (যুদ্ধে আহত ও নিহত হয়েছিলো), তাতে তাদের মন ভেঙ্গে যায়নি, দুর্বল হয়নি এবং (বাতিলের সামনে) নতিও স্বীকার করেনি(১)। আর আল্লাহ (তাঁর পথে বিপদ আপদে) ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন।
(147) (যখন বিপদাপদ নেমে আসতো তখন) তাদের একটিই কথা ছিলো: ‘হে আমাদের রব! আমাদের পাপ এবং আমাদের কাজের সীমালঙ্ঘন আপনি ক্ষমা করুন, (শত্রুর মোকাবেলায়) আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।’
(148) ফলে আল্লাহ তাদেরকে (বিজয় ও স্থায়ীত্বের মাধ্যমে) দুনিয়ার পুরস্কার এবং আখিরাতের উত্তম প্রতিদান (জান্নাত) দিলেন। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন।
(149) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! যদি তোমরা (ইয়াহূদী, খৃস্টান ও মুশরিক) কাফিরদের (ভ্রষ্টতার) আনুগত্য করো, তারা তোমাদেরকে (ঈমান আনার পরে) তোমাদের পূর্বাবস্থায় (কুফরিতে) ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে তোমরা (দুনিয়া ও আখিরাতে) ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
(150) বরং আল্লাহই তো তোমাদের (একমাত্র) অভিভাবক এবং তিনিই সর্বোত্তম সাহায্যকারী।
(151) অচিরেই আমি কাফিরদের অন্তরে কঠিন ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে দিবো। যেহেতু তারা (নিজেদের জন্যে মনগড়া মা‘বূদ বানিয়ে) আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, যে সম্পর্কে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাযিল করেননি। আর তাদের আশ্রয়স্থল হলো জাহান্নাম এবং যালিমদের ঠিকানা (জাহান্নাম) কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল!
(152) আর (উহুদের দিনে) আল্লাহ তোমাদের কাছে তাঁর (শত্রুর উপর বিজয়ের) প্রতিশ্রুতি সত্যে পরিণত করেছিলেন, যখন তোমরা তাঁর অনুমতিক্রমে তাদেরকে (কাফিরদেরকে) হত্যা করছিলে। অবশেষে যখন তোমরা (রাসূলের আদেশের ওপর অবিচল থাকার ব্যাপারে) দুর্বলতা দেখালে এবং (উহুদের ময়দানে তার নির্দেশিত অবস্থানে না থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত হয়ে) তার নির্দেশ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলে এবং তোমরা যা ভালোবাসো (শত্রুর উপর বিজয়) তা তোমাদেরকে দেখানোর পরেও তোমরা অবাধ্য হলে। মূলত তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া (গনীমত) চাচ্ছিলো আর কেউ চাচ্ছিলো আখিরাত (পরকালের সাওয়াব)। তারপর আল্লাহ পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে তাদের (শত্রুদের) থেকে ফিরিয়ে দিলেন(১), যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। আর অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ মু’মিনদের ওপর অনুগ্রহশীল।
(153) (হে মু’মিনগণ) তোমরা স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন তোমরা (উহুদের দিন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে) ওপরের (পাহাড়ের) দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলে না(১), আর রাসূল তোমাদেরকে পিছন দিক থেকে ডাকছিল(২)(কিন্তু তোমরা তাতে সাড়া দিচ্ছিলে না)। ফলে তিনি তোমাদেরকে বিপদের উপর বিপদ দিলেন(৩), যাতে তোমরা (উহুদের দিনে) যা হারিয়েছ এবং যে বিপদ তোমাদের ওপর এসেছে তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। আর তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।
