(1) আলিফ্ -লাম্- মীম।
(2) ঐটি (আল-কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই। মুত্তাক্বীদের জন্য (ঐটি) হিদায়াত (পথ-প্রদর্শক)।
(3) যারা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়িম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযক (জীবনোপকরণ) দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
(4) আর যারা ঈমান আনে তোমার প্রতি যে কিতাব (আল-কুরআন) নাযিল করা হয়েছে তার ওপর এবং যা তোমার পূর্ববর্তী (নবী)-দের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতি। আর আখিরাতের প্রতি তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী ।
(5) তারাই তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।
(6) নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে, তুমি তাদেরকে সতর্ক কর বা না কর, তাদের জন্য (উভায়টাই) সমান; তারা ঈমান আনবে না।
(7) আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে (অবাধ্যতার) আবরণ। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
(8) আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে, যারা বলে, ‘ আমরা আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনেছি’; অথচ তারা (প্রকৃত) মু’মিন নয়।
(9) তারা আল্লাহ এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিতে চায়, বস্তুত তারা নিজদেরকে ব্যতীত কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না; অথচ তারা তা বুঝে না।
(10) তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি (সন্দেহ ও কপটতা), আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তারা যে মিথ্যা বলত (পরকালে) তাদের জন্য রয়েছে, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(11) আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ (অশান্তি ও বিপর্যয়) সৃষ্টি করো না’, তখন তারা বলে, ‘আমরা তো শুধু সংশোধনকারী’ (শান্তি স্থাপনকারী)।
(12) সাবধান! তারাই ফ্যাসাদ (অশান্তি ও বিপর্যয়) সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা তা অনুধাবন করে না।
(13) আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘লোকেরা (সাহাবীরা) যেরূপ ঈমান এনেছে’, তোমরা তাদের মত ঈমান আনো’ তখন তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধেরা ঈমান এনেছে’? সাবধান! নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না।
(14) আর যখন তারা (মুনাফিকরা) মু’মিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো তাদের সাথে কেবল উপহাসকারী’।
(15) আল্লাহও তাদের উপহাসের জবাব দেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় (বিভ্রান্ত হয়ে) ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন।
(16) এরাই তারা, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। তাই তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত নয়।
(17) তাদের উপমা হলো ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে (অন্ধকারে পথ চলার জন্য) আগুন জ্বালালো। তারপর আগুন যখন তার চারপাশ আলোকিত করল, তখন আল্লাহ তাদের জ্যোতি কেড়ে নিলেন এবং তাদেরকে ছেড়ে দিলেন এমন অন্ধকারে যে, তারা কিছুই দেখতে পায় না।
(18) তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। কাজেই তারা (বিভ্রান্ত পথ হতে) ফিরে আসবে না।
(19) অথবা (তাদের উপমা হচ্ছে) আকাশ হতে মুষলধারে বৃষ্টির ন্যায়, যাতে রয়েছে অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎ চমক। বজ্রধ্বনিতে মৃত্যুভয়ে তারা তাদের কানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখে। আর (এভাবে তারা বিপদমুক্ত হতে চা্ইলেও) আল্লাহ সবদিক থেকে কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন।
(20) বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেয়ার উপক্রম করে । (বিদ্যুতের চমক) যখনই তাদের সামনে আলো উদ্ভাসিত করে, তখন তারা পথ চলতে থাকে। আর যখন তাদের উপর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন তারা থমকে দাঁড়ায়। আল্লাহ ইচ্ছে করলে, তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি নিয়ে নিতে পারেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।
(21) হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের সেই (একমাত্র) রবের ‘ইবাদাত করো যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারো।
(22) যিনি জমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আসমানকে ছাদ বানিয়েছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তা দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেছেন। কাজেই তোমরা জেনেও কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না।
(23) আর আমি আমার বান্দার (মুহাম্মাদের) উপর যা (কুরআন) নাযিল করেছি, তোমরা সে বিষয়ে যদি সন্দেহে থাকো, তবে তোমরা তার অনুরূপ একটি সূরাহ (রচনা করে) নিয়ে এসো এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষী-সাহায্যকারীদেরকে ডাক; যদি তোমরা (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হও।
(24) অতএব যদি তোমরা (কুরআনের অনুরূপ একটি সূরাহ রচনা) করতে না পারো, আর (বাস্তবতা হলো) তোমরা তা কখনই পারবে না, তাহলে তোমরা সে আগুনকে ভয় করো, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর, যা কাফিরদের জন্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে ।
(25) আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, (হে নবী,) তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্যে রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার নিম্নদেশে নদ-নদী প্রবাহিত। যখনই তাদেরকে সেখানে ফলফলাদি জীবিকা হিসেবে দেয়া হবে তখনই তারা বলবে, ‘এ ধরনের ফলই ইতঃপূর্বে আমাদেরকে জীবিকা হিসেবে (পৃথিবীতে) দেয়া হয়েছিলো। আর তাদেরকে দুনিয়ার ফলের সাদৃশ্যপূর্ণ ফলফলাদিই দেয়া হবে। সেখানে তাদের জন্যে রয়েছে পবিত্র সঙ্গিনী এবং সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে ।
(26) নিশ্চয় আল্লাহ মশা কিংবা তার চেয়েও ক্ষুদ্র কোন বস্তুর উপমা দিতে লজ্জাবোধ করেন না। অতঃপর যারা ঈমান এনেছে তারা জানে যে, এটি তাদের রবের পক্ষ হতে (আসা) সত্য। কিন্তু যারা কুফুরি করেছে তারা বলে যে, আল্লাহ কী উদ্দেশ্যে এ উপমা পেশ করছেন? এর দ্বারা অনেককেই তিনি বিপথগামী করেন, আবার অনেককেই হিদায়াত দান করেন। আর তিনি ফাসিকদের ছাড়া আর কাউকে এর দ্বারা বিপথগামী করেন না।
(27) যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আর যে (আত্মীয়তার) সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
(28) তোমরা কীভাবে আল্লাহর সাথে কুফরি করছ? অথচ তোমরা ছিলে মৃত, তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। আবার তিনি তোমাদের মৃত্যু দিবেন ও পুনরায় জীবিত করবেন, তারপর তাঁরই দিকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
(29) তিনিই জমিনে যা কিছু আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আসমানের প্রতি মনোনিবেশ করলেন এবং সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করলেন। আর তিনি সর্ব বিষয়ে সবিশেষ অবগত।
(30) (আর স্মরণ করুন) যখন আপনার রব ফিরিশতাদের বললেন: ‘নিশ্চয় আমি জমিনে খলীফাহ (একে অন্যের স্থলাভিষিক্ত) সৃষ্টি করতে যাচ্ছি’। জবাবে তারা বলল: ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে ফ্যাসাদ (বিপর্যয়) সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? আর আমরাই তো আপনার সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করছি এবং পবিত্রতা ঘোষণা করছি । তিনি বললেন: ‘নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’।
(31) আর তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। তারপর সেগুলো ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন এবং বললেন: ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম বলে দাও; যদি তোমরা ( তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হও’।
(32) তারা বলল: ‘আপনি পবিত্র মহান! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। নিশ্চয় আপনিই মহাজ্ঞানী, মহা প্রজ্ঞাময়।’
(33) তিনি বললেন: ‘ হে আদম ! তাদেরকে এসবের নাম বলে দাও’। অতঃপর সে (আদম) যখন তাদেরকে সেসবের নাম বলল, তখন তিনি (আল্লাহ) বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও জমিনের গায়েবের (অদৃশ্যের) বিষয় অবগত আছি। আমি আরও জানি তোমরা যা প্রকাশ করো এবং তোমরা যা গোপন করো।’
(34) যখন আমি ফিরিশতাদের বললাম: আদমকে সাজদাহ করো। তখন ইবলিস ছাড়া সকলেই সাজদাহ করলো। সে অস্বীকার করলো ও অহংকার করলো। আর সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
(35) আর আমি বললাম: ‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে আহার কর; কিন্তু এই গাছটির কাছে যেয়ো না; তাহলে তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
(36) অত:পর শয়তান সেখান (জান্নাত) থেকে তাদের দুজনের পদস্থলন ঘটালো এবং তারা দুজন যেখানে ছিলো সেখান থেকে তাদেরকে বের করে দিলো। আমি (শয়তানসহ তিনজনকে) বললাম: ‘তোমরা (জান্নাত থেকে পৃথিবীতে) নেমে যাও, (আজ থেকে) তোমরা একে অন্যের শত্রু। আর পৃথিবীতে তোমাদের জন্য রয়েছে কিছু দিনের বসবাস ও জীবনোপকরণ।’
(37) অত:পর আদম তার রবের পক্ষ থেকে (ক্ষমা চাওয়া ও তাওবাহ কবুল হওয়ার জন্যে) কিছু বাণী পেলো। ফলে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবাহ কবুলকারী, অতি দয়ালু।
(38) আমি বললাম: ‘তোমরা সকলে এখান (জান্নাত) থেকে (পৃথিবীতে) নেমে যাও। অত:পর যখনই আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট কোনো হিদায়াত ( দিকনির্দেশনা) আসবে, তখন যারাই আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয়ও থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’
(39) আর যারা কুফরী করবে এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করবে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে।
(40) হে বানূ ইসরাঈল! তোমরা আমার সে (অসংখ্য) নি‘আমতের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ কর, তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে আমার কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর শুধু আমাকেই ভয় কর।
(41) আর আমি (মুহাম্মাদের প্রতি) যা নাযিল করেছি (আল-কুরআনে) তোমরা তার ওপর ঈমান আনো। এটা তোমাদের কাছে যা আছে (তাওরাত ) তার সত্যতা প্রমাণকারী। আর তোমরা এর প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করো না । আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।
(42) আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করো না।
(43) আর তোমরা সালাত কায়িম করো, যাকাত প্রদান করো এবং রুকূ‘কারীদের সাথে রুকূ‘ করো ।
(44) তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিচ্ছ, আর নিজেদেরকে (তা করা থেকে) ভুলে যাচ্ছ? অথচ তোমরা আল্লাহর কিতাব (তাওরাত) তিলাওয়াত কর। তোমরা কি বুঝ না?
