(1) সকল প্রশংসা আল্লাহরই যিনি সৃষ্টি করেছেন, আসমানসমূহ ও জমিন এবং সৃষ্টি করেছেন, অন্ধকার ও আলো। এরপরও কাফিররা (অন্যদেরকে) তাদের রবের সমকক্ষ ও শরীক বানায়।
(2) তিনিই তোমাদেরকে (তোমাদের পিতা আদমকে) কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর (পার্থিব জীবনে অবস্থানের জন্য) একটা সময় নির্দিষ্ট করেছেন এবং আর একটি নির্ধারিত সময় আছে (কিয়ামতের দিন), যা শুধু তিনিই জানেন। এরপরও তোমরা (পুনরুত্থানের ব্যাপারে তাঁর ক্ষমতায়) সন্দেহ করো!
(3) আর আসমানসমূহ ও জমিনে তিনিই আল্লাহ। তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য (কথা, কাজ ও নিয়ত) সবকিছুই তিনি জানেন এবং তোমরা (ভালো-মন্দ) যা উপার্জন করো, তাও তিনি উত্তমরূপে জানেন।
(4) আর তাদের (মুশরিকদের) কাছে তাদের রবের আয়াতসমূহের কোন আয়াত আসলেই, তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় (অস্বীকার করে)।
(5) অতঃপর তারা সত্যকে(১) অস্বীকার করেছে, যখন তা তাদের কাছে এসেছে। সুতরাং অচিরেই তাদের কাছে সে বিষয়ের সংবাদ আসবে, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত।
(6) তারা (এ কাফিররা) কি দেখে না যে, আমি তাদের আগে বহু (যালিম) জাতিকে ধ্বংস করেছি? তাদেরকে জমিনে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যেমনটি তোমাদেরকেও করিনি এবং তাদের উপর অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম। আর তাদের (ঘরগুলোর) পাদদেশে নদী প্রবাহিত করেছিলাম। তারপর তাদের পাপের জন্য তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং তাদের পর অন্য জাতিকে সৃষ্টি করেছি।
(7) আর (হে রাসূল!) আমি যদি কাগজে লিখিত কিতাব তোমার ওপর নাযিল করতাম, অতঃপর তারা তা নিজেদের হাত দিয়ে স্পর্শ করত; তবুও যারা কুফরী করেছে তারা বলত: ‘এ তো প্রকাশ্য যাদু ছাড়া আর কিছুই না।’(১)
(8) আর তারা (কাফিররা আরো) বলে: ‘কেন তার (মুহাম্মাদের) সাথে কোন ফিরিশতা নাযিল করা হয়নি?’ যদি আমি ফিরিশতা নাযিল করতামই তাহলে বিষয়টি ফয়সালা (ঈমান না আনলে ধ্বংস ) হয়েই যেতো , তারপর তাদের (তাওবার) সুযোগ দেওয়া হতো না।
(9) তাছাড়া আমি যদি কোনো ফিরিশতাকেও রাসূল করে পাঠাতাম, তবে তাঁকে পুরুষ মানুষের আকৃতিতেই পাঠাতাম।(১) আর তাদেরকে সেরকম বিভ্রান্তিতে ফেলতাম, যেরূপ বিভ্রান্তিতে তারা এখন রয়েছে।(২)
(10) আর (হে মুহাম্মাদ!) তোমার পূর্বেও অনেক রাসূলের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়েছিলো।(১) কিন্তু বিদ্রুপকারীরা যে অকাট্য সত্য নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছিল, অবশেষে সেটাই (অস্বীকারকৃত শাস্তই) তাদের ওপর চেপে বসেছিলো।
(11) (হে রাসূল! তুমি মিথ্যুক ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদেরকে) বল: ‘তোমরা জমিনে পরিভ্রমণ করো, তারপর দেখো, (আল্লাহর রাসূলদেরকে) অস্বীকারকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছে?’
(12) (হে রাসূল!) বল, ‘আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে, তা কার?’ বল, ‘আল্লাহরই (মালিকানা)।’ তিনি তাঁর নিজের ওপর (বান্দাদের প্রতি) দয়া করা লিখে নিয়েছেন (কর্তব্য হিসাবে ধার্য করে নিয়েছেন) । তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের দিনে অবশ্যই একত্র করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা (আল্লাহর সাথে কুফরী করে) নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, তারা ঈমান আনবে না।
(13) আর রাতের (আধারে) ও দিনের (আলোতে) যা কিছু স্থিতিশীল হয়, তা তাঁরই (মালিকানা)। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(14) (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে) বল: ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্যকে অভিভাবক (সাহায্যকারী) হিসেবে গ্রহণ করব, যিনি আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা? তিনি (সৃষ্ট প্রাণীকে) আহার দেন, তাঁকে আহার দেওয়া হয় না।’ (হে নবী) বল: ‘নিশ্চয় আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে যেন আমি প্রথম ব্যক্তি হই।’ আর (আমাকে আরও আদেশ করা হয়েছে যে,) ’তুমি কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’
(15) (হে রাসূল!) বল: ‘আমি যদি আমার রবের অবাধ্য হই, তবে নিশ্চয় আমি মহা দিবসের (কিয়ামতের দিনের) শাস্তিকে ভয় করি।
(16) সেদিন (কিয়ামতের দিন) যার থেকে শাস্তি সরিয়ে নেওয়া হবে, তার প্রতি তো তিনি দয়া করলেন। আর এটাই স্পষ্ট সফলতা।
(17) আর (হে নবী!) আল্লাহ তোমাকে যদি কোন দুঃখ- দুর্দশায় ফেলেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর তিনি যদি তোমাকে কোন কল্যাণ দান করেন, তবে (তা প্রতিরোধকারী কেউ নেই) তিনিই তো সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
(18) আর তিনিই নিজ বান্দাদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী। আর তিনি মহাপ্রজ্ঞাময়, সব কিছু জানেন।
(19) (হে রাসূল! তুমি মুশরিক ও মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদেরকে) বলো: ‘কোন জিনিস (আমার সত্যবাদিতার) সবচেয়ে বড় সাক্ষী?’ বলো: ’আল্লাহই আমার (সত্যবাদিতার) ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষ্যদাতা। আর এ কুরআন আমার নিকট অহী করা হয়েছে, যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট তা পৌঁছবে তাদের এ দ্বারা সতর্ক করতে পারি। (হে মুশরিকরা!) তোমরা কি এমন (ভয়ানক মিথ্যা) সাক্ষ্য দিতে পারবে যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহও আছে? (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বলো: ‘ আমি সে সাক্ষ্য দেই না ।’ বলো: ’অবশ্যই তিনি একমাত্র ইলাহ এবং তোমরা (তাঁর সাথে) যা শরীক করো, তা থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত।’
(20) আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা ) তাকে (শেষ নবী মুহাম্মাদকে) চিনে, যেরূপ চিনে তাদের সন্তানদেরকে। যারা নিজেরাই নিজেদেরকে (জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে) ক্ষতি করেছে, তারা ঈমান আনবে না।
(21) আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে, যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রটনা করে অথবা তাঁর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে? নিশ্চয় যালিমরা সফলকাম হয় না।
(22) আর (কিয়ামতের দিনের কথা স্মরণ করো) যেদিন আমি তাদের সকলকে সমবেত করবো, অতঃপর যারা (আল্লাহর সাথে) শিরক করেছে তাদেরকে বলব: ‘(আজ) তোমাদের (মিথ্যা দাবিকৃত) শরীকরা কোথায়, যাদেরকে তোমরা (শরীক) মনে করতে?’
(23) অতঃপর (এ পরীক্ষার পর) তাদের আর কোন কৈফিয়ত থাকবে না; বরং তারা (মিথ্যার সূরে) বলবে: ‘আল্লাহর শপথ! হে আমাদের রব, আমরা তো (দুনিয়াতে) মুশরিকই ছিলাম না।’
(24) (হে নবী! তুমি তাদেরকে) দেখো, তারা (এখন শিরক অস্বীকার করে) নিজেদের প্রতি কিরূপ মিথ্যাচার করছে। আর তারা (দুনিয়াতে যাদে নিয়ে) মিথ্যা রটনা করতো (আল্লাহর সাথে শিরক করতো), তারা (তাদের শরীকরা) কীভাবে তাদের থেকে উধাও হয়ে গেল?