(154) অতঃপর দুঃখ ও সঙ্কীর্ণতার পর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি নাযিল করলেন তন্দ্রারূপে প্রশান্তি, যা তোমাদের একদলকে (যারা আল্লাহর সাহায্যের ওয়াদায় আস্থাশীল, তাদের অন্তরে নিরাপত্তা ও প্রশান্তি থাকার কারণে) ঘুমে আচ্ছন্ন করেছিল এবং আরেক দল (যারা মুনাফিক) জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা(১) করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, ‘আমাদের কি কোন কিছু করার আছে?’(২) হে নবী! তুমি তাদের উত্তরে বল: (এসব ব্যাপারে আমারই বা কী করার আছে!) ‘সব বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারে’।(৩) যা তারা তোমার কাছে প্রকাশ করে না, তারা তাদের অন্তরে সেগুলো গোপন রাখে। তারা (মুনাফিকরা আরো) বলে: ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।’(৪) (হে নবী তুমি তাদেরকে) বল: ‘তোমরা যদি (যুদ্ধে বের না হয়ে) তোমাদের ঘরে অবস্থান করতে, তবুও নিহত হওয়া যাদের ভাগ্যে লেখা ছিল তারা নিজেদের মৃত্যুস্থানে বের হত-ই। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে (ঈমান ও মুনাফিকীর পার্থক্য নিরূপণ করে) তা পরীক্ষা করতে চান এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশুদ্ধ করতে চান। আর (তোমাদের) অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবগত।
(155) নিশ্চয় যেদিন (উহুদের দিনে) দুদল (মুসলিম ও মুশরিক) পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল, সেদিন তোমাদের মধ্য থেকে যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, তাদের এ পদস্খলনের কারণ ছিল এই যে, তাদের কোনো কৃতকর্মের (গুনাহের) কারণে শয়তান তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।(১) নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও অতি সহনশীল।
(156) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা তাদের (মুনাফিকদের) মতো হয়ো না যারা কুফরী করে এবং তাদের ভাইয়েরা যখন (রিযিকের অনুসন্ধানে) বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে বা যুদ্ধে যায় (এবং সেখানে মারা যায়) তখন তাদের সম্পর্কে বলে: ‘তারা যদি আমাদের কাছে থাকতো তবে তারা মারা যেতো না এবং নিহতও হতো না।’ আর আল্লাহ তাদের এ ধরনের কথাকে তাদের মনের দুঃখ ও দুশ্চিন্তার কারণ বানিয়ে দেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। আর আল্লাহ তোমাদের সমস্ত কার্যাবলীর ওপর দৃষ্টিদানকারী।
(157) আর (হে মু’মিনগণ!) তোমাদেরকে যদি আল্লাহর পথে হত্যা করা হয় অথবা তোমরা (সফরে গিয়ে) মারা যাও, তাহলে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমা ও দয়া লাভ করবে, তা এরা (কাফিররা) যা কিছু একত্রিত করে তার থেকে উত্তম।
(158) আর যদি তোমরা (স্বাভাবিকভাবে) মারা যাও অথবা তোমাদেরকে (আল্লাহর পথে) শহীদ করা হয় (যেভাবেই মৃত্যু হোক না কেন, তাতে কী?) তোমাদেরকে (তো একদিন) আল্লাহর নিকটই একত্রিত করা হবে (যাতে তিনি তোমাদের কর্মের প্রতিদান দিতে পারেন)।
(159) (হে নবী!) আল্লাহর অতীব দয়ায় তুমি তাদের (তোমার সাথীদের) প্রতি হয়েছিলে কোমল-হৃদয়ের (মানুষ) ; যদি তুমি (কথা ও কাজে) রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে বহু দূরে সরে যেতো। কাজেই তুমি তাদেরকে (তোমার হকের ব্যাপারে তাদের ত্রুটিসমূহ) ক্ষমা করে দাও এবং তাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। তারপর (পরামর্শের পর) তুমি কোনো কাজ করার সংকল্প করলে আল্লাহর উপর নির্ভর করবে (এবং সে কাজ চালিয়ে যাবে)। নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন।