(45) আর তোমরা (আল্লাহর কাছে)ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও । নিশ্চয় তা বিনীত-অনুগত ছাড়া অন্যদের জন্যে অবশ্যই কঠিন।
(46) (তারাই বিনীত-অনুগত) যারা বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয় তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাত করবে এবং নিশ্চয় তারা তাঁরই কাছে ফিরে যাবে।
(47) হে বানূ ইসরাঈল! আমার সে নি‘আমাতের কথা স্মরণ করো, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি। আর নিশ্চয় আমি বিশ্ববাসীর ওপর তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।
(48) আর তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না। আর কারো পক্ষ থেকে কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারও কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ হবে না। আর সেদিন তারা (পাপীরা) সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
(49) (আর স্মরণ কর) যখন আমি তোমাদেরকে ফির‘আউনের সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করতো। তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করতো এবং তোমাদের কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত রাখতো। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে (তোমাদের জন্য) ছিল মহাপরীক্ষা।
(50) (আর স্মরণ করো) যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম। অত:পর আমি তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউনের দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম; আর তোমরা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলে।
(51) (আর স্মরণ করো) যখন আমি মূসার সাথে (তাওরাত নাযিলের জন্যে) চল্লিশ রাতের অঙ্গীকার করেছিলাম। এরপর তোমরা গরুর বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলে; আর তোমরা তো যালিম।
(52) এরপর (এত বড় অপরাধ করালেও) আমি তোমাদেরকে (তাওবার পরে) ক্ষমা করেছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।
(53) (আর স্মরণ করো) যখন আমি মূসাকে দিয়েছিলাম সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী কিতাব (তাওরাত), যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।
(54) (আর স্মরণ করো) যখন মূসা (তূর পর্বত থেকে ফিরে এসে) স্বীয় জাতির লোকদের বললো: ‘হে আমার জাতি! গো-বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছ। কাজেই তোমরা নিজেদের (গো-বৎসকে উপসানাকারীদের)কে হত্যা করে তোমাদের স্রষ্টার কাছে তাওবাহ কর। তোমাদের স্রষ্টার কাছে এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তখন তিনি তোমাদের তাওবাহ কবুল করে নিবেন। অবশ্যই তিনি তাওবাহ কবুলকারী -ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'
(55) (আর স্মরণ কর) যখন তোমরা বলেছিলে: ‘হে মূসা ! আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যভাবে না দেখা পর্যন্ত তোমাকে কখনও বিশ্বাস করব না।’ ফলে আকস্মিক বজ্রপাত হলো, যা তোমরা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছিলে ।
(56) কিন্তু তোমাদের মৃত্যুর পর আমি তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।
(57) আর আমি তোমাদের উপর মেঘমালা দিয়ে ছায়া দিলাম এবং (খাবার হিসেবে) তোমাদের প্রতি প্রেরণ করলাম মান্না ও সালওয়া। (আর আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম:) তোমরা সে পবিত্র জীবিকা থেকে আহার কর, যা আমি তোমাদেরকে রিযক দিয়েছি। আর তারা আমার প্রতি যুলম করেনি; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল।
(58) (আর স্মরণ করো) যখন আমি বললাম: এই জনপদে প্রবেশ করো এবং তা হতে যাইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার করো। তবে শহরের মূল দরজা দিয়ে নতশিরে প্রবেশ করো। আর বলো: হিত্তাতুন ‘ক্ষমা চাই’। তাহলে আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবো। আর অচিরেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে আমার অনুগ্রহ বাড়িয়ে দিবো।
(59) কিন্তু যারা যালিম তারা তাদের শিখিয়ে দেয়া কথাটি পরিবর্তন করে তার স্থলে অন্য কথা (হাব্বাতুন ফী শা‘ঈরাতিন) বলল। ফলে আমি যালিমদের প্রতি তাদের অবাধ্যতার কারণে আকাশ হতে শাস্তি নাযিল করলাম।
(60) (আরো স্মরণ করো সে সময়ের কথা) যখন মূসা তার জাতির জন্য (তীহের মরু প্রান্তরে) পানি চাইলেন। আমি বললাম: ‘তুমি লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত করো।’ ফলে তা হতে বারোটি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হলো। প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ পানি সংগ্রহের স্থান জেনে নিলো। (আমি তাদেরকে বললাম), ‘আল্লাহর দেয়া জীবিকা হতে তোমরা খাও এবং পান করো, তবে জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা।’
(61) (আর স্মরণ করো) যখন তোমরা বললে: ‘হে মূসা, আমরা এক খাবারের উপর কখনো ধৈর্যধারণ করব না। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের নিকট দু‘আ করুন, যেন তিনি আমাদের জন্য জমিন থেকে শাক-সবজি, কাঁকুড় (বা শসা), রসুন (বা গম), মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করেন। তখন মূসা তাদেরকে বললো: ‘তোমরা কি উত্তম জিনিসের বদলে নিম্নমানের জিনিস চাও? তবে তোমরা অন্য কোন শহরে অবতরণ কর, তোমরা যা চাও, সেখানে তা আছে।’ অবশেষে তাদের উপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য আপতিত হলো এবং তারা আল্লাহর গজবের শিকার হলো। এটা এ জন্য যে , তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার এবং নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতো। তাদের এই পরিণতি এ কারণে যে, তারা নাফরমানি করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত।
(62) নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, আর ইয়াহূদী , নাসারা ও সাবিঈরা, (তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট পুরস্কার । আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
(63) (আর স্মরণ করো) যখন আমি তোমাদের ওপর তূর পর্বত তুলে ধরে তোমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম; (এবং বলেছিলাম), ‘আমি তোমাদেরকে যা দিলাম দৃঢ়তার সাথে তা গ্রহণ করো এবং তাতে যা আছে তা স্মরণে রাখ, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।’
(64) কিন্তু এরপরেও তোমরা (অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে) মুখ ফিরিয়ে নিলে। অত:পর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এবং রহমত না থাকলে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হতে।
(65) আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের (মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ) প্রসঙ্গে সীমালঙ্ঘন করেছিলো তাদের বিষয়টি তোমরা অবশ্যই জানো। আমি তদেরকে বলেছিলাম: ‘তোমরা ঘৃণিত বানরে পরিণত হয়ে যাও।’
(66) আর আমি এ (এ জনপদের) ঘটনাকে তাদের সমকালীন ও পরবর্তীদের জন্যে একটা শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত এবং তা মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ করেছি।
(67) (আর স্মরণ করো) যখন মূসা তার জাতিকে বললো: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গাভি যবহ করার আদেশ দিচ্ছেন।’ তখন তারা বলল: ‘তুমি কি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছো?’ মূসা জবাবে বললো: ‘আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।’
(68) তারা (মূসাকে) বলল: ‘তুমি তোমার রাবের কাছে আমাদের জন্যে দু‘আ করো, তিনি যেন আমাদেরকে গাভিটি কেমন হবে’ তা সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। সে বললো: ‘আল্লাহ বলছেন, সেটা এমন গাভী, যা অতি বৃদ্ধও নয়, অল্পবয়স্কও নয়; মধ্যবয়সী। অত:এব তোমাদেরকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা পালন করো।’
(69) তারা বলল: ‘(হে মূসা) তুমি তোমার রাবের কাছে আমাদের জন্যে দু‘আ করো , তিনি যেন আমাদেরকে সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, গাভিটির রং কী হবে?’ সে বললো, ‘আল্লাহ বলেছেন, সেটা হলুদ বর্ণের গাভি, উজ্জ্বল গাঢ় হলুদ রংবিশিষ্ট, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে।’
(70) তারা বলল: ‘(হে মূসা) তুমি তোমার রাবের কাছে আমাদের জন্যে দু‘আ করো, তিনি যেন আমাদেরকে সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, গাভিটি কেমন হবে? নিশ্চয় গাভিটির (ধরন) সম্পর্কে আমরা সংশয়ে আছি (আমাদের কাছে সব গাভিই এক রকম মনে হচ্ছে)। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে নিশ্চয় আমরা সঠিক (গাভি)টির সন্ধান পাবো।’
(71) তিনি (মূসা) বললো: ‘আল্লাহ বলেছেন,‘ সেটা এমন এক গাভি, যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি, সুস্থ-সবল ও নিখুঁত গাভি।’ তারা বলল: ‘এবার তুমি সঠিক বর্ণনা নিয়ে এসেছো।’ অবশেষে তারা সেটাকে যবহ করলো; যদিও তারা তা (যবহ) করতে প্রস্তুত ছিলো না।
(72) (আর স্মরণ করো) যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, অত:পর তোমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ করছিলে। আর তোমরা যা গোপন করেছিলে আল্লাহ ছিলেন তা ব্যক্তকারী।
(73) আমি (তাদেরকে) বললাম: ‘এর (জবাইকৃত গাভির) কোন অংশ দিয়ে তাকে (মৃত ব্যক্তির লাশকে) আঘাত করো।’ এমনিভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলি দেখিয়ে থাকেন, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার।
(74) এরপরেও তোমাদের হৃদয়গুলো কঠিন হয়ে গেলো, যেন পাথর কিংবা তার চেয়েও কঠিন। অথচ কোন কোন পাথর তো এমন যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়। আর এমনও কিছু পাথর আছে, যেগুলো বিদীর্ণ হয়ে তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার এমন কিছু পাথর আছে, যা আল্লাহর ভয়ে (কাঁপতে কাঁপতে) নিচে ধ্বসে পড়ে, আর তোমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ মোটেই অনবহিত নন।
(75) (হে ঈমানদারগণ,) তোমরা কি এ আশা পোষণ করছ যে, তারা (ইয়াহূদীরা) তোমাদের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ঈমান আনবে? অথচ তাদের একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত, অতপর তারা তা অনুধাবন করার পর বিকৃত করত; অথচ তারা ভালো করেই জানে (যে, এটাই আল্লাহর শাশ্বত বাণী)।
(76) আর তারা (ইয়াহূদীরা) যখন মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে: ‘আমরা (তোমাদের দীন ও রাসূলের প্রতি) ঈমান এনেছি।’ আবার যখন তারা একে অন্যের সাথে নিভৃতে মিলিত হয় তখন বলে: যা আল্লাহ (তাওরাতে) তোমাদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন‘ তোমরা কি তাদেরকে (মুসলিমদেরকে) তা বলে দিয়েছো? এ দ্বারা তারা (মুসলিমরা) তো তোমাদের রাবের নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে দলিল পেশ করবে, তোমরা কি তা অনুধাবন করো না?’
(77) তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন রাখে এবং যা প্রকাশ করে, নিশ্চয় আল্লাহ তা জানেন?
(78) আর তাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর লোক আছে যারা মিথ্যা আশা-আকাঙ্ক্ষা ছাড়া কিতাব সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে।
(79) কাজেই ধ্বংস-দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে (মনগড়া) কিতাব রচনা করে, অতঃপর তুচ্ছ মূল্য পাওয়ার জন্য বলে: ‘এটা আল্লাহর কাছ থেকে (অবতীর্ণ হওয়া)।’ অতএব, তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য তাদের ধ্বংস-দুর্ভোগ এবং যা তারা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস-দুর্ভোগ।
(80) তারা (ইয়াহূদীরা মিথ্যা ও দাম্ভিকতার সাথে) বলে: নির্দিষ্ট কিছু দিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনও স্পর্শ করবে না।’ বলুন: ‘তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে এমন কোন অঙ্গীকার আদায় করে নিয়েছো যে, আল্লাহ সে অঙ্গীকার কখনও ভঙ্গ করবেন না? নাকি আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু (মিথ্যা অপবাদ) বলে বেড়াচ্ছ যা তোমরা জান না?’
(81) হ্যাঁ, যে (কুফুরীর) পাপ উপার্জন করেছে এবং তার পাপরাশি তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।
(82) আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতবাসী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।
(83) (আর স্মরণ করো) যখন আমি বানূ ইসরাঈলের অঙ্গীকার এ মর্মে গ্রহণ করেছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ‘ইবাদাত করবে না এবং সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে। আর মানুষকে উত্তম কথা বলবে, সালাত কায়িম করবে এবং যাকাত প্রদান করবে। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া তোমরা সকলেই অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে।
(84) (আর স্মরণ করো) যখন আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা একে অপরের রক্তপাত করবে না এবং একে অন্যকে স্বদেশ থেকে বের করে দিবে না। তারপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে। আর তোমরাই তার সাক্ষ্য।
(85) এই সুদৃঢ় অঙ্গীকার করার পরেও তোমরাই তো তারা, যারা আজ নিজেরা পরস্পরকে হত্যা করছো, তোমাদেরই এক দল আরেক দলকে তাদের গৃহ থেকে বের করে দিচ্ছো। তোমরা পাপ (অবিচার) ও সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে সহায়তা করছো। আর তারা যদি যুদ্ধবন্দি হয়ে তোমাদের নিকট আসে, তোমরা মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করো; অথচ তাদেরকে বের করাই তোমাদের জন্য হারাম ছিল। তাহলে তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখো, আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের আর কী বা প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে অনবহিত নন।
(86) তারাই সেসব লোক, যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে ক্রয় করেছে। কাজেই তাদের শাস্তি বিন্দুমাত্র কমানো হবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না।
(87) অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব (তাওরাত) দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলগণকে পাঠিয়েছি। মারইয়াম-পূত্র ‘ঈসাকে আমি সুস্পষ্ট প্রমাণ ও নিদর্শনসমূহ দিয়েছি এবং ‘রূহুল কুদুস’ দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। তবে তোমরা তো এমনটিই করে এসেছো, যখনই কোন রাসূল তোমাদের কাছে এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখনই তোমরা দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছো। আর (নবীদের) একদলের উপর মিথ্যারোপ করেছো এবং আরেকদল (নবী-রাসূল)-কে হত্যা করেছো ।
(88) আর তারা বলেছিলো: ‘আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত’ (আসলে তা নয়); বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছেন । সুতরাং তাদের অতি অল্প সংখ্যকই ঈমান আনে।
(89) আর যখন আল্লাহর কাছ থেকে তাদের কাছে যা আছে (তাওরাত-ইঞ্জীল) তার সত্যায়নকারী কিতাব (আল-কুরআন) আসলো; অথচ (কুরআন নাযিলের) পূর্বে তারা এর সাহায্যে কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয় প্রার্থনা করতো, তারপর যখন তাদের কাছে পরিচিত কিতাব আসল, তখন তারা এটিকে অস্বীকার করে বসলো। কাজেই কাফিরদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত।
(90) যার বিনিময়ে তারা তদের নিজেদেরকে বিক্রি করেছে তা কতই না নিকৃষ্ট! তা হচ্ছে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তার সাথে হঠকারিতা বশত কুফরী করেছে, শুধু এজন্য যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহ নাযিল করেন। কাজেই তারা ক্রোধের উপর ক্রোধ অর্জন করেছে। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে (কিয়ামত দিবসে) লাঞ্ছনাময় শাস্তি।
(91) আর যখন তাদেরকে (ইয়াহূদীদেরকে) বলা হয়: ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তাতে (আল-কুরআনে) ঈমান আনো।’ তারা বলে: ‘আমাদের (বানূ ইসরাঈলের) প্রতি যা নাযিল হয়েছে আমরা কেবল তাতেই ঈমান আনি।’ আর এর বাইরে যা (কুরআনে) নাযিল করা হয়েছে তার সবকিছুই তারা অস্বীকার করে; অথচ তা মহা সত্য এবং তাদের নিকট যা আছে (তাওরাত) তার সত্যায়নকারী। বলো: ‘তোমরা যদি মু’মিনই হয়ে থাকো, তবে কেন তোমরা ইতঃপূর্বে আল্লাহর নবীদেরকে হত্যা করেছিলে?’