(25) আর তাদের (মুশরিকদের) কেউ কেউ তোমার প্রতি কান পেতে (আলকুরআন তিলাওয়াত) শোনে; কিন্তু (তাদের হঠকারিতা ও সত্য বিমুখতার কারণে) আমি তাদের অন্তরের ওপর আবরণ করে দিয়েছি, যেন তারা তা উপলব্ধি করতে না পারে। তাছাড়া আমি তাদের কানে পর্দা (বধিরতা) লাগিয়ে দিয়েছি। আর তারা যদি প্রতিটি আয়াতও দেখে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে না। এমনকি যখন তারা তোমার কাছে উপস্থিত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়, যারা কুফরী করেছে তারা ( সব শোনার পর ) বলে: ‘এটা পূর্ববর্তীদের কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।’
(26) আর তারা (মুশরিকরা) অন্যকে (রাসূলের ওপর ঈমান আনা থেকে) নিষেধ করে এবং নিজেরাও তা থেকে দুরে থাকে। আর তারা (রাসূলের প্রতি ঈমান না এনে) নিজেরাই শুধু নিজেদেরকে ধ্বংস করে; অথচ তারা উপলব্ধি করে না।
(27) আর (হে রাসূল!) তুমি যদি দেখতে, যখন তাদেরকে (কিয়ামতের দিন) জাহান্নামের কিনারে দাঁড় করানো হবে, তখন তারা বলবে: ‘হায় আফসোস! যদি আমাদেরকে (পৃথিবীতে) ফেরত পাঠানো হতো, তাহলে আমরা আমাদের রবের আয়াতসমূহকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম!’
(28) না (ব্যাপারটি তেমন নয়, যেমন তারা বলেছে); বরং তারা ইতঃপূর্বে যা গোপন করত (আমরা কখনোই মুশরিক ছিলাম না-দাবী), তা তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে গেছে। আর যদি তাদেরকে (দুনিয়াতে) ফেরত পাঠানো হয়, অবশ্যই (কুফরী ও শিরকের) যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিলো, তারা তার দিকেই ফিরে যেতো। আর (দুনিয়াতে ফিরে গেলে ঈমান আনবে সে ব্যাপারে) নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।
(29) আর তারা (মুশরিকরা) বলেছিল: ‘আমাদের এ দুনিয়ার জীবন ছাড়া আর কিছু নেই এবং (হিসাবের জন্যে) আমাদেরকে পুনরুত্থিতও করা হবে না।
(30) আর যদি তুমি তাদেরকে (পুনরুত্থান অস্বীকারকারীদেরকে) দেখতে যখন তাদেরকে দাঁড় করানো হবে তাদের রবের সামনে এবং তিনি বলবেন: ‘এটা (পুনরুত্থান) কি সত্য নয়’? তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, আমাদের রবের শপথ!’(এটা বাস্তব সত্য) । তিনি বলবেন: ‘সুতরাং (এই সত্যকেই) তোমরা যে কুফরী করতে তার কারণে, আজ তোমরা (জাহান্নামের) শাস্তি আস্বাদন করো।’
(31) যারা (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর সাক্ষাতকে(১) অস্বীকার করেছে, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি যখন হঠাৎ তাদের কাছে কিয়ামত উপস্থিত হবে, তখন তারা বলবে: ‘হায় আফসোস! (দুনিয়াতে) আমরা যে (আল্লাহকে অস্বীকার করে ও কিয়ামতের জন্যে প্রস্তুতি না নিয়ে) ত্রুটি করেছি তার জন্যে।’ তারা তাদের পাপসমূহ তাদের পিঠে বহন করবে। সাবধান! তারা যা বহন করবে, তা কতই না নিকৃষ্ট!
(32) আর দুনিয়ার জীবন তো খেল–তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা (আল্লাহর আনুগত্য করে ও নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করে) আল্লাহকে ভয় করে, তাদের জন্য আখিরাতের আবাসই উত্তম। অতএব, তোমরা কি তা বুঝবে না?
(33) আমি অবশ্যই জানি যে, তারা যা বলে, তা তোমাকে নিশ্চিতই কষ্ট দেয়। আসলে তারা তো তোমার প্রতি মিথ্যারোপ করে না; বরং যালিমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকেই অস্বীকার করে।
(34) আর (এ মিথ্যারোপ শুধু তোমার আনীত বিধানের সাথেই হয়নি, বরং) তোমার আগেও অনেক রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করা হয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ও কষ্ট দেওয়ার পরও তারা (দা ‘ওয়াতের ক্ষেত্রে) ধৈর্যধারণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে আমার সাহায্য এসে পৌঁছে। আর আল্লাহর বাণীসমূহের(১) কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর অবশ্যই রাসূলগণের কিছু সংবাদ তোমার কাছে এসেছে।(২)
(35) আর (হে রাসূল!) যদি তোমার কাছে তাদের (কাফিরদের মিথ্যারোপ ও) উপেক্ষা কষ্টকর হয়, তাহলে পারলে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ বা আকাশে সিঁড়ি খোঁজ করো এবং তাদের কাছে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসো। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে, তাদের সবাইকে অবশ্যই হিদায়েতের পথে একত্র করতেন(১)। কাজেই তুমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
(36) যারা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে শুধু তারাই তোমার ডাকে (তোমার আনীত বিধানে) সাড়া দেয়। আর মৃতদেরকে আল্লাহ আবার জীবিত করবেন(১)। তারপর তাঁর দিকেই তাদেরকে প্রত্যাবর্তন করানো হবে।
(37) আর তারা (মুশরিকরা) বলে: ‘কেন তার ওপর তার রবের পক্ষ থেকে কোন নিদর্শন আসে না?’ (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বল: ‘নিশ্চয় আল্লাহ (তোমাদের দাবী অনুযায়ী) যে কোন নিদর্শন নাযিল করতে সক্ষম। কিন্তু তাদের অধিকাংশ জানে না (যে, নিদর্শনসমূহ নাযিলের ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছাধীন, তাদের ইচ্ছাতে হয় নয়)।
(38) আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণী এবং ডানার সাহায্যে উড়ে এমন প্রতিটি পাখি, যারা (সৃষ্টি ও রিযকের ক্ষেত্রে) তোমাদের মত এক একটি জাতি। আমি কিতাবে (লাওহে মাহফূযে) কোনো কিছু বাদ দেইনি। অতঃপর তাদেরকে তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে।
(39) আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তারা বধির, বোবা এবং অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে। আল্লাহ যাকে চান, তাকে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান, তাকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
(40) (হে রাসূল! তুমি এ মুশরিকদেরকে) বলো: ‘তোমরা চিন্তা করে দেখো, তোমাদের ওপর যদি (হঠাৎ) আল্লাহর শাস্তি এসে যায় অথবা কিয়ামত এসে পড়ে, তবে কি তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে (বিপদাপদ দূর করতে) ডাকবে, যদি তোমরা সত্যবাদী হও?
(41) বরং তোমরা তাঁকেই (আল্লাহকেই) ডাকবে। অতঃপর তোমরা যে দুঃখ দূর করতে তাঁকে ডাকছ, তিনি ইচ্ছে করলে, তোমাদের সে দুঃখ দূর করবেন। আর তোমরা যাকে শরীক করো, তা তোমরা ভুলে যাবে (১)।
(42) আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে বিভিন্ন জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর (তারা রাসূলদেরকে মিথ্যারোপ করায়) আমি তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পাকড়াও করেছি, যাতে তারা বিনয়ী ও অনুগত হয়।
(43) সুতরাং যখন আমার শাস্তি তাদের ওপর আপতিত হল, তখন তারা কেন বিনীত হলো না? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়েছিল। আর তারা যা করছিল, শয়তান তাদের জন্য তা শোভিত করেছে (তাদের কৃত কুফরী ও গুনাহকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে)।
(44) অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা যখন তা ভুলে গেল, আমি তাদের জন্য সবকিছুর দরজা খুলে দিলাম।(১) অবশেষে যখন তাদেরকে যা প্রদান করা হয়েছিল তার কারণে তারা (অহংকার করলো এবং আত্মতৃপ্তিতে) উৎফুল হলো, তখন আমি আকস্মিকভাবে তাদেরকে (শাস্তি দ্বারা) পাকড়াও করলাম। ফলে তখন তারা হতাশ হয়ে গেল।
(45) অতএব যারা যালিম সেই সম্প্রদায়ের মূলোচ্ছেদ করা হলো। আর সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই জন্য।
(46) (হে রাসূল! তুমি এ মুশরিকদেরকে) বল: ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন (তোমাদেরকে বধির ও অন্ধ করে দেন) এবং তোমাদের অন্তরসমূহে মোহর মেরে দেন, তবে আল্লাহ ছাড়া কি কোন ইলাহ আছেন, যে তোমাদেরকে এগুলো ফিরিয়ে দিবেন?‘ (হে রাসূল! তুমি) দেখো, কেমন করে আমি বিভিন্নভাবে আয়াতসমূহ বর্ণনা করি; এরপরও তারা এগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
(47) (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বলো: ‘তোমরা ভেবে দেখেছো কি, যদি আল্লাহর শাস্তি হঠাৎ কিংবা প্রকাশ্যে তোমাদের কাছে এসে পড়ে, তবে যালিম সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কাউকে ধ্বংস করা হবে কি?’