(160) আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে কেউ তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না (তোমরাই বিজয়ী হবে; যদিও পুরো বিশ্ববাসী তোমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়)। আর তিনি তোমাদেরকে সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে এমন আছে যে তোমাদেরকে সাহায্য (ও বিজয়ী) করবে? (১) সুতরাং মু’মিনগণের আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা উচিত।
(161) আর কোন নবীর পক্ষে অন্যায়ভাবে (গনীমত আত্মসাৎ বা) কোনো কিছু গোপন করা সম্ভব নয়। আর যে খিয়ানত করবে (গনীমতের কোন কিছু আত্মসাৎ করে), কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে তা নিয়ে, যা সে খিয়ানত করেছে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি (প্রতিদান) দেয়া হবে, যা সে (পার্থিব জীবনে ভালো-মন্দ) উপার্জন করেছে এবং তাদেরকে (গুনাহ বা সাওয়াব কম-বেশি করে) যুলম করা হবে না।
(162) যে ব্যক্তি (ঈমান ও উত্তম আমলের মাধ্যমে) আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছে, সে কি তার মতো হতে পারে যে (কুফরি ও খারাপ আমল করে) আল্লাহর ক্রোধ নিয়ে ফিরে এসেছে ? আর তার আবাস হলো জাহান্নাম এবং তা কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল!
(163) ( নিজ নিজ কৃতকর্ম অনুযায়ি) আল্লাহর নিকট (দুনিয়া ও আখিরাতে) তাদের রয়েছে বিভিন্ন স্তর ও মর্যাদা। তারা যা করে, আল্লাহ সেসব ভালোভাবে দেখেন(১)।
(164) নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন রাসূল (মুহাম্মাদকে) পাঠিয়েছেন, যে তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করে, তাদেরকে (শিরক ও চারিত্রিক পঙ্কিলতা থেকে) পরিশুদ্ধ করে এবং কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দেয়; যদিও তারা ( রাসূলের রিসালাতের) আগে সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে ও গোমরাহীতে ছিলো।
(165) (হে মু’মিনগণ) কী ব্যাপার! তোমাদের ওপর যখন (উহুদের যুদ্ধে পরাজয় ও নিহত হওয়ার মাধ্যমে) বিপদ এসেছিলো তখন তোমরা বলেছিলে: ‘এটা কোত্থেকে আসলো?’ অথচ তোমরা তো (বদরের যুদ্ধে শত্রুদেরকে হত্যা ও পরাজিত করে) দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। (হে নবী) তুমি তাদেরকে বল: ‘এটা তোমাদের (পরস্পর বিবাদ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণের কারণে) নিজেদেরই পক্ষ থেকেই’। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।(১)
(166) আর (উহুদ যুদ্ধে) যেদিন দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল, সেদিন তোমাদের ওপর যে বিপর্যয়(১) ঘটেছিলো, তা আল্লাহর হুকুমেই ঘটেছিল; যাতে তিনি প্রকাশ করে দেন, কে তোমাদের মধ্যে সত্যবাদী মু’মিন।
(167) আর যাতে তিনি তাদেরকেও চিনে নিতে পারেন, যারা মুনাফিক। আর তাদেরকে বলা হয়েছিল: ‘এসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো অথবা (মুসলিমদের সংখ্যা বাড়িয়ে কাফিরদেরকে) প্রতিরোধ করো।’ তারা বলেছিল: ‘সত্যিই যদি যুদ্ধ হবে জানতাম তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম’।(১) সেদিন তারা ঈমানের চেয়ে কুফরীর অধিকতর নিকটবর্তী ছিল। বস্তুত তারা মুখ দিয়ে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই এবং তারা যা গোপন রাখে, আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন।
(168) যারা (যুদ্ধে না গিয়ে) ঘরে বসে রইল এবং তারা তাদের (যুদ্ধাহত) আত্মীয়দেরকে বলল যে, ‘তারা তাদের কথামত চললে (যুদ্ধের জন্য বের না হলে) নিহত হতো না।’ হে নবী! তুমি তাদেরকে বল: ‘যদি তোমরা (তোমাদের দাবীতে) সত্যবাদী হও তবে নিজেদেরকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করো, ( যখন তোমাদের মৃত্যু আসবে)।