(92) অবশ্যই মূসা তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এসেছিল। এরপরেও তোমরা তার অনুপস্থিতিতে গো বৎসকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলে। বাস্তবিকই তোমরা যালিম।
(93) (স্মরণ করো) যখন আমি তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার ওপর উঠিয়ে ধরে তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম, (বলেছিলাম,) ‘আমি তোমাদেরকে যা (যে কিতাব ও বিধান) দিলাম তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং আমার বাণী শোনো।’ তারা বলেছিল: ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম।’ আসলে কুফরীর কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। (হে মুহাম্মদ, তুমি) বলো: ‘যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে তোমাদের ঈমান যার নির্দেশ দেয় (কুফুরী ও ভ্রষ্টতা) , তা কতই না নিকৃষ্ট।’
(94) (হে মুহাম্মাদ,) বলো: ‘যদি আল্লাহর কাছে আখিরাতের বাসস্থান (জান্নাত) মানবজাতিকে বাদ দিয়ে বিশেষভাবে শুধু তোমাদের জন্যেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে তোমরা (দ্রুত সেখানে যাওয়ার জন্যে) মৃত্যু কামনা করো, যদি তোমরা ( তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হয়ে থাকো।’
(95) কিন্তু তাদের কৃতকর্মের কারণে কখনোই তারা তা (মৃত্যু) কামনা করবে না। আর আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত।
(96) আর (হে নবী,) তুমি অবশ্যই তাদেরকে (ইয়াহূদীদেরকে) জীবনের প্রতি অন্যসব মানুষের চেয়ে বেশি লোভী দেখতে পাবে, এমনকি মুশরিকদের চেয়েও। তাদের প্রত্যেকে আশা করে যদি তাকে হাজার বছর আয়ু দেয়া হত; অথচ দীর্ঘায়ু তাকে শাস্তি হতে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
(97) বলো: ‘যে কেউ জিবরীলের সাথে শত্রুতা করবে, শুধু এজন্যে যে, নিশ্চয় সে আল্লাহর হুকুমেই তোমার হৃদয়ে কুরআন নাযিল করেছে, যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেরও সত্যায়নকারী এবং যা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও সুসংবাদ।’
(98) আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিব্রীলের ও মীকাঈলের যে কেউ শত্রু, সে (জেনে রাখুক, তারা কাফির) নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু।
(99) আর অবশ্যই আমি তোমার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেছি। ফাসিকরা ছাড়া অন্য কেউ তা অস্বীকার করে না।
(100) ব্যাপারটা কি এমন নয় যে, তারা যখনই কোন অঙ্গীকার করেছে তখনই তাদের কোন এক দল তা ছুঁড়ে ফেলেছে? বরং তাদের অধিকাংশই ঈমান আনে নাই।
(101) আর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নিকট একজন রাসূল (মুহাম্মাদ) আসলো, তাদের কাছে যা রয়েছে তার সত্যায়নকারী হিসেবে, তখন যাদেরকে ইতঃপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের একদল আল্লাহর কিতাবকে এমনভাবে তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেললো, যেন তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানেই না।
(102) পক্ষান্তরে তারা (ইয়াহূদীরা) সুলায়মানের রাজত্বে শয়তানরা যা আবৃত্তি করতো (ম্যাজিক-মন্ত্র) তা অনুসরণ করত। আর সুলায়মান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে শিক্ষা দিতো জাদুবিদ্যা ও (সে বিষয় শিক্ষা দিত) যা বাবিল (ইরাকের ব্যাবিলন) শহরে (প্রেরিত)হারূত ও মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপর নাযিল করা হয়েছিলো। তারা উভয়েই এই কথা না বলে কাউকে যাদু শিক্ষা দিতো না যে, ‘আমরা ( আল্লাহর পক্ষ হতে) নিছক একটি পরীক্ষা; কাজেই তুমি কুফরী করো না।' তা সত্ত্বেও তারা ফিরিশতাদ্বয়ের কাছ থেকে এমন জাদু শিখতো যা দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতো। অথচ তারা আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তা দ্বারা কারো ক্ষতি করতে পারতো না। আর তারা তা-ই শিখতো যা তাদের ক্ষতি করতো এবং কোন উপকারে আসত না। আর তারা নিশ্চিত জানে যে, যে কেউ তা খরিদ করে, (অর্থাৎ জাদুর আশ্রয় নেয়) তার জন্য আখিরাতে কোন অংশ নেই। তারা যার বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে , তা কতোইনা নিকৃষ্ট। হায় যদি তারা জানতো!
(103) আর তারা (ইয়াহূদীরা) যদি (আল্লাহর ওপর সত্যিকার) ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আল্লাহর কাছ থেকে কত উত্তম প্রতিফলই না তারা লাভ করত; হায়! যদি তারা জানত!
(104) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমরা ‘রা‘ইনা’ বলো না; বরং ‘উনযুরনা" বলো এবং শোনো। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(105) আহলে কিতাবের (ইয়াহহূদী-খৃস্টানদের) মধ্যে যারা কুফরী করেছে তারা এবং মুশরিকরা এটা চায় না যে, তোমাদের রাব-এর কাছ থেকে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ নাযিল হোক। অথচ আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ রহমত দ্বারা বিশেষিত (মনোনীত) করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।
(106) আমি কোন আয়াত রহিত করলে বা ভুলিয়ে দিলে তা থেকে উত্তম অথবা (নিদেন পক্ষে) তারই অনুরূপ কোন আয়াত নিয়ে আসি। তুমি কি জানো না যে, নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান!
(107) তুমি কি জানো না যে, আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব ও আধিপত্য একমাত্র আল্লাহর? আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক নেই, নেই কোন সাহায্যকারীও।
(108) (হে মু’মিনগণ) তোমরা কি তোমাদের রাসূলকে সেরূপ প্রশ্ন করতে চাও যে-রূপ প্রশ্ন ইতঃপূর্বে মূসাকে করা হয়েছিল? আর যে ঈমানকে কুফরের দ্বারা পরিবর্তন করবে, সে অবশ্যই সরল সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে।
(109) আহলে কিতাবের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর কুফুরীতে ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিদ্বেষবশতঃ (তারা এটা করে থাকে)। অতএব, তোমরা ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ্ তার কোন নির্দেশ দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
(110) আর তোমরা সালাত কায়িম করো ও যাকাত প্রদান করো। তোমরা নিজেদের (আখিরাতের) জন্য উত্তম কাজের যা কিছু অগ্রিম পাঠাবে, তা অবশ্যই আল্লাহর কাছে পাবে। নিশ্চয় তোমরা যা করছো নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
(111) আর তারা বলে: ‘ইয়াহূদী অথবা খৃস্টান ছাড়া অন্য কেউ কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ আসলে এটা তাদের মিথ্যা অলীক আশা মাত্র। (হে রাসূল) তাদেরকে বলো: ‘যদি তোমরা (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হও, তবে তোমাদের দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করো।’
(112) হ্যাঁ (জেনে রাখো, জান্নাতে কেবল সে-ই প্রবেশ করবে), যে আল্লাহর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে এবং বাস্তবেও সে সৎকর্মশীল। তার প্রতিদান তার রাব-এর কাছে রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
(113) আর ইয়াহূদীরা বলে: ‘খৃস্টানরা কোন ভিত্তির (সত্য দীনের) উপর প্রতিষ্ঠিত নয়’ এবং খৃস্টানরা বলে: ‘ইয়াহূদীরা কোন ভিত্তির (সত্য দীনের) উপর প্রতিষ্ঠিত নয় ’; অথচ তারা (উভয় পক্ষই আল্লাহর) কিতাব) পড়ে। এভাবে যারা কিতাবের কিছুই জানেনা তারাও তাদের অনুরূপ একই কথা বলে। কাজেই যে বিষয়ে তারা মতভেদ করতো কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে (সে বিষয়ে চূড়ান্ত) মীমাংসা করবেন।
(114) আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম স্মরণ (উচ্চারণ) করতে বাঁধা দেয় এবং সেগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে! অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত ও বিনয়ী হওয়া ছাড়া তাদের সেগুলোতে (আল্লাহর মসজিদসমূহে) প্রবেশ করার অধিকার ছিল না। দুনিয়াতে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা-অপমান এবং আখিরাতে রয়েছে মহা শাস্তি।
(115) আর পূর্ব-পশ্চিম (ও এর মধ্যকার যা কিছু আছে) সবকিছুরই মালিক আল্লাহ। সুতরাং তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকই আল্লাহর দিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।
(116) আর তারা (ইয়াহূদী, খৃস্টান ও মুশরিকরা) বলে: ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি (এ অপবাদ থেকে) অতি পবিত্র। বরং আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে সবই তাঁর। সবাই একান্তভাবে তাঁরই একান্ত অনুগত।
(117) তিনিই আসমানসমূহ ও জমিনের (পূর্ব নমুনা বিহীন) স্রষ্টা-উদ্ভাবক। আর তিনি যখন কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন: ‘হও’, আর তা সাথে সাথেই হয়ে যায়।
(118) আর যারা কিছু জানে না তারা বলে: ‘আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না?’ এভাবে তাদের পূর্ববর্তী (অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ও) তাদের মতো কথা বলতো। তাদের সকলের অন্তর একই রকম। অবশ্যই আমি নিদর্শনসমূহকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি, সেসব লোকদের জন্য, যারা দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।
(119) (হে মুহাম্মদ) নিশ্চয় আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সত্য দীনসহ, (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) সতর্ককারীরূপে। আর জাহান্নামীদের সম্পর্কে তোমকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
(120) আর ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা আপনার প্রতি কখনোই সন্তুষ্ট হবে না; যতক্ষণ না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন। (হে মুহাম্মাদ, তুমি) বলো: ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই প্রকৃত হিদায়াত।’ আর তোমার কাছে (মহাসত্য অহীর) জ্ঞান আসার পরেও তুমি যদি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো, তবে (জেনে রাখো) আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কোন অভিভাবক থাকবে না এবং থাকবে না কোন সাহায্যকারীও।
(121) যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তাদের মধ্যে যারা যথাযথভাবে তা তিলাওয়াত করে, (এবং অনুসরণ করে) তারাই মূলত এর প্রতি ঈমান আনে। আর যারা একে(কুরআনকে) অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
(122) হে বানূ ইসরাঈল! আমার সে নি‘আমাতের কথা স্মরণ করো যা আমি তোমাদেরকে দান করেছিলাম। আর নিশ্চয় আমি সমগ্র বিশ্ববাসীর ওপর তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।
(123) আর তোমরা ভয় কর (কিয়ামতের) সেদিনকে, যেদিন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কোন কাজে আসবে না। কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় (ক্ষতিপূরণ) গ্রহণ করা হবে না এবং কোন সুপারিশও কারো উপকারে আসবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
(124) আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীমকে তাঁর রাব কয়েকটি বাণী (বিধি-বিধান) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন। অতঃপর তিনি সেগুলো পূর্ণ করেছিলেন। আল্লাহ বললেন: ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে মানুষের ইমাম (নেতা) বানাবো।’ সে বললো: ‘আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও?’ আল্লাহ বললেন: ‘আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়।’
(125) (আর স্মরণ করো) যখন আমি কা‘বা ঘরকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম: ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ করো। আর আমি ইবরাহীম ও ইসমা’ঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম: ‘তোমরা দুজন আমার (কা‘বা) ঘরকে তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী, রুকূ‘ ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখবে ।’
(126) (আর স্মরণ করো) যখন ইবরাহীম (দু‘আ করে) বলেছিলো: 'হে আমার রাব! এ (মক্কা) নগরকে নিরাপদ নগরে পরিণত করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনে তাদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান করুন।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন: ‘যে কুফরী করবে তাকেও কিছু কালের জন্য জীবন সামগ্রী সরবরাহ করবো। তারপর তাকে আমি (জাহান্নামের) আগুনের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব। আর তা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল !’