(48) আর আমি রাসূলদেরকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করি। অতএব যারা ঈমান এনেছে ও নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছে, তাদের ওপর (আখিরাতে) কোনো ভয় নেই এবং তারা (দুনিয়ার কোন সুবিধা হারানোর জন্য) চিন্তিতও হবে না।
(49) আর যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, তাদের পাপাচারের কারণে তাদেরকে স্পর্শ করবে শাস্তি।
(50) (হে রাসূল! তুমি এ মুশরিকদেরকে) বলো: ‘আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর (রিযকের) ভাণ্ডারসমূহ আছে, আর আমি গায়িবও জানি না এবং আমি একথাও বলি না যে, নিশ্চয় আমি ফিরিশতা। আমি শুধু তাই অনুসরণ করি, যা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) আমার কাছে অহী রূপে প্রেরণ করা হয়।’ (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বলো: ‘(সত্য দর্শনে) অন্ধ (কাফির) আর চক্ষুষ্মান (মু’মিন) কি সমান হতে পারে? অতএব তোমরা (নিদর্শনাবলি দেখেও) কি চিন্তা করবে না?
(51) আর (হে রাসূল! তুমি) এর দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করো, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে (কিয়ামতের দিবসে) তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে। (সেদিন) তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক কিংবা সুপারিশকারী থাকবে না। (আশা করি এ কারণেই ) হয়ত তারা (আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে) তাঁকেই ভয় করবে।
(52) আর (হে রাসূল! মুশরিক দলপতিদেরকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য মজলিশ থেকে) তুমি তাদেরকে (দরিদ্র মুসলিমদেরকে) তাড়িয়ে দিয়ো না, যারা নিজ রবকে সকাল সন্ধ্যায় ডাকে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি চায়। তাদের (দরিদ্র মুসলিমদের) কোনো কাজের জবাবদিহিতার দায়িত্ব তোমার ওপর নেই এবং তোমারও কোনো জবাবদিহিতার দায়িত্ব তাদের ওপর নেই যে, তুমি তাদেরকে তাড়িয়ে দিবে, ফলে তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
(53) আর এভাবেই আমি তাদের একদল লোককে দিয়ে আরেক দলকে পরীক্ষা করেছি, যাতে তারা (ধনী কাফিররা দরিদ্র মু’মিনদেরকে) বলে: ‘আমাদের মধ্যে কি এদের প্রতিই আল্লাহ অনুগ্রহ করলেন?’ আল্লাহ কি কৃতজ্ঞদের সম্বদ্ধে সবিশেষ অবগত নন?
(54) আর (হে রাসূল!) যারা আমার আয়াতসমূহের ওপর ঈমান আনে, তারা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তাদেরকে বলো: ‘তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ তোমাদের রব (অনুগ্রহপূর্বক) দয়া করাকে নিজের ওপর কর্তব্য বলে তিনি লিখে নিয়েছেন। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে কেউ না জেনে যদি খারাপ কাজ করে, তারপর তাওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাহলে তিনি (তাওবাকারী বান্দাহদের প্রতি) অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(55) আর এভাবেই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি, যাতে অপরাধীদের পথ স্পষ্ট হয়ে যায়।
(56) (হে রাসূল!) বলো: ‘নিশ্চয় তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাক, তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।’ (হে রাসূল! তুমি আরো) বলো: ‘(আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদাত করে) আমি তোমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করি না, করলে নিশ্চয় আমি পথভ্রষ্ট হবো এবং আমি হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো না।
(57) বলো: ‘নিশ্চয় আমি আমার রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর আছি ; অথচ তোমরা তা অস্বীকার করছো। তোমরা যা (যে শাস্তি ও অলৌকিক নিদর্শনাবলী) নিয়ে তাড়াহুড়া করছো, তা আমার কাছে নেই। (জেনে রেখো) হুকম (কর্তৃত্ব) কেবল আল্লাহরই । তিনি সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনি সর্বোত্তম ফয়সালাকারী।’
(58) বলো: ‘তোমরা যা (যে শাস্তি) নিয়ে তাড়াহুড়া করছো, তা যদি আমার কাছে থাকত, অবশ্যই আমার ও তোমাদের মাঝে বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যেত। আর আল্লাহ যালিমদের ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত।’(১)
(59) আর গায়িবের চাবিসমূহ (ভাণ্ডার) তাঁরই কাছে। তিনি ছাড়া তা কেউ জানে না। আর স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারসমূহে যা কিছু আছে, তা তিনিই অবগত আছেন। গাছের একটি পাতাও পড়ে না, তাঁর অবগতি ছাড়া। মাটির অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না বা আদ্র (রসযুক্ত) কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে (লাওহে মাহফূযে) নেই।
(60) আর তিনিই রাতে তোমাদেরকে (ঘুমের মাঝে কিছু সময়ের জন্য) মৃত্যু দেন এবং দিনে তোমরা যা উপার্জ ন করো তিনি তা জানেন। তারপর তিনি তোমাদেরকে দিনে পুনরায় (ঘুমের মাধ্যমে মৃত্যুর পরে) জাগিয়ে তুলেন, যাতে নির্দিষ্ট মেয়াদ (জীবনকাল) পূর্ণ করা হয়। তারপর তাঁর দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর তোমরা যা যা করতে, তিনি তোমাদেরকে সে বিষয়ে অবহিত করবেন।
(61) আর তিনিই নিজ বান্দাদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী এবং তোমাদের ওপর প্রেরণ করেন হিফাযতকারীদেরকে।(১) অবশেষে যখন তোমাদের কারো কাছে মৃত্যু আসে, আমার প্রেরিত দূতগণ (মৃত্যুর ফিরিশতাগণ) তার মৃত্যু ঘটায়। আর তারা (আদেশ পালনে) কোন ত্রুটি করে না।
(62) তারপর তাদেরকে (রূহ কবযকৃত সকলকে) তাদের সত্যিকার মালিক আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে। জেনে রেখো, সমস্ত হুকম (কর্তৃত্ব) তো তাঁরই এবং তিনি সবচেয়ে দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী।
(63) (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে ) বলো: ‘কে তোমাদেরকে উদ্ধার করেন স্থল ও সমুদ্রের যাবতীয় অন্ধকার (বিপদাপদ) থেকে? তোমরা তখন তাকে ডাকো অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে, (আর বলো), ‘যদি তিনি আমাদেরকে এ (ধ্বংসাত্মক বিপদ) থেকে উদ্ধার করেন, আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’
(64) (হে নবী! তুমি তাদেরকে) বলে দাও: ‘আল্লাহ যিনি (যাবতীয় ভয়ভীতি ) থেকে তোমাদেরকে উদ্ধার করেন এবং প্রত্যেক বিপদ থেকে। তারপরও তোমরা তার সাথে শিরক করো!’