(169) আর (হে নবী!) যারা আল্লাহর পথে (যুদ্ধ করে) নিহত হয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করিও না, বরং তারা (বিশেষ জীবনে) জীবিত। তাদের রবের পক্ষ থেকে (জান্নাত থেকে) তাদেরকে রিযক দেওয়া হয়।
(170) আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত ও পরিতৃপ্ত এবং তাদের পিছনে যারা এখনো (দুনিয়াতে রয়ে গেছে) তাদের সাথে মিলিত হয়নি তাদের বিষয়ে তারা সুসংবাদ প্রকাশ করছে যে, (যুদ্ধে শহীদ হলে) তাদের (পরকালে) কোনো ভয় নেই এবং তারা (পার্থিব ভোগ-বিলাস হারানোর জন্য) চিন্তিতও হবে না।
(171) তারা আল্লাহর প্রাপ্ত নি‘আমত ও অনুগ্রহের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে এটা জেনে যে, আল্লাহ মু’মিনদের কর্মফল বিনষ্ট করেন না।
(172) যারা (উহুদের দিনে) আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার পরও আল্লাহ এবং রাসূলের ডাকে (মুশরিকদের বিরুদ্ধে হামরাউল-আসাদে যুদ্ধের ডাকে পুনরায়) সাড়া দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্ম করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার (জান্নাত)।
(173) লোকেরা (কপিতয় মুশরিকরা খন্দকের যুদ্ধের সময়) তাদেরকে বলেছিল: ‘তোমাদের বিরুদ্ধে (কাফিরদের) বিরাট বাহিনী জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো।’(১) কিন্তু এ কথা শুনে আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান আরো বেড়ে গিয়েছিলো এবং তারা বলেছিলো: ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক!’
(174) তারপর তারা(১) আল্লাহর নি‘আমত ও অনুগ্রহসহ (যুদ্ধ থেকে) ফিরে এসেছিল। কোনো অনিষ্ট (আহত-নিহতের ঘটনা) তাদেরকে স্পর্শ করেনি। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।
(175) (মূলতঃ তোমাদের ভীতি প্রদর্শনকারী) সে তো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় করো; যদি তোমরা (প্রকৃত) মু’মিন হও।
(176) (হে নবী! মুনাফিকদের মধ্যকার) যারা (মুরতাদ হয়ে) কুফরীতে দ্রুত ধাবিত হয়, তাদের আচরণ যেন তোমাকে দুঃখ না দেয়। তারা কখনো আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ আখিরাতে তাদেরকে কোনো অংশ দেবার ইচ্ছা করেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
(177) নিশ্চয় যারা ঈমানের বিনিময়ে কুফরী ক্রয় করেছে, তারা কখনো আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(178) আর কাফিররা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, (তাদের কুফরী সত্ত্বেও) আমি তাদের জন্য যে অবকাশ দেই(১), তা তাদের কল্যাণের জন্যে। আমি তো তাদেরকে অবকাশ দেই যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। আর তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।
(179) আল্লাহ এমন নন যে, তিনি মু’মিনদেরকে (এমন অবস্থায়) ছেড়ে দিবেন যার ওপর তোমরা আছো; যতক্ষণ না তিনি পৃথক করবেন অপবিত্র লোকদেরকে (মুনাফিকদেরকে) পবিত্র লোকদের (মু’মিনদের) থেকে। আর আল্লাহ এমনও নন যে, তিনি তোমাদেরকে গায়িব (অদৃশ্যের সংবাদ) সম্পর্কে জানাবেন।(১) তবে আল্লাহ (কিছু গায়িবের ব্যাপার জানানোর জন্যে) তাঁর রাসূলদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের উপর ঈমান আনো। আর যদি তোমরা ঈমান আনো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো তাহলে তোমাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।