(127) (আর স্মরণ করো) যখন ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল কা‘বা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলো, তখন (তারা দু‘আ করে বলছিলো): ‘হে আমাদের রাব! আমাদের পক্ষ থেকে (এ কাজ) কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’
(128) ‘হে আমাদের রব ! আর আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত (আদেশ মান্যকারী বিনয়ী) করুন এবং আমাদের বংশধর হতে আপনার এক অনুগত জাতি বানান। আর আমাদেরকে ‘ইবাদাতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দিন এবং আমাদের তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনিই তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’
(129) ‘হে আমাদের রাব! আর আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন রাসূল পাঠান, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করে শোনাবেন ; তাদেরকে (আল্লাহর) কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(130) আর (সব কিছু জেনে-বুঝেও) যে নিজেকে বোকা-নির্বোধ বানিয়েছে, সে ব্যতীত ইব্রাহীম এর মিল্লাত (জীবন-বিধান) হতে আর কে বিমুখ হবে! দুনিয়াতে আমি তাকে (নবী ও রাসূল হিসেবে) মনোনীত করেছি ; আর আখিরাতেও সে হবে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত ।
(131) (স্মরণ করো) যখন তাঁর (ইবরাহীমের) রাব তাঁকে বলেছিলেন: ‘আত্মসমর্পণ করো।’ সে বলেছিলো: ‘আমি সৃষ্টিকুলের রাবের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।’
(132) আর ইবরাহীম ও ইয়া’কূব তাঁদের পূত্রদেরকে এরই (দীন ইসলামেরই ) নির্দেশ (১) দিয়ে বলেছিলো: ‘হে পুত্রগণ! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মারা যেয়ো না।’
(133) ইয়াকুবের যখন মৃত্যু এসেছিল তোমরা কি তখন (তাঁর পাশে) উপস্থিত ছিলে? তিনি যখন তাঁর সন্তানদের বলেছিলো: ‘আমার পরে তোমরা কার ‘ইবাদাত করবে?’ তারা জবাবে বলেছিলো: ‘আমরা আপনার ইলাহ (উপাস্য) ও আপনার পিতৃ-পুরুষ ইবরাহীম, ইসমা‘ঈল ও ইসহাকের ইলাহ - সেই এক ইলাহরই (উপাস্যেরই) ‘ইবাদাত করবো। আর আমরা তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।’
(134) সেটি ছিলো এমন এক উম্মাহ, যারা অতীত হয়ে গেছে। তারা যা অর্জন (‘আমল) করেছে তা তাদের-ই জন্যে। আর তোমরা যা অর্জন (‘আমল) করেছো তার প্রতিফল তোমাদের-ই। তারা যা (‘আমল) করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
(135) আর তারা (ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা) বলে: ‘তোমরা ইয়াহূদী অথবা খৃস্টান হয়ে যাও, তবেই সঠিক পথ (হিদায়াত) পাবে।’ (হে মুহাম্মাদ) তুমি বলো: ‘বরং একনিষ্ঠ হয়ে আমরা ইবরাহীমের মিল্লাত (জীবন-বিধান) অনুসরণ করব । আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।’
(136) (হে মুসলিমগণ) তোমরা বলো: ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং যা (আল- কুরআন) আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে, এবং যা ইবরাহীম, ইসমা’ঈল, ইসহাক, ইয়া’কূব ও তার বংশধরদের প্রতি নাযিল হয়েছে, এবং যা মূসা, ‘ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের রাবের নিকট হতে দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে কোন তারতম্য (পার্থক্য) করি না। আর আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।’
(137) অতএব তোমরা (মুসলিমরা) যেরূপ ঈমান এনেছো, তারাও যদি সেরূপ ঈমান আনে, তবে নিশ্চয় তারা হিদায়াত (সঠিক পথ) পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে অবশ্যই তারা বিরোধিতায় লিপ্ত। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।
(138) আল্লাহর রঙ (দীন ইসলাম) এ রঙিন হও। আর এমন কে আছে যার রঙ আল্লাহর রঙের চেয়ে অধিকতর সুন্দর? আর আমরা তাঁরই ‘ইবাদাতকারী।
(139) (হে নবী, তুমি তাদেরকে) বলো: 'আল্লাহ সম্পর্কে তোমরা কি আমাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? অথচ তিনি আমাদের রাব এবং তোমাদেরও রাব! আর আমাদের জন্য আমাদের ‘আমল এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের ‘আমলসমূহ। আর আমরা তাঁরই প্রতি একনিষ্ঠ।’
(140) নাকি তোমরা বলতে চাও যে, ‘অবশ্যই ইবরাহীম, ইসমা‘ঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণ ইয়াহূদী বা খৃস্টান ছিলো?’ (হে মুহাম্মাদ,) তুমি বলো: (এসব ব্যাপারে)‘তোমরা কি বেশি জানো, না আল্লাহ?’ আর তার চেয়ে বেশি যালিম আর কে হতে পারে, যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও সে তা গোপন করে? আর তোমরা যা করছো, তা থেকে আল্লাহ অমনোযোগী নন।
(141) তারা ছিলো এমন এক উম্মাহ, যারা আজ অতীত হয়ে গেছে। তারা যা অর্জন (‘আমল) করেছে তা তাদের-ই জন্যে। আর তোমরা যা অর্জন (‘আমল) করেছো তার প্রতিফল তোমাদের-ই। তারা যা (‘আমল) করতো সে বিষয়ে তোমাদেরকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
(142) অচিরেই মানুষের মধ্য হতে কিছু মূর্খ- নির্বোধরা (১) বলবে: কীসে তাদেরকে (মুসলিমদেরকে) তাদের কিবলা (বায়তুল মাকদা) থেকে ফিরিয়ে দিলো, যে কিবলার তারা এ যাবত অনুসরণ করে আসছিল? (হে মুহাম্মদ,) বলো: ‘পূর্ব ও পশ্চিম (ও অন্যান্য দিক)-এর মালিক আল্লাহ-ই। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সরল-সঠিক পথের হিদায়াত দান করেন।’
(143) আর এভাবে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী (১) উম্মাহ (জাতি) বানিয়েছি- যাতে তোমরা মানবজাতির উপর সাক্ষী হতে পার এবং (একইভাবে) রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারে। আর তুমি এ যাবত যে কিবলা অনুসরণ করছিলে সেটাকে আমি এ উদ্দেশ্যে কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করেছিলাম, যাতে আমি জানতে পারি যে, কে রাসূলের অনুসরণ করে, আর কে (তাঁর ধর্ম থেকে) পিছনে ফিরে যায়? নি:সন্দেহে আল্লাহ যাদেরকে হিদায়াত করেছেন তারা ব্যতীত অন্যদের ওপর এটা (পরিবর্তিত কিবলা মেনে নেয়া) বড় কঠিন বিষয় ছিলো। আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করে দিবেন।(২) নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।
(144) অবশ্যই আমি তোমার (কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ পাওয়ার আশায়) বারবার আকাশের দিকে তাকানোর বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। সুতরাং অবশ্যই আমি তোমাকে এমন কিবলার (কা‘বার) দিকে ফিরিয়ে দিবো, যা তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি (এখন থেকে সালাত আদায়ের জন্য) মাসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরাও। আর তোমরাও যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের চেহারাসমূহকে সেদিকে (মাসজিদুল হারামের দিকে) ফিরাও। আর নিশ্চয় যাদেরকে ইতঃপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছে, তারা অবশ্যই জানে যে, এটা তাদের রব-এর পক্ষ থেকে সত্য নির্দেশ। আর তারা যা করছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফিল (বেখবর) নন।
(145) আর যাদেরকে ইতঃপূর্বে (তাওরাত ও ইঞ্জীল) কিতাব দেয়া হয়েছে , তাদের কাছে আপনি যদি (কিবলা পরিবর্তনের) সমস্ত দলিল-প্রমাণও নিয়ে আসেন, তবুও তারা আপনার কিবলার (কা‘বার) অনুসরণ করবে না; আর (নতুন নির্দেশ আসার পর) আপনিও তাদের কিবলার অনুসরণ করতে পারেন না। আর তারাও পরস্পরের কিবলার অনুসরণ করে না। আর আপনার নিকট (কিবলা পরিবর্তন ও শরী‘আহর অন্যান্য বিধান সংক্রান্ত অহীর) সত্য-জ্ঞান আসার পরও যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেন, তাহলে নিশ্চয় আপনি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(146) আমি যাদেরকে (তাওরাত ও ইঞ্জীল) কিতাব দিয়েছি, তারা (ইয়াহুদি ও খৃস্টান পণ্ডিতরা) তাকে(১) এতটাই ভালো করে চিনে যেভাবে তারা নিজেদের সন্তানদেরকে চিনে। আর নিশ্চয় তাদের একদল জেনে-বুঝে সত্য গোপন করছে।
(147) (হে নবী (এ)) সত্য তোমার রব-এর কাছ থেকে এসেছে। কাজেই তুমি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হইও না।
(148) আর প্রত্যেকেরই (প্রত্যেক জাতি ও গোষ্ঠীরই) একটি দিক (কিবলা) রয়েছে, যে দিকে সে (ইবাদতে) চেহারা ফিরায়। অতএব (হে মুসলিমগণ!) তোমরা সৎকাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সবাইকেই (কিয়ামতের দিন) একত্রিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
(149) আর যে স্থান থেকেই তুমি (ও তোমার অনুসারীরা) যাত্রা কর না কেন,(অথবা তুমি যেখানে থাকো না কেন?) সেখান থেকেই (সালাত আদায়ের সময়) মসজিদুল হারামের দিকে তোমার চেহারা ফিরাও। নিশ্চয় এটা তোমার রব-এর কাছ থেকে (কিবলার বিষয়ে) পাঠানো সত্য। আর তোমরা যা করছো, সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফিল নন।
(150) আর যেখান থেকেই তুমি (ও তোমার অনুসারীরা) যাত্রা কর না কেন, সেখান থেকেই (সালাত আদায়ের সময়) মসজিদুল হারামের দিকে তোমার চেহারা ফিরাও এবং (হে মু’মিনগণ!) তোমরা যেখানেই থাকো না কেন এর (মসজিদুল হারামের) দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও; যাতে তাদের মধ্যে যালিম ছাড়া অন্যরা তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ দাঁড় করাতে না পারে। কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় করো। আর যাতে(১) আমি তোমাদের উপর আমার নি‘আমত পরিপূর্ণ করে দিতে পারি এবং যাতে তোমরা হিদায়াত লাভ করতে পারো।
(151) এমনিভাবে(১) আমি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদের কাছে আমাদের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং কিতাব (আল-কুরআন) ও হিকমাহ (সুন্নাহ) শিক্ষা দেয। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় সেসব বিষয় যা তোমরা জানতে না।
(152) কাজেই (এতসব অনুগ্রহের জন্য) তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে (ফিরিশতাদের সামনে) স্মরণ করবো। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।
(153) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা (আল্লাহর কাছে) ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
(154) (হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ,) যারা আল্লাহর পথে নিহত (শহীদ) হয় তাদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পারো না।
(155) আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করবো কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর তুমি ধৈর্যশীলদেরকে (ইহকাল ও পরকালের উত্তম বিনিময়ের) সুসংবাদ দাও।
(156) যারা বিপদ-মুসিবতে আক্রান্ত হলে বলে: ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি্ঊন (‘নিশ্চয় আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী)।
(157) এরা সেই সব লোক, যাদের প্রতি তাদের রব-এর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং অপার করুণা (রহমত) বর্ষিত হতে থাকে। আর তারাই (তাঁর পক্ষ থেকে) হিদায়াতপ্রাপ্ত।
(158) নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া ( পাহাড়দ্বয়) আল্লাহর নিদর্শনসমূহের (১) অন্তর্ভুক্ত। কাজেই যে কেউ (কা’বা) ঘরের হজ্জ বা “উমরা সম্পন্ন করবে, তার জন্য এ দু'টির মধ্যে সা‘ঈ (২) করলে কোন পাপ বা দোষ নেই। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন সৎকাজ করবে, (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহ উত্তম পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।
(159) নিশ্চয় যারা (১) গোপন করে (নবীর সত্যতার উপর) আমি যেসব সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও হিদায়াত নাযিল করেছি, মানুষের জন্য কিতাবে তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর। আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীগণও তাদেরকে অভিসম্পাদিত করেন।
(160) তবে যারা তাওবা করেছে (১), নিজেদেরকে সংশোধন করেছে এবং সত্যকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। আমি তাদের তাওবা কবুল করি। আর একমাত্র আমিই অধিক তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
(161) নিশ্চয়ই যারা কুফুরি করেছে (সত্যকে গোপন করার কাজ অব্যাহত রেখেছে) এবং কাফির অবস্থায় মারা গেছে, তাদের ওপর আল্লাহ, ফিরিশতাগণ এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত ।
(162) তারা তাতে (জাহান্নামে) চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। তাদের শাস্তি বিন্দুমাত্রও শিথিল করা হবে না এবং তাদেরকে কোন প্রকারের অবকাশও দেয়া হবে না।
(163) আর জেনে রাখো, তোমাদের সত্য ইলাহ ( উপাস্য) এক ও একক । তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু ।
(164) নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের আবর্তনে , মানুষের জন্য উপকারী পণ্যবাহী চলমান সামুদ্রিক জাহাজে এবং আল্লাহ আসমান থেকে যে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর তার মাধ্যমে মৃত ভূ-পৃষ্ঠকে পুনর্জীবিত করেছেন তার মধ্যে, তিনি যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী সেগুলোতে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে (ভেসে বেড়ানো) নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে বিবেকবান সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শনসমূহ।
(165) আর (এসব সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ থাকা সত্ত্বেও) মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহর ভালোবাসার মতোই। পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসে। আর যারা যুলম করেছে, তারা যদি (পরকালের) শাস্তি দেখতে পেতো, (তবে তারা নিশ্চিত হতো যে,) সমস্ত শক্তি একমাত্র আল্লাহরই। আর নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে অতি কঠোর।
(166) যখন (পথভ্রষ্ট) আনুগত্যলাভকারী নেতারা তাদের অনুসারী-আনুগত্যকারীদের থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে নিবে(১) এবং তারা সকলে (কিয়ামত দিবসের) শাস্তি দেখতে পাবে, আর তাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে,
(167) আর (পৃথিবীতে) যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে: ‘হায়! যদি (পৃথিবীতে) একবার আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ হতো, তবে আমরাও তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, যেমন তারা আমাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।’ এভাবে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী তদেরকে দেখাবেন, তাদের জন্য আক্ষেপস্বরূপ। আর তারা কখনোই জাহান্নামের আগুন থেকে বের হতে পারবে না।
(168) হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা খাও। আর তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্র।
(169) সে তো শুধু তোমাদেরকেমন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয় (১) । (সে আরও নির্দেশ দেয় যে,) তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব কথা বলো, যা তোমরা জানো না।
(170) আর যখন তাদেরকে (কাফিরদেরকে) বলা হয়: ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর।’ তখন তারা (হঠকারিতা দেখিয়ে) বলে: ‘না; বরং আমরা অনুসরণ করবো তার, যার ওপর আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে পেয়েছি।’ যদিও তাদের পিতৃ-পুরুষরা কিছু বুঝতো না এবং তারা সৎপথেও পরিচালিত ছিল না, তবুও কি তারা তাদেরই অনুসরণ করবে?