(65) (হে নবী! তুমি) বলো: ‘তিনি তো তোমাদের ওপর থেকে (পাথর, বজ্র ও তুফানের শাস্তি) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে (ভূমি ধস ও ভূমিকম্পন দিয়ে) তোমাদের ওপর শাস্তি প্রেরণ করতে, অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন সন্দেহপূর্ণ দলে বিভক্ত করতে এবং তোমাদের একদলকে অন্য দলের ভীতি আস্বাদন করাতে সক্ষম।‘ দেখ, কীভাবে আমি আয়াতসমূহ (বিভিন্ন দলিল ও অকাট্য প্রমাণসহ) নানাভাবে বর্ণনা করি, যাতে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারে।
(66) আর তোমার সম্প্রদায় তা (এ কুরআনকে) অস্বীকার করেছে; অথচ তা সত্য। (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বলো: ‘আমি তোমাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক নই।’
(67) প্রত্যেক সংবাদের জন্য নির্ধারিত সময় (ও পরিণতি) রয়েছে এবং অচিরেই তোমরা (কিয়ামতের দিন) তা জানতে পারবে।
(68) আর যখন তুমি তাদেরকে (মুশরিকদেরকে) দেখো, তারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে উপহাসমূলক সমালোচনায় রত আছে, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য কথাবার্তায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে (মুখ ফিরিয়ে নিতে) ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণের পর যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসো না।
(69) আর তাদের (যালিমদের) কোনো কাজের জবাবদিহির দায়িত্ব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের নয়। তবে (তাদের কর্তব্য হচ্ছে) উপদেশ দেওয়া, যাতে তারা আল্লাহকে (তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে) ভয় করতে শিখে।
(70) আর যারা (মুশরিকরা) তাদের দীনকে খেল-তামাশারূপে গ্রহণ করে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে, তুমি তাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করো। আর তুমি আলকুরআন দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দিতে থাকো, যাতে কেউ নিজ কৃতকর্মের কারণে ধ্বংসের শিকার না হয়। তার জন্য তো আল্লাহ ছাড়া নেই কোন অভিভাবক এবং নেই কোন সুপারিশকারী। আর যদি সে মুক্তিপণ হিসেবে সব কিছু দেয়, তবুও তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। এরাই তারা, যারা নিজেদের কৃতকর্মের কারণে ধ্বংসের শিকার হয়েছে। তাদের কুফরীর কারণে তাদের জন্যে রয়েছে ফুটন্ত পানীয় এবং বেদনাদায়ক শাস্তি।
(71) (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে) বলো: ‘আমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডাকব, যা আমাদেরকে কোন উপকার করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না? আর আল্লাহ আমাদেরকে পথ দেখানোর পর আমাদেরকে কি ফিরানো হবে আমাদের পশ্চাতে সেই ব্যক্তির ন্যায়, যাকে শয়তান জমিনে এমন শক্তভাবে পেয়ে বসেছে যে, সে দিশেহারা? অথচ তার রয়েছে কিছু (ঈমানদার) সহচর, যারা তাকে সত্য-সঠিক পথের দিকে আহ্বান করে বলে: ‘আমাদের কাছে আসো (কিন্তু সে ঈমানদার বন্ধুদের এ ডাকে সাড়া দেয় না।)।’ বলো: ‘আল্লাহর পথই সঠিক পথ। আর আমরা রাব্বুল আলামীনের আনুগত্য করতে আদিষ্ট হয়েছি।’
(72) আর (তিনি আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে,) তোমরা সালাত কায়িম করো এবং তাঁকে (তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে) ভয় করো। আর তাঁর কাছেই তোমাদেরকে সমবেত করা হবে।
(73) আর তিনিই, আসমানসমূহ ও জমিনকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। আর যেদিন (কিয়ামতের দিন) তিনি বলবেন: ‘হও’ তখন হয়ে যাবে।(১) তাঁর কথাই সত্য। আর যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তাঁর জন্যই রয়েছে সেদিনের রাজত্ব। তিনি গায়িব ও উপস্থিত বিষয়ে পরিজ্ঞাত এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, অধিক অবহিত।
(74) আর (স্মরণ করো সে সময়ের কথা) যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল: ‘তুমি কি (সত্যিই) মূর্তিগুলোকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছ? নিশ্চয় আমি তোমাকে এবং তোমার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট গোমরাহীতে (ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত) দেখছি।’
(75) (যেভাবে তাঁকে তাঁর পিতার ও তাঁর সম্প্রদায়ের পথভ্রষ্টতা দেখিয়েছি) এভাবে আমি ইবরাহীমকে আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব (মালিকানা) দেখিয়েছি, যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।
(76) অতঃপর যখন রাতের অন্ধকার তার ওপর আচ্ছন্ন হলো, সে একটি তারকা দেখে, বলল: ‘এ আমার রব।’ অতঃপর যখন সেটা অস্তমিত হলো, তখন সে (দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে) বললো: ‘যা অস্তমিত হয় আমি তা ভালোবাসি না।’
(77) অতঃপর যখন সে চাঁদকে উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখল, বললো: ‘এই আমার রব।’ পরে যখন সেটাও অস্তমিত হলো, সে বললো: ‘যদি আমার রব আমাকে হিদায়াত (তথা তাঁর তাওহীদ ও একক ইবাদাতের তাওফীক দান) না করেন, নিশ্চয় আমি পথহারা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’
(78) অতঃপর যখন সে (দিনের বেলায়) সূর্যকে উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখলো, বললো: ‘এই আমার রব, এটি সবচেয়ে বড়।’ পরে যখন তা অস্তমিত হয়ে গেলো, তখন সে (তার সম্প্রদায়কে ডেকে) বললো: ‘হে আমার জাতি, তোমরা (আল্লাহর সাথে) যা শরীক করো, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত।’
(79) (ইবরাহীম আরো ঘোষণা করলো:) ‘নিশ্চয় আমি একনিষ্ঠভাবে (খাঁটি একত্ববাদী হয়ে) তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’
(80) আর তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বললো: ‘তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করছো? অথচ তিনি আমাকে হিদায়াত দান করেছেন? তোমরা তাঁর সাথে যাদের (যে মূর্তিগুলোর) শরীক করছো, আমি তাদেরকে ভয় করি না, তবে আমার রব যদি কিছু (উপকার বা ক্ষতি) করতে চান, সেটা ভিন্ন কথা। আমার রব ইলম (জ্ঞান) দ্বারা সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন। অতঃপর তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?’
(81) (ইবরাহীম আরো যুক্তি দিয়ে বলেন:) ‘তোমরা যাদেরকে (যে মূর্তিগুলোকে আল্লাহর সাথে) শরীক করছো, তাদেরকে আমি কীভাবে ভয় করবো? তোমরা তো মহান আল্লাহর সাথে শরীক করতে আল্লাহকে ভয় করছো না; অথচ তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক বানানোর প্রসঙ্গে তিনি তোমাদের নিকট কোন দলিল- প্রমাণ নাযিল করেননি। অতএব (তাওহীদপন্থী বা মুশরিকদের) কোন দলটি নিরাপত্তার বেশি হকদার? (বলোঃ) যদি তোমাদের জানা থাকে?