(180) আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দান করেছেন, তা থেকে যারা (আল্লাহার রাস্তায় দান করতে) কৃপণতা করে(১), তারা যেন এই কৃপণতাকে নিজেদের জন্যে কিছুতেই কল্যাণকর মনে না করে। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। কৃপণতা করে তারা যা কিছু জমাচ্ছে, কিয়ামতের দিন সেটাই তাদের গলার বেড়ী হিসাবে পরিয়ে দেয়া হবে। আসমানসমূহ ও জমিনের সত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যে আমল করো, আল্লাহ সে ব্যাপারে সম্যক জ্ঞাত।
(181) আল্লাহ তাদের (ইয়াহূদীদের) কথা শুনেছেন যারা বলে, ‘আল্লাহ অবশ্যই অভাবগ্রস্ত এবং আমরা অভাবমুক্ত’। তারা যা কিছু বলেছে তা এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করার বিষয়টি (তাদের আমলের খাতায়) আমি লিখে রাখব। আর আমি (কিয়ামতের দিন তাদেরকে) বলবো: ‘তোমরা জাহান্নামের আযাবের স্বাদ ভোগ করো।’
(182) (হে ইয়াহূদীরা!) এ (আযাব) হচ্ছে, তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিফল এবং এটা এ কারণেও যে, আল্লাহ বান্দাদের প্রতি মোটেই যালিম নন।
(183) যারা (ইয়াহূদীরা) বলে, ‘আল্লাহ আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন কোনো রাসূলের প্রতি ঈমান না আনি যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাদের কাছে এমন কুরবানী(প্রমাণস্বরূপ) উপস্থিত না করবে, যা আগুন খেয়ে ফেলবে। (হে নবী!) তাদেরকে বলো: ‘আমার আগে অনেক রাসূল সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ এবং তোমরা যা বলছ তা (উল্লিখিত কুরবানী)সহ তোমাদের কাছে এসেছিল। তারপরেও কেন তোমরা তাদেরকে হত্যা করেছিলে যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো?
(184) (হে নবী!) তারা যদি তোমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, তবে (এ নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই, কারণ তোমার আগেও তারা বহু রাসূলের প্রতিও তো মিথ্যারোপ করেছিলো, যারা সুস্পষ্ট নিদর্শন, উপদেশভরা আসমানী সহীফা(১) এবং দীপ্তিমান কিতাবসহ এসেছিলো।
(185) প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেবল কিয়ামতের দিনই তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হবে। অতঃপর (হিসাব-নিকাশের পালা শেষে সেদিন) যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলকাম হবে। বস্তুত, পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
(186) (হে মু’মিনগণ!) তোমাদেরকে অবশ্যই তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবনের ব্যাপারে পরীক্ষা করা হবে। তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল (ইয়াহূদী ও খুস্টান) তাদের এবং মুশরিকদের কাছ থেকে তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি তোমরা (বিপদা আপদ ও পরীক্ষায়) ধৈর্যধারণ করো এবং (আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে) তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে নিশ্চয়ই তা হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ।
(187) (হে নবী!) স্মরণ কর, যখন আল্লাহ কিতাবপ্রাপ্তদের (ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের) থেকে এ প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, ‘অবশ্যই তোমরা তা (তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাব) মানুষের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করবে এবং তা গোপন করবে না।’ এরপরও তারা তা (অঙ্গীকারকে প্রত্যাখ্যান করে) তাদের পেছনে ফেলে রাখে ও তুচ্ছ মূল্যে (আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার) বিক্রি করে। কাজেই (বিনিময়ে) তারা যা ক্রয় করে, তা কতইনা নিকৃষ্ট!