(171) আর যারা (বাপ-দাদার অনুসরণ করে) কুফরী করেছে, তাদের উদাহরণ সে রাখালের ন্যায়, যে তার চরানো পশুগুলোকে খুব চিৎকার করে ডাকছে; বস্তুত তারা তার হাঁক-ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনে না। আসলে তারা বধির, বোবা, অন্ধ। কাজেই তারা বুঝে না।
(172) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমাদেরকে আমি যেসব পবিত্র ও হালাল বস্তু রিযক দিয়েছি তোমরা তা থেকে খাও এবং (এসব নি‘আমতের জন্য) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ‘ইবাদাত করে থাকো।
(173) নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, (প্রবাহিত) রক্ত, শূকরের মাংস এবং যা আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারো নামে যবহ করা হয়েছে। কিন্তু যে কেউ নিরুপায় হয়ে খেতে বাধ্য হয় অথচ সে অবাধ্য এবং সীমালঙ্ঘনকারী নয়, (সে এ ধরনের কিছু খেলে) তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(174) আল্লাহ কিতাব হতে যা নাযিল করেছেন, যারা তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে (বৈষয়িক) তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ভরছে না। আর কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(175) এরাই তারা, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে। সুতরাং আগুন (এর আযাব) সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল!
(176) তা (শাস্তি) এই কারণে যে, আল্লাহ সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছেন। আর যারা কিতাব নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছে, অবশ্যই তারা চরম বিবাদে লিপ্ত রয়েছে (১)।
(177) পূর্ব ও পশ্চিমদিকে(১) তোমাদের মুখ ফিরানো সৎকর্ম নয়; কিন্তু সৎকর্ম হলো যে ব্যক্তি আল্লাহ, শেষ দিবস, ফিরিশতাগণ, কিতাবসমূহ ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনবে। আর সম্পদের প্রতি ভালোবাসা(২) (মোহ) থাকা সত্ত্বেও তা দান করবে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দিবে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করবে, অর্থ-সংকটে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করবে। মূলত (ঈমান ও ইসলামের দাবিতে) তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী।
(178) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর ‘কিসাস’ (হত্যার বিনিময়ে হত্যা) (১) ফরয করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তির, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাসের এবং নারীর বদলে (হত্যাকারী) নারীর মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। তবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা (২) প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার রক্ত-বিনিময় আদায় করা কর্তব্য। এটা তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে শিথিলতা (দণ্ড হ্রাস) ও অনুগ্রহ। সুতরাং এর পরও যে সীমালঙ্ঘন করে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(179) হে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন লোকেরা! তোমাদের জন্যে কিসাসের (বিধানের) মধ্যে রয়েছে জীবন (-এর নিরাপত্তা)।(১) আশা করা যায়, তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।
(180) তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সে যদি ধন-সম্পত্তি রেখে যায়, তবে প্রচলিত ন্যায়নীতি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য অসিয়াত করার বিধান তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ।(১) এটা মুত্তাকীদের জন্য অবশ্যই করনীয়।
(181) যদি কোন ব্যক্তি এটা (অসিয়াত) শোনার পরও (নিজ স্বার্থে) তাতে রদবদল করে, তবে যারা রদবদল করবে, এর পাপ তাদের উপরেই বর্তাবে ৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(182) তবে যদি কেউ অসিয়াতকারীর পক্ষ থেকে (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) পক্ষপাতিত্ব বা অন্যায়ের আশঙ্কা করে, অতঃপর সে (পুণ্যের আশায়) তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তাহলে তার কোন অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(183) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হলো, যেমন ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।
(184) এগুলো (ফরজ সাওম) নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্যে। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ রোগাক্রান্ত(১) হলে বা সফরে(২) থাকলে (এ কারণে যদি সে সাওম পালনে অক্ষম হয়), সে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করে নিবে। আর যাদের জন্য সিয়াম পালন অতি কষ্টসাধ্য(৩) হয়, তাদের কর্তব্য হলো এর পরিবর্তে ফিদ্ইয়া হিসেবে (প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে) একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। যদি কেউ স্বেচ্ছায় সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে।
(185) রামাদান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য হিদায়াত এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ (বিধান) চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।
(186) (হে নবী,)আর যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন তুমি তাদেরকে বলে দাও যে) নিশ্চয় আমি (তাদের) অতি নিকটে।(১)আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।
(187) (রামাদান মাসে) সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা নিজেরা নিজেদের প্রতি খিয়ানত (অবিচার ও প্রতারণা) করছিলে। সুতরাং তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এখন (চাইলে সাওমের রাতেও) তাদের সাথে মিলিত হতে পারো (সহবাস করতে পারো) এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা (সন্তান) কামনা করো। আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ না রাতের কালোরেখা থেকে উষার সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশ না হয়।(১) তারপর রাতের আগমন (সূর্যাস্ত) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো (সাওম সংক্রান্ত) আল্লাহর সীমারেখা। কাজেই (লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে) এগুলোর নিকটবতী হয়ো না। এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ (বিধি-বিধান) মানুষদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করন, যাতে তারা তাকওয়ার অধিকারী হতে পারে।
(188) আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে (১) ভক্ষণ করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের সামনে উত্থাপন করো না।
(189) লোকেরা তোমার কাছে নতুন চাঁদ (এবং এর অবস্থার পরিবর্তন) সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলো: ‘এটা (১) মানুষ এবং হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক।’ আর (হজ্জ ও উমরাহর ইহরামের সময় জাহিলী যুগের মতো) ঘরের পিছন দিক দিয়ে প্রবেশ করাতে কোন সাওয়াব (পুণ্য) নেই; বরং সাওয়াব তো রয়েছে ঐ ব্যক্তির জন্যে, যে তাকওয়া অবলম্বন করে। সুতরাং তোমরা (সামনের) দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।
(190) আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (জিহাদ) করো, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না।(১) নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালোবাসেন না।
(191) আর তোমরা তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে (১) এবং যে স্থান (মক্কা) থেকে তারা তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছে তোমরাও সে স্থান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করবে। আর ফিতনা ( কুফর, শিরক এবং ইসলাম থেকে বিরত রাখা) হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। আর মসজিদুল হারামের কাছে তোমরা তাদের সাথে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ করবে না, যে পর্যন্ত না তারা সেখানে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। তবে হ্যাঁ, তারা যদি (সেখানে) তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তবে (আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে) তোমরা তাদেরকে হত্যা করবে। কাফিরদের পরিণাম এমনই হয়।
(192) আর যদি তারা (ফিতনা-ফ্যাসাদ) থেকে বিরত থাকে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(193) আর তোমরা তাদের (কাফিরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা চুড়ান্তভাবে নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। অতঃপর যদি তারা (কুফর) থেকে বিরত থাকে, তবে যালিমরা (১) ছাড়া আর কারও উপর সীমালঙ্ঘন করা যাবে না।
(194) পবিত্র মাস পবিত্র মাসের বিনিময়ে।(১) যার পবিত্রতা অলঙ্ঘনীয় ।পবিত্র বিষয়সমূহ অবমাননার বিধান হলো কিসাস। কাজেই যে কেউ হারাম মাসসমূহে তোমাদেরকে আক্রমণ করবে, তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করো এবং তোমরা আল্লাহ্র তাকওয়া অবলম্বন করো। আর জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন।
(195) আর তোমরা আল্লাহর পথে (১) ব্যয় করো এবং নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না। আর তোমরা ইহসান (সৎকাজ) করো। নিশ্চয় আল্লাহ মুহসীনদের (সৎকর্মশীলদেরকে) ভালোবাসেন।
(196) আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে যথাযথভাবে হজ্জ ও ‘উমরা পালন (সম্পন্ন) করো। তবে যদি তোমরা (হজ্জ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে কোথাও কোনভাবে) বাঁধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে সহজলভ্য হাদী (প্রাণী যথা উট, গরু ও ছাগল (১) প্রদান কুরবানি করো (এবং হালাল হয়ে যাও)। আর তোমরা মাথা মুণ্ডন করো না; যে পর্যন্ত হাদী তার স্থানে না পৌঁছে। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হয় বা মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় ( যথা উকুন, খুশকি ইত্যাদি এবং এ কারণে মাথা মুণ্ডন করে ফেলে) , তবে সিয়াম বা সাদাকা বা কুরবানী দ্বারা তার ফিদিয়া দিবে। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে, তখন তোমাদের মধ্যে যে হজ্জের পূর্বে উমরা (তামাত্তু হজ) করতে চায়, তবে সে যেন সহজলভ্য হাদী যবহ করে। কিন্তু সে যদি হাদী যবহ করতে না পারে, তবে তাকে হজ্জের সময় তিনদিন এবং হজ্জ থেকে ঘরে ফেরার পর সাতদিন- এ পূর্ণ দশ দিন সিয়াম পালন করতে হবে। এটা তাদের জন্য, যাদের পরিবার পরিজন মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।
(197) হজ্জের সময় নির্দিষ্ট (১) মাসসমূহ। অতএব যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ্জ করা স্থির করল, তার জন্য হজ্জের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করা বৈধ নয়। আর তোমরা উত্তম কাজ থেকে যা-ই করো আল্লাহ্ তা জানেন। আর তোমরা পাথেয় (২) সংগ্রহ করো। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ ! তোমরা আমাকে ভয় করো।
(198) তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোনো পাপ নেই। (১) সুতরাং যখন তোমরা ‘আরাফাত হতে ফিরে আসবে তখন (পথিমধ্যে) মাশ’আরুল হারামের কাছে পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করো (২) এবং তিনি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করো। যদিও ইতঃপূর্বে তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।
(199) তারপর অন্যান্য লোকেরা (হজ্জ পালনকারীরা) যে স্থান (‘আরাফাহ) থেকে ফিরে আসে তোমরাও সে স্থান থেকে ফিরে আসো। আর (নিজেদের ভুল-ভ্রান্তির জন্যে) আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(200) অতঃপর যখন তোমরা হজ্জের কাজসমূহ (আনুষ্ঠানিকতা) সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যেভাবে স্মরণ করতে তোমাদের পিতৃ পুরুষদের অথবা তার চেয়েও অধিক স্মরণ। মানুষের মধ্যে যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতেই (আমাদের প্রাপ্য কল্যাণ) দিন।’ এ ধরনের লোকদের জন্যে আখিরাতে কোনো অংশ নেই।
(201) আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ (১) দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।
(202) এরাই হলো সে সব (উত্তম) মানুষ, যাদের জন্যে তাদের উপার্জনের ভিত্তিতে (উভয় জাহানেই) যথাযথ প্রাপ্য রয়েছে। আর আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।
(203) আর তোমরা (হজ্জের) নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করো।(১) অতঃপর কেউ যদি তাড়াতাড়ি করে (মিনা থেকে মক্কায়) দুই দিনে (২) চলে আসে, তবে তার কোনো পাপ নেই।আর যে ব্যক্তি বিলম্ব (৩) করে আসে তারও কোনো পাপ নেই। এ (বিধান) তার জন্য (যে হজ্জের কার্যাদি সম্পাদনে) তাক্ওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা আল্লাহ্র তাকওয়া অবলম্বন করো এবং জেনে রাখো, একদিন তোমাদেরকে তাঁরই নিকট সমবেত করা হবে।
(204) আর মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি (মুনাফিক) আছে, পার্থিব জীবনে যার কথাবার্তা তোমাকে অভিভুত করে। আর (কথা বলার সময়) নিজের অন্তরে যা কিছু আছে (ঈমান ও কল্যাণ) সে ব্যাপারে বারবার আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ ঝগড়াটে (চরম শত্রু)।
(205) আর যখন সে আপনার কাছ থেকে প্রস্থান করে তখন সে জমিনে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণীকুল ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ ফ্যাসাদ (বিপর্যয়) পছন্দ করেন না।
(206) আর যখন তাকে (নসীহত করে) বলা হয়, ‘আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো’, তখন তার অহংকার বোধ ও আত্মাভিমান তাকে পাপাচারে লিপ্ত করে। কাজেই জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই তা কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল।
(207) আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেদের জান-প্রাণ বিক্রিয় করে দেয়।(১) আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল।
(208) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা পুর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে প্রবেশ করো (১) এবং শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্ৰ।