(82) যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করেনি, প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।
(83) আর ওটাই আমার দলিল–প্রমাণ, যা আমি ইবরাহীমকে তার জাতির মোকাবেলার (বিতর্ক করার) জন্যে দান করেছিলাম। আমি যাকে ইচ্ছা অনেক উঁচু মর্যাদায় উন্নীত করি। নিশ্চয় তোমার রব প্রজ্ঞাবান, সর্বজ্ঞানী।
(84) আর আমি তাকে (ইবরাহীমকে) দান করেছি (পুত্র) ইসহাক ও (নাতি) ইয়াকূবকে। প্রত্যেককে আমি হিদায়াত দিয়েছি এবং নূহকে পূর্বে হিদায়াত দিয়েছি। আর তার সন্তানদের মধ্য থেকে দাঊদ, সুলায়মান, আইয়ূব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকে (হিদায়াত দিয়েছি)। আর আমি (নবীদেরকে সৎকর্মের কারণে যেভাবে প্রতিদান দিয়েছি) এভাবেই (অন্যান্য) সৎকর্মশীলদেরকেও প্রতিদান দেই।
(85) আর যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, ‘ঈসা ও ইলয়াসকে (হিদায়াত দিয়েছি)। এরা প্রত্যেকেই সৎকর্মপরায়ণ ছিলেন।
(86) আর ইসমা‘ঈল, আল ইয়াসা‘, ইউনুস ও লূতকে (হিদায়াত দিয়েছি)। প্রত্যেককে আমি সৃষ্টিকুলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।
(87) এছাড়াও (আমি হিদায়াত দিয়েছি) তাদের পিতৃপুরুষ, বংশধর ও ভাইদের কিছুসংখ্যককে। আর আমি তাদেরকে মনোনীত করেছি এবং সরল পথে পরিচালিত করেছি।
(88) এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত, স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তিনি এ দ্বারা হিদায়াত করেন। আর যদি তারা শিরক করতো, তবে তাঁদের কৃতকর্ম নিষ্ফল হয়ে যেতো।
(89) এরাই তারা (সেসব নবীগণ), যাদেরকে আমি কিতাব, কর্তৃত্বও নবুওয়্যাত দান করেছি। অতএব তারা (তোমার সম্প্রদায়) যদি (উপরিউক্ত তিনটি বিষয়) এর সাথে কুফরী করে, তবে (কোনো পরওয়া নেই, কারণ) আমি এগুলোর তত্ত্বাবধায়ক এমন সম্প্রদায়কে করেছি, যারা এগুলোর অস্বীকারকারী (কাফির) নয়।(১) ( যারা এগুলো মানতে অস্বীকার করবে না।)
(90) এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন। অতএব তুমি তাদের হিদায়াত অনুসরণ করো। ( হে রাসূল! তুমি তোমার সম্প্রদায়কে) বলো: ‘আমি তোমাদের কাছে এর (আলকুরআন প্রচারের) জন্যে কোনো বিনিময় চাই না। এটা তো সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশ ছাড়া আর কিছুই না।
(91) আর তারা (মুশরিকরা) আল্লাহকে যথার্থ সম্মান দেয়নি, যখন তারা বলছে: আল্লাহ কোন মানুষের ওপর কিছুই নাযিল করেননি। (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বলো: ‘কে নাযিল করেছে মূসার আনীত কিতাব (তাওরাত)? যা মানুষের জন্য আলো ও হিদায়াতস্বরূপ, যা তোমরা বিভিন্ন কাগজে লিখে রাখতে, তোমরা তার কিছু প্রকাশ করতে, (যা তোমাদের কামনা-বাসনার অনুকূলে হতো), আর অনেকাংশ গোপন রাখতে (যা তোমাদের কামনা-বাসনার প্রতিকূলে হতো, যেমনঃ মুহাম্মাদ সা.- এর গুণাবলী)। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, যা তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা জানতে না? বলো: ‘আল্লাহই’ (তা নাযিল করেছেন)। অতঃপর তাদেরকে তাদের অযাচিত সমালোচনার ওপর ছেড়ে দাও, তারা খেলতে থাকুক।
(92) আর (হে নবী) এটি বরকতময় কিতাব (আল-কুরআন), যা আমি নাযিল করেছি। এটি তার পূর্বের সব কিতাবের সত্যায়নকারী এবং এর দ্বারা যেন তুমি মক্কা ও তার চারপাশের (দুনিয়ার পূর্ব-পশ্চিমের সকল) মানুষদেরকে সতর্ক করতে পারো। আর যারা আখিরাতের ওপর ঈমান রাখে, তারা এ কিতাবের প্রতিও ঈমান রাখে এবং তারা তাদের সালাতের হিফাযত করে।
(93) আর তার চেয়ে বড় যালিম কে, যে আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটনা করে অথবা বলে: ‘আমার ওপর অহী প্রেরণ করা হয়েছে; অথচ তার প্রতি কোনো অহীই প্রেরণ করা হয়নি? আর তারা (মিথ্যা দাবী করে) বলে: ‘আমি অচিরেই এমন কিছু নাযিল করব, যেরূপ আল্লাহ নাযিল করেছেন।’ আর (হে নবী) তুমি যদি ঐ সময়ের অবস্থা দেখতে, যালিমরা যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে, এমতাবস্থায় ফিরিশতাগণ হাত বাড়িয়ে (তাদেরকে শাস্তি দিবে এবং ধমক দিয়ে) বলবে: ‘তোমাদের প্রাণগুলো বের করো। আজ তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি; কারণ তোমরা আল্লাহর ওপর অসত্য বলতে এবং তোমরা তাঁর আয়াতসমূহ সম্পর্কে অহংকার করতে।’
(94) আর অবশ্যই তোমরা আমার কাছে একা একা এসেছ, যেমন আমি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছিলাম। আর আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা তোমরা তোমাদের পিছনে (দুনিয়ায়) ফেলে এসেছ। আর তোমরা যাদেরকে তোমাদের ব্যাপারে (আল্লাহ্র সাথে) শরীক মনে করতে, তোমাদের সে সুপারিশকারীদেরকেও আমি তোমাদের সাথে দেখছি না। তোমাদের মধ্যকার সম্পর্ক অবশ্যই ছিন্ন হয়েছে এবং যা ধারণা করেছিলে, তাও তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে।
(95) নিশ্চয়ই আল্লাহ শস্য-বীজ ও আঁটি অংকুরিত করেন। তিনিই মৃত (বীর্য) থেকে জীবিতকে (মানুষ ও অন্যান্য জীবকে) বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন।(১) তিনিই তো তোমাদের আল্লাহ। কাজেই (হে মুশরিকগণ, এসব সৃষ্টির সক্ষমতা দেখার পরেও) তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে?
(96) তিনিই (রাতের বুক চিরে) প্রভাতের উন্মেষকারী। আর তিনি রাতকে বিশ্রামের জন্যে এবং সূর্য ও চাঁদকে হিসাবের জন্যে বানিয়েছেন। এসবই পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানীর (আল্লাহর) নির্ধারিত।
(97) আর তিনিই তোমাদের জন্যে নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা এ দ্বারা স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে (সফরের সময় পথহারা হলে) পথপ্রাপ্ত হও। অবশ্যই আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্যে আমার আয়াতসমূহকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি।
(98) আর তিনিই তোমাদেরকে একই ব্যক্তি (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের জন্যে রয়েছে স্থায়ী ও স্বল্পকালীন বাসস্থান।(১) অবশ্যই আমি (আল্লাহর বাণী বুঝে এমন) বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ এভাবেই বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।
(99) আর তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টির পানি বর্ষণ করেন, তারপর তা দ্বারা আমি সকল প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। অতঃপর সে উদ্ভিদ থেকে (তৃণ পল্লব ও) সবুজ গাছপালা উদ্গত করি। তা থেকে আমি ঘন ঘন নিবিড় শস্য-দানা উৎপন্ন করি। অনুরূপভাবে খেজুর গাছের মাথা থেকে ঝুলন্ত কাঁদি, আঙ্গুরের বাগান, যায়তুন ও আনার উৎপন্ন করি, যার ফলসমূহ পরস্পরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, আবার প্রতিটি পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যেরও অধিকারী। (হে মানুষ! তোমরা) লক্ষ্য করো এ ফলগুলোর দিকে, যখন সেগুলো ফলবান হয় এবং যখন তা পাকে। নিশ্চয় মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্যে এগুলোর মধ্যে রয়েছে (আল্লাহর কুদরতের) নিদর্শনাবলি।
(100) আর তারা (মুশরিকরা) জিনকে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে; অথচ তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।(১) আর তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর জন্যে পুত্র ও কন্যা সন্তান নির্ধারণ করেছে। অথচ তিনি পবিত্র, মহিমান্বিত এবং তারা তাকে যে গুণে গুণান্বিত করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।
(101) তিনিই (পূর্ব নমুনা ছাড়াই) আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা। কীভাবে তাঁর সন্তান হবে; অথচ তাঁর কোন স্ত্রী নেই! আর তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্বন্ধে তিনি সবিশেষ অবগত।
(102) তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদাত করো। আর তিনি সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক।
(103) দৃষ্টিসমূহ তাঁকে আয়ত্ত করতে পারে না; অথচ তিনি সকল দৃষ্টিকে আয়ত্তে রাখেন। আর তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।
(104) (হে মানুষ!) নিশ্চয় তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে চাক্ষুষ প্রমাণাদি এসেছে। অতএব যে চক্ষুষ্মান (যে তা বুঝেছে ও বিশ্বাস করেছে), সে নিজের জন্যেই কল্যাণ সাধন করবে। আর যে অন্ধ সাজবে (না বুঝে ও বিশ্বাস না করে), সে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে বলো:) আমি তোমাদের ওপর সংরক্ষক (পাহারাদার) নই।
(105) আর এভাবেই আমি (আল্লাহ আমার কুদরত বিষয়ক) নিদর্শনসমূহ নানাভাবে বিস্তারিত বর্ণনা করি, যাতে তারা (মুশরিকরা) বলে: তুমি পাঠ করেছ(১)। আর আমি যাতে এটাকে (কুরআনকে) সুস্পষ্টভাবে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য বর্ণনা করি।
(106) (হে রাসূল!) তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অহী প্রেরণ করা হয়েছে, তুমি তার অনুসরণ করো। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। আর মুশরিকদের উপেক্ষা করে চলো।
(107) আর যদি আল্লাহ চাইতেন, তারা শিরক করতো না। (হে রাসূল!) আমি তোমাকে তাদের ওপর রক্ষক নিযুক্ত করিনি এবং তুমি তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক নও।(১)
(108) আর (হে মু’মিনগণ!) তারা (মুশরিকরা) আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে (মূর্তিগুলোকে) ডাকে, তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না। ফলে তারাও অজ্ঞতাবশত সীমালঙ্ঘন করে, আল্লাহকে গালমন্দ করবে। এভাবেই আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য তাদের কর্ম শোভিত করে দিয়েছি। তারপর তাদের রবের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দিবেন।
(109) আর তারা (মুশরিকরা) আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে বলে: তাদের কাছে যদি (তাদের প্রস্তাবিত) কোন নিদর্শন আসত, তবে তারা অবশ্যই তার ওপর ঈমান আনত। (হে রাসূল! তুমি তাদেরকে) বলো: ‘নিদর্শন তো আল্লাহর কাছেই।’ আর (হে মু’মিনরা!) তোমাদের কীভাবে বুঝানো যাবে যে, তা (তাদের প্রস্তাবিত নিদর্শন) এলেও তারা ঈমান আনবে না!