(188) (হে নবী!) যারা নিজেরা যা করেছে তাতে আনন্দ প্রকাশ করে এবং নিজেরা যা করেনি এমন কাজের জন্য প্রশংসিত হতে ভালোবাসে, তারা আযাব থেকে মুক্তি পাবে- এরূপ তুমি কখনো মনে করো না (বরং তাদের জায়গা হবে জাহান্নাম)। আর তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(189) আর আসমানসমূহ ও জমিনের সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই। আর আল্লাহ সব কিছুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।
(190) আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন।
(191) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (তথা সর্বাবস্থায়) আল্লাহর স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে, আর বলে: ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি (অর্থহীন কর্ম থেকে) অত্যন্ত পবিত্র। অতএব আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’
(192) ‘হে আমাদের রব! আপনি (আপনার সৃষ্টির) কাউকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলে তাকে তো আপনি নিশ্চয়ই লাঞ্ছিত ও অপমানিত করলেন। আর যালিমদের জন্যে থাকবে না কোনোই সাহায্যকারী।’
(193) ‘হে আমাদের রব! আমরা এক আহ্বায়ককে (আপনার নবী মুহাম্মাদকে) ঈমানের দিকে আহ্বান করতে শুনেছি।’ (তিনি এই বলে আহ্বান করছেন) ‘তোমরা তোমাদের রবের উপর ঈমান আনো।’ কাজেই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দকর্ম ও ক্রটি-বিচ্যুতি বিদূরিত করুন এবং পরিশেষে আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করে মৃত্যু দিন।’
(194) ‘হে আমাদের রব! আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে (হিদায়েত ও দুনিয়ার বিজয়ের) যা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন. তা আমাদেরকে দান করুন এবং কিয়ামতের দিন আমাদেরকে (জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে) লাঞ্ছিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।’
(195) তারপর তাদের রব আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বললেন: ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্যে আমলকারী কোনো পুরুষ বা নারীর আমল (সাওয়াব) নষ্ট করব না। তোমরা একে অপরের অংশ। কাজেই যারা হিজরত করেছে, যাদেরকে (কাফির কর্তৃক) নিজ ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে , আমার (আনুগত্যের) পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি (কিয়ামতের দিন) তাদের পাপসমূহ অবশ্যই দূর করব এবং অবশ্যই তাদেরকে প্রবেশ করাবো জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার। আর আল্লাহরই কাছে রয়েছে উত্তম পুরস্কার।
(196) (হে নবী!) যারা কুফরী করেছে, দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন কিছুতেই আপনাকে বিভ্রান্ত না করে।(১)
(197) (বস্তুতঃ এ দুনিয়াটি) তো স্বল্পকালীন সময়ের সুখ-সম্ভোগ মাত্র। তারপর জাহান্নাম তাদের আবাসস্থল। আর এটা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান!
(198) কিন্তু যারা (আদেশ-নিষেধ মেনে) তাদের রবকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। আর (কাফিরদের দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের চেয়ে) আল্লাহর কাছে সৎকর্মপরায়ণদের জন্যে যা (প্রস্তুত) আছে তা অতি উত্তম ও অধিক শ্রেষ্ঠ ।
(199) আর নিশ্চয় আহলু কিতাবের (ইয়াহহূদী ও খৃস্টানদের) মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হয়ে তাঁর (আল্লাহর) প্রতি এবং তিনি যা তোমাদের ও তাদের প্রতি নাযিল করেছেন, তাতে ঈমান আনে। তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ(পার্থিব স্বার্থে) তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে না। এরা সেসব লোক, যাদের জন্যে তাদের রবের কাছে রয়েছে পুরস্কার। নিশ্চয়ই আল্লাহ (আমলের) দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।
(200) হে তোমার যারা ঈমান এনেছ! (শরীয়তের বিধি-বিধান পালনে ও পার্থিব বিপদ আপদে) ধৈর্যধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো(১) এবং সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো। আর আল্লাহর (আদেশ-নিষেধ মেনে) তাকওয়া অবলম্বন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।