(209) অতঃপর তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি (কুরআন ও সুন্নাহ) আসার পরও যদি তোমাদের পদস্খলন ঘটে, তবে জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(210) (যারা স্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পরও শয়তানের অনুসরণ করছে) তারা কি শুধু এর প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আল্লাহ ফিরিশতাদের সাথে নিয়ে মেঘমালার ছায়ায় তাদের কাছে স্বয়ং উপস্থিত হবেন?(১) এবং সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে। আর সমস্ত বিষয় আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে।
(211) (হে নবী, তুমি) বানূ ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস করো, আমি (রাসূলগণের সত্যতা প্রমাণে) তাদেরকে কত সুস্পষ্ট নিদর্শন প্রদান করেছি! আর আল্লাহর নি‘আমত আসার পর যে (জাতি) সেটাকে পরিবর্তন করে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দানে কঠোর।
(212) যারা কুফুরী করে তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন সুশোভিত করা হয়েছে এবং তারা মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে থাকে। অথচ যারা তাকওয়া অবলম্বন করে কিয়ামতের দিন তারাই এদের মোকাবেলায় উঁচু ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করবে।(১) আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে অগণিত রিযিক দান করেন।
(213) (একটা সময়ে) সমস্ত মানুষ একই উম্মত ছিল ।(১) অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন এবং তাদের সাথে সত্যবাহী কিতাবও নাযিল করেন, যাতে মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করতো তা (কিতাব) সেগুলোর মীমাংসা করতে পারে। আর যাদেরকে তা (তাওরাত) দেয়া হয়েছিল, সুস্পষ্ট নিদর্শন তাদের কাছে আসার পরেও শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত সে বিষয়ে (২) তারা বিরোধিতা করতো। অতঃপর আল্লাহ তাঁর ইচ্ছাক্রমে ঈমানদারদেরকে হিদায়াত দান করেছেন সে সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিলো। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে সরল পথের দিকে হিদায়াত দান করেন।
(214) (হে মু’মিনগণ) তোমরা কী মনে করো যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে; অথচ এখনও তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো অবস্থা আসেনি? অর্থসংকট, দুঃখ-ক্লেশ ও রোগ- ব্যাধি তাদেরকে স্পর্শ করেছিলো এবং তারা ভীত-প্রকম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তাঁর ঈমানদার সাথীগণ (দ্রুত আল্লাহর সাহায্য পেতে) বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে’? জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।
(215) হে নবী! তোমার সাথীরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করছে, তারা কি ব্যয় করবে? বলো, তোমরা উত্তম যা কিছুই ব্যয় করবে, তা করো পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম- মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্যে। মনে রেখো, উত্তম কাজের যা কিছুই তোমরা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।
(216) (হে মুমিনগণ) তোমাদের ওপর আল্লাহর পথে যুদ্ধ (জিহাদ) করাকে ফরয করা হয়েছে; যদিও তোমাদের নিকট এটা অপ্রিয় বস্তু(১)। বস্তুত তোমরা যা অপছন্দ করছো (যেমন: জিহাদ), হতে পারে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর (২) । পক্ষান্তরে তোমরা যা ভালোবাস (যেমন: জিহাদ না করে ঘরে বসে থাকা), হতে পারে তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর (কিসে কল্যাণ এবং কিসে অকল্যাণ) আল্লাহ্ই ভাল জানেন, তোমরা তা জান না।
(217) (হে নবী) পবিত্র মাসে (১) যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকেরা (মুশরিক ও কাফিররা) আপনাকে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, ‘এতে যুদ্ধ করা ভয়ানক অপরাধ। কিন্তু আল্লাহর পথে (চলতে) বাঁধা দান করা, তাঁর সাথে কুফরী করা, (মুমিনদেরকে) মসজিদুল হারামে (প্রবেশ করতে) বাঁধা দেয়া ও এর বাসিন্দাকে এর থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকট তার চেয়েও (২) বেশী ভয়ানক অপরাধ। আর ফিতনা হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। আর তারা নিরন্তর তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যে পর্যন্ত না তোমাদেরকে তোমাদের দীন থেকে ফিরিয়ে নিতে পারে, যদি তারা সক্ষম হয়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ নিজের দীন থেকে ফিরে যাবে(৩) এবং কাফির হয়ে মারা যাবে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর এরাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।
(218) নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করতে পারে। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(219) (হে নবী) লোকেরা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, এ ‘দু’টোর মধ্যেই রয়েছে মহাপাপ (১) এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও।(২) আর এ দু’টোর পাপ উপকারের চেয়ে অনেক বড়’। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, (আল্লাহর পথে) তারা কী ব্যয় করবে? বলো, যা উদ্বৃত্ত(৩)। এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা চিন্তা ভাবনা করো।
(220) (এ নির্দেশ তোমাদের) দুনিয়া ও আখিরাতের (কল্যাণের) জন্যেই। আর লোকেরা তোমাকে ইয়াতীমদের (পৃষ্ঠপোষকতা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, ‘তাদের জন্য সুব্যবস্থা করাই উত্তম’।(১) তোমরা যদি তাদের সাথে একত্রে থাকো, তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ জানেন কে উপকারকারী এবং কে অনিষ্টকারী। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে এ বিষয়ে তোমাদেরকে অবশ্যই কষ্টে ফেলতে পারতেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(221) (হে মু’মিনগণ) তোমরা মুশরিক নারীকে ঈমান না আনা পর্যন্ত বিবাহ করো না। (স্বাধীন) মুশরিক নারী তোমাদেরকে (সৌন্দর্যে ও সম্পদে) মুগ্ধ করলেও, অবশ্যই মুমিন কৃতদাসী তার চেয়ে উত্তম। তেমনিভাবে ঈমান না আনা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমরা (স্বাধীন কিংবা কৃতদাসী) মুসলিম মেয়েদেরকে বিবাহ দিও না। মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও অবশ্যই মুমিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম। তারা তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে; অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ ইচ্ছায় ও অনুগ্রহে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন। আর তিনি মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
(222) (হে নবী) তারা তোমাকে হায়িয (নারীদের মাসিক ঋতুস্রাব ও এসময়ে তাদের সাথে দৈহিক মিলন) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, (নারীদের) এ সময়টা হচ্ছে একটা (অপবিত্র ও) কষ্টকর অবস্থা‘। কাজেই তোমরা ঋতুস্রাবের সময় স্ত্রী-সঙ্গম থেকে বিরত থাকো এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত (সঙ্গমের জন্যে) তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। তারপর তারা যখন (হায়িয শেষে ) উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হবে (গোসল করে পবিত্র হবে), তখন তাদের নিকট ঠিক সেভাবে গমন করবে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন।(১) নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং তাদেরকেও ভালোবাসেন যারা পাক-পবিত্রতা অবলম্বন করে।
(223) তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র (সন্তান প্রসবকারিণী)। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে (হালাল পন্থায়) যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পারো। আর তোমরা (সময় থাকতে) নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু (নেক আমল) পাঠিয়ে রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো। জেনে রেখো, তোমরা অবশ্যই আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে। আর (হে নবী আপনি) মুমিনদেরকে (তাদের রবের সাক্ষাৎ ও পুরস্কারের) সুসংবাদ দিন।
(224) আর (হে মুসলিমগণ) তোমরা সৎকাজ, তাকওয়া অবলম্বন এবং মানুষের মাঝে সন্ধি-সমঝোতা স্থাপন থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহর নামের শপথকে অজুহাত ও প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড় করো না।(১) আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(225) তোমাদের (অনিচ্ছাকৃত) অনর্থক শপথের জন্যে আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না;(১) কিন্তু তিনি সেসব শপথের ব্যাপারে পাকড়াও করবেন, যেগুলোর ব্যাপারে তোমাদের অন্তরসমূহ সংকল্পবদ্ধ ছিল। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম ধৈর্যশীল।
(226) যারা নিজ স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রাখবে না (সহবাস করবে না) বলে শপথ করে, তাদের অবকাশ চার মাস। (এর মধ্যে শপথ ভঙ্গ করে) যদি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় (এবং সহবাস করে), তবে (জেনে রাখো) নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(227) আর যদি তারা তালাক দেয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়(১), তবে (তারা জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(228) আর তালাকপ্রাপ্তা নারীগণ তিন ঋতুস্রাব (১) অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত (পুনরায় বিয়ের বন্ধন থেকে) বিরত থাকবে। আর তারা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমান রাখলে (এ সময়) তাদের গর্ভাশয়ে আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তা গোপন রাখা তাদের পক্ষে হালাল নয়। আর যদি তারা (ইদ্দত চলাকালীন সময়ে) আপোশ-নিষ্পত্তি করতে চায় (ফিরিয়ে নিতে চায়), তবে এতে তাদের পুনঃ গ্রহণে তাদের স্বামীরাই বেশি অধিকার রাখে। আর (অধিকার ও দায়িত্বের বিবেচনায়) নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের অধিকার। আর (২) নারীদের উপর পুরুষদের একটি আলাদা মর্যাদা আছে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(229) তালাক দু’বার।(১) অতঃপর (দু’ তালাক শেষে স্ত্রীকে) হয় বিধিমতো রেখে দিবে, নতুবা সদয়ভাবে চলে যেতে দিবে। আর তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে যা (মোহরানা ও অন্যান্য হাদিয়া) প্রদান করেছ তা থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করা তোমাদের পক্ষে হালাল নয়। অবশ্য যদি তাদের উভয়ের আশঙ্কা হয় যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না (তাহলে উভয়ের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই উত্তম)। তারপর (তারা যদি মীমাংসার জন্য বসে ) তোমরাও আশঙ্কা করো যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না, তবে স্ত্রী কোনো কিছুর বিনিময়ে বিচ্ছেদ পেতে চাইলে তাতে তাদের কারো কোনো অপরাধ নেই। এ সব আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যারা আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে তারাই যালিম।
(230) অতএব স্বামী যদি তার স্ত্রীকে (তৃতীয় বার) তালাক দেয় তাহলে ঐ স্ত্রী স্বামীর জন্য ততক্ষণ হালাল হবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্ন একজন স্বামী সে গ্রহণ না করে (এবং তারা সহবাস না করে )। অতঃপর সে (দ্বিতীয় স্বামী) যদি তালাক (১) দেয়, আর তারা উভয়ে (স্ত্রী ও প্রথম স্বামী) মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করতে পারবে, তবে তাদের পুনঃবিয়েতে কারো কোনো অপরাধ হবে না। আর এটা আল্লাহর সীমারেখা, তিনি তা বিবেকবান সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করেন ।
(231) আর যখন তোমরা স্ত্রীকে (এক বা দুই) তালাক দাও, অতঃপর তারা ‘ইদ্দত পূর্তির নিকটবর্তী হয়, তখন তোমরা হয় বিধি অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দিবে অথবা ন্যায়সংগতভাবে বিদায় করে দিবে।(১) তাদের ক্ষতি করে সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আটকে রেখো না। আর যে তা করে, সে নিজের প্রতি যুলম করে। আর তোমরা আল্লাহর বিধানকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের বস্তু করো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নি‘আমত এবং কিতাব ও হিকমত যা তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন, যা দ্বারা তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, তা স্মরণ করো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
(232) আর তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে (তিন তালাকের কম) তালাক দাও এবং তারা তাদের ‘ইদ্দতকাল পূর্ণ করে, তারপর তারা যদি ন্যায়সংগত পদ্ধতিতে পরম্পর সম্মত হয়, তবে স্ত্রীরা নিজেদের (পূর্বের) স্বামীদের (পুনরায়) বিয়ে করতে চাইলে তোমরা (অভিভাবকরা) তাদেরকে বাধা দিও না। এ দ্বারা তাকেই উপদেশ দেয়া হচ্ছে যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান রাখে। এটাই তোমাদের জন্য বিশুদ্ধ ও পবিত্রতম পন্থা। আর আল্লাহ (সকল বস্তুর মূল রহস্য ও পরিণতি সম্পর্কে) জানেন; অথচ তোমরা তা জানো না।
(233) আর মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে, এটা সে ব্যক্তির (পিতার) জন্য, যে (সন্তানের) দুধ পানের মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। শিশুর পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের (মাতাদের সম্মানজনক) ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।(ভরণ-পোষণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে গিয়ে) কারো উপর যেন তার সাধ্যাতীত ভার চাপিয়ে দেওয়া না হয়। কোনো মাতাকে তার সন্তানের জন্য এবং পিতাকেও তার সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা ও কষ্ট দেওয়া যাবে না। আর (বাচ্চার পিতার অবর্তমানে ) উত্তরাধিকারীরও রয়েছে (পিতার) অনুরূপ দায়িত্ব-কর্তব্য। কিন্তু যদি তারা (মাতা-পিতা) পরস্পরের সম্মতি ও পরামর্শক্রমে দুধ পান বন্ধ রাখতে চায়, তবে তাদের কারো কোনো অপরাধ নেই। আর যদি তোমরা (কোনো ধাত্রী দ্বারা) তোমাদের সন্তানদেরকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলে যদি তোমরা প্রচলিত বিধি মোতাবেক তাদেরকে বিনিময় দিয়ে দাও, তবে তোমাদের কোনো পাপ নেই। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করো নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষকারী।