(110) আর আমি তাদের অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ উল্টিয়ে দিবো, যেমন তারা আলকুরআনের প্রতি প্রথমবারে ঈমান আনেনি। আর আমি তাদেরকে তাদের বাড়াবাড়ি করার মধ্যে বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ছেড়ে দিবো।
(111) আর যদি আমি (তাদের প্রস্তাবিত বিষয়াদি উপস্থাপন করে) তাদের নিকট ফিরিশতা নাযিল করতাম এবং মৃতরা তাদের সাথে কথা বলত (যারা তোমার আনীত কিতাবের সত্যতার ব্যাপারে সংবাদ দিতো) আর তাদের সামনে (তাদের প্রস্তাবিত) সবকিছু এনেও যদি হাজির করতাম, তবুও তারা ঈমান আনতো না, তবে আল্লাহ চাইলে ভিন্ন কথা। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মূর্খ।
(112) আর (হে মুহাম্মদ! তোমাকে যেভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছি) এভাবেই আমি মানবজাতি ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু বানিয়ে দিয়েছি। তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে মুখরোচক কথা বলে। যদি তোমার রব ইচ্ছে করতেন তবে তারা এসব করত না(১)। কাজেই তুমি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যা রটনাকে পরিহার করো।
(113) আর তারা এ উদ্দেশ্যে পরস্পরকে কুমন্ত্রণা দেয় যে, পরকালে অবিশ্বাসীদের অন্তরগুলো যেন সে চমকপ্রদ কথার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা সন্তুষ্ট হয়। আর তারা যে অপকর্ম করে, তাতে যেন তারা নিমজ্জিত থাকে।
(114) (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে বলে দাও) আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিচারক হিসেবে মেনে নিবো? অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি প্রত্যেক জিনিসের পরিপূর্ণ বর্ণনাকারী হিসেবে কিতাব (আল-কুরআন) নাযিল করেছেন। আর (ইয়াহূদী ও খ্রীস্টান) যাদেরকে আমি কিতাব (তাওরাত ও ইঞ্জীল) দিয়েছিলাম তারা জানত যে, তা (আল-কুরআন) তোমার রবের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে নাযিলকৃত। সুতরাং তুমি কখনো সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
(115) আর সত্য ও ইনসাফের দিক দিয়ে তোমার রবের বাণী (আল-কুরআন) পরিপূর্ণ। তাঁর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(116) আর (হে মুহাম্মদ!) তুমি যদি বিশ্বের অধিকাংশ লোকের কথামতো চলো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা শুধু ধারণারই অনুসরণ করে এবং তারা নিছক আন্দাজ-অনুমান করে ।
(117) নিশ্চয় তোমার রব ভালো করেই জানেন কারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং তিনি হিদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত ।
(118) সুতরাং (হে মানুষ!) তোমরা আহার করো তা (সে প্রাণী) থেকে, যা আল্লাহর নামে যবহ করা হয়েছে; যদি তোমরা তাঁর আয়াতসমূহের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো।
(119) আর (হে মু’মিনগণ!) তোমাদের কী হয়েছে, (যবহকালে ) যার ওপর আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে, তোমরা তা থেকে খাবে না?অথচ তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা তোমাদের ওপর হারাম করেছেন। তবে তোমরা নিরুপায় হলে তা ভিন্ন কথা।(১) নিশ্চয় অনেকে অজ্ঞতাবশত তাদের খেয়াল-খুশি দ্বারা অন্যকে পথভ্রষ্ট করে। নিশ্চয় তোমার রব সীমালঙ্ঘনকারীদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত।
(120) আর তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন (সকল) পাপ পরিত্যাগ করো। নিশ্চয় যারা পাপ কামাই করে, অচিরেই তাদেরকে তাদের পাপের শাস্তি দেওয়া হবে।
(121) আর যে পশুতে (যবহের সময়) আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তার কিছুই তোমারা খেও না। কারণ তা গর্হিত কাজ (অপকর্ম)। নিশ্চয়ই শয়তানরা (মৃত পশুর গোস্ত খাওয়ার বিষয়ে) তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়। আর যদি তোমারা (মৃত পশুর গোস্ত খাওয়াকে হালাল মনে করে) তাদের অনুগত্য করো, তবে তোমারা অবশ্যই মুশরিক।
(122) যে ব্যক্তি (হিদায়াতের পূর্বে কুফরি, মূর্খতা ও গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে) মৃত ছিল, অতঃপর আমি (আল্লাহ) তাকে (ঈমান, জ্ঞান ও আনুগত্যের প্রতি হিদায়াতের মাধ্যমে) জীবিত করেছি এবং তাকে মানুষের মধ্যে চলার জন্য আলো দিয়েছি, সে কি তার মত, যে ব্যক্তি (কুফরি, মূর্খতা ও গুনাহে নিমজ্জিত হয়ে) ঘোর অন্ধকারে রয়েছে, যেখান থেকে সে বের হতে পারে না?(১) এভাবেই কাফিরদের জন্য তাদের কৃতকর্ম সুশোভিত করা হয়েছে (যাতে তাদেরকে কিয়ামতের দিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির প্রতিদান দেওয়া যায়)।
(123) আর (১) এভাবেই আমি প্রত্যেক জনপদে সেখানকার অপরাধীদের প্রধানকে সেখানে (রাসূলগণ ও তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে) চক্রান্ত করতে দিয়েছি। কিন্তু তারা শুধু তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই চক্রান্ত করে; অথচ তারা তা বুঝতে পারে না।
(124) আর যখনই তাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে তখন তারা বলে: ‘আল্লাহর রাসূলগণকে যা দেয়া হয়েছিল আমাদেরকেও তা দেওয়া না হলে, আমরা কখনোই ঈমান আনবো না।’ আল্লাহই ভালো জানেন, তিনি তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব কার ওপর অর্পণ করবেন। যারা অপরাধ করেছে, তাদের চক্রান্তের কারণে অচিরেই তারা আল্লাহর কাছে লাঞ্ছনা ও কঠোর শাস্তিতে নিপতিত হবে।
(125) সুতরাং আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দান করতে চাইলে, তিনি তার বক্ষকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। অন্যদিকে কাউকে বিপথগামী করতে চাইলে, তিনি তার বক্ষকে অতিশয় সংকীর্ণ করে দেন। তখন (তার কাছে ইসলামে প্রবেশ করাটা) মনে হয়, সে কষ্ট করে আকাশে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে(১)। যারা ঈমান আনে না, আল্লাহ এভাবেই তাদেরকে শাস্তি দেন।
(126) আর (হে রাসূল!) এটাই তোমার রবের নির্দেশিত সরল পথ। যারা উপদেশ গ্রহণ করে, আমি তাদের জন্য (আমার) আয়াতসমূহ ( নিদর্শনসমূহ) বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।
(127) তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট শান্তির আবাস। আর তাদের নেক আমলের প্রতিদান স্বরূপ তিনিই (আল্লাহই) হবেন, তাদের অভিভাবক।
(128) আর যেদিন তিনি তাদের সবাইকে একত্র করবেন এবং বলবেন: ‘হে জিন সম্প্রদায়! তোমরা তো অনেক লোককে পথভ্রষ্ট করেছিলে।’ তখন তাদের অনুসারী মানুষরা বলবে: ’হে আমাদের রব! আমরা একে অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি(১) এবং আমরা সে সময়ে উপনীত হয়েছি, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’ আল্লাহ বলবেন: ‘আগুনই তোমাদের বাসস্থান, তোমরা সেখানে স্থায়ী হবে, তবে আল্লাহ অন্য কিছু চাইলে সেটা ভিন্ন কথা।(২) নিশ্চয় তোমার রব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।’
(129) আর এভাবেই আমি যালিমদের একদলকে তাদের কৃতকর্মের কারণে আরেক দলের বন্ধু বানিয়ে দেই।
(130) ( কিয়ামত দিবসে আল্লাহ বলবেন:) হে জিন ও মানবজাতি, তোমাদের মধ্য থেকে কি তোমাদের নিকট রাসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করত এবং তোমাদের (কিয়ামতের) এই দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করত?’ তারা বলবে: (হ্যাঁ, তারা এসেছিলেন) ‘আজ আমরা আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছি, (আমরা অপরাধ করেছি )।’ আর দুনিয়ার জীবন (সৌন্দর্য, সাজ-সজ্জা ও অস্থায়ী নি‘আমত) তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে। আর তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে যে, তারা ছিল কাফির।