(234) আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মারা যায়, তারা (বিধবাগণ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে) নিজেরা চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় থাকবে (ইদ্দত পালন করবে)। অতঃপর যখন তারা তাদের ‘ইদ্দতকাল পূর্ণ করবে, তখন যথাবিধি নিজেদের জন্য (বিয়ে করা বা না করা) যে সিদ্ধান্ত নিবে তাতে তোমাদের কোনো পাপ (দায়-দায়িত্ত ) নেই। আর তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক খবর রাখেন।
(235) আর যদি তোমরা ইশারা-ইঙ্গিতে (বায়িন তালাক ও মৃত্যুর ইদ্দত পালনকারী) নারীদের বিয়ের প্রস্তাব দাও বা তোমাদের অন্তরে গোপন রাখো, তবে তোমাদের কোনো পাপ নেই। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তাদের সম্বন্ধে (বিয়ের ব্যাপারে) অবশ্যই আলোচনা করবে; কিন্তু বিধিমত কথাবার্তা ছাড়া (ইদ্দত চলাকালীন) গোপনে তাদের সাথে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখো না; এবং নির্দিষ্ট কাল (ইদ্দত) পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করো না। আর জেনে রাখো , নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে, তা জানেন। কাজেই তাঁকে ভয় করো। আর একথাও জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম সহনশীল।
(236) যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ (সহবাস) না করে অথবা মাহর নির্ধারণ না করেই তালাক দাও, তবে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই। কিন্তু (এ পরিস্থিতিতে) তোমরা তাদেরকে ন্যায়ানুগ পন্থায় কিছু অর্থ-সামগ্রী দিবে। সচ্ছল ব্যক্তি দিবে তার (আর্থিক) স্বচ্ছলতা অনুযায়ী এবং অসচ্ছল ব্যক্তি দিবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী। এটা মুহসিন সৎকর্মশীল লোকদের ওপর কর্তব্য।
(237) আর তোমরা যদি তাদেরকে স্পর্শ (সহবাস) করার আগে তালাক দাও; অথচ তাদের জন্য মাহর ধার্য করে থাকো, তাহলে যা তোমরা ধার্য করেছ তার অর্ধেক (দিয়ে দাও)। তবে তারা (সদ্য তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীগণ) যদি (অর্ধেক মাহর) না নিয়ে (স্বামীকে) ক্ষমা করে দেয় অথবা যার হাতে বিয়ের বন্ধন রয়েছে (১) সে (স্বামী পূর্ণ মাহর দিয়ে যদি ) অনুগ্রহ করতে চায় (সেটা ভিন্ন কথা)। তবে মাফ করে দেয়াই তাকওয়ার নিকটতর। আর তোমরা নিজেদের মধ্যে অনুগ্রহের কথা ভুলে যেও না। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
(238) তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও (১) বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের (২) এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে।
(239) কিন্তু যদি তোমরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকো, তবে পদচারী বা আরোহী অবস্থায় (সালাত আদায় করে নাও)। অতঃপর যখন নিরাপদ হবে তখন আল্লাহর স্মরণ (সালাত আদায়) করো সেভাবে, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিখিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।
(240) আর তোমাদের মধ্যে যারা নিজের মৃত্যু আসন্ন অনুভব করবে এবং স্ত্রীদেরকে রেখে যাবে, তারা যেন তাদের স্ত্রীদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের না করে তাদের এক বছরের ভরণ-পোষণের অসিয়াত (ওয়ারিশদেরকে) করে যায়।(১) কিন্তু তারা যদি (এক বছরের পূর্বে) নিজেরাই বের হয়ে যায়, তবে বিধিমত তারা নিজেদের জন্য যা করবে তাতে তোমাদের (উত্তরাধিকারদের) কোনো পাপ নেই। আর আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(241) আর তালাকপ্রাপ্তা নারীদের ন্যায়সংগত ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা মুত্তাকীদের কর্তব্য।
(242) এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।
(243) (হে নবী) তুমি কি তাদের (১) (পরিণতি) দেখো নি যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় আবাসাভুমি পরিত্যাগ করেছিল? অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে বলেছিলেন: ‘তোমরা মরে যাও।’ (তারা আল্লাহর নির্দেশে মারা গেল।) তারপর আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
(244) আর (হে ’মুমিনগণ) তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো এবং জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(245) তোমাদের মধ্যে কে আছে যে আল্লাহকে করযে হাসানা (উত্তম ঋণ) প্রদান করবে? ফলে তিনি তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে (তাকে ফেরত) দিবেন। আর আল্লাহ (তাঁর কৌশল ও ইনসাফের ভিত্তিতে রিযিক) সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁর দিকেই তোমাদেরকে (ধনী-গরীব সবাইকে) প্রত্যাবর্তিত করা হবে।(১)
(246) (হে নবী) তুমি কি মুসার পরবর্তী বনী ইসরাইল নেতাদের দেখনি? তারা যখন তাদের নবীকে বলেছিল: ‘আমাদের জন্য একজন বাদশাহ নিযুক্ত করুন, যাতে আমরা ( তাঁর নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি।’ তিনি বললেন: ‘এমন তো হবে না যে, তোমাদের প্রতি যুদ্ধ ফরয করলে তখন তোমরা আর যুদ্ধ করবে না?’ তারা বলল: ‘কেন আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করব না? অথচ আমাদেরকে আমাদের আবাসভূমি ও স্বীয় সন্তান-সন্ততি হতে বহিষ্কার করা হয়েছে।’ অতঃপর যখন তাদের প্রতি যুদ্ধ ফরয করা হলো, তখন তাদের কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া সবাই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলো। আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞানী।
(247) আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল: (তোমাদের দাবি অনুযায়ী) ‘আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্যে বাদশাহ করে পাঠিয়েছেন।’ তারা বললো: ‘আমাদের উপর তাঁর রাজত্ব কিভাবে হবে? অথচ আমরা তো তাঁর চেয়ে রাজত্ব লাভের বেশি হকদার। তাছাড়া তাকে প্রচুর ঐশ্বর্যও দেয়া হয়নি!’ তিনি (নবী) বলল: ‘আল্লাহ অবশ্যই তাঁকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাঁকে জ্ঞানে ও দৈহিকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।’ আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।
(248) আর তাদের নবী তাদেরকে আরো বলেছিল: তার রাজত্বের নিদর্শন হলো: ‘তিনি তোমাদের নিকট সেই তাবূত (হারানো সিন্ধুক) ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন, যাতে রয়েছে তোমাদের রবের নিকট হতে প্রশান্তি, আরও রয়েছে মুসা ও হারুন এর পরিবারের পরিত্যক্ত কিছু (বরকতময়) জিনিসপত্র।(১) ফিরিশতাগণ তা বহন করে আনবে। তোমরা যদি মু’মিন হও, তবে নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।
(249) তারপর তালূত যখন সেনাবাহিনীসহ বের হল তখন সে বলল, ‘আল্লাহ এক নদী-(র পানি) দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন।(১) যে তা থেকে পানি পান করবে (পিপাসা নিবারণ করবে ), সে আমাদের দলভুক্ত নয়; আর যে তার স্বাদ গ্রহণ করবে না সে আমার দলভুক্ত। তবে যে ব্যক্তি (বাধ্য হয়ে) তার হাতে এক অঞ্জলি পরিমাণ পানি গ্রহণ করবে তার কথা ভিন্ন।’ অতঃপর অল্প সংখ্যক ছাড়া তারা তা থেকে পানি পান করল। সে এবং তার সঙ্গী ঈমানদারগণ যখন তা অতিক্রম করল, তখন তারা বলল: ‘জালূত ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো শক্তি আজ আমাদের নেই। কিন্তু যাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সাথে তাদের (একদিন) সাক্ষাৎ হবে, তারা বলল: ‘(আমরা সংখ্যায় নগণ্য তাতে কি? ইতিহাসে এমন বহুবার দেখা গেছে যে,) আল্লাহর হুকুমে (ও তাঁর সাহায্যে) কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাজিত করেছে!’ আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই রয়েছেন।
(250) আর তারা যখন যুদ্ধের জন্যে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হলো তখন তারা (আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে) বললো: ‘হে আমাদের রব! আমাদের (অন্তরের) উপর ধৈর্য ঢেলে দিন, (যুদ্ধের মাঠে) আমাদের পা অবিচলিত রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।’
(251) অতঃপর তারা (তালূতের বাহিনী ) আল্লাহর হুকুমে (ও সাহায্যে) তাদেরকে (জালূতের বাহিনীকে) পরাজিত করলো এবং দাঊদ (তাদের সেনাপতি) জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ তাঁকে রাজত্ব ও হিকমত (নবুওয়াত) দান করলেন এবং তিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে (অনেক কিছু ) শিক্ষা দিলেন। আর আল্লাহ যদি মানুষের এক দলকে অন্য দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর উপর অত্যন্ত দয়াশীল।
(252) (হে নবী! কিতাবে উল্লিখিত) এগুলো সবই আল্লাহর আয়াত (বাণী), যা আমি তোমার নিকট যথাযথভাবে তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছি। আর অবশ্যই তুমি আমার পাঠানো (নবী) রাসুলগণের একজন।
(253) সেইসব রাসুল, আমি তাদের কাউকে কারো উপর (ওহী, ও আনুগত্যে মর্যাদার ক্ষেত্রে) শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছেন যার সাথে আল্লাহ স্বয়ং কথা বলেছেন(১), আবার কাউকে তিনি উঁচু মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।(২) আর মারইয়াম পুত্র ‘ঈসাকে আমি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি (৩) প্রদান করেছি এবং রুহুল কুদুস (জিবরাঈল) দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে তাদের পরবর্তীরা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পরও পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না; কিন্তু তারা মতভেদ করলো।(৪) ফলে তাদের কেউ কেউ ঈমান আনল এবং কেউ কেউ কুফরী করলো। আর আল্লাহ চাইলে তারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না; কিন্তু আল্লাহ (তাঁর ইনসাফ ও হিকমতের ভিত্তিতে) যা ইচ্ছা তা-ই করেন।
(254) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! আমি তোমাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে তোমরা (আমার পথে) ব্যয় করো, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন ক্রয়-বিক্রয় (লেনদেন), বন্ধুত্ব ও সুপারিশ (কিছুয়ই ) থাকবে না। আর কাফিররাই হলো যালিম।
(255) আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব (চির অবিনশ্বর, তাঁর কোন মৃত্যু নেই), সর্বসত্তার রক্ষণাবেক্ষণকারী, ধারক(১)। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না, নিদ্রাও না। আসমানসমূহে যা রয়েছে ও যমিনে যা রয়েছে সবই তাঁর (মালিকানাধীন)। এমন কে আছে , যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে ? তাদের সামনে ও পেছনে (ভবিষ্যতে ও অতীতে) যা কিছু আছে, তিনি তা সবই জানেন। আর তিনি যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কোনো কিছুকেই (সৃষ্টিকুল) আয়ত্ত্ব করতে পারে না। তাঁর ‘কুরসী’(২) আসমানসমূহ ও যমিনকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। আর এ দুটোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত করে না। আর তিনি সুউচ্চ সুমহান।
(256) দীন (ইসলাম) গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। (কারণ) ভ্রান্ত পথ থেকে সত্য-সঠিক পথ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। অতএব, যে তাগূতকে(১) অস্বীকার করবে ও আল্লাহর উপর ঈমান আনবে, সে এমন এক শক্তিশালী রশি ধরলো, যা কখনো ছিঁড়ে যাবে না। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।
(257) আল্লাহ যারা ঈমান এনেছে তাদের অভিভাবক।(১) তিনি তাদেরকে (কুফরী ও মূর্খতার) অন্ধকার থেকে বের করে (ঈমান ও ‘ইলমের) আলোতে নিয়ে আসেন। অপরদিকে, যারা কুফরী করে, তাদের অভিভাবক হলো তাগূত (মূর্তি, সমকক্ষ ও অংশীদারগণ)। এরা তাদেরকে (ঈমান ও জ্ঞানের) আলো থেকে (কুফরি ও মূর্খতার) অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।
(258) (হে নবী) তুমি কি সে ব্যক্তির অবস্থা লক্ষ্য করোনি, যে ইবরাহীমের সাথে তাঁর রবের (রুবুবিয়্যাত ও একত্ববাদ) সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলো। যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন। যখন ইবরাহীম বললো: ‘আমার রব তিনিই, যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। সে বললো: ‘আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই।(১) ইবরাহীম বললো: ‘নিশ্চয়ই (আমার) আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন। সুতরাং তুমি পারলে সেটাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও তো। এ কথা শুনে কাফিরটি হতভম্ব হয়ে গেলো। আসলে আল্লাহ যালিম সম্প্রয়ায়কে হিদায়াত করেন না।
(259) অথবা (হে রাসূল তুমি) সে ব্যক্তির বিষয়টি কি লক্ষ্য করোনি, যে এমন এক জনপদ অতিক্রম করেছিল, যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়েছিলো। সে (আশ্চর্য হয়ে) বলল: ‘মৃত্যুর পর কীভাবে আল্লাহ এ জনপদের অধিবাসীদেরকে জীবিত করবেন? তারপর আল্লাহ তাকে শত বছর মৃত রাখলেন। অতঃপর তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ্ বললেন: ‘(বলো তো) তুমি কত বছর মৃত অবস্থায় ছিলে?’ সে বললো: ‘একদিন বা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি।’ তিনি বললেন: ‘বরং তুমি (মৃত অবস্থায়) একশত বছর অবস্থান করেছো। সুতরাং তুমি তোমার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর দিকে লক্ষ্য করো, সেগুলো পরিবর্তন হয়নি(১) এবং লক্ষ্য করো তোমার (মৃত) গাধাটির দিকে। আর (আমি এটি এ জন্যে করেছি) যাতে আমি তোমাকে মানুষের পুনর্জীবন সম্পর্কে নিদর্শন বানাতে পারি। আর (গাধার) হাড়গুলোর দিকে লক্ষ্য করো; কীভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই।’ অতঃপর যখন তার নিকট স্পষ্ট হলো তখন সে বললো: ‘আমি জানি নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’