(131) এটা (মানুষ ও জিনদের নিকট রাসূল পাঠানোর যৌক্তিকতা) এ জন্যে যে, কোনো জনপদের অধিবাসীরা (সত্য সম্পর্কে) গাফিল থাকা অবস্থায় তাদের যুলমের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া তোমার রবের কাজ নয়।
(132) আর প্রত্যেকের আমল অনুযায়ী তার মর্যাদা (-র বিভিন্ন স্তর) নির্ধারিত হবে(১) এবং তারা যে আমল করে, সে সম্বন্ধে তোমার রব গাফিল নন।
(133) আর তোমার রব অমুখাপেক্ষী, দয়ালু। তিনি ইচ্ছে করলে, তোমাদেরকে সরিয়ে নিবেন এবং তোমাদের পরে যাকে ইচ্ছে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন, যেমন তিনি তোমাদেরকে (তোমাদের পূর্ববর্তী) অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধারা থেকে সৃষ্টি করেছেন।
(134) ( হে কাফিররা!) নিশ্চয় তোমাদেরকে (পুনরুত্থান, হাশর, হিসাব ইত্যাদির) যে ওয়াদা দেয়া হচ্ছে, তা অবশ্যই আসবে এবং (এ সব বিষয়ে তাঁকে) তোমরা অক্ষম করতে পারবে না।
(135) (হে রাসূল!) বলো: ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদের অবস্থানে (কুফরি ও ভ্রষ্টতার উপর অবিচল) থেকে কাজ করো, নিশ্চয় আমিও কাজ করছি। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে, কার পরিণাম হবে কল্যাণময়।(১) নিশ্চয়ই যালিমরা কিছুতেই সফল হবে না।’
(136) আর আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তারা (মুশরিকরা) আল্লাহর জন্য একটি অংশ নির্দিষ্ট করে এবং তাদের ধারণা অনুযায়ী বলে: ‘এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের শরিকদের (দেবতাদের) জন্য।’ অতঃপর যা তাদের শরিকদের (দেবতাদের) অংশ, তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না; অথচ আল্লাহর অংশ তাদের শরিকদের (দেবতাদের) কাছে পৌঁছায়।(১) তাদের ফয়সালা কতই না নিকৃষ্ট!
(137) (শয়তান এ বেইনসাফি ফায়সালাকে মুশরিকদের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে) আর এভাবে তাদের শরিক শয়তানরা বহু মুশরিকদের নিকট (দরিদ্রতার ভয়ে) তাদের সন্তানদের হত্যাকে সুশোভিত করেছে , তাদের ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এবং তাদের দীন সম্বন্ধে তাদের বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যে। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে, তারা এসব করতে পারতো না। কাজেই (হে রাসূল!) তাদেরকে তাদের মিথ্যা রটনা নিয়েই থাকতে দাও।
(138) আর তারা তাদের ভ্রান্ত ধারণা অনুযায়ী বলে: ‘এসব গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত্র (সর্বসাধারণের জন্য) নিষিদ্ধ(১); আমরা যাকে চাইবো সে ছাড়া কেউ এসব খেতে পারবে না।’ তাছাড়া কিছু সংখ্যক গবাদি পশুর পিঠে আরোহণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে(২) এবং কিছু সংখ্যক গবাদি পশু যবহ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয় না(৩)। তাদের এসব বিধি নিষেধ মূলত আল্লাহর ওপর ডাহা মিথ্যা রটনা। তিনি অবশ্যই তাদেরকে তাদের এ মিথ্যা রটনার শাস্তি অচিরেই প্রদান করবেন।
(139) তারা আরো বলে: ‘এ চতুষ্পদ জন্তুগুলোর (বাহীরাহ ও সায়িবাহর) পেটে যা আছে, তা আমাদের পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট এবং এটা আমাদের স্ত্রীদের জন্য হারাম। কিন্তু সেটা যদি মৃত হয়, তবে (নারী-পুরুষ) সবাই এতে অংশীদার।’ অচিরেই তিনি তাদেরকে তাদের এরূপ বিধিনিষেধ আরোপের শাস্তি প্রদান করবেন। নিশ্চয় তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।
(140) অবশ্যই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতাবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করেছে এবং আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটনা করে আল্লাহর দেয়া রিযক (পশুগুলোকে) হারাম করেছে। তারা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা কখনোই হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না।
(141) আর তিনি সেই মহান সত্তা, যিনি (এ পৃথিবীতে) সৃষ্টি করেছেন (কাণ্ডহীন ও কাণ্ডবিশিষ্ট) এমন বাগানসমূহ, যার কিছু মাচায় তোলা হয়, আর কিছু তোলা হয় না(১) এবং খেজুর গাছ ও বিভিন্ন আকৃতি ও স্বাদের ফসল, আর যায়তুন ও আনার, এগুলো (পাতাসমূহ দেখতে) একটি অন্যটির মত, তবে (স্বাদ) ভিন্ন ভিন্ন রকমের। যখন ওগুলো ফলবান হবে, তখন সেগুলোর ফল খাবে এবং ফসল তোলার দিন সে সবের হক (যাকাত) প্রদান করবে। আর তোমরা (খাবার গ্রহণ এবং সম্পদ খরচের ক্ষেত্রে শরী‘আতের) সীমারেখা অতিক্রম করো না। কারণ আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালোবাসেন না।(২)
(142) আর তিনি গবাদি পশুর মধ্যে কিছু ভারবাহী ও কিছু ছোট পশু সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ যা রিযক হিসেবে (হালাল প্রাণিগুলো) তোমাদেরকে দিয়েছেন, তা থেকে খাও এবং (আল্লাহর হারামকৃত বস্তু হালাল করে বা হালালকৃত বস্তু হারাম করে) শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শক্র।
(143) তিনি (তোমাদের জন্য) আট প্রকারের পশু সৃষ্টি করেছেন(১), মেষের দুটি (একটি নর ও একটি মাদী) ও ছাগলের দুটি (একটি নর ও একটি মাদী)। (হে রাসূল! মুশরিকদেরকে) তুমি বলো: ‘নর দুটিই কি তিনি (নর হওয়ার কারণে) হারাম করেছেন কিংবা মাদি দুটিই (মাদি হওয়ার কারণে) অথবা মাদি দুটির গর্ভে যা আছে, তা হারাম করেছেন (শুধু তা গর্ভে থাকার কারণে)? (হে মুশরিকরা!) তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণসহ আমাকে অবহিত করো।
(144) আর (আট প্রকারের বাকিগুলো হলো) উট থেকে দু’টি (একটি নর ও একটি মাদী)ও গাভি থেকে দু’টি (একটি নর ও একটি মাদী)। (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে) বলো: ‘নর দুটিই কি তিনি (নর হওয়ার কারণে) হারাম করেছেন কিংবা মাদি দুটিই (মাদি হওয়ার কারণে) অথবা মাদি দুটির গর্ভে যা আছে, তা (গর্ভে থাকার কারণে কি ) তিনি হারাম করেছেন? নাকি আল্লাহ যখন তোমাদেরকে এসব (হারাম করার) নির্দেশ দান করেছেন তখন তোমরা উপস্থিত ছিলে?’ কাজেই যে ব্যক্তি না জেনে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।
(145) (হে রাসূল! তুমি) বলো: ‘আমার প্রতি যে অহী নাযিল হয়েছে তাতে, লোকে যা খায় তার মধ্যে আমি মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের মাংস ছাড়া আর কিছু হারাম পাই না। কেননা এগুলো অবশ্যই অপবিত্র অথবা এমন অবৈধ, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো (যেমন: বিভিন্ন দেবতার) জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে।’ তবে যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘন না করে তা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে ( তাতে কোন গুনাহ নেই)। কারণ নিশ্চয় তোমার রব পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।
(146) আর আমি ইয়াহূদীদের জন্য সমস্ত নখরধারী(১) (প্রাণী) হারাম করেছিলাম এবং গরু ও ছাগলের চর্বিও তাদের জন্য হারাম করেছিলাম; তবে এগুলোর পিঠের অথবা অন্ত্রের (নাড়িভুঁড়ির) কিংবা হাড়ের সাথে লেগে থাকা চর্বি ছাড়া। তাদের অবাধ্যতার জন্য আমি তাদেরকে এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আর নিশ্চয় আমি (এ সকল বক্তব্যে) সত্যবাদী।
(147) অতঃপর (হে রাসূল!) তারা যদি তোমার ওপর মিথ্যারোপ করে, তবে তাদেরকে বলো, ‘তোমাদের রব প্রশস্ত অনুগ্রহের মালিক। আর তাঁর শাস্তি অপরাধী সম্প্রদায়ের ওপর থেকে ফেরানো হয় না।’