(260) (হে নবী! তুমি স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম বললো: ‘হে আমার রব! কীভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন, সেটা আমাকে দেখান? তিনি বললেন: ‘তবে তুমি কি এ ব্যাপারটিকে বিশ্বাস করো না?’ সে বলল: ‘অবশ্যই হ্যাঁ; কিন্তু (তা বাস্তবে দেখতে চাই) আমার মনের প্রশান্তি অর্জনের জন্যে।’ আল্লাহ বললেন: ‘তবে চারটি পাখি নাও এবং তাদেরকে তোমার কাছে রেখে বশীভূত কর। তারপর (সেগুলোকে যবহ করে টুকরো টুকরো করে) এক একটি টুকরো এক এক পাহাড়ে রেখে আস। তারপর সেগুলোকে (নাম ধরে) ডাক। (দেখবে) সেগুলো তোমার নিকট দ্রুত দৌড়ে আসবে। আর (হে ইব্রাহীম) জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(261) যারা নিজেদের ধন সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি (শষ্য) বীজের মতো, যা সাতটি শিষ উৎপাদন করে। প্রত্যেক শিষে রয়েছে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে (এমনিভাবে) বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ মহা প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।
(262) যারা (আল্লাহর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির কাজে) আল্লাহর রাস্তায় তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর তারা যা ব্যয় করেছে, তার জন্যে খোঁটা দেয় না(১) এবং কোন কষ্টও দেয় না। তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট প্রতিদান এবং তাদের কোন ভয় নেই, আর তারা চিন্তিতও হবে না।
(263) উত্তম কথা ও ক্ষমা প্রদর্শন সে দানের চেয়ে অনেক ভালো, যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয়(১)। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, সহনশীল।
(264) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! সাদাকা করে (গ্রহীতাকে) খোটা এবং কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের সাদাকাকে ঐ ব্যক্তির মতো বরবাদ করো না যে নিজের সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে না। এ ধরনের সাদাকাকারীর উপমা হলো এমন একটি মসৃণ পাথর, যার উপর সামান্য মাটির আস্তর থাকে, তারপর প্রবল বৃষ্টিপাত সেটাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়। তারা যা (দান সাদাকা করে) উপার্জন করে তার কিছুই তারা তাদের কাজে লাগাতে পারে না।(১) আর আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না।
(265) (পক্ষান্তরে) যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ও নিজেদেরকে সুদৃঢ় রাখার লক্ষ্যে ধন-সম্পদ ব্যয় করে তাদের উপমা কোনো উঁচু (উর্বর) ভূমিতে অবস্থিত একটি (সুসজ্জিত) উদ্যান, যেখানে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়, ফলে তার ফলন হয় দ্বিগুণ। আর যদি মুষলধারে বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হালকা বৃষ্টিপাতই যথেষ্ট(১)। আর তোমরা যা আমল করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা(২)।
(266) তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে, তার থাকবে (ফলে ফুলে সুশোভিত) একটি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত থাকবে অনেকগুলো ঝর্ণাধারা এবং যেখানে তার জন্য থাকবে সব ধরনের ফল-ফলাদি। ইতোমধ্যে সে বার্ধক্যে উপনীত হলো(১) এমন অবস্থায় যে, তার রয়েছে (ছোট ছোট) কতিপয় দুর্বল সন্তান-সন্ততি। (এ অবস্থায় হঠাৎ) এক অগ্নিবায়ু তার বাগানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলো, যাতে তা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।(২) এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের (দুনিয়া ও আখিরাতে লাভের) জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারো।
(267) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা হালাল ও পবিত্র বস্তু থেকে যা উপার্জন করো এবং আমি যা যমিন থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো। আর নিকৃষ্ট অংশ (সাদাকা হিসেবে দরিদ্র লোকের জন্যে) ব্যয় করার সংকল্প করো না; অথচ তোমরা তা গ্রহণ করবে না, যদি না তোমরা (বাধ্য হয়ে) চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করো। আর জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।(১)
(268) শয়তান তোমাদেরকে অভাব অনটনের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়।(১) আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং অনুগ্রহের (প্রশস্ত রিযিকের) প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।
(269) তিনি যাকে ইচ্ছে হিকমত (সত্য কথা ও সঠিক কাজের তাওফীক) দান করেন। আর যাকে হিকমত প্রদান করা হয় তাকে তো প্রচুর কল্যাণ দান করা হয়। আর বিবেকসম্পন্নগণই(১) শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।
(270) আর তোমরা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কম-বেশি) যা কিছু ব্যয় করো অথবা (আল্লাহর কোন আনুগত্য নিজেদের উপর বাধ্যবাধকতা করে) যে কোন মানত করো তা অবশ্যই আল্লাহ জানেন। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।
(271) তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান সাদাকা করো তবে তা ভালো; আর যদি গোপনে (দান সাদাকা) করো এবং অভাবী লোকদেরকে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও ভালো এবং এতে তিনি তোমাদের জন্য কিছু পাপ মোচন করবেন । আর তোমরা যে ‘আমলই করো, আল্লাহ তার খবর রাখেন।
(272) (হে নবী) তাদেরকে হিদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নয়(১); বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছে হিদায়াত দেন। আর যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করো, তা তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যেই। আর তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই ব্যয় করে থাকো। আর তোমরা উত্তম কোনো কিছু ব্যয় করলে তার পুরস্কার তোমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে(২) এবং তোমাদের প্রতি যুলম করা হবে না।
(273) সেসব নিঃস্ব-অভাবী লোকেরা তোমাদের দান সাদাকা পাওয়ার প্রাপ্য; যারা আল্লাহর পথে (জিহাদ ও দীনী কাজে) নিজেদেরকে এমনভাবে ব্যাপৃত রাখে যে, (রিযক অনুসন্ধানের জন্য) যমিনে সফর করতে পারে না।আত্মসম্মানবোধে না চাওয়ার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সচ্ছল মনে করে। তুমি তাদের (চেহারা ও পোশাক-পরিচ্ছেদের) লক্ষণ দেখলেই চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি মিনতি করে হাত পাতে না। আর যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ জ্ঞানী।
(274) যারা (লৌকিকতা ও সুনামের জন্যে নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে (সর্বাবস্থায়) ব্যয় করে, তাদের প্রতিদান তাদের রবের নিকট রয়েছে। আর তাদের (ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে) কোনো ভয় নেই এবং তারা (বিগত জীবনের জন্যে) চিন্তিতও হবে না।
(275) যারা সুদ খায় (ও সুদের লেনদেন করে) তারা (কিয়ামতের দিন কবর থেকে) দাঁড়াতে পারবে না, তবে দাঁড়াবে সে ব্যক্তির ন্যায় যাকে (জিন) শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সুদেরই মতোই।’ অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। অতএব, যার নিকট তার রবের পক্ষ হতে (সুদ সম্পর্কীয় সতর্কবাণী ও নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত) উপদেশ আসার পর সে বিরত হলো (এবং তাওবা করলো), তাহলে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর দায়িত্বে। আর যারা পুনরায় সুদ গ্রহণ করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।
(276) আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন(১) এবং দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ কোনো অধিক অকৃতজ্ঞ পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে ভালোবাসেন না।
(277) নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, সালাত কায়িম করেছে এবং যাকাত দিয়েছে, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের নিকট। আর তাদের (পরকালীন জীবনের ব্যাপারে) কোনো ভয় নেই এবং তারা (দুনিয়ার জীবন ও এর নি‘আমত হাতছাড়া হওয়ার ব্যাপারে) চিন্তিতও হবে না।
(278) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা (আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে) একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা (পুনরায় তলব না করে) ছেড়ে দাও; যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো।
(279) অতঃপর যদি তোমরা না করো, (১) তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা গ্রহণ করো। আর যদি তোমরা তাওবা করো (সুদী কাজ-কারবার ছেড়ে দাও) তবে তোমাদের (সুদের ঋণের) মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের ওপরও যুলম করা হবে না।
(280) আর যদি ঋণগ্রহীতা অভাবগ্রস্ত হয়, তবে সচ্ছলতা পর্যন্ত তাকে সময় দাও। আর যদি তোমরা (তার করুণ অবস্থা দেখে ঋণের পুরোটুকুই বা কিছু অংশ) সাদকা করো, তবে তা তোমাদের জন্যেই কল্যাণকর; যদি তোমরা (আল্লাহর নিকট এর মর্যাদা সম্পর্কে) জানতে।
(281) আর তোমরা সে (কিয়ামত) দিনের শাস্তির ভয় করো, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তারপর প্রত্যেককেই তার (ভালো-মন্দ সকল) কৃতকর্মের পুরোপুরি প্রতিদান প্রদান করা হবে। আর তাদের কাউকেই যুলম করা হবে না।
(282) হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা যখন একে অন্যের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের চুক্তি করো তখন তা লিখে রাখো। তোমাদের মধ্যে যে কোনো লেখক যেন তা ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখে দেয়। কোনো লেখক তা লিখতে অস্বীকার করবে না, যেমন আল্লাহ তাকে (লিখতে) শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং সে যেন (ঋণদাতা বা ঋণগ্রহীতার শর্তাবলি) লিখে দেয়। এবং যে ব্যক্তির উপর হক্ক রয়েছে (ঋণগ্রহীতা) সে যেন লেখার বিষয়বস্তু বলে দেয় এবং সে (লেখক) যেন তার রব আল্লাহকে ভয় করে এবং (উভয়ের মধ্যে) স্থিরকৃত কোন কিছুই যেন কম-বেশি না করে।(১) অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ (২) অথবা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু বলে দেওয়ার যোগ্যতা না রাখে, তবে যেন তার অভিভাবক ন্যায়সঙ্গতভাবে লেখার বিষয়বস্তু (শর্তাবলি) বলে দেয়। আর তোমরা (এ লেনদেনের চুক্তিকে) তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী রাখো। অতঃপর যদি দু’জন পুরুষ (একত্রে) পাওয়া না যায়, তবে একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোককে সাক্ষী রাখো, যাদেরকে (দীনদারিতা ও আমানতদারিতার বিবেচনায়) তোমরা সাক্ষী হিসেবে পছন্দ করো; যাতে স্ত্রীলোকদের মধ্যে একজন ভুলে গেলে তাদের একজন অপরজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর সাক্ষীগণকে যখন (সাক্ষ্য প্রদানের জন্যে) ডাকা হবে তখন তারা যেন (সাক্ষ্য দিতে) অস্বীকার না করে। আর তা (লেনদেন) ছোট-বড় যাই হোক, মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনোরূপ অলসতা করো না। এটাই আল্লাহর নিকট ন্যায্যতার ও সাক্ষ্যদানের জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার জন্য অধিকতর উপযুক্ত। তবে তোমরা পরস্পর যে নগদ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করো তা তোমরা না লিখলে কোনো দোষ নেই। আর তোমরা যখন পরস্পর বেচা-কেনা করো তখন সাক্ষী রেখো। আর কোনো (চুক্তিনামার) লেখক ও সাক্ষীকে (তাদের মত পরিবর্তনের জন্যে চাপ প্রয়োগ করে) কষ্ট দেওয়া যাবে না। আর যদি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করো, তবে তা হবে তোমাদের জন্যে একটি মারাত্মক গুনাহ। আর তোমরা (আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার মাধ্যমে) আল্লাহকে ভয় করো এবং আল্লাহ তোমাদেরকে (দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকর বিষয়াদি) শিক্ষা দিবেন। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে জ্ঞানী।
(283) আর যদি তোমরা সফরে থাকো এবং (এ কারণে ঋণের চুক্তি লেখার) কোনো লেখক না পাও, তবে (চুক্তি লেখার পরিবর্তে জামানত স্বরূপ) হস্তান্তরযোগ্য বন্ধক রাখবে। অতঃপর তোমাদের একে অপরকে বিশ্বস্ত মনে করলে(১), যার কাছে আমানত রাখা হয়েছে সে যেন আমানত ফেরত দেয় এবং (এ আমানতের ব্যাপারে) সে যেন তার রব আল্লাহকে ভয় করে। আর (আমানতদার যদি অস্বীকার করে তবে, হে সাক্ষীগণ) তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। আর যে কেউ তা গোপন করে অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা-ই করোনা কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন।
(284) আল্লাহর জন্যই আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু রয়েছে। তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ করো কিংবা গোপন রাখো, আল্লাহ সেগুলোর হিসেব তোমাদের কাছ থেকে নিবেন। অতঃপর তিনি (দয়া ও অনুগ্রহ করে) যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছে (ইনসাফ ও হিকমতের ভিত্তিতে) শাস্তি দিবেন। আর আল্লাহ সবকিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।
(285) রাসূল (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওপর তার রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তিনি নিজেও এর ওপর ঈমান এনেছেন এবং মু’মিনরাও ঈমান এনেছে। তাদের প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের ওপর। (তারা বলে:) আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা (আরো) বলে: আমরা (আপনার আদেশ-নিষেধ) শুনেছি ও আনুগত্য করেছি। হে আমাদের রব! আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার কাছেই আমাদের (একদিন) ফিরে যেতে হবে।
(286) আল্লাহ কখনোই কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো দায়িত্ব (কাজ ও বোঝা) চাপিয়ে দেন না। সে ভালো যা কিছু উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই, আর মন্দ যা কামাই করে তার প্রতিফলও (শাস্তি ও) তার উপরই বর্তায়। (অতএব হে ঈমানদারগণ! তোমরা এই বলে দু‘আ করো:) ‘হে আমাদের রব! যদি আমরা কিছু ভুলে যাই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না (শাস্তি দিবেন না)। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু (আদেশ ও নিষেধ চাপিয়ে দিবেন না) বহন করাবেন না যার সামর্থ্য আমাদের নাই। আমাদের গুনাহসমূহ মোচন করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং (নিজ অনুগ্রহে) আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনিই তো আমাদের অভিভাবক (ও সাহায্যকারী)। অতএব, কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে (বিজয়ী করে) সাহায্য করুন।