(148) অচিরেই মুশরিকরা (নিজেদের শিরকী কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতা প্রমাণে আল্লাহর ইচ্ছা ও তাকদীরের দোহাই দিয়ে) বলবে: ‘আল্লাহ যদি চাইতেন, আমরা ও আমাদের পিতৃপুরুষরা শিরক করতাম না এবং আমরা কোন কিছু হারাম করতাম না।’ এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যারোপ করেছে, যে পর্যন্ত না তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে। (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে) বলো: ‘তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে?(১) তোমরা তো শুধু কল্পনারই অনুসরণ করো এবং শুধু মনগড়া কথা বলো।'
(149) (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে) বলো: ‘চূড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই। সুতরাং তিনি যদি ইচ্ছে করতেন, তবে তোমাদের সবাইকে অবশ্যই হিদায়াত দান করতেন।’
(150) (হে রাসূল! তুমি এসব মুশরিকদেরকে) বলো: ‘আল্লাহ যে এটা হারাম করেছেন, এ ব্যাপারে যারা সাক্ষ্য দিবে, তাদেরকে হাজির করো।(১) তারা সাক্ষ্য দিলেও, তুমি তাদের সাথে সাক্ষ্য দিবে না।(২) আর তুমি তাদের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং আখিরাতে ঈমান রাখে না। আর তারাই তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করায়।’
(151) (হে রাসূল! তুমি মানুষদেরকে) বলো: ‘এসো তোমাদের রব তোমাদের ওপর যা হারাম করেছেন, আমি তা তোমাদেরকে তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছি। সেগুলো হচ্ছে : ‘তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবে না, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্রের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিযক দিয়ে থাকি। প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে, অশ্লীল কাজের ধারে-কাছেও যাবে না। আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, (শরী‘আহ অনুমোদিত) যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না।’ তিনি তোমাদেরকে এ আদেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা (তাঁর আদেশ-নিষেধগুলো সহজেই) বুঝতে পারো।
(152) (তিনি আরো হারাম করেছেন যে:) ‘ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থা ছাড়া তোমরা তার(১) সম্পদের নিকটবর্তীও হয়ো না ।(২) আর পরিমাপ ও ওজনে ইনসাফের সাথে পরিপূর্ণ দাও। আমি কাউকে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি দায়িত্বভার অর্পণ করি না। আর যখন তোমরা কথা বলবে (সাক্ষ্য দিবে), তখন ন্যায্য কথা বলবে; যদিও তা আত্মীয়-স্বজনের বিপক্ষে হয় এবং আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করো। (উল্লিখিত) এ বিষয়গুলোর নির্দেশ তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’
(153) আর এ পথই আমার সরল সঠিক পথ। কাজেই তোমরা এর অনুসরণ করো এবং (ভ্রষ্টতার) বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে।(১) এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে (সত্য ও সঠিক পথের অনুসরণ করতে) নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা (তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে) তাঁকে ভয় করতে পারো।
(154) অতঃপর আমি মূসাকে প্রদান করেছি কিতাব (তাওরাত), যা ছিল সৎকর্মপরায়ণদের জন্যে (নি‘আমতের ) পরিপূর্ণতা, সবকিছুর বিশদ বিবরণ, হিদায়াত এবং রহমতস্বরূপ, যাতে তারা তাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে ঈমান রাখে।
(155) আর এটি কিতাব (আল-কুরআন), যা আমি অতি বরকতময় করে নাযিল করেছি। কাজেই তোমরা তার অনুসরণ করো এবং (এর বিরোধিতার ব্যাপারে) তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।
(156) (হে আরবের মুশরিকরা!) যেন তোমরা এ কথা বলতে না পারো যে, ‘কিতাব তো শুধু আমাদের পূর্বে দুটি সম্প্রদায়ের (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের) প্রতিই নাযিল হয়েছিল; অথচ আমরা তাদের কিতাবগুলো পাঠ করতে কিছুতেই সক্ষম নই।’(১)
(157) যাতে তোমরা এ কথাও বলতে না পারো যে, ‘যদি আমাদের প্রতি কিতাব নাযিল হত, তবে আমরা তো তাদের (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের) চেয়ে বেশি হিদায়াত প্রাপ্ত হতাম।’ এখন তো তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ, হিদায়াত ও রহমত এসেছে।(১) অতঃপর যে আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? যারা আমার আয়াতসমূহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের বিমুখ হওয়ার কারণে, অচিরেই আমি তাদেরকে (জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করিয়ে) নিকৃষ্ট শাস্তি দিবো।
(158) (ঈমান আনার জন্য) তারা (আল্লাহর আয়াতগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারীরা) শুধু এরই তো প্রতীক্ষা করে যে, তাদের কাছে ( আসমান থেকে) ফিরিশতা আসবে, কিংবা তোমার রব (নিজেই) আসবেন, কিংবা (কিয়ামতের আলামতস্বরূপ) তোমার রবের কোনো নিদর্শন আসবে? যেদিন তোমার রবের কোন নিদর্শন আসবে (যেমন: সূর্যাস্তের দিক থেকে সূর্য উঠা) সেদিন তার ঈমান কোনো কাজে আসবে না, যে পূর্বে ঈমান আনেনি অথবা যে ব্যক্তি ঈমানের মাধ্যমে ইতঃপূর্বে কল্যাণ লাভ করেনি। (হে রাসূল! তুমি মিথ্যা প্রতিপন্নকারী মুশরিকদেরকে) বলো: ‘তোমরা প্রতীক্ষা করো , আমরাও প্রতীক্ষায় রইলাম।’
(159) নিশ্চয় যারা (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা) তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নেই। তাদের ফয়সালার দায়িত্ব তো আল্লাহর ওপর। অতঃপর তিনি তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করবেন।
(160) (কিয়ামতের দিন) যে মু’মিন কোন সৎকাজ নিয়ে আসবে, তার জন্য রয়েছে দশ গুণ প্রতিদান। আর যে অসৎ কাজ নিয়ে আসবে, তাকে সমপরিমাণই শাস্তি দেয়া হবে এবং তাদেরকে (নেকি কমিয়ে বা পাপের শাস্তি বাড়িয়ে) কোন যুলম করা হবে না।
(161) (হে রাসূল! তুমি মিথ্যারোপকারী এ মুশরিকদেরকে) বলো: ‘নিশ্চয় আমার রব আমাকে সরল সঠিক পথের হিদায়াত দিয়েছেন। তা সুপ্রতিষ্ঠিত দীন, ইবরাহীমের একনিষ্ঠ আদর্শ, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।’
(162) (হে রাসূল!) বলো: ‘নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ (সবকিছুই) বিশ্বজগতের রব আল্লাহরই জন্য।’
(163) ’তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং (এ উম্মতের মধ্যে) আমিই সর্বপ্রথম তাঁর সামনে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।’
(164) (হে রাসূল! তুমি মুশরিকদেরকে) বলো: ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন রব অনুসন্ধান করব? অথচ তিনিই সব কিছুর রব।’ আর প্রত্যেকে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না। অতঃপর (কিয়ামতের দিন) তোমাদেরকে তোমাদের রবের নিকটই ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যেসব বিষয়ে তোমরা (দুনিয়াতে) মতবিরোধ করেছিলে।
(165) আর তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীর প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, সে বিষয়ে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তোমাদের কিছু লোককে অন্যের উপর উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। নিশ্চয় তোমার রব (অপরাধীদের) দ্রুত শাস্তি প্রদানকারী এবং নিশ্চয় তিনি (তাওবাকারী বান্দার প্রতি) পